You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.20 | হামুদুর রহমান কমিশনের বেসামরিক আদালতের নিয়ম-পদ্ধতি মানা উচিত ছিল - সংগ্রামের নোটবুক

হামুদ-উর-রহমান কমিশন

কখনাে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলী জনগণের কাছে প্রকাশ করা হয় নি। জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স ও সরকার ব্যর্থ হয়েছে প্রদেশের বাস্তবতা জনগণের সামনে তুলে ধরতে  তাই তারা পারে নি পরিস্থিতিকে এর যথাযথ প্রেক্ষিতে বিচার করতে। জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স ও সরকার ছিল ঘটনাস্থল থেকে বহু দূরে। সৈন্যরা সেখানে কী পরিস্থিতি মােকাবেলা করেছে তা তাদের বােঝার কথা নয় জনগণকে মিথ্যা সংবাদ ও মিথ্যা আশ্বাস দেয়া হয়েছে। এতে ফুলে ফেঁপে ওঠে তাদের প্রত্যাশা বেড়ে যায় আশা বিপর্যয়ের সংবাদ প্রচণ্ডভাবে ঝাকুনি দেয় জনগণের বিবেককে। এ দুঃসংবাদ শােনার জন্য প্রস্তুত ছিল না তারা  এতে তাদের আশা ভেঙে যায় এবং ধূলিসাৎ হয়ে যায় অহংকার ক্ষোভ ওঠে চরমে তাদের। জাতিকে গ্রাস করে গভীর হতাশা। তাদের ক্ষোভ প্রশমিত করতে হবে এবং এটা অপরিহার্যও ছিল। এ পটভূমিতে গঠন করা হয় হামুদ-উর-রহমান কমিশন জনগণের দাবি ছিল বিশ্বাসঘাতকদের ফাসিতে ঝুলানাে। ১৯৭১-এর ২০ ডিসেম্বর তারা নেমে আসে রাস্তায়। এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভুট্টোকে জিজ্ঞেস করা। হয়, “ইয়াহিয়া খানের কি বিচার করা হবে?”জবাবে তিনি বলেন যে, বিশ্বাসঘাতকদের বিচার করার জন্য যারা আওয়াজ তুলেছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ইতােমধ্যেই তারা পরাজিত হয়েছে। যখন বলা হলাে যে, জাতি তাদের ফাসি চায়। তিনি বললেন, “আমি এর অংশ হতে চাই না।” জনগণের দাবি এত প্রবল ছিল যে, তা উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। সময়ক্ষেপণে ভুট্টোর অবস্থান নাজুক হয়ে উঠবে। তাকে তার বিশ্বাসযােগ্যতা প্রমাণে। এ উভয় সংকট থেকে বের হয়ে আসতে হবে। ১৯৭১-এর ২৪ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভেঙে যাবার বেদনাদায়ক ঘটনাগুলাে তদন্তে ভুট্টো নয়া প্রেসিডেন্ট ও বেসামরিক সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে প্রধান বিচারপতি হামুদ-উর-রহমানের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেন। সর্বস্তরের মানুষ এ কমিশন গঠনের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়। জনগণের দাবি পূরণ করা হয়েছে। এটা ছিল একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন। আশা করা হয়েছিল যে, এ কমিশন ভয়-ভীতি ও পক্ষপাতিত্ব ছাড়া কাজ করবে। জাতি কমিশনের ওপর তাদের পূর্ণ আস্থা স্থাপন করে। যুদ্ধবন্দি শিবিরে থেকেও আমরা খুশি হয়েছিলাম। একজন প্রধান বিচারপতি এ ঘটনার নিষ্পত্তি করবেন। সত্যের। জয় হবে, সত্য প্রকাশিত হবে এবং প্রকৃত দোষীদের মুখােশ উন্মােচিত হবে এবং অশুভ মেঘ কেটে যাবে। কিন্তু হামুদ-উর-রহমান কমিশন একটি প্রহসনে পরিণত হয়।

রাষ্ট্রপ্রধান কমিশনের শর্তাবলী নির্ধারণ করেন। এসব শর্তের আওতায় কমিশনকে শুধু ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার ও তার কমান্ডের আওতায় সশস্ত্র বাহিনী কোন পরিস্থিতিতে আত্মসমর্পণ এবং পশ্চিম পাকিস্তান ও ভারতের সীমান্ত এবং জম্মু ও কাশ্মীর সীমান্ত বরাবর যুদ্ধবিরতির নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, ততটুকু তদন্ত করার ক্ষমতা দেয়া হয়। তদানীন্তন সেনাবাহিনী প্রধান লে. জেনারেল গুল হাসান শর্ত আরােপ করে তদন্ত কমিশনের হাত-পা বেঁধে দেয়ার বিরুদ্ধে কোনাে শব্দটি করেননি। গুল হাসান ও টিক্কা দুজনেই পূর্ব পাকিস্তানে বিপর্যয়ের জন্য দায়ী ছিলেন। তাই তদন্ত কমিশনের সীমানা সংকুচিত হওয়ার তারা সন্তুষ্ট হন। বস্তুতপক্ষে, তাদেরকে ছাড় দেয়ার জন্যই কমিশনের তদন্ত কাজে শর্তারােপ করা হয়। ভুট্টোর ওপর চাপ দেয়া ছিল গুল হাসান ও টিকার নৈতিক দায়িত্ব। এ চাপ দিয়ে তারা পাকিস্তান ও সশস্ত্র বাহিনীর বিরাট উপকার করতে পারতেন। কিন্তু তারা তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, স্বার্থ ও উচ্চ-আকাক্ষার জন্য জাতি ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্রতারণা করেন। পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন হওয়ার মূল কারণগুলাে চিহ্নিত করা কমিশনের কখনাে লক্ষ্য ছিল।  জনগণের আবেগ-অনুভূতিকে ধামাচাপা দেয়াই ছিল কমিশনের কাজ। কমিশন সুচিন্তিতভাবে গােপন করেছে বেশি এবং প্রকাশ করেছে কম। একজন ক্ষমতালিন্দু লােকের ঘৃণ্য তৎপরতা থেকে জনগণের দৃষ্টিকে ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে এটাকে একটি বলির পাঁঠা খুঁজে বের করার নির্দেশ দেয়া হয়। এ ক্ষমতালি লােকটি একটি জাতির এমন ক্ষতি করেছে যা কখনাে পূরণ হবার নয়। খুব সাদামাটা দৃষ্টিতেও শর্ত আরােপের অসৎ উদ্দেশ্য ধরা পড়ে কমিশনের এক্তিয়ার সামরিক তৎপরতা বিশেষ করে পূর্ব রণাঙ্গনে সামরিক তৎপরতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। এ সামরিক তৎপরতাকে মূল জাতীয় যুদ্ধ পরিকল্পনা থেকে আলাদা করে বিচার করা হয়। যেসব ঘটনা পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য দায়ী সেসব ঘটনাকে কমিশনের দায়িত্বের বাইরে রাখা হয়। রাজনৈতিক সংকটেই এ বিপর্যয় ঘটেছে। কিন্তু কমিশনকে রাজনৈতিক ঘটনাবলী বিশ্লেষণ ও রাজনেতিক দায়-দায়িত্ব নির্ধারণের ক্ষমতা দেয়া হয় নি। ক্ষমতালিন্দুদের প্রকাশ্য ও গােপন তৎপরতায় জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হয়। কিন্তু এসব তৎপরতা ছিল কমিশনের এক্তিয়ার বহির্ভূত। ক্ষমতা লিপ্সার জন্যই ঘটেছে সর্বনাশ রাজদণ্ড ও রাজসিংহাসন দখলে দেশের অর্ধেক খােয়ানাে হয়েছে। ক্ষমতা দখলের প্রতিযােগিতা থেকে সরে যাওয়া ভুট্টোর পক্ষে সম্ভব ছিল না। সত্যকে মিথ্যা বানানাে ক্ষমতার রাজনৈতিক খেলায় খুবই সামান্য পাপ। “এ ভয়াবহ নাটকের প্রধান চরিত্রগুলাে উল্লেখ করতে গিয়ে ভুট্টোর একজন জীবনী লেখক চমৎকারভাবে বলেছেন যে, ১৯৭১ এর বিপর্যয়ের জন্য ইয়াহিয়া, মুজিব ও ভুট্টোই দায়ী। তবে অনেকেরই অভিমত এই যে, এ তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদ হিসেবে ভুট্টোকেই এ ঘটনার সিংহভাগ দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। কেননা, তার কর্মকাণ্ডের পরিণাম সম্পর্কে ধারণা করার মতাে তিনি যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছিলেন।” (সালমান তাসির, আ পলিটিক্যাল বায়ােগ্রাফি, ২৩ ও ২৬ জুলাই, ১৯৮৬,

দৈনিক ডন-এ এ. টি. চৌধুরী এ উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন)

যদি ভবিষ্যতে প্রয়ােগের জন্য সামরিক শিক্ষা আহরণ অথবা সামরিক কর্মকর্তাদের তৎপরতা মূল্যায়ন করা কমিশনের লক্ষ্য হতাে তাহলে বিষয়টি ছিল ভিন্ন। পেশাগত যােগ্যতা ও প্রশ্নাতীত সততার অধিকারী সামরিক বিশেষজ্ঞদের ওপর এ কাজের দায়িত্ব অর্পণ করা অপরিহার্য ছিল। তদন্তের সীমারেখা বেঁধে দেয়ায় তাদের অভিপ্রায় সম্পর্কে আমাদের মনে সন্দেহ উঁকি দেয়। তারা সুস্পষ্টরূপে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, কয়েকজন অফিসারকে বলির পাঁঠা বানানাে হবে। “এসব ঘটনায় যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তারাই তদন্তের শর্তাবলী ঠিক করায় এতে দুটি বড় রকমের ক্রটি লক্ষ্যণীয়। প্রথমত তারা পেশাগত সামরিক বিষয়াদিতে তদন্ত সীমাবদ্ধ রেখেছেন এবং শুধুমাত্র পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলীকে তদন্তের আওতায় রেখেছেন। প্রথম ছাড় দেয়ার লক্ষ্য হচ্ছে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে রক্ষা করা এবং দ্বিতীয় ছাড় দেয়ার লক্ষ্য হচ্ছে মিলিটারি হাই কমান্ডের কার্যকলাপ গােপন রাখা। এসব ছাড় দেয়ার কারণ দিনের আলাের মতাে স্পষ্ট। কারণ, যে রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব তদন্তের এসব শর্ত নির্ধারণ করেছেন তারাই পাকিস্তান সরকার ও সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। এ ধরনের ছাড় দেয়ার বিপর্যয়ের জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করা আদৌ সম্ভব হবে না। পূর্ব পাকিস্তানের কমান্ডার ও তার সৈন্যদের অভিযুক্ত করাই মূল নায়কদের জন্য সুবিধাজনক। এজন্য তদন্তের সীমারেখা বৃদ্ধি করা হয় নি। (দ্য মুসলিম, ইসলামাবাদ, জানুয়ারি ১৯৯১) আশংকা অনুযায়ী হামুদ-উর-রহমান কমিশন একটি প্রহসনে পরিণত হয়।

জাতীয় পর্যায়ে এটা ছিল একটি হাস্যকর তদন্ত। বিপর্যয়ের দুই মূল নায়ক ভুট্টো ও টিক্কা দৃঢ়ভাবে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হন। নিজেদের মধ্যে তারা রাষ্ট্রের দুটি শীর্ষ পদ। ভাগাভাগি করে নেন। একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শীর্ষ রাজনৈতিক পদ এবং আরেকজন সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে সেনাবাহিনীর শীর্ষ পদ দখল করেন। ক্ষমতার অলিন্দ থেকে তারা ক্ষমতার শীর্ষে আরােহণ করেন। লােকজন স্বার্থের মােহে নয়তাে চাপের মুখে কমিশনের কাছে জবানবন্দি দেন। পুরােপুরি দায়মুক্ত করা হয় টিক্কাকে। রিপাের্টে তার নাম উল্লেখ করা হয় নি। ভুট্টো নিজের নির্দোষিতা নিশ্চিত করেন। ব্যর্থতা ক্ষমা করা যায়। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা ক্ষমা করা যায় না। মরহুম খ্যাতিমান সাংবাদিক জনাব এ,টি, চৌধুরী তার অনুসন্ধানী রিপাের্টে লিখেছেন : “পিপিপি’র হােমরা-চোমড়ারা হামুদ-এর রিপাের্টেকে শুধু প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত। সম্পত্তিতেই পরিণত করে নি, তারা একপেশে, সংক্ষিপ্ত ও পক্ষপাতদুষ্ট’ প্রভৃতি। বিশেষণ প্রয়ােগ করে এ রিপাের্টের নিন্দাও করেছে। রিপাের্টকে অপর্যাপ্ত দেখে ভুট্টোর লােকজন তাদের নেতাকে দোষারােপ না করে পারেন নি। বস্তুত তদন্ত কমিশন গঠন করার সময় ভুট্টো সতর্ক ছিলেন যাতে এ কমিশনের পরিধি সীমিত থাকে এবং এজন্য তিনি শর্ত বেঁধে দিয়েছিলেন।  সন্দেহাতীত সূত্রের ভিত্তিতে যে কেউ একথা বলতে পারে যে, এ তদন্ত কমিশনকে তাদের তদন্ত সামরিক বিপর্যয় পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখার এবং আত্মসমর্পণের কারণ বিশেষভাবে সামরিক বিপর্যয়ের জন্য দায়ী রাজনৈতিক পটভূমি উদঘাটন না করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। বিচারপতি হামুদুর রহমান ঢাকার পতন ঘটার । আগে পরিস্থিতির সামগ্রিকতাকে পুংখানুপুংখভাবে তলিয়ে দেখার জন্য তদন্তের সীমানা বৃদ্ধির সুপারিশ করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু তাকে রাজনৈতিক বিষয়ে নাক না গলানাের জন্য কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়।”

(ডন, করাচি, ২৩ ও ২৬ জুলাই, ১৯৮৬)

যেহেতু যুদ্ধ হচ্ছে রাজনীতির একটি সম্প্রসারিত অংশ, তাই পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক সংকটের ফলে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়ােজন দেখা দেয় এবং সামরিক অভিযান একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ ও পাকিস্তানের ব্যবচ্ছেদের মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি লাভ করে। কিন্তু হামুদ-উর-রহমান কমিশনকে রাজনৈতিক বিষয়ে তদন্ত করতে দেয়া হয় নি। আমি যতবার কমিশনের মুখােমুখি হয়েছি ততবারই রাজনৈতিক ব্যর্থতার উদাহরণ দিয়ে কমিশনকে বােঝানাের চেষ্টা করেছি যে, এটা সামরিক নয়, একটি রাজনৈতিক বিপর্যয় ও সংকট। কিন্তু প্রতিবারই কমিশন বলতাে যে, রাজনৈতিক বিষয় তদস্তযােগ্য নয়। রাজনৈতিক তৎপরতা থেকে। সামরিক তৎপরতাকে আলাদা করা সম্ভব নয়। রাজনীতিবিদরা রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে দেন-দরবার করেন। তারা ব্যর্থ হলে সামরিক ব্যবস্থার মাধ্যমে রাজনৈতিক। স্থিতি প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং রাজনৈতিক নিষ্পত্তির মধ্য দিয়ে সামরিক তৎপরতার প্রয়ােজন ফুরিয়ে যায়। জনাব এ, টি, চৌধুরী আরাে লিখেছেন:  ‘হামুদ কমিশনের স্পন্সর সুপার পলিটিশিয়ান যদি এ কমিশনের পরিধি নির্ধারণ করে থাকেন এবং রাজনৈতিক ঘটনাবলী এড়িয়ে যাবার জন্য কমিশনকে নির্দেশ দিয়ে থাকেন তাহলে একথাই প্রমাণিত হচ্ছে যে, যারা ক্ষমতার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ছিলেন তাদের অপকর্ম আড়াল করা জন্যই এ রিপাের্টকে অসম্পূর্ণ রাখা হয়েছে।”  এ কমিশনের পরিধি সামরিক তৎপরতা বিশেষ করে পূর্ব রণাঙ্গনের সামরিক তৎপরতা পর্যন্ত সীমিত রাখা হয়। কিন্তু পশ্চিম রণাঙ্গনের সামরিক তৎপরতাকে এর আওতায় আনা হয় নি। এটা অন্যায় এবং এর উদ্দেশ্য উচ্ছে ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার ও তার সৈন্যদের ক্রুশবিদ্ধ করা। ভৌগলিক বাস্তবতাকে বিচেনায় রেখে। উভয় রণাঙ্গনের জন্য অভিন্ন জাতীয় যুদ্ধ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। পারস্পরিক সম্পর্কে বজায় রেখে যুদ্ধ করার কথা ছিল। একথা সত্য না হলে বলা হতাে না যে, “পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ পশ্চিম পাকিস্তানে করা হবে এবং হাই কমান্ডও পূর্ব রণাঙ্গন থেকে পশ্চিমে ভারতীয় সৈন্যদের সরিয়ে নেয়ার সুযােগ না দিতে আমাকে নির্দেশ দিত না। হাই কমান্ডের নির্দেশ পালন করতে গিয়ে আমাকে ভারতের ২০ ডিভিশনের বিরুদ্ধে আমার পরিকল্পিত অভিযান বন্ধ রাখতে হয় এবং ভারতের ৬ ডিভিশনকে ব্যস্ত রাখার জন্য দিনাজপুর-সৈয়দপুর এলাকায় আত্মরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করতে হয়।

ভারতের ৬ ডিভিশনকে পশ্চিম রণাঙ্গনে স্থানান্তর করার কথা ছিল। অভিন্ন পরিকল্পনার আওতায় যুদ্ধ না হলে লড়াই চালিয়ে যাবার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও আমাকে অস্ত্র সংবরণ করতে হতাে না। প্রথমে আঘাত হেনেও ভারতীয়। সৈন্যদের অগ্রযাত্রা রােধে আমাদের অক্ষমতার জন্য পশ্চিম রণাঙ্গনে আমরা পরাজিত হই।  জাতীয় ও সামরিক কৌশলের সঙ্গে গভীরভাব পরিচিত না হওয়ায় আমরা একথা আশা করতে পারি না যে, এ কমিশন একটি নির্ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে। লে. জেনারেল আফতাব একটি তদন্ত চালাচ্ছিলেন। তার সঙ্গে আমার দাদুবাদ হয়। আমি পশ্চিম রণাঙ্গনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা এবং পূর্ব পাকিস্তানের ওপর চাপ। কমাতে পশ্চিম রণাঙ্গনে পরিকল্পিত হামলা চালাতে টিক্কার ব্যর্থতার প্রতি তার দৃষ্টি। আকর্ষণ করা মাত্র তিনি উত্তেজিত হয়ে আমাকে বলেন, “পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে চিন্তা করবেন না। চলুন আমরা পূর্ব পাকিস্তানের বিষয়ে মনােযােগ দেই।” আমি কোনাে নিম্নপদস্থ কর্মকর্তা ছিলাম না। একজন লে. জেনারেল ও একটি রণাঙ্গনের কমান্ডার হিসেবে আমাকে কৌশলগত পর্যায়ে ভাবতে হয়েছে। তাই পশ্চিম রণাঙ্গনের তৎপরতা এড়িয়ে যেতে পারি নি। আমি আমার স্টাফকে একটি মানচিত্রে পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধের ছক আঁকতে নির্দেশ দেই। জেনারেল আফতাব ছিলেন। একজন সরল ধরনের মানুষ। তিনি রাষ্ট্রদূত হিসেবে লিবিয়ার যাবার টোপ। 

প্রত্যাখ্যান করতে পারেন নি। কর্নেল সাবির কোরেশী হামুদুর রহমান কমিশন ও আফতাব কমিটির মধ্যে একজন লিয়াজো অফিসার হিসেবে কাজ করছিলেন। তাকেও সৌদি আরবে সামরিক এ্যটাশে করে পাঠানাে হয়।  হামুদ-উর-রহমান কমিশনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সুপ্রীমকোর্টের প্রধান বিচারপতি হামুদ-উর-রহমান। এ কমিশনের অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন বিচারপতি আনােয়ারুল হক ও বিচারপতি তােফায়েল আলী আবদুল রেহমান। কর্নেল হাসান ছিলেন আইন উপদেষ্টা। যুদ্ধের পরিকল্পনা ও পরিচালনা সংক্রান্ত বিষয়ে আদালতকে সহায়তা করার জন্য সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে লে, জেনারেল (অব.) আলতাফ কাদিরকে নিযুক্ত করা হয়। এ ধরনের কমিশন গঠনে অনেকেই জ কুঞ্চিত করেছেন। এ ব্যাপারে এ, টি, চৌধুরী লিখেছেন , কমিশন গঠনেও অভিপ্রায় ধরা পড়েছে। এতে কোনাে সন্দেহ নেই যে, এ কমিশন গঠন করা হয়েছে এমন একজন। বিচারপতির নেতৃত্বে যার সততা সন্দেহের ঊর্ধ্বে। তবে তিনি ছিলেন সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের লােক। পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় তিনি অবশ্যই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। এছাড়া, কমিশনে কোনাে নিরপেক্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অথবা উঁচুমানের একজন সামরিক বিশেষজ্ঞকেও রাখা হয় নি। সব বাঙালিকে বাংলাদেশে পাঠানাের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। প্রধান বিচারপতি হামুদ-উর-রহমানকেও ফেরত পাঠানাের কথা ছিল। কিন্তু যেতে চান নি তিনি। এ দুর্বলতাকে একটি অনুকূল রিপাের্ট প্রণয়নে কাজে লাগানাে হয়। সাধারণত বিচারপতিগণ রাজনৈতিক দলের সংশ্রব থেকে দূরে থাকেন। কিন্তু ভুট্টো হামুদ-উররহমান কমিশনের সদস্যদের পিপিপিতে যােগদানের আমন্ত্রণ জানান। এতে তাদের ওপর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব পড়ে। বিচারপতি হামুদ-উর-রহমান একবার আমাকে জানিয়েছিলেন যে, প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো তাকে বলেছেন যে, ভুট্টো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কয়েক টন প্রমাণসহ শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে একটি অভিযােগ পেয়েছেন। বিচারপতি হামুদ-উর আমাকে আরো জানিয়েছিলেন যে, তার এক ছেলে মেজর।

কিন্তু তাকে বাংলাদেশে যাবার অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। হামুদ-উর-রহমানের ছেলেই একমাত্র বাঙালি যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে থেকে যায়।  কমিশনের দ্বিতীয় ব্যক্তি বিচারপতি আনােয়ার-উল-হক ছিলেন রাজনীতিতে নিরাসক্ত। তৃতীয় ব্যক্তি বিচারপতি তােফায়েল আলী আবদুল রহমান ছিলেন একজন খাটি বিচারক। তার আচরণ ছিল পক্ষপাতহীন এবং মর্যাদাপূর্ণ। চতুর্থ ব্যক্তি লে. জেনারেল (অব.) আলতাফ কাদির এ ধরনের একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দায়িত্ব পালনে মােটেও যােগ্য ছিলেন না। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে কখনাে কোনাে ফরমেশনের নেতৃত্ব দেন নি। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের ভূমি এবং সৈন্য চলাচল ও সামরিক অভিযানে ভূমির প্রভাব সম্পর্কেও জানতেন না। তিনি যুদ্ধে কখনাে সৈন্য পরিচালনা করেন নি। ১৯৬৫-এ ৭ ডিভশনের কমান্ডার ছিলেন তিনি। কিন্তু যুদ্ধ  আসন্ন হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তাকে কমান্ড থেকে অপসারণ করা হয়। তিনি এক অস্পষ্ট ধারণা নিয়ে কাজ করেছেন এবং তার সামরিক জ্ঞান ও পূর্ব পাকিস্তানে লড়াইয়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতার অভাব ছিল। জেনারেল কাদির অহেতুক প্রশ্ন করতেন এবং অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতেন। এতে কমিশন মাঝে মাঝে তার প্রতি বিরক্ত হতাে এবং বিচারপতি হামুদুর রহমানকে তার ভুল সংশােধনে এগিয়ে আসতে হতাে। বেসামরিক বিচারকদের সামরিক বিষয়াদিতে অভিজ্ঞতা বিশেষ করে অসামরিক জ্ঞান ও স্টাফ সিস্টেম, যুদ্ধের কৌশল ও পরিকল্পনা, স্থায়ী নির্দেশ, ড্রিল ও পদ্ধতি এবং নিয়ম-কানুন ইত্যাদি বিষয়ে কোনাে জ্ঞান ছিল না। হামুদ-উর-রহমান কমিশন বার বার আমাকে প্রশ্ন করছিল আমি কেন সৈন্যদের বার্মার দিকে নিয়ে যাই নি। এ প্রশ্নে প্রকাশ পেয়েছে তাদের সরলতা। লড়াই থেকে পিছু হটে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে হাজার হাজার সৈন্যের শত শত মাইল পাড়ি দেয়া সম্পর্কে তাদের ন্যূনতম ধারণা ছিল না। অনুগত লােকজনের পরিণতির কথাও মাথায় আসে নি তাদের। আমার মনে হয় তারা রিপাের্টে লিখেছেন যে, আমি সকল সৈন্য নিয়ে বার্মায় চলে যেতে পারতাম।

বার্মার পালিয়ে যাওয়া যদি যুক্তিযুক্ত হয় তাহলে নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত প্রস্তাব মেনে নেয়া ছিল তার চেয়েও যুক্তিযুক্ত। সম্ভবত কমিশন মেজর জেনারেল ফজল মুকিমের ‘অন প্রিসারভেশন অব কমান্ড’-এর ধারণায় প্রভাবিত হয়েছেন। এ ধারণা বলতে কী বােঝায় তা মুকিম নিজে এবং কমিশন উভয়েই কিছু বুঝতেন না। ভূ-রাজনীতি, সামরিক কৌশল এবং জাতীয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কমিশনের বিবেচ্য বিষয় ছিল না। একটি বিদেশি রাষ্ট্রে সৈন্য নিয়ে এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সমস্যা ও ঝুঁকি তারা বুঝতে চেষ্টা করতেন না। বার্মার দিকে সৈন্য পরিচালনার কোনাে কারণ তারা উল্লেখ করেন নি। আমি চমৎকারভাবে লড়াই করছিলাম এবং সংখ্যায় বিশাল একটি শত্রুকে তাদের লক্ষ্য অর্জনের সকল প্রচেষ্টা নস্যাৎ করে দিচ্ছিলাম। আমি কৌশলগত দিক থেকে ভারতীয়দের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় ছিলাম। | সামরিক উপদেষ্টার প্রশ্নগুলাে ছিল কেতাবী, শিশুসুলভ ও বাস্তবতাবিবর্জিত। ঘটনার বাস্তবতার সঙ্গে তার প্রশ্নের মিল ছিল না। এ পরিস্থিতিতে কমিশন চক্রান্ত ও পরিকল্পিত মিথ্যাচারের অতলে হারিয়ে যাওয়া সত্য উঘাটনে ব্যর্থ হয়। তিনজন বিচারপতি, একজন আইন ও আরেকজন সামরিক উপদেষ্টা নিয়ে এ কমিশন গঠিত হওয়া সত্ত্বেও মেজর জেনারেল কোরেশী, কর্নেল সাবির কোরেশী ও আরাে কয়েকজনের সমন্বয়ে গঠিত জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সের একটি টিমও তদন্তে অংশগ্রহণ করতাে। জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সের এ টিমের বাগাড়ম্বরপূর্ণ আচরণ ও উপর্যুপরি হস্তক্ষেপ শুধু উস্কানিমূলকই ছিল না, তারা এ কমিশনকে একটি বেআইনি তদন্ত আদালতেও পরিণত করেন। তারা ইচ্ছামতাে সাক্ষীদের জেরা করতেন। আমাদেরকে আত্মপক্ষ সমর্থন করার মৌলিক অধিকারও দেয়া হয় নি। তাদের সার্বক্ষণিক বিঘ্ন সৃষ্টি ছিল কমিশনের প্রতি একটি অমর্যাদা ও অসম্মান। তবু কমিশন বিনা আপত্তিতে তাদের বাড়াবাড়ি মেনে নিতেন। তারা আইন কর্মকর্তা অথবা কমিশনের সদস্য কোনােটাই ছিলেন না। তারা কোন্ ক্ষমতা বলে আমাদের জেরা করেছিলেন তা স্পষ্ট নয়। কমিশনের কাজে বাধা দানই জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সের একমাত্র অনিয়ম নয়। তারা সামরিক তৎপরতা তদন্তে লে. জেনারেল আফতাব কাদিরের নেতৃত্বে। আরেকটি সমান্তরাল কমিটিও গঠন করেছিল। এ কমিটি গঠন করা ছিল আদালত অবমাননার শামিল। কারণ হামুদ-উর-রহমান কমিশন তখন তদন্ত চালাচ্ছিল।

এ কমিটির মূল উদ্দেশ্য ছিল পূর্বাহ্নে অফিসারদের বিবৃতি তন্নতন্ন করে পরীক্ষা করা, তাদের মনের ভাব ও গতি ঠিক করে দেয়া এবং তাদেরকে গ্রুপে বাছাই করা। সাধারণত জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সের নীতির সঙ্গে যাদের মতের মিল হতে কেবলমাত্র তাদেরকে হামুদুর রহমান কমিশনে উপস্থিত হওয়ার অনুমতি দেয়া হতাে। আর যারা দ্বিমত পােষণ করতাে তাদেরকে ভয়-ভীতি প্রদর্শন এবং বক্তব্য পাল্টানাের জন্য প্রলােভন দেখানাে হতাে। এরপরও যারা নতিস্বীকার করে নি তাদেরকে যথাক্রমে সেনাবাহিনী থেকে বিদায় করা হয়। অফিসারদের মতামত পরিবর্তনে জেনারেল টিক্কা জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সে যা করছিলেন লাহােরে চতুর্থ কোর কমান্ডার লে. জেনারেল হামিদ কাজীও তাই করছিলেন। জেনারেল হামিদ লােকজনকে আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বলেন। ব্রিগেডিয়ার আসগর হাসান ও ব্রিগেডিয়ার কাদির আমাকে একথা জানিয়েছেন। জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স ও লাহােরের ঘটনাবলীর বিরুদ্ধে আমি টিক্কার কাছে প্রতিবাদ করি। কিন্তু কোনাে ফল হয় নি। টিক্কার নির্দেশ ও পৃষ্ঠপোষকতায় এসব অশুভ তৎপরতা চালানাে হচ্ছিল। তাই তার পক্ষে কাউকে শাস্তি দেয়া অথবা কাউকে ভৎসনা করা সম্ভব ছিল না। আমি আফতাব কমিটিতে হাজির হতে অস্বীকৃতি জানাই। তখন আমাকে কোর্ট মার্শালের ভয় দেখানাে হয়। তাই প্রতিবাদ সত্ত্বেও আমি এ কমিটিতে হাজির হই। লে. জেনারেল আফতাবের কাছে লেখা চিঠিতে আমি পরিষ্কার ভাষায় জানাই যে, বিষয়টি বিচারাধীন থাকায় আইন ভঙ্গের দায়-দায়িত্ব জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সের। | আমি একটি আইনগত রুলিং চাই। কিন্তু আমাকে এ রুলিং দেয়া হয়নি। আমি বুঝতে পারি যে, জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সে জেনারেল টিক্কা খানের অধীনের একটি বিশেষ সেল গঠন করা হয়েছে। এ সেলের দায়িত্ব ছিল সাক্ষ্য মূল্যায়ন করা এবং কমিশনের জন্য কৌশল নির্ধারণ করা। সাক্ষীদের যেসব প্রশ্ন জিজ্ঞেস হবে যেসব প্রশ্নের একটি তালিকা দেয়া হয় কর্নেল সাবির কোরেশীকে।

টিক্কা কর্নেল সাবিরকে ব্যক্তিগতভাবে ব্রিফ করতেন।  ফজল মুকিমের বই ছিল আদালত অবমাননার শামিল। এ ব্যাপারে প্রতিবাদ করা হলে প্রধান বিচারপতি হামুদুর নিরাসক্তভাবে বলেন, ‘আমার সময় নষ্ট করবেন না।’ বিচারকরা যেখানে ছিলেন তৈরি সেখানে সঙ্গত কারণেই ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা করা যায় না। ফজল মুকিমের বই পরােক্ষ এবং মনস্তাত্ত্বিকভাবে সাক্ষীদের প্রভাবিত করছিল এবং সরকারি লাইনে তাদেরকে চিন্তা করতে উৎসাহিত করছিল। এজন্য আমার আপত্তি প্রত্যাখ্যান করা হয়। | ইস্টার্ন গ্যারিসনের সৈন্যরা ভারতে যুদ্ধবন্দি শিবিরে আটক থাকাকালেই হামুদুর রহমান কমিশন কাজ করতে শুরু করে। এ কমিশনের তদন্ত শুধু পূর্ব রণাঙ্গনে যুদ্ধের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়। পূর্ব পাকিস্তান থেকে দুনীতি, অযােগ্যতা, অসন্তোষজনক যুদ্ধ তৎপরতা, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযােগের অভিযােগে যেসব অফিসারকে বরখাস্ত করা হয় সেসব অফিসারের জাবনবন্দিই কমিশন রেকর্ড করতে থাকে। তখনি এ কমিশনের উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়ে যায়। যেসব সৈন্য ও অফিসার বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে যুদ্ধবন্দি হয় তাদেরকে ওসব অযােগ্য অফিসারদের সামনে খাটো করার ঘৃণ্য মানসিকতা থেকেই এরূপ করা হচ্ছিল। হামুদুর রহমান কমিশন এসব অযােগ্য অফিসারের বিবৃতির ভিত্তিতেই এর তদন্ত চালাচ্ছিল।

আমার আপত্তির পর কমিশন একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে মেজর জেনারেল কোরেশীকে এ কার্যক্রমে যােগানের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। আমাদের চরিত্র ও সম্মানের প্রশ্ন জড়িত থাকা সত্ত্বেও সাক্ষীদের বক্তব্য শ্রবণ এবং তাদেরকে জেরা করার অনুমতি দেয়া হয় নি। কিন্তু দেশের কোন আইনের বলে কোরেশীকে কমিশনে বসার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। এছাড়া, এডিসি ও স্টেনােগ্রাফারদেরকে তাদের জেনারেলের অনুপস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট জেনারেলদের সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন করা হয়। এ থেকে আমি ও ধারণায় উপনীত হই যে, কমিশনের রিপাের্টে আমার প্রতি ন্যায়বিচার করা হবে না। দৈনিক ডন- এ ১৯৮৬ সালের ২৩ ও ২৬ জুলাই প্রকাশিত মরহুম এটি চৌধুরীর অনুন্ধানী রিপাের্ট একটি চক্ষু উন্মােচনকারী ঘটনা। সুতরাং এ ব্যাপারে আমি আমার নিজস্ব বক্তব্য পরিবেশন করার চেয়ে তার উক্তি উল্লেখ করাই শ্রেয় বলে মনে করি। দৈনিক ডন-এর সৌজন্যে পরিশিষ্ট ৫-এর তার এ অত্যন্ত মূল্যবান রিপাের্টগুলাে দেয়া হলাে। এখানে কিঞ্চিৎ উল্লেখ করছি : “এটা খুবই দুঃখজনক যে, কমিশন বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্রের ব্যবচ্ছেদ এবং সামরিক বিপর্যয়ের রাজনৈতিক পটভূমি সম্পর্কে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ও ইচ্ছায় নীরব সম্মতি দিয়েছে। যেসব দেশপ্রেমিক পুরনাে ছাইভস্মের ওপর নয়া পাকিস্তান সৃষ্টির চেষ্টা করেছিলেন তারা ইয়াহিয়ার বিচার করে নি। প্রশ্ন হচ্ছে, মূল খলনায়ককে কেন ছেড়ে দেয়া হলাে? এর কারণ হচ্ছে, তার বিচার করা হলে নির্লজ্জ নায়কদের চেহারা উন্মোচিত হতাে এবং প্যান্ডােরার বাক্স খুলে যেত। ভুট্টো হামুদ-উর রহমান কমিশনের রিপাের্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করার সাহস পান নি। কারণ যেসব রাজনৈতিক কারণ ও ভুলের জন্য দেশ ভেঙে গেছে তিনি সেগুলাের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। কমিশন ভুট্টোকে তুষ্ট করার মানসিকতা নিয়ে কাজ করা সত্ত্বেও এ রিপাের্ট পিপিপি সরকারের মন্ত্রিসভাকেও দেখতে দেয়া হয়নি।

মন্ত্রিসভার একটি সাব-কমিটিকে এক নজর এ রিপাের্ট দেখার অনুমতি দেয়া হয়। এ কমিটিতে যারা ছিলেন তারা হলেন, জে, এ. রহিম, খান আবদুল কাইউম খান (জোটের শরীক), হাফিজ পীরজাদা, জেনারেল টিক্কা খান, আজিজ আহমেদ, রফি রাজা ও গিয়াসউদ্দিন। এরা এ রিপাের্ট প্রকাশ না করার জন্য সুপারিশ করেছিলেন বলে জানা যায়। রিপাের্টের পক্ষপাতিত্ব খুবই স্পষ্ট। কমিশনে যেসব বিবৃতি রেকর্ড করা হয় রিপাের্টে সেগুলাে স্থান পায় নি। রিপাের্টের অর্ধেক হচ্ছে পুনরাবৃত্তি এবং বাকি অর্ধেক হচ্ছে ভাসা-ভাসা। কমিশন চরিত্র হনন করেছে। এটা পুরাে অথবা আংশিকভাবেও তদন্ত আদালতের রীতি-নীতি অনুসরণ করেনি।” সর্বাধুনিক সামরিক মতবাদ এবং যুদ্ধের পরিকল্পনা ও পরিচালনায় এগুলাের প্রয়ােগ সম্পর্কে কমিশনের ধারণা না থাকায় এ কমিশনের রিপাের্টের কতটুকু মূল্য আছে। আমাদের সর্বোচ্চ বিচার বিভাগ আইনগত সিদ্ধান্তের জন্য সকলের কাছে সমাদৃত। কিন্তু যেখানেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয় জড়িত ছিল সেখানেই তারা ভুল করেছেন। গােলাম মােহাম্মদ ও মৌলভী তমিজউদ্দিন খানের মামলায় প্রধান বিচারপতি মুনীরের সিদ্ধান্ত অথবা জেনারেল জিয়াউল হকের ল অব নেসেসিটি অথবা ইয়াহিয়ার পদত্যাগের পর ক্ষমতা দখলকারী হিসেবে তাকে ঘােষণা দানের ক্ষেত্রে আদালতের সিদ্ধান্তে ভুল হয়। হামুদুর রহমান কমিশন প্রচলিত দন্ত কমিশনের কোনাে রীতি-নীতি অনুসরণ করে নি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী আইনের উল্লেখিত ধারার আওতায় যেখানে কারাে চরিত্র হনন ও সুনামের প্রশ্ন জড়িত সেখানে বিবাদীকে সাক্ষীদের জেরা করার অনুমতি দান বাধ্যতামূলক। আমাদেরকে এ আইনগত অধিকার দেয়া হয় নি। ফলে কোনাে সাক্ষীকে জেরা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় নি।  শর্ত অনুযায়ী কমিশনের আত্মসমর্পণ ও অস্ত্র সংবরণের ঘটনা তদন্ত করার কথা ছিল। কিন্তু বিভিন্ন কাগজপত্র পরীক্ষা করতেই দু’দিন কেটে যায়। কমিশন আদালতে ঘােষণা করে যে,

১. প্রেসিডেন্ট ১৪ ডিসেম্বর অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ ইস্যু করেন।

২. ১৯৭১ এর ১৪ ডিসেম্বর ০৯১০ গ্রিনিচ সময়ে জে, নিয়াজি একটি পাল্টা

বার্তা পাঠিয়ে বলেন যে, যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্তে আমি এখনাে অটল রয়েছি।

৩.  সন্ধ্যায় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ অস্ত্র সমর্পণের জন্য তাগিদ দেন। তিনি নিয়াজির লড়াই চালিয়ে যাবার অনুরােধে সাড়া দেন নি। এরপর বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল রহিম খান টেলিফোনে একই তাগিদ দেন। তিনি নিয়াজির নির্দেশ পালনে এয়ার কমােডর ইনামুল হককে নির্দেশ দেন।

৪.  নিয়াজি ফরমানকে সঙ্গে নিয়ে মার্কিন কনস্যুলেটে যান এবং যুদ্ধবিরতির

আহ্বান জানিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধানের কাছে একটি বার্তা পাঠান। তিনি ভারতের কাছ থেকে যুদ্ধবিরতিতে সম্মতি জ্ঞানকারী একটি বার্তা পান। তবে তাতে আত্মসর্পণের দাবিও জানানাে হয়। জে, নিয়াজি ভারতের এ বার্তা হুবহু প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠান। রাতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়ে প্রেসিডেন্ট তার কাছে একটি বার্তা পাঠান। উপরেল্লিখিত ঘটনাগুলাের ধারাবাহিকতা বর্ণনা দিয়ে কমিশন ঘােষণা করে যে, তারা স্বীকার করছেন যে, প্রেসিডেন্টই আমাকে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। কার নির্দেশে এবং কিভাবে আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটেছে, সেটাই কমিশনের তদন্তের মূল বিষয়বস্তু ছিল। কমিশন যখন একথা বুঝতে পেরেছে এবং নিশ্চিত হয়েছে যে, প্রেসিডেন্টের নির্দেশেই আমি আত্মসমর্পণ করেছি, তখন আমার বিরুদ্ধে আর কোনাে অভিযােগ থাকে না। কমিশনের একথাও ঘােষণা করা উচিত ছিল যে, পােলিশ প্রস্তাব গ্রহণ করা হলে দেশকে এ অপমান থেকে রক্ষা করা যেত। এবং ভুটোই হচ্ছেন এ বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। কমিশনের রিপাের্টে কী রয়েছে তা আমরা জানি না। তবে দৃশ্যত মনে হচ্ছে এতে হয়তাে ভুট্টোকে দোষারােপ করে কিছু লেখা হয়েছে, নয়তাে সুপারিশগুলাে বদলে ফেলা হয়েছে অথবা আমাকে অব্যাহতি দিতে বলা হয়েছে।

বিভিন্ন ঘটনা থেকে বােঝা যাচ্ছে যে, হয়তাে রিপাের্টের সুপারিশগুলাে পরিবর্তন করা হয়েছে নয়তাে সুপারিশের বিপরীত কাজ করা হয়েছে। পরে এক বিয়ে অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি হামুদুর রহমানের সঙ্গে আমার চিফ অভ স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বাকির সিদ্দিকীর সাক্ষাৎ হয়। বিচারপতি হামুদুর জানতে চান ব্রিগেডিয়ার বাকির তখন কোথায় আছেন। জবাবে বাকির জানালেন যে, তিনি আর সেনাবাহিনীতে নেই এবং তার রিপাের্টের জন্যই এ পরিণতি হয়েছে। বিচারপতি হামুদুর জানালেন যে, কমিশন তার বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে নি। বরং পূর্ব পাকিস্তানে এক অসম্ভব যুদ্ধে তার ভূমিকার প্রশংসা করা হয়েছে। এ ঘটনা থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, মূল রিপাের্ট গায়েব করে ফেলা হয়েছে। আমি যতদূর জানি জনগণকে শান্ত এবং তৎকালের ক্ষমতাসীনদের অপকর্ম চাপা দেয়ার জন্য ভুঠো এ কমিশন গঠন করেছিলেন। এ কারণে জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সের ডেপুটি জাজ অ্যাডভােকেট-জেনারেল এ রিপাের্টকে ‘দুর্বল’ বলে অভিহিত করেছিলেন। আমার দৃষ্টিতে এটা হচ্ছে একটি অবৈধ তদন্ত। আমরা ছিলাম পাকিস্তান সেনাবাহিনী আইনের আওতায় এবং এ আইনে বর্ণিত সুযােগসুবিধা আমাদের প্রাপ্য ছিল। আমরা কোনাে অপরাধ করি নি এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী আইনের রীতি-নীতি অনুসরণ করা উচিত ছিল। হামুদুর রহমান কমিশনের একটি বেসামরিক আদালতের নিয়ম-পদ্ধতি মানা উচিত ছিল। বেসামরিক আদালতে সাক্ষীকে বিবাদীর জেরা করার সুযােগ থাকে আমাদেরকে এ ধরনের সুযােগ থেকে বঞ্চিত করায় সাংবাদিক এ. টি. চৌধুরী যে মন্তব্য করেছেন তাই সঠিক বলে প্রমাণিত হচ্ছে। কমিশন এসব রীতি-নীতি অনুসরণ না করায় তাদের সিদ্ধান্ত অকার্যকর ও অবৈধ  শােনা যায় যে, হামুদুর রহমান কমিশনের চেয়ে আরাে শক্তিশালী একটি কর্তৃপক্ষ এ কমিশনের রিপাের্ট পরিবর্তন ও সংশােধন করেছে। রিপাের্টের ১৮টি পৃষ্ঠায় ভুঠোর কার্যকলাপের বর্ণনা ছিল। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন তিনি। এরপর তিনি সকল কপি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেন এবং তার কার্যকলাপের বিবরণ সম্বলিত পাতাগুলাে সরিয়ে সেখানে নতুন পাতা সংযােজন করা হয়। রেজিস্ট্রারকে তলব করে সংযােজিত পাতাগুলাে সত্যায়িত করার নির্দেশ দেয়া হয়। রেজিস্ট্রার অস্বীকৃতি জানালে ভুট্টো তাকে একটি কক্ষে আটক করেন। তাকে সেখানে দানা-পানি ছাড়া রাখা হয়। প্রধান বিচারপতি হামুদুর রহমানের সরাসরি হস্তেক্ষেপে রেজিস্ট্রার মুক্তি পায়। বিচারপতি হামুদুর রহমান হাবিবুর রহমানের কাছে এ ঘটনা প্রকাশ করেছেন। 

মজার ব্যাপার হচ্ছে যে, রিপাের্ট উপস্থাপনের পর ভুট্টো বিচারপতিদের তাদের ব্যক্তিগত মন্তব্য হস্তান্তর করতে বলেন। বিচারপতিগণ পরস্পর পরামর্শ করেন এবং বিচারপতি তােফায়েল সকল মন্তব্য ও রেকর্ড হস্তান্তরের পক্ষে মতামত দিয়ে বলেন। যে, অন্যথায় তারা অফিসিয়াল সিক্রেট আইনে অভিযুক্ত হবেন।তার এ মন্তব্যের পর তারা তাদের কাছে রক্ষিত রেকর্ডপত্র ও মন্তব্যগুলাে হস্তান্তর করেন। গােয়েন্দারা (এফএসএফ) কমিশনের অফিসে তল্লাশি চালায় এবং কমিশনের স্টাফ ও অন্যান্যদের বাসা থেকে প্রয়ােজনীয় কাগজপত্র ছিনিয়ে নিয়ে আসে। এ থেকে বােঝা যাচ্ছে যে, বিচারপতিরাও ভুট্টোর হয়রানির ভয়ে তটস্থ ছিলেন।  হামুদ-উর-রহমান কমিশনের রিপাের্ট হিসেবে যা প্রকাশিত হয়েছে তা হচ্ছে কায়েমী স্বার্থবাদীদের মস্তিষ্ক প্রসূত ফসল। প্রকৃতপক্ষে, মূল কপিগুলাে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। মাত্র একটি সংশােধিত কপি রক্ষা পেয়েছে। তবে কেউ এ কপির সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত নয়। সুতরাং একথা নির্ধিধায় বলা যায় যে, হামুদ-উররহমান কমিশনের কোনাে রিপাের্ট আর অবশিষ্ট নেই। কোনাে কপিতে হয়তাে এ কমিশনের নাম থাকতে পারে। কিন্তু বিষয়বস্তু হবে সম্পূর্ণ বিকৃত। সংশােধিত তথাকথিত রিপাের্টটি প্রকশিত হলেও ক্ষমতাসীনদের বহু দুষ্কর্ম প্রকাশিত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। খান আবদুল ওয়ালি খান এক উর্দু দৈনিকে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, ‘হামুদ-উর-রহমান কমিশনের রিপাের্টে যথেষ্ট ফাকফোকর রয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে, সকল পক্ষকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।

আমি আমার সাক্ষ্যে বলেছিলাম যে, রাজনীতিকরা সংকট সমাধানে ব্যর্থ হওয়ায় সেনাবাহিনী ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য হয়। আমি বিচারপতি হামুদুর রহমানকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিলাম যে, ভুট্টো ও ইয়াহিয়ার ঘৃণ্য ভূমিকায় পাকিস্তান ভেঙে গেছে। আমার বিবৃতি টাইপ করা কপি দেখে আমি বিস্মিত হই। আমি দেখতে পাই যে, আমার বিবৃতি পাল্টে ফেলা হয়েছে। আমি আবার খসড়া সংশােধন করি এবং পুনরায় টাইপ করে পাঠিয়ে দেই। সংশােধিত খসড়ার একটি ফটোকপি এখনাে আমার কাছে রয়েছে। নতুন কমিশন হামুদ-উর-রহমান কমিশনের রিপাের্ট ছিল একটি অতি গােপনীয় দলিল। ঐ তথাকথিত রিপাের্টের কিছু কিছু নির্বাচিত অংশ পাকিস্তান ও বিদেশে প্রকাশিত হয়েছে। যেটুকু প্রকাশ করা হয়েছে সেটুকু ছিল স্বার্থবাদীদের অনুকূলে। এ পর্যন্ত যা প্রকাশ করা হয়েছে তাতে একথা স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, এ রিপাের্ট প্রকাশ করার প্রয়াস যতটুকু, গােপন করার প্রয়াস তার চেয়েও বেশি। আমি নিশ্চিত যে, কমিশনের রিপাের্টের নির্বাচিত অংশ হিসেবে যা প্রকাশ করা হয়েছে তা মূল রিপাের্ট থেকে নয়। মূলকপি গায়েব করে নতুন কপি তৈরি করা হয়।  পরিবর্তন এত বেশি করা হয়েছে যে, এটি এর বিশ্বাসযােগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে। প্রখ্যাত সাংবাদিক এমভি নকৰী ১৯৮৬ সালে দৈনিক ডন-এ লিখেছেন :  “সিনিয়র সেনা কর্মকর্তা, রাজনীতিক ও প্রবীণ বিচারপতিদের সমন্বয়ে সর্বজন। গ্রহণযােগ্য একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে সত্য উঘাটন এবং দোষীদের শাস্তি দান করা অপরিহার্য। সমগ্র পাকিস্তান এবং আলাদাভাবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে সশস্ত্র বাহিনীর তৎপরতা মূল্যায়নে হামুদ-উর-রহমান কমিশনের টার্মস অব রেফারেন্সে বিরাজমান রাজনেতিক ও সামরিক পরিস্থিতিকে বিবেচনায় রেখে একটি কম্পিউটার মডের সংযােজনের জন্য আমি সুপারিশ করেছিলাম। কিন্তু কমিশন আমার সুপারিশে কর্ণপাত করে নি। আধুনিককালে কর্মতৎপরতা যাচাইয়ে কম্পিউটার মডেলই হচ্ছে উত্তম পদ্ধতি। আমার এ পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করা হলে আমাকে ও আমার অধীনস্থ অন্যান্য জেনারেলকে দেশের সবচেয়ে সফল জেনারেল হিসেবে দেখানাে ছাড়া উপায় ছিল না। 

 

সূত্র : দ্য বিট্রেয়াল অভ ইস্ট পাকিস্তান – লে. জে. এ. এ. কে. নিয়াজি (অনুবাদ)