কলাম
দৈনিক ইত্তেফাক
২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
রাজনৈতিক মঞ্চ
মোসাফির
রাজনীতিতে সত্য কথা বলা অনেক সময় দুরূহ হইয়া পড়ে। ভাবাবেগ দ্বারা মানুষকে পরিচালিত করা সহজ। অবশ্য ভাবাবেগ ও চেতনাবোধ না থাকিলে মানুষের সৃজনীশক্তি বিকশিত হয় না। যেহেতু আমি সক্রিয় রাজনীতিতে নাই বহুদিন যাবৎ, সেহেতু রাজনীতিকের পক্ষে যাহা সমস্যা আমার পক্ষে সেই সমস্যা নাই। আমরা যখন যাহা ভাল মনে করি জনসাধারণের কাছে তাহা তুলিয়া ধরি। আমাদের বক্তব্যের মধ্যে ভুলভ্রান্তি থাকিতে পারে। তবে তাহা ইচ্ছাকৃত অথবা কোন মহলের চাপের মুখে নয়, এই আশ্বাস আমরা দিতে পারি।
গোটা পাকিস্তানে, বিশেষতঃ পূর্ব পাকিস্তানে যে অভাবিতপূর্ণ গণ- অভ্যুত্থান ঘটিয়াছে, তাহা শুধু আমাদিগকে বিস্ময়াভিভূত করে নাই, গোটা দুনিয়ার কাছে আমাদের দেশবাসীর মুখ উজ্জ্বল হইয়াছে, একটি স্বৈরাচারী সরকারকে গণ-অভ্যুত্থান কিভাবে পর্যুদস্ত করিতে পারে, আমাদের ছাত্র- জনতা তার এক নূতন ইতিহাস সৃষ্টি করিয়াছে। এদেশের সর্বস্তরের মানুষের তথা কৃষক-মজদুর-মধ্যবিত্ত ও আমাদের সন্তান সন্তানতুল্য নির্ভীক সংগ্রামী ছাত্রদের দুর্বার আন্দোলনের ফলেই ইত্তেফাক আজ মুক্ত হইয়াছে। এই আন্দোলনের ফলেই শেখ মুজিব এবং তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামীরা মর্যাদার সহিত মুক্তি পাইয়াছেন। এই আন্দোলনের ফলেই পাকিস্তানের সকল জেল আজ রাজনৈতিক বন্দীশূন্য হইয়া পড়িয়াছে। গণ- অভ্যুত্থানের এইগুলি সুফল সন্দেহ নাই। কিন্তু আমাদের স্মরণ রাখিতে হইবে যে, লক্ষ্যে পৌঁছিবার পথে আমাদের অনেক বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করিতে হইবে। গণ-আন্দোলনের মুখে এদেশের প্রতিক্রয়াশীল শক্তি গা ঢাকা দিয়া থাকিলেও তারা যে এখনও তলে তলে সক্রিয় নাই এই ধারণা পোষণ করা ভুল হইবে। তাহারা এখনও নানা কলা-কৌশল প্রয়োগ করিয়া গণ-ঐক্যে ফাটল ধরাইবার এবং উস্কানিমূলক কার্যকলাপ দ্বারা আন্দোলনকে বিপথগামী করার প্রচেষ্টা চালাইবে। যেহেতু এই দুষ্কর্ম করার সাহস বা শক্তি নিজেদের নাই। বিভিন্ন পথে এজেন্ট মারফত তাঁহারা এই দুষ্কর্ম সাধনের চেষ্টা করিবে। আমরা জানি, আমাদের ছাত্রসমাজ ও জননেতারা এ ব্যাপারে সজাগ আছেন; কিন্তু বর্তমানে অভূতপূর্ব গণ-জাগরণের মুখে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মহলের দুরভিসন্ধিমূলক কার্যকলাপ প্রতিরোধ করা তাদের একার কার্য নয়। এক্ষেত্রে গোটা দেশবাসীকে সজাগ দৃষ্টি রাখিতে হইবে এবং সক্রিয় ভূমিকা পালন করিতে হইবে। আন্দোলন আজ গ্রামে-গঞ্জে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। কিন্তু আন্দোলন সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত করিবার মত সংগঠন সেখানে নাই। দীর্ঘদিনের লাঞ্ছনা-বঞ্চনা এবং বর্তমান ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মুখে কেহ কেহ ‘আগুন লাগাও’ প্রভৃতি শ্লোগান তুলিতে পারে। কিন্তু এই ব্যাপারে জনগণকে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হইবে।
সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯