You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.02.29 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শান্তি | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী

ঢাকা: বুধবার ১৬ই ফাল্গুন, ১৩৭৯ ২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩

দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার শান্তি

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জয়পুরহাটের অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসভায় বলেন, বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশেষ করে এই উপমহাদেশে শান্তি চায়। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে সব সময় স্থায়ী শান্তির জন্য কাজ করে যাচ্ছে এবং এ ব্যাপারে তার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

বাংলাদেশ যে এই উপমহাদেশে তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনতে বদ্ধপরিকর তাতে কোন সন্দেহই আজ আর নেই। বাংলাদেশ তার জন্মলগ্নেই ঘোষণা করেছে যে কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়-সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং জোটনিরপেক্ষ নীতিতে বিশ্বাসী। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শান্তি আজ বিভিন্নমুখী সমস্যা সমাধানের ওপর নির্ভরশীল। একদিকে ইন্দোচীন ও অন্যদিকে পাকিস্তান। দু’নামেই আজকের দিনে বৃহৎশক্তি নাক গলিয়ে বসে আছে। একথা আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, দক্ষিণ ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়া এবং পাকিস্তানের কর্ণধাররা পরের মুখে ঝাল খেতেই অভ্যস্ত। এসব দেশের সরকারের পক্ষে কোনো অবস্থাতেই বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতার পক্ষে স্বাধীনভাবে কাজ করা সম্ভব নয়। দক্ষিণ ভিয়েতনাম লাও সরকার এখন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই তাদের ভাগ্যবিধাতা বলে মনে করেন। তাই তাদের লক্ষ্য হলো যাতে ইন্দোচীনের মাটি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হাতগুটিয়ে না নেয়। সুতরাং এ দুটো দেশের পক্ষে জোট নিরপেক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করা কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়। অন্যদিকে চিনও ইন্দোচীনের ব্যাপারে নাক গলিয়েছে অনেকদিন আগে থেকেই। চীনের আসল লক্ষ্য, হলো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যাতে রাশিয়া প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। এ জন্য যদি প্রয়োজন হয় তাহলে চির শত্রু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হাত মেলাতে আপত্তি নেই। কার্যতঃ হয়েছেও তাই। চীন আরো ঘনিষ্টভাবে এগিয়ে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিশেষ উপদেষ্টা ডঃ কিসিঙ্গার  এ নিয়ে এককভাবে দু’বার পিকিং সফর করলেন। সম্প্রতি মিশন বিনিময় করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে যে সুবিধা দিল তা খুবই তাৎপর্যময়। কারণ ওয়াশিংটনে তাইওয়ানের দূতাবাস রয়েছে। সেখানে পিকিং এর দূতাবাস থাকার অর্থ হলো দুই চীনকে স্বীকার করে নেওয়া। এ যাবৎ পিকিং তার বিরোধিতা করে এসেছে। শুধু তাই নয় চীন এখন আর এশিয়া থেকে আমেরিকার অপসারণ দাবি করে না। পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর থেকে সপ্তম নৌবহরের সংখ্যা কমানোর কথাও বলে না। জাপানে মার্কিন ঘাঁটির বিরুদ্ধে চীনের প্রতিবাদও এখন আর সোচ্চার নয়।

স্পষ্টতঃই বোঝা যাচ্ছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বুকে নিজেদের প্রভাব বজায় রাখার জন্য একটা সমঝোতা হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বুকে ‍চির অশান্তিকে টিকিয়ে রাখলে লাভ হবে চীন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। সাহায্য সহযোগিতার নামে তারা যেকোনো সময় নাক গলাতে পারবেন এ উদ্দেশ্যেই পারস্পরিক সমঝোতা। পাকিস্তানের ঠিক আছে কি ব্যাপার চলছে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো একথা ভালো করেই জানেন যে, এই উপমহাদেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা সম্পূর্ণভাবে ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের অভ্যুদয় আজ বাস্তব সত্য। এ বাস্তবতাকে না মেনে কোন উপায় নেই। অথচ ভুট্টো সাহেব সে বাস্তবতাকে সহজে মেনে নিতে পারছেন না।

প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর বাস্তবতা আঘাতে ভুট্টো সাহেব এসেছিলেন যে, ভারতের সঙ্গে সদ্ভাব রক্ষা করা প্রয়োজন। তাই তিনি সিমলা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। আর ঠিক সিমলা বৈঠকের আগে ও পরে সোচ্চার কণ্ঠে বলেছেন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিলে পাকিস্তানকে বিশ্বের চোখে ‘একঘরে’ হয়ে যেতে হবে।

সিমলা বৈঠকের আগে ও পরে যেটুকু চৈতন্যদয় ভুট্টো সাহেবের হয়েছিল তাও অপস্বত হলো পরবর্তী সময়ে। ভুট্টো সাহেবের ‘মুরব্বিরা’ তার এহেন বক্তব্যে বিরক্ত হলেন। নেপথ্য ভ্রুকুটির সম্মুখীন হলেন ভুট্টো সাহেব। তারপরেই ভুট্টো সাহেব আবার অন্য সুরে গান গাইতে আরম্ভ করলেন। জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যভুক্তির প্রশ্নে চীনা ভেটোর হুমকি দিলেন। চীনও পাকিস্তানকে হাতে রাখতে ভেটো প্রয়োগ করলো।

একথা আজ আর কারো বুঝতে বাকী নেই যে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোন অবস্থাতেই চায়না পাকিস্তানের সঙ্গে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো হোক। দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হয়ে পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতার পথকে প্রশস্ত করুক।

বাংলাদেশ সরকার ও জনগণ বৃহৎ শক্তিবর্গের এহেন কারসাজি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকেবহাল থাকা সত্ত্বেও একথা বিশ্বাস করে যে, এশিয়ার ছোট ছোট দেশগুলোর একদিন না একদিন চৈতন্যদিয় হবেই। আর বাংলাদেশে সবসময়ই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য কাজ করে যাবে। জয়পুরহাটের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর পুনরায় এ কথাই দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেছেন। বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। বিশ্বের তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জনগণের মুক্তি সংগ্রামের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশ একাত্মবোধ করে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন