টাইম, ২৪ মে ১৯৭১
পাকিস্তান
বিনষ্ট ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার প্রয়াস
“আমাদের কালিমালিপ্ত করা হয়েছে,” পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর গোয়েন্দা প্রধান ঘোষণা করেন। মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আকবর খান। জেনারেলের কাছে করাচিতে দেড় ডজন বিদেশী সাংবাদিক পূর্ব পাকিস্তানে সাত সপ্তাহ ধরে বাঙালি বিদ্রোহ দমন করার প্রচেষ্টায় সেনা নিষ্ঠুরতার ব্যাপক রিপোর্ট উল্লেখ করে জানতে চাওয়া হলে তিনি একথা বলেন। “বানানো সংবাদ বিদেশী সংবাদ এবং রেডিও প্রচার করছে,” সরকার ধারাবাহিকভাবে আসল ঘটনার বিবরণ দিয়েছে এবং চারদিনের দ্রুত হেলিকপ্টার সফরে “সঠিক” গল্প জানানো হবে – বলে তিনি জানান।
শান্তি কমিটিঃ পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। দমন অভিযানে মার্চ থেকে অন্তত ২০০০০০ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে – তাদের সব বাঙালি। উপরন্তু, আরও ১৫০০০০০ জন বাঙালি ভারতে পালিয়ে যান এবং যারা এখনো আছেন তারা দুর্ভিক্ষ অভাবের মধ্যে ছেবে আছেন যা নিয়ে সরকার পক্ষের কোন উদ্বেগ আছে বলে মনে হচ্ছে না। পূর্ব পাকিস্তান ট্রাজেডি জেনারেল টিক্কা (যার মানে “লাল গরম”) খানের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে। সেনাবাহিনী বলছে তারা পূর্ব পাকিস্তানকে রক্ষা করছে ধ্বংসের হাত থেকে। তারা আরও বলেন বিদ্রোহীরা আসলে ভারতের সঙ্গে অনেক বৃহৎ ষড়যন্ত্রেে নেমেছে। নাৎসি স্টর্ম ট্রুপারদের মত এটা একটা রণকৌশল। পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনী রক্তগঙ্গা প্রতিরোধ করতে বাধ্য হচ্ছে মাত্র।
সাংবাদিক দের সফর সাবধানে দেখাশোনা করা হয় যাতে সরকারের অভাবনীয় কাহিনী অন্তত বিশ্বাসযোগ্য বানানো হয়। ছয়জন সংবাদমাধ্যমকর্মীর সাথে পাহারা দেয়ার জন্যে যে কয়জন সেনা পাঠানো হয়েছিল, তারা টিক্কা খানের ট্যাংক আর যুদ্ধবিমানের হামলায় পোড়া ও ধ্বংসপ্রাপ্ত বাঙ্গালীদের বাড়িঘর ও অন্যান্য ধ্বংসচিত্র না দেখানোর জন্য চেষ্টার কোন কমতি রাখেনি। পাকিস্তানীরা নৃশংসতার দৃষ্টান্ত ঢেকে রাখার সুযোগ পায়নি। নাটোরে, এটি ঢাকার উত্তর-পশ্চিম দিকের একটি শহর, সাংবাদিকদের শান্তি কমিটির লোকেরা অভ্যর্থনা জানায়। এই দল আর্মিদের তৈরি। কমিটির লোক নিকটবর্তী গ্রামে ণয়ে যান যেখানে, ৭০০ থেকে ১৩০০ লোককে বাঙ্গালীরা জবাই করেছিল। সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল একটি কুয়া যেটি মানুষের কঙ্কাল এবং পচা মাংস দিয়ে ভর্তি । এক শান্তি কমিটির লোক বলেছিলেন: “তোমরা যেমন নৃশংসতার কখনো দেখনি!”
সেনাবাহিনী সাংবাদিকদের তাদের নিজেদের ইচ্ছামত চারপাশে ঘুরে দেখতে দিতে চাচ্ছিলনা। টাইম পত্রিকার প্রতিবেদক লুই Kraar গত সপ্তাহে রিপোর্ট করেন , “আমি নাটোরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। একজন দাড়িওয়ালা শান্তি কমিটির লোক কেউ যখন আমার সাথে কথা বলতে আসছিল তাকেই বাঁধা দিচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত আমি সেই লোকের থেকে বিচ্ছিন্ন হলাম এবং সেখানকার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় গেলাম। জায়গাটা সম্পূর্ন ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। এক গাদা ধ্বংসস্তুপ ও ছাই পড়ে আছে। হাঁটতে হাঁটতে এক তরুণ আমার কাছে এসে বলল সে একজন ছাত্র। সে বলল ‘আমরা আর্মির ভয়ে আতংকিত থাকি। আপনি আসার আগ পর্যন্ত তারা মানুষকে মারছিল।’
পারফেক্ট অর্ডারঃ দেখতে পেলেন হত্যার ধরণ সর্বত্র একই রকম। সরকারি বাহিনী নিজেদের ইচ্ছামত যা খুশি করেছে। বাঙ্গালী অধিবাসিরা মোট হত্যা – প্রায় ২০০০০ এর হয়ত ১০% অবাঙালির উপর প্রতিশোধ নিতে পেরেছে। এবং তারপর সেনাবাহিনী এসে সবকিছু শেষ করে দিয়ে গেছে। ঢাকার উত্তরে ময়মনসিংহে, পাকিস্তানি জেট বিমান দ্বারা এবং দুই টি আমেরিকান এম 34 ট্যাঙ্ক দ্বারা পাঁচ ঘন্টা গোলাবর্ষণ ও শেলিং করা হয়েছে। ময়মনসিংহ এখন শুধু ধ্বংসাবশেষ রয়েছে এবং তার প্রাক গৃহযুদ্ধ জনসংখ্যার প্রায় ৯০% লোক পালিয়ে গেছেন বা হত্যা করা হয়েছে। টিক্কা খান যথার্থ বলেছেন , “আমরা নিখুঁত আইন-শৃঙ্খলা চাই”।