You dont have javascript enabled! Please enable it! বাংলাদেশ সম্পর্কে বিবিসি প্রচারিত অনুষ্ঠানমালাঃ সাম্প্রতিক ঘটনাবলী, বিবিসি, লন্ডন, ২৬ মার্চ- ১ ডিসেম্বর, ১৯৭১ - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশ সম্পর্কে বিবিসি প্রচারিত অনুষ্ঠানমালাঃ সাম্প্রতিক ঘটনাবলী, বিবিসি, লন্ডন, ২৬ মার্চ- ১ ডিসেম্বর, ১৯৭১

সাম্প্রতিক বিষয়ে আলোচনাঃ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এর বক্তব্য
সম্প্রচারেঃ মার্ক টালি
২৬ মার্চ, ১৯৭১

দুইদিন আগেও ঢাকায় যে আলোচনা চলছিল তা ফলপ্রসু হবে বলে ধারনা করা হচ্ছিল। কিন্তু, সেদিন সন্ধ্যার মধ্যেই হঠাত এ আলোচনা ভেস্তে যাওয়া, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার করাচি গমন এবং কঠোর মার্শাল আইন জারি হওয়া স্পষ্টতই হতাশাব্যাঞ্জক। শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন বলে খবর পাওয়া গেছে জানিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে যে ভাষন দিয়েছেন, তাতে এখন পরিস্থিতি কতটা গুরুতর তা বোঝা যাচ্ছে।

বেশ আক্রমণাত্মক ভাষায়, বক্তব্যের শুরুতেই মিঃ প্রেসিডেন্ট রাজনৈতিক নেতাদের সাথে সমঝোতায় আসার লক্ষ্যে তার গৃহীত উদ্যোগগুলোর বিবরন দেন। এরপর তিনি বলেন, অবশেষে তিনি বুঝতে পারলেন যে শেখ মুজিবর রহমান যেসকল প্রস্তাব দিচ্ছিলেন, তা কেবল বিশৃঙ্খলারই সৃষ্টি করবে। তিনি বলেন, শেখ মুজিব অসহোযোগ আন্দোলনের ঘোষণা ও তার পরিচালনার মাধ্যমে দেশদ্রোহিতা করেছেন, তিনি পাকিস্তানের পতাকা ও জাতির জনকের প্রতিকৃতিকে অসম্মান করেছেন, তিনি দেশে ত্রাশ, অরাজকতা ও অনিরাপদ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন। একি সাথে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে বসবাস স্থাপনকারী পশ্চিম পাকিস্তানি নাগরিকদেরকেও বিপন্ন অবস্থায় ফেলেছেন। এধরনের অপমানকে ক্ষমাসূচক দৃষ্টিতে দেখার জন্য প্রেসিডেন্ট তার ভাষণে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের অভিবাদন জানান।
প্রেসিডেন্ট আরো বলেন যে তিনি শেখের বিরুদ্ধে আরো আগেই ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারতেন, কিন্তু তিনি চাননি যে সংলাপে কোন ধরনের বিভ্রান্তি থাকুক। তিনি বলেন যে, আওয়ামী লীগ দলটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তিনি আরো জানান যে, শীঘ্রই তিনি আরো কিছু সামরিক আইন ব্যবস্থার ঘোষণা দিবেন।

ভবিষ্যতের কথা বলতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট বলেন, তিনি এখনও জনগনের মনোনীত প্রার্থীর হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যত দ্রুত সম্ভব, তিনি এর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার ঘোষণা দিবেন। সুতরাং, এ মুহূর্তে, পূর্ব পাকিস্তানের সর্বাধিক সমর্থিত দল, একটি বাদে যারা পূর্ব পাকিস্তানের সকল আসনে জয়লাভ করে জাতীয় পরিষদে বিজয়ী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল, তাদের নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট তার বক্তব্যে স্পষ্টভাবেই এই সংকটময় পরিস্থিতির জন্য মুজিব ও তার সমর্থকদের দোষারোপ করেছেন।

কেউ জানে না, পূর্ব পাকিস্তানে ঠিক কত সংখ্যক সৈন্য দল অবস্থান করছে, তবে তাদের সংখ্যা যতই হোক না কেন, যে কঠিন পরিস্থিতির মোকাবেলা সেখানে তাদের করতে হবে তাকে খাটো করে দেখার কোন সুযোগ নেই; বিশেষ করে শহরের বাইরের এলাকাগুলোতে যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবি সঙ্গীন। কিছুদিন আগের হাইজ্যাকিং এর ঘটনার পর, ভারত দেশটির দুই প্রদেশে যাতায়াতের জন্য তাদের আকাশ সীমা ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দেয়াতে সেনাদের সমস্যা আরো বেড়ে গিয়েছে। খুব সম্ভবত সৈন্যরা মুলত শহরগুলোতেই কার্যক্রম চালাবে। তবে যতই কঠোর ভাষায় ভাশন দিন না কেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পশ্চিম পাকিস্তানেও সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন, কেননা এ অঞ্চলও এখনও পর্যন্ত সামরিক আইনের আওতাধীন। মিঃ ভুট্টোর পিপলস পার্টি, পাঞ্জাবের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রদেশে যারা অত্যন্ত প্রভাবশালী, ইতিমধ্যেই অসহিষ্ণুতার জানান দিয়েছে এবং তাদেরো সকল রাজনৈতিক কর্মকান্ডের উপর সাধারন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। শুরু থেকেই মিঃ ভুট্টো বিনাশর্তে শেখ মুজিবের দাবী মেনে নেয়ার বিরোধিতা করে এসেছেন। পশ্চিম অংশে তার দল সর্বাধিক আসনে বিজয়ী হওয়ায় যেখানে তিনি তার দলকে ক্ষমতা হস্তান্তর করার দাবী জানিয়ে আসছেন সেখানে তিনি কোনভাবেই সামরিক আইনের শাসন আরো দীর্ঘায়িত হওয়াকে সুনজরে দেখবেন না।

প্রেসিডেন্ট এর এই ভাষণের মাধ্যমে সুস্পষটভাবেই আপাতত পাকিস্তানে পরীক্ষামুলকভাবে গনতন্ত্র চালু করার প্রক্রিয়া রহিত করা হল। তিনি অঙ্গীকার করেন যে তিনি এখনও ক্ষমতা হস্তান্তর করতে ইচ্ছুক, কিন্তু এ মুহূর্তে এ বিষয়ে পরবর্তী কোন ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এ মুহূর্তে সামরিক আইন আরো কিছুদিন বহাল রাখা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। যদিও এই সামরিক আইন কতখানি সফল হবে তাও অনিশ্চিত।

সাম্প্রতিক বিষয়ে আলোচনাঃ পাকিস্তানের ভবিশ্যতঃ
২রা এপ্রিল, ১৯৭১
সম্প্রচারেঃ মারটিন এডিনি

ধারাবাহিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানে চলমান সহিংসতার খবর আসছে। মাত্র এক সপ্তাহেরও কম সময় পূর্বে লন্ডন ভিত্তিক ‘গারডিয়ান” পত্রিকার পক্ষ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় অবস্থান করছিলেন মারটিন এডিনি। তার মন্তব্য এখানে উল্লেখ করা হলঃ

এক সপ্তাহ আগে আমি এবং আমার অন্যান্য সহকর্মী সাংবাদিকবৃন্দ দেখেছি কিভাবে পাকিস্তানি আর্মি পূর্ব বাংলার শহরগুলো এবং শেখ মুজিবের দল আওয়ামীলীগের সমর্থকদের উপর ভয়াবহ সেনা হামলা চালিয়েছে। জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে বিজয়ী দল আওয়ামীলীগ এক অপ্রত্যাশিত কঠোর প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়েছে। সরকার পরিচালিত ও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত পাকিস্তান রেডিও নাগরিকদের উদ্দ্যেশ্যে একটি সর্তকবানী প্রচার করেছে যে, তারা যেন ব্যারিকেড দিয়ে এই দুর্বৃত্ত বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর অভিযানে কোন ধরনের বাধা সৃষ্টি না করে। এর মধ্যে যেসকল পশ্চিমা সাংবাদিকগন ভারত সীমান্ত থেকে ২৫ মাইল দূরে অবস্থিত যশোরে যেতে পেরেছেন, তারা বলছেন সেখানে আর্মিদের ক্যান্টনমেন্ট থেকে উৎখাত করা হয়েছে, শহর সম্পূর্ণভাবে সাধারন মানুষের দখলে। যদিও সেনাদের পরাজিত হবার কোন খবর এপর্যন্ত শোনা যায়নি।

আমি এবং অন্যান্য সাংবাদিকরা যা দেখেছি, তাতে মনে হয়েছে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, শেখ মুজিব ও মিঃ ভুট্টোর মধ্যে চলমান সাংবিধানিক সংলাপ ভেঙ্গে যাওয়ার মাত্র ছয় ঘন্টা পর চালানো এই সামরিক অভিযানের মুল লক্ষ্য অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় ও পরিকল্পিত ভাবে স্থির করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শেলিং এর ফলে সুশীল নাগরিকদের মধ্যে প্রবল ভিতীর সঞ্চার, বস্তি এলাকাগুলোতে অগ্নিসংযোগ, রাস্তায় এলোপাথারি মেশিনগানের গুলিবর্ষণ, সেই সাথে এ প্রদেশের মুল রাজনৈতিক নেতা ও আদর্শের গ্রেফতারের ঘটনায় রাজধানী ঢাকায় যেন কবরের নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। গ্রামে ও শহরাঞ্চলে, সেনাঘাটিগুলোর নাগালের বাইরে মানুষ ধীরে ধীরে জোটবদ্ধ হচ্ছে বলে মনে হলেও, এই বিশাল সংখ্যক পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের তুলনায় তাদের শক্তি খুবি দুর্বল। আধুনিক সশস্ত্র এই সেনাবাহিনীকে তারা কতক্ষন তাদের এই সামান্য কিছু মাধান্তা আমলের অস্ত্র দিয়ে ঠেকাতে পারবে, সেটাও আরেকটি ভাবনার বিষয়। তবে আর কয়েক সপ্তাহ পরেই বরষা শুরু হয়ে যাবে, ফলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষে কিছু সুনির্দিষ্ট ঘাটি ছাড়া অন্যত্র নিয়ন্ত্রন বজায় রাখা অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে পড়বে।

শেখ মুজিবের ডাকা চার সপ্তাহের অসহোযোগ আন্দোলনের ফলে সেনাবাহিনী যে হেনস্থার স্বীকার হয়েছিল, নিঃসন্দেহে এই সহিংসতার মধ্যে দিয়ে তারা সেই হয়রানির শোধ তুলে নিয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান, এবং পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসনের প্রধান লেফটেন্যান্ট টিক্কা খান যদি এই প্রদেশের লোকদের শিক্ষা দেয়ার জন্য, তাদেরকে পুনরায় কেন্দ্রিয় সরকারের প্রতি অনুগত করে তোলার উদ্দেশ্যে এ হামলা চালিয়ে থাকেন, তবে সেটিকে কার্যকর করতে তাদের আরো নতুন নতুন এবং বন্ধুত্বপূর্ণ কৌশল অবলম্বন করতে হবে। এ প্রদেশে এখনও স্বাধীন বলে ঘোষিত হয়নি এবং সরকারকে অবশ্যই দেখাতে হবে যে তারা এটিকে একটি ভাল সম্ভাবনার সুচনা হিসেবে দেখছেন।

এই সবকিছুর মধ্যে, সবচেয়ে বেশি দুরবস্থার মধ্যে পরেছে অবাঙ্গালিরা, বিশেষ করে দেশভাগের পর ভারত ও বিহার থেকে এদেশে আসা দরিদ্র শরণার্থীগন। পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক না থাকলেও, অবাঙ্গালি হিসেবে চিনহিত হওয়ায় অসুরক্ষিত এই গোশঠির লোকরাই বেশিরভাগ পূর্বাঞ্চলের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।

পাকিস্তানের এই সামরিক অভিযানের বন্ধ করতে বিশ্বের সকল রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছে ভারত। অন্যদিকে পাকিস্তানও ভারতের বিরুদ্ধে সীমান্তের এপারে সশস্ত্র ভারতীয় সেনাদের অনুপ্রবেশ ও তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর অভিযোগ এনেছে। যদিও ভারত এসকল অভিযোগই অস্বীকার করছে।

১৯৬৫ এর যুদ্ধের পর থেকে দুই দেশের মধ্যেকার শত্রুতা মৌখিকভাবেই সীমাবদ্ধ থাকলেও, এখন তা চুরান্ত অবস্থায় পোউছেছে। দুই দেশের বাঙ্গালীদের জাতিগত সম্প্রীতি এই বৈরিতাকে আরো বৃদ্ধি করছে। শেখ মুজিবকে রাজনৈতিক ও বাস্তবিকভাবে ধ্বংস করে দেয়ার এ চক্রান্ত ভারতে তিক্ত হতাশার সৃষ্টি করেছে। ভারতের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য গৃহীত তার নীতিমালা এবং কাস্মীর বিষয়ে তার তুলনামুলক নির্লিপ্ত অবস্থান দুই দেশের মধ্যকার পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক করে তুলবে বলে আসা করেছিল ভারত। এখনও পর্যন্ত সত্যিকারের সসস্ত্র সংঘর্ষের কোন সম্ভাবনা না দেখা গেলেও, কোন পাকিস্তানি সেনাদলকে সীমান্ত পার করতে দেখা মাত্র গুলি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে। পূর্ব বাঙ্গালিরা একা অসহায় অবস্থাতেই রয়ে গেছে।

সাম্প্রতিক বিষয়ে আলোচনাঃ ভারত ও পাকিস্তানঃ
Distribution “A” DIPLOMATIC ESCALATION
তারিখঃ ২৬শে এপ্রিল, ১৯৭১
হিলারি হেন্সন

পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কের ক্রমাগত অবনতি আজ থেকে আরো চরম তিক্ত অবস্থা ধারন করতে যাচ্ছে। কারন, আজ ভারত আকস্মিকভাবে এক সিদ্ধান্তে জানিয়েছে যে, পাকিস্তানি কোন কুটনৈতিক ভারত সরকারের অনুমতি ছাড়া দেশ ত্যাগ করতে পারবে না। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ভারত ভিয়েনা কনভেনশনে গৃহীত কুটনৈতিকদের সঙ্গে আচরনের বিধিমালা লঙ্ঘন করছে।
পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি আর্মিদের চালানো হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্ক আরো বেশি টানাপোড়েনের মধ্যে পরে গেছে। এই কুটনৈতিক পর্যায়ের লড়াইটা শুরু হয়, এক সপ্তাহ আগে থেকেই, যখন কলকাতায় অবস্থিত পাকিস্তানের ডেপুটী হাই কমিশন অফিসের কিছু পূর্ব পাকিস্তানি কর্মকর্তা, মুক্তিযোদ্ধাদের ঘোষণাকৃত, বাংগালীদের জন্য স্বাধীন ও নতুন দেশ বাংলাদেশের প্রতি তাদের সমর্থন প্রদর্শন করে। পাকিস্তানি সরকার তাদের বদলে নতুন লোক পাঠানোর চেষ্টা করলেও, কিন্তু নতুন ব্যক্তি সেখানে পৌছাতে পারেননি। পশ্চিম বঙ্গের মানুষরাও তাকে বেশ তিক্ত অভ্যর্থনা জানিয়েছে। কমিশন যারা দখল করে রেখেছে, তদেরকে সরিয়ে দিতে কোন ধরনের কোন সাহায্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে ভারত। ভারত বলছে এটা সম্পূর্ণভাবে তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।

পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে পাকিস্তান জানিয়েছে যে যেহেতু ঠিকভাবে চলছে না, সুতরাং তারা কলকাতার মিশন অফিস বন্ধ করে দিবে, একি সাথে তারা দাবী করছে যে ভারতকেও অতি দ্রুত ঢাকায় অবস্থিত দুতাবাস অফিসটি বন্ধ করে দিতে হবে। আজ সকালে দুইটি অফিসই আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ ছিল। এর ফলে কলকাতা মিশনে অবস্থানকারী সকল পূর্ব পাকিস্তানিদের নাগরিকত্ব বাতিল করেছে পাকিস্তান সরকার। ভারত দাবী করছেন যে এই ব্যক্তিরা রাজনৈতিক শরণার্থী, ফলে তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করা বৈধ নয়।

স্পষ্টতই ভারত আশংকা করছে যে তারা সব বাঙালি দুতাবাসের কর্মীদের ফেরত না পাঠালে ঢাকা মিশনে তাদের যেসব কর্মকর্তা আছেন, পাকিস্তান তাদের জিম্মি করতে পারে। দিল্লীতে পাঠানো পাকিস্তান হাই কমিশনারের বার্তা বেশ হুমকিস্বরূপ বলেই মনে হচ্ছে, যেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন কুটনৈতিকদের সাথে আচরনবিধি, দুতাবাস ও সেখানের কাগজপত্রের নিরাপত্তার বিষয়ে লক্ষ্য রাখার কথা এবং আরো বেশ কিছু বিষয়, কিন্তু তিনি বেশ কঠোরভাবে বলেছেন যে এক্ষেত্রে ভারত যেরুপ আচরন করবে, পাকিস্তানও সেভাবেই আচরন করবে। ভারত ইতিমধ্যেই ঢাকা দুতাবাসের উপ প্রধান এর পত্নী মিসেস সেন গুপ্তার সাথে গত বুধবার করাচি এয়ারপোরটে যেধরনের বর্বর আচরন করা হয় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। তার বদলে অভিযোগনামার একটি কূটনৈতিক স্মারকলিপি ভারতও পেয়েছে। নিষেধাজ্ঞার সাথে সাথে ভারতীয়রা পাকিস্তানি কুটনৈতিকদের জিম্মি করার হুমকিও দিয়ে যাচ্ছে। কারন হিসেবে তারা বলেছে যে তাদের নিষেধাজ্ঞার ফলে এর মধ্যেই ভারতীয় কুটনৈতিকদের উপর নানাধরনের নিয়ম চাপানো হয়েছে, তাদের পাকিস্তান থেকে আসতেও দেয়া হচ্ছেনা। ভারত দাবী করছে যে, কুটনৈতিকদের ফেরত পাঠানোর বদলে তারাও পাকিস্তানিদের প্রতিহিংসার নীতি অনুসরন করছে।

সাম্প্রতিক ঘটনাবলীঃ বুদাপেস্ট শান্তি সম্মেলন ও বাংলাদেশঃ
১৩ই মে,১৯৭১
প্রতিবেদকঃ ডেভিড গ্রাহাম

আজ “বিশ্ব শান্তি সংস্থা” এর আয়োজিত কনফারেন্সে প্রায় ১২৪ টী দেশের ৭০০ জন প্রতিনিধি সমবেত হয়েছেন বুদাপেস্ট এ। পূর্ব পাকিস্তানের সংবাদ এই সম্মেলঙ্কে এক অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যায় ফেলে দিয়েছে। বিশ্ব শান্তি সংস্থার সেক্রেটারি জেনারেল মিঃ রমেশ চন্দ্র, যিনি এই শান্তি সম্মেলনের অন্যতম একজন আয়োজক, একি সাথে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বস্থানীয় একজন ব্যক্তিত্বও বটে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি বিশ্বের সকল কমিউনিস্ট পার্টির কাছে সংবাদ পাঠিয়েছে এবং তাদেরকে অনুরোধ করেছে যে তারা যেন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টিকে ও পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশ এর স্বাধীনতাকে সমর্থন করে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি একি সাথে মিঃ রমেশ চন্দ্রকে দায়িত্ব দিয়েছে যেন তিনি মস্কো, বুদাপেস্ট ও অন্যান্য যেখানে সম্ভব, সেখানে বাংলাদেশের জন্য সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন।

এই ৭০০ জন প্রতিনিধি যারা এই মুহূর্তে বুদাপেস্টে সমবেত হয়েছেন, তাদের জন্য এটিই একটি সমস্যার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে, কেননা, তারা এধরনের কিছু নিশ্চয়ই আসা করেননি, যখন তারা এখানে আসার আমন্ত্রন পেয়েছিলেন।

“আন্তর্জাতিক শান্তি সংস্থা” সোভিয়েত ফরেন পলিসির ক্ষেত্রে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হাতিয়ার। যখন জানুয়ারিতে ফিনল্যান্ডের হেলসিংকিতে মিঃ রমেশ এই সম্মেলনের এজেন্ডা বলেছিলেন, তখন মনে হয়েছিল এই এজেন্ডার মুল দিকগুলো হবে, ইউরোপের নিরাপত্তা সম্মেলন, ভিয়েতনামে ও মধ্য প্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা, আফ্রিকা নব্য-কলোনি তৈরির প্রচেষ্টাকে রুখে দেয়া, অস্ত্রের দমনের প্রতিবাদ ইত্যাদি। এসকল বিষয়ে এর আগেও প্রচুর বক্তব্য দেয়া হয়েছে, অনেক বিধিমালা পাশ করা হয়েছে, এবং যদি এর দ্বারা এ সমস্যাসমুহের সমাধান সম্ভব হত, তবে অনেক আগেই তা হয়ে যেত। কিন্তু, এই নাছোরবান্দা সিকিউরিটি জেনারেল মিঃ রমেশ চন্দ্র লাতিন আমেরিকায় ইতিমধ্যে ভ্রমন করে এসেছেন, যেন তারা বুদাপেস্টে অংশগ্রহন করে, ফেব্রুয়ারিতে তিনি কিউবা ও ভেনিজুয়েলাও ভ্রমন করেন। আজ সকালে যখন ঘোষণা দেয়া হয় যে এই সম্মেলনে ১২৪টি দেশ থেকে ৭০০ জন প্রতিনিধি একত্রিত হয়েছেন, তখনি বোঝা যাচ্ছিল যে এটি হবে একটি দারুন সম্মেলন। উপস্থিত অতিথিদের মধ্যে ৭ জন প্রতিনিধি স্বনামধন্য, বাকিরাও নিজ নিজ দেশের বেশ গুরুতবসম্পন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।

বুদাপেস্টে কনফারেন্সেও দায়সারা গোছের আলোচনা হচ্ছিল। প্রেসিডেন্ট পদ্গমি, যিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন এর প্রধান, তিনি তার উদ্ভোদনী বক্তৃতায় পাকিস্তান, বা পূর্ব পাকিস্তানি শরনারথীগন, যারা এখন বন্যার মত ভারতের সীমান্তে আশ্রয় গ্রহন করছেন, তাদের নিয়ে কোন আলোচনাই করেননি। অন্যদিকে হাঙ্গেরির “প্যাট্রিওটিক পিপলস ফ্রন্ট” এর জেনারেল সেক্রেটারি অমীমাংসিত সঙ্ঘরষগুলোর প্রসঙ্গ তুললে সেক্রেটারি গেনারেল রমেশ চন্দ্র বলেন যে তার দৃঢ় বিশ্বাস যে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যাটি এধরনেরি। তিনি এবং বুদাপেস্ট এর এই মিটিঙে উপস্থিত তার সমর্থকরা সর্বচ্চো চেষ্টা করবেন যেন উপস্থিত অতিথিরা অনুধাবন করতে পারে যে ভারত ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পারটিগুলোর দাবী কতখানি যুক্তিসঙ্গত এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন হওয়া কতটা প্রয়োজন। মস্কোর এমন একটি আনুষ্ঠানিক মুহূর্তে এটি খুবি অসবস্তিকর ও অনাকাঙ্ক্ষিত উদ্যোগ হলেও, সম্মেলন শেষে এর ফল কি দাড়ায় তা অনেকের মধ্যেই কৌতুহল সৃষ্টি করছে যে রমেশ চন্দ্রকে কি আবারো সংস্থাটির সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে নির্বাচিত করা হবে নাকি না।

সাম্প্রতিক বিষয়ে আলোচনাঃ পাকিস্তানের দীর্ঘকালীন রাজনৈতিক সমস্যাসমুহ
ডিস্ট্রিবিউশন- এঃ
তাঃ ৭ জুন, ১৯৭১
সম্প্রচারেঃ মারক টালি

ভারতের রাজনীতিবিদরা পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থী ও কলেরা মহামারী সংকট কতখানি ভয়াবহ আকার ধারন করেছে তা জানাতে তাদের আন্তর্জাতিক প্রচারনা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিবিসি পূর্ব বারতায় মারক টালি যে মন্তব্য করেন তা হলঃ ৬ জুন, রবিবার, ভারতীয় প্রধান মন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বলেন যে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীগুলোর একটি অবশ্যকর্তব্য পাকিস্তানকে বোঝানো যে গনতান্ত্রিক প্রয়োজন অস্ত্রের জোরে দমন করা সম্ভব নয়। এখন, পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ বিষয় বেশ আইনানুগ ভাবেই ভারতের মাথা ব্যাথার কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতে অবস্থানরত শরণার্থীর সংখ্যা এখন প্রায় ৪০ লক্ষ এবং এ সংখ্যা রোজ আরও অজস্র শরণার্থীর আগমনে কেবল বেড়েই যাচ্ছে, যার ফলে এটি ভারতের জন্যও একটি বেশ বড় অভ্যন্তরীণ সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে। ভারতের সরকার মনে করছে যে এই শরণার্থীদের অত্যন্ত দ্রুত পূর্ব পাকিস্তানের ফিরত পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে, কেননা এখন না তাদেরকে আশ্রয় দেয়ার মত যথেষ্ট স্থান রয়েছে আর না তাদের পালনের মত পর্যাপ্ত অর্থ রয়েছে। কিন্তু, তারা এটাও অনুধাবন করতে পারেন যে, যতক্ষন পূর্ব পাকিস্তানিরা তাদের নিজ ভুমিতে জীবনের ঝুকি অনুভব করবেন, ততক্ষন তাদেরকে ফেরত পাঠানো সম্ভবপর হবে না। তাই, ভারত সরকারের মনে হচ্ছে যে, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এমন পরিস্থিতি সৃষ্টিতে পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করার উদ্যোগ যথেষ্ট পরিমানে নীতিসঙ্গত।

পাকিস্তান সরকার যে সমস্যার এখন মুখোমুখি হচ্ছে, তা হল কি করে পূর্বাংশের মানুষদের মধ্যে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা যায়। দুই সপ্তাহ আগে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে তিনি অত্যন্ত দ্রুতই জনতার কাছে তাদের ক্ষমতা ফিরিয়ে দিবেন। সময় চলে যাচ্ছে, এবং এখনও এধরনের কোন ঘোষণা ইসলামাবাদ থেকে আসেনি। এখনও পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে পকিস্তানে যা বলা হয়েছে, তা হল, জাতীয় পরিষদ তারাই গঠন করবে যারা গত ডিসেম্বরের ইলেকশনে বিজয়ী হয়ে আসন লাভ করেছেন। কেবল মাত্র যেসকল সদয়কে রাজদ্রোহের অপ্রাধে গ্রেফতার করা হয়েছে, তারা বাদে আর সকলেই এই পরিষদ গঠনে সামিল হবেন। কিন্তু, আমাদের প্রতিবেদকদের খবর দেখে মনে হচ্ছেনা যে কোন আওয়ামী সমর্থক পাকিস্তানের বা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার এধরনের সমাধানকে মেনে নিবে এবং জাতীয় পরিষদে অংশগ্রহন করবে।

যদিও, গনতান্ত্রিক সরকারের আওতাধিন অবস্থায় থেকেই সেনাবাহিনী চাইলে কিছুদিন প্রসাসন চালাতে পারে, কিন্তু সেইটিও যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধই থেকে যাবে, কেননা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ আর সহসা সেনাবাহিনীর উপর নির্ভর করবে বলে মনে হয় না।

ভারত সরকার এবং অন্যান্য ব্যক্তিরা মনে করেন, যেসকল দেশ পাকিস্তানকে সাহায্য করে, তাদেরই উচিত পাকিস্তানকে চাপ প্রদান করা যে যতক্ষন পর্যন্ত তারা এই সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধানে না পৌছাতে পারছে, ততক্ষন পর্যন্ত তারা কোন ধরনের সাহায্য পাবে না। এ প্রস্তাবের সবচাইতে বড় সমস্যাটি হল এটি এখনও ধারনা করছে যে এ সমস্যার একটি সন্তোষজনক সমাধান পাওয়া যাবে। দ্বিতীয়ত, সাহায্য রুখে দেয়ার মানে পূর্ব পাকিস্তানকে সমর্থন করা, আর ত্রিতিয়ত এই সাহায্যকারি দেশগুলো খুব ভালভাবেই জানে কিভাবে সাহায্যকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে হয়। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে পাকিস্তানের যেমন সাহায্য দরকার, একি সাথে পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি ফিরিয়ে আনাও পাকিস্তানের জন্য অবস্যকর্তব্য হয়ে পরেছে।

এটাই আপাত দ্রিষ্টিতে মনে হচ্ছে যে অন্য কোন দেশের এক্ষেত্রে আর কিছু করার কোন সুযোগ নেই, পাক্সিতান সরকারের উপর আর্থিক চাপ সৃষ্টি করা ছাড়া। জাতিসঙ্ঘও পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণ দেয়া ছাড়া আর কোন সাহায্য করতে পারছে না। সুতরাং, সমস্যা এখন এমন এক অবস্থানে পৌছেছে, যেখানে এর সমাধান ইয়াহিয়াকে একাই করতে হবে। ভারত এর পক্ষেও এই চাপ বেশিদিন নেয়া সম্ভব হবেনা, ধীরে ধীরে তারা এ বিষয়ে আরো বেশি জরিয়ে পড়বে।

সাম্প্রতিক বিষয়ে আলোচনা মিসেস গান্ধী, পাকিস্তান ও সামগ্রিক বিশ্ব
১৬ই জুন, ২৯৭১
সম্প্রচারেঃ ফ্র্যাঙ্ক বারবার

ভারতীয় সংসদের এক অধিবেশনে অত্যন্ত শোকাবহ গলায়, প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বলেন, প্রতিটা দিন যাওয়ার সাথে সাথে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধান পাওার আসা ক্ষীণ হয়ে আসছে। বিবিসি সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর প্রতিবেদক ফ্র্যাঙ্ক বারবারের মন্তব্য অনুযায়ীঃ
পাকিস্তানি আর্মিদের হামলার পর তিন মাস কেটে গেছে। যারা পূর্ব পাকিস্তানের এই সংকটের কথা জানেন, তারা সকলেই আসা করছেন, একটা কিছু ভাল সংবাদ শোনার। সকল প্রমান থাকা স্বত্বেও, পাকিস্তান সরকার প্রমান করার চেষ্টা করেই যাচ্ছে যে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার দাবী শুধুই একটা বিচ্ছিন্ন আন্দোলন, এবং পরিস্থিতি আবারো স্বাভাবিক অবস্থায় চলে আসবে। এ সপ্তাহেই সেনাবাহিনীর গভরনর জেনারেল টিক্কা খান বলেছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক এবং শান্তিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। যদিও বাইরের পৃথিবীতে, যারা এ মুহূর্তে উদ্ভুত কলেরা পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পরেছেন, এবং এবিষয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে আসছেন, তারাও মোটামুটি নিশ্চিত যে খাবার, কম্বল এবং পর্যাপ্ত ঔষধ সরবরাহ না করা হলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে এগিয়ে যাবে। ভারতীয় উপমহাদেশের ভাগ্যে কি ঘটবে তার একটি সম্ভাব্য পরযালোচনার ভার পরেছে মিসেস গান্ধির উপরে, “আমাদের হয়ত নরকের মধ্য দিয়ে দিন পার করতে হবে”, এবার যখন তিনি প্রায় ৬০ লক্ষ ও ক্রমশ ব্রিদ্ধিশীল শরণার্থী কে আশ্রয় দেয়া নিয়ে ভারতীয় সংসদে বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তখন তিনি এ বক্তব্য দেন। কিন্তু, তারপরি তিনি আবার এবিশয়ের উপরো জোর দেন যে- তারপরও তাদেরকে কেবল মাত্র অস্ত্রের মুখে নিহত হওয়ার জন্য, ভারত তাদেরকে তাড়িয়ে দিবেনা। তিনি বলেন যে এই সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধান যত দিন যাচ্ছে, তত অসম্ভব হয়ে পরছে।মিসেস গান্ধির এই পর্যালোচনা শরণার্থীদের বর্তমান অবস্থার থেকেও করুন এক পরিনতির দিকে ইঙ্গিত করে। রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা যত কমে আসবে, ততই এই গ্রিহহীন অভিবাসীদের ঢাকায় ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে আসবে, যা পৃথিবীর অন্যতম একটি দরিদ্র অঞ্চলের জন্য খুবি হতাসাব্যাঞ্জক একটি পরিনতি। একটা বেশ অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, মার্চের শেষের দিকে পাকিস্তান আর্মিদের হামলার প্রায় ১২ সপ্তাহ পরও শরণার্থীরা দলে দলে দেশ ত্যাগ করছে। এখন সকলেই সন্দিহান যে আদৌ প্রথমদিকের শরণার্থীরা আর্মিদের ভয়াবহ হামলার ভয়ে দেশ ত্যাগ করেছিল কিনা, কেননা ধারনা করা হয়েছিল যে এই গতি ধীরে ধীরে কমে আসবে। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ বলছেন যে কিছু বিচ্ছিন্ন ও অকার্যকর প্রতিরোধ ও দেখা গেছে। এমনকি বিচ্ছিন্নতাবাদী সমর্থকরাও আর্মিদের প্রতিরোধ করার বেশি কোন কার্যক্রমের কথা বলছেন না। এই ক্রমাগত শরণার্থীদের মিছিলের কারনেই মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বলেছেন, অদুর ভবিষ্যতেও শান্তি আনার ক্ষেত্রে এই শরণার্থীদের মিছিল একটি হুমকি স্বরূপ, আর তার দায় বহন করতে হবে সারা পৃথিবীকেই। যদিও এখনও পৃথিবীর নেতাদের এই দায় স্বীকার করার কোন উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। তবে, বৈদেশিক অনেক সাহায্যই করা হয়েছে। জাতিসঙ্ঘ প্রায় ৭৩ মিলিয়ন ডলার সাহায্য চাইলেও এখন পর্যন্ত প্রায় ১২.৫ মিলিয়ন সংগৃহীত হয়েছে, যার বেশিরভাগই যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য দিয়েছে। যদিও, ভারত যা চেয়েছিল, ৭৩ মিলিয়ন ডলার তার অর্ধেকেরও কম।

মিসেস ইন্দিরা গান্ধী সমাধান হিসেবে একি কথা বারবার বলে যাচ্ছেন, আর তা হল, সারা পৃথিবীর নেতাগন মিলে পাকিস্তানকে চাপ দিতে হবে, যেন তারা পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদের সাথে একটা শান্তিপূর্ণ সমঝোতায় আসে, সেইসব নেতাদের কথা এখানে বলা হচ্ছে, যাদের ইয়াহিয়া ইতিমধ্যে বিদ্রোহী বলে ঘোষণা করেছেন। এই ধরনের উপদেশ দেয়া বেশ বিপদজনকই বটে, কেননা, এমন উপদেশের মানে হল, কোন দেশ তার নিজস্ব সমস্যা কিভাবে মোকাবেলা করবে, সে বিষয়ে কথা বলা, সে দেশের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করা। তবুও, ভারতের উপর যে সমস্যা এখন চেপে বসেছে, তা অবশ্যই এই সমস্যাকে একটি আন্তর্জাতিক সমস্যায় পরিণত করেছে। এ অবস্থায়, সারা পৃথিবীর মিসেস গান্ধির এই উপদেশ মেনে নেয়াই যুক্তিগত মনে হবে, কেননা, পাকিস্তানও বুঝতে পারছে যে একটি রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া এ সমস্যার আর কোন সমাধান নেই।

সাম্প্রতিক বিশয়াবলীঃ ইয়াহিয়া খান ও মিসেস গান্ধী বিষয়কঃ
১ম ডিসেম্বর, ১৯৭১
প্রচারেঃ জন টুসা, একজন এশিয়া বিষয়ক লেখক, ইয়াহিয়া খানের জাতিসংঘের কাছে করা আপিলের আবেদন এর নেপথ্য ঘটনা নিয়ে আলোচনা করেছেন।

যদি পৃথিবীকে মনে করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন পরে যে, ভারত পূর্ব পাকিস্তানের বিষয়ে নাক গলাবেনা বলে পূর্বে যে নীতিমালা গ্রহন করেছিল, তা থেকে কতখানি সরে এসেছে, তাহলে এ সপ্তাহে তাদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মিঃ জগজীবন রামের কথাই তা আবার মনে করিয়ে দিতে যথেষ্ট, কেননা তিনি বলছেন, পাকিস্তানিদের অস্ত্রকে থামাতে প্রয়োজনে তারা পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করবেন। মিঃ রাম আরো বলেছেন যে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার দাবি পুরন করে চাইলে এই যুদ্ধকে এড়ানো সম্ভব। একি সময়ে মিসেস ইন্দিরা গান্ধীও পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় কর্তব্য সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন। নিউ দিল্লীর সংসদে এই সুলিখিত বক্তব্যে মিসেস গান্ধী আবারো তার পূর্বে উল্লেখিত রাজনৈতিক সমাধানের কথা উল্লেখ করেন, সেই সাথে আরো বলেন যে আওয়ামীলীগ নেতা শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তিও এই যুদ্ধকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে।
অন্যদিকে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার পাকিস্তান বর্ডারে জাতিসংঘের পরিদর্শকদের আহবান করা দেখে মনে হচ্ছে যে তারা ভারতের এর পূর্বে দুইদিকেই পরিদর্শক রাখার প্রস্তাবের বিরোধিতার প্রতি নত হয়ে এসেছেন। যদিও, এটাই ছিল পাকিস্তানের ভারত বিরোধী সবচাইতে জোরালো পদক্ষেপ। আসলে, পাকিস্তানও এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল যে পূর্ব পাকিস্তান বিষয়ে তাদের আবেদন খুবি নাজুক, আবার এবিষয়ে ভারতের অবস্থান বেশ শক্ত। এমন পরিস্থিতিতে, জাতিসংঘের পরিদর্শক আহবান করাই তাদের জন্য সবচাইতে কার্যকর পন্থা ছিল।

সেনাবাহিনীর দিক থেকে, পাকিস্তানি সেনারা সংখ্যায় কমে এসেছে এবং তাদের অস্ত্রের জোরও বেশ কমে গিয়েছে ভারতের দিক থেকে। সেনাদের দুই পক্ষে ভাগ হয়ে যাওয়া আরো শক্তি দুর্বল হওয়ার জন্য দায়ী। এই দুই কারণই ব্যাখ্যা করছে, কেন ইয়াহিয়া খান কাশ্মীর বা পশ্চিম অংশে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করার সুযোগ থাকা স্বত্বেও অস্ত্র বেছে নেয়ার সবচাইতে দুর্বল সিদ্ধান্তটি বেছে নিয়েছেন। আওয়ামীলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, শেখ মুজিবর রহমানকেও জেলে পাঠানো হয়েছে। জাতীয় আওয়ামী পার্টি, যেটি দেশের পশ্চিমাংশে কার্যকর ছিল, সেটিকেও সম্প্রতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর ফলে, ডিসেম্বরে যে নির্বাচন হয়েছিল, সেই নির্বাচনে একমাত্র যেই পার্টি এখনও অক্ষত আছে, তা হল, মিঃ জে, এ ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি, যারা পশ্চিম পাকিস্তানের হ্রিদপিন্ড হিসেবে গন্য হওয়া পাঞ্জাব ও সিন্ধু এর মত প্রদেশ নিয়ন্ত্রন করে। যদিও, বলা হচ্ছে যে প্রেসিডেন্ট পরিকল্পনা করছেন, যে তিনি ক্ষমতা ভুট্টোর হাতে নয়, মিঃ নুরুল আমিনের হাতে তুলে দিবেন, যার পার্টি গত ডিসেম্বরে কেবলমাত্র একটি সিট পেয়েছিল। এর থেকে বেশি অদ্ভুত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আর হতে পারেনা, আর বরতমানে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তাই নিয়ে যাচ্ছেন এক্তার পর একটা।

মনে হচ্ছে, ভারতের পন্থা হচ্ছে, এইসকল দ্বিধাকেই এক্টার পর এক্তা কাজে লাগিয়ে যাওয়া। এর সাথে আরও একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে, এই পূর্ব পাকিস্তানি শরণার্থীরা যেন একটি স্থায়ী দায় হয়ে চেপে না বসে, যেমনটি ফিলিস্তিনী শরণার্থীরা মধ্যপ্রাচ্যের জন্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু, বর্তমান পরিস্থিতি মিসেস গান্ধির সুনামকে খুন্ন করছে, এবং পরিস্থিতির উপর তার হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা ক্রমশ হ্রাস করছে। এমুহূর্তে পৃথিবীর মনোযোগ শরণার্থী বা পুরবা পাকিস্তানে কি হচ্ছে, তা থেকে আবারও ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সীমান্ত বিষয়ক বিবাদের দিকে সরে গিয়েছে। রাজনৈতিকভাবে এই শরণার্থীর সমস্যাকে একটি আন্তর্জাতিক সমাধানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রন করার বদলে মিসেস গান্ধী যুদ্ধকেই বেছে নিয়েছেন।