ওয়াশিংটন পোস্ট, ১৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭১
পূর্ব-বাংলার যুদ্ধের সমাপ্তি- হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়ে ভারতীয়দের ঢাকা প্রবেশ
ঢাকা, ডিসেম্বর ১৬- হাজারো বাঙালীর “জয় বাংলা” (বাংলার জয়) ধ্বনির মধ্য দিয়ে ভারতীয় সৈন্য বাহিনী আজ ঢাকায় প্রবেশ করেছে।
মেজর-জেনারেল গান্ধার নাগরার নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানী গেরিলা এবং ভারতীয় সৈন্যদের মিত্রবাহিনী আজ ঢাকার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে একটি সেতু আক্রমণ করেছে এবং এরপরই খবর পেয়েছে যে এখানকার পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দ ভারতের দেওয়া আত্মসমর্পণ এর প্রস্তাব মেনে নিয়েছে।
নাগরা বলেছেন তিনি স্থানীয় সময় সকাল ৮.৩০ টায় (পূর্বাঞ্চলীয় বুধবার রাত ১০টা) শহরের অপর প্রান্তে অবস্থিত পাকিস্তানি সেনা সদর দপ্তরে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন এবং সাথে সাথেই প্রত্যত্তরে তাঁকে জানানো হয়েছে এরপর পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আর কোন বাঁধা দেওয়া হবে না। এরপর তিনি তার সৈন্যদল নিয়ে শহরে প্রবেশ করেন।
সকাল প্রায় ১০টার দিকে তিনি এখানকার পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর প্রধান লেফটেনেন্ট জেনারেল এ.এ.কে. নিয়াজীর সাথে দেখা করেন। “আমরা পুরনো বন্ধু”, বলেন নাগরা, “কলেজের দিনগুলো থেকেই”।
ভারতীয় জেনারেল এরপর ঢাকা বিমানবন্দরে গিয়ে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল জে.এফ.আর জ্যাকব এর আগমণ এর অপেক্ষা করেন, যিনি তাঁর কলকাতার সদর দপ্তর থেকে হেলিকপ্টারযোগে আসেন।
বিমানবন্দরে, জেনারেল মাত্র তিনজন ভারতীয় সৈন্য পাশে রেখে দাঁড়িয়ে তাঁর কাঠের তৈরী হাঁটার লাঠিটি ঘোরাচ্ছিলেন, একই সময়ে রানওয়ের দূরবর্তী প্রান্তে পাকিস্তানি বিমানবন্দর রক্ষী বাহিনী তাদের আত্মসমর্পণ এর স্থানে যাওয়ার জন্য একত্রিত হচ্ছিল।
রাস্তায় পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী সংখ্যায় ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর চেয়ে অনেক বেশি ছিল, কয়েক ঘন্টা ধরে বিচ্ছিন্ন গোলাগুলি হয়েছে, এবং বেশ কিছু পাকিস্তানি এবং ভারতীয় সৈন্য মৃত্যুবরণ করেছে, যার মধ্যে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের বাইরে গুলি করে হত্যা করা একজন ভারতীয় কর্মকর্তাও আছেন।
মুক্তিবাহিনী- পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সদস্যরাও উৎসবমুখর সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে গিয়ে আনন্দ উল্লাস করতে থাকে এবং তাদের বন্দুক থেকে বাতাসে গুলি ছুঁড়তে থাকে।
নাগরা ৯৫তম মাউন্টেন ব্রিগেডের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার এইচ. এস. ক্লারকে নিরপেক্ষ এলাকা হিসেবে “রেড ক্রস” দেওয়া ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে পাঠান বিদেশি এবং প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তানি সরকারী কর্মকর্তাদের রক্ষার চেষ্টা করতে, যারা সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
ক্লার এর গাড়ি যখন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, তখন তার গাড়ির উপরে বারবার উৎসুক বাঙালীরা ঝাঁপিয়ে পড়ছিল। এক পর্যায়ে তারা গাড়ির চালককে ঝটকা টান দিয়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে ফেলতে চেষ্টা করে এবং ক্লার নেমে আসেন, শুধুমাত্র বাঙালীদের তাঁকে আলিঙ্গনের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য, যাদের মধ্যে একদন তাঁর হাতে কিছু গাঁদা ফুল গুঁজে দেয়।
“ধন্যবাদ, ধন্যবাদ” বাঙালীরা চিৎকার করতে থাকে তার দিকে।
নাগরা এবং ক্লার মাত্র দুইটি সৈন্যদলের চেয়ে কিছু বেশী সৈন্য নিয়ে ৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সীমানা অতিক্রম করে উত্তর প্রান্ত থেকে যুদ্ধ করে এসে ঢাকায় প্রবেশ করেন।
তাঁরা ১৬০ মাইল ধরে শুধুমাত্র ষাঁড় দিয়ে টানা গাড়ি এবং পায়ে হেঁটে এসেছেন, যার মধ্যে প্রতিটি শহরেই তাঁদের যুদ্ধ করতে হয়েছে।
“বড়দিনের আগে আমাদের বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমরা আপনার উপর ভরসা করছিলাম”, বিমানবন্দরে একজন সাংবাদিক নাগরাকে বললেন। “এবং আমরা তা করে ফেলেছি”, নাগরা জবাব দেন।
নাগরা বলেন তিনি যে পথে ঢাকা এসেছেন সে পথে পুরোটা জুড়েই বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল পাকিস্তানি সৈনিকদের মৃতদেহ। “এটি খুবই করুণ ছিল”, তিনি বলেন, “আমরা তাদের কবর দিতে পারি নি। আমাদের হাতে সময় ছিল না।”
“আমরা পুরো পথ জুড়েই হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়ে এসেছি”, নাগরা বলতে থাকেন, “ময়মনসিংহে আমার সব ব্যাজ উৎসুক জনতা ছিঁড়ে নিয়ে যায়।”
“আশা করছি সবকিছু শান্ত এবং শান্তিপূর্ণ আছে”, জ্যাকব বলেন, “আমরা নিশ্চয়তা দিয়েছি যে সৈন্য এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের রক্ষা করা হবে, এবং আমরা আমাদের কথা রাখতে চাই।”
প্রায় আটজন বাঙালী বিমানবন্দরের ফটক দিয়ে জোড় করে রানওয়েতে ঢুকে যায় জ্যাকবকে অভিবাদন জানাতে। “আমি কি আপনার সাথে করমর্দন করতে পারি?”, তারা একজন এর পর আরেকজন জিজ্ঞেস করল। নয় মাস ধরে তারা আমাদের ইঁদুরের মত মেরেছে”, একজন জ্যাকবকে বলল, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে।
একজন সাংবাদিক এর দিকে ফিরে একজন বাঙালী বলল, “আপনি কোন দেশ থেকে এসেছেন?”, “আমেরিকা”, সাংবাদিক জবাব দিলেন।
বাঙালী থুতু ফেলল, করমর্দন করতে অস্বীকার করে বলল, “আমরা আমেরিকার প্রতি খুশি নই”।
বাঙালীরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করল পুরো যুদ্ধ জুড়ে রাষ্ট্রপতি নিক্সন এর পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি সমর্থন এর ব্যাপারে, যা আজকের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ডেকে এনেছে।
এতদিন ধরে যে বাংলাদেশ (বাঙালী জাতি) এর স্বপ্ন তারা দেখে আসছিল তা আজ জন্ম নিল। জেনারেল বিমানবন্দরে দাঁড়ানো অবস্থায়ই জেনারেল এর সাহায্যকারীদের মধ্যে একজন বাংলাদেশ এর একটি পতাকা বহন করে নিয়ে আসেন।
পুরো রাস্তা জুড়ে সাধারণ মানুষের হাতে বাংলাদেশ এর পতাকা উড়ছিল, যারা রাস্তা দিয়ে যাওয়া প্রতিটি গাড়ি থামিয়ে করমর্দন করছিল এবং স্লোগান দিচ্ছিল।
রাস্তার কিনারা দিয়ে তখনো পরাজিত পাকিস্তানি সৈনিক এবং পুলিশরা সারিবদ্ধভাবে অস্ত্র জমা দিতে যাচ্ছিল। তাদের হাতে তখনো অস্ত্র ছিল- কিন্তু বাঙালীদের আনন্দ যেন তাদের অস্ত্রকে গ্রাহ্যই করছিল না।
পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ এবং ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর আগমণ যেন হঠাৎ হল, জনশূন্য সকালে যখন মনে হচ্ছিল পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ শম্বুক গতিতেই এগুচ্ছে, সাথে তীব্র যুদ্ধ এবং নতুন করে বিমান আক্রমণ, যার ফলে ঢাকায় অনেক ক্ষয়ক্ষতি এবং অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
শহরের উপরে ভারতের বিমান আক্রমণের বিরতি স্থানীয় সময় সকাল ৯.৩০টার ( পূর্বাঞ্চলীয় সময় বুধবার রাত ১০.৩০টা) দিকে শেষ হবার কথা, এবং সকাল ৯টার কিছু আগে জাতিসংঘ এবং রেডক্রস কর্মকর্তারা জানতে পারেন পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দের সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে এবং তারা নয়াদিল্লিতে তাদের আত্মসমর্পণ এর সম্মতিপত্র পাঠাতে পারছে না।
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন
পাকিস্তানি সেনা সদর দপ্তরে জেনারেল নিয়াজীর অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব পালনরত মেজর জেনারেল ফরমান আলী খান এক জরুরী সভায় সৈন্যদের প্রতি অস্ত্র সংবরণের আদেশ দেন, এবং জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের জানান তারা বিনা শর্তাধীনে আত্মসমর্পণ করবেন। এই বার্তা এরপর জাতিসংঘের বিশেষ বেতারবার্তার মাধ্যমে সকাল ৯টা ২০ মিনিটে নয়াদিল্লিতে পাঠানো হয়, গোলা বর্ষণ পুনরায় শুরু হবার ১০ মিনিট আগে।
আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠিত হয় স্থানীয় সময় বিকাল ৫টায় (পূর্বাঞ্চলীয় সময় সকাল ৬টা), রেসকোর্স ময়দানে, সাথে আশপাশের এলাকায় চলতে থাকে তুমুল হর্ষধ্বনি এবং বাতাসে গুলি বর্ষণ।
ভারতীয় সৈন্যভর্তি বাসগুলো সিক্ত হচ্ছিল বাঙালীদের ধন্যবাদের চিৎকারে, বাংলাদেশ এর পতাকাগুলো বেরিয়ে আসছিল লুকোনো জায়গাগুলো থেকে, যেখানে সেগুলো সযত্নে লুকোনো ছিল সেই ২৫ মার্চ থেকে, যেদিন থেকে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী এখানে শুরু করেছিল নৃশংস হত্যাযজ্ঞ।
লি লেস্যাজ