You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.03 | গার্ডিয়ান, ৩রা নভেম্বর, ১৯৭১ গেরিলারা ১২ মাস ব্যাপী যুদ্ধের লক্ষ্য স্থির করেছে - সংগ্রামের নোটবুক

গার্ডিয়ান, ৩রা নভেম্বর, ১৯৭১
গেরিলারা ১২ মাস ব্যাপী যুদ্ধের লক্ষ্য স্থির করেছে

পাক-ভারত সীমান্তের একটি ঘাঁটি থেকে জিম হোগল্যান্ড-এর প্রতিবেদন

বয়রা নামক ছোট্ট সীমান্ত চৌকি থেকে কয়েকশো গজ দূরে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে ভারতের সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিস্ফোরন্মুখ সীমান্ত, যেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন তরুণ লেফটেন্যান্ট হাসিমুখে গোড়ালি পর্যন্ত কাদায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে সীমান্তের দিকে দেখাচ্ছিল। “আমি আপনাদের সাথে যাচ্ছি না”, আধা-ডজন বিদেশী সাংবাদিক যারা পায়ে হেঁটে সীমান্ত অতিক্রম করার জন্য কিছুক্ষণের মধ্যেই রওনা দেবে তাদের কে সে বলে, “আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আমাদের সীমান্ত অতিক্রম করা নিষেধ”।

বয়রার ভারতীয় সেনাবাহিনীর ঘাঁটির ভিতর দিয়ে সাথে করে নিয়ে আসার সময় এই অফিসার সাংবাদিকদের প্রতি এই বাগাড়ম্বরপূর্ণ মন্তব্য বেশ কয়েকবারই পুনরাবৃত্তি করেছে। স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে যে সে অত্যন্ত আগ্রহের সাথে এই কথাগুলো অনুশীলন করেছে যা পূর্ব পাকিস্তানে চলমান ঘটনাবলী এবং এসব ঘটনাবলীতে ভারতের বিতর্কিত ভূমিকার ব্যপারে ভারতের স্পর্শকাতরতারই প্রতিফলন।

এই ভারতীয় লেফটেন্যান্ট একজন উষ্কখুষ্ক চেহারার মানুষের কাছে যার বয়স হয়তো ৬০ যে একটি পুরাতন কার্বাইন (ক্ষুদ্র অস্ত্র) বহন করছিল এবং নিজের পরিচয় দেয় “মুক্তি বাহিনী” – গেরিলা সামরিক শাখা – এর একজন হিসেবে তার কাছে সাংবাদিকদেরকে হস্তান্তর করে এবং প্রবল ঝড়বৃষ্টির মধ্যে দ্রুত পায়ে হেঁটে ফিরে যায়। ঘন কাদায় হোঁচট খেতে খেতে, সাংবাদিকেরা মুক্তি বাহিনীর সদস্যটিকে অনুসরণ করে চার-মাইল দীর্ঘ আঁকাবাঁকা পথ ধরে ধান ক্ষেতের ভেতর দিয়ে এবং ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানকে বিভক্তকারী সীমান্ত চিহ্নিতকারী খুঁটির পাশ দিয়ে। দ্রুতপায়ে হাঁটার শেষে পাওয়া যায় একটি পরিত্যক্ত স্কুল ঘর, যেটির বর্তমান পরিচয় একটি ব্যনারে লেখা আছে “বাংলাদেশ মুক্তি বাহিনী”-র সাব-সেক্টর সদর দপ্তর হিসেবে।

মেজর নাজমুল হুদা, ৩৩-বছর-বয়স্ক একজন স্পষ্টভাষী মানুষ যিনি আমাদেরকে বলেন যে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন ছিলেন, কর্তৃত্বের সাথে দাবী করেন যে এই স্কুল ঘর থেকে তিনি ১৫০ বর্গ মাইল এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁর সাথে প্রায় একশো নিয়মিত বাহিনীর সৈন্য রয়েছে যারা বিদ্রোহীদের পক্ষে সেনাবাহিনী থেকে দলত্যাগ করে, এবং ৭,০০০ গ্রামবাসী যাদেরকে তাঁর সহযোগীরা প্রশিক্ষণ দিয়েছে। গেরিলারা দাবী করে যে তারা পুরো পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে এরকম সদর দপ্তর স্থাপন করেছে, এবং তারা জানায় যে তারা তাদের আক্রমণ আরো তীব্র করবে যা এক বছরের মধ্যে এই দেশ থেকে পাকিস্তানের নিয়মিত সেনাবাহিনীকে বিতাড়িত করবে।

বিদ্রোহীদের এলাকায় খুব দ্রুত একবার গিয়ে এবং ঘুরে এসে তাদের দাবির ন্যায্যতা বিচার করা অসম্ভব। কিন্তু নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ এই গেরিলা সংস্থাটিকে সাত মাসের মধ্যে শূন্য থেকে শুরু হয়ে ৮০,০০০ থেকে ১,০০,০০০ সৈন্যের বাহিনীতে পরিণত হওয়ার কৃতিত্ব দেয়, যে সংখ্যাটি মোটামুটিভাবে তাদের বিরুদ্ধে মোতায়েনকৃত পাকিস্তানের নিয়মিত সেনাবাহিনীর সৈন্য সংখ্যার সমান। এই বিশ্লেষকেরা মনে করেন যে মুক্তি বাহিনী হয়তো সমাজের নিম্নশ্রেণীর লোকদের নিয়ে তাড়াহুড়ো করে জোড়াতালি দিয়ে তৈরী করা একটি বাহিনী থেকে এমন একটি সংস্থায় রূপান্তরিত হচ্ছে যাদের সম্মিলিত কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষমতা ক্রমবর্ধমান।

এখানকার কূটনৈতিক মহলে প্রচারিত নির্ভরযোগ্য প্রতিবেদনগুলোও মেজর হুদা-র দাবীগুলোকে সমর্থন করে যে মুক্তি বাহিনী “গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে অনেক বেশী আক্রমণাত্মক এবং কার্যকরী হয়ে উঠেছে”। বিগত ২০ দিনে, যোগাযোগ মাধ্যম ও সরবরাহ প্রবাহের উপর বিদ্রোহীদের কেন্দ্রীভূত আক্রমণ একটি নমুনা প্রদর্শন করছে গেরিলাদের অস্ত্র সরবরাহ এবং প্রশিক্ষণের ক্রমবর্ধমান উৎকর্ষের, এই প্রতিবেদনগুলো অনুযায়ী, যা এই ধারণাকে আরো জোরদার করছে যে ভারত হয়তো সম্প্রতি গেরিলাদের প্রতি তাদের যুদ্ধ কৌশলগত সাহায্যের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে সীমান্ত জুড়ে পাকিস্তানী সৈন্যদের বিচ্ছিনভাবে ছড়িয়ে পড়া তাদেরকে এব্যপারে সাহায্য করেছে।

দেশের ভেতরে গেরিলাদের সাফল্য আপাতদৃষ্টিতে ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকায় পাকিস্তানী বাহিনীর প্রতিশোধমূলক আক্রমণ বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে সেখানে গেরিলারা আশ্রয় নিচ্ছে এরকম সন্দেহ থেকে। প্রতিদিন খবর আসছে বিভিন্ন গ্রামে গোলাবর্ষণের এবং কিছু ক্ষেত্রে পাকিস্তানী জঙ্গিবিমান থেকে ভারতীয় এলাকায় গুলিবর্ষণের।

বয়রা এমন একটি এলাকায় অবস্থিত যেখানে গত সপ্তাহেই গোলাবর্ষণ করা হয়। সেখানে ঘাঁটি গেঁড়ে থাকা ভারতীয় সৈন্যরা যাতে গেরিলাদের সাহায্য করার জন্য সীমান্ত অতিক্রম না করে তারই ইংগিতজ্ঞাপক। তারা অন্য কোন ভাবে গেরিলাদেরকে সাহায্য করছে কিনা তা তিক্ত বিতর্কের বিষয়। যেখানে ভারতীয়রা অস্বীকার করে যে তারা কোন সাহায্য করছে। সেখানে পাকিস্তানীরা নিয়মিতভাবে গেরিলাদেরকে ভারতের দালাল বা তাদের দ্বারা পরিচালিত পুতুল হিসেবে বর্ণনা করে।

মেজর হুদা অস্বীকার করেন যে তাঁর লোকেরা ভারতীয়দের কাছ থেকে অস্ত্র বা প্রশিক্ষন পাচ্ছে। তিনি বলেন তাঁর লোকদের হাতে অস্ত্রের সংখ্যা লক্ষণীয় হারে বেড়ে যাওয়ার পেছনে গত কয়েক সপ্তাহে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তাদের অনুগত বেসামরিক লোকদের মধ্যে যে রাইফেল বিতরণ করেছে সেগুলো দখল করা দায়ী।

কিন্তু নিশ্চিত খবর রয়েছে যে আনুমানিক ১০ দিন আগে থেকে ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকায় নতুন অস্ত্রের ব্যাপক সরবরাহ শুরু হয়েছে। একটি ভাষ্যমতে, যেটি নিশ্চিত করা যায়নি, গেরিলাদের জন্য ভারতীয় অস্ত্রের সরবরাহ বেড়ে গেছে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে নিশ্চয়তা দেয়ার পর যে বিদ্রোহী বাহিনীকে দেয়া প্রতিটি সোভিয়েত অস্ত্র তারা প্রতিস্থাপন করবে।

আহত গেরিলাদেরকে সীমান্ত পেড়িয়ে ভারতে পাঠানো হচ্ছে চিকিৎসা সেবা নেয়ার জন্য, এবং এই এলাকার গ্রামবাসীরা ভারতীয় রেড ক্রস এবং অক্সফাম-এর কাছ থেকে খাদ্য সাহায্য পাচ্ছে, মেজর হুদা বলেন।

গেরিলা এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী নিঃসন্দেহে নিজেদের মধ্যে তথ্য আদানপ্রদান করে। পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে যে তথ্য ফাঁস হচ্ছে, এখানকার ভারতীয় নির্ভরযোগ্য সুত্রের নিশ্চয়তা অনুযায়ী, ভারতের কাছে দেশজুড়ে পাকিস্তানী বাহিনীর অবস্থানের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে।

মুক্তি বাহিনীর মধ্যে একত্রে থাকার ক্রমবর্ধমান প্রবণতা এবং মেজর হুদার মতো কার্যত জেলা প্রশাসকের আবির্ভাবের প্রবণতা পশ্চিমা পর্যবেক্ষকেরা খুবই সতর্কতার সাথে সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করছে।

“আমাদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করে যে পূর্ব পাকিস্তান বাস্তবিকই কোন এক পর্যায়ে স্বাধীন দেশ হবে” একজন পশ্চিমা কূটনৈতিক বলেন। “আমরা জানি না এর জন্য ছয় মাস না ছয় বছর লাগবে। কিন্তু যদি তা ঘটে তাহলে নতুন প্রজন্মের নেতারা আসবে যারা গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে সঙ্ঘটিত হয়েছে, এবং এটা জানা জরুরী যে তারা আসলে কি”। – ওয়াশিংটন পোস্ট।