বাংলার বাণী
ঢাকা: মঙ্গলবার ১৫ই ফাল্গুন, ১৩৭৯ ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩
বগা ভাই আর নেই
পাবনার প্রবীণ রাজনীতিক আওয়ামী লীগের সংগ্রামী সভাপতি জনাব আবদুর রব গত রবিবার সন্ধ্যায় এক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছেন (ইন্নালিল্লাহি……রাজিউন)। মৃত্যু কালে তার বয়স হয়েছিল সাতান্ন বৎসর। সুদীর্ঘ বারো বৎসর তিনি ছিলেন পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর পাবনার এই জননেতা গত স্বাধীনতা সংগ্রামে একজন নির্ভীক সেনানীর মতো দেশ মাতৃকার মুক্তি সাধনকে স্বীয় ব্রত হিসেবে গ্রহণ করে অসেম সাহসিকতা প্রদর্শন করেন।
দিলখোলা প্রাণ প্রাচুর্য পরিপূর্ণ এই সংগ্রামী নেতা ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক এবং বন্ধুবৎসল। জনগণের সুখে-দুঃখে তিনি ছিলেন তাদের সাথে একান্ত আপনজন। সর্বস্তরের মানুষ এবং তাদের সমস্যা নিয়েই ছিল তার জীবন, কর্ম এবং সাধনা। জীবনের সকল প্রাচুর্যকে তিনি দূরে ঠেলে দিয়েছেন আদর্শের প্রতি পরম নিষ্ঠায়, লোভ-লালসা কে ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করে সংগ্রাম ও নির্যাতনের পথকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন। একদিনের জন্যও তিনি বিচ্যুত হননি তার লক্ষ্য পথ থেকে।
তিনি নেই, শত ডাকেও তাকে আর আমরা আমাদের পাশে পাবো না। হাড় জিরজিরে রিক্সাওয়ালা, ওষুধ প্রস্তুতকারী শ্রমিক অথবা হোসিয়ারি শিল্প শ্রমিকরা আর তাদের যাত্রাপথে সেই সুস্থ সবল সাতান্ন বছর বয়সী তরুণকে তাদের পাশে বল ভরসার আশ্রয় হিসেবে খুঁজে পাবেনা, খুঁজে পাবেনা তার সংগঠনের কর্মীরা। একদিন যিনি নেতৃত্ব দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন আজকের দিনের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক সংগঠন, আজ তার শুধু আদর্শকে সামনে রেখে এগিয়ে যেতে হবে তার কাছে দীক্ষা পাওয়া অসংখ্য কর্মীকে। অথচ তার প্রয়োজন ছিল আজকেই সবচাইতে বেশি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার বঙ্গবন্ধুর দর্শন অনুযায়ী একে একটা শোষণহীন সুখী-সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তার নেতৃত্ব পাবনাবাসীদের কাছে সবচাইতে বেশি করে কাম্য ছিল।
আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। তিনি নেই, কিন্ত তাঁর আদর্শ জনগণকে প্রেরণা যোগাবে। শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের ভাষা আমাদের নেই। তবুও যিনি নেই তাকে তো আর শত আরাধনায় ফিরে পাওয়া যাবে না।
বাহৃতঃ তিনি সশরীরে আমাদের মাঝে অবস্থান করছেন না ঠিকই কিন্তু তিনি রয়েছেন প্রতিটি সংগ্রামীর হৃদয়ে, আদর্শগত সকল মনের মণিকোঠায়।
দ্বাদশ জাতি আন্তর্জাতিক সম্মেলন
ইন্দোচীন সম্পর্কিত দ্বাদশ জাতি আন্তর্জাতিক সম্মেলন শুরু হয়েছে প্যারিসে। এ সম্মেলনে পরস্পর মুখোমুখি হচ্ছেন ভিয়েতনাম বুন্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষ তিনটি বৃহৎ শক্তির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ উইলিয়াম রজার্স, সোভিয়েট পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ অন্ত্রে গ্লোমিকো, চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ চি-পেঙ-ফি। সম্মেলনে উপস্থিত থাকছেন জাতিসংঘের মহাসচিব ডঃ ওয়াল্ডহেইম, যুদ্ধবিরতি নিয়ন্ত্রণ কমিশনের চেয়ারম্যান কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ মিচেল শ্যার্প এবং অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিগণ।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ রজার্স প্যারিসে পৌঁছে বলেছেন, ২৭শে জানুয়ারি তে স্বাক্ষরিত যুদ্ধবিরতি চুক্তি এই অঞ্চলের জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।
তিনি বলেন ইন্দোচীনে প্রকৃত ও স্থায়ী শান্তির জন্য কাজ করে যাওয়ার উদ্দেশ্যে প্যারিসে এই দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলন ডাকা হয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব ডঃ ওয়াল্ডহেইম ও সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ গ্লোমিকো সম্মেলন যাতে সার্বিক ভাবে সফল হয়ে উঠতে পারে সে জন্য সাধ্যমত চেষ্টা চালিয়ে যাবার কথা ঘোষণা করেছে।
প্যারিসের সপ্তাহব্যাপী দ্বাদশ জাতি সম্মেলন যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। বৃহৎ শক্তিবর্গের প্রতিনিধিরাও স্থায়ী শান্তির স্বপক্ষে কাজ চালিয়ে যাবেন বলে জানিয়েছেন। সম্মেলনে যে তিনটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে তা হলো (১) সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের চুক্তিকে অনুমোদন দান (২) চুক্তিটিকে মর্যাদা দানের প্রতিশ্রুতি এবং (৩) সম্মেলনে যোগদান করেনি সে সব দেশের প্রতিও চুক্তি কার্যকর করতে সাহায্য সহযোগিতার আহ্বান জানানো।
ইন্দোচিনে স্থায়ী শান্তির জন্য সম্মেলন প্যারিসে শুরু হয়েছে বটে তবে এ প্রসঙ্গে আমরা প্রথমেই যে কথাটি বলতে চাই তা হল শুধুমাত্র বৈঠকে বসলেই শান্তি আসবে এমন নয়। প্যারিসে ভিয়েতনাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার আগে পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছে-তাতে কিছু হয়নি। শেষ পর্যন্ত উভয় পক্ষ যখন বিশেষ একটা বাস্তব অবস্থার চাপে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য এগিয়ে এলেন তখনই চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো।
ইন্দোচীন এর ব্যাপারে যে তিনটি দেশ বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেন তাহলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত, রাশিয়া ও চীন। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দদিচ্ছা ও সক্রিয় ভূমিকা এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে প্রয়োজন।
সম্মেলন শুরু হয়েছে ঠিকই অন্যদিকে দক্ষিণ ভিয়েতনামের বিস্তীর্ণ এলাকায় সারগন বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং থিউ সরকার ও বিপ্লবী সরকার পরস্পরের বিরুদ্ধে ভিয়েতনাম শান্তিচুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ করছেন। ঠিক এমনই একটা অভিযোগ দায়ের করেছেন লাওসের প্রধানমন্ত্রী প্রিন্স সুভান্না ফুমাও। এদিকে হ্যানর বেতার থেকে অভিযোগ করা হয়েছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শান্তি চুক্তির শর্ত অনুসারে ভিয়েতনামের উপকূল থেকে মাইন সরিয়ে ফেলার কাজে বিলম্ব ঘটাচ্ছে। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাইন গুলি সরিয়ে ফেলার কথা ছিল।
সম্মেলন চলাকালীন যদি এই হয় ইন্দোচীনের অবস্থা তাহলে স্থায়ী শান্তির আশা করাটা আকাশ কুসুম এর মতই মনে হওয়া স্বাভাবিক। এ প্রসঙ্গে আমরা বলব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইন্দোচীনের যুদ্ধে অন্যায় ও অসঙ্গতভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন। সেজন্যে মার্কিন সরকারকে খেসারত কম দিতে হয়নি। ভবিষ্যতে যাতে আর খেসারত দিতে না হয় সেজন্যই মার্কিন সরকার ভিয়েতনাম শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন। সুতরাং উত্তর ভিয়েতনামের বন্দরগুলো থেকে মাইন অপসারণ থেকে আরম্ভ করে মিঃ থিউ ও মিঃ সুভান্না ফুমার মত ঢাল-তলোয়ার শূন্য নিধিরাম সর্দারদের ব্যাগ মানানোর দায়িত্ব আজকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। মোদ্দা কথা হলো ইন্দোচিনে স্থায়ী শান্তি আনয়নের দায়িত্ব বিশেষভাবে আজ বৃহৎ শান্তি বর্গের উপর অর্পিত।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক