You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.03 | জয় বাংলা ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা - সংগ্রামের নোটবুক

জয় বাংলা ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা

মূল পত্রিকা পড়তে এখানে ক্লিক করুন

জয় বাংলা
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপত্র
প্রথম বর্ষ, ৩০শে সংখ্যা, মুজিবনগর শুক্রবার ১৬ই অগ্রহায়ণ ১৩৭৮ ৩রা ডিসেম্বর, ১৯৭১
“অশুভ পরিণতির জন্য প্রেরকরাই দায়ী থাকবেন
বাংলাদেশ জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক প্রেরণের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের হুঁশিয়ারি
(জয়বাংলা প্রতিনিধি)
দশ লক্ষাধিক বাঙালি হত্যার জঙ্গী নায়ক ইয়াহিয়া খানের অনুরোধে বাংলাদেশে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক প্রেরণের প্রশ্নটি সেক্রেটারি জেনারেল উথান্ট-এর বিবেচনাধীন রয়েছে বলে প্রকাশিত খবর মুজিবনগরে তীব্র চাওয়া হলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর জন্য তাজউদ্দিন আহমেদ জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক প্রেরণের প্রশ্নটিকে “একটি সুগভীর ষড়যন্ত্র বলে” আখ্যায়িত করেন এবং বলেন এটা হচ্ছে পেছনের দুয়ার দিয়ে অপচেষ্টা মাত্র।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন আমাদের সংগ্রামের এই চূড়ান্ত পর্যায়ে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক সেজে যারাই আসুক না কেন তাদের ‘অবধারিত অশুভ পরিণতির’ জন্য যারা তাদের পাঠাবেন তারাই দায়ী হবেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানবতার দুশমন ইয়াহিয়ার হানাদার বাহিনী যখন বাংলাদেশে নারকীয় হত্যাযজ্ঞের সৃষ্টি করেছিল তখন যারা টু-শব্দটি পর্যন্ত করেনি আজ তারাই জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক প্রেরণের মাধ্যমে জঙ্গী চক্রকে রক্ষার শেষ চেষ্টা করছেন।
জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ বলেন, ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ থেকে মুক্ত হবার সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে যখন আমরা উপনীত হয়েছি তখন কোনো অজুহাতে যদি কেউ অন্তরায় সৃষ্টি করতে আসে আমরা তা সহ্য করব না।
ইন্দিরার দাবী হানাদার হটাও
“বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ হিসেবে হানাদার পাকিস্তানকে বাংলাদেশ থেকে সমস্ত সৈন্য সরিয়ে নিতে হবে এবং সেটাই হবে শান্তির পথে প্রথম পদক্ষেপ। “গত ৩০শে নভেম্বর রাজ্যসভায় শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেছেন, আগামী মাসের (ডিসেম্বর মাস) ভারত ও বাংলাদেশের জনগণের চরম সমস্যার মাস। তবে ভারত ও বাংলাদেশের জনগণ যে বর্তমান অন্ধকার কাটিয়ে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ জীবন গড়ে তুলতে পারবে সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ।”
প্রধান সেনাপতির প্রত্যয়
বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল ওসমানী সদ্য মুক্ত খুলনা জেলার বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণ করে এই আশা প্রকাশ করেছেন যে, বাংলাদেশের পবিত্র ভূমি থেকে পাকহানাদারদের বিদায়ও সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়ার দিন এসে গেছে।
সোহরাওয়ার্দীর অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে
-প্রধানমন্ত্রী
আমাদের অভিযানে যে গৌরব-জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ৮ম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে প্রদত্ত এক বাণীতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ এক বাণীতে বলেনঃ
ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের অগ্রদূত জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকী আগামী ৬ই ডিসেম্বর দেশের সর্বত্র পালিত হতে চলেছে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সকল চক্রান্তের বিরুদ্ধে বিশেষতঃ একনায়কত্ববাদের উচ্ছেদ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক শোষণের অবসান ও দেশবাসীর মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নেতৃত্বে তিনি দিয়েছেন, ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। সামরিক চক্রের নির্যাতন ও নিপীড়ন সত্বেও তার মনোভাব ছিল আপোষহীন। তাই পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে তাকে বিদেশে স্বজনহীন পরিবেশে রহস্যময় মৃত্যু বরণ করতে হয়েছে। সে রহস্য একদিন উদ্ঘাটিত হবেই।
সোহরাওয়ার্দীর স্মৃতি যেমন অমলিন, তার সংগ্রাম তেমনি অজেয়। তার যোগ্য উত্তরসূরি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের মানুষ সেই সংগ্রামের পথে অগ্রসর হয়েছে এবং রক্তের বিনিময়ে সেই সংগ্রামকে আজ চূড়ান্ত বিজয়ের মুহূর্তে নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ কে সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত করে আমাদের জাতীয় নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দীর স্মৃতিকে আমরা অম্লান করে রাখবো। আজ তার মৃত্যুদিনে শত্রুকে শেষ আঘাত হানার জন্য সকল নতুন করে শপথ গ্রহণ করুন।”
চারটি জেলা মুক্ত
সকল রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর অগ্রগতি
যশোর দুর্গের মুক্তি আসন্ন
(জয়বাংলার প্রতিনিধি)
বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমণে বিপর্যস্ত বিধ্বস্ত পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদের আত্মরক্ষার শেষ উপায় হিসেবে ক্যান্টনমেন্টের শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য ক্যান্টনমেন্ট ও গ্যারিসনে সৈন্য সরিয়ে নিয়ে যাওয়ায় ফরিদপুর, বরিশাল পটুয়াখালী জেলা কার্যত মুক্ত হয়েছে। অপরদিকে মুক্তিবাহিনী টাঙ্গাইল জেলাও শত্রুকবলমুক্ত করেছেন।
দখলীকৃত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও শক্তিশালী যশোর ক্যান্টনমেন্ট এর পতন আসন্ন। মুক্তিবাহিনী চারিদিক থেকে যশোর ক্যান্টনমেন্ট কে ঘিরে রেখেছে এবং মর্টার ও কামান থেকে অবিরাম গুলি বর্ষণ করে চলেছেন।
ঢাকার সাথে যশোর ক্যান্টনমেন্ট এর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। ফলে বাইরে থেকে শত্রুবাহিনীর রসদ বা অস্ত্রশস্ত্র লাভের পথ কার্যত বন্ধ হবার পথে। ওদিকে খুলনা ও কুষ্টিয়ার সাথেও যশোর ক্যান্টনমেন্ট এর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। সামরিক বিশেষজ্ঞদের মতে যশোর ক্যান্টনমেন্ট এর অবরূদ্ধ পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে সমর্পণ করতে হবে নয়তো যুদ্ধে প্রাণ দিতে হবে। তবে যশোর ক্যান্টনমেন্ট যে অদূর ভবিষ্যতেই মুক্ত হবে তাতে দ্বিমতের কোনো অবকাশ নেই।
নোয়াখালী সেক্টরেও মুক্তিবাহিনী এলাকার পর এলাকা দখল করে বর্তমানে ফেনী শহরের পরে হামলা চালাচ্ছেন। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমণে বিপর্যস্ত এক ব্যাটালিয়ন বালুচ সৈন্য অস্ত্রশস্ত্রসহ মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় ফেনী শহরের মুক্তি ও আসন্ন।
সিলেট সেক্টরের মুক্তিবাহিনীর জাহেরপুর, রাধানগর ও গৌরি নগর থানা দখলের পর বর্তমানে সিলেট শহরের একেবারে কাছে এসে গিয়েছে। জানা গিয়েছে যে, বাইরের সাহায্য লাভে বঞ্চিত পাক বাহিনীর পক্ষে আর বেশিদিন সিলেট রক্ষা করা সম্ভব হবে না।
দিনাজপুর- রংপুর সেক্টরে পঁচাগর দখলের পর মুক্তিবাহিনীর দ্রুতগতিতে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। এই সেক্টরে গত কয়েক দিনে প্রায় সাড়ে চার শত বর্গ মাইল এলাকায় শত্রুমুক্ত হয়েছে।
কুষ্টিয়া সেক্টরে মুক্তিবাহিনী মেহেরপুর ও নাটুদহ থেকে শত্রু সৈন্যদের বিতাড়িত করেছে। মুক্তিবাহিনীর অপর একটি দল দর্শনা স্টেশন এলাকা মুক্ত করেছে।
সাতক্ষীরা সেক্টরে একমাত্র সাতক্ষীরা শহর ছাড়া প্রায় বাদ বাকি সমস্ত এলাকা মুক্তিবাহিনীর হস্তগত হয়েছে। মুক্তিবাহিনী সাতক্ষীরা শহরে শত্রু সৈন্যদের অবরোধ করে রেখেছে।
রণাঙ্গনে
যশোরে মুক্তিযোদ্ধাদের সাঁড়াশি আক্রমণ
ভীতসন্ত্রস্ত হানাদার সৈন্যরা মৃত্যুর দিন গুনছে
মুক্তিবাহিনীর (অস্পষ্ট) বীর যোদ্ধারা গত ২৩শে নভেম্বর যশোর বিমান ক্ষেত্রটি প্রচন্ড আক্রমণ চালিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ করেছেন।
মুক্তিযোদ্ধারা যশোর শহরের উপকণ্ঠে এখন আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন। ভীতসন্ত্রস্থ সৈন্য, বাঙালি অফিসার ও দালালরা এখন শহর থেকে পলায়ন করতে শুরু করেছে। এদিকে গেরিলা যোদ্ধাদের মারাত্মক সাঁড়াশি আক্রমণ এর ফলে হানাদার পাকিস্তানী সৈন্যরা এখন ক্যান্টনমেন্টে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা শহরের তিন দিক থেকে আক্রমণ চালাচ্ছেন।
জঙ্গী সরকার আসন্ন পরাজয়ের মুখে শহর থেকে গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্র ও অর্থ ঢাকায় পাচার করছে।
২৫শে নভেম্বরের যশোর রণাঙ্গন
আমাদের রণাঙ্গন প্রতিনিধি জানাচ্ছেন, মুক্তিবাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণে যশোরের দালাল, রাজাকার এবং অন্যান্য বেইমানরা এক্ষণে শহর ছেড়ে সেনাবাহিনীর আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছে। গেরিলা যোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণ ইতিমধ্যে শত্রুপক্ষের একটা বিরাট অংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
পাকিস্তানের স্বীকারোক্তি
পাকিস্তান বেতার থেকে গত ২৫শে নভেম্বরের সংঘর্ষের খবর স্বীকৃত হয়েছে। খবরে বলা হয়, যশোরের চৌগাছায় তুমুল লড়াই চলছে। চৌগাছা যশোর ক্যান্টনমেন্টের লড়াইয়ে পাকিস্তানি দখলদার সেনারা জয় লাভের জন্য দখলীকৃত রেডিও মসজিদে মসজিদে কান্নাকাটি-র আবেদন জানায়।
যশোর শহর থেকে প্রায় আঠারো মাইল পশ্চিমে ঝিনাইদহ পাঁচ মাথার মোড়ে মুক্তিবাহিনী সেখানে তাদের ঘাঁটি শক্তিশালী করেছেন। ঝিকরগাছায় যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে।
ওদিকে মুক্তিবাহিনীর বাজারের কাছে জগন্নাথপুর ও চুয়াডাঙ্গা নামক গ্ৰাম দুটো দখল করে নিয়ে যশোর-ঝিনাইদহ রোগ মারফত পাকসেনাদের চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন। এই রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাক সৈন্যদের ঢাকার দিকে পলায়নের আর কোন পাকা রাস্তা রইল না।
যশোর ও কুষ্টিয়া জেলায় মুক্তিবাহিনীর জীবননগর, বগাচড়া, শার্শা ও নাভারন থেকে শত্রু সৈন্যকে বিতাড়িত করেছে।
ঝিনাইদহ পাঁচ মাথার মোড় সামরিক দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই মোড় থেকে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, খুলনা, মাগুরা, ঢাকা যাওয়ার পথ। সুতরাং পাকিস্তানি সৈন্য ঝিনাইদহ পাঁচ মাথার মোড় পুনরুদ্ধারের জন্য একটা মরণপণ লড়াই চলার সম্ভাবনা রয়েছে।
মুক্তিবাহিনী ঝিনাইদহ পাঁচ মাথার মোড়ে কুষ্টিয়া চুয়াডাঙ্গার রাস্তায় বিরাট বিরাট ব্যারিকেড গড়ে তোলায় ঝিনাইদহ থেকে পাকিস্তানী সৈন্যরা যশোরের দিকে যেতে পারছে না।
মুক্ত এলাকার গ্রামে বন্দরে
সারওয়ার জাহান
(জয়বাংলা প্রতিনিধি)
খুলনা জেলার দেবহাটা থানা আজ দুই মাস হল মুক্তি বাহিনীর দখলে। খবর পেলাম আগ্রহ মুক্তিবাহিনীর সমগ্র এলাকায় প্রশাসনিক ব্যবস্থা পুরোদমে চালু রেখেছে। এলাকাটা স্বচক্ষে দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। একদিন বেলা এগারটায় দখলীকৃত এলাকা থেকে হানাদার চোখ এড়িয়ে যখন মুক্ত এলাকা প্রবেশ করলাম তখন সমগ্র এলাকা কর্মব্যস্ত। মাঠে মুক্ত বাংলার কৃষকেরা কাজ করছে, পাশে দাঁড়িয়ে সজাগ দৃষ্টি রেখেছে সশস্ত্র বীর মুক্তি সৈনিক। বাংলাদেশের আকাশে নতুন সূর্যের আগমন আসন্ন। এদের সকলের চোখে তারেই ইঙ্গিত। বাংলাদেশ কৃষকের দেশ। এই কৃষকের দেশে মুক্তিসেনাদের সাথে কৃষকের যে সম্পর্ক দেখলাম তা প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। ক্ষেত ভরা ধান শীষ খেলা করছে পথের দু’পাশে। কোথাও কোথাও পাকা ধানে ভরে আছে ক্ষেত। বাড়ির পাশের পুকুরে গান গায়ের মায়েরা, বঁধুরা, বোনেরা। কোথাও ক্ষেতের পাকা ধান কেটে তুলছেন বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলের সংগ্রামী কৃষক। কয়েক জায়গায় দেখলাম সদ্য ফসল কাটা জমিতে হালচাষ করছে চাষীরা। দ্রুত হেঁটে চলেছি আমরা। কয়েকজন থানার কার্যালয়ে পৌঁছাব এই-ই লক্ষ্য। ডান পাশের একটা মোর ঘুরে হঠাৎ দেখলাম রাইফেল কাঁধে দুইজন যুবক অদ্ভুত তেঁজে হাল চাষ করে চলেছে। সাথে আরো দুজন একজন বৃদ্ধ আর এক তরুণ জমির আগাছা বেছে চলেছে। অদ্ভুত এই দৃশ্য। বাংলাদেশ ভিয়েতনামের এমন একটি দৃশ্য তার নিজের বুকে আশা করেনি। ক্ষুদিরাম, মাস্টার দা, আসাদের ছবিও যেন এ দৃশ্যের কাছে ম্লান হয়ে যায়। ম্লান হয়ে যায় শত শত মিছিল জামায়াতের কাহিনী। আমাদের বাংলাদেশের কৃষকের ছেলে মাতৃভূমির মুক্তির জন্য; দেশের স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র হাতে করছে লড়াই; এ লড়াই এর ফাঁকে ফাঁকে তার আগে দাঁড়াচ্ছে কর্মরত কৃষকের কাছে, নিজ হাতে করে দিচ্ছে তাদের কাজ। কৃষকের সাথে তারা চাষ করছে আর মারাই করছে ফসল, মাঝে মাঝে জাল টেনে ধরছে’ মাছ। তৈরি করছে ছিন্নমূল মানুষের জন্য ঘর বাড়ি। স্বাধীনতা পিয়াসী, মুক্তি পিয়াসী মানুষ তাদের আত্ম শক্তি ফিরে পেয়ে আজ বাংলাদেশে গড়ে তুলছে ইতিহাস। বাংলাদেশের দুর্বার যৌবনা মুক্তিসেনারা আজ এই ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ। বাংলাদেশের লাখো কৃষক যারা চাষাবাদকে আজ মুক্তি বাহিনীর কাজ বলে মনে করছে, বীর যোদ্ধাদেরকে পথ চিনিয়ে দেওয়াকে, মুক্ত এলাকার স্বাভাবিক কাজ চালিয়ে যাওয়াকে, অধিকৃত এলাকার হানাদারের সাথে অসহযোগিতা করাকে স্বাধীনতা যুদ্ধে শরিক হওয়া বলে ভাবতে শিখেছে, চাকুরীজীবী, মিল কারখানার শ্রমিকরা যারা চাকুরীর মায়া ত্যাগ করে-সর্বস্ব ত্যাগ করে মাতৃভূমির মুক্তির জন্য দৃপ্ত শপথে সশস্ত্র লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণের নাগপাশ ছিন্ন করে বঙ্গবন্ধুর প্রতিশ্রুত শোষণহীন সমাজ গঠনের যে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে মাঠে নেমেছে , তারাই এই ইতিহাসের স্রষ্টা।
গায়ের পথ ধরে থানা সদরে দিকে এগিয়ে যেতে অনেকের সাথে দেখা হল। আমাদের সাথে দুজন মুক্তিসেনা পথ দেখিয়ে চলেছে, আমরা কখনও বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে, কখনো সুপারি বাগানের ধার দিয়ে, নারিকেল গাছের নিচে দিয়ে, বুকের বাঁ দিকে বসতবাটির সদর দরজার ধার দিকে এগিয়ে চলেছি। মাঝে মাঝেই পড়ে ঘরবাড়ি নজরে পড়েছে। কোথাও ঘরের চাল পুরো ধ্বসে পড়েছে, কয়েকটি পাকা বাড়ি ও দেখলাম পুড়ে পরে রয়েছে। এখানে দাঁড়িয়ে নিবারণ চন্দ্র দাস নামে এক বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলাম,’আচ্ছা এই যে ঘরবাড়ি পোড়া দেখছি এর কারণটা কি বলুন তো।’ বৃদ্ধ যেন আক্রোশে চেঁচিয়ে উঠলো, সব ওই পাকিস্তানি মিলিটারির কাজ। আমাদের মুক্তি বাহিনীর সাথে যুদ্ধে টিকতে না পেরে পালিয়ে যাবার সময় কাপুরুষের মত নিরীহ মানুষের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। মেয়েদের উপরে যে কি অত্যাচার করেছে তা বলা যায় না। আমার ৮৩ বছর বয়সে এমন কোনোদিন দেখিনি, শুনিওনি। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছি ওরা যেন এদিকে আর না আসতে পারে।”পাশে দাঁড়িয়েছিল মাথায় গামছা বেঁধে প্রৌর কৃষক আব্দুল করিম। জিজ্ঞাসা করলাম, “মুক্তিবাহিনী আপনাদের বন্ধু না শত্রু?”সে ফুঁসে উঠলো, ” বলেন কি সাব? আমরাইতো মুক্তিবাহিনী। নিজের ঘরবাড়ি সব কিছু দস্যুরা কেড়ে নিয়েছিল। পালিয়ে গিয়ে ছিলাম ভারতে। আবারো ফিরে পেয়েছি সেটাই মুক্তিবাহিনীর জন্য। আমাদের জন্যই তারা লড়ছে। নিজেকে কি আর তাদের থেকে পৃথক করে দেখতে পারি? বললাম, আর তো আমরা হারবো না। আপনারা জেগেছেন। জাগ্রত জনতাকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারে না।’আমরা আরো এগিয়ে চলেছি। পথে এক বৃদ্ধার সাথে দেখা। বললাম-কি বুড়িমা, বাংলাদেশ হবে? বুড়িমা দ্রুত বলে উঠলেন, হবে বাবা হবে; দশে যা বলে তা হতেই হবে।”পাশে দাঁড়িয়েছিল ছেলে কোলে এক পিতা। তিনি বলে উঠলেন, বাংলাদেশ না হলি আমাগো পোলাপানরা বাচবো কেমনে?” পথ আমরা হেঁটেই চলেছি। আরো কিছুদূর এগিয়ে এখানে দেখতে পেলাম আম গাছের গোড়ায় বসে কতগুলো যুবক জটলা করছে। কাছে গেলাম, জিজ্ঞাসা করলাম, আপনারা কি বরাবরই এখানে ছিলেন, না পালিয়ে ছিলেন? একজন বলল, সেবার না বুঝে দেশ ছেড়ে পালিয়েছি, কিন্তু এবার আর পালাবো না। এবার সবাই মিলে অস্ত্র ধরে শত্রুকে রুখে দাঁড়াবো। মুক্ত এলাকায় স্বাধীনতার যে সাধ আমরা পেয়েছি, তা মুক্ত এলাকার পরিধি বাড়াতে আমাদের সাহায্য করবে, হানাদার বাহিনীর ক্রীতদাস হতে নয়।’নতুন বাংলার সৃজনশীল যুবকের এ দৃঢ়তা কোনদিন ভুলবার নয়। বাংলাদেশের যুবকের মুক্তিসংগ্রাম বিশ্বের ইতিহাসে চির অম্লান হয়ে থাকবে।
প্রায় পৌনে চার ঘণ্টা হাঁটার পর আমরা থানা সদরে গিয়ে পৌঁছলাম। হানাদার দস্যুরা পিছু হটে যাবার সময় থানার আশেপাশে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। থানার দক্ষিণ পাশে একটা বিধ্বস্ত ইটের বাড়ি অত্যাচারের প্রতিচ্ছবি হয়ে পড়ে আছে। দোতলা ইমারতে ছিল থানার অফিস। নিচতলা উপর তলা মিলে ছয়টি ঘর আমরা অনেক প্রশ্ন নিয়ে ঘুরে দেখলাম। কোথাও কোনো আসবাপত্র নেই। এখানে-ওখানে ওয়ারেন্ট আর ডায়েরির বই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মাঠে পড়ে আছে এক ভাঙ্গা স্কুটার। পাশের লোকটিকে জিজ্ঞেস করে জানলাম থানার অদূরে যুদ্ধচলাকালীন ভীতসন্ত্রস্ত শ্রীপুরে মিউনিসিপাল অফিসের কোনকিছুই তারা সরাতে পারেনি। থানার সামনেই স্কুল।
জরুরি অবস্থায় স্কুল বন্ধ। স্কুল এর উপরে সমুন্নত হয়ে উড়ছে- বাংলাদেশের শক্তিধর পতাকা- সংগ্রাম আর জীবনের প্রতিশ্রুতির প্রতীক।
একটু হেঁটে মিউনিসিপাল অফিসে গেলাম। এই মিউনিসিপাল অফিসেই মুক্তিবাহিনীর ছোটখাটো প্রশাসনিক কাজ চালায়। এখানেই পরিচিত হলাম মুক্ত এলাকার ভারপ্রাপ্ত অফিসার লেফটেন্যান্ট চৌধুরী, পার্শ্ববর্তী কয়েকটি থানার ভারপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন হুদা এবং ভারপ্রাপ্ত মেডিকেল অফিসার ডাক্তার শাহজাহানের সাথে। সবাই তো এখন কাজে ব্যস্ত। লোকজন কেউ অধিকৃত এলাকার অবস্থা জানাচ্ছে, কেউ তাদের অভাব-অভিযোগের কথা জানাচ্ছে, আবার কেউ বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি ঠিক করার জন্য চাচ্ছে মুক্তিবাহিনীর সাহায্য। আমরা যখন কথা বলছি তখন মুক্ত এলাকার শেষ সীমানা থেকে গোলাগুলির আওয়াজ আসছিল। ক্যাপ্টেন সাহেবের বিশেষ কাজ থাকায় তিনি বিদায় নিলেন। লেফটেন্যান্ট চৌধুরী আমাকে একটু বসতে বলে বাহিরে গেলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি ফিরে এসে বললেন, “আমার একটু কাজ আছে, আপনাকে একটু বসতে হবে, আপনাকে পাকহানাদারদের একটি মজবুত ঘাঁটি দেখাবো।”অফিসের পাশেই আছে একটি বাজার আর বাজার থেকে কিছু দূরে বসে একটি হাট। সেদিন ছিল হাটবার। আমরা বললাম, ” আপনি আপনার কাজটা সেরে নিন, আমরা একটু হাটটা ঘুরে আসি।”বেরিয়ে পড়লাম। বাজারটাকে ডান পাশে রেখে হাটে গেলাম। সেখানে পুরোদমে কেনাবেচা চলছে সরিষার তেল, চাউল, ধান, লবন, মসলা, তাঁতের কাপড় ইত্যাদি প্রতিটি জিনিসের দেখলাম প্রচুর আমদানি। এখানে দুই প্যাকেট স্টার সিগারেট কিনতে কিনতে সাথে মুক্তি সৈনিক দিকে দেখিয়ে দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করলাম আচ্ছা, এই যে এলাকা? না, মিলিটারি ইচ্ছে করেই আসেনা বলে এটা মুক্ত?” কথার পিঠেই সে বলে উঠলো, এখানে থাকেন না বলেই কথাটা বলছেন। পাক পশুরা সবসময়ই এই এলাকা দখল করার চেষ্টা করছে, প্রতিদিনই হানা দেবার চেষ্টা করছে, কিন্তু মুক্তিবাহিনীর সাথে তারা কিছুতেই পারছে না। এই এলাকার জোর করেই মুক্ত করা হয়েছে, কার দোয়ার উপরে নয়।” বললাম” মিলিটারি এখান থেকে হটে যাবার পর কি ভেতরে আর ঢোকেনি?” উত্তর পেলাম, খাস পাকসেনারা ঢুকেনি কিন্তু বদমাইশ রাজাকাররা একদিন ঢুকেছিল। তার এই হাটেই এসে লুট করতে চেয়েছিল, কিন্তু মুক্তিবাহিনী হঠাৎ কোথা থেকে এসে এমন মার দিলো যে সাত জনকে মরা রেখেই বাকিরা দৌড়ে পালালো।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্ত)
বিদেশিদের দৃষ্টিতে ঢাকা শহর ও মুক্তি বাহিনী
( বিশেষ সংবাদ প্রেরিত)
ঢাকা, ২৯শে নভেম্বর- মুক্তি বাহিনীর গেরিলা যোদ্ধাদের সাফল্যজনক চোরাগোপ্তা আক্রমণে হানাদার সৈন্যরা আজ ভীতসন্ত্রস্ত ও দিশেহারা। দখলীকৃত ঢাকা শহরে সামরিক দপ্তর এ প্রতিদিন যে টুকরো টুকরো খবর পৌঁছাচ্ছে তার ফলে হানাদাররা চূড়ান্তভাবে মুক্তিবাহিনীর হাতে মার খাওয়ার সেই ভয়ঙ্কর দিনটির জন্য অসহায় ভাবে প্রতীক্ষায় আছে।
মুক্তিযোদ্ধাদের মারের চোটে জঙ্গী সরকার এখনই মুক্তি বাহিনীর তৎপরতা স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে।
গত ২৭শে নভেম্বর হানাদার বাহিনীর দখলীকৃত বাংলাদেশের সেনাধ্যক্ষ লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ, কে, নিয়াজী সর্বনাশা ঘটনা মাথায় নিয়ে সারা বাংলাদেশে ছুটোছুটি করতে করতে ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলন করে।
উক্ত সাংবাদিক সম্মেলনের খবর দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে সামরিক সরকার বলছে বর্তমানে ঢাকা শহরে দুই সহস্রাধিক মুক্তিযোদ্ধা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন।
বিবিসি গত সপ্তাহ ব্যাপী মুক্তিবাহিনীর ঢাকা আক্রমণের খবর পরিবেশন করে বলছেন, মুক্তিবাহিনী ঢাকা-ময়মনসিংহ মধ্যবর্তী সড়কের ১৭টি গুরুত্বপূর্ণ সেতু ধ্বংস করে দিয়েছেন। ফলে এ পথে সড়ক যোগাযোগ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে পড়েছে। এদিকে মুক্তিবাহিনীর অব্যাহত আক্রমণের ফলে ঢাকা-যশোর এর মধ্যে সড়ক ও বিমান যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে ঢাকাবাসী আটকে পড়ে গেছে। ফরিদপুর, বরিশাল ও অন্যান্য নদীতে লঞ্চ সার্ভিস বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে গ্রামের বাড়ির সাথে যোগাযোগ হারিয়ে তারা এক অসহায় অবস্থায় পতিত হয়েছেন।
বিবিসি সংবাদ পর্যালোচনা করে বলছেন যে, ঢাকা শহর একতাবদ্ধ রাত্রি পর্যন্ত কর্মচঞ্চল থাকতো আর সেই সন্ধার পর মৃত নগরীর রূপ নেয়। এছাড়া স্কুল-কলেজ বন্ধ রয়েছে। মুক্তিবাহিনী গত ২৭শে নভেম্বর দালালদের একটি পেট্রলপাম ধ্বংস করে দিয়েছেন।
বিবিসির খবরে প্রকাশ মুক্তিবাহিনীর গত ২৮ শে নভেম্বর সেগুনবাগিচায় অবস্থিত কেন্দ্রীয় জুট বোর্ডে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, গত সপ্তাহের গোড়ার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় একটি ব্যাংকে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সাতজন দালালকে হত্যা করেছেন।
মুক্তিবাহিনীর প্রকাশ্য আক্রমণের ভীত ও সন্ত্রস্ত জঙ্গী সরকার গত ২৪শে নভেম্বর সন্ধ্যায় ছাড়ে পাঁচটা থেকে রাত সাড়ে নটা পর্যন্ত পুনরায় ঢাকায় কারফিউ জারি করে। পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই এবারও কারফিউ জারি করা হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য গত ১৭ই নভেম্বর এগার ঘণ্টা ব্যাপী কারফিউ জারি করে মুক্তিযোদ্ধাদের আটক করার অজুহাতে ব্যাপক ভাবে হত্যা, লুণ্ঠন ও নারী ধর্ষণ করে। আমাদের দু সাহসিক যোদ্ধারা শহরে বিভিন্ন অংশে ও ব্যভিচার এর বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে শত্রুসেনার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেন।
দ্বিতীয়বারের কারফিউ কালীন হানাদার পশুরা পূর্ব ঘটনার অনুরূপ অপচেষ্টায় মাতলে আমাদের স্বাধীনতাকামীরা তার প্রতিশোধ নেন। ফলে শত্রুরা মাত্র চার ঘণ্টা পরেই কারফিউ তুলে প্রাণ বাঁচানোর জন্য শহর থেকে নিজেদের আস্তানায় অবস্থান নেয়।
মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধারা উত্তর দিন সকালে সমগ্র ঢাকা শহরে গোলাগুলি ও বোমা দ্বারা আক্রমণ চালিয়ে একজন মহিলা দালালসহ তিনজনকে খতম করেন। এসব আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যই স্থান ছিল রাজার বাগ পুলিশ সদর দপ্তর, খিলগাঁও শত্রু অবস্থান ও পাটের গুদাম।
মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা উদ্দিন কয়েকটি পাটগুদাম ও ভষ্মিভূত করেন। এনিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা নারায়ণগঞ্জ ও খুলনায় অন্তত বিশটি পাটগুদাম জ্বালিয়ে দিয়েছেন।
বিবিসি-র পড়ে খবরে প্রকাশ মুক্তিবাহিনীর দুর্ধর্ষ গেরিলা যোদ্ধারা ঢাকা থেকে সতের মাইল দূরে গত ২২শে নভেম্বর মুন্সিগঞ্জ থানায় আক্রমণ চালিয়ে একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর কে নিহত এবং কয়েক জনকে গুরুতররূপে আহত করেন। এর আগে মুন্সিগঞ্জ থানা ফাঁড়ি ও লৌহজং ফাঁড়িও জ্বালিয়ে দেন।
হরগঙ্গা কলেজে হানাদার সৈন্য ছাউনির পৌনে এক মাইল নিকট দিয়ে প্রকাশ্য রাজপথে দেড় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা কুচকাওয়াজ করে ঘাঁটিতে প্রত্যাবর্তন করেন।
মুক্তিবাহিনী গত ২৬শে নভেম্বর দখলীকৃত ঢাকায় হানাদার সৈন্যদের উপর ব্যাপক আক্রমণ চালায়।
এ সম্পর্কে এএপির একটি সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়।
মুক্তিবাহিনীর দুঃসাহসিক গেরিলা যোদ্ধারা পূবাইল আড়িখোলা রেল সেতু ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ এর মধ্যবর্তী হানাদারদের রেলযোগাযোগ সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। গেরিলা যোদ্ধারা মিরপুর সড়কে হানাদার সৈন্যবাহিনী একটি বাসে আক্রমণ চালিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেন।
মুক্তিবাহিনীর দুঃসাহসিক আক্রমণে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ ২৩ জন বেইমান দালাল হাসপাতালে স্থানান্তরিত হয়। এদের মধ্যে তিনজন পথে প্রাণ হারায়।
দখলীকৃত ঢাকা অন্যান্য শহর থেকে বিচ্ছিন্ন
এএপির এক খবরে প্রকাশ বাঙালি গেরিলাদের ক্রমবর্ধমান তৎপরতায় সম্প্রতি যশোর, সিলেট, চাটগা, ঈশ্বরদী ও সৈয়দপুরে সঙ্গে ঢাকার স্থলপথে কোন যোগাযোগেই ছিল না। বিমান পথেই একমাত্র সম্বল। এখন সে যোগাযোগ ও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওইসব শহরের সঙ্গে ঢাকার আর কোন সংযোগেই রইল না।
কসবার মুক্ত অঞ্চল ঘুরে এলাম
-জাহাঙ্গীর আলম
‘শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। হাত মাস পরে একটু শান্তিতে নামাজ পড়বার পাল্লাম।’
কথাটা একজন বৃদ্ধ কৃষকের। বাড়ি বিয়ারা, কসবা। মাত্র সেদিনেই বাংলার বীর মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার পশুদের তাড়িয়ে দিয়ে দখল করে নিয়েছিল কসবা এলাকা। অনেকটা কৌতুহল হতে দেখতে গেলাম সদ্য মুক্ত এলাকাটি। বুকে একটা চাপা উত্তেজনা। কসবা কুটি রোড ধরে হাঁটছিলাম। সর্বপ্রথমে চোখে পড়ল একটা মিছিলের প্রতি। এগিয়ে আসছেন সামনের দিকে। আনন্দ মিছিলে অংশ নিয়েছে গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। কন্ঠে তাদের নিরলস স্লোগান “জয় বঙ্গবন্ধু- জয় বাংলা।”
মিছিলটি চলে গেল পাশ কেটে। আমি তখনও ওদিকেই তাকিয়ে। মনে পড়ে গেল কয়েক মাস আগের কথা। গত ডিসেম্বর মাসে এ পথেই দেখেছি এমনি কত মিছিল। কণ্ঠে ওদের একই স্লোগান ছিল ‘জয় বঙ্গবন্ধু- জয় বাংলা।’
আজকের এই মিছিলে হয়তোবা ওদের অনেকেই নেই।
আবার পথ চলতে শুরু করলাম। পথের দুপাশে মাঠ, আমন ধান কাটার প্রায় সময় হয়ে এসেছে। বড় খলাস (একপ্রকার আগাছা) হয়েছে এবার সদ্যফোটা খলাসের ফুলে সাদা সারাটা মাঠ। এতদিন শত্রু ভয়ে মাঠে কাজ করতে পারেনি কৃষক। তাই এত আগাছা। কিন্তু আর কয়দিন পরেই পেকে যাবে খলাস। ফুটে ঝরে পড়বে। জমিতে পরবর্তী বছরে এ জমি চাষ করতে বড় কষ্ট হবে কৃষকের। তাই অনেকদিন পর সুযোগ পেয়ে আর ঘরে বসে নেই তারা। সবাই মাঠে নেমে গেছে। পরিষ্কার করছে ক্ষেতের খলাস। মনে তাদের উৎসাহ। দূরে থেকে ভেসে আসছিল গানের দুটো কলি -‘ও দাইমা কিসের বাদ্য বাজে গো, আমার দাইমা, দাইমা গো।’
আর কত দূর এগিয়ে গেলে সামনে পড়লেও বিয়ারার মসজিদ। সেখানে একটি গাছের নিচে বসে আছে একদল মুক্তিযোদ্ধা। ওরা একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। চারদিকে ভিড় জমিয়েছে গ্রামের অসংখ্য জনসাধারণ। কেউ পানি নিয়ে আসছে, কেউ তামাক, কেউবা আবার পাত্রে করে খাবার নিয়েও এগিয়ে আসে তাদের জন্য। সবার মুখেই হাসি। শুধু কথার উপর কথা। প্রশ্নের পর প্রশ্ন। এর যেন আর শেষ নেই।
দুপুর অনেকটা গড়িয়ে পড়েছে। জোহরের নামাজ পড়া শেষ হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। সবে মাত্র মসজিদ থেকে বেরিয়ে এসেছেন একজন বৃদ্ধ। বার্ধক্যের ভারী একেবারে নেমে পড়েছেন তিনি। লাঠিতে ভর দিয়ে হেঁটে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এসে থেমে যান। মুখে তার মৃদু হাসি। উপরের দিকে মুখ করে কাকে উদ্দেশ্য করে যেন বলে ওঠেন, “শুকুর আলহামদুলিল্লাহ! হাত মাস পরে একটু শান্তিতে নামাজ পরবার পাল্লাম।”

তাঁর চোখে আগুন
অনু ইসলাম
চুলোর মুখে শুকনো পাতাগুলো ঠেলে দিচ্ছিলেন তিনি। ঝরঝরে পাতাগুলো শব্দ করে জ্বলছিল -যেমন করে জ্বলছে বসে যাওয়া তার দুচোখের কোটরে।
তাকে আমি জানিনা। কি নাম তাও জিজ্ঞেস করতে পারব না। রাত কটা তাও বলতে পারবো না। তবুও রাতের তাঁরার সাথে ঘড়ির মিনিটের কাটা কাটা দাগের সাথে সময় মিলাতে ইদানিং আমাকে ঘড়ি সন্ধান করতে হয়না। রাত এখন আটটা হয়তোবা!
আমি দেখছিলাম জ্বলন্ত চুলো। দেখছিলাম তার কোটরাগত বিস্ফোরণ উন্মত্ত দু চোখের মনি। অবিকল যেন মায়ের চোখ। পনের বছর আগে হাফপ্যান্ট পড়ে মার্বেল খেলা খেলতে খেলতে সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে ঘরে ফিরলে যেমন করে মায়ের চোখ মুখ দিয়ে আগুন জ্বলত তেমনি করে আজ এই অচেনা অজানা বুড়িমার দু চোখের কোটরে আগুন জ্বলছে।
ভাঙ্গা ঘরের বাঁশের খুঁটিতে ঠেস দিয়ে বসে ভাত রান্না দেখছিলাম। বয়সের চাপে ঘরটা একদিকে হেলে পড়েছে। বেড়ার ফাঁক দিয়ে পুবের আকাশ দেখা যাচ্ছে। অজান্তে কুয়াশার চাদরে নতুন বাড়ি কিংবা বড় বাড়ির পুকুর চালাটা দেখতে গিয়ে অকস্মাত্ মনে পড়লো আহসানগঞ্জ বসে আছি এক বুড়িমার সম্মুখে।
গতকাল ছেড়ে আসা গ্রামটাতে অপারেশন চালিয়ে সূর্য ওঠার আগে এখানে আশ্রয় নিয়েছি। আমার সাথে আরও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। এপাড়ার আরও দশটি ঘরে।
রাত তখন শেষ হতে আরো কিছু বাকি। তখন আমরা এই আহসানগঞ্জে। নদীর বাঁকে গড়ে ওঠা ঘনবসতিপূর্ণ একটি ক্ষয়িষ্ণু গ্রাম।
মধ্যরাতে প্রচন্ড চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালিয়ে তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করলে শত্রুরা কয়েকটি লাশ, এল এম জি রাইফেল ও কয়েক রাউন্ড গুলি ফেলে প্রাণ বাঁচানোর জন্য অধিকৃত এলাকা থেকে পালিয়ে যায়। আমরা যখন গোপন সংকেত দিয়ে সঙ্গবদ্ধ হয়ে পোড়া বারুদ সুকে সুকে অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধারে লেগে গেলাম।
আমাদের প্লাটুনের সবচেয়ে তরুণ ছেলেটা ফিসফিস করে লাফিয়ে উঠলো-নাজমুল ভাই, একটা এলএমজি রোজগার করেছি। আমার তখন সে কি আনন্দ। ১৯৫৪ সালের বর্ষায় বাড়ির উঠোনে বড়শি ফেলে একটা সরপুঁটি ধরে যেমন উৎফুল্ল হয়ে ছিলাম ঠিক তেমনই মনে হল একটা সরপুঁটি ধরেছি।
আনন্দের আতিশয্যে আমি দ্রুত পেছনের দিনগুলো তে ছুটে গেলাম। তারপর -আর ভাবতে পারলাম না দু ফোঁটা অশ্রু অজান্তে হাতের এলএমজির উপর গড়িয়ে গেল। হানাদার হায়নারা এমনই একটা অশ্লীল আমার স্নেহময়ী বড় বোনকে এ পৃথিবীর আশা-আকাঙ্ক্ষার অধিকার থেকে চিরতরে বঞ্চিত করেছে। ওই দস্যুরা পাহাড়তলীর বাসায় ঢুকে শোভা আপা কে গুলি করে হত্যা করেছে।
ভাবতে ভাবতে আমার শরীর হিংস্রতা ও প্রতিশোধের নেশায় মত্ত হয়ে উঠল। শিরায় শিরায় যন্ত্রণার সেই বিষাক্ত ধারালো সূচ গুলো আমাকে অনুক্ষণ নির্মমভাবে আঘাতে আঘাতে ক্ষিপ্ত করে তুলল। এমনি অনুভব এর সাগরে যখনই তলিয়ে যেতে থাকি তখনই হাতড়াতে হাতড়াতে রাইফেলটাকে শক্ত করে ধরে সতর্ক দৃষ্টিতে এগিয়ে যাই। মেশিনগানের ট্রিগারটা যেইমাত্র লাফিয়ে উঠে ঝাঁকঝাঁক শত্রু নিধনে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে তখন বুকের যন্ত্রণা ক্রমেই মিলিয়ে যেতে থাকে।
ঃ কাইল রাইত্যা কি খায়ছিল্যা?
বুড়িমার দিকে তাকালাম- অবিকল সেই মায়ের কন্ঠ, সেই মুখ, সেই স্নেহ মাখা দৃষ্টি। মার জন্য বুকটা কেঁপে উঠল। বেদনায় কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো।
ঃবুচ্ছি কিছু খাও নাই –
না না আমরা ঠিক খেয়ে ছিলাম। তবে কি জানো মা কেবল দুমুঠো ভাত খেতে দিয়েছি এমন সময় একটা ছেলে এসে শত্রু অবস্থানের খবর দিল। অমনি আমার বুকের ভেতর যন্ত্রণায় পাগল করে তুলল। আমি পাগল হয়ে উঠলাম।
ঃ হবে না। সারা দিন রাত না খাইয়া খাইয়া ছোটাছুটি করলে কি আর শরীর টেকে। তা বাবা কোন ওষুধ-টুষুধের ব্যবস্থা কইরতাছাও? যেন কতটা রেগে গিয়ে একগাদা শুকনো পাতা চুলোর মুখে ঠেসে দিলেন। আবার পূর্ণবেগে দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগলো।
জলন্ত অগ্নি আলোকে মেশিন গানটা এগিয়ে দিয়ে বললাম এই হল আমার ওষুধ। জানো মা এটা শত্রুর দিকে তাক করে বসে পড়লে আমি একদম সুস্থ মানুষ।
বুড়িমা নিষ্পলক নিরুত্তর। মুহুর্তের মাঝে প্রতিহিংসায় যেন সারা মুখে ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা ফুটে উঠল। চুলার আগুন পাগলা হাওয়ার মতো দাউ দাউ করে জ্বলে চলেছে। মুক্তিকামী বাঙ্গালীদের বুক যেন বুড়িমার জ্বলন্ত উনুন’।
তিনচুলে থেকে ভাতের পাতিল নামালেন। যন্ত্রচালিতের মত খাবার সাজিয়ে বললেন ন্যাও ঠান্ডা ছাওয়ালের মত খ্যায়া নাও।
থালার অর্ধেক অংশ জুড়ে ২/৩টি বোয়াল মাছের টুকরা। পড়া মুখস্ত করার জন্য সেই যে ওপেন মাস্টার অনেকক্ষণ কাঁদিয়েছিল তেমনি ভয়ে ভয়ে ভাত খেতে লাগলাম।
সকাল থেকে যে মাছগুলো ধরেছিলাম তাই দিয়ে ভাত খাচ্ছিলাম। ভোরে আমরা কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা পলো নিয়ে বাটতে গিয়েছিলাম। আসলে মাছ ধরা না -খান সেনা ধরা।
মাছ ধরার ছদ্মবেশে খোঁজ নিয়ে এসেছি। আজ মধ্যরাতে আমরা ওদের উপর আবার আক্রমণ চালাবো।
ঃ কি ব্যাপার হাত ধুইয়া উঠলা যে?
ঃ অনেক খেয়েছি এবার আমাদের উঠতে হবে। প্রস্তুতি হওয়ার জন্য চারিদিক থেকে গোপন সংকেত আসতে লাগলো। ভালো করে লক্ষ্য করলাম বুড়িমা কোন কিছু টের পেল না।
ঃ মা আবার বুকের ভেতর যন্ত্রণাটা বেড়ে উঠেছে। আমাকে এবার যেতেই হবে।
ঃ ঘর থেকে বের হতেই দেখি সঙ্গীরা সবাই উঠোনে এসে জমায়েত হয়েছে। বুড়িমা আমাদের মাঝখানে এসে তার শুকনো হাত মাথায় বুলিয়ে শূন্যে দৃষ্টি তুলে দোয়া করলেন।
শিন্নির দিন তোমরা আইসো, আমি বইয়া থাকুম।
আমরা ততক্ষণে সামনের পথটায় মিলিয়ে গেলাম।
সৈনিক
|| নির্মলেন্দু গুণ ||
রক্ত তো নয় বাংলাদেশের উচ্ছল নদীর জল
যুদ্ধের মাঠ কাঁপছে উষ্ণ খুনে
কি হবে এখন অযথা শস্য বুনে
মৃত্যুর মাঝে জেগেছে জীবন, জাগ্রত চঞ্চল।
কৃষক এখন অযথা শস্য বুনোনা
শ্রমিক তুমি রক্তের দামে কেনো
স্বাধীনতা, নব জীবনের বুনিয়াদ
পদাতিক তুমি মুক্তির ডাক শুনো না?
চেয়ে দেখ ঐ রক্তে রাঙানো চাঁদ
লক্ষ প্রানের অম্লান চিতা ঘাসে
জ্বলছে দুপুর শত্রুর মানুষের নিঃশ্বাসে
প্রেমিক তুমি সৈনিক হলে এইসব ভালোবেসে।
ঢাকা বেতারের স্বীকৃতি
মুক্তি বাহিনীর গুলিতে অল্পের জন্য নরঘাতী নিয়াজীর প্রাণরক্ষা
(নিজস্ব সংবাদদাতা)
হিলি(দিনাজপুর), ২৮শে নভেম্বর -মুক্তি বাহিনীর তরুণ যোদ্ধারা এই রণাঙ্গনেও মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা রেখে পাকিস্তানি নরপশুদের উপর আক্রমণ কালে গতকল্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী অল্পের জন্য প্রাণে মৃত্যুর করাল গ্রাস থেকে রক্ষা পায়।
দখলীকৃত ঢাকা বেতার থেকে গত ২৭শে নভেম্বর রাত ১১টা ২০ মিনিটে এ খবরের সত্যতা স্বীকার করা হয়।
ঘটনার বিবরণে প্রকাশ সারা বাংলাদেশে গেরিলা যোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমণে দিশেহারা খানসেনাদের মনোবল অক্ষুন্ন রাখার জন্য দখলীকৃত বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক রণ উন্মাদ লেফটেনেন্ট জেনারেল এ কে নিয়াজী সমগ্র দখলীকৃত এলাকায় ছোটাছুটি কালে গতকাল হিলি রণাঙ্গনে আগমন করে।
ঠিক সেসময় চলছিল মুক্তিবাহিনীর সর্বাত্মক আক্রমণ। মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্ধর্ষ আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পলায়নকালে নরঘাতী নিয়াজীর জীপটির অগ্ৰভাবে গেরিলা যোদ্ধাদের নিক্ষিপ্ত গোলা এসে পড়ে। নেতাজি কোন রকমে গোলা বৃষ্টির মধ্যে আত্মরক্ষা করে ঢাকায় ফিরে যায়।
একটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র
বাংলাদেশের উপর থাবা বিস্তারের চেষ্টা বরদাস্ত করা হবে না
বাংলাদেশের উপর আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের খাবা বসাবার চেষ্টা হচ্ছে। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্ত, প্রায় এক কোটি শরণার্থীর আর্তকান্না পাকিস্তানি হানাদারের যে মাতব্বরদের সীমাহীন উদাসীনতা টলাতে পারেনি, বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মার খেতে শুরু করার পর তাদের টনক নড়েছে। তারা এখন গেল গেল রব তুলেছে। হঠাৎ তাদের মনে হতে শুরু করেছে যে ভারতীয় উপমহাদেশের শান্তির রসাতলে যেতে বসেছে। তাদের মতে বাঙালি নিধন যজ্ঞ কিংবা বাংলাদেশের ব্যাপক গণহত্যায় শান্তির কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, শান্তি বিঘ্নিত হতে বসেছে, ইয়াহিয়ার জল্লাদরা যখন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মার খেতে শুরু করেছে তখন। এ থেকে বোঝা যায় এই মুরুব্বি মাতব্বরদের শান্তির সূত্র টা আসলে কি।
সম্প্রতি বেলজিয়াম জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বিবেচনার জন্য এ সম্পর্কে একটি প্রস্তাব পেশ করেছে। তাতে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে সর্বাধিক সংযম অবলম্বনের আহ্বান জানানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন প্রভৃতি দেশ ও তৎপর হয়ে উঠেছে। কিন্তু বাংলাদেশে পাক জল্লাদরা যখন নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছিল তখন তারা এই নৃশংস তম বর্বরতাকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে রায় দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘ সাত মাসে ও তাদের বিবেক জাগ্রত করা যায়নি, একটা জাতিকে হত্যা করার মতো নৃশংস ঘটনাকেও তারা শান্তি ও মানবতার পরিপন্থী বলে মনে করেনি।
বাঙালিরা বিনা প্রতিবাদে যদি ইয়াহিয়ার ঘাতকবাহিনী হতে রাজি হয়ে হাড়িকাঠে মাথা পেতে দিতো, বাংলাদেশের মা বোনেরা যদি বিনা প্রতিবাদে নিজের সম্ভ্রম ইয়াহিয়ার ঘাতকদের লোভাতুর আলিঙ্গনে বিসর্জন দিতে রাজি হতো, তাহলে এইসব মুরুব্বীদের মতে উপমহাদেশে শান্তি রক্ষা পেত। কিন্তু কোন দেশ, কোন জাতি এই জাতীয় অবমাননা মেনে নিতে পারে না। তাই তারা রুখে দাঁড়িয়েছে, পাল্টা মার দিতে শুরু করেছে। আর সঙ্গে সঙ্গে ইয়াহিয়ার মাতব্বররা শান্তি বিপন্ন বলে চেচাতে শুরু করেছে। মানবতার হত্যায় এই মুরুব্বিদের শান্তি বিপন্ন হয়না, তাদের শান্তি বিপন্ন হয় জানোয়ারদের হত্যা করলে।
বেলজীয় প্রস্তাবে সুকৌশলে মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপত্তা পরিষদের বিচারের আওতায় আনার জন্য বিবদমান পক্ষ হিসেবে শুধু পাকিস্তান ও ভারতের নাম উল্লেখ না করে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে মুক্তিবাহিনীর অস্তিত্বের বাস্তবতাকে তারা স্বীকার করতে অবশ্য বাধ্য হয়েছে। কিন্তু এই ত্যাগটুকু স্বীকার না করলেও সর্বাধিক সংযমের নামে মুক্তি সংগ্রাম বন্ধ করার ষড়যন্ত্র সফল হয় না। অবশ্য একমাত্র পাকিস্তান ছাড়াও সংশ্লিষ্ট পক্ষই প্রস্তাবটি উপেক্ষা করেছে।
যারা মাত্র সেদিন পর্যন্ত বাংলাদেশ সমস্যাকে পাকিস্তানের ঘরোয়া সমস্যাগুলো ঘোষণা করে এসেছে তারা মে নেহাৎ বেকায়দা বুঝে পাকিস্তানকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যেই রাতারাতি আন্তর্জাতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইছে এটা কারো পক্ষেই বুঝতে অসুবিধা হয় না। বেলজীয় প্রস্তাবে পরোক্ষ মুক্তিবাহিনীর অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। এবং এটাই আসল সত্য যে যুদ্ধ চলছে পাকিস্তানি হানাদারের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর। এটা অপর কোনো পক্ষের বিশেষ করে নিরাপত্তা পরিষদের নাক না গলানোই ভালো। বাংলাদেশে যা ঘটছে এবং এ ব্যাপারে জাতিসংঘের ভূমিকা তাতে মুক্তিবাহিনী বা বাংলাদেশের জনগণকে কোন কথা বলবার তাদের আর কোন নৈতিক অধিকার নেই। বাংলাদেশের মানুষ কঙ্গোর ইতিহাস জানে, জানে লুমুম্বা এবং দাগ হ্যামারশোল্ড এর হত্যাকারীদের পরিচয়। বেলজীয় দের ভূমিকা একেবারে অজানা নয় বাংলাদেশের মানুষের। তাই বাংলাদেশের মানুষ বাংলাদেশের উপর আন্তর্জাতিক চক্রান্ত অথবা বিস্তারের যেকোনো চেষ্টার জবাব দেবে মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের ভাষায়। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ভাগ্য নিরাপত্তা পরিষদের কোন প্রস্তাবের শর্তের দ্বারা কখনো নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানানোর নামে ও জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম বন্ধ রাখার মতো নির্লজ্জ প্রস্তাব একমাত্র পাকিস্তানের মুরুব্বীদের পক্ষেই সম্ভব। তবে জাতিসংঘের সীমাহীন ঔদাসীন্য সত্ত্বেও বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষ এবং জাতীয় নেতৃত্ব জাতিসংঘের মূলনীতি কে বরং ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে। কারণ শক্তির দাবা খেলায় জাতিসংঘের পরিণতি আজ যাই হোক না কেন উপনিবেশিক শাসনের অবসান এবং উপনিবেশের জনগণের জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতার মৌলিক অধিকার জাতিসংঘ সনদের একটি অন্যতম ঘোষণা।
পাকিস্তান কর্তৃক আক্রান্ত হলে মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করবে
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর যেন কামরুজ্জামানের ঘোষণা
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর জনাব আবু হেনা মোঃ কামরুজ্জামান বলেন, ‘ভারত আক্রান্ত হলে মুক্তি বাহিনী ভারতের বীর সৈনিকদের পাশে দাঁড়িয়ে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়বে।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সম্প্রতি মুক্ত এলাকায় সপ্তাহব্যাপী সফর শেষ করে সম্প্রতি মুজিবনগরে ফিরে এসে উপরোক্ত মন্তব্য করেন। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত পরিস্থিতি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে জনাব কামরুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ সরকার আওয়ামী লীগ সবরকম সাম্রাজ্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে।
সীমান্তে পশুদের বারবার ভারতের উপর গোলাবর্ষণকে তিনি পাক সাম্রাজ্যবাদী নীতির নগ্ন প্রকাশ বলে মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন শান্তিপ্রিয় বন্ধু প্রতিবেশী ভারতের উপর পাক নগ্ন হামলার চাপ যদি অব্যাহত থাকে তবে আমরা বাংলাদেশের জনসাধারণ সাম্রাজ্যবাদী ইয়াহিয়ার জল্লাদী নেশা ও যুদ্ধের তৃষ্ণা মেটানোর জন্য ভারতের পাশে আছি এবং থাকব।’
বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব কামরুজ্জামান মুক্তাঞ্চলে প্রশাসন ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য জেলা শাসক ও পুলিশের পদস্থ অফিসারদের সঙ্গে বৈঠক করেন। প্রতিটি স্তরে অফিসার নিয়োগ এবং তার তালিকা আগামী কয়েকদিনের মধ্যে প্রকাশ করা হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
বহির্বিশ্ব শোনো!
পাকিস্তানের জল্লাদরা হিটলারের বন্দিশিবিরের নৃসংসতাকেও হার মানিয়েছে
মায়েদের বোনেদের প্রতি এই বর্বরতা বাঙালিরা কখনো ক্ষমা করবে না
বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় হানাদার নেকড়ে বাহিনীর মুক্তিফৌজের বেপরোয়া মারের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য শতাধিক বন্দি নিবাসের লক্ষাধিক নারীর ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। হিটলারের নাৎসি বন্দিশিবির ও এর তুলনায় অনেক মানবিক ছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে প্রকাশ।
বন্দী শিবিরে নির্বিচারে বাঙালি নারী, পুরুষ ও শিশুদের ধরে এনে আটকে রেখে অবর্ণনীয় নির্যাতন চালানো হচ্ছে। এই নিরপরাধ বাঙ্গালীদের পাকড়াও করে নির্যাতন চালানোর ব্যাপারে সেনাবাহিনীকে রাজাকার ছাড়াও বাংলাদেশের উর্দুভাষী মুসলমানরা মদদ দিচ্ছে। আগাখানীরা পূর্বে গোপনে হানাদার বাহিনীকে মদত দিতো। বর্তমানে তারা বাঙালি নিধন যজ্ঞ সেনাবাহিনীর সাথে প্রকাশ্যে কাজ করছে।
এই বন্দিশিবির গুলোতে বন্দীদের সারাদিনে দুখানি আটার রুটি এবং কিছু ডাল আহার্য হিসেবে দেওয়া হয়। চারো দিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা জায়গায় শুতে হয় এবং মাথার উপর সামান্যতম আচ্ছাদনের ও ব্যবস্থা নেই। প্রত্যহ তাদের দিয়ে পায়খানা ও নর্দমা পরিষ্কার করা, মাটি কাটা, মাটি বহন করা ইত্যাদি কঠোর পরিশ্রমের কাজ করানো হয়। কাজ করতে অক্ষম হলে তাদের নির্দয়ভাবে প্রহার করা হয়।
এছাড়াও বন্দীদের উপর মধ্যযুগীয় পন্থায় নির্যাতন চালানো হয়। বন্দীদের হাত-পা বেঁধে টানিয়ে পিটানো, আঙ্গুলে সুচ ফোটানো, নখ উপড়ে ফেলা, পায়ে ঢুকে ঢুকে পেরেক গেঁথে দেওয়া, ব্লেড দিয়ে কেটে চামড়া টেনে উল্টে দেয়া, যৌনাঙ্গে বিদ্যুৎপ্রবাহ দিয়ে ও গুহ্যদ্বারে শলাকা বিদ্ধ করে যন্ত্রণা দেওয়া, উলঙ্গ করে বরফে বসিয়ে রাখা, পানির গামলায় মাথা ডুবিয়ে দিয়ে পানিতে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করে দেওয়া, মাংস কেতে ক্ষতস্থানে জ্বলন্ত দেশলাই কাঠি বা লাইটার চেপে ধরা এবং দিনের পর দিন বন্দীদের ঘুমোতে না দেওয়া।
বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকা থেকে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, হিংস্র নেকড়ের বাহিনী বহু ক্ষেত্রে অন্যদের ভয় দেখাবার জন্য বন্দীদের জীবন্ত কবর দেওয়া বা তাদের অর্ধ প্রোথিত করে পাথরের আঘাতে তাদের খুন করার পদ্ধতি অবলম্বন করেছে।
মেয়েদের দিয়েও সব ধরনের কঠোর কাজ করানো ছাড়াও তাদের যেকোনো সময় হানাদার সেনাদের লালসা চরিতার্থ করতে বাধ্য করা হয়।
এই দুঃসহ অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে কয়েকজন বন্দিনী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। এসমস্ত বন্দিশিবির নরপশু ইয়াহিয়া বাহিনীর সৈন্যদের ঘাঁটিগুলোর কাছেই করা হয়েছে।
গত ১৪ই ও ১৫ই তারিখে তীব্র লড়াই এর পর বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর রংপুরের ভুরুঙ্গামারী শহর দখল করার পর এমনই একটি বন্দিশিবিরে আবিষ্কার করেন। এটি সেখানকার পাক ফৌজের কমান্ডিং অফিসারের বাসভবনে অবস্থিত ছিল। একটি বদ্ধ ঘর থেকে আর্ত চিৎকার শুনে মুক্তিসেনারা সেই ঘরের দরজা ভেঙে ২৫ জন অর্ধনগ্ন অর্ধাহারে ক্লিষ্ট বিভিন্ন বয়সের মেয়েকে উদ্ধার করেন। এর মধ্যে ১০-১১ বছর থেকে ৫০ বছর বয়সের মেয়েরা পর্যন্ত ছিলেন। ওই বাড়ি থেকে প্রায় হাজার পথ দূরে একটি স্কুলের শিশু ও বৃদ্ধ পুরুষদের বন্দিদশা থেকে মুক্তিসেনারা উদ্ধার করেন। এখানে একজন বন্দিনী হলেন আবদুল লতিফের স্ত্রী। ধর্মপ্রাণ লতিফ তার স্ত্রীকে সেনাবাহিনীর লালসা চরিতার্থ করার জন্য ছেড়ে দিতে রাজি না হওয়ায় পাকিস্তানিরা তাকে হত্যা করে এবং তার স্ত্রীকে জোর করে পাকিস্তানের ক্যাপ্টেন আতাউল্লাহ ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। মায়ের সামনেই একটি সন্তানকে হত্যা করে ও অপর দুই সন্তানকে জোর করে মায়ের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর ৫ মাস ওই মহিলাকে নাটকীয় চরম লাঞ্চনা ভোগ করতে হয়েছে। ভুরুঙ্গামারী মুক্ত হবার পর মাতার সব কনিষ্ঠ সন্তানটির সঙ্গে পুনর্মিলিত হয়েছেন, কিন্তু অপর সন্তানের এখনো কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
ভুরুঙ্গামারী মুক্ত হবার কয়েকদিন আগে পাকিস্তানিরা পরাশর গ্রাম থেকে ১১ বছরের অপাপবিদ্ধ জামিলা খাতুন আর তার মাকে ধরে নিয়ে আসে। মুক্তিবাহিনী এসে পরার ফলে দুদিনের বেশি তাদের চরম লাঞ্চনা ভোগ করতে হয়নি, এটাই বোধ হয় একমাত্র সান্তনা।
৪০ বছরের অন্তঃসত্ত্বা আমিনা খাতুন পাক সৈন্যের লালসা চরিতার্থ করতে বাধা দিলে বর্বর সৈন্যরা তার পেটে লাথি মারে। ফলে আমিনা একটি মৃত সন্তানের জন্ম দেয়। কিন্তু তার পরদিনই তিনি একাধিক সৈন্য দ্বারা ধর্ষিত হন।
স্কুল বাড়িতে বন্দি অন্যতম পুরুষ এবারুদ্দিন মন্ডল তার স্ত্রীকে সৈন্যদের হাতে তুলে দিতে অস্বীকার করলে বেয়োনেট দিয়ে তার পা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেওয়া হয়। সৌভাগ্যবশতঃ জনাব মণ্ডলের স্ত্রী পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হয়েছেন।

জাতির উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের বেতার ভাষণের পূর্ণ বিবরণ
“খান সেনাদের পলায়নের সমস্ত পথ রুদ্ধ করে দিতে হবে”
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর জন্য তাজউদ্দিন আহমেদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ভাষণে দৃঢ়তার সাথে পুনরায় বলেন যে, বাংলাদেশের জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা একটিই-আর তা হলো পূর্ণ স্বাধীনতা। তিনি বলেন একটি বিশ্বশক্তির সমর সম্ভার দিয়ে ও জনগণের মুক্তি সংগ্রাম দমন করা যায় না।
২৩শে নভেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় বাংলাদেশের দামাল ছেলের মুক্তি সৈন্যদের অনুকরণীয় রন নিপুণতার প্রতি সংগ্রামী
অভিনন্দন
জানান।
প্রধানমন্ত্রীর বেতার ভাষণের পূর্ণ বিবরণ নিয়ে প্রদত্ত হলো ঃ-
গত সেপ্টেম্বর মাসে আপনাদের কাছে আমাদের মুক্তি সংগ্রামের পর্যালোচনা করেছিলাম। তারপর আড়াই মাস কেটে গেছে। এর মধ্যে আমাদের সাফল্য এসেছে নানা দিক থেকে। দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তি বাহিনীর আক্রমণ যে সর্বক্ষেত্রে তীব্রতর হয়েছে, সেকথা শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সকলেই স্বীকার করেছেন। মুক্তিবাহিনী এখন যেকোন সময় যেকোন জায়গায় শত্রুকে আঘাত করতে পারে; এমনকি শত্রুর নিরাপদ অবস্থানের কেন্দ্রে অতর্কিত আক্রমন চালিয়ে তাকে বিমূর করে দিতে পারে। জলে-স্থলে চমকপ্রদ অগ্রগতি ঘটেছে মুক্তিবাহিনীর। নদীপথে হানাদাররা বিপর্যস্ত, মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর প্রায় অকেজো, বাংলাদেশের বিস্তৃত শত্রুমুক্ত। ক্রমেই অধিকতর এলাকায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রম প্রশাসন চালু হচ্ছে। আর সৈন্য, সামগ্রী ও মনোবল হারিয়ে শত্রুপক্ষ হতাশায় ততই উন্মাদ হয়ে উঠেছে।
মুক্তিবাহিনীর হাতে পরাজয়ের গ্লানি গোপন করার প্রচেষ্টা
একদিকে রণক্ষেত্রে শত্রুর বিপর্যয় ঘটছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ইসলামাবাদের দুষ্কৃতিকারীরা আজ দিশেহারা ও কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কেই সংশয় ও ভীতির উদ্রেক হয়েছে তাদের মনে। বাংলাদেশের জনগণের অপরিমেয় দুর্দশা ঘটাবার সঙ্গে সঙ্গে তারা পশ্চিম পাকিস্তানকে টেনে নিয়ে গেছে অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও রাজনৈতিক ভাঙ্গনের মুখে। এখন তারা চায় ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে একটা আন্তর্জাতিক সংকট সৃষ্টি করতে। তারা আশা করে যে এখন একটা যুদ্ধ হলে বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে পৃথিবীর দৃষ্টি অন্য দিকে নিবদ্ধ হবে, মুক্তিবাহিনীর হাতে তাদের পরাজয়ের গ্লানি গোপন করা যাবে এবং এমন একটা পরিস্থিতির উদ্ভব হবে যাতে তাদের পৃষ্ঠপোষকরা হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পাবে। কিন্তু আমি প্রত্যহ সঙ্গে বলছি যে, এর একটি উদ্দেশ্য ও সিদ্ধ হবে না। বরঞ্চ এতে তাদের ভ্রান্তি, অপরাধ ও আত্মঘাতের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে মাত্র এবং পরিণামে তাদের আত্মবিনাশ সুনিশ্চিত হবে।
বাঙালির কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা একটিই-
সামরিক শাসক চক্র আত্মহত্যার যে ব্যবস্থা করে থাকুক না কেন আর এই উপমহাদেশের জন্য যে ব্যবস্থাই বিশেষ বিশেষ রাষ্ট্রপতি মনপুতঃ হোক না কেন, বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা একটিই-আর তা হলো পূর্ণ স্বাধীনতা। ইতিহাসের অন্যতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে প্রতিদিন প্রমাণিত হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতার সংকল্প ও সে স্বাধীনতা রক্ষার শক্তি। ইতিহাস মানুষকে অন্ততঃ এই শিক্ষা দিয়েছে যে, জনসাধারণের ইচ্ছা শক্তির পরাজয় নেই-এমনকি এক বিশ্বশক্তির সমর সম্ভার দিয়ে ও জনগণের মুক্তির সংগ্রাম দমন করা যায় না।
কোন কোন রাষ্ট্র যখন শরণার্থীদের….
এশিয়ায় গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোন কোন পাশ্চাত্য দেশের নিরাসক্তি লক্ষ্য করার মতো। মনে হয় মানুষ হিসেবে মানুষের মর্যাদার চাইতে এখানে তারা সরকারের স্থিতিশীলতার গুরুত্ব দেন বেশি। এটা শোচনীয়। কিন্তু ভারতকে অর্থ সাহায্যের বিনিময় বাংলাদেশের শরণার্থীদেরকে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের প্রস্তাব যখন কোন রাষ্ট্র উত্থাপন করেন, তখন আমরা শিউরে না ওঠে পারিনা। এই প্রস্তাবে গণহত্যা ও তার ফলাফল কে নীরবে মেনে নেওয়া হয়েছে, পর্বত প্রমাণ অবিচার অন্যায় কে বিনা বাক্যে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে এবং ভবিষ্যতে গণহত্যা ও ব্যাপক বাস্তুত্যাগের পথ প্রশস্ত করা হয়েছে। পাকিস্তানি সন্ত্রাসের ফলে যারা ছিন্নমূল হয়েছেন তারা অস্থাবর সম্পত্তির নয় যে, অর্থের বিনিময়ে তাদেরকে হাত বদল করা হবে। সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে নিজ বাসভূমে ফেরার জন্মগত অধিকার তাদের আছে এবং তারা সেখানে সে ভাবেই ফিরে আসবেন। আর আমি বলছি যে, তার খুব বেশি দেরি নেই।
নিক্সন কি উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে চান?
ঠিক এই সময়ে এই উপমহাদেশে তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি বিশেষ দল পাঠিয়ে প্রেসিডেন্ট নিক্সন কি উদ্দেশ্য সাধন করতে চান? কার দেশের কূটনীতিবিদ ও আইন সভার সদস্যরা অবগত নন এমন কি নতুন তথ্য তিনি জানতে ইচ্ছুক? দশ লক্ষ বাঙালিকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা এবং প্রায় এক কোটি মানুষকে বাস্তু ত্যাগে বাধ্য করা সত্বেও পাকিস্তান সরকারকে তার প্রশাসন নিন্দা করেন নি। এখন তথ্য সংগ্রহ পাঠিয়ে কি ফল তারা লাভ করতে চান, জানিনা।-তবে এতে আমাদের সংকল্পের কোনো ব্যত্যয় হবেনা। সে সংকল্প হল দেশকে শত্রুমুক্ত করে নিজেদের অভিপ্রেত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
আমাদের সংগ্রাম সেদিনেই সার্থক হবে…
অশ্রু ও রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতার জন্য আমরা লড়ছি সে স্বাধীনতা লাভের দিনটি নিকটতর হয়েছে। কিন্তু তার জন্য আরও আত্মত্যাগ, কষ্ট স্বীকার ও জীবন দান এর প্রয়োজন হবে। স্বাধীনতা ধারণা অশেষ অর্থ গর্ভ। স্বাধীনতার তাৎপর্য নির্ভর করে যুদ্ধাবস্থায় এর জন্য আমরা কি মূল্য দেই এবং শান্তির সময়ে এর কি ব্যবহার করি তার উপর। শত্রু সংহারের প্রতিজ্ঞা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে তাই শহীদের রক্তের উপযুক্ত সমাজ গঠনের প্রতিজ্ঞাও আমাদেরকে নতুন করে নিতে হবে। বাংলাদেশের শহরে ও গ্রামে তরুণেরা যে যুদ্ধে লিপ্ত, তা বিদেশি দখলদারদেরকে বিতাড়িত করার সংগ্রাম এবং অসাম্য সুবিধাভোগের অবসান ঘটানোর সংগ্রাম। আমাদের আজকের সংগ্রাম সেদিনই সার্থক হবে, যেদিন আমরা বঙ্গবন্ধু প্রতিশ্রুত ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হব। সমাজের সে ভবিষ্যৎ রূপ আজ বাংলাদেশের জনসাধারণ প্রত্যক্ষ করছেন, যেখানে সকলের সমানাধিকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন গঠিত হবে এবং উন্নয়ন ও পরিপূর্ণতার সাধারণ লক্ষ্যে উপনীত হবার প্রয়াসে সকলে অংশগ্রহণ করবেন।
বঙ্গবন্ধুকে পাওয়ার একমাত্র পথ….
বাংলাদেশের জনসাধারণের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ ও পাকিস্তানের সামরিক চক্রের হাতে বন্দী হয়ে রয়েছেন। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস তাকে মুক্ত করার একমাত্র উপায় হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে হানাদার সৈন্যদের নিষ্ক্রমণ এর সকল পথ রুদ্ধ করে দেওয়া। তা করবার শক্তি আমারের আছে এবং আমরা তা-ই করতে যাচ্ছি। জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে শত্রুকে আমরা চরম আঘাত হানবো আর তখনই জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্রুর সত্যের মুখোমুখি হবেন।
অনুতাপ হীন বিশ্বাসঘাতকদের শাস্তি একটাই….
বাংলাদেশের জনগণের কাছে আমার আহ্বান ঃ মুক্তিসংগ্রামের বর্তমান পর্যায়কে চূড়ান্ত স্তরে নিয়ে চলুন যেসব সরকারি কর্মচারী, রাজাকার, পুলিশ বা অন্যান্য ব্যক্তির বিবেকের নির্দেশের বিরুদ্ধে হানাদারদের কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা সামরিক চক্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সুযোগ গ্রহণ করুন। শত্রু পক্ষের সঙ্গে যারা স্বেচ্ছায় হাত মিলিয়েছেন, তাদেরকে আমি শেষবারের মতো বলতে চাইঃ বিশ্বাসঘাতকরা পথ পরিহার করুন। অনুতাপহীন বিশ্বাসঘাতকদের আর তাদের বিদেশী প্রভুদের পরিণত একই হবে-আর তা হলো গ্লানিকর মৃত্যু। হাজার হাজার মুক্তিসেনা আজ শত্রুকে ঘিরে রেখেছে তার অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে।
চরম মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত থাকুন
সকলে প্রস্তুত থাকুনঃ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আহ্বানে চরম মুহূর্তে যেন জন্য সর্বশক্তি দিয়ে শত্রুকে একযোগে চরম আঘাত করতে পারেন।
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম কে যারা সাফল্যের বর্তমান স্তরে নিয়ে এসেছেন, সেই বীর শহীদ, অকুতোভয় যোদ্ধা ও সংগ্রামী জনগণকে আমি সালাম জানাই। জয় বাংলা।”
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী
পাঁচই ডিসেম্বর জনক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রয়াণ দিবস। ১৯৬৩ সালে স্বদেশ সজন থেকে বহুদূরে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে নিঃসঙ্গ স্বেচ্ছানির্বাসিত জননেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আকস্মিক মৃত্যু ঘটে। এই মৃত্যু অত্যন্ত রহস্যময়। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার পল্টনের সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে অভিযোগ করেছিলেন, আমাদের নেতার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি, তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। পাকিস্তানের ফ্যাসিস্ট সরকার এই অভিযোগের জবাব দিতে পারেনি। বরং এই সত্যটি ফাঁস করে দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধেই নতুন চক্রান্তের জাল বিস্তার করেছিল।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশ যে একটি উপনিবেশে পরিণত হবে এই সত্যটি বহু পূর্ব অর্থাৎ ২৪ বছর আগে অনুধাবন করতে পেরে জনাব সোহরাওয়ার্দী ব্রিটিশদের ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের এক পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু তার এ পরিকল্পনা তখন বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু আজ ২৪ বছর পরে মৃত পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ পূর্ববাংলা বাংলাদেশ নাম ধারণ করে এক স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়েছে। এটাকে লোকান্তরিত নেতার অপূর্ণ ইচ্ছাপূরণ ছাড়া আর কি বলা যাবে?
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর জনাব সোহরাওয়ার্দী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম শুরু করেন। কারণ, তিনি জানতেন, পাকিস্তান আসলে একটি দেশের নাম নয়, দুটি দেশের একটি নাম। এই দুটি দেশ হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। একমাত্র ধর্ম ছাড়া ভাষা সংস্কৃতি, আহার, বিহার, রুচি কোন কিছুতে এ দু’দেশের মানুষের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। বিশেষ সাময়িক প্রয়োজনে দুটি দেশ একত্র হয়েছে বটে কিন্তু উভয় দেশের মধ্যে গণতান্ত্রিক ঐক্য ও ক্ষমতার অংশীদারিত্ব ছাড়া এই জোড়াতালির মিল টিকবে না। তার এই ক্ষমতা ও পদের প্রলোভন ছেড়ে তিনি পাকিস্তানের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হয়েছিলেন। তার এই অক্লান্ত প্রচেষ্টারই ফল আজিকার সংগ্রামী আওয়ামী লীগ। শেখ মুজিব পরবর্তীকালে জনাব সোহরাওয়ার্দীরই গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের যোগ্য উত্তরাধিকার গ্রহণ করেন।
কিন্তু পাকিস্তানের ফ্যাসিস্ট চক্র জনাব সোহরাওয়ার্দী এবং তার রাজনৈতিক সহযোগী ও শেখ মুজিবের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টাকে সফল হতে দেয়নি। আজ যেমন তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ভারতের চর আখ্যা দেয়ার নির্লজ্জ ধৃষ্টতা প্রদর্শনে দ্বিধা করছে না, তেমনি আজ থেকে বাইশ বছর আগে তারা শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মত বরেণ্য নেতাকেও ‘ভারতের লেলিয়ে দেওয়া কুকুর’ আখ্যা দিতে লজ্জা বোধ করেনি। এদের চক্রান্তে সোহরাওয়ার্দী পদচ্যূত হয়েছেন, কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগ নেতাকেও বারবার কারাগারে নিক্ষিপ্ত হতে হয়েছে। পাকিস্তানের ফ্যাসিস্ট চক্র তাতেই সন্তুষ্ট হয়নি, ১৯৬৩ সালে জঙ্গিচক্রের গোপন ষড়যন্ত্রে জনগণ সোহরাওয়ার্দী বৈরুতে রহস্যজনকভাবে মারা যান। অন্যদিকে, ১৯৬৭ সালে শেখ মুজিবকে ফাসিঁকাঠে ঝোলাবার জনতার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা আনায়ন করা হয়েছিল, যেমন আড়াল করা হয়েছে আবার ১৯৭১ সালে।
সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবকে যদি দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে দেয়া হতো, জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিনিধিত্ব করতে দেওয়া হতো, তাহলে পাকিস্তান -ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও টিকে থাকার একটা বাস্তব ভিত্তি পেতো। কিন্তু জঙ্গি চক্রের ষড়যন্ত্র আজ পাকিস্তান একটি মৃত ও অতীতের শব্দ এবং বাস্তব সত্য হচ্ছে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। জননেতা সোহরাওয়ার্দীকে তার মৃত্যু দিবসে আমরা এজন্যই স্মরণ করি, জনগণের অধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সংগ্ৰামের সূচনা করে গেছেন, আজ তাই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামে রূপান্তরিত হয়েছে। তাই ৫ই ডিসেম্বরের অমর স্মৃতির প্রতি গোটা বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষের জাতীয় প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগ ও জানায় সশ্রদ্ধ সংগ্রামী অভিবাদন।
ইয়াহিয়ার মরণকামড়
বাংলাদেশ এখন কাপুরুষ ইয়াহিয়ার হাতছাড়া। এখন পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তান ও এই বর্বর জঙ্গিচক্রের বিরুদ্ধে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে। দিশেহারা ইয়াহিয়া তাই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিকে ও বেআইনী ঘোষণা করেছে। যে ইয়াহিয়া নিজেই মৃত পাকিস্তানের বেআইনি প্রেসিডেন্ট, সে জনগণের ভোটে নির্বাচিত রাজনৈতিক দলগুলোকে খুশিমতো বেআইনি ঘোষণা করছে, এটা দেখে আফগানিস্তানের বাচ্চা-ই-সাক্কোর রাজত্বের কথা আমাদের মনে পড়ছে। বাচ্চার সঙ্গে ইয়াহিয়ার তফাৎ এই যে, বাচ্চা ছিলো তৃতীয় শ্রেণীর ডাকাত আর ইয়াহিয়া তৃতীয় শ্রেণীর খুনী এবং লম্পট।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রাদেশিক পর্যায়ে বেলুচিস্তান এবং সীমান্তের নির্বাচনের সাফল্য লাভ করেছিল। এই দুটি প্রদেশে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হলে ন্যাপের হাতেই করতে হয়। প্রতারক ইয়াহিয়া একদিকে মুখে বলছে, সে জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে বদ্ধপরিকর, অন্যদিকে জনগণের প্রতিনিধি স্থানীয় দলগুলোকে সে একের পর এক বেআইনী ঘোষণা করেছে এবং জনপ্রতিনিধিদের প্রতিনিধিত্বের অধিকার হরণ করে তাদের জেলে প্রেরণ করছে। ইয়াহিয়ার এই বর্বর চণ্ডনীতির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ তাই মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্র ধারণ করেছে। বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশের জনগণ এবং অচিরেই সিন্ধু দেশের জনগণ ও যে এই বর্বর জঙ্গিচক্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধের পতাকা উড়াবে, তাতে আমাদের কোন সন্দেহ নেই। বস্তুতঃ আত্মমর্যাদার সঙ্গে জীবনধারণের জন্য সীমান্ত, সিন্ধুও বেলুচিস্তানের জনগণের এখন এই একটিমাত্র পথেই খোলা আছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর জনাব তাজউদ্দিনের স্পষ্টই বলেছেন, পাকিস্তান নামক দেশটি এখন দশ লাখ বাঙালির মৃতদেহের স্তুপের নিচে চিরদিনের জন্য লুপ্ত হয়ে গেছে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কথা সঙ্গে আরেকটি কথা মাত্র যোগ করতে চাই তা হলো -পাকিস্তানের ধ্বংসস্তূপের তলা থেকে আজ যেমন স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ বেরিয়ে এসেছে, ভবিষ্যতে তেমনি স্বাধীন সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও পাখতুনিস্তানও বেরিয়ে আসবে বলে আমরা দৃঢ় আশা পোষণ করি। এই উপমহাদেশে সেদিনই হবে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বাদের স্থায়ী সমাধান এবং সূচনা হবে সুখী ও সমৃদ্ধ নবযুগের।
২৪ বছর আগে সোহরাওয়ার্দী যে স্বপ্ন দেখেছেন
-অধ্যাপক সামাদ
বাংলাদেশের বাঙালিরা এখন লড়াই করছে তাদের স্বাধীনতার জন্য, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য। একটা বিশেষ মানসিকতা নিয়ে জেগে উঠেছে এই বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এই জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়েছে পাকিস্তানের রাজনীতির মধ্যে, এক বিশেষ পরিমণ্ডলে। সেই ভাবেই বিচার করতে হয় এ জাতীয়তাবাদকে। কিন্তু এর একটা জন্মসূত্র সুপ্ত হয়েছিল প্রাক পাকিস্তানি রাজনীতিতেও।
পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে। বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যেও পড়েছিল এই তত্ত্বের প্রভাব। কিন্তু বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে আবার গোড়া থেকে ছিল একটা সাধারণ বাঙালি চেতনা। তার ভাত মাছের জীবন অন্য বাঙালি থেকে স্বতন্ত্র ছিল না। বাঙালি সংস্কৃতির গোড়ায় ছিল মৌলিক ঐক্য। বাঙালি মুসলমানদের সংস্কৃতির ভাষা হিসেবে উর্দুকে গ্রহণ করেনি। অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমানদের মতো সে তার মাতৃভাষাকে আরবি হরফে লিখে মনোভাব ব্যক্ত করতে চায়নি।
বাঙালি মুসলমান বাংলা বলতো, বাংলা লিখতো আর তা লিখত বাংলা বর্ণমালাতেই। ভাষা ও জীবনধারণের মৌলিক উপাদানের দিক থেকে সব বাঙালিই ছিল এক। বাংলার আউল-বাউল পীরের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশে ইসলাম ধর্ম ও পেয়েছিল একটা দেশজ রূপ। আর একটা প্রভাব অমুসলমান বাঙালি লোক জীবনেও ছিল । পীরের দরগায় শিরণী দিত সবাই। সবাই আবার শুনতো প্রভু নিরঞ্জন এর গান। এমনই ছিল বাংলার জীবন ও লোকসংস্কৃতি। নদীমাতৃক বাংলার ভাটিয়ালি গান দোলা জাগাতো সব বাঙালির প্রাণে। কিন্তু তবু দ্বিজাতিতত্ত্ব বাঙালি মুসলমান কে প্রভাবিত করেছিল। আর তারা করেছিল পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন। কিন্তু এই পাকিস্তান পরিকল্পনায় পুরাতন বাংলাকে পন্ডিত করার কোন কথা ছিলনা। তাই আদি বাংলাকে ভাগ করে যখন পাকিস্তান গড়বার প্রস্তাব আসে, তখন যে পাকিস্তানের বাঙ্গালীদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে অনেক গোরা মুসলিম লীগ নেতা শংকিত হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশের তখনকার মুসলিম লীগ নেতা ও প্রাদেশিক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বলেন, পাকিস্তানের পরিবর্তে স্বাধীন স্বতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠন করার কথা। তার প্রস্তাব প্রচারিত হওয়ার পর, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জ্যেষ্ঠভ্রাতা ও ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা, শ্রী শরৎচন্দ্র বসু একটি সভা ডাকেন (২০শে মে, ১৯৪৭) তার নিজের বাসভবনে। এই সভায় তিনি ও সোহরাওয়ার্দী মিলে রচনা করেন একটি যুক্ত পরিকল্পনা, যা ইতিহাসে বসু সোহরাওয়ার্দী পরিকল্পনা বলে খ্যাত। এই পরিকল্পনার গোড়ার কথা ছিল, বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
কিন্তু সেদিনের রাজনৈতিক আবহাওয়ায় তাদের ইচ্ছা কার্যকর হয় নাই। আদি বাংলা ভেঙে তৈরি হয় পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ব পাকিস্তান।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আজ বাস্তব হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে আর এই বাংলাদেশের যে বৃহত্তর অংশ পাকিস্তানের সাথে রাজনৈতিক ভাবে যুক্ত ছিল কেবল তাই নিয়ে। কারণ, এই অংশে প্রবল ভাবে দেখা দিয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। ইউরোপের ফ্রান্স ছাড়াও বেলজিয়াম ও সুইজারল্যান্ড এর বিশেষ অঞ্চলের মানুষ ফরাসি বলে। ভাষার দিক থেকে তারা ফরাসি হলেও রাষ্ট্রের দিক থেকে তারা ফরাসি নয়, ফরাসি হতেও চায়না। আজকের বাংলার বাইরে যে বাঙালিরা থাকছে, তারাও থাকবে এমনি আলাদা হয়ে। কিন্তু তবু বাঙ্গালীদের একটি দেশ গঠিত হচ্ছে। খন্ডিতভাবে হলেও আজ বলতে হয়, বসু সোহরাওয়ার্দী পরিকল্পনা কার্যকর হতে যাচ্ছে, পাকিস্তান হবার ২৪ বছর পরে।
বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা শত্রুমুক্ত
-রণাঙ্গন প্রতিনিধি
মুক্তিবাহিনীর অপূর্ব রণকৌশল ও জয়েরগাঁথা প্রচারে আজ সারা বিশ্বের টেলিভিশন পত্র-পত্রিকা মুখর হয়ে উঠেছে।
গত ২১শে নভেম্বর নিউইয়র্ক টাইমসের ঢাকাস্থ সংবাদদাতা ম্যাক্লোন ব্রাউনের একটি লন্ডনের একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।
উক্ত সংবাদদাতা বলছেন ছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর দুই-তৃতীয়াংশ এলাকায় শত্রু কবল থেকে ছিনিয়ে নিতে সমর্থ হয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধারা আজ শহরের স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, হোটেল, বিদেশী দূতাবাস, দোকানপাট প্রভৃতি স্থানে ছড়িয়ে আছেন। স্বাধীনতার প্রতি বাংলাদেশের জনগণ ধীরে ধীরে এক অটল বিশ্বাসে রূপান্তরিত হচ্ছেন।
লন্ডনের সাপ্তাহিক নিউজ উইক এর সিনিয়র এডিটর মিঃ ব্রর্সগ্ৰেভ বেইলী টেলিগ্রাফ পত্রিকার সংবাদদাতা মিঃ বোলিং ওয়ার্থের সাথে বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকা এবং মুক্ত অঞ্চল সফর করে সদরদপ্তরে ফিরে গিয়ে এক বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করেন।
এই সম্পর্কের নিউজ উইক এর এক সাম্প্রতিক সংখ্যায় (২২শে নভেম্বর) মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের একটি বিশেষ রিপোর্ট প্রকাশ পায়।
তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে এক লক্ষ বাঙালি গেরিলা দখলদারদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রাম করে যাচ্ছেন এবং এর মধ্যে প্রায় এক-চতুর্থাংশ এলাকা নিজেদের করায়ত্ত করে নিয়েছেন। …. প্রতি সপ্তাহে গ্রামাঞ্চলে গেরিলাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার পরিষদ ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে।
এদিকে ডেইলি টেলিগ্রাফের সংবাদদাতা মিঃ হোলিংওয়ার্ড ঢাকা থেকে লিখছেন বর্তমানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ৪০ হাজার গেরিলা যোদ্ধা খান সেনাদের উপর আক্রমন করে যাচ্ছেন।
ঢাকা শহরে এখন বোমা বিস্ফোরণ নিত্য নৈতিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুরাতন ঢাকায় প্রতি রাত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে গুলিবিনিময়ে হচ্ছে।
একজন বিদেশি কূটনীতিবিদ সম্প্রতি ঢাকা থেকে কলকাতায় ফিরে গিয়ে বলেছেন ঢাকা শহর এখন সূর্যাস্তের পর সম্পূর্ণ মুক্তিবাহিনীর অধীনে চলে যাচ্ছে।
বিবিসি থেকে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশে অনেক শহর ও গ্রাম রাত্রিবেলায় মুক্তি বাহিনীর দখলে থাকে।
ইয়াহিয়া বলছে তার আর ফেরার পথ নেই
মুমূর্ষ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তক্ষশীলায় চিনা সাহায্যপুষ্ট ভারী যন্ত্রপাতি কারখানা উদ্বোধন প্রসঙ্গে তাঁর দিবাস্বপ্নের কথাটি পুনরাবৃত্তি করেছে মাত্র। সে বলেছে পাকিস্তান তার সম্মান ও অখন্ড সর্বশক্তি নিয়োগ করে রক্ষা করবে।
মুক্তিবাহিনীর হাতে নাকানি-চুবানি খেতে খেতে ইয়াহিয়া খান ভারত পূর্ববঙ্গের উপর আক্রমণ চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে। সে বলেছে এর ফলে এই উপমহাদেশের শান্তি বিঘ্নিত হয়েছে।
মৃত পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ইয়াহিয়ার অসহায় উক্তি হলো, বর্তমান পরিস্থিতি তাদেরকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গেছে সেখান থেকে আর ফেরার কোন উপায় নেই।
যেকোনো আক্রমণের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে চীন সরকারের সাহায্যের আশ্বাস এর কথাটিও ক্ষয় হয়ে যাওয়া রেকর্ডের মতো তার কণ্ঠে শোনা গেছে।
উক্ত অনুষ্ঠানে চীনের মন্ত্রী মিঃ লি শিশু চিং উপস্থিত ছিলেন। তিনি তার ভাষণে ভারতের নাম উল্লেখ করে সরাসরি কিছু বলেননি। তবে বৈদেশিক আক্রমণ ও হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সংগ্রামে চীন সরকার পাকিস্তানকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করবেন বলে মিঃ শিউ চিং জানান।
হানাদারদের বর্বরতা
নিউজউইকের সংবাদদাতা উল্লেখ করেছেন ঢাকার নিকটস্থ ডেমরা অঞ্চলের কথা। এখানে মুক্তি বাহিনীর লোকেরা লুকিয়ে আছে শুনে ১২ বছরের উর্ধ্বে সব পুরুষ মানুষকে হত্যা করেছে পাক ফৌজ। কিশোরী, যুবতী ও প্রৌড়াদের উপর চালিয়েছে পাশবিক অত্যাচার। অথচ ওই এলাকায় কোন মুক্তিযোদ্ধাই ছিল না।
রাজাকারদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে নিউজ উইকের সাংবাদিক বলেছেন, রাজাকার বাহিনী তৈরি করা হয়েছে গুন্ডা-বদমাশ দের নিয়ে। এসব ছোকরারা হাতে বন্দুক পেয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। এদের কেউ কিছু বলে না বলে এরা গ্রামে গ্রামে চালাচ্ছে জঘন্য অত্যাচার। লোকের কাছ থেকে টাকা পয়সা কেড়ে নিচ্ছে। মেয়েদের উপর করছে পাশবিক অত্যাচার। এতে গ্রামবাসীর ভয়ের চাইতে জাগছে ঘৃণা। তারা বাংলাদেশে মুক্তি বাহিনীর প্রতি হয়ে উঠছে বিশেষভাবে শ্রদ্ধাশীল। পাকিস্তান সরকারের অদূরদর্শী নীতি সারা বাংলাদেশের মানুষকে তাদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন করে তুলেছে।
নিউজউইকে সাংবাদিক মন্তব্য করেছেন যে, পাক-সামরিক কর্তৃপক্ষ গেরিলা যুদ্ধ সম্পর্কে বিশেষ কোনো জ্ঞান রাখে না। বাঙালি গেরিলা যোদ্ধাদের রণনিপুণতা এখন বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর তাদের প্রস্তুতি রয়েছে বাংলাদেশের মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন।
নিউজ উইক পত্রিকার মতে বাংলাদেশের শতকরা ২৫টি থানা এখন মুক্তিবাহিনীর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
হীথের দুয়ারে ইয়াহিয়ার ধর্ণা !
পাকিস্তান এখন বৃটেনের ধর্ণা দিয়েছে। ওয়াকিবহাল মহলের খবর, পাক-ভারত পরিস্থিতির রাতে অবনতি না ঘটে তার জন্য প্রভাব খাটাতে জঙ্গী সরকারের কাছে সরকারিভাবে দেনদরবার শুরু করেছে।
লন্ডনস্থ পাক হাইকমিশনার জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ লাজ- লজ্জা বিসর্জন দিয়ে প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথের কাছে জরুরী টেলিফোন করেন এবং বলেন, দেখা করতে চাই। সময়নিষ্ঠ ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ বিব্রত হয়ে কর্মসূচির উদ্বোধন করে তার সঙ্গে ২৫ মিনিট কাটান।
জানা গেছে, হাইকমিশনার মিটার এর কাছে ইয়াহিয়ার আরেকটি চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে আশা প্রকাশ করা হয়েছে, ভারতকে সংযত করতে ব্রিটেন তার প্রভাব খাটাবে।
সালদানদীতে ৩০ জন শত্রুসৈন্য খতম
গত কয়েকদিন আগে স্বাধীনতাকামী গেরিলা যোদ্ধারা সালদানদী রেলওয়ে স্টেশন, সালদানদী বাজার ও নয়নপুরে আক্রমণ চালান। ২৪ ঘণ্টাব্যাপী প্রচন্ড আক্রমণ চালিয়ে ৩০ জন সৈন্যকে খতম করেন উক্ত স্থান থেকে হানাদার পাঞ্জাবি সৈন্যদেরকে বিতাড়িত করেন। মুক্তিবাহিনীর সাফল্যজনক আক্রমণে তিনটি হালকা মেশিনগান, পাঁচটি টমিগান, ১২টি রাইফেল এবং ৫ হাজার রাউন্ড গুলি দখল করেন।
মুক্তিবাহিনী গত ৮ই নভেম্বর কুমিল্লার সরাইলে একটি বাহিনীর উপর অতর্কিত আক্রমণ চালান।
রাজশাহীতে দশজন খান সেনা নিহত
রাজশাহী থেকে আমাদের প্রতিনিধি জানাচ্ছেন মুক্তিবাহিনীর দুঃসাহসিক বীর যোদ্ধারা গত ৬ই নভেম্বর সুন্দরপুরে শত্রু ঘাঁটির উপর এক আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে পাঁচজন হানাদার সৈন্যকে নিশ্চিহ্ন ও দশ জন গুরুতররূপে আহত করেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিবাহিনীর হাতে বেপরোয়া মার খেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে পরেরদিন কালিনগর মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর আক্রমণের দুঃসাহস দেখালে আমাদের বীর যোদ্ধারা সে আক্রমণ দৃঢ়তার সাথে প্রতিহত করে পাঁচজন হানাদার সৈন্য নিশ্চিহ্ন করে দেন এবং তাদের কাছ থেকে অস্ত্র-শস্ত্র কেড়ে নেন। দিশেহারা হানাদার সৈন্যরা পাল্টা ব্যবস্থা স্বরূপ কালিনগর এর পার্শ্ববর্তী গ্রামের বহুসংখ্যক কাঁচা ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। মুক্তিবাহিনী এর আগে পাকিস্তানি সৈন্যের একটি লাশ ক্যাম্পে নিয়ে আসেন।
কারফিউর অন্তরালে
জঙ্গী কর্তৃক গত ১৭ই নভেম্বর ঢাকা শহরে পূর্বঘোষণা ছাড়া কারফিউ জারি করে হানাদার সৈন্যরা সারা শহরে ২৫শে মার্চের স্টাইলে পুনরায় নারী ধর্ষণ, হত্যা ও লুণ্ঠন চালায়। মুক্তিবাহিনীর সাহসী যোদ্ধা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা রেখে টিকাটুলি, লালবাগ, রাজারবাগ, সূত্রাপুর এলাকায় জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে মুখোমুখি আক্রমণ চালান। এই আক্রমণে শত্রুসৈন্যের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। হানাদার সৈন্যরা ক্ষিপ্ত হয়ে গেরিলা যোদ্ধাদের গ্রেফতারের নাম করে দেড় শতাধিক নিরীহ যুবককে ক্যান্টনমেন্ট আটক করে। পরে এসকল তরুণদের হত্যা করা হয়।
এই সান্ধ্য আইন এর মাত্র ৪৮ ঘন্টা পরে মুক্তিবাহিনীর ঢাকার উপকণ্ঠে প্রচন্ড আক্রমণ চালিয়ে রামপুরার টেলিভিশন ট্রান্সমিশন এর কাছে জামাতে ইসলামের একজন কুখ্যাত নেতাকে নিশ্চিহ্ন করে দেন। ওই দিনেই গেরিলা যোদ্ধারা ঢাকা শহরে প্রচণ্ড গোলাগুলি ও বোমাবর্ষণ করে আরও দু’জনকে খতম এবং ২৪ জনকে গুরুতর আহত করেন বলে এপি-র খবরে জানা গেছে।
বিবিসির এক খবরে প্রকাশ , গত ২০শে নভেম্বর হানাদার সৈন্যদের ব্যাপক প্রহরার মধ্যেই শান্তিনগরে অবস্থিত কেন্দ্রীয় চলচ্চিত্র দফতরে প্রকাশ্য দিবালোকে গেরিলা যোদ্ধাদের বোমা বিস্ফোরণের ফলে খানসেনাদের পদলেহী দালাল কর্মচারী গুরুতর আহত হয়।
মুক্তিযোদ্ধারা সম্প্রতি খানসেনাদের পদলেহী দুইজন ডাক্তার কে গুলি করে হত্যা করেছেন।

‘বেহায়া খান !’
নয়াদিল্লিস্থ বাংলাদেশ মিশনের প্রধান জনাব এইচ আর চৌধুরী সত্যিই একজন বাস্তববাদী ও স্বচ্ছ দৃষ্টি সম্পন্ন লোক।তিনি কিছুদিন আগে ছোট্ট একটি মন্তব্যে তথাকথিত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের চরিত্র চমৎকারভাবে তুলে ধরেছিলেন। তিনি তাকে ‘বেহায়া খান’ বলে অভিহিত করেছিলেন। জনাব চৌধুরীর প্রদত্ত উপাধিটা যে কত সত্য নিজেই তার প্রমান করলো।
মাত্র মাস দুয়েক আগে যুদ্ধোন্মাদ, রক্তপিপাসু ইয়াহিয়া ফ্রান্সের ‘ল্য ফিগারো’ পত্রিকার প্রতিনিধির কাছে বলেছিল ঃ”কোনদিন যদি এই মেয়ে মানুষটির সাথে আমার সাক্ষাত হয় আমি প্রথমে তাকে বলব চুপ করো মেয়ে মানুষ।”
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ ও বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি এটা নিশ্চয়ই শোভন মন্তব্য ছিল না। তবে বিশ্বের সমস্ত বিবেকবান মানুষেই সেদিন ধরে নিয়েছিলেন যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে ইয়াহিয়া কোনদিন আলোচনায় বসার ইচ্ছা রাখে না। সেরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে সে আত্মহত্যা করে হলেও নিজের মান রক্ষা করবে, কথার মূল্য রাখবে। কিন্তু হায়! দু মাস যেতে না যেতেই ইয়াহিয়া তার সমস্ত “হারায়” বিসর্জন দিয়ে একেবারে বেহায়ার মত ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আলোচনায় বসার জন্য পাগল হয়ে গেছে। এই আলোচনা বৈঠকের ব্যবস্থা করার ব্যাপারে এগিয়ে আসার জন্য সে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের দুয়ারে ধর্না দিয়েছে। কিন্তু শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সবাইকে না বলে দিয়েছেন।
সর্বশেষ খবরে প্রকাশ, বেহায়া খান এবার স্বয়ং ইন্দিরার দুয়ারে ধরনা দিয়েছে।
ইসলামাবাদে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার শ্রী জেকে অটল এর মাধ্যমে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর কাছে একখানা ব্যক্তিগত পত্র পাঠিয়েছে। তাদের অনেক কান্না কাটির পর বেহায়া খান ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাতের খায়েস প্রকাশ করেছে। শ্রী অটল এ পত্র নিয়ে দিল্লি গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে আবার ইসলামাবাদে ফিরে গিয়েছেন। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী তার কাছে লিখিত বেহায়া খানের পত্রের কোন জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি।
তবে অনুমান করা হচ্ছে যে শ্রী অটল এর মাধ্যমে বেহায়া খানকে ইন্দ্রাগান্ধির একটি কথাই জানিয়ে দিয়েছেন। তা হলো, তাঁর মতে ‘বেহায়ার’ সাথে সাক্ষাতের তার কোনও প্রয়োজন নাই।
চা বাগান এলাকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল মুক্ত
অফিসার সহ বহু হানাদার সৈন্য নিহত
বিলম্বে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, পনের/ষোল নভেম্বর রাতে মৃত্যুঞ্জয় মুক্তিফৌজ ছগলনাল চা বাগান এবং ফ্যাক্টরিতে এক দূঃসাহসিক হামলা চালায়। দখলদার পাকিস্তানি সৈন্যরা চা ফ্যাক্টরি তাদের ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করছিল। চার ঘন্টা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর চা বাগান ও ফ্যাক্টরি মুক্তিবাহিনীর প্রান্ত হয়।
এ যুদ্ধে লেফটেন্যান্ট রহিমসহ ৩০ জন কসাই সৈন্য প্রাণ হারায়। এদের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র আমাদের বাহিনী দখল করে।
একই রাতে মুক্তিসেনারা ফুলতলা চা ফ্যাক্টরিতে প্রচন্ড আক্রমণ চালিয়ে হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে। পাঁচ ঘণ্টা স্থায়ী এই যুদ্ধে ২৫ জন দখলদার সৈন্য ও রাজাকার নিহত, ছয় জন রাজাকার বন্দি এবং প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র মুক্তি বাহিনীর দখলে আসে।
১৬ই অক্টোবর মুক্তিফৌজ খাজুরি ছড়া চা বাগানে অবস্থানরত হানাদার বাহিনীর ওপর তীব্র আক্রমণ চালিয়ে তাদের বাঙ্কার ও চা কারখানা ধ্বংস করে।
১৯শে অতঃপর মুক্তিফৌজ চম্পারেছাড়া চা বাগান আক্রমণ করে হানাদার বাহিনীকে সম্পূর্ণ হটিয়ে দিয়ে বাগান দখল করে নেয়।
১৯/২০শে অক্টোবর রাতে মুক্তিফৌজ হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত ধালাই চা ফ্যাক্টরি আক্রমণ করে। উভয় পক্ষই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সজ্জিত ছিল। এই প্রচণ্ড যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ফ্যাক্টরি ভবনের কিয়দংশ এবং কয়েকটি বাঙ্কার ধ্বংস করে।
২৮শে অক্টোবর সকাল আটটায় মুক্তিবাহিনী পাটরো খোলা চা এষ্টেটে অবস্থানরত হানাদার বাহিনীর উপর বীর বিক্রমে আক্রমণ চালায়। একই সময়ে অপর একদল মুক্তিফৌজ ধালাই চা এষ্টেটে আক্রমণ করে। এই আক্রমণ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একজন ক্যাপ্টেনসহ ৫০ জন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিফৌজ তিনজন রাজাকারকে বন্দি এবং দশটি রাইফেল উদ্ধার করে। এ যুদ্ধে আমাদের একজন দুঃসাহসী মুক্তিসেনা গুরুতররূপে আহত হয়েছেন।
বাংলাদেশ ঃ প্রতিশোধের মুহূর্ত সমাগত
নিউজ উইক পত্রিকার সংবাদ নিবন্ধ
মার্কিন সংবাদ সাপ্তাহিক নিউজ উইক এর সিনিয়র এডিটর আর্ণড ধর্ম বর্কগ্রেভ এবং লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার মিঃ ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থ সম্প্রতি একসঙ্গে ঢাকার ৪৫ মাইল দূরবর্তী বিস্তীর্ণ মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন করেছেন। মিঃ বর্কগ্ৰেভ নিউজ উইকের ২২শে নভেম্বর সংখ্যায় “বাংলাঃ প্রতিশোধের মুহূর্ত” শিরোনামে এক সচিত্র প্রবন্ধে তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন।
তিনি বলেন পুড়িয়ে ফেলা ঘরবাড়ির অবশিষ্টাংশ আধা উষ্ণমন্ডলের গ্রামগুলিতে ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। সাদা ও বেগুনি মেশানো কচুরিপানার থাবার মধ্যে চুপসে যাওয়া শস্যক্ষেত্র একটি করুণ দৃশ্যের অবতারণা করেছে। লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফের ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থ এবং আমি একসঙ্গে রাজধানী ঢাকার বাইরে ৪৫ মাইল পর্যন্ত‌ গিয়েছিলাম, মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রিত ও মুক্তাঞ্চলের কেন্দ্রগুলো আমরা পরিদর্শন করেছি গৃহযুদ্ধের যাবতীয় চিহ্ন সর্বত্রই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। তিন ঘণ্টাব্যাপী ছোট্ট ডিঙিতে করে আমরা যখন ঘুরেছি তখন শতশত কৃষক আমাদের লক্ষ্য করেছেন কিন্তু তাদের মধ্যে কাউকেই এমনকি শিশুদের কেও দেখেনি গরু বাছুরের যত্ন নিতে, জেলের জাল মেরামত করছেনা, মহিলারা মাটির ঘর লেপছেন না। তারা কেউই আমাদের সম্ভাষণের প্রতুত্তর দেননি। জনৈক মুক্তিযুদ্ধা আমাকে বললেন তাদের এই উদাসীনতার কারণে তাদের বেদনাবোধ। এমন বাঙালি পরিবার খুব কমই আছে যারা এক বা একাধিক আত্মীয় বিয়োগের বেদনায় ব্যথিত নন।
ধানের জমির উপর ঘরের ছাউনি দেওয়া ছোট্ট কুটির -এটাই বিদ্রোহীদের হেডকোয়াটার। সেখানে আত্মবিশ্বাস আর সাহসিকতার পরিবেশ বিরাজ করছে। কোন রক্ষী প্রহরায় মোতায়ন নেই। মুক্ত প্রাঙ্গণে বসে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্রশস্ত্র পরিষ্কার করছেন। সকলেই স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরে কথাবার্তা বলছেন। গেরিলা নেতা আবদুল মান্নান বলেন জনগণ আমাদের সঙ্গে আছেন। হানাদার সেনা এমুখী হলেই তারা আমাদের নানাভাবে সতর্ক করে দেবেন।” ৪৩ বছর বয়স্ক সাবেক সরকারি কর্মচারী আব্দুল মান্নান বর্তমানে ১৫ হাজার অধ্যুষিত এলাকার মুক্তিবাহিনীর নিযুক্ত ডিস্ট্রিক্ট কমিশনার। তিনি বললেন কোন মুক্তিযোদ্ধাই হানাদারের আক্রমণ প্রত্যাশা করে না। এই অঞ্চলে আসার হিম্মত হানাদার বাহিনীর নেই। তারা ভীষণ ভয় পেয়েছে। এখন প্রকাশ্য দিবালোকে আমরা যেকোন জায়গায় যেতে পারি, যে কোন কাজ করতে পারি।
মিঃ বর্কগ্ৰেভ একটি সন্ধ্যা তাদের সঙ্গে কাটান। তিনি তাদের সঙ্গে ভাত ও খান। খাদ্যতালিকায় মাছ ছিল। কেদে কেদে জনাব মান্নান গেরিলাদের সফলতার বর্ণনা দিয়েছিলেন। সেদিনই গেরিলারা চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ১৯ জনকে বন্দি করে।
কিছুদিন পূর্বে ক্যাপ্টেন কে এম শাহজাহানের নেতৃত্বে গেরিলারা পাক সেনাবাহী দুইটি লঞ্চ ধ্বংস করেন। একজন তরুণ কমান্ডো বললেন আমরা বাতাসে একটা ফাঁকা আওয়াজ’ করলেই শত্রুসেনার অপর পাড়ে চলে যায়, আর আমাদের ফাঁদে পড়ে।
মিঃ বর্কগ্ৰেভ বলেন, গত ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনে বাঙালির বিজয়ের পরেই পাকিস্তান সরকারের গণহত্যা অভিযান। গণসমর্থন মুক্তিবাহিনীর তৎপরতার পেছনে কাজ করছে। মান্নান বলেন আমাদের বিজয় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কর্তৃক সম্মানিত হয়নি। সেনাবাহিনীই এই আমাদের এই কাজে বাধ্য করেছে। অনেক হত্যাকাণ্ড অনুষ্ঠিত হয়েছে। লুটতরাজ এবং নারী নির্যাতন হয়েছে।আমরা এখন উদ্দাম বেপরোয়া জাতি। প্রতিটি পরিবার মৃত্যু এবং ধ্বংসের স্বাদ গ্রহণ করেছে।
জনাব মান্নান বলেন আমরা জয়ী হলে সত্যিকারের গণতন্ত্র আমরা লাভ করব। অন্যান্য উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের মত স্বাভাবিক ভাবে আমাদের ও সমাজতান্ত্রিক কাঠামো থাকবে, কিন্তু সাম্যবাদী নয়। আমরা একটি নতুন জাতি, বাংলাদেশের জন্যই এই লড়াই করছি।
তিনি বলেন, প্রতি সপ্তাহে গ্রামাঞ্চলে গেরিলাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার পরিসর ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। সরকারি কর্মচারী ও গ্রামের মাতব্বরগণ মুক্তিবাহিনীকে সমর্থন করছেন। অবশ্য কয়েকটি এলাকায় সাময়িক ব্যতিক্রমও আছে। শহর-বন্দর এর বাইরে সরকারি বাহিনী কে কদাচিৎ দেখা যায়। দেশের অধিকাংশ এলাকায় রাতে বিদ্রোহী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকে। এমনকি দিনের বেলাতেও বিস্তীর্ণ এলাকায় মুক্তিবাহিনীর কর্তৃত্ব দেখা যায়। যে সমস্ত এলাকায় গেরিলা তৎপরতা দেখা যাবে সেসব এলাকায় পাইকারি জরিমানার সরকারি নির্দেশ প্রমাণ করে যে, পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃত্বে চিড় ধরেছে। সামরিক কতৃপক্ষ এখনো গাঁজাখুরি গল্প ছড়াচ্ছে যে বিদ্রোহী তৎপরতা সম্পূর্ণ খতম হয়ে গেছে। বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে পাক সেনাবাহিনীর চরিত্র নির্ণয় করে এমন একজন পাকিস্তানী গোয়েন্দা বললেন,’মুক্তিবাহিনী এখন বড় দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। অনেক বিদ্রোহী আত্মসমর্পণ করেছে। এ জেলার প্রায় ৩৫ লক্ষ লোকের মধ্যে সম্ভবতঃ ১০০ জন বড়জোর ২০০ জন বিদ্রোহী ছিল। কিন্তু এখন আর একজন ও অবশিষ্ট নাই। দেখতেই তো পাচ্ছেন জনগণ পাকিস্তানের সঙ্গে আছে কিনা।’
অবশ্য আমি যাদের দেখে ছিলাম তারা কেউই পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন না। বিধ্বস্ত শহর এবং অধিক চট্টগ্রাম সর্বত্রই লোকজন পাক সেনাবাহিনীর নিসংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞের দৈনিক ফিরিস্তি শুনিয়েছেন।
সাংবাদিক তার সংযত ভাষায় হানাদার বাহিনীর হাতে নারী নির্যাতনের এক চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন, একটি ছোট্ট গ্রামের প্রায় সকলেই ১৪ বছরের মেয়েটির ঘটনাটি জানেন, তাকে পাক সেনাবাহিনীর ১২ জন সেপাই পালাক্রমে ধর্ষণ করে, পরে তার একদিনের শিশু সন্তানকে এবং তাকে তারা হত্যা করে। অপর একটি গ্রামের লোক দুইজন পাকসেনাকে ধরে রেখেছিল, তারা তাদের ভোগের জন্য দুইটি কুমারী মেয়ে চেয়েছিল। ঘটনাটি সামরিক অধিকর্তাকে জানানোর পর দিনেই ঐ গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয় আর পাক সামরিক বাহিনীর হাতে ৩৮ জন গ্রামবাসী প্রাণ হারায়।
তিনি আরো বলেন, বিদ্রোহের এলাকা পরিদর্শনের সময় আমি একাধিকবার লক্ষ্য করেছি যে পাকিস্তানি সেনারা দোকানপাট লুন্ঠন করছে এবং তাদের মর্জিমতো জিনিস পত্র সংগ্রহ করছে।
এই বর্বরতা বাঙালির স্বাধীন দেশ গঠনের আকাঙ্ক্ষাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমি যেখানেই গিয়েছি, সেখানে মুক্তিবাহিনীর বিদ্রোহীদের এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল লোকের মুখে আসন্ন ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার কথা শুনেছি। নদী পেরোনোর সময় আমি জনৈক পাকিস্তানি সার্জেন্টকে একটি ভারী লাঠি নিয়ে একজন বাঙালিকে প্রহার করতে দেখেছি। আমাকে দেখেই লোকটি তাড়াতাড়ি থেমে যায়। পরে আমাকে ওই বাঙালি টি বললেন, “এতো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। কিন্তু প্রতিশোধ গ্রহণের দিন দ্রুত এগিয়ে আসছে, আর ওই দিনটি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ।”
বাড়বেন না
ইয়াহিয়ার প্রতি সোভিয়েত হুঁশিয়ারি
গত ২৫শে নভেম্বর মস্কোর ওয়াকেফহাল মহলের সূত্রে বলা হয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের পরিস্থিতি আর খারাপ না করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানের প্রতি পুনর্বার জরুরি আবেদন জানিয়েছেন।
সমস্যার শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের আন্তর্জাতিক উপদেশ অগ্রাহ্য করে পাকিস্তান তার বর্তমান যুদ্ধংদেহী মনোভাব অব্যাহত রাখলে তার যে গুরুতর পরিণতি দেখা দিতে পারে সোভিয়েত ইউনিয়ন সে বিষয়ে পাকিস্তানকে সতর্ক করে দিয়েছে।
ভারতে আক্রমণের ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে পাকিস্তান বাংলাদেশ সমস্যার সাথে ভারতকে জড়িত করার যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তার পরেই সোভিয়েত ইউনিয়ন এই সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে।
প্রকাশ্য পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত এ, রভিনোভ জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সাথে সাক্ষাত করেন।
পাক দূতাবাস কর্মচারীদের দিল্লি ত্যাগ
বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে ইসলামাবাদের স্নিগ্ধ বাতাসেও পাক সামরিক জান্তার মস্তিষ্ক উত্তপ্ত হয়েছে। সেই উত্তাপে তারা সীমান্ত অঞ্চলে সৈন্য সমাবেশ করেছে। তাতেই হয়তো দিল্লির পাক হাইকমিশনার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বাতাসেও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। গত ১৮ই নভেম্বর বৃহস্পতিবার পাক হাইকমিশনের ৭০ জন কর্মচারী পাকিস্তানে চলে গেছে। এর পরদিন আরো ৫৫ জন কর্মচারী তাদের পরিবারবর্গ সহ নয়াদিল্লি থেকে পাকিস্তানি গিয়েছে। বৃহস্পতিবার ইসলামাবাদস্থ ভারতীয় হাইকমিশনার দপ্তরের ৯০ জন কর্মচারী ও তাদের পরিবারবর্গ সহ স্বদেশে ফিরেছেন। আটক বাঙালি কর্মচারী জনাব হোসেন আলী এখনো মুক্তি লাভ করেন নি। তবে হানাদাররা তাকে পাকিস্তানে নিয়ে যেতে পারেনি।
এটা পাকিস্তানি হামলার পূর্বাভাস বলে অনেকে মনে করছেন। মুক্তিবাহিনীর সাফল্যে দিশেহারা পাকহানাদারদের শেষ পর্যন্ত ক্ষিপ্ত কুকুরের মত আচরণ বিস্ময়কর নয়।
উত্তরাঞ্চলের মুক্ত এলাকা
স্বাধীন বাংলার প্রশাসন ব্যবস্থা চালুঃ পুনর্গঠন কর্মসূচি গ্রহণ (নিজস্ব প্রতিনিধি)
বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা রংপুর জেলার পাক দস্যু কবলিত বারশত বর্গমাইল বিস্তীর্ণ আটটি থানা এলাকা সম্পূর্ণ মুক্ত করেছে। এলাকায় মোট সাত লাখ লোকের বসতি রয়েছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বেপরোয়া আক্রমণের ফলে ভীতসন্ত্রস্ত হানাদার বাহিনী ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। তারা অস্ত্রশস্ত্র ফেলে এবং বিপুল ক্ষয়ক্ষতির শিকার করে পালিয়ে প্রাণ বাঁচানোর নীতি গ্রহণ করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্য এবং জনগণের ইস্পাতদৃঢ় ও প্রতিরোধের ফলে মুক্তাঞ্চলের পরিধি প্রতিদিনই বেড়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার মুক্তাঞ্চলে প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।
বাংলাদেশ সরকার গ্রাম এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করার কাজে হাত দিয়েছেন। অসামরিক ধরনের মামলা পরিচালনা করার জন্য ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয়েছে। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক এলাকায় শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য পুলিশ বাহিনী ও কাজ করছেন। জেলখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারে অভিযুক্ত কয়েকজন অপরাধীকে উক্ত কয়েদখানায় আটক রাখা হয়েছে। উক্ত এলাকায় ডাক চলাচল শুরু হয়েছে এবং টেলিফোন সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে। জমি হস্তান্তর এবং বিবাহ রেজিস্ট্রেশনের জন্য সাব-রেজিস্ট্রার দফতর নিয়ম মত কাজ করছে। আবগারি ও স্থল শুল্ক দফতরের কাজও শুরু হয়ে গেছে। অধিকাংশ স্কুল কলেজ খুলেছে। প্রাইমারি স্কুল গুলোতে নিয়মিত ক্লাস হচ্ছে।
প্রতিটি থানায় একটি করে ডিসপেনসারি স্থাপন করা হয়েছে এবং পুরোদমে কাজ শুরু হয়ে গেছে। স্বেচ্ছাসেবকদের সহযোগিতায় হেলথ অফিসারগণ কলেরা প্রতিরোধ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন।
হানাদার বাহিনীর হাত থেকে ছিনিয়ে আনা এ সমস্ত অঞ্চলে এখন খাদ্যাভাব বিরাজ করছে। আঞ্চলিক কাউন্সিল এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার টেস্ট রিলিফের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।
বাংলাদেশ অসামরিক শাসন ব্যবস্থা চালু করার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জনগণের মনে বল উন্নত রাখার জন্য জনসভার আয়োজন করেছেন।
অতিসম্প্রতি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের আঞ্চলিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যান জনাব মতিউর রহমান এম, এন, এ রংপুর জেলার পাটগ্রাম, ফুলবাড়ী, সোনাহাট, হাতীবান্ধা থানার হেডকোয়ার্টারে আয়োজিত জনসভায় ভাষণ দেন। নেতৃস্থানীয় এম এন এ এবং এমপি গণ ও বক্তৃতা করেন। বিপুল সংখ্যক শ্রোতা উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে আলোচনা সভায় যোগদান করেন। নেতৃবৃন্দ স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে সরকারি কর্মচারী এবং মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেন।
উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন প্রান্তে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোরঞ্জনের জন্য বাংলাদেশের পুরুষ ও মহিলা শিল্পীগণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করছেন।
ঢাকায় ত্রাসের রাজত্ব
পাকহানাদাররা পুনরায় গণহত্যায় লিপ্ত
গত ১৭ই নভেম্বর বুধবার দিন পাকিস্তানের সামরিক জান্তার ঘাতকরা সমগ্র ঢাকা শহরের কারফিউ জারি করে বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে ব্যাপক গণহত্যা, লুটতরাজ ও নারীর শ্লীলতাহানি করে। ঢাকা নগরীতে জল্লাদের তাণ্ডবলীলা ২৫ শে মার্চের বীভৎসতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
কিন্তু পাকদস্যুদের উন্মত্ত তাণ্ডবলীলা সত্বেও ২৫শে মার্চ ও ১৭ই নভেম্বরের ঘটনাবলীর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য লক্ষ্য করা গেছে। পাকিস্তানি ঘাতকরা এই দিনে ২৫শে মার্চের মত অবাধে একতরফা হত্যাকাণ্ড চালাতে পারেনি। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন মহলে আমাদের মুক্তিবাহিনীর দেশপ্রেমিক’ গেরিলা যোদ্ধারা আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সাহায্যে অসীম সাহসের সঙ্গে তাদের মোকাবিলা করে এবং একমাত্র ঢাকা শহরেই মোট ১০০ জন দালাল, রাজাকার, পাকিস্তানি সৈন্য ও পশ্চিম পাকিস্তানের পুলিশকে হত্যা করে।
ইয়াহিয়ার গাধা ডাক্তার মালিককে দখলকৃত বাংলাদেশের গভর্নর নিযুক্ত করে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা নিজেদের বিষাক্ত নখর আড়ালে চেপে রাখতে চেয়েছিল।
তারা দুনিয়াকে দেখাতে চেয়েছিল যে, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে এবং হানাদার বাহিনীর জুলুম-নির্যাতন বলে কোন বস্তুর অস্তিত্ব নাই। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে, এমন খোদ ঢাকা শহরেও মুক্তিবাহিনীর দুঃসাহসী ও সফল অভিযানের বিভ্রান্ত সামরিক জান্তা ও সামরিক শাসন ও ভালো মানুষীর মুখোশ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পুনরায় বাঙ্গালীদের হত্যা করতে শুরু করেছে। মুক্তিযোদ্ধারা বাধ্য করেছে ডাক্তার মালিককে তথাকথিত সামরিক সরকারের তুচ্ছতা ও অর্থহীনতাকে ফাঁস করে দিতে এবং তাদের স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করতে।
সমগ্র ঢাকা শহরকে তারা এখন একটি অবরুদ্ধ নগরীতে পরিণত করেছে। শহরের পাঁচটি থানা পাঁচজন ব্রিগেডিয়ারের নেতৃত্বে ট্রাকবোঝাই হানাদার সৈন্যরা বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে তরুণ বাঙ্গালীদের হত্যা করেছে নয়তো জিজ্ঞাসাবাদের নামে অকথ্য নির্যাতন করেছে। মুক্তি বাহিনীর আক্রমণে বিপর্যস্ত হানাদাররা এত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে যে, কারফিউ জারির কথা পূর্বাহ্নে জানিয়ে দিয়ে জনসাধারণকে তারা সতর্ক পর্যন্ত করেনি। কারফিউ শুরু হবার প্রায় তিন ঘন্টা পরে ঢাকার জনসাধারণকে কারফিউর কথা জানানো হয়। প্রথম পর্যায়ে একটানা প্রায় পনের ঘন্টা পর কারফিউ কাগজে-কলমে তুলে নেওয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে তাদের আচার-আচরণে কারফিউ অব্যাহত রাখা হয়েছে।
কারফিউর প্রথম পর্যায়ে এমনকি ডাক্তার, সাংবাদিক, রেডিওর গাড়িকেও পথে বের হতে দেওয়া হয়নি।
এখানে প্রাপ্ত এক খবরে প্রকাশ, পাক হানাদাররা এই দিন প্রায় এক হাজার নিরীহ অসামরিক অধিবাসীদের হত্যা করেছে। শহরে হানাদাররা নতুন করে সন্ত্রাস সৃষ্টি করায় পুনরায় দলে দলে লোক নিরাপদ এলাকার সন্ধানে শহর ত্যাগ করতে শুরু করেছে।