You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.25 | প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে দেশদ্রোহিতার অভিযুক্ত -সামরিক আইন জারি রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ করে - সংগ্রামের নোটবুক

অগ্নিগিরির উচ্চিারণ

শেখ মুজিবুর রহমান তার জনগণের উদ্দেশে অসহযােগ ও আইন অমান্য আন্দোলনের ডাক দিলেন। তাতে সম্পূর্ণ সাড়া পাওয়া গেল। শেখ তখন একটা নাগরিক প্রশাসন পরিষদ মনােনীত করে দিলেন। ১ মার্চ ১৯৭১ থেকে তা কাজ শুরু করল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবুর রহমান -এর সাথে ব্যক্তিগতভাবে বােঝাপড়া করার উদ্দেশ্যে ঢাকা আসলেন। আলােচনা শুরু হল ১৬ মার্চ ১৯৭১ তারিখে এবং চলল। বেশ কিছুদিন । জনাব ভুট্টোও আলােচনায় অংশগ্রহণের জন্য এসে হাজির হলেন। এই বােঝাপড়ার আলােচনার আড়ালে জাহাজভর্তি সৈন্য নামাল চট্টগ্রামে ও চালনায়। তা আগে থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত ৬০ হাজার সৈন্যের দুর্দান্ত বাহিনীকে তা আরও শক্তিশালী করে তুলল । যেই মাত্র সুচিন্তিত পরিকল্পনা অনুযায়ী সৈন্য সমাবেশ ও যথাযথভাবে সৈন্যদের ছড়িয়ে যাওয়া সম্পন্ন হল ঠিক তখনই ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ আলােচনা হঠাৎ করে ভেঙে দেওয়া হল। ইয়াহিয়া খানের বিমানযােগে করাচি ফিরে যাওয়াটা ছিল জেনারেল টিক্কা খানের অধীনে সৈন্যবাহিনীর জন্য পূর্ব পাকিস্তানের গণআন্দোলন গুড়িয়ে দেওয়ার সংকেত। টিক্কা খান ঠিক এই লাইনেই তালেবর হয়ে ওঠেন বেলুচিস্তানে। বেলুচিস্তানের কসাই কাজটা শুরু করল বিরামহীন ও অনুশােচনাহীন। ধর্মান্ধের চরম চণ্ডরূপ নিয়ে। চট্টগ্রামে সৈন্যবাহিনীর সরবরাহ বহনে অস্বীকৃত হাজার। হাজার বাঙালি শ্রমিককে ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগের একদিন আগেই মেশিনগানের গুলি চালিয়ে শেষ করে দেওয়া হল। এই পরিস্থিতিতে শেখ মুজিবর রহমান ২৫ মার্চ ১৯৭১ থেকে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসাবে ঘােষণা করা ছাড়া আর কোনও পথ খােলা দেখলেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মুজিবকে দেশদ্রোহিতার জন্য অভিযুক্ত করলেন, সামরিক আইন জারি করলেন ও সব রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ করলেন। তাদের শেষ করে দেওয়ার লক্ষ্য ছিল ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শত শত ছাত্র ও অধ্যাপককে গুলি করে মারা হল । বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে পাক। সেনারা অনেক ছাত্রীকে অপহরণ করল । ১৩ এপ্রিল যশােরের সেন্ট ফ্রান্সিস যেভিয়ার স্কুলের ৩০০ ছাত্রকে লাইন করিয়ে মেশিনগান দিয়ে গুলি করা হল। প্যারিশের যাজককেও হত্যা করা হল। আন্তর্জাতিক মতামত অ্যাসােসিয়েটেড প্রেস -এর প্রেস করেসপন্ডেন্ট শ্ৰী মট রােযেনবম এই সময়কালে পূর্ব ।

পাকিস্তান ভ্রমণ করে রিপোের্ট করলেন যে অত্যন্ত ভয়াবহ পাইকারি হত্যা এবং ঘৃণা সহযােগে এক গৃহযুদ্ধ চলছে। হিসাব করে বলা হয়েছিল যে এই গৃহযুদ্ধের মৃত্যুসংখ্যা ২৫ মার্চ থেকে (১৯৭০ এর) নভেম্বরের এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের মৃত্যুসংখ্যা ৪ লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছে। এর আগে ব্যাংকক থেকে এক ডেসপ্যাচ -এ শ্রী রোেযেনবম লিখেছিলেন- “পেট ভর্তি হওয়ার কারণে শুকুনেরা উড়তে পারছে না। গঙ্গা নদীর পাড় ধরে তারা বসে আছে, ভয়ানকভাবে তৃপ্ত তার, মার্চ থেকে সম্ভবত ৫ লাখের বেশি খুন হওয়া পাকিস্তানিকে। খাওয়ার ভাগ্য তাদের হয়েছে।” লন্ডনের দি সানডে টেলিগ্রাফ বলেছিল,-“যাই হােক না কেন পুরনাে পাকিস্তান এখন মৃত। শাসকেরা চেষ্টা করছে অস্ত্রের জোরে সত্যকে অস্বীকার করতে কিন্তু সে চেষ্টা দুঃখজনক বােকামি ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।” ২ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে প্রাভদা বলেছিল-“এই (পাকিস্তানি) আর্মি অ্যাকশনগুলি হচ্ছে চরম বাছবিচারহীন গোয়ার্তুমি ও হিংস্রতা যা সােভিয়েত জনগণকে নিদারুণভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।” দি গার্ডিয়ান (২৭ মার্চ ১৯৭১) বলে-“প্রেসিডেন্টের নেওয়া অবস্থান বাংলার পক্ষে স্বাধীনতার যে ঘােষণা শেখ মুজিব দিয়েছিলেন বলে জানা গিয়েছে তাকে অনিবার্য করে তুলেছিল। বাংলার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার অর্থ মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ থেকে শুরু হওয়া ভক্তিপূর্ণ ইসলামি ঐতিহ্যের অবিভক্ত পাকিস্তানের অযৌক্তিকতা আবার প্রকাশিত হওয়া। আঞ্চলিকতার উত্তেজনা মাঝে মাঝে ফেটে পড়া সত্ত্বেও যে এতদিন (পাকিস্তান) টিকে ছিল সেটাই এক পরমাশ্চর্য ব্যাপার।” দি ডেইলি টেলিগ্রাফ (২৭ মার্চ ১৯৭১) বলে- “পরম দুঃখের বিষয় এই যে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে যত ভয়াবহ পন্থায় যা-ই করুক না কেন, একটা স্থিতিশীল টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা কোনও মতেই সম্ভব হবে না।” পরে পত্রিকাটি ২৯ মার্চ ১৯৭১ তারিখে বলল- “পশ্চিম পাঞ্জাবের সবগুলি বেয়ােনেট বাঙালি জাতীয়তাবাদের জিনকে আর বােতলে ঢােকাতে পারবে না।” দি গার্ডিয়ান (১৪ এপ্রিল ১৯৭১) বলে- “কাশ্মির ইস্যু আবার এলে জাতিসংঘ নিশ্চয়ই তিক্ত হাসিতে ভেঙে পড়বে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মতাে ঐ ইস্যুটিও এখন

২৮ মার্চ ১৯৭১ -এর দি নিউইয়র্ক টাইমস রক্তাক্ত দমন নীতির বদলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় সংযােগের পরামর্শ দেয়। ২৮ মার্চ ১৯৭১ -এর দি ওয়াশিংটন ইভিনিং স্টার পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধাবস্থার কথা স্বীকার করে এবং সেখানে এক জনযুদ্ধের সম্ভাবনা সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে । একজন জ্যেষ্ঠ রিপাবলিকান সিনেটর শ্রী উইলিয়াম বি স্যাক্সবি বলেন- “অনেক মানুষের, যারা বেশির ভাগ ছিল নিরস্ত্র, হত্যা ও অঙ্গচ্ছেদের অনেক খবর পেয়েছি এবং তা সত্য এবং সেখানকার (বাংলাদেশ) মনােভাব দমন করার জন্য গৃহীত ব্যবস্থার যে কঠোরতা, তাতে আমি বেদনাহত।” তিনি বেদনাহত হন এজন্যও যে “পাকিস্তানিরা তাদেরকে আত্মরক্ষার্থে ব্যবহারের জন্য দেওয়া আমেরিকান অস্ত্র নিজেদের জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে।” ফরাসি পত্রিকা ল, অরােরে (২৮ মার্চ ১৯৭১) বলে- “সেই সাইক্লোনটার সময় থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ আশা করা যেত। সাইক্লোনটা বিশ্বকে এক দুঃখময় উদাহরণের মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছিল দেশটার দ্বন্দ্বগুলি।” পত্রিকাটি আরও মনে করে যে হাজার হাজার মানুষকে হয়তাে জীবন দিয়ে ১৯৪৭ সালের ভুলের জন্য এবং পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষের একগুঁয়েমির জন্য মূল্য দিতে হবে । সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি পূর্ব বাংলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দায়িত্ব তুলে ধরে বলেন যে “আমাদেরই সামরিক সরঞ্জামাদি, আমাদের বন্দুক, ট্যাংক ও উড়ােজাহাজ সেখানকার মানুষদের দুর্দশা ঘটাতে সাহায্য করছে এবং এসব করা হচ্ছে আমেরিকান সামরিক সাহায্যের ব্যবহার সংক্রান্ত আপশ -ঐীমাংসা পূর্বক কৃত চুক্তি ভঙ্গ করে।” কুয়ালালামপুরের দি উহুসান মালয়েশিয়া বলে- “পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের দোষারােপ করাটা আমরা উপভােগ করি না কিন্তু আমরা পরিষ্কার পর্যবেক্ষণ করেছি যে পূর্ব পাকিস্তান আসলে একটি স্বাধীন দেশের অংশ নয় বরং স্রেফ পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ। আমরা ইয়াহিয়া খানের বর্তমান কার্যব্যবস্থাকে একটা আহম্মকি বলে মনে করি ।” কাঠমান্ডুর রাইযিং নেপাল এবং নিউ হেরাল্ড বলে, এমন অবস্থা পঁড়িয়েছে, যেখান থেকে আর আগের অবস্থায় ফেরা যাবে না। হাজার হাজার পূর্ব পাকিস্তানি প্রাণ উৎসর্গ করছে। তার ফলে ভাঙ্গন আসবেই। টোকিও’র এক বহুল প্রচারিত খবরের কাগজ মাইনিচি শিমুন বলে—“সামরিক নির্যাতন সমস্যার সমধান করতে পারে না।

যে কেউ দেখতে পারবে যে পূর্ব পাকিস্তানের আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং দারিদ্র মুক্তির দাবি বন্দুক আর তলােয়ার দিয়ে ধ্বংস করা যাবে না।” যাম্বিয়ার লুসাকার ডেইলি মেইল বলে-“প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে বােঝানাে দরকার তিনি যেন না ভাবেন যে বন্দুকের নল থেকে কোনও স্থায়ী সমাধান বেরিয়ে আসবে।” ইস্তাম্বুলের এক দৈনিক ইয়েনি গেযেট -এ কিকমত বিল বলেন-“পাকিস্তান কখনওই একটি দেশ ছিল না। অনাহুত পশ্চিমি ট্যাংক, পে-ন, হেলিকপ্টার এবং সেনাবাহিনী এখন বাংলায়। এই অনাহুত সেনাবাহিনী পূর্বকে বেঁধে নিজের হাতে রাখার চেষ্টায় আছে। এটা আর কতদিন সম্ভব।” ইয়েনি ইস্তাম্বুল, গুনায়দি, গুমহুরিয়েত, উলুস-তুরস্কের এই সব পত্রিকা পাকিস্তানের ভাঙনের আশঙ্কা প্রকাশ করে এবং সামরিক দমন অভিযানের নিন্দা করে । তেহরানের কায়হান ইন্টারন্যাশনাল লেখে-“আওয়ামী লীগ নেতা মুজিবর রহমান এবং তার প্রধান প্রধান অনুসারীরা আরও এক দফার জন্য কারাগারে গেলেন, মনে হচ্ছে ব্যাপক হারে ভ্রাতৃহত্যার জন্য পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গিয়েছে। এটা স্পষ্ট যে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যাবলি শক্তি প্রয়ােগের মাধ্যমে সমাধান করা যাবে না।” এমনকি তুর্কি ও ইরানি মিত্রদের মতামতও পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষের ওপর কোনও কাজ করল না। বিশ্বের মতামতকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হল। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে চীন ছিল গােটা বিশ্বের একমাত্র দেশ যে কিনা পাক বাহিনীর কার্যব্যবস্থাকে সমর্থন করল । ১৪ এপ্রিলে পিপলস ডেইলি’র একটি ধারাভাষ্য পিকিং রেডিও থেকে প্রচারিত হল । ধারাভাষ্যটা ছিল জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই -এর পাঠানাে একটি বার্তার ওপরে । তাতে বলা হয়পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ইয়হিয়া খান যে প্রাসঙ্গিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন তা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। চীনা সরকার ও জনগণ সবসময়ই জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার ন্যায্য সংগ্রামে পাকিস্তান সরকারকে জোর সমর্থন দিয়ে যাবে। তদুপরি চীন পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার জন্য অভিযুক্ত করে ভারতকে একটি প্রতিবাদ লিপি পাঠাল। ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড. কেনেথ বি. কীটিং ১৫ এপ্রিল বােম্বাইতে বললেন-“অভ্যন্তরীণ ব্যাপার কথাটার অপব্যবহার করা হয়েছে। এটা নিশ্চিত যে এই ঘটনাপ্রবাহকে অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলা যেতে পারে শুধুমাত্র এই সীমিত পরিসরে যে ঘটনাগুলি ঘটছে পাকিস্তানের মধ্যে।”

ভারতে নিযুক্ত এক প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত শ্রী চেস্টার বাইলস্ তাঁর সরকারকে বললেন বাংলাদেশের ঘটনা প্রবাহকে এশিয়ার শান্তির প্রতি হুমকি হিশাবে বিবেচনা করার জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এক সভা আহ্বান করতে। তিনি খাদ্য ও অষুধের সরবরাহ ছাড়া পাকিস্তানকে আর কোনও প্রকার মার্কিন সাহায্য দেওয়া বন্ধ করার জন্যও বললেন। বিশ্ব যখন বাংলাদেশ পরিস্থিতি সহানুভূতির সাথে বিবেচনা করছে, তখন হাজার হাজার বাস্তুহারা পুরুষ নারী ও শিশু আন্তর্জাতিক সীমারেখা পেরিয়ে ভারতে এসে জড়াে হচ্ছিল। তারা কিছুই সাথে করে আনছিল না। এমনকি কাপড়চোপড়ও না। তাদের মধ্যে শত শত ছিল অসুস্থ, অনেকে দারুণভাবে আহত ছিল এবং শােকাভিভূত ছিল । তারা এমন ত্রাসের গল্প সাথে করে আনছিল যা ছিল ইতিহাসে অজানা। এ সব ব্যাপার ভারতীয় জনগণের মনে বিশেষত ভারতের বাঙালিদের মনে গভীর ও স্থায়ী দাগ কেটে যাচ্ছিল। লাঞ্ছিত ও বলপূর্বক তাড়িয়ে দেওয়া মানুষদের জন্য সাহায্য দেওয়ার বহু-প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য এখানে কাজ করল এবং নিদারুণ মর্মাঘাতের মধ্যে ভারতীয় জনমত গড়ে উঠল ।

ভারতীয় প্রতিক্রিয়া

মার্চ ১৯৭১ -এর সম্পাদকীয়তে দি টাইমস অব ইন্ডিয়া বলল- “ন্যাশনাল অ্যাসেমবি

অধিবেশন শেষ মুহুর্তে স্থগিত করে দেওয়ায় জনাব ভুঠেী শাসনতন্ত্র প্রস্তুত প্রক্রিয়ায় ভেটো দেওয়ার অধিকার পেয়ে যান। এ আত্মসমর্পণ অতটা জনাব ভুট্টোর হুমকি ও | ব-কিমেইলিং -এর পরিপ্রেক্ষিতে নয় যতটা পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক আমলাতান্ত্রিক যন্ত্রের চাপের পরিপ্রেক্ষিতে। ঐ সামরিক আমলাতন্ত্র শেখ মুজিবর রহমানের ছয় দফা কর্মসূচির মধ্যে স্বীয় প্রাধান্যের প্রতি হুমকি দেখতে পায়।” ১৬ মার্চ ১৯৭১ In the Brink of Disaster শিরােনামের এক সম্পাদকীয়তে দি টাইমস অব ইন্ডিয়া লেখে- “কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিজের কাছে দায়বদ্ধতা আছে পূর্ব বাংলার জনগণকে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক যন্ত্রের হত্যাযজ্ঞ থেকে রক্ষা করার সব রকম প্রচেষ্টা চালানাের। পূর্ব বাংলার জনগণ শুধু চেয়েছে নিজেদের ব্যাপার নিজেদেরই নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার। এখানে বিশেষভাবে গভীর দায়িত্ব আছে দুটি পরাশক্তির । শেখ কোনও বিচ্ছিন্নতাবাদী নন। তিনি আসলে একজন মধ্যপন্থী। পূর্ব বাংলার জনগণ ও সৈন্যদের মধ্যে একটা সংঘর্ষ এড়াতে তার চেয়ে বেশি চেষ্টা কেউ করেনি।” একই পত্রিকা ১৯ মার্চ লেখে-“ কিন্তু বিশ্ব কখনও এমন সর্বাত্মক ও শক্তিশালী। শান্তিপূর্ণ বিপ-ব দেখেনি যেমন আজ পূর্ব বাংলায় হচ্ছে। শেখের পিছনে সমগ্র জনগণ ঐক্যবদ্ধ। ইতিহাসে এমন আর ঘটেনি যেখানে সকল জ্যেষ্ঠ বিচারক সামরিক গভর্নরকে শপথবাক্য পাঠ করাতে অস্বীকার করেন এবং সিভিল সার্ভেন্টরা স্বেচ্ছায় বিপ-বী নেতার নির্দেশাবলি পালন করেন।” ২৭ মার্চ ১৯৭১ The Unmaking of Pakistan নামের এক সম্পাদকীয়তে দি হিন্দুস্তান টাইমস বলে-“ভারত কখনও পাকিস্তানের ভাঙনের ইচ্ছা পােষণ করেনি। কিন্তু ভারত বাংলার অপর অর্ধেকে অনুষ্ঠিত সামরিক শক্তির দমনপীড়নে নির্বিকার থাকতে পারে ।” মাকেকার দি মাদারল্যান্ড -এ লেখেন-“পাকিস্তান বলতে যা আমরা জেনেছি তা এখন আর নেই । পিন্ডিও ঘটা করেই বলতে পারত যে তার পূর্ব অংশ আর নেই । ইতিহাস জুলফিকার আলী ভুট্টোর ও ইয়াহিয়া খানের নাম লিখবে তেইশ বছরের পুরনাে রাষ্ট্রটির ছেদনকারী হিশাবে।” ফ্রাংক মােরএস ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস -এ (৯ এপ্রিল ১৯৭১) এক সম্পাদকীয়তে বললেন-“পূর্ব বাংলায় পাশবিক কার্যক্রমের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তান শুধু একটি আগুনই জ্বালায়নি, তা পাকিস্তানকে যে দ্বিজাতি তত্ত্ব আকাশসমান উচ্চে স্থাপন করেছে তাকেও ফুকে দিয়েছে।

পাকিস্তান নিজেকে যে থিওক্রাসির কল্পকাহিনির উপর গড়ে তুলতে চেয়েছে তা ভারত ধ্বংস করেনি। পূর্ব বাংলার স্বধর্মীয়দের পায়ের নিচে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে পাকিস্তান নিজেই সে কল্পকাহিনি বিস্ফোরিত করে দিয়েছে।” প্রজা সােশ্যালিস্ট পার্টি সভাপতি শ্রী এন. জি. গােরেই বলেন (দি টাইমস অব ইন্ডিয়া, ২৭ মার্চ ১৯৭১)-এহেন প্রকৃতির এক সংঘর্ষ শুধু পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ্যই বদলাবে না, বরং সমগ্র অঞ্চলেই নৈরাজ্যের বন্যা বইয়ে দেবে যাতে বৈদেশিক শক্তিসমূহের পক্ষে। ঘােলা পানিতে মাছ শিকার সহজ হয়ে যাবে।” সংসদ সদস্য এবং প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী শ্রী এম, সি, চাগলা অবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করেন। তিনি বলেন, যে বৈধ এবং সংগতভাবে সংগঠিত বাংলাদেশ সরকারের বৈধতা ইয়াহিয়া খানের চেয়ে বেশিই ছিল । সর্বোদয় নেতা শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণ অবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধীর গতিশীল নেতৃত্বের অধীন ভারতীয় পার্লামেন্ট ৩১ মার্চ ১৯৭১ একটি ঐতিহাসিক প্রস্তাব পাশ করে। তাতে বলা হলএই সংসদ পূর্ব বাংলার সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে গভীর বেদনা ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছে । পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পাঠানাে বাহিনী এক বিপুল আক্রমণে ঝাপিয়ে পড়েছে পূর্ব বাংলার সমগ্র জনগণের ওপর তাদের প্রাণের দাবি ও আকাক্সক্ষাসমূহকে দমন করার অভিপ্রায়ে। ১৯৭০ -এর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের নির্বাচনে সন্দেহাতীতভাবে প্রকাশিত জনগণের ইচ্ছাকে সম্মান করার বদলে পাকিস্তান সরকার গণদাবিকে অবজ্ঞা করার পথ অবলম্বন করেছে। পাকিস্তান সরকার শুধু আইনত নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরেই অস্বীকৃতি জানায়নি, ন্যাশনাল অ্যাসেমবি-কে তার ন্যায়সংগত ও সার্বভৌম ভূমিকা গ্রহণেও বিরত রেখেছে। পূর্ব বাংলার জনগণকে তারা দমন করতে চাইছে উলঙ্গ শক্তি প্রয়ােগ দ্বারা বেয়ােনেট, মেশিনগান, ট্যাংক, কামান আর বিমান দ্বারা। ভারতীয় সরকার ও জনগণ সবসময় পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ, স্বাভাবিক ও ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্কের জন্য চেষ্টা করে এসেছে। কিন্তু ভারত যেখানে অবস্থিত আর উপমহাদেশের বিভিন্ন জনগােষ্ঠী যেভাবে বহু শতাব্দি প্রাচীন ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যিক বন্ধনে আবদ্ধ তাতে এই সংসদ আমাদের সীমান্তের কাছে যে ভয়াবহ, রক্তাক্ত, বিষাদময় নাটক অনুষ্ঠিত হচ্ছে তাতে নির্বিকার থাকতে পারে না।

আমাদের দেশের সমগ্র বিস্তার জুড়ে আমাদের জনগণ। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এক নিরস্ত্র ও নির্দোষ জনগণের ওপর অভূতপূর্ব মাত্রায় চালিয়ে যাওয়া নৃশংসতার নিন্দা করছে। পূর্ব বাংলার জনগণ এক গণতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থার জন্য যে সংগ্রাম করে চলেছে তার প্রতি এই সংসদ গভীর সহমর্মিতা ও একাত্মতা প্রকাশ করছে। শান্তির ব্যাপারে ভারতের যে স্থায়ী আগ্রহ আছে এবং আমরা মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় ও রক্ষায় যেভাবে সংকল্পবদ্ধ তা মনে রেখে এই সংসদ প্রতিরােধহীন জনগণের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত শক্তিপ্রয়ােগ ও ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ অবিলম্বে বন্ধ করার দাবি জানাচ্ছে। জনগণের ওপর প্রণালীবদ্ধভাবে চালিয়ে যাওয়া, যা গণহত্যার শামিল, এই হত্যাকাণ্ড অবিলম্বে বন্ধ করায় পাকিস্তান সরকারের উপর চাপ দিতে জরুরি এবং গঠনমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য এ সংসদ বিশ্বের সকল জাতি ও সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে। এই সংসদ এই মর্মে গভীর বিশ্বাস প্রকাশ করছে যে, পূর্ব বাংলায় সাড়ে সাত কোটি মানুষের ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান অবশ্যই জয়যুক্ত হবে। সংসদ তাদেরকে এই মর্মে নিশ্চয়তা দিচ্ছে যে তাদের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ ভারতীয় জনগণের সর্বাত্মক সহমর্মিতা ও সমর্থন লাভ করবে। শ্রীমতী গান্ধী সম্পূর্ণ সােজা হয়ে দাঁড়ান। ২৭ মার্চ ১৯৭১ রাজ্যসভায় তিনি বললেন“আমরা নির্বাচনের ঘটনাপ্রবাহ সপ্রশংস দৃষ্টিতে লক্ষ করেছি। তা এই আশা জাগ্রত করেছিল যে গােটা দেশটার জন্য একটা নতুন ভবিষ্যতের শুরু হতে যাচ্ছে, এমন ভবিষ্যৎ যা তাদেরকে আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করবে। কিন্তু তা এক দীর্ঘ কালাে পথে, যা গােটা জনগণের জন্য দুর্ভোগ বয়ে নিয়ে এসেছে, এক বিষাদময় পথে ঘুরে গিয়েছে। এ শুধু আন্দোলন দমন করা নয়। এ হচ্ছে ট্যাংকের সাহায্যে নিরস্ত্র মানুষের মােকাবিলা করা… আমরা পরিস্থিতির প্রতি সম্পূর্ণ জাগ্রত এবং যা ঘটছে ও যা আমাদের করা দরকার তার সাথে আমরা নিরবচ্ছিন্ন সংযােগ রেখে যাব।” বাংলাদেশে পাক সামরিক দমন অভিযানের প্রতিক্রিয়া তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন সরকারকে বুঝিয়ে বলার জন্য এক বিশ্বভ্রমণ শুরু করলেন। শান্তির সপক্ষে তার সেই সমর্থন ছিল শক্তিশালী, কিন্তু কিছু কিছু সরকারের স্বার্থপর সাম্রাজ্যবাদী ঝোঁকসমূহ ছিল আরও বেশি শক্তিশালী।

এ অবস্থায় মানবিক বিবেচনাবলির কোনও স্থান ছিল না। এমন সব উৎস থেকে হুমকি আসতে লাগল যা এরকম প্রতিক্রিয়া দেখাবে বলে আশঙ্কা ছিল সবচেয়ে কম । দিগন্ত অন্ধকার বলে মনে হচ্ছিল। সারা বিশ্বের মুসলমান জাতিগুলি ট্রাজেডিটাকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করছিল। তাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক একটা-ভাঙতেবসা মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতি মিথ্যা সহানুভূতিবােধের অজুহাতে তা করছিল এবং অনন্যরা সে ট্রাজেডির দ্বারা অভিভূত হয়েছে মনে হল কিন্তু নিজেদেরই সীমান্তের মধ্যকার ধর্মান্ধদের সেন্টিমেন্টে আঘাত করার ভয়ে সত্য বলার জন্য যথেষ্ট নৈতিক সাহস সঞ্চয় করতে পারছিল না। সাধারণভাবে বিশ্ববিবেক এবং বিশেষ করে মুসলিমবিবেক পরীক্ষার সম্মুখীন হল এবং তা ব্যর্থ হল। প্রতিটি দেশের মধ্যেই এখানে ওখানে উলে-খযােগ্য ব্যতিক্রম ছিল । তারা হতভাগ্য বাংলাদেশিদের দুঃখজনক দুর্দশায় আহাজারি করছিল, তারা তার মধ্যে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের এবং তার সাথে অবিচ্ছেদ্য মানবিক অধিকারের মৃত্যু দেখতে পাচ্ছিল। কিন্তু তারা মােটেই পাত্তা পাচ্ছিল না। চীন সুবিধাবাদের স্বার্থে তার বৈপ-বিক ঐতিহ্য জলাঞ্জলি দিল । ঐ দেশটা বাংলাদেশে পাক সামরিক দমন অভিযানকে পুরাপুরি সমর্থন করল। বলল, এটা পাকিস্তানের একটা অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এবং তদদ্বারা দেশটা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের ভােলা দৃষ্টির সামনে উলঙ্গ হয়ে পড়ল, যে মানুষেরা আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের পক্ষ সমর্থনে চীনের ওপর নির্ভর করত। চীনারা অবশ্য এই অধিকার দিতে অস্বীকার করেছিল নিজেদেরই দেশের এথনিক সংখ্যালঘু জাতিগােষ্ঠীদেরকে, যেমন মােঙ্গলদের, তিব্বতিদের এবং সিংকিয়াং জনগণকে। বিশেষত তিব্বত চীনাদের বিশেষ ক্রোধ আকর্ষণ করেছিল তাদের বিশ্বাসঘাতকতা সারা বিশ্বে উন্মােচিত করে দেওয়ার কারণে। হাজার হাজার অনুসারী সহ দালাই লামা ভারতের কাছে আশ্রয় চাইতে এসেছিলেন যখন কিনা তাকে একটি সম্প্রদায়ের নিছক ধর্মীয় প্রধান হিশাবে কাজ করতে দেওয়া হল না, যে সম্প্রদায় নিজের সমস্ত সময়টা বৌদ্ধ সাহিত্যের ধ্যানে এবং গবেষণায় নিয়ােজিত করত। দলে দলে চীনারা তিব্বতকে আক্ষরিক অর্থেই বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল।

আধ্যাত্মিকঝোঁকসম্পন্ন তিব্বতীয় জাতির আক্রমণকারী চীনা সেনাবাহিনী গুলিকে দেওয়ার মতাে বৌদ্ধ সাহিত্য ছাড়া আর ছিল তাদের মন্দিরসমূহ ও তার মূর্তিগুলি যার কিছু ছিল সােনা ও মূল্যবান পাথরে অলংকৃত। মন্দিরগুলি লুণ্ঠন করার পর অপবিত্র করা হয়েছিল। মূর্তিগুলি ভেঙে মূল্যবান পাথর ও সােনা লুট করে ও যুদ্ধেজেতা মালামাল হিশাবে নেওয়া হয়েছিল। তারপর এল সামরিক-প্রাধান্যগ্রস্ত পার্টি যন্ত্র যা দারিদ্র্য এবং নিদারুণ দারিদ্রের মধ্যে একটা রেখা টানতে চাইল । যেহেতু তিব্বতীয় সমাজে কোনও পুঁজিপতি ছিল না, মঠগুলির প্রধান লামাদেরকে নতুন সৃষ্ট এই শ্রেণির মধ্যে ফেলা হল। কম্যুনিস্ট দর্শনের। ভিত্তি শ্রেণি সংগ্রাম হওয়ায়, শ্রেণি ভেদ যদি না থাকে তাে, তা সৃষ্টি করতে হবে “সংগ্রাম”-কে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য, কারণ সেটাই বিপ-বী আদর্শ। তিব্বতের। উপজাতীয় সমাজ ১৪ হাজার ফুটের বেশি উচ্চতায়, যেখানে ঘাস ছাড়া আর কিছু গজায়, প্রকৃতির খেয়ালের সম্মুখীন হতে অভ্যস্ত ছিল, এবার তাদের সম্মুখীন হতে হল বিদেশিদের খামখেয়াল আর অসার কল্পনার। আক্রমণকারী বাহিনীগুলি যাতে স্থানীয়ভাবে সরবরাহ পায় সেইজন্য খাদ্যদ্রব্যের রেশন করা হল, আর সেখানকার গরিব। অধিবাসীরা তাদের ইতিহাসের সর্বপ্রথম মানুষের তৈরি দুর্ভিক্ষাবস্থার সম্মুখীন হল ।। স্থানীয় ভােগের জন্য বণ্টন করা রেশনে জনগণের প্রয়ােজনের অর্ধেক মিটল না । তারা। বুঝল না কম্যুনিস্ট শাসকদের অধীনে তাদের রেশন কেন এত কমে গেল। চীনা। আক্রমণের আগে লােকে প্রচুর রেশন পেত এবং এমনকি সাধারণ কৃষকদের সােলায়ও অনেক বছরের প্রয়ােজনীয় খাদ্যশস্য ভরতি থাকত। তারা বুঝল না চীনারা কেন তাদের ওপর শাসন চালাবে এবং তাদের স্বাধীনতা নির্মমভাবে দমন করবে, যে স্বাধীনতা তারা বহু শতাব্দি ধরে ভােগ করেছে এবং সকল উপজাতীয় জনগণ যাকে মূল্য দিত এমনকি নিজেদের জীবিকার চেয়ে বেশি। দারিদ্র্য বহুগুণ বেড়ে গেল। ভূমিদাসরা এখন আর মঠগুলির জন্য স্বেচ্ছা শ্রম নয় বরং বিদেশি প্রভুদের জন্য বাধতামূলক শ্রম দিতে লাগল। সত্যিকারের আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল যে দালাই লামা-কে বন্দি করা হবে এবং কোনও না কোনও অজুহাতে তাকে শেষ করে দেওয়া হবে। এমনকি পাঞ্চন লামা, যিনি কম্যুনিস্ট পক্ষে যােগ দিয়েছিলেন, পরে এক অদ্ভুত পরিণতি ভােগ করেছিলেন। এমনকি তিনি কোথায় গেলেন তাও আর জানা যায়নি। দালাই লামা, যিনি দীর্ঘকালের ঐতিহ্য ও সংবিধান অনুযায়ী সরকারের প্রতীক স্বরূপ, অনুভব কলেন যে বিদেশি কম্যুনিস্ট একনায়কত্বের অধীনে তিনি আর তাঁর জনগণের কল্যাণের ব্যাপার দেখাশােনা করতে পারবেন না। অনেক কষ্টে তিনি পার্শ্ববর্তী ভারতে পলায়ন করতে সক্ষম হলেন- যে ভারতে তার আধ্যাত্মিক বাড়ি (বুদ্ধের নিজ ভূমি)।

যখন থেকে চীনা সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনী তাকে অবিরাম খুঁজে ফিরছিল তখন থেকে বিশ্বের সংবাদ প্রতিনিধিরা রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছিল এই গুরুত্বপূর্ণ পলাতকের নিরাপদে ভারতে পৌছার জন্য। ভারতে পৌছে তিব্বতে যা ঘটছিল বলে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন তার বর্ণনা দিলেন। বৌদ্ধ ঐতিহ্যের প্রতি নিষ্ঠাবান থেকে তিনি মধুর ন্যায়পরায়ণতার সাথে বললেন সব কথা। চীনা কম্যুনিস্ট আগ্রাসনকারীদের উদ্ধত স্বেচ্ছাচারী নির্মম আচরণ তিনি ইচ্ছা করেই কমিয়ে বললেন । তিনি এমনকি মাও সেতুঙ -এর প্রশংসা করলেন এবং তিব্বতে কর্মরত চীনা ক্যাডারদের মধ্যে কেবলমাত্র অতিউৎসাহীদের ওপর দোষারােপ করলেন। তাঁর এই মানবিক আচরণের বিপরীতে চীনা কম্যুনিস্ট সরকার তাঁকে ডাকাত হিশাবে অভিহিত করল এবং এমন ইঙ্গিতও দিল যে সি.আই.এ. -এর সহযােগিতায় তাকে অপহরণ করার ব্যাপারে ভারতীয় সরকারের হাত আছে এবং ভারত সরকার তাকে বলপূর্বক আটকে রেখেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের ঘটনা-প্রবাহের ব্যাপারে চীনা প্রতিক্রিয়া বুঝতে হবে। পাকিস্তান তার চীনা বন্ধুরা তিব্বতে যা করছিল, বাংলাদেশে তাই করছিল সেটা ছিল একটা অগ্রহণযােগ্য নৃগােষ্ঠীর উপর গণহত্যা। পাকিস্তান এক কদম বেশি অগ্রসর হয়েছিল এবং বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে নিছক অস্ত্রের জোরে সংখ্যালঘিষ্ঠতায় নামিয়ে এনেছিল। তারা ভাল করে বুঝেছিল যে শক্তি আসে বন্দুকের নল থেকে এবং সব বন্দুক ছিল পাঞ্জাবিদের হাতে, যারা ছিল সত্যিকারের পাকিস্তানি। সিন্ধি, বেলুচ ও পাঠানদের কিছু বলার অধিকার ছিল না। বাংলাদেশের অবস্থা ছিল প্রায় ঠিক তিব্বতের মতাে। বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খানের দমনপীড়নকে সমর্থন করে চীনা কম্যুনিস্টরা মানুষের চোখে নতুন পােশাকে সাম্রাজ্যবাদী হঠকারী জুয়াড়ি রূপে দেখা দিল এবং অনেক কাল যাবৎ তাদের ঐভাবেই প্রতিভাত হতে হবে । 

সূত্র : ফ্যান্টমস অব চিটাগং-দি ফিফথ আর্মি ইন বাংলাদেশ – মেজর জেনারেল (অব.) এস এস উবান