You dont have javascript enabled! Please enable it! 1969.02.23 | শেখ মুজিবের মুক্তি লাভ : ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার | দৈনিক পয়গাম - সংগ্রামের নোটবুক

দৈনিক পয়গাম
২৩শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
শেখ মুজিবের মুক্তি লাভ : ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার
(স্টাফ রিপোর্টার)

তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার এক নম্বর অভিযুক্ত ব্যক্তি আওয়ামী লীগ প্রধান ৪৯ বৎসর বয়স্ক শেখ মুজিবর রহমানকে ঢাকার লক্ষ লক্ষ উল্লাস-বিহ্বল জনসাধারণ গতকল্য (শনিবার) বীরোচিত সম্বৰ্ধনা দান করেন। স্মরণকালের ইতিহাসে পাকিস্তানের কোন জননেতা এমনি ধরনের গণসম্বর্ধনায় সিক্ত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন নাই। বিপ্লবের অগ্নিসেনা আলজিরিয়ার বেন বেল্লা ফরাসী কারাগার হইতে মুক্তি লাভ করিয়া স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর তাঁহাকে যে গণসম্বর্ধনা জানান হইয়াছিল গতকল্য শেখ মুজিবের সম্বর্ধনার সহিত তাহার তুলনা করা যায়।
শেখ মুজিবের মুক্তির সংবাদ বিদ্যুৎ তরঙ্গের মত সারা শহরে ছড়াইয়া পড়িলে লক্ষ লক্ষ মানুষ উল্লাস নৃত্য করিতে থাকে এবং রাস্তাঘাট ও অলি- গলি সয়লাব করিয়া রাস্তায় নামিয়া পড়ে। মানুষের চাপ চাপ ভিড়ে শহরের অসংখ্য রাজপথে যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণরূপে অচল হইয়া পড়ে। অপরাহ্ন হইতে রাত্রি পর্যন্ত এই অবস্থা অব্যাহত থাকে।
“আমার নেতা তোমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব” ধ্বনি সারা শহরকে সচকিত-উচ্চকিত করিয়া রাখে।
পুর্ব পাকিস্তানের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক শেখ মুজিবের মুক্তির সংবাদ ছড়াইয়া পড়িলে মৌমাছির মত মানুষ তাহার ধানমন্ডীস্থ বাসভবনের দিকে ধাবিত হয়। তাঁহার বাসভবন কিছুক্ষণের মধ্যেই মানুষ আর শুধু মানুষের ভিড়ে ভরিয়া যায়। শেখ সাহেব তাঁহার গৃহের অলিন্দ হইতে উল্লসিত জনতার প্রতি সহাস্যে হস্ত আন্দোলন করিয়া অভিনন্দন জানান। তিনি জনতার উদ্দেশ্যে কয়েক দফা বক্তৃতা দান করেন। তিনি আবেগ জড়িত কণ্ঠে বলেন, “আমার মুক্তি জনগণেরই বিজয়।”
শেখ সাহেবের গৃহে সমবেত উল্লসিত জনতা তাঁহাকে বিপুলভাবে মাল্যভূষিত করেন। বাজির শব্দে আর জনগণের উল্লাস ধ্বনিতে সমগ্র এলাকা ধ্বনিতে প্রতিধ্বনিত হয়।
শেখ সাহেব অপরাহ্ন তিনটায় একটি খোলা জীপে করিয়া জনগণের সহিত সাক্ষাতের জন্য রাস্তায় নামিয়া পড়েন। পথের দুইধারে সমবেত উদ্বেলিত জনতা তাঁহাকে দেখামাত্র দীর্ঘ করতালিতে ফাটিয়া পড়ে।
তাঁহার খোলা জীপকে অসংখ্য মোটর সাইকেল আগাইয়া নিয়া যায়। মীরপুর রোড, নিউ মার্কেট ধরিয়া তিনি শহীদ মিনারে আগমনের পর এক অভুতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। উল্লাস আর আনন্দে জনগণ দুই হাত তুলিয়া নৃত্য করিতে শুরু করে। আবেগ-উত্তেজনায় কতিপয় ছাত্র অজ্ঞান হইয়া পড়ে। শহীদদের স্মৃতিবাহী শহীদ মিনারের সম্মুখে খোলা জীপে দাঁড়াইয়া তিনি নীরবে শহীদদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন।
গৃহ হইতে শেখ মুজিবর রহমান খোলা জীপে করিয়া যখন বাহির হন তখন এক উদ্বেলিত জনসমুদ্র তাঁহাকে অনুসরণ করে। মিছিল যতই অগ্রসর হইতে থাকে মানুষের সংখ্যা ততই বাড়িতে থাকে। কত হাজার ফুল যে তাহার প্রতি নিক্ষেপ করা হইয়াছে তাহার হিসাব করা দুঃসাধ্য। কত আবেগ, কত আনন্দ, কত অনুভূতির পরশ-সিক্ত ছিল এই সম্বর্ধনা। সংগ্রামী মহিলা ও ছাত্রীরাও এই সম্বর্ধনায় শরীক হন। আবাসিক এলাকার অলিন্দ হইতে হাজার হাজার মহিলা ও শিশু তাঁহাকে হাত নাড়িয়া সম্বর্ধনা জানায়।
শেখ মুজিবর রহমান আজিমপুর গোরস্থানে সাম্প্রতিক গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শহীদ বীরদের কবর জেয়ারত করেন এবং ফাতেহা পাঠ করেন। তিনি মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসাধীন আহতদের দেখার জন্য মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও গমন করেন। তিনি তাঁহার রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু মরহুম শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং মরহুম জননেতা শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুর হকের মাজারও জিয়ারত করেন। তিনি সামগ্রিক হেফাজতে গুলিবর্ষণের ফলে নির্মমভাবে নিহত সার্জেন্ট জহুরুল হকের গৃহেও গমন করেন।
গতকল্য নারায়ণগঞ্জ, ডেমরা এবং টঙ্গী হইতেও হাজার হাজার উল্লসিত শ্রমিক ট্রাক-বাসে করিয়া শহরে আগমন করে এবং গভীর রাত্রি পর্যন্ত “শেখ মুজিব শেখ মুজিব” “আমার ভাই তোমার ভাই শেখ মুজিব,” আমার নেতা তোমার নেতা শেখ মুজিব” জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো” “সংগ্রাম সংগ্রাম চলবে চলবে” ধ্বনিতে পর্যন্ত উল্লসিত শহরকে আনন্দ-বিহ্বল করিয়া রাখে।
গতকল্য পাড়ায়-পাড়ায়, রাস্তায় রাস্তায়, গলিতে-গলিতে আনন্দ প্রকাশের জন্য হাজার হাজার পটকা ফোটান হয়। রাস্তায় রাস্তায় আনন্দ নৃত্য গভীর রাত্রি পর্যন্ত চলিতে থাকে। গানে মুখরিত থাকে শহর। উৎসব আর উৎসব আনন্দ আর আনন্দ।
গতকল্য শেখ মুজিবের মিছিলের পশ্চাৎভাগে তথাকথিত ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম অভিযুক্ত খান শামসুর রহমান, লেঃ কম্যাণ্ডার মোয়াজ্জেম ও পৃথক পৃথক ট্রাকে উল্লাস-মুখর জনতা পরিবৃত হইয়া শহর পরিভ্রমণ করেন। তাহাদেরও বিপুলভাবে মাল্যভূষিত করা হয়। জিন্দাবাদ ধ্বনিতে তাহাদের সিক্ত করা হয়।
গতকল্য লক্ষ মানুষের কন্ঠে একটি শ্লোগান বিশেষ প্রিয় ছিল। তাহা হইল “ক্যান্টনমেন্টের তালা ভেঙ্গেছি, শেখ মুজিবকে এনেছি।”

সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯