শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
কলকাতাস্থ পাকিস্তানি ডেপুটি হাইকমিশনারের বাংলাদেশের পদাম্বলন | এশিয়ান রেকর্ডার- জুন ১১-১৭,১৯৭১ | ১৮ এপ্রিল ১৯৭১ |
বাংলাদেশে পাকিস্তানি কূটনীতিক ট্র্যান্সফার আনুগত্য: কলকাতায় পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার জনাব এম হোসেন আলী, 18 এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নিকট তার আনুগত্য প্রকাশ করেন। তার পাঁচজন কর্মকর্তাসহ কর্মীদের 70 জন বাঙালী সদস্য, বাংলাদেশ সরকারকে সাহায্য করার আকাঙ্খা প্রকাশ করেছিলেন। জনাব হোসেন আলী 30 জন অন্যান্য কর্মচারী, বেশিরভাগ সুপার কেরানী ও কর্মীদের জুনিয়র সদস্যদের বরখাস্ত করেন যারা পশ্চিম পাকিস্তানীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ছিলো। তার এ পদক্ষেপ ছিলো বিদেশে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মিশন। তার কর্মীদের বাঙালী সদস্যদের কতৃক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে, জনাব আলী তার মিশন শীর্ষে পাকিস্তানের পতাকা প্রতিস্থাপন করে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। অনুষ্ঠানে তার কর্মীদের কয়েকজন সিনিয়র সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। পরে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত “আমার নিজের” ছিল; তিনি খুশি ছিলেন যে তার কর্মীদের কয়েকজন বাঙালী সদস্যরা তাঁকে সমর্থন করেছিল। তিনি বলেন: “বর্তমানে পাকিস্তানের সরকারের প্রতিনিধিত্ব অব্যাহত রাখা অসম্ভব কারণ এটি বাংলাদেশে বাঙালিদের উপর চালানো একটি ইচ্ছাকৃত গণহত্যার সব প্রমাণ দ্বারা সীমাবদ্ধ হয়ে আছে ” তিনি 1600-শব্দের একটি বিবৃতি প্রদান করেন, যেখানে বর্ননা করেন কিভাবে পাকিস্তানি সরকার বাংলাদেশের একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের সুস্পষ্ট রায়কে কিভাবে বিদ্রুপ করেছিলো এবং “পরিকল্পিতভাবে বাঙালি জাতিকে পরিকল্পিতভাবে দমন করার প্রয়াসে” জড়িত ছিলো। সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তিনি বলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের অন্যান্য মন্ত্রীবর্গ, যারা কাল যোগাযোগ রক্ষা করতেন, “সবচেয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে” তাঁকে ও তার বাংলা কর্মীদের যারা সরকারের প্রথম বৈদেশিক মিশন হিসেবে কাজ করেছিলেন, তাদেরকে স্বাগত জানান। তিনি বিগত কয়েক দিন ধরেই মিশনের কিছু বিশ্বস্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন গোপন বৈঠক ছিলেন , “আমাকে সতর্ক থাকতে হতো”, তিনি বলেন, “অন্তত আমাদের সিদ্ধান্ত সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার পূর্বেই যেন ফাঁস না হয়ে যায়”. ‘কলকাতায় একটি ব্যাংক সূত্র জানায়, একটি সিটি ব্যাংক কতৃক পাকিস্তানের ডেপুটি হাই কমিশনের ক্রেডিটের সমগ্র টাকা 17 এপ্রিল প্রত্যাহার করা হয়। এতে মিশনের সব সিনিয়র সদস্যদের অনুমোদন ছিল। এক সূত্র জানায়, ডেপুটি হাই কমিশনের আনুগত্য পরিবর্তন করার সিদ্ধান্তটি বিগত কয়েক দিন ধরে ইসলামাবাদ থেকে প্রেরণকৃত কয়েকটি টেলিগ্রামের বার্তা থেকে অনুসৃত ছিলো, এতে ছিলো মিশনের তথ্য বিভাগের উচ্ছেদের পাকিস্তান সরকারের সিদ্ধান্তের তথ্য, তাৎক্ষণিকভাবে রাওয়ালপিন্ডিতে তথ্য বিভাগের কর্মচারীদের পুনরাহ্বান এবং এতে কর্মীদের কয়েকজন বাঙালি সদস্যদের অবিলম্বে স্থানান্তর হওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে বলা হয়েছিল।
পাকিস্তানের সতর্কবার্তা :
২২ ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশনকে পাকিস্তানের ‘অবৈধ দখলদারিদের’ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ‘তার ফল ভালো হবে না’ বলে ভারতকে হুমকি দেয় পাকিস্তান।
এর আগেই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব এ কে রায় পাকিস্তানের হাই কমিশনার সাজ্জাদ হায়দারকে বলেছিলেন এটা পাকিস্তানের অন্তর্গত বিষয়ে ভারত আইনবিরোধী কোনও কাজে হস্তক্ষেপ করবে না।
এপ্রিল মাসের ২৩ তারিখে কলকাতায় পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার হিসেবে মেহেদী মাসুদকে নিয়োগ দেয়ায় কোনও প্রকার উস্কানি ছাড়াই মন্ত্রণালয়ে বিক্ষোভ করলেন।
হায়দার সাহেব এ কে রায় এর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করলো এমন সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাওয়া গেলো। যার মাধ্যমে জানা গেলো কলকাতার লোকাল অফিস ঠিক সময়ে ঠিক কাজটি করতে পারেনি, না হলে গতকালের এই বিচ্ছিরি ঘটনাটির অবকাশ হতো না।
ভারতের ডেপুটি হাই কমিশনও রাষ্ট্রবিরোধী (পাকিস্তান) কোনও কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করেনি। বরং পাকিস্তান এর একটি আইনি সমাধান চাইতে পারে, ভাতরের পক্ষ থেকে এমন পরামর্শ দেয়া হয়। পাকিস্তান যদি পররাষ্ট্রনৈতিক নিময়কানুন না মানেন, তবে এর জন্য সরকারি
ভারতীয়দের পরামর্শ অনুযায়ী পাকিস্তানের আইনগতভাবে একটা ব্যবস্থা নেয়া উচিত। বিবৃতি অনুযায়ী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এর অধিনে কূটনৈতিক যে নিয়মকানুনগুলো আছে তাতে বিদেশী মিশনগুলো আদালতে যেতে পারবে না। তাতে কূটনৈতিক সীমা লংঘন হয়।
পরবর্তিতে একজন মূখপাত্র জানান, হায়দার সাহেবের এই আচরণ গণমাধ্যমের সাথে ভুল আচরণ কূটনৈতিক অসৌজন্যতা। তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো ‘তার ফল ভালো হবে না’ মর্মে পাকিস্তান কি বুঝাতে চাইলো, তখন তিনি উত্তরে বলেন, এক হাতে তালি বাজে না। ভারতও একই সাথে অবমাননাকর হুমকি দিয়েছে।
আরও দুই কূটনৈতিকের রাজনৈতিক আশ্রয় প্রত্যাশা :
এপ্রিল মাসের ২০ তারিখে পূর্ব বাংলার দুই পাকিস্তানি হাই কমিশনের কূটনৈতিক নয়া দিল্লীতে রাজনৈতিক আশ্রয় চায় এবং তা দ্রুত তা পাশ হয়ে যায়।
রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া কূটনৈতিকেরা হলেন যুগ্ম সচিব কে এম সাহাবুদ্দিন (৩০) এবং সহকারী প্রেস এটাসে আরনজাদুল হক (৩৩) সিদ্ধান্ত নিলেন পাকিস্তানি আর্মিদের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষদের ওপর যে ধ্বংসযজ্ঞ চলছে এ বিষয়ে ইসলামাবাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে দেবেন। তারাহুরার মধ্য দিয়েই মাঝরাত্রে সংবাদ সম্মেলন ডাকলেন তারা। সেই সংবাদ সম্মেলনে ভারতীয় সাংবাদিকদের সাথে বিদেশী সাংবাদিকরাও উপস্থিত ছিলো।
সাহাবুদ্দিন সাহেব ১৯৬৬ সালে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দিয়ে কিছুদিন নেপালে কাজ করেন। ১৯৬৭-র জানুয়ারি থেকেই নয়া দিল্লীতে কাজ করছিলেন তিনি।
আরনজাদুল হক ঢাকায় পাকিস্তান রেডিওতে আঞ্চলিক প্রোগ্রাম পরিচালক হিসেবে কাজ করতেন। ১৯৬৬ সালে তিনি এই পদে যোগ দেন এবং তখন থেকেই নয়া দিল্লীতে কাজ করছিলেন।
সাহাবুদ্দিন সাহেব তার দুই মেয়ে এবং স্ত্রী সহ এবং আরনজাদুল হক একাই (তিনি অবিবাহিত ছিলেন) রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছিলেন।
বিবৃতিতে তারা বলেন, বাংলাদেশের মানুষদের ওপর ইসলামাবাদ ইতিহাসের জঘন্যতম নির্যাতন চালাচ্ছে। নিরপরাধ, নিরস্ত্র মানুষদের হত্যা করছে। এর ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে শুরু করেছে বিশ্ব।
সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেন, তারা একটি ফ্যাসিস্ট, স্বৈরাচারি সেনাবাহিনী পরিচালিত সরকারের হয়ে আর কাজ করবে না। এখন থেকে তারা সাতে সাত কোটি বাংলাদেশীদের জন্য দ্বৈর্থহীনভাবে কাজ করে যাবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তারাই প্রথম পাকিস্তানি কূটনৈতিক হিসেবে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলো।
পশ্চিমবঙ্গে থাকা যেসব বাঙ্গালি কূটনৈতিকদের তাদের কর্মস্থল থেকে বদলীর নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাদেরকে রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে এক সপ্তাহ আগেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবরে রাজনৈতিক আশ্রয় নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গে তখন তিনজন বাঙ্গালি কর্মকর্তাসহ ১৪জন কূটনৈতিক পাকিস্তান হাই কমিশনে কাজ করতেন। তাদের মাঝে ২জনকে ভারতে বদলি করা হয়েছিলো।