শেখ মুজিব আমাকে ডেকে পাঠালেন
একদিন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব শ্রী পি এন হাকসার আমাকে একটা বার্তা পাঠিয়ে জানালেন যে শেখ মুজিবর রহমানের অনুরােধে শেখের ব্যক্তিগত উপদেষ্টা হিসাবে আমার ঢাকা যাওয়াতে প্রধানমন্ত্রী সম্মত হয়েছেন এবং আমাকে অবিলম্বে যেতে হবে । ঐ সময় যিনি সারা বিশ্বে সবচেয়ে বড় খবর সৃষ্টি করেছেন সেই শেখ মুজিব তার উপদেষ্টা হিসাবে আমাকে চেয়ে পাঠিয়েছেন এটা আমার পক্ষে বিরাট সম্মানের ব্যাপার ছিল। ঢাকায় পৌছতেই দেখি শেখের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব সামাদ বিমানবন্দরে আমাকে নিতে এসেছেন। শহরে যাওয়ার আগে তিনি আমাকে বিমানবন্দরে এক কাপ চা খাওয়ানাের জন্য বেশ জোর করলেন। শেখ সাহেব আমাকে খুব ভালভাবে অভ্যর্থনা করলেন। তিনি বললেন আমি যেন তার সরকারি বাসভবনে থাকি। আমি দ্রভাবে সেটা অস্বীকার করলাম। তার নিজের বাসায় খালি ঘর ছিল না। নইলে আমার সন্দেহ নেই তিনি চাইতেন আমি গােটা পরিবারটার সঙ্গে থাকি কারণ আমার সঙ্গে তাদের সবার খুব ভাল জানাশােনা হয়ে গিয়েছিল। এই বারে আমি লক্ষ করলাম তার বাসায় কোনও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। সব রকমের মানুষ সময়-অসময় নেই যখন তখন এসে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার চাইত। তার সাথে দেখা করতে আসা লােকেদের কোনও বাছবিচার নেই এ কথা তুলতেই তিনি বললেন“আমি জাতির জনক দিন বা রাতের যে কোনও সময়ে আমার কাছে আসার অধিকার প্রত্যেকের আছে। কেউ যদি কষ্টে থাকে, তার সামনে তাে আমি আমার দরজা বন্ধ করে দিতে পারি না। আমি তাকে বললাম আমি তাঁর এই অনুভূতিতে মুগ্ধ হচ্ছি কিন্তু তিনি নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তার জাতির প্রতি দায়বদ্ধ। জনাব তােফায়েলও, যিনি তখন শেখের রাজনৈতিক সচিব, এ ব্যাপারটায় হতাশ বােধ করতেন। আমার মনে হয় জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক নেতারা ঝুঁকি নিয়ে থাকেন, কিন্তু মুজিব যতদূর পর্যন্ত গিয়েছিলেন ততদূর খুব কম সংখ্যকই গিয়েছেন। আমাকে বিখ্যাত শিল্পপতি আদমজির বাসায় রাখা হল। আমাকে নিরামিষ খাবার দেওয়ার জন্য ভাল বন্দোবস্ত করা হল। মুজিব ঐ সময় তিনটি ব্যাপার নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। একটা হল, কতকগুলি মহল তখনও অস্ত্র সমর্পণ করেনি, তারা সুযােগ পেলে সেগুলি সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারত। বাংলাদেশের যুদ্ধের সময় তথাকথিত মুক্তিযােদ্ধাদের কতকে লুকানাে অন্ত্রের অনেক গুপ্ত ভাণ্ডার গড়ে তুলেছিল।
তিনি সে ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। দ্বিতীয়টা হল আমাদের সাধারণ সীমান্তের বিভিন্ন অংশ দিয়ে উভয় দিকে চোরাচালানের প্রশ্ন। এই চোরাচালান তার অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিতে পারত। তৃতীয়টা ছিল তাঁর দেশের প্রকৃত যুব ক্যাডারদের পুনর্বাসনের প্রশ্ন । তারা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের দ্বারা ভালভাবে প্রশিক্ষিত ও অস্ত্রসজ্জিত হয়েছিল এবং এখন তারা সবাই বেকার ছিল। এত বিরাট সংখ্যায় তাদেরকে আত্তীকরণ করার সাধ্য তার ছােট্ট আর্মির ছিল না। তাদেরকে সবচেয়ে ভাল কিভাবে কাজে লাগানাে যায় সেটুকু তিনি জানতেন । শেখ মনে মনে একটা ভাবনা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন- একটা বাহিনী যা মুক্তিবাহিনী ও মুজিববাহিনীর সকল দেশপ্রেমিক যুবাদের ধারণ করতে পারবে এবং আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে পারবে, বিধ্বংস অর্থনীতির পুনর্গঠনেও সাহায্য করতে পারবে। তিনি চাচ্ছিলেন এ বাহিনী অস্ত্রের সকল গুপ্ত ভাণ্ডার খুঁজে বের করবে এবং যেসব লােক দেশের পলিসিসমূহের বিরুদ্ধে কাজ করছে তাদের বের করে কৈফিয়ত আদায় করবে। তিনি আশা করছিলেন তাদেরকে ভারত-বাংলাদেশের বিশাল সীমান্তে চোরাচালান। বিরােধী তৎপরতার জন্য কিন্তু শেষ পর্যন্ত কৃষিতে ও অন্যান্য ক্ষেত্রে পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে কাজে লাগাতে । ঠিক এই মূল ভাবনা নিয়ে আমি বিস্তর মাথা ঘামিয়েছিলাম যখন এই ক্যাডারদের প্রশিক্ষণ চলছিল এবং তাদের মনে এটা গেঁথে দেওয়া হচ্ছিল যে তাদের দেশের মুক্তি অর্জনের পর সকল দেশপ্রেমিক তরুণদের দেশের পুনর্গঠনে কাজ করাটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ আবশ্যিক ব্যাপার। কথাটা তরুণদের মধ্যে আবেদন সৃষ্টি করেছিল এবং সিরাজের মতাে নেতারা তাতে বিপুল গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে অনেকে এটা নিশ্চয়ই শেখের সঙ্গে আলােচনা করেছিলেন এবং শেখের প্রত্যয় হয়েছিল যে এমন প্রকৃতির একটা বাহিনী বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা আনার ব্যাপারে বিপুলভাবে সাহায্য করবে। তিনি আমার সঙ্গে ব্যাপারটা আলােচনা করলেন এবং আমাকে একমত দেখে এই বাহিনী গড়ে তােলার আদেশ দিলেন। তিনি বাহিনীর নাম দিলেন জাতীয় রক্ষী বাহিনী (জেআরবি) এবং আদেশ দিলেন শুরুতে এতে ১২ হাজার অফিসার ও জওয়ান থাকবে। এর সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য একে তিনি নিজ কমান্ডের অধীনে রাখলেন এবং ঢাকাকে এর গ্যারিসন করলেন। এক চূড়ান্ত রকমের দক্ষ অফিসার কর্নেল নূরুজ্জামানকে এই বাহিনী কমান্ড করার জন্য বাছাই করলেন। আমাকে অনুরােধ করলেন এ বাহিনীকে সংগঠিত, প্রশিক্ষিত ও সজ্জিত করতে সাহায্য করার জন্য আমি যেন যথাসাধ্য চেষ্টা করি ।
মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে এরকম একটা বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া ও সজ্জিত করার ব্যাপারে ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে রাজি করতে আমার কিছুটা সময় লেগেছিল। সৌভাগ্যক্রমে আমার সরকার বাংলাদেশ সরকারের এই অনুরােধ মেনে নিল এবং এই বাহিনীর লীডাররা আমাদের স্থাপনায় প্রশিক্ষণ লাভ করল। এই জাতির স্বাধীনতার পরে গঠনমূলক সময়কালে এই বাহিনীটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, জনগণের সেবা করেছিল, তাদের আস্থা অর্জন করেছিল। খবরের কাগজের রিপাের্টে তাদের অটল সততা ও ন্যায়পরায়ণতা ছাড়া আর কিছু থাকত না। এমন একটা সন্ধিক্ষণে তার এই পদক্ষেপের জন্য এমনকি শেখের সবচেয়ে গুরুতররা শক্রও কখনও তার কোনও বিরূপ সমালােচনা করেনি। এটা অত্যন্ত দুঃখের কথা যে জাতির স্বার্থে শেখের এমনকি সবচেয়ে গভীরভাবে উপকারী পদক্ষেপগুলিও তার হত্যাকাণ্ডের পর সন্দেহের চোখে দেখা হল। বাংলাদেশের বিরাট দুর্ভাগ্য যে জাতীয় রক্ষী বাহিনী (জেআরবি) এই রকম পরিণতি ভােগ করল। বাঙালিদেরকে যে-ই জানে সে-ই সাক্ষ্য দেবে তাদের স্বাধীনতা-প্রিয় ও ভয়হীন চরিত্রের । তাদের দেশপ্রেমিক মন ও জাতীয় বােধ বহুবিদিত। কোনও নতুন সেট আপ -এও জাতীয় রক্ষী বাহিনী একই রকম উপকারী ভূমিকায় কাজ করত কারণ তাদের আনুগত্য ছিল মূলত জাতির প্রতি, শান্তি ও উন্নয়নের প্রতি, যার জন্য তারা এমনকি তাদের জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিল।
শ্ৰীমতী গান্ধীর ঢাকা সফর
মুক্তির খুব অল্প পরেই যখন শ্রীমতী গান্ধী ঢাকা সফর করছিলেন, তাঁর নিরাপত্তার ব্যাপারে শেখ মুজিবকে বেশ উদ্বিগ্ন মনে হল। আইন-শৃঙ্খলা তখন পর্যন্ত সন্তোষজনকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সব রকমের লােকের হাতে আধুনিক মারণাস্ত্র । পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের সাথে সংস্রবের কারণে পুলিশের মর্যাদাহীন অবস্থা। আমি কিছুটা অসংগঠিত । তিনি এই বিষয়টা আমার কাছে পাড়তে ইতস্তত করছিলেন। শ্রীমতী। গান্ধীর সঙ্গে মঞ্চে তার উপস্থিতিই শ্ৰীমতী গান্ধীর মতাে একজন গুরুত্বপূর্ণ সফরকারীর নিরাপত্তার নিশ্চয়কারক নয়। তিনি বললেন-“আপনি কেন এই অংশের দায়িত্ব নেন না? যত সংখ্যক লােক চান আমি দেব; তার মধ্যে জাতীয় রক্ষী বাহিনী থেকেও লােক থাকবে, তারা আপনাকে খুব সম্ভমের চোখে দেখে।” আমি বললাম-“বিদেশে বসে আমি এ ধরনের একটা কাজের জন্য সবচেয়ে কম উপযুক্ত ব্যক্তি। তিনি বললেন”আমি চাই না ঢাকায় এমন কোনও ঘটনা ঘটুক যা ভবিষ্যতে আমাদের সম্পর্ককে মেঘাচ্ছন্ন করবে। যা-ই হােক আমি অবশ্যই তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করব। আর তাকে স্বাগত জানাতে ও তার কথা শুনতে আসা সমবেত জনতার মধ্যে জাতীয় রক্ষী বাহিনীর কিছু দেশপ্রেমিককে ছড়িয়ে দেব।” আমি বললামএটা খুব ভাল হবে। এর কয়েকদিন বাদে আমার এমন এক ব্যাপার দর্শন করার সৌভাগ্য হল যা কারও পক্ষে কখনও ভােলা সম্ভব নয়। এই উপলক্ষে একটা ময়দানের মধ্যখানে নৌকার আকারের এক উঁচু মঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছিল। দুজনের মঞ্চ আরােহণে লক্ষ লক্ষ মানুষ তুমুল করতালি ও কণ্ঠ ধ্বনিতে ফেটে পড়ল। এশিয়ার দুজন সবচেয়ে ক্যারিশম্যাটিক জননায়ক, দুজনই নিজ নিজ জাতির অতি প্রিয় কিন্তু আজকের ঘটনায় দুজন একযােগে উপস্থিত হয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ায় এক নতুন প্রপঞ্চের দুটি দুর্দান্ত স্তম্ভ হয়ে। যে জয়ধ্বনি উঠল তা হৃদয়কে উষ্ণ করে তােলে। লক্ষ লক্ষ কণ্ঠ চিৎকার তুলল- “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় ইন্দিরা গান্ধী।” মানুষ আনন্দে পাগল হয়ে গেল যখন শ্রীমতী গান্ধী তার বক্তৃতার শুরুতে কতগুলি বাক্য বললেন বাংলায় যা তিনি রবি ঠাকুরের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিখেছিলেন। এটা জনতাকে দেখিয়ে দিল ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের আত্মীয়তা। কোনও পাকিস্তানি কখনও তাদের প্রতি এভাবে কথা বলেনি, তাদের নিজেদের ভাষায়, যে ভাষার ব্যাপারে তারা এত গর্বিত ছিল।
আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকরা ও অন্যরা শ্রোতৃমণ্ডলীকে ভালভাবে সামলেছিল । নিরাপত্তা কর্মীরা বিভিন্ন স্থান থেকে সাতজনকে ধরতে সক্ষম হল যারা পকেটে গ্রেনেড বহন করছিল এবং যাদের ধরনধারণ ছিল অস্বাভাবিক। খানিক পরে শ্রীমতী গান্ধী ও শেখ একটা ঘিরে রাখা স্থানে গেলেন। সেখানে আওয়ামী লীগ নেতারা তাদের অভ্যর্থনার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। শেখ শ্রীমতী গান্ধীর কাছে এই নেতাদের পরিচয় করিয়ে দিতে শুরু করেই লক্ষ করলেন আমাকে কাছাকাছি দাঁড়ানাে অবস্থায় । আমাকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন এবং আমাকে হাত দিয়ে ধরে শ্রীমতী গান্ধীকে আমার পরিচয় দিলেন এই বলে- “এই হচ্ছে আপনার জেনারেল উবান।” আমি দুই হাত একত্র করে নমস্তে বললাম। এর আগে কখনও তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়নি। উত্তরে তিনি একটু মৃদু হাসলেন। তারপর তার স্বাভাবিক মধুর ভঙ্গিতে হেঁটে এগিয়ে গেলেন। ভারতের জন্য তার আন্তরিকতম সম্মানবোেধ প্রদর্শন করার জন্য কোনও কিছু করতে বাংলাদেশ বাকি রাখেনি। তখন দেখাচ্ছিল যেন অভিমানে বড় ভাই ভারত থেকে ১৯৪৭ সনে আলাদা হয়ে যাওয়া দু’ভাই -এর এক ভাই (বাংলাদেশ) ঘরে ফিরেছে; এখন সে বড় হয়েছে, নিজের ইচ্ছায় চলে, স্বাধীন, কিন্তু পুরনাে পারিবারিক বন্ধনের ব্যাপারে ব্যথাতুর এবং সহমর্মিতা ও ভালবাসায় ভরপুর।
এর পরে খুব শ্রীঘই শেখ মুজিব বললেন বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় আর্মি প্রত্যাহার করা হােক। ভারত সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যাহার শুরু করল। আমি মনে করি ভারতীয় আর্মির এই প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত খুব বিজ্ঞের মতাে কাজ হয়েছিল। আরও দীর্ঘ সময় ধরে থাকলে বাংলাদেশের ভিতরে-বাইরে এই ধারণার সৃষ্টি হত যে তারা একটা দখলদার আর্মি। শান্তির সময় আমি একটা আপদ ছাড়া আর তাে কিছু নয়। তার এই ঝটপট প্রত্যাহার সারা বিশ্বের সব মানুষ আমাদের অনাগ্রাসী ও শান্তিপ্রিয় চরিত্রের প্রমাণ হিশাবে স্বাগত জানাল। আর্মি চলে যাওয়ার পর আমি দেখলাম আমিই সরকারি মহলে চলাফেরা করা একমাত্র শিখ অনেক লােকই আমাকে একজন ভারতীয় জেনারেল বলে জানত। যুদ্ধে সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হওয়া উচ্চমাত্রায় আবেগপ্রবণ এই জাতির স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করাই ছিল আমার সবচেয়ে বড় কামনা। বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তােলার কাজটা করে আমি আমার দেশের প্রতি দায়িত্ব পালন করেছিলাম। ভারতীয় আর্মির অন্য কোনও জেনারেলকে না চেয়ে শেখ মুজিব আমাকে চেয়েছিলেন কারণ আমার ন্যায়পরায়ণতা ও আন্তরিকতায় তার প্রচুর আস্থা, যেমন আস্থা ছিল সামরিক ব্যাপারে অপ্রচলিত ধারায় আমার বিশেষজ্ঞতার ওপর। আমার সিভিলিয়ান উর্ধ্বতনরা আমার ওপর যে বিপুল পরিমাণ বিশ্বাস পােষণ করতেন সে সম্বন্ধে আমি সচেতন ছিলাম। বিদেশ মন্ত্রক বা আমার নিজের সচিব আমাকে কিছু বলে দেননি, ফলে শেখ মুজিবর রহমানের উপদেষ্টা হিশাবে আমার ভূমিকার ব্যাপারে আমার কাছে অত্যন্ত ভারী দায়িত্বভার তুলে দেওয়া হয়েছিল। শেখের উপদেষ্টা হিশাবে আমার কাজ চালিয়ে যেতে আমি নিমলিখিত দিকনির্দেশগুলি নিজের জন্য নির্ধারণ করেছিলাম।
ক) ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে নিটোল পারস্পরিক বােঝাপড়া অর্জন যাতে আমরা পারস্পরিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কসমূহ গড়ে তুলতে পারি। মূলত এ কাজটা ছিল ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনার -এর যিনি একজন সর্বোচ্চ পারদর্শিতাসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন এবং তার অতিরিক্ত সুবিধা ছিল শুধু এই নয় যে তিনি বাংলা ভাষা জানতেন বরং উপরন্তু তার জন্মস্থানও ছিল বাংলাদেশে। আমি এ প্রক্রিয়ায় কেবল সাহায্যই করতে পারতাম, আমার নিজ সামরিক ক্ষেত্রে। বা অন্য যে কোনও ক্ষেত্রে, যে ক্ষেত্রেই শেখ আমার উপদেশ পেতে চাইতেন।
খ) আমাকে অবশ্যই বাংলাদেশের স্বার্থসমূহ অগ্রসর করার জন্য সম্ভাব্য সব কিছু করতে হবে। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে ঐক্য আনয়নের চেষ্টা করতে হবে। কারণ সাম্প্রতিক যুদ্ধে আনুগত্যসমূহ প্রচণ্ড রকম ধাক্কা খেয়েছে। ভারতের প্রতি তাদের শুভেচ্ছা অর্জন করতে হবে। কেবল বাংলাদেশের এবং তার নির্বাচিত নেতাদের প্রতি অনুগত নিরেট ঐক্যসম্পন্ন একটি আর্মিই স্থিতিশীলতা আনতে পারবে। গ) মাফ করাে ও ভুলে যাও নীতির অধিবক্তা হওয়া। পাকিস্তান এমন এক পরাজয় ভােগ করেছে যার থেকে সম্ভবত সে কমপক্ষে বিশ বছরের মধ্যে ওঠে আসতে পারবে না। আর সে যা-ই হােক পাকিস্তান আবার কখনও সেই আগের পাকিস্তান হবে না। পাকিস্তানের প্রতি বাংলাদেশের প্রতিকূল ভাব চলতে থাকলে তাতে অসংখ্য সমস্যার সৃষ্টি হবে । আমার আশা, বাংলাদেশ একদিন পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের শান্তি প্রচেষ্টায়ও অগ্রগামী ভুমিকা পালন করবে এবং বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান এই তিনটি দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্রের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ পারস্পরিক বােঝাপড়া নিয়ে আসবে যা তিনটি রাষ্ট্রকেই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে আমাদের চারদিকে যে নতুন হুমকি। ক্রমেই বড় হয়ে উঠছে তাকে মােকাবেলায় সমর্থ করে তুলবে। বাংলাদেশের বিহারিগণ এবং জনাব ভুট্টো, এই দুটি নাম শেখ মুজিব সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করতেন। তারা তাঁর জাতির অনেক ক্ষতি সাধন করেছিল, তিনি প্রতিশােধ নিতে এবং তাদেরকে একটা শিক্ষা দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। আমি শেখের কাছে বিহারিদের প্রতি মানবিক আচরণ করার আবেদন জানালাম। তিনি তাই করলেন কিন্তু ভুট্টোকে তাঁর সবচেয়ে বড় শত্রু হিশাবে বিবেচনা করার ব্যাপারে অনমনীয় রইলেন। আমি তাকে বােঝাতেই লাগলাম যে ভুট্টোর সাথে একটা সংলাপ শুরু করা বাঞ্ছনীয়, তাতে করে এমন কিছু সমস্যা যা দুটি দেশের জন্যই উপদ্রব স্বরূপ এবং তার প্রভাব গােটা দক্ষিণ এশিয়াতেই পড়ছে সেসবের একটা সমাধান হয়ে যেতে পারে। তিনি আমার কথা শুনতেন কিন্তু কখনও হ্যা সূচক উত্তর দিতেন না। অতঃপর একদিন হঠাৎ আমি একটা ফোন পেলাম লাহাের থেকে। লাইনে ছিলেন শেখ মুজিব তিনি জিজ্ঞেস করলেন-“আপনি কি জানেন আমি আজকে কী করেছি?” আমি বললাম-“আপনি বলুন তাে আপনি এখন কিসের ধাক্কায় আছেন। তিনি যা বললেন তা শুনে আমি থ হয়ে গেলাম।
তিনি বললেন-“একটা প্রকাশ্য মঞ্চের ওপর আমি জনাব ভুট্টোর সঙ্গে কোলাকুলি করেছি। আমি জানি আপনি এটা পছন্দ করবেন তাই আপনাকেই প্রথমে জানাচ্ছি।” এতে আমার চোখে পানি এসে গেল। আমি তাঁর দূরদর্শিতা ও রাষ্ট্রনায়কতার প্রশংসা করলাম। পাছে আমার উপস্থিতি শেখের শত্রুদেরকে একজন শিখ জেনারেলকে ঢাকায় রেখে দেওয়ার বদনাম দেওয়ার সুযােগ করে দেয়, তাই আমি তার কাছে দিলি- ফেরার অনুমতি চাইলাম। প্রথমে তাকে অনিচ্ছুক দেখা গেল । কিন্তু শেষটায় সম্মত হলেন এই শর্তে যে আমার সঙ্গে পরামর্শ করা যখন যেমন আবশ্যক হবে তিনি সে অনুযায়ী তা করতে পারবেন। আমার একটা চিঠির উত্তরে তিনি নিমরূপ চিঠি লিখেছিলেন: আমার প্রিয় জেনারেল, আপনার লেখা চিঠিটি পড়ে পরমানন্দ লাভ করা গেল। সাে নাইস অব ইউ।’ আসলে যিনি আমাদের হৃদয়ের এত প্রিয় ও এত কাছের তার কাছ থেকে কিছু শােনা অত্যন্ত মনােরম এবং ইন্টারেস্টিংও বটে। আমার স্বাস্থ্য ও সুখ নিয়ে আপনার ব্যক্তিগত উৎকণ্ঠা, আমার সন্তানদের জন্য আপনার ভালবাসা ও সপ্রশংস মনােভাব এবং সর্বোপরি আমাদের মুক্তির সংগ্রামে আপনার অবদান আমাদের সবার কাছে আপনাকে এমন প্রিয় করে তুলেছে যে আমরা আপনাকে কিছুতেই ভুলতে পারি না। তাড়াতাড়িই আপনাকে আবার এখানে দেখার জন্য আমরা অপেক্ষায় আছি। আমার সন্তানরা শ্রদ্ধার সাথে সব সময় আপনার কথা স্মরণ করে। আপনি ও আপনার স্ত্রীর উদ্দেশ্যে আমার এবং সেই সঙ্গে আমার স্ত্রীর হৃদয়ের উষ্ণতম শ্রদ্ধা পাঠানাে হল । সহৃদয় ভাবনাসহ, আন্তরিকভাবে আপনার, স্বা, (মুজিব) এর পরে শিগগিরই আমি শেখের কাছ থেকে একটা কল’ পেলাম। তিনি বললেন“আমার ছেলে জামাল আমার বা তার মা -এর কথা শােনে না। একমাত্র আপনি তাকে গড়ে তুলতে পারেন কারণ আপনার জন্য তার রয়েছে সর্বোচ্চ সম্মান। আমি তাকে আরও পড়াশুনার জন্য আপনার কাছে পাঠানাের প্রস্তাব করছি। তাকে যে কোনও প্রতিষ্ঠানে দিন কিন্তু তাকে আপনার বাড়িতে রাখুন এবং তার চরিত্র গড়ে তুলুন ।
আমি আশা করি এটা আপনার বা আপনার স্ত্রীর জন্য খুব বেশি অসুবিধাজনক হবে না।” আমি বললাম- “জামাল অবশ্যই আসতে পারে। তাকে এখানে পাঠান এবং তার সম্বন্ধে সকল উদ্বেগ ঝেড়ে ফেলুন। সে একটা সাহসী ছেলে এবং সে জীবনে ভাল করবে । আমি মিলিটারি একাডেমিতে তার ভর্তির জন্য চেষ্টা করব। এবং তাকে বাংলাদেশ আর্মির একজন অফিসার হিশাবে আপনার কাছে ফেরত পাঠাব ।” তিনি বললেন- “সেটা ভাল হবে।” সংশি-ষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে আমি জানতে পারলাম যে কেবলমাত্র বিশেষ কতগুলি শিক্ষাগত যােগ্যতা অর্জন করা থাকলেই জামালকে আইএমএ-তে ভর্তি করানাে যেত। আমলাতন্ত্র কোনও ব্যতিক্রম মানে না। আমি খুব হতাশ হলাম। এখানেই একজন ক্ষমতাবান নেতার কৃতজ্ঞতা অর্জন করার সুযােগ ছিল এবং আমি এমনই ক্ষুদ্র মনের যে। আমি সুযােগটা গ্রহণ করতে পারছি না! এমন সময় মার্শাল টিটো বাংলাদেশ সফর করলেন। আমার এই দুর্ভাগ্যজনক অবস্থা থেকে আমাকে বাঁচালেন তিনি। সফর শেষে শেখকে তিনি বললেন জামালকে যুগাে-ভি একাডেমিতে কমিশনিং -এর জন্য পাঠাতে। শেখ সঙ্গে সঙ্গে রাজি হলেন। জামাল যুগাে-ভি একাডেমিতে যােগ দিল । যুগাে-ভিয়ার পথে সে দিলি-তে আমার আশীর্বাদ নিতে এসেছিল। তখন অত্যন্ত আবেগপূর্ণ হয়ে পড়েছিল সে। ভাষার সমস্যার কারণে তাকে যুগাে-ভি একাডেমি ত্যাগ করতে হল । ব্রিটিশরা তাকে স্যান্ডহার্স্ট একাডেমিতে গ্রহণ করল। তারপর শিগগিরই সে বাংলাদেশ আর্মিতে কমিশনড অফিসার হিশাবে যােগদান করল । হায়, এই সাহসী, নিরপরাধ ও সম্ভাবনাময় বালককে আততায়ীদের হাতে শেখ মুজিবসহ তার গােটা পরিবারের সঙ্গে প্রাণ দিতে হল।
বন্ধুদের বিদায়
বার্ধক্যের কারণে আমার বিদায়ের ঘণ্টা বেজে গেল ১৯৭৩ -এ ২ জানুয়ারিতে আমার অবসর গ্রহণ ধার্য হল। সেটা একটা বিষাদময় দিন। ৬২ বছর বয়সে আমি মানসিক ও শারীরিকভাবে সমর্থ ছিলাম। একটা ব্যতিক্রম হিশাবে এ বয়স পর্যন্ত আমাকে চাকরি করতে দেওয়া হয়েছিল। আমার পর্যায়ের জ্যেষ্ঠ লােকদের অবসর গ্রহণের বয়স ছিল ৫৪। সেই কঠিন মুহূর্তে ভারত সরকারের সর্বোচ্চ শক্তিশালী সচিবের একটা দল ছিল। তাঁরা বিপুলভাবে আমাদের ঐতিহাসিক বিজয়ে অবদান রেখেছিলেন। আমাদের বিদেশ সচিব শ্রী টিএন কাউল তার যােগ্যতা ও কুটনৈতিক ঋজুতায় অন্য যে কারও চেয়ে বেশি উজ্জ্বল ছিলেন। তাঁর লাইনে তিনি বিশ্বের যে কোনও স্থানের সর্বশ্রেষ্ঠগণের সমকক্ষ ছিলেন । কাউলের মতাে জাতি-গঠনকারীগণ আন্তর্জাতিক সম্মেলনসমূহে তাদের নিজ নিজ জাতির গৌরবে দীপ্তি বাড়িয়ে থাকেন। অতঃপর ছিলেন শ্রী পিএন ধর। আমি একে একে এই সব জমকালাে মানুষগুলির কাছ থেকে বিদায় গ্রহণ করলাম । আমার সহকর্মীরা ও বন্ধুরা একটা বিদায়ি ভােজের আয়ােজন করলেন। উচ্চতম কর্মকর্তাদের মধ্যে কয়েকজন যেমন মন্ত্রিপরিষদ সচিব শ্ৰী টিএন কাউল তাতে যােগ দিলেন। শ্রী আর এন কাও তার চমৎকার ইংরেজিতে আমার চাকরি জীবনের অনেক প্রশস্তি করলেন, আমাকে একজন জীবন্ত কিংবদন্তি বলে অভিহিত করলেন এবং বললেন যে সরকার অন্য কোনও রূপে আমার সেবা পেতে থাকবে । ঠিক তাই হল। সরকার আমাকে আমার অবসর গ্রহণের পর পরই মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়ের একজন উপদেষ্টা হিশাবে নিযুক্ত করল। আমি ঐ হিশাবে দুই বছর কাজ করলাম। তারপর আমার সহকর্মীদেরকে চূড়ান্ত বিদায় জানালাম। আগে আমার সম্মানে এসএসবি -এর শ্রী বিবি সাভারওয়াল -এর লেখা একটি সুন্দর মর্মস্পর্শী কবিতা আমাকে উপহার দেওয়া হয়েছিল। আমার অবসর গ্রহণে আমার সহকর্মী ও স্টাফদের অনুভূতি একটা কবিতার মাধ্যমে জানতে পারা দারুণ একটা আনন্দের ব্যাপার ছিল। তারপর আমাকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর কক্ষে নিয়ে যাওয়া হল । তাকে বিদায় জানানাের জন্য আমি তার সঙ্গে সাক্ষাতের অনুরােধ করেছিলাম। তিনি অত্যন্ত সদয় ছিলেন। আমার চাকরিজীবনে আমি যা কিছু করেছি সেসবের জন্য তিনি উচ্চ প্রশংসা করলেন। বিশেষত বাংলাদেশে আমার কাজের ব্যাপারে তিনি বললেন-“বাংলাদেশে আমাদের সকল সাফল্যের মেরুদণ্ড ছিলেন আপনি।” আমার। চাকরির সমাপ্তিতে এসব কথার দ্বারা আমি নিজেকে ভাল রকম পুরস্কৃত বলে অনুভব করলাম। তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসতে আসতে আমি তাঁর প্রতি মাথা নত করলাম । উত্তরে তিনিও মনােমুগ্ধকর ভঙ্গিতে মাথা নিচু করলেন। এবং এর সঙ্গে আমার। সামরিক চাকরির সম্পূর্ণ সমাপ্তি হয়ে গেল ।
সূত্র : ফ্যান্টমস অব চিটাগং-দি ফিফথ আর্মি ইন বাংলাদেশ – মেজর জেনারেল (অব.) এস এস উবান