বাংলার বাণী
ঢাকা: ৭ই অক্টোবর, রোববার, ২০শে আশ্বিন, ১৩৮০
আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ
গত শুক্রবার বিশ্ব শিশু দিবস পালিত হয়েছে। বাংলাদেশ পরিষদের শিশু কল্যাণ পরিষদ আয়োজিত ‘গ্রামীণ শিশু’ শীর্ষক এক আলোচনা সভার উদ্বোধন করেছেন আমাদের শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী উদ্বোধনী ভাষণে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘দারিদ্র্যই আমাদের গ্রামীণ শিশুদের লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। তাই গ্রামীণ মানুষের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার জন্য আমাদের সর্বাগ্রে প্রচেষ্টা চালাতে হবে।’ শিক্ষামন্ত্রী তার বক্তব্যের একাংশে পরিসংখ্যান দিতে গিয়ে বলেছেন, আমাদের দেশে বর্তমানে ষাট লাখ শিশুর প্রাথমিক বিদ্যালয় যাওয়ার উপযোগী, কিন্তু পারিবারিক অর্থনৈতিক কারণে বহু শিশু বিদ্যালয় যেতে পারে না। প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা যায় কিন্তু দেশে এমন বহু পরিবার রয়েছে যারা তার সন্তানের উপর নির্ভরশীল ফলে তাকে যদি বিদ্যালয় বাধ্যতামূলকভাবে আনা হয় তাহলে তার পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ করবে কে।’ তাই মন্ত্রীর অভিমত হলো আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতিকে দ্রুত উন্নত করে গড়ে তুলতে হবে এবং যে সীমিত সম্পদ রয়েছে তার দ্বারা শিশুদের ভবিষ্যৎ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি গ্রাম ও শহরের দূরত্ব কমিয়ে উভয় প্রকার জীবনের অগ্রগতি সাধন মনোনিবেশের কথাও বলেন। বিশেষ করে গ্রামীণ জীবনের মানোন্নয়নের তিনি সর্বাগ্রে যোগ দেয়ার পক্ষপাতি বলে ঘোষণা করেন।
বাংলাদেশের আগামী দিনের যারা নাগরিক সেই শিশুদের ভবিষ্যৎ সত্যিই একটা অনিশ্চিতের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। এদেশের শিশুদের জীবনের সত্যিকারের মূল্যায়ন কোনদিন হয়নি। তাদের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য বাস্তব কোনো কার্যক্রম অতীতেও নেওয়া হয়নি, আজো হচ্ছে বলে মনে হয় না। আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তারাই এদেশ গড়বে। তাদেরকে যদি আজকের সমাজ একটি মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে প্রাথমিকভাবেও গড়ে যেতে না পারে তাহলে যেমন বিলুপ্ত হবে আজকের সমাজ গঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত মানুষের ঐতিহ্য তেমনি ভবিষ্যৎ নতুন সমাজের স্বপ্ন হবে অলীক। আমাদের কতৃপক্ষের এখন থেকেই একটি মহৎ সুদুরপ্রসারী কার্যক্রম গ্রহণ করা দরকার যাতে করে আজকের শিশুদের রোগ ধরা কুশিক্ষা অশিক্ষার অভিশাপ মোচনের পথ সুগম হয়। এখন থেকেই নতুন জাতীয় সমাজ গঠনের প্রত্যয় এর পরিপ্রেক্ষিতে শিশুদেরকে নব মানসিকতায় গড়ে তোলা আবশ্যক। কতৃপক্ষ অর্থনৈতিক সচ্ছলতার সোনার হরিণ চিন্তা করে আজকের লক্ষ লক্ষ শিশুর ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে পারেন না।
জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী
আজ জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের (জি ডি আর) চব্বিশতম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। উনপঞ্চাশ সালের সাতই অক্টোবর বিশ্ব মানচিত্রে অভাবনীয় সম্ভাবনার স্বাক্ষর নিয়ে এ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়। জন্মলগ্ন থেকেই সমস্যা ও সংকটের পাহাড় ঠেলে এগুতে হয় পূর্ব জার্মানিকে। বলতে গেলে একবারে শূন্য থেকে যাত্রা করতে হয়েছে। চরম সংকট ও সমস্যার মুখে জার্মান বাসীরা সেদিন হাত পা গুটিয়ে বসে থাকেননি। দেশ গড়ার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সকলে সমবেতভাবে। সকলের সামনেই সেদিন একটিমাত্র লক্ষ্য ছিল আর সে লক্ষ্য হলো শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।
দীর্ঘদিনের পথ পরিক্রমায় অনেক সংগ্রাম অনেক আত্মত্যাগের বিনিময়ে পূর্ব জার্মানি আজ বিশ্ব মানচিত্র সম্মানজনক আসলে সুপ্রতিষ্ঠিত। শুধু তাই নয়, বিশ্ব মানবতার মহান পূর্ব জার্মানি বিভিন্ন সময় এগিয়ে এসেছেন সাহায্য ও সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পূর্ব জার্মানি সরকার ও দেশবাসীর যে সাহায্য ও সহযোগিতা আমরা পেয়েছি তা কোনো অবস্থাতেই ভুলবার নয়। কথায় বলে বিপদে বন্ধুর পরিচয়। পূর্ব জার্মানি বাংলাদেশের বিপদের দিনে প্রকৃত বন্ধুর পরিচয়ই দিয়েছেন। পূর্ব জার্মানি আজ জাতিসংঘের সদস্য। শিল্পোন্নয়নে ক্ষেত্রে পূর্ব জার্মানিতে অভাবনীয় অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। শুধু তাই নয় ক্রীড়া জগতেও পূর্ব জার্মানির নাম আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। একটি ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে কিভাবে ধীরে ধীরে প্রাচুর্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়, কিভাবে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যায় এ সম্পর্কিত বিষয়ে পূর্ব জার্মানির কাছ থেকে আমাদের শেখার অনেক কিছু রয়েছে। বিশেষতঃ সে দেশের জনসাধারণের অভাবনীয় আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের কাহিনী আমাদের কাছে প্রেরণার উৎসস্বরূপ। বাংলাদেশ আজ যে অবস্থা বিদ্যমান পূর্ব জার্মানিতেও তাই একদিন ছিল। একটা দেশের জনসাধারণের অটুট মনোবল থাকলে অভাব-অভিযোগ, সমস্যা ও সংকট চেয়ে কিছুই নয় তার জ্বলন্ত প্রমাণ হলো পূর্ব জার্মানি।
গত শুক্রবার পূর্ব জার্মানির চব্বিশতম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে সে দেশের রাষ্ট্রদূত মিঃ লোথার ওয়েনজেল বলেন যে, বাংলাদেশের সংবিধানের মতো তার রাষ্ট্রের সংবিধান যারা স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছেন অথবা যারা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়ছেন তাদের সংগ্রামের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন দানের বিধান রয়েছে।
মিঃ ওয়েনজেলের বক্তব্য তার একার নয়। এ বক্তব্য সারা পূর্বজার্মানিবাসীর। সে পরিচয় যেমন আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পেয়েছি, স্বাধীনতা লাভের পরও তেমনি পাচ্ছি। পূর্ব জার্মানি উদারহস্তে সাহায্য-সহযোগিতা করে যাচ্ছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে। পারস্পারিক সাহায্য সহযোগিতা ও সহমর্মিতা ভিত্তিতে যে বন্ধুত্বের সেতুবন্ধ রচিত হয়েছে দু’টো দেশের মধ্যে তা চিরদিন অক্ষুন্ন থাকবে এ বিশ্বাস আমাদের রয়েছে। জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের চব্বিশতম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর এ দিনটিতে আমরা কামনা করি সে দেশের আগামী দিনের যাত্রা পথ শুভ হোক। সুন্দর হোক।
রেশন ডিলারদের কারচুপি
গতকালকের স্থানীয় দুটি দৈনিকের দুটি খবর। একটিতে অভিযোগ অন্যদিকে সান্তনার বানী। অভিযোগ একশ্রেণীর রেশন ডিলার ও তাদের পোষ্য ভুয়া রেশন কার্ড ধারীদের দৌরাত্ম্যে রাজধানীর নাগরিক জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এবং পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, এর প্রতিকারের জন্য জনগণ সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর শরণাপন্ন হতে বাধ্য হচ্ছে।
প্রকাশিত খবরে জানা যায় এই সমস্ত রেশন দোকান মালিক সপ্তাহের চাউল আনার পূর্বেই ভুয়া রেশন কার্ডের মেমো কেটে রাতারাতি চাল, গম, চিনি, তেল ইত্যাদি কালোবাজারে পাচার করে দেয়। গত শুক্রবার যাত্রাবাড়ী এলাকার একটি রেশন দোকান থেকে এক বস্তা চাউল পাচারের সময় স্থানীয় জনসাধারণ হাতেনাতে ঘটনার নায়ক কে পাকড়াও করে।
অপরদিকে বিগত এক মাস নাগাদ রেশনের চাল বিতরণ না করার দরুন বাজারে চালের দাম বেড়ে গিয়েছে। বিশেষ করে রোজা ও পূজা শুরু হবার সাথে সাথে অস্বাভাবিক ভাবে অন্যান্য জিনিসপত্রের সঙ্গে চালের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণে রেশনের চাল দেয়া হলে চালের দাম কমবে এবং একটা স্থিতিশীল অবস্থায় আসবে বলে ব্যবসায়ী মহল এবং জনগণ মনে করেন।
গতকালকের যে দৈনিকটিতে কিছুটা আশ্বাসের বাণী পাওয়া গেছে তাতে খাদ্য মন্ত্রী বলেছেন, আগামী মঙ্গলবার থেকে রেশনে নিয়মিত চাল দেয়া হবে। তিনি আরো জানিয়েছেন জাপান থেকে প্রায় চার হাজার দু’শ টন চালবাহী প্রথম জাহাজটি শনিবার (গতকাল) চট্টগ্রাম এসে পৌছবে। চার হাজার তিপ্পান্ন টন চালবাহী দ্বিতীয় জাহাজটি আগামীকাল (সোমবার) নাগাদ’ এসে পৌঁছাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এছাড়াও প্রায় এগারো হাজার টন চালবাহী আরেকটি জাহাজ চলতি মাসের পনেরো তারিখ নাগাদ এসে পৌছবে বলেও খাদ্যমন্ত্রী তথ্য প্রকাশ করেছেন।
আমরা জানি সরকার বিশেষ করে খাদ্য ভাব দূর করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং তার ফলে বিদেশ থেকে মোটামুটি সন্তোষজনক পরিমাণ চাল এর ব্যবস্থা করছেন। কিন্তু তবু খাদ্যাভাব কমছে না কেন? কেন অভিযোগ আসে রেশনের চাল ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না?
আমাদের প্রশ্নও তাই। আমরা মনে করি বিদেশ থেকে আনা চাল রেশনের দোকানে দোকানে পৌছবে; সত্যিই কিন্তু তা যদি সঠিকভাবে বিতরণ করা না হয় যদি অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যে অন্ধকার পথ দিয়ে সেগুলো পাচার হয় তাহলে যত অধিক পরিমাণেই বিদেশ থেকে চাল আনা হোক না কেন চালের বাজার দর কমবে না এবং রেশন কার্ডধারীদেরও দুর্ভোগ নিরসন হবে না।
এমতাবস্থায় রেশন দোকান মালিকদের কারচুপি বন্ধ করে রেশন দোকান গুলো থেকে যাতে সুষ্ঠুভাবে চাল প্রকৃত কার্ডধারীদের মাঝে বিতরণ করা হয় তার নিশ্চিত ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা আশা করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়টিতে কড়া নজর দিয়ে নাগরিক জীবনের দুর্বিসহ যন্ত্রনা দূর করতে তথা সারাদেশের খাদ্যাভাব নিরসন করতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে এতোটুকু কুন্ঠিত হবেন না।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক