You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.10.06 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | একদিকে অস্ত্রের প্রতিযোগিতা অন্যদিকে বাঁচবার সংগ্রাম | প্রশংসনীয় উদ্যোগ | কিসিঙ্গারের বোধোদয় | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ৬ই অক্টোবর, শনিবার, ১৯শে আশ্বিন, ১৩৮০

একদিকে অস্ত্রের প্রতিযোগিতা অন্যদিকে বাঁচবার সংগ্রাম

জাতিসংঘের মহাসচিব ডঃ কুর্ট ওয়াল্ড হেইম সম্প্রতি তাসের একজন প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে একটি গুরুত্বপূর্ণ সোভিয়েত প্রস্তাবের প্রতি তার অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য ভুক্ত উন্নত দেশগুলোর প্রতি সোভিয়েট ইউনিয়নের প্রস্তাব ছিল সামরিক খাতে ব্যয় বরাদ্দ শতকরা দশ ভাগ কমিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তার সাহায্য হিসেবে দেয়ার। মহাসচিব ডঃ কুর্ট ওয়াল্ড হেইম-এর এই প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন নিঃসন্দেহে বিশ্ব রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তিনি বলেন ‘জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য দেশগুলোর সামরিক ব্যয় বরাদ্দ শতকরা দশভাগ কবিতা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সাহায্য হিসেবে প্রস্তাব সোভিয়েট ইউনিয়ন এনেছে তা একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ।’ সোভিয়েত ইউনিয়ন জাতিসংঘের সাবেক অনুমোদনের ওপর ভিত্তি করেই এ প্রস্তাব উত্থাপন করেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যা কথা বলতে গিয়ে ডঃ ওয়াল্ড হেইম বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যার একটি সম্মানজনক রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হবে। তাকে সোভিয়েত বিদেশমন্ত্রী মিঃ আঁদ্রে গ্রোমিকোর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ভাষণের উপর মন্তব্য করতে বলা হলে তিনি বলেন, ‘মিঃ গ্রোমিকোর ভাষণ ছিল সম্পূর্ণ বাস্তবমুখী ও গঠনমূলক। তার ভাষণে জাতিসংঘের কার্যক্রমে স্বপক্ষের সমর্থন ছিল।’
বস্তুতপক্ষে বিশ্বের বর্তমান বৃহৎ শক্তির অস্ত্রের প্রতিযোগিতার মুখে মহাসচিব ডঃ কুর্ট ওয়াল্ড হেইম এর উল্লেখিত এ অভিমত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সুদুরপ্রসারী বলে আমরা মনে করি। বিশ্বের বড় বড় শক্তি তাদের সামরিক খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানোর প্রতিযোগীতা আজ মেতে উঠেছে। একদিকে প্রাচুর্যের পাহাড় গড়ে তোলা হচ্ছে অন্যদিকে কোটি কোটি মানুষ অর্ধাহারে অনাহারে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। একদিকে মানুষ বাঁচবার জন্য লড়াই করছে অন্যদিকে মানুষকে মেরে ফেলে দেবার জন্য আধুনিক অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা চলছে। এক বিশ্বের মানুষ শান্তি আর মুক্তি সংগ্রাম করছে আর অন্য বিশ্বের মানুষ শান্তি আর মৈত্রী কবুতরকে প্রতিনিয়ত নিহত করছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা গোটা এশিয়ার শান্তি ও মৈত্রীর অন্যতম প্রতীক আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ সত্য বিশ্বের শান্তি ও প্রগতিশীল মানুষ মাত্র স্বীকার করে নিয়েছে বঙ্গবন্ধুকে যখন শান্তির দূত হিসেবে প্রখ্যাত শান্তি পুরস্কার দেয়া হয় তখন তিনি বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন মরন অস্ত্র তৈরি প্রতিযোগিতা বন্ধ করার জন্য। তিনিও সেদিন বলেছিলেন-“আপনারা মানুষ মারার জন্য যে মারণাস্ত্র তৈয়ার করছেন, যার জন্য আপনারা দেশের সম্পদকে অধিকাংশ ব্যয় করছেন তা অবিলম্বে বন্ধ করে বিশ্বের শতাধিক কোটি লোককে অর্ধাহারে-অনাহারে অভিশাপ থেকে বাঁচাবার জন্য সাহায্য করুন।”
আলজিয়ার্সে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জোট-নিরপেক্ষ সম্মেলনে ভাষণ দিতে গিয়েও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দৃপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করেছেন, “তৃতীয় বা চতুর্থ বিশ্বের কথা বুঝি না, বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত-এক শোষক, অন্যরা শোষিত। এই শোষিত বিশ্বমানবত্মাকে বাঁচানোর সংগ্রামই আজ জাতিসংঘের অন্যতম কাজ বলে আমরা মনে করি। সেইসঙ্গে সোভিয়েট ইউনিয়নের প্রস্তাবের প্রতি আমরা সমর্থন জানিয়ে বলি, আর অস্ত্রের ঝনঝনানি নয় আর যুদ্ধ করার বা শক্তি বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা নয়-এবার অভুক্ত মানুষের কল্যাণের জন্য উন্নত দেশসমূহ এগিয়ে আসুন। মানবতার জয়গান মুখরিত হোক।

প্রশংসনীয় উদ্যোগ

গত ২৮শে সেপ্টেম্বর থেকে আরেকটি চুক্তি কার্যকর হয়েছে। নতুন চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশ এবং বন্ধুরাষ্ট্র ভারত উভয়ে ২২ লক্ষ টাকা মূল্যের বই, সংবাদপত্র, সাময়িকী ইত্যাদি বিনিময় করতে পারবে। একটি সহজ পদ্ধতিতে এই বিনিময় সম্পাদন করা যাবে বলে চুক্তিতে ঘোষণা করা হয়েছে।
নতুন চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সহজে ও দেশের বই, পত্রপত্রিকা ও সাময়িকী ইত্যাদি আমরা পাব এবং সেসবের মাধ্যমে সে দেশের বুদ্ধিজীবীদের সমসাময়িককালীন ধারণা ও চিন্তাভাবনা সম্পর্কে আমরা অবগত হতে পারব। তেমনিভাবে তারাও আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে জানতে পারবেন বুঝতে পারবেন। এতে করে দুটো দেশের মানুষের চিন্তা ও মননের যে আদান প্রদান এবং লেনদেন ঘটবে তাতে করে উভয় দেশের মানুষের মুক্ত চিন্তা ভাবনার বিকাশ সাধনে পথ আরও সহজ করে দেবে। এর ফলে দেশের মানুষ উভয়কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বুজবার অবকাশে শুধু পাবে না, বরং একটি উদাহরণ ভঙ্গি প্রতিফলন ঘটবে সারা বিশ্বও। প্রাসঙ্গিকক্রমে উল্লেখ করতে হয়, তদানীন্তন পাক আমলে বিগত দিনগুলোতে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী ধর্মীয় জিগির তুলে একই ভাষা ও সংস্কৃতি বন্ধনে আবদ্ধ দুটি দেশের মানুষের মধ্যে একটা বিরাট ব্যবধান সৃষ্টি করেছিল। শুধু তাই নয়, বাঙালি সাহিত্য-সংস্কৃতি কালপুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বাংলাদেশের মানুষের অন্তর থেকে জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে ঝিলামের পানিতে বিসর্জন দেবার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়েছে বার বার। দীর্ঘ দুই যুগের অধিককাল পরে হলেও স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের এই বাল্য বয়সে ওই দেশের মানুষের সঙ্গে খোলা মন নিয়ে সমসাময়িক ধ্যান-ধারণা ও চিন্তাভাবনার আদান-প্রদান ঘটলে তা উভয়ে পক্ষেই লাভজনক হবে। এবং এই জন্যই আমরা মনে করি নতুন চুক্তিটি একটি ফলপ্রসূ উদ্যোগ।
বিপদে যে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়ে পাশে এসে দাঁড়ায় সেই না প্রকৃতি বন্ধু। আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারত সেই বন্ধুত্বের হাত সম্প্রসারিত করেই এগিয়ে এসেছিল। এবং তাই ওরা আজ আমাদের পরম বন্ধু। যুদ্ধের ধ্বংসলীলায় রক্তধারায় উভয় দেশের যে মৈত্রী বন্ধন গড়ে উঠেছে আমরা মনে করি নতুন চুক্তি বাস্তবায়নে সেই বন্ধন আরো সুদৃঢ় হবে। কেবলমাত্র ব্যবসায়ী দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং তার মুক্তির নিমিত্তে পত্র-পত্রিকা, বই ও সাময়িকী ইত্যাদির আদান-প্রদান হবে এবং উভয়ের দেশে এগুলো পারস্পরিকতা সাধনের প্রেক্ষিতে মূল্যায়িত হবে বলেও আমরা মনে করি। অবশ্য সেজন্য উভয় দেশ কে সজাগ থাকতে হবে অবশ্যই যাতে উন্নত বই-পুস্তক, পত্র-পত্রিকা সহজ লেনদেনের স্রোতে আবর্জনাময় অখাদ্য অপ্রাসঙ্গিক অপ্রয়োজনীয় বইপত্র ও পত্রপত্রিকার বিনিময় না ঘটে।
নতুন চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের রাখি বন্ধন চির অটুট হোক সেটাই আমরা প্রত্যাশা করি।

কিসিঙ্গারের বোধোদয়

যুদ্ধবাজ আর সমরাস্ত্র বিক্রয়ের রাজনীতিতে বিশ্বাসী মার্কিন নেতাদের শেষটায় যেন বোধোদয় হতে শুরু করেছে। গতকালকের পত্রিকায় প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে যে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ হেনরি কিসিঙ্গার ওয়াশিংটনে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিংয়ের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, পাকিস্তানের শক্তি ভারতের শক্তি সমকক্ষ হওয়ার দরকার নেই, উচিত নয়। তিনি আরো বলেছেন যে, ভারতের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রের প্রয়োজন পাকিস্তানিদের প্রয়োজনের চাইতে অনেক বেশি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবসময়ই একথা স্বীকার করে এবং সে দিক থেকে পাকিস্তানকে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ভারতের সমান হতে হবে একথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে না। ডঃ কিসিঙ্গার এই বক্তব্য যদি মার্কিন সরকারের বোধোদয় এর প্রেক্ষিতেই ব্যর্থ হয়ে থাকে তবে তা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের জন্য অবশ্যই কিছু না কিছু আশার বাণী বয়ে আনবে, একথা জোরের সাথেই বলা যায়। কিন্তু যদি তারা এ ধরনের বক্তব্য রেখে সেই বক্তব্যের প্রতি সার্থবোধক হতে পারে এমন কোন কাজ করেন, তবে তা হবে মর্মান্তিক। বস্তুত আজকের বিশ্বে যেখানেই যে কোনো হানাহানি, গৃহযুদ্ধ, সীমান্ত সংঘর্ষ সহ উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ রয়েছে মার্কিন সমরাস্ত্র সেখানে হাজির হয়েছে, মার্কিন সমরাস্ত্রের ছড়াছড়িতে সেখানেই পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে, রক্তের হোলি খেলায় লালে লাল হয়ে গেছে সেখানকার মাটি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পাকিস্তানী সেনারা মার্কিন ও চীনাদের সর্বাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত হয়েই এই দেশের ৩০ লক্ষ নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে আজকের দিনে থেকে থেকে যে অস্ত্রের ঝনঝনানি বিশ্বমানবতাকে আতঙ্কগ্রস্থ করে তুলেছে সেই অস্ত্র মার্কিন মুল্লুকেই তৈরি। মার্কিনিদের চক্রান্তেইতো চিলিতে সালভেদর আলেন্দে পাবলো নেরুদা সহ লক্ষ লক্ষ লোক হত্যা করে গৃহযুদ্ধ বাঁধানো হলো। ইন্দোনেশিয়ার তিন লাখ মানুষের রক্ত ঝরিয়েছে সেই একই মার্কিন সমরাস্ত্র। সর্বোপরি সেই একই মার্কিন অস্ত্র তো আজ পাকিস্তানের ভুট্টোর হাতকে শক্তিশালী করে উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ কে বিঘ্নিত করছে। এমতাবস্থায় কিসিঙ্গার সারেবের বক্তব্য কি মূলত তার নিজস্ব মর্যাদা রাখবে?
কিসিঙ্গার সাহেব আরো বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে নতুন করে কোনো অস্ত্র দেবে না। পাকিস্তানের ভুট্টো তার সাম্প্রতিক ওয়াশিংটন সফরকালে নিক্সন সাহেবের কাছে অস্ত্র জন্য যে বায়না ধরেছেন নিক্সন সাহেব তার রাখেননি। এটা যদি সত্যিকার অর্থে না রাখা হয় তবে এ উপমহাদেশের মানুষ অবশ্যই নিক্সন সরকারকে ধন্যবাদ জানাবে। কিন্তু যদি সরাসরি অস্ত্র না দিয়ে মার্কিন সরকার তাদের পশ্চিম এশিয়ার প্রধান লেজুড় ইরানের শাহের মাধ্যমে সেই অস্ত্র পাঠান তবে কি কোন অংশে কম মর্মদ্ভদ হবে? আমরা আশা করব কিসিঙ্গার সাহেব যা বলেছেন, তার সরকার সে কথার মর্যাদা রাখতে ব্রতী হবেন।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন