সানডে টেলিগ্রাফ, লন্ডন, ২৫ জুলাই, ১৯৭১
বাঙ্গালীদের দেশ ত্যাগ এখনো চলছে
পিটার গিল গত দুই মাস পূর্ববাংলায় সেখানকার সংকট নিয়ে রিপোর্ট করছেন।
বাঙালিদের সঙ্গে দুই মাস থাকার পরে, আপনি সহজেই বাকিদের থেকে শরনার্থিদের আলাদা করতে সক্ষম হবেন। পাশে থাকার সুবিধা হল বর্ষার বৃষ্টিতে গাড়ীর জানালা না খুলেই ভেতর থেকে বলে দিতে পারবেন কার অবস্থা কি।
সংখ্যাটা পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে। টাইম ম্যাগাজিনের সাংবাদিক হিসেবে আমি গত বুধবার কলকাতার অদূরেই বনগাঁ থেকে ১২ মাইল গাড়ি চালিয়ে পূর্ববাংলার সীমান্তে বগুড়ায় পৌছাই। কিছু জিনিস এর মাঝে চোখে পড়ল। এগুলো ব্রিটিশ সানডে ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ ও রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত টেলিভিশন ফিচার ফিল্ম হিসেবে চলবে।
হিন্দু ও মুসলমান কোন বিষয় না – বিষয় হল তারা বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমান।
মুসলমান পুরুষরা লুঙ্গি পরে। এটি একটুকরো কাপড় যা কোমর বৃত্তাকারভাবে বাঁধা থাকে এবং কাফ পর্যন্ত ঝুলে থাকে। হিন্দুরা প্রধানত ধুতি পরে। এটি একটু জটিল ধরনের গান্ধীবাদী প্যাঁচানো ধরণের কাপড় যেটা আলগা এবং মাটি পর্যন্ত বিস্তৃত। সেদিন সেখানে বেঁচে থাকার পদব্রজে হিন্দু ও মুসলমান উভয় লোক ছিল।
বিধবাদেরকেও আলাদা করা যায়। রঙ্গিন সুন্দরী মেয়েদের এবং বিবাহিত মহিলাদের মত রঙ্গিন শাড়ির পরিবর্তে তারা পূর্ব বাংলা বাজার থেকে কেনা সস্তা প্লেইন সাদা ফ্যাব্রিক পরে। তাদের বেশিরভাগ অনেক বৃদ্ধ , দুর্বল এবং খোঁড়া। কিন্তু তবুও তাদের পূর্ববঙ্গ থেকে বৃষ্টির মধ্যে ভারত শিবিরে যেতে হবে।
শরণার্থীরা যাকিছু আছে তার সব কিছুই বহন করছে। সবকিছু পুরনো শাড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে একটি থলির মত বানিয়ে তার ভেতরে করে নিয়ে যাচ্ছে। একজন বৃদ্ধ মানুষ তার হাতে একটি হাঁড়িতে মাছ নিয়ে সেটিকে হাতের সাথে ঝুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। একজন বিদেশী নিউট্রিশনিস্ট আমাকে বলেছিল ওটাই হবে তার শেষ বারের মত দুই এক বেলার আমিষের যোগানদাতা।
আমাদের রাস্তা ছিল পূর্ববাংলার একটি অঞ্চল যেটা পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিল – যা এখন স্বাধীন বাংলাদেশ।
কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনের দুজন লোক আমাদের সঙ্গে ছিলেন। একজনের কাছে একটা সামান্য টেপ রেকর্ডার ছিল, যা দিয়ে সে স্বাধীনতাকামীদের অনুভূতি রেকর্ড করতে যাচ্ছিলেন। এবং অন্যজন স্যার ওয়াল্টার রেলির (Sir Walter Raleigh) দেশপ্রেমের কবিতার কিছু চরণ শোনাচ্ছিল।
স্থানীয় গেরিলা কমান্ডার আমাদের সাথে দেখা করতে আসলেন। তিনি বললেন “আপনি ইতিমধ্যে হয়ত দেখেছেন এখানকার মানুষের উচ্চ মনোবল।”
সত্যি বলতে, আমি দেখিনি। তারা ভারতের রিফুজি ক্যাম্পে যাবার যে পথযাত্রা তাদের ভেতরে ছিলোনা। তাই দেখার সুযোগ হয়নি। তাদের উদ্যম ছিল কম। হয়ত পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশ তাদের কাছে একই রকমের। যদি গেরিলারা না থাকত আর আর্মি দুরেই থাকত তারা হয়ত এখানে থেকে শুধু ফসল উৎপাদন আর বিক্রি করে জীবন পার করে দিতেন।
বাংদা গ্রামে আজ হাটের দিন। এলাকার গেরিলা কমান্ডার বললেন বাংদা-বাজারে বুধবার ও শনিবার হাট বসে। টেপ রেকর্ডার সঙ্গে রাখা ব্যাক্তিটি মাইক্রোফোন ঠিক করলেন এবং গেরিলারা ও ছাত্র-স্বেচ্ছাসেবকরা চিয়ার্স আরম্ভ করার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগল।
মাইকে চিৎকার দিয়ে বলল “শেখ মুজিবুর রহমান।”
“জিন্দাবাদ” (অর্থাৎ চিরজীবী হন)।
উদ্বাস্তুরা ধীরে ধীরে আমাদের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল। তারা ভারতে যাচ্ছে – সেখানকার সরকার দুই মাসে তেমন কিছু করতে পারেনি। ভারত চেষ্টা করেছে কিন্তু কমই করতে পেরেছে। পাকিস্তান পেরেছে – যদিও তারা কোন কিছুরই প্রস্তাব দেয়নি। পশ্চিমারা শুধু নিন্দা করেছে এবং বেশিরভাগই নির্লিপ্ত রয়েছে।
এমনকি পশ্চিমাদের ত্রাণ প্রচেষ্টা বর্ষার কাদার মধ্যে ম্লান হয়ে গেছে। লন্ডনের স্টার্লিং, ওয়াশিংটনের ডলার এবং জেনেভার দান কাগজেই সুন্দর দেখায়। সত্য এটাই যে ভারতে অবস্থিত একজন বাঙ্গালী রিফুজিকে ভালো কোন আশ্রয় দেয়া হয়নি বা তাদের স্বাস্থ্য দুই মাস আগে যা ছিল সেরকম মোটেও নেই।