জয় বাংলা ২০ আগস্ট ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা
মূল পত্রিকা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
জয় বাংলা
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপত্র
মুজিবনগরঃ প্রথম বর্ষ, ১৫শ সংখ্যা শুক্রবার, ৩রা ভাদ্র, ১৩৭৮ ২০শে আগস্ট ৭১ঃ
হাশমি হুংকার ছাড়লেন বিবৃতিতে সই করবে কিনা
কক্ষের চারদিকে উদ্যত সঙ্গীন
বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে মামলা সাজানো হচ্ছে
(জয়বাংলা প্রতিনিধি)
আমার টেবিলের সামনে ইংরেজিতে টাইপ করার কয়েক পৃষ্ঠা কাগজ রাখল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সদ্য আমদানি করা প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট ই এ হাশমি। বললঃ পড়ে দেখো। এটা হবে তোমার সজ্ঞানে, স্বেচ্ছায় এবং নির্ভয়ে প্রদত্ত বিবৃতি।
“পড়লাম। নিয়ম রক্ষার জন্য হাসমির জিজ্ঞেস করল ঃ কোন বক্তব্য আছে? বললামঃ এখানে যা লেখা রয়েছে তার কিছুই তো আমি জানিনা।
“ক্রুর হয়ে উঠল হাসমির এতক্ষণের বিনয়ের মুখোশ পরা হাসি হাসিমুখ। আমার সামনের চেয়ারের উপরে একটা পা তুলে দিয়ে হিংস্র হায়েনার বিষাক্ত হাসির তীর ছুড়ে গর্জন করে উঠল ঃ এ বিবৃতি স্বাক্ষর করবে কিনা বল? এক্ষুনি জবাব চাই।
“আমার চারদিক যেন হঠাৎ অন্ধকার হয়ে এলো। মুক্ত বাতাসের জন্য প্রাণ আঁকুপাঁকু করে উঠলো। ঢাকার এগার নম্বর রোডের এই কক্ষ টির নৈঃশব্দ্য ক্রুরতায় ভয়ঙ্কর। মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই নিস্তব্ধ কক্ষের ওপারেই ঘাতকবাহিনী সঙ্গিন উঁচিয়ে অপেক্ষা করছে। আমার সমস্ত অণু-পরমাণু চিৎকার করে উঠলঃ না, না। কিন্তু মুখ দিয়ে সেই ‘না’ উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে এই আমি একটি নিষ্প্রাণ শবদেহে পরিণত হব। তারপর তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার পরিবারবর্গের উপরে। না বলার বেয়াদবি তারা যে সহ্য করবে না অন্যান্য সাক্ষীদের উপলব্ধির জন্য তা তারা দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরবে।
ঘাতকের কারাগার
” সিদ্ধান্ত নিলাম পালাবো এই অবরুদ্ধ এলাকার এই নৃশংস কারাগার ও বধ্যভূমি থেকে। সিদ্ধান্ত নিলাম অভিনয়ের আশ্রয় নিতে হবে। মুখের রেখায় এতোটুকু পরিবর্তন আর কুঞ্চন দেখা দিলে চলবে না।
“বললামঃ নিশ্চয় সই করবো। জানা ঘটনা তো নয়, জেরার সময় যদি গুলিয়ে ফেলি সেই জন্যেই কথাটা বলেছি।
জেরা! হুঃ!
“হাশমি আবার পা নামিয়ে বসলো। চেহারায় আবার আঁটলো সে বিনয়ের ভদ্রতার মুখোশ। একটা ক্রুর তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললঃ জেরা! হুঃ!
“কিছুই আর অস্পষ্ট রইলোনা। অস্পষ্ট রইল না -গোপনে সবার চোখের অন্তরালে বিদেশি কৌসুলীর সহায়তা অধিকার হরণ এর অর্থ।”
সম্প্রতি ঢাকা থেকে মুক্ত এলাকায় আগত বাংলাদেশের জনৈক বিশিষ্ট সাংবাদিক জয় বাংলার নিজস্ব প্রতিনিধির কাছে উপযুক্ত তথ্য প্রকাশ করেন। আত্মীয়-স্বজনের নিরাপত্তার জন্য তিনি নিজের নাম প্রকাশ করতে সমর্থ হন নি। তখন তার চোখে-মুখে অবরুদ্ধ এলাকার বিভীষিকা আর পশ্চিম পাকিস্তানি পাঞ্জাবি সামরিক চক্রের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা আর ক্রোধ পরিস্ফুট।
১১ নং বেইলিরোডঃ সাক্ষ্য প্রমাণ তৈরীর কারখানা
তিনি আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধিকে জানান যে, একটা বেআইনি ও সাজান বিচার প্রহসন করে পশ্চিম পাকিস্তানের বর্ব্বর জঙ্গী সরকার সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মুক্তিমন্ত্রের ‘উদ্গাতা’, জাতীয় চেতনার দীক্ষাগুরু ও মুক্তিসংগ্রামের অগ্রনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সংগ্রামী জাতীয় সংগঠন আওয়ামী লীগের উপরে বাংলাদেশের নারকীয় গণহত্যা ও নৃশংস অত্যাচার এর দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়ার এবং বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে জাল নথিপত্র, সাক্ষ্য-প্রমাণ, সাজানো ছবি তৈরি করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর ব্যাজ ও টুপির অনুকরণে তৈরি করে রাজাকার ও দালালদের সেই ব্যাজ ও টুপি পরিয়ে তাদের দিয়ে হত্যা, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ করিয়ে ছবি তুলে নেওয়া হচ্ছে।
ঢাকার ১১নং বেইলি রোডে জাল নথিপত্র, সাক্ষ্যপ্রমাণ ও ফটোগ্রাফ তৈরীর কারখানা স্থাপিত হয়েছে। কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক ও সিভিলিয়ান অফিসারের উপর এই কারখানার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মতো এই মামলা ও যাতে ফেঁসে না যায় আর তার চেয়েও যাতে অনেক বেশি চাঞ্চল্য ও চমক সৃষ্টি করতে পারে সেজন্য জল্লাদ বাহিনীর পশুশক্তির সাহায্যে সবরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। সাক্ষ্য প্রমাণের ক্ষেত্রে একটা রেস্পেক্টিবিলিটি আনার জন্য শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, অধ্যাপক, শিক্ষক, ব্যবসা জীবী, সরকারি অফিসার প্রভৃতিকে সাক্ষী হতে বাধ্য করা হচ্ছে। তাদের সম্মুখে একটা টাইপ করা বিবৃতি ফেলে দিয়ে সই করিয়ে নেয়া হচ্ছে। সই করতে অধিকৃত জানাবার পরিণতি একটাই-অবধারিত মৃত্যু- সপরিবারে নিধন।
আইনের পরিহাস
বিবৃতির উপরে লেখা থাকে তথাকথিত বিবৃতি দানকারীর নাম এবং তাতে লেখা হয় যে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট মি ঃ ইয়ে হাশমি নিজে পাকিস্তান ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১৬৪ ধারামতে বিবৃতিদানকারী নিজের ভাষায় লিপিবদ্ধ করেছেন।
এই ভাবে তৈরি হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে বিচার প্রহসনের উপকরণ।
আরো একজন
হংকং স্থিত পাকিস্তানের অস্থায়ী বাণিজ্য কমিশনার জনাব মহিউদ্দিন আহমেদ পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশে গণহত্যা ঘটেছে
নির্বাচনে জয়লাভেই শেখ মুজিবের একমাত্র অপরাধ
-সিনেটর কেনেডি
নয়াদিল্লি, ১৬ই আগস্ট -শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার আন্তর্জাতিক আইনের দিক থেকে বিচারের ব্যভিচার। ভারত সফররত মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি সাংবাদিক সম্মেলনে উপরোক্ত মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, আমার মনে হয় শেখ মুজিবের একমাত্র অপরাধ তিনি নির্বাচনে জয়লাভ করেছিলেন।
বাংলাদেশের গণহত্যার ঘটনা স্বীকার করে তিনি বলেন, পূর্ববঙ্গে গণহত্যা ঘটেছে। তিনি পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর আত্মসমর্পণের ব্যাপারে কোনোরূপ মন্তব্য করেননি।
বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব বলে তিনি মনে করেন এবং আশা প্রকাশ করেন যে, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছানো যেতে পারে।
বঙ্গবন্ধু আত্মপক্ষ সমর্থনে রাজি নন
করাচি ১৬ই আগস্ট-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আত্মপক্ষ সমর্থনে সম্মতি জ্ঞাপন করায় গোপন সামরিক বিচার মুলতবি হতে পারে। গোপন সূত্রের বরাত দিয়ে এএফপি উপরোক্ত সংবাদ পরিবেশন করে।
বঙ্গবন্ধুর পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক যান তাকে জানিয়ে দিয়েছেন যে তিনি কোন অপরাধেই করেননি। জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে নেবার জন্য এবং শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য তিনি এবং তার দল আইনসম্মতভাবে রাজনৈতিক আন্দোলন করেছিলেন।
জল্লাদ ইয়াহিয়াকে ঠেকাও
বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্নেল এম এ জি ওসমানী বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি পিয়াসি জনগণের আশা-আকাঙ্খার প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের নামে যে প্রহসন চালানো হচ্ছে তা বন্ধ করার ব্যাপারে জল্লাদ ইয়াহিয়া সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য বিশ্ব বিবেকের কাছে আবেদন জানিয়েছেন।
মুক্তিবাহিনীর জনসংযোগ শাখার মুজিবনগর থেকে প্রচারিত এই আবেদনে সর্বাধিনায়ক ওসমানী বলেছেন ঃ আমাদের জাতীয় নেতাকে হত্যা করা বন্ধ করুন। মানবীয় মূল্যবোধের অবলুপ্তি হইতে দেবেন না।
টিক্কার স্বীকারোক্তি
দখলীকৃত ঢাকায় বেতারের খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় ইয়াহিয়া খানের সিপাহ্সালার টিক্কা খান সম্প্রতি রংপুর সফরে গিয়েছিলেন। সেখানে সশস্ত্র পাহারার মধ্যে স্থানীয় মুসলিম লীগ ও জামাত ইসলামের দালাল দের নিয়ে এক সভা করেছে এবং বলেছে, “দখলীকৃত এলাকায় যারা বৈদ্যুতিক তার কেটে দিচ্ছে” যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে তারা জনগণের মিত্র নয়।”
জনগণের মিত্র কারা তা নিয়ে টিক্কার মত নরঘাতকদের সঙ্গে বিতর্কে প্রবৃত্ত হওয়ার ইচ্ছা আমাদের নেই। তবু রংপুরে প্রদত্ত টীক্কার এই বক্তৃতাকে আমরা উদ্ধৃতি করছি এজন্যেই যে, টিক্কা স্বীকার করে নিয়েছে বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসেনি। এটা টীক্কার স্বীকারোক্তি।
অথচ দু’দিন আগেও শুধু টীক্কা নয়, ইসলামাবাদে বসে ইয়াহিয়া খাঁ গোঁফে তা দিয়ে বলেছে, ‘বাংলাদেশে দখলকৃত এলাকার অবস্থা এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে।’ স্বাভাবিক অবস্থার বড়াই চলছে, সেই ২৬শে মার্চ থেকেই। তারপর গত চার মাসে এক কোটি লোক দেশ ছেড়েছে, দশ লাখ নর নারী নিহত হয়েছে, দখলীকৃত এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা আবার চালু করার জন্য ইয়াহিয়াকে আমেরিকার কাছে হাত পাততে হয়েছে, এমনকি শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে আনার নামে তথাকথিত অভ্যর্থনা শিবির খুলতে হয়েছে এবং দখলীকৃত এলাকায় জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক বসাতে রাজি হতে হয়েছে, এবং এতসবের পরেও স্বাভাবিক অবস্থার বড়াই করা থামেনি। স্বাভাবিক অবস্থায় বড়াই শুধু ইয়াহিয়া টিক্কার মত বেহায়াদের পক্ষে সম্ভব। কিন্তু এই স্বাভাবিক অবস্থাও যে হয়েছে কতটা স্বাভাবিক এখন টিক্কার স্বীকারোক্তিতেই জানা গেল। মার্চ মাসে ৪৮ ঘণ্টার ক্রাশ বেঙ্গলি প্রোগ্রাম গ্রহণ করেছিল টীক্কা। ইয়াহিয়াকে আশ্বাস দিয়ে বলেছিল, ৪৮ থেকে ৭২ ঘন্টার মধ্যে সব কুছ্ ঠিক হো জায়েগা। তারপর ৭২ ঘণ্টার জায়গায় চার মাস কেটে গেছে কিছুই ঠিক হয়নি। যশোর সফরে গিয়ে তাকে হেলিকপ্টার যোগে পালাতে হয়েছে। গত চার মাসের মধ্যে বহুবার তারিখ ঘোষণা করে ইয়াহিয়া একবারও ঢাকা আসতে পারেনি। এদিকে অধিকৃত এলাকার মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ইউনিটের লোকদের ধরিয়ে দেয়ার জন্য টিক্কা মোটা টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে। সুতরাং অবস্থা যে কতটা স্বাভাবিক তাতো বিশ্ববাসী স্পষ্টই বুঝতে পারছে।
রংপুরে দালালদের সভায় টিক্কা বলেছে, ‘দখলীকৃত এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ও যোগাযোগব্যবস্থা যারা ধ্বংস করেছে তারা জনগণের মিত্র নয়।’ আমাদের প্রশ্ন, তাহলে মিত্র কারা? টিক্কার হানাদার বাহিনী? যারা এই যোগাযোগ ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে বিনা বাধায় গ্রামে ঢুকে নিরীহ নর-নারীকে খুন করছে, নারীর সতীত্ব হরণ করছে এবং বাজার দোকানপাট জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে, তারা? মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ইউনিট জনগণের ক্ষতি করার জন্য নয়, হানাদারের বাধা প্রদান এবং উৎসাদনের জন্য যেখানে প্রয়োজন, মাত্র সেখানেই গেরিলা পদ্ধতিতে কাজ করছে। দেশের স্বাধীনতার জন্য জার্মানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সময়ও একই পদ্ধতিতে কাজ করতে হয়েছে। চীনের মাও সেতুং এর গেরিলা ইউনিট ও অনুরূপ ভাবে কাজ করেছেন এবং আজ ভিয়েতনামে দেশপ্রেমিক গেরিলা বাহিনীও এই একই কাজ করছেন। একদিকে তারা দখলীকৃত এলাকায় অত্যাচারী হানাদারের পরাজিত করার জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা, সেতু, রেলপথ উড়িয়ে দিচ্ছেন, অন্যদিকে মুক্ত এলাকায় এই যোগাযোগ ব্যবস্থায় তারা দ্রুত গড়ে তুলছেন। তাদের এই কাজে জনগণই সহযোগী। কারণ, জনগণ জানে, তাদের ক্ষতি করার জন্য এই ধ্বংস কার্য নয়। বরং তাদের স্বাধীনতা, সুখ ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য দেশপ্রেমিক গেরিলাদের এই মহান তৎপরতা। বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকা আজ যা প্রয়োজনে ধ্বংস হচ্ছে, কাল স্বাধীনতার নতুন প্রভাতে তা পূর্ণোদ্যমে গড়ে তোলা হবে। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর দেশপ্রমিক গেরিলারা নিজের স্বজাতি, জনগণের ক্ষতি করার জন্য জীবন উৎসর্গ করে নি। তারা জীবন উৎস্বর্গ করেছে, এই জনগণের শত্রু বর্বর অত্যাচারী দস্যু টীক্কা খাঁদের বাংলার মাটি থেকে সমূলে উৎখাত করার জন্য।
উথান্টের তৎপরতা
জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্ট আবার সক্রিয় ও কর্মতৎপর হয়েছেন বলে প্রকাশ। বাংলাদেশের মুজিবুর রহমানের বিচার প্রশাসনের তারিখ ঘোষিত হওয়ার পর তার প্রাণ রক্ষা সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী যে উদ্বেগ ও আশঙ্কা দেখা দেয়, তাতে উ থান্ট নিজেও নাকি বিচলিত না হয়ে পারেনি। খবরে প্রকাশ, শেখ সাহেবের প্রাণ রক্ষার উপায় উদ্ভাবন সম্পর্কে তিনি বিভিন্ন মহলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছেন।
সেক্রেটারি জেনারেলের এই বহু বিলম্বিত প্রচেষ্টার ফল কী দাঁড়াবে, তা আমরা জানিনা। সত্তুর দশকের গোড়ায় আজ জাতিসংঘের নাকের ডগায় যে মর্মন্তুদ নাটকের অভিনয় চলছে, ষাট দশকের গোড়াতেই একই মর্ম বিদারক নাটকের শেষ যবনিকাপাত হয়েছে বিশ্ব ইতিহাসের এক নিদারুন ট্রাজেডির মধ্য দিয়ে। সদ্যস্বাধীন বিপুল ভোটে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মিঃ প্যাট্রিস লুমুম্বা তার দেশকে সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের ক্রীড়ানক কাসাবুভু-মবুতুশোম্বে চক্রের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করার জন্য সেদিন জাতিসংঘের প্রতি আকুল আবেদন জানিয়েছিলেন। জাতিসংঘ তার আবেদনে সাড়া দিয়ে কঙ্গোতে পর্যবেক্ষণ বাহিনী ও পাঠিয়েছিল। আর সেই পর্যবেক্ষক বাহিনীর চোখের সামনে কঙ্গোর জাতীয় নেতা লুমুম্বাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। জাতিসংঘ ছিল এই পৈশাচিক হত্যাকান্ডের নিরব ও নির্বাক দর্শক।
ষাট দশকের গোড়ায় কঙ্গোয় জাতিসংঘ যে ভূমিকা গ্রহণ করেছিল, লজ্জা ও দুর্ভাগ্যের কথা একজন এশীয় সেক্রেটারি জেনারেল এর নেতৃত্বে বাংলাদেশে জাতিসংঘ ঠিক একই ভূমিকা গ্রহণ করতে চাচ্ছে। ইতিমধ্যেই উথান্ট সাহেব শরণার্থীদের গৃহ প্রত্যাবর্তন নিরাপদ করার নামে বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক বাহিনী মোতায়েনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। লুমুম্বা হত্যার নীরব দর্শকের ভূমিকা গ্রহণের মতোই যে এই জাতিসংঘ বাহিনীর ভূমিকা হতো এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নস্যাৎ করার সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের চাল হিসেবে ব্যবহৃত হতো, তাতে কোন সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার তবে পর্যবেক্ষক মোতায়েনের নামের নতুন চক্রান্ত এর তীব্র প্রতিবাদ করেছেন একেবারে শুরুতেই।
অবশ্য বিশ্বের বিভিন্ন জটিল সমস্যায় জাতিসংঘের এই ধরনের অকেজো ও নঙর্থক ভূমিকার জন্য কেবল উথান্ট একা দায়ী নয়। এজন্য মুখ্যত দায়ী আমেরিকার রিপাবলিকান সরকারের ভূমিকা। আমাদের দুর্ভাগ্য, ষাট দশকের গোড়ায় কঙ্গো সমস্যার সময় আমেরিকায় যে রিপাবলিকান সরকার ক্ষমতাসীন ছিল আজ বাংলাদেশের ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের সময় সেই একই বিবেকহীন ও মানবতাবোধ শূন্য পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ক্ষমতাসীন। তবু সেদিন যিনি রিপাবলিকান সরকারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তার সঙ্গে আজকের রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টের চরিত্রগত ও ব্যক্তিত্বগত পার্থক্য আকাশ পাতাল। পূর্বোক্ত রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইজেনহাওয়ার তার ব্যক্তিত্ব ও দূরদর্শিতা বলে কোরিয়ায় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করেছিলেন; আর তারই অদূরদর্শী উত্তরসূরি নিক্সন কম্বোডিয়ায় নতুন করে মার্কিন জাতিকে যুদ্ধে লিপ্ত করেছেন এবং বাংলাদেশের যুদ্ধ সম্প্রসারণের চক্রান্তে মেতে উঠেছেন। ইয়াহিয়ার মত একটি বর্বর খুনিচক্রকে ক্রমাগত মারণাস্ত্র সরবরাহ দ্বারা নিক্সন সরকার শুধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সাড়ে সাত কোটি নির্যাতিত মানুষের সহানুভূতি হারায়নি, গোটা এশিয়ায় গণতন্ত্রের দেশগুলোর কাছে আমেরিকাকে অনির্ভরযোগ্য ও অবিশ্বস্ত বন্ধুরূপে তুলে ধরেছেন। নিক্সনের অদূরদর্শী নীতির দরুন গণতন্ত্রী দেশ ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ। আইজেনহাওয়ারের শাসনামলে ডালেস-নীতির দরুন আমেরিকা সারাবিশ্বে বন্ধুহীন নিঃসঙ্গ জাতিতে পরিণত হতে চলেছিল। আজ ডালেসের চাইতেও অদূরদর্শী নীতি অনুসরণ দ্বারা প্রেসিডেন্ট নিক্সন আমেরিকাকে শুধু বন্ধুহীন রাষ্ট্রে পরিণত করতে চলেননি তিনি গণতন্ত্র রক্ষার কাজে আমেরিকা যে নির্ভরযোগ্য মিত্র নয়, গণতান্ত্রিক দেশগুলোর কাছে তাও সুস্পষ্ট করে তুলেছেন। সর্বোপরি জাতিসংঘকে হাতের পুতুলে পরিণত করে একে লীগ অব নেশনস এর পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছেন।
তবু এতো অন্ধকারের মধ্যেও আশার আলো যে একেবারে নেই, তা বলবো না। ষাট দশকের আমেরিকায় রিপাবলিকান অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের অদূরদর্শী নীতির বিরুদ্ধে মার্কিন জাতির কণ্ঠ এতটা সরব ছিল না, আজ যতটা সরব। স্বীয় ভিয়েতনাম নীতির দরুন নিক্সন এর পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট জনসনকে প্রেসিডেন্ট পদে পুনঃপ্রতিদ্বন্দ্বিতার সংকল্প ত্যাগ করে রাজনীতির মঞ্চে থেকে সরে যেতে হয়েছিল। বাংলাদেশে গণহত্যা অব্যাহত রাখার কাজে সমর্থন যুগিয়ে প্রেসিডেন্ট নিক্সন কেও যদি আগামী নির্বাচনে মার্কিন জাতির কাছে প্রত্যাখ্যাত প্রেসিডেন্ট হিসেবে গণ্য হতে আমরা দেখতে পাই, তাহলে বিস্মিত হবো না। উ থান্ট সাহেব তো ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছেন, তিনি আর পরবর্তী মেয়াদের জন্য জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল থাকতে চান না। সম্ভবত তিনি বুঝতে পেরেছেন, বিশ্ব সমস্যার সমাধানে জাতিসংঘের আজ যেমন আর কোনো কার্যকরী ভূমিকা নেই, তেমনি এই ভূমিকা গ্রহণে তারও কোনো নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নেই।
তবুও আমরা আশা করব, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নেতা শেখ মুজিবের প্রাণ রক্ষার চেষ্টায় উথান্ট যেন তার কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় সফল হন। কারণ তিনি জাতিসংঘের এশীয় সেক্রেটারি জেনারেল। তার ব্যর্থতা যে এশিয়ার ব্যর্থতা, এই সামান্য সত্যটি উপলব্ধি করে মুরুব্বীদের চাপ এড়িয়ে তিনি যেন একটু সাহসী ভূমিকা গ্রহণে সক্ষম হোন।
মুক্তিবাহিনী শত্রুর উপর মরণছোবল হানছে
বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধারা সকল আক্রমণ চালিয়ে বহু হানাদার শত্রু খতম করে চলেছেন প্রতিদিন। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা এখন মরিয়া হয়ে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করছে। ভীতসন্ত্রস্ত পাকিস্তানি সৈন্য বাহিনী দখলীকৃত এলাকা থেকে হটে যেতে বাধ্য হয়েছে।
মুক্তিবাহিনীর দুঃসাহসী যোদ্ধারা গত এগারই আগস্ট ঢাকার বিলাসবহুল হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল টাইম বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আমেরিকার টাইমসের সংবাদদাতা সহ ২০ জন দস্যু সৈন্যকে গুরুতর আহত করে। শত্রুসৈন্য পরিবেষ্টিত দখলীকৃত ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নিত্যনৈমিত্তিক তৎপরতা দেখে বাঙালি বীর যোদ্ধাদের প্রশংসায় উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে সারাবিশ্বের স্বাধীনতাকামীরা। অন্যদিকে গত ১৪ই আগস্ট সিলেটের ডেপুটি কমিশনারের বাংলাতে পতপত করে উড়ছে আমাদের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পতাকা। স্বাধীনতাকামীরা এমনই পতাকা উড়িয়ে দিয়েছেন সুনামগঞ্জের অনেকগুলো বাসভবনের শীর্ষে।
মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহীতে পাকিস্তানের নৌবাহিনীর একটি জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছেন। ফলে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সহ বহু সংখ্যক দস্যুসৈন্য পদ্মা নদীতে ডুবে গেছে। এদিকে চট্টগ্রামের রামগড় মহাকুমা হাকিমের দপ্তর গেরিলা যোদ্ধারা তছনছ করে দিয়েছেন।
সিলেট সেক্টরের মুক্তিবাহিনী গত ১২ ও ১৩ই আগষ্ট ১৪০ জন হানাদার সৈন্য খতম করেছেন। এর আগে মুক্তিযোদ্ধারা জুরি, কালিহাতি, কাংলি ও সবুজপুরে তৎপরতা চালান। মুক্তিবাহিনী পলায়নরত হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে প্রচুর অস্ত্র উদ্ধার করেছেন। গত ৯ই আগস্ট অত্র জেলার উত্তর-পূর্ব এলাকায় শাহবাজপুরে মুক্তিবাহিনীর সাফল্যজনক আক্রমণে প্রায় ৫০ জন খতম হয়েছে। গেরিলা যোদ্ধারা চার জন পাকিস্তানী সৈন্য কে জীবন্ত অবস্থায় আটক করতে সক্ষম হয়েছেন।
গত ৮ই আগস্ট ঝিকরগাছার ধুলিয়ানি গ্রামে হানাদার সুন্দরা লুটপাট করতে গেলে একজন মুক্তিযোদ্ধা একটি বাগান থেকে গ্রেনেড দিয়ে আক্রমণ চালিয়ে একজন হানাদারকে খতম করেন। স্বাধীনতাকামী যোদ্ধারা হালকা মেশিনগান ও রাইফেল দিয়ে অন্য একটি আক্রমণে তিনজন শত্রু সৈন্যকে হতাহত করেন। হারাদা সৈন্যরা এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য উক্ত গ্রামে লুটপাট ও নির্যাতন চালাতে থাকে। গেরিলা যোদ্ধারা পুনরায় আক্রমণ চালিয়ে দুইজনকে খতম ও দুই জনকে আহত করে।
গত ৯ই আগষ্ট (সোমবার) যশোরের নাভারন এলাকায় গেরিলা যোদ্ধারা রাজাকারদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। এতে ৯৩ জন শত্রু নিহত ও বহু আহত হয়। পরদিন ভোর রাত্রে মুক্তিযোদ্ধারা একটি সেতু পাহারারত রাজাকারদের উপর আক্রমণ চালিয়ে চারজনকে হত্যা করে। অন্যান্যরা কোন রকমে পালিয়ে যায়।
স্বাধীন বাংলা বেতারের খবরে প্রকাশ, গত ১৮ই আগস্ট সিলেটের লাতু অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধাদের সাথে হানাদার পাকিস্তানী সৈন্যদের আট ঘণ্টা ব্যাপী প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়েছে। এই সংঘর্ষে মুক্তিযোদ্ধারা জীবনপণ করে হানাদার শত্রুদের উপর প্রবল আক্রমণ চালিয়ে যান এবং ৫৫ জন হানাদারকে খতম ও ৬৫ জনকে গুরুতর আহত করেন। সংঘর্ষে ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
সম্প্রতি সিলেটের কেরামতনগর রহিমপুর, বিয়ানীবাজার ও মৌলভীবাজারে বিভিন্ন সংঘর্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ছয় জন পাকিস্তানী সৈন্য ও এক জন রাজাকার খতম হয়েছে।
শিববাড়ি অঞ্চলে এক সংঘর্ষ ১১ জন পাকিস্তানী সৈন্য প্রাণ হারায় ও ১৩ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়।
চিলমারী থানার উপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে গেরিলারা একজন অফিসারসহ পাঁচ জন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশকে গুলি করে হত্যা করেন।
সম্প্রতি বানিয়াবাজারে নদীর কাছে একটি লঞ্চ, দুটি স্পিডবোট ও আঠারোটি নৌকা নিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা যাওয়ার সময় মুক্তিবাহিনী তাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালান। এই আক্রমণে ৭৮ জন পাকিস্তানী সৈন্য খতম হয়। মুক্তিযোদ্ধারা সৈন্যবাহী একটি স্পিডবোট ও ১৭টি নৌকা ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হন। এই এলাকায় অন্য একটি সংঘর্ষে ২০ জন শত্রুসৈন্য মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে প্রাণ হারায়। অন্য এক সংঘর্ষে একজন দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধা মেশিনগান হাতে নিয়ে শত্রুর বাংকারের এর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ১৫ জন হানাদারকে খতম করেন।
টাঙ্গাইলের গেরিলা যোদ্ধারা পাওয়ার হাউজ এর উপর সম্প্রতি গ্রেনেড হামলা চালায়। কোন এক সংঘর্ষ গেরিলা টাঙ্গাইলে ৯জন শত্রু সৈন্যকে খতম করেন।
গত সপ্তাহে পাগলা-দেওয়ান হাটে এক সংঘর্ষে মুক্তিযোদ্ধারা তিনজন হানাদারকে খতম করেন।
আলমপুরের মুক্তিবাহিনীর সাথে গুলিবিনিময়ে ১৩ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত ও ৭ জন গুরুতরূপে আহত হয়।
রাজশাহি সেক্টর থেকে প্রাপ্ত সংবাদে প্রকাশ, মুক্তিবাহিনীর কমান্ডোরা চৌঠা আগস্ট রাজশাহী থেকে ৪০ মাইল উত্তর-পূর্বে আড়ানী রেল স্টেশনে একটি রাজাকার বাহিনীর ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। মর্টার মেশিনগানের গুলিতে শত্রুসেনার তিনজন নিহত হয় এবং অন্যান্যরা পালিয়ে যায়। মর্টারের গোলাতে স্টেশনটি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কমান্ডোরা টেলিফোন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ফলে রাজশাহী ঈশ্বরদী এর মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এই আক্রমণ করে পরপর খান সেনাবাহীর একটি ট্রেন উক্ত পথ দিয়ে গমনকালে দুঃসাহসী কমান্ডোরা মাইনের সাহায্যে ট্রেনটি উড়িয়ে দেয়। ফলে বহু শত্রুসেনা হতাহত হয়। পরে কমান্ডোরা আড়ানী বাজারের একটি ব্যাংকে অবস্থানরত শত্রুসেনার পদলেহী দালালদের উপর আক্রমণ চালিয়ে সাতজন হত্যা করেন। এর কাছে বাংকারে অবস্থানরত খানসেনারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পালিয়ে গেলে মুক্তিযোদ্ধারা বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র দখল করেন।
সম্প্রতি তথাকথিত শান্তি কমিটির ১১ জন গুন্ডা অনুপনগরের জনৈক ডাক্তার কে হত্যা করতে গেলে বাংলার অতন্ত্র প্রহরী গেরিলা যোদ্ধারা এক অতর্কিত হামলা চালিয়ে তিনজনকে হত্যা করেন।
আমাদের সংবাদদাতা জানাচ্ছেন, গত ২৭শে আগস্ট মুক্তিবাহিনী মর্টার, মেশিনগান ও হাতবোমা নিয়ে গোদাগাড়ী থানায় অতর্কিত আক্রমণ চালায়। মর্টারের গোলার আঘাতে থানাটি বিধ্বস্ত হয় এবং দখলদার বাহিনীর তিন জন রাজাকার নিহত হয়।
গত ৫ই আগস্ট কুমিল্লা সেক্টরে নয়নপুর শত্রু ঘাঁটিতে মুক্তিযোদ্ধারা এক অতর্কিত হামলা করে।
সম্প্রতি পাবনার শাহজাদপুরে খান সেনাদের পদলেহী দুজন দালাল জামাতে ইসলামীর তথাকথিত নেতা মাওলানা ওসমান গনি ও থানা ফুড ইন্সপেক্টরকে গেরিলা যোদ্ধারা করেছেন। মাওলানা ওসমান গত নির্বাচনে ভরাডুবির প্রতিশোধ হিসেবে সম্প্রতি শত্রুসেনাদের সহযোগিতায় খুব তৎপর হয়ে উঠেছিল।
সুবিধাবাদী রাজনীতিক ভুট্টো
… মাথার উপর ইয়াহিয়ার তরবারী ঝুলছে
প্রধানমন্ত্রিত্ব লাভের নেশায় উন্মাদ লারকানার তরুণ রাজনৈতিক খেলোয়াড় মিঃ জুলফিকার আলী ভুট্টো আজ স্বখাদ সলিলে নিমজ্জিত হচ্ছেন। জনগণের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক জীবনের সর্বক্ষণেই যিনি সুবিধাবাদী নীতির সিঁড়ি বেয়ে আজকের বিলুপ্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্ব লাভের নেশায় উন্মাদ হয়ে উঠেছিলেন, সেই ষড়যন্ত্রকারী ভুট্টোর মস্তকের উপর ইয়াহিয়ার তরবারী চলছে। বাংলাদেশ নাগরিকদের হত্যার ব্যাপারে সার্বিক সহযোগিতা করে শেষ পর্যন্ত তিনি জেনারেলদের অ্যামবুশে অবরুদ্ধ হয়েছেন। যারা জনগণের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে ক্ষমতা দখল করে, যারা সাধারন নাগরিকদের নির্বিচারে হত্যার জন্য সেনাবাহিনী লেলিয়ে দেয়, তাদের কাছ থেকে গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবিক মূল্যবোধ যে আশা করা যায় না, -এই রাজনৈতিক চিরন্তন সত্যটি মিঃ ভুট্টো তার পুঁথিতে পাঠ করেন নি। আর এই রাজনৈতিক অপরিপক্কতার ধ্বংস আসন্ন করছে।
জুলাই মাসে ইয়াহিয়া ও তার জেনারেলরা ইরানসহ কয়েকটি ইসলামিক রাষ্ট্রের বাংলাদেশে গণহত্যা সমর্থনে দোসর যোগাবার উদ্দেশ্যে মিঃ ভুট্টোকে পাঠিয়েছিলেন। আপাতদৃষ্টিতে সেই কথাই মনে হয়েছিল। ক্ষমতার লোভে উন্মত্ত হয়ে মিঃ ভুট্টো জেনারেলদের নির্দেশিত যে কোনো ষড়যন্ত্র মূলক কাজ করতে সম্মত ছিলেন। তিনি তখন ভাবেননি যে, এই সফর প্রস্তাবের সাথে ফাঁসির রজ্জু ছিল।
ইয়াহিয়ার জেনারেলরা ফাঁদ পেতেছিল মিঃ ভূট্টোর জন্য। তারা জানতেন সার্বক্ষণিক কথক ভুট্টো দেশের বাইরে গিয়ে নিজের মনের কথা প্রকাশ না করে পারবেন না। ক্ষমতার লোভ, নিজ পার্টির ভাঙ্গন রোধ ও হত্যার কলঙ্ক থেকে রেহাই পাবার উদ্দেশ্যে তিনি দলভুক্ত দের নিয়ে যেসব ফন্দি পেতেছেন, তা ফাঁস হতে বাধ্য। জেনারেলদের একথা অজ্ঞাত ছিল না যে, সাম্রাজ্যবাদীদের ক্রীড়নক ইরানের শাহানশাহ ও তথাকথিত পাকিস্তানের ইয়াহিয়া একই পাত্রে আহার করেন। সেন্টো ও আরসিডি-র সদস্যরূপে এ দুটি দেশ একই ছত্র তলে আশ্রিত। তবুও ভুট্টোকে ইরানে প্রেরণ করা হয়েছিল স্বপক্ষে প্রচার এর মুখ্য উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, তাকে অন্ধকূপে নিক্ষেপের জন্য। কারণ তিনি এখন আবর্জনার সমতুল্য।
শাহান শাহ পাহলভীর ন্যায় একজন গুনগ্রাহী বাদশার সাথে সুরম্য প্রাসাদ এর সাক্ষাৎ করতে পেরে অভিজাত ভুট্টো নিজেকে ধন্য মনে করেছিলেন। পুরাতন বন্ধু উক্ত রাজতন্ত্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরদালীর সাথে ডিনার টেবিলে বসে ভুট্টো উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন। কিন্তু তিনি জানতেন না যে, ভবিষ্যৎ স্বপ্নকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করার উদ্দেশ্যে জনৈক সাংবাদিকের হাতে তার ফাঁসির রজ্জু তুলে দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু ভুট্টোর উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। ইরানের বাদশাহো আরদেশীরকে দিয়ে তিনি ইয়াহিয়াকে দ্রুত তার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করাতে সম্মত করাতে চেয়েছিলেন। জাতীয় পরিষদে নিজ দলের সদস্যদের সংখ্যার আনুপাতিক হার যাতে হ্রাস না পায়, তার জন্য বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সদস্যদের স্থলে যত অল্পসংখ্যক সম্ভব উপ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য মত দেন। অবরোধে তিনি পার্টির হাই কমান্ডের সঙ্গে সফরের ফলাফল ও ভবিষ্যত কর্মসূচি সম্পর্কে আলোচনার স্থান স্থির করেন কাবুলে। এই উদ্দেশ্যে পিপলস পার্টির সহ-সভাপতি মোহাম্মদ আলী ও সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা খান অন্যপথে কাবুল পৌঁছান।
প্রশ্নের তোড়ে ভুট্টো বিব্রত
একটি বিশেষ ইঙ্গিতে তেহরানের প্রভাবশালী দৈনিক “খাইয়ান ইন্টারন্যাশনাল” জনৈক সম্পাদককে পাঠালেন ভুট্টোর কাছে সাক্ষাৎকারের জন্য। এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকার এর একটির পর একটি অপ্রত্যাশিত প্রশ্নের তোড়ে ভূট্টো বিব্রতবোধ করতে লাগলেন-কিন্তু তাকে অধিকাংশ প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে। আর এই সমস্ত উত্তরের মাধ্যমে ইয়াহিয়ার বিস্তারিত জালে তিনি ধরা দিয়েছেন। রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য শেখ মুজিব ও তার আওয়ামী লীগ সদস্যদের সাথে আলোচনা করা বাঞ্ছনীয়-এই মত তিনি প্রকাশ করে বসেন। কারণ ইতিমধ্যে জানতেন যে, ব্যাপক উপ নির্বাচনের মাধ্যমে ইয়াহিয়া তার পার্টিকে সংখ্যালঘু করার চেষ্টা করছে। এবং ক্ষমতা শেষ পর্যন্ত দৌলতানা কাইয়ুমের হাতে চলে যাবে। এই পদ্ধতিতে তার দলের ভাঙ্গন রোধ করা সম্ভব হবে না। সেখানে গণহত্যার সহায়ক হয়েও তিনি ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হবেন। তদুপরি তার পার্টি আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠান রূপে চিহ্নিত হতে চলেছে।
ইয়াহিয়া প্রকাশ্যভাবে ভুট্টোর এই উক্তিকে দুদিকে ধারালো অস্ত্রের মতো ব্যবহার করতে চান। এদিকে ইয়াহিয়ার ভাষায় “রাষ্ট্রদ্রোহীদের” সাথে মীমাংসা করার জন্য ভুট্টো দাবি করেছে-এই অভিযোগ তোলা হয়েছে এবং অপরদিকে হত্যাকারী সামরিক বাহিনীর পরাজয়ের মুখে বিদ্রোহীদের সাথে কোন মীমাংসা করা যায় কিনা, তার জন্য টোপ ফেলা। তিন নম্বর মুসলিম লীগের সহ-সভাপতি কাইয়ুম খাঁ তো ষড়যন্ত্রের দায়ে ভুট্টোর বিচারেই চেয়ে বসেছেন। অথচ অতিকায় এই ভদ্রলোক জানেনা যে তার সামরিক প্রভুরাই ভুট্টোকে দিয়ে এ কথা বলেছেন।
বিবিসি পরদিন উত্তর সাক্ষাৎকার কাইয়ান ইন্টারন্যাশনাল থেকে প্রচার করে। এর ২৪ ঘন্টা পর ভুট্টো আকস্মিকভাবে কাবুল সহ অন্যান্যদের সফর বাতিল করে তড়িৎ করাচির দিকে যাত্রা করেন। তথাকথিত লৌহমানবের লোমশ হস্ত তাকে তেহরান থেকে সোজা করাচিতে তুলে আনে। করাচি বিমানবন্দরে তিনি যাদের মুখোমুখি হন, তারা সবাই পাবলিক রিলেশন অফিসার। সাংবাদিক নামের এই সমস্ত ব্যক্তিদের কাছে তিনি বলেন যে, তার বক্তব্যকে সঠিকভাবে উদ্ধৃত করা হয়নি- গুরুতর ভুল-ভ্রান্তিতে পূর্ণ। বিবিসিতে প্রচারের ৪৮ ঘন্টা পর করাচিতে পৌঁছে তিনি এই প্রতিবাদ করেন- তেহরানে নয়। তবে ভাবে বিবৃতি প্রদান করে বা প্রতিশ্রুতি দিয়ে পিছিয়ে যেতে অভ্যস্ত ভুট্টো বিশেষ বিব্রতবোধ করেন নি।
এমনকি সরকারি কাগজেও ভুট্টো “কাপুরুষ”
সরকারি কাগজগুলো ভুট্টোকে এ ব্যাপারে “কাপুরুষ” বলে আখ্যায়িত করেছে। প্রেস ট্রাস্ট এর উর্দু কাগজ “ইমরোজ” ভুট্টোর নিন্দা করে বলেছেঃ “যিনি নিজের কন্ঠ থেকে উচ্চারিত বক্তব্যকে নিজের বলে স্বীকার করতে ভয় পান, তিনিই আবার নিজেকে গণতন্ত্রের সাহসী চ্যাম্পিয়ন বলে দাবি করেন। সামরিক আইনে জড়িত হবার ভয়ে তিনি নিশ্চুপ হয়ে পড়েন, কাকে দেশের দুর্যোগের সময় ক্ষমতা দিয়ে বিশ্বাস করা যায় না।” ইতিমধ্যে কাইয়ুম খান বিদেশে ভুট্টোর কার্যক্রম সম্পর্কে তদন্তের দাবি করেছেন। এসবের কোনো উত্তর নেই মিস্টার ভুট্টোর’ তিনি জালে আবদ্ধ।
বধুয়া স্বীকার করা সত্বেও প্রায় ১৫ দিন পর ঢাকার “পাকিস্তান অবজারভার” পত্রিকায় পুনরায় সেই বক্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে। নিশ্চয়ই সামরিক সরকারের ইঙ্গিতে পুনরায় কথা প্রকাশ করা হচ্ছে। ভুট্টো আজ এসব জেনেও অসহায়ের মত চঞ্চল হয়ে উঠছেন। আদালতে এক অপরাধীর অপর অপরাধীর নাম গোপন রাখে না। বিশ্ব দরবারে ইয়াহিয়া একা গণহত্যার জন্য দায়ী হবে কেন? আর অবরোধে ভুট্টোকে তিনি ক্ষমতাতেই বা আনেন কি করে?
ইয়াহিয়া তার রাজনৈতিক চাল অব্যাহত রেখেছেন। মমতাজ দৌলতানাও ফজলুল কাদের চৌধুরীর দুটি মুসলিম লীগকে তিনি এক করে তুলেছেন। এবং কায়ুম খানের লীগকে শীঘ্রই একান্নভুক্ত করা হবে। অপরদিকে যেভাবেই হোক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অন্তত ৭৩টি আসনে একতরফাভাবে উপ নির্বাচন করতে চান। অবশ্য এটা তার দুঃসাহসী অভিযান। এক্ষেত্রে বন্দুক উঁচিয়ে উপ নির্বাচনের মাধ্যমে মুসলিম লীগ ক্রীড়নকদের প্রায় একশত জন পরিষদে বসাতে পারলে গণবিরোধী ও বিশ্বাসঘাতকদের একটি দরবির গড়ে তোলা যাবে। ভুট্টো এখন সংখ্যালঘু।
তিনি আজ চক্রান্তের শিকার
যে ভুট্টো চক্রান্তকারীদের সাথে হাত মিলিয়ে সংখ্যাগুরুদের ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করেছিলেন, গণ হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে ঔদ্ধত্যের সাথে ঘোষণা করেছিলেন-“আল্লা পাকিস্তানকে রক্ষা করেছে”-, ক্ষমতার লোভে রক্তপিপাসু জেনারেলদের রাজনৈতিক পরামর্শদাতার ভূমিকা নিয়েছিলেন, স্বাভাবিক ভাবেই তিনি আজ আর এক চক্রান্তের শিকার।
সামরিক জান্তার এখন উভয়সঙ্কট
পশ্চিম পাকিস্তানের জঙ্গিশাহী বিচার প্রহসনের নামে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণ হননের যে ষড়যন্ত্র করছে তাতে বাংলাদেশের অবরুদ্ধ এলাকার জনসাধারণের মনের তীব্র ক্ষোভ ও ক্রোধ এর সঞ্চার হয়েছে। ফলে অবরুদ্ধ এলাকা মুক্তিসংগ্রাম আরও সংহত ও জোরদার হয়ে উঠছে। বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসন বন্ধ করার এবং তাকে মুক্তি দেবার দাবিতে ঢাকা শহরের দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার পড়তে শুরু করেছে।
অপরদিকে বঙ্গবন্ধুর প্রশ্নে হত্যাযজ্ঞের উল্লাসে মত্ত সামরিক জান্তার ঐক্যজোটে মারাত্মক কোন্দল দেখা দিয়েছে বলে অবরুদ্ধ এলাকা থেকে সদ্য আগত জনৈক বিশিষ্ট চিকিৎসাবিদ গত বৃহস্পতিবারে এ সংবাদ দিয়েছেন। তিনি বলেন যে, বাংলাদেশের অবরুদ্ধ এলাকার জল্লাদগণের ও সামরিক প্রশাসক টিক্কা খান গোড়াতেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পক্ষপাতি ছিল। অপরদিকে সামরিক জান্তার অপর একটি দরজা আছে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করতে এবং বঙ্গবন্ধুর প্রাণের মূল্যে বাংলাদেশকে নেয়া সম্ভব কিনা বাজিয়ে দেখতে। কিন্তু এখন তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে বাংলাদেশের মানুষ বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু, উভয়কেই মুক্ত করতে বদ্ধপরিকর। তাই তারা এক্ষনে গোপনে নাকি এমন এক বন্ধুর সন্ধান করছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানের জঙ্গিশাহীকে এই সংকটের চোরাবালি থেকে উদ্ধার করতে পারে। তাই তারা নাকি এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের দোরে ধর্না দিচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে উথান্ট্ও বিশেষ তৎপর হয়ে উঠেছেন। বঙ্গবন্ধুর বিচার সম্পর্কে ইসলামাবাদের আকস্মিক নীরবতার কারণ জানা সম্ভব হয়নি।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা
নিজেদের স্বাধীনতা নিজেদেরকেই অর্জন করতে হবে –
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
বন্ধুরা, ব্যথায় দুঃখে বুক ফেটে যায় যখন দেখি আমাদের প্রতিবেশী যাকে আমরা বন্ধু বলে মনে করতাম সেই মহান জাতির চীনের বর্তমান নায়করা ইয়াহিয়ার সঙ্গে মিতালী গড়ে তুলেছেন। জানি না এর পেছনে রাষ্ট্রপতি স্বার্থ ছাড়া কি থাকতে পারে। আমরা তো চীনকে এই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখিনাই। চীনের বর্তমান নায়করা যাই বলুন না কেন মহান জাতি চীনের প্রতি কোন অবিশ্বাস আমরা পোষণ করিনা। চীনের সাধারণ মানুষকে আমরা আমাদের ভালোবাসাই দেই। আর আবেদন জানাই আপনারা আপনাদের নায়কদের বাধ্য করুন- যেখানে কৃষক-শ্রমিক মরছে, যেখানে একটা জাতির নির্যাতনে নিষ্পেষিত হচ্ছে সেখানে একটা অত্যাচারী সাম্রাজ্যবাদী সরকারকে সমর্থন যেন না জানায়। একটা সাম্রাজ্যবাদী সরকারকে কি করে আজকে আপনাদের নায়করা সমর্থন করছে। তা একবার আপনারা চোখ মেলে দেখুন। তাদের কাছে আমি আবেদন করি।
তবু বন্ধুরা আমাদেরকে সাবধান হতে হবে। মনে রাখতে হবে আমাদের স্বাধীনতা অন্য কেউ এনে দেবে না। নিজেদের স্বাধীনতা নিজেদেরকেই অর্জন করতে হবে। যদি কারো মনের মধ্যে এই ধারণা করে থাকেন বাইরের কোন রাষ্ট্র স্বাধীনতার মেওয়া ফল এনে দেবে, আমরা সুখ করে খাব তাহলে সেটা ভুল ধারণা। দশ লক্ষ বাঙালির রক্ত দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন মহান নেতাকে স্মরণ করে, আপনাদেরকে মনে করিয়ে দিই যে রক্ত যখন আমরা দিতে শিখেছি তখন আরও রক্ত দেব, বাংলার মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো। দশ লক্ষ বাঙালি বীরের কসম, যারা প্রাণ দিয়েছে তাদের কসম দিয়ে আপনাদেরকে বলছি, আজকে স্বাধীনতার লড়াই এর প্রয়োজন পড়লে আরো আমরা প্রাণ বিসর্জন দেবো। আপোষ আর করবোনা। ইয়াহিয়া খান সাহেব তার শেষ বেতার ভাষণে আমাদের হুমকি দিয়েছেন। এই ইয়াহিয়া খান বাংলার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সদস্যপদ কেটে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।
ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমরা নির্বাচিত সদস্য নই। বাংলার মানুষ আমাদেরকে নির্বাচিত করেছেন। তাদের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার জন্যই আজ আমরা গৃহহারা, সর্বহারা, আজ আমরা বনে জঙ্গলে ঘুরছি। কে তুমি ইয়াহিয়া? তোমাকে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব কে দিয়েছে?
এদেশের জনগণ-নয় পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণও তোমাকে রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব দেয় নাই। সেখানেও তো তুমি নির্ব্বাতি পাঠান বেলুচ, সিন্ধিদেরকে তুমিও তোমার পূর্বসূরিরা শাসন করে চলেছো। পাঞ্জাবের চাষী মজুরদেরকে জমিদারদের অত্যাচারে তুমি সহায়তা করছো। তুমি বাংলার নির্বাচিত পরিষদ সদস্যদের সদস্যপদ কেটে দেওয়ার হুমকি দিয়েছো, তার উত্তরঃ এই ঔদ্ধত্যের উত্তর রণক্ষেত্রে আমাদের বীর সৈনিকেরা দিবে।
বন্ধুরা আমার দায় সর্বশেষে আপনাদেরকে বলি সংকল্পে অটুট থাকতে হবে। দুর্বলতা কোনভাবে যেন আমাদের মনে স্থান না পায়। মনে রাখতে হবে যে, পরিপূর্ণ স্বাধীনতা আমাদের লক্ষ্য। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার বিকল্প কোনো প্রস্তাব এর বিকল্প কোনো সমাধান আপনাদের কাছে বাংলার মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তৎসত্ত্বেও ইয়াহিয়া খান সাহেবের কাছে বলেছিলাম আহ্বান জানিয়েছিলাম যুদ্ধ বন্ধ করুন। আর কত রক্ত ক্ষয় করবে বাবা।
আমরা দশ লক্ষ মরেছি, তোমার ১৫ হাজার সৈনিক কে তো ইতিমধ্যে মুক্তি বাহিনীর লোকেরা খতম করেছে।
মোটের উপর ২০-২৫ হাজার সৈন্য আহত হয়েছে। শুধু আমার বাংলার ঘরে ঘরে মা বোনের ক্রন্দনের-রোল নয়, আজকে পাঞ্জাবের ঘরে ঘরে তো ক্রন্দনের-রোল। সেখানে বিধবার মর্মভেদী হাহাকার তোমার কানে পৌঁছে না? তাই যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যা সমাধান করো।
(১) বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করো। (২) বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দাও। (৩) সমস্ত সেনাবাহিনী প্রত্যাহার কর। আর (৪) যে ক্ষতি করেছ তার ক্ষতিপূরণ দাও। এই চারটি শর্ত আমি দিয়েছিলাম। এই চারটি শর্ত মেনে নিয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে তুমি মীমাংসা করে ফেলো। ইয়াহিয়া খান প্রতি উত্তর দিয়েছেন। ১৮ জুন তারিখে। আঠাশের পর থেকে শান্তিপূর্ণ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্ত সমস্যার সমাধান করার সমস্ত পথ রুদ্ধ হয়েছে। এখন বাংলার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে বাংলার মাঠে, রণে, প্রান্তরে, বাংলার ভবিষ্যত নির্ধারিত হবে পদ্মা, মেঘনা, যমুনার কূলে কূলে। [ সম্প্রতি মুজিবনগরে আওয়ামী লীগ দলীয় জাতীয় ও প্রাদেশিক সদস্যবৃন্দের সম্মুখে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ভাষণ দান করেন তার মূল কথা হলো-
∆ আমাদের যে সকল বীর সৈনিকরা, মুক্তিবাহিনীর যে তরুণ সংগ্রামীরা মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে এদের অপূর্ব বাংলার মানুষের জন্য এক গর্বের বস্তু। আর ভবিষ্যৎ ইতিহাসের জন্য এক অপূর্ব বীরগাথা।
∆ আপনারা জেনে রাখুন, যেখানে বিশ্বজনমত আপনাদের পক্ষে সেখানে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো আপনাকে স্বীকৃতি দিবেই।
∆ একটি বিষয়ে আপনাদের স্পষ্ট থাকতে হবে। কোন প্রকারের সাম্প্রদায়িকতার মালিন্য যেন আওয়ামী লীগের সদস্য বৃন্দের নাম কলঙ্কিত না হয় সে বিষয়ে আপনাদেরকে লক্ষ্য রাখতে হবে। গণতন্ত্রের অর্থই হলো অসাম্প্রদায়িকতা। যেখানে সাম্প্রদায়িক বিভেদ বুদ্ধি সেখানে গণতন্ত্র কোনদিন কার্যকরী হতে পারে না। ]
বাংলার ভবিষ্যত নির্ধারিত হবে বাংলার শ্যামল মাঠের পথে-প্রান্তরে যেখানে মুক্তিফৌজের বীরেরা মরছে, যেখানে আপনাদের সুযোগ্য প্রধান সেনাপতির নির্দেশে তার সৈন্যবাহিনী রক্ত ঢেলে দিচ্ছে। তাদের সেই তপ্ত লহু আজ আপনাদের সংকল্পকে আরো দৃঢ় করুক। বাংলার যে শত শত শত নারী তাদের ইজ্জত দিয়েছে, তাদের ইজ্জতের কসম ইয়াহিয়ার বাহিনীকে নির্মূল না করা পর্যন্ত আমাদের শান্তি নাই। বাংলার যে দশ লক্ষ বীর আজ আত্মহুতি দিয়েছে তাদের অমর আত্মার কসম, প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত, বাংলার স্বাধীনতা অর্জন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের বিশ্রাম নেই।
বন্ধুরা আমার, আপনারা সংকল্পবদ্ধ হউন, আপনারা শপথ করুন, মুক্তিযুদ্ধে যেকোনো অবস্থায়, যে কোন অধ্যায়ে, আপনারা ঝাঁপিয়ে পড়বেন। আমি আপনাদের কাছে আকুল আবেদন করব।
দীর্ঘকাল বহু সুখে-দুখে আমি আপনাদের পাশে পাশে ছিলাম। আমার প্রিয়তম নেতা জনাব শেখ মুজিবুর রহমান স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন, আপনারা দীর্ঘকাল আমাকে ভালোবাসা দিয়েছেন, স্নেহ দিয়েছেন, আমার বন্ধু তাজউদ্দিন সাহেবকে, যেমন দিয়েছেন আমার বন্ধু কামরুজ্জামান সাহেব কে, যেমন দিয়েছেন আমার বন্ধু মুরুব্বী মোশতাক সাহেবকে মনসুর আলী সাহেবকে। কোনদিন কি আমরা আপনাদের বিশ্বাসের অমর্যাদা করেছ বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস, আপনাদের স্নেহ, ভালোবাসার বিনিময়ে আমরা কি কোনদিন আপনাদের আদর্শ থেকে চ্যুত হয়েছি। ২০-২২ বছরের ইতিহাস যদি একথা বলে সুখে- দুখে, জয়-পরাজয়ে, গৌরবে-অগৌরবের আপনাদের পাশে পাশে ছিলাম। আপনাদের বিশ্বাসের অমর্যাদা করি নাই। তাহলে আপনাদের কাছে আকুল আবেদন জানাব আবার আপনারা বিশ্বাস করুন। দেখুন আমরা কি করতে পারি, যদি না পারি তবে শুধু আপনাদের কাছে নয় অনাগত ভবিষ্যতের কাছে আমাদের কি জবাবদিহি করতে হবে। আমার বিশ্বাস আমার মন্ত্রিসভার সদস্যরাও আমার প্রধান সেনাপতিও এ সম্বন্ধে সজাগ।
বন্ধুরা, ১৯৬৬ সাল থেকে ১৬৬৯ সালে তিন বছর আমি আপনাদের পরিচালনা করার দুর্ভাগ্য বা সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম। বঙ্গবন্ধু এই তিন বছর কারাগারে ছিলেন। আইয়ুব শাহীর দাপট আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে আমি দেখেছি তখনও আপনারা অধৈর্য হতেন। আমি কোন দিন ধৈর্য হারাই নাই। বহুবার আপনাদের বলেছি সংগ্রামী, জয়ী হতে হলে ধৈর্যের প্রয়োজন। বহুবার সংগ্রামের বহু কৌশল নিয়ে আপনাদের সাথে আমার মত বিরোধ হয়েছে। আমার সহকর্মী ভাইরা, আজকে আমি গর্বের সাথে বলতে পারি আমার প্রবর্তিত কৌশলের ফলে আমরা ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করেছিলাম, তথা আইয়ুব শাহীকে খতম করেছিলাম।
আমি জানি, এই বিশ্বাসের বলে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে আবার আপনারা আমাকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দিয়েছেন। আমার ভাগ্য এইযে, আমার নেতা, আমার ভাই, আমার প্রিয়তম বন্ধু হিসেবে শেখ সাহেব যখনেই যান, তার অসমাপ্ত কাজের দায়িত্ব ঘাড়ে পড়ে যায়।
বন্ধুরা আমার, কিন্তু সেই কাজ চিরকাল আপনাদের পাশে পাশে থেকে করেছি। বন্ধুরা আমার আজও আপনাদেরকে আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি- যদি বিশ্বাসঘাতকতা করি, যদি সংকল্পে কোনরকম মলিনতা দেখেন, যদি আপনাদের নীতি ও আদর্শ থেকে কোনদিন চ্যূত দেখেন, আপনারা আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করবেন। কিন্তু বাংলার এই সঙ্কট মুহূর্তে জাতীর স্বাধীনতা এই ক্লান্তিলগ্নে যেখানে শত শহীদের রক্তে আজকে ইতিহাস লেখা হয়েছে, আর যেখানে হাজারে হাজারে সৈনিক আজকে বনে প্রান্তরে ইতিহাস লিখে চলেছে, সেই মুহূর্তে আর একবার আপনারা আস্থা স্থাপন করুন। আমার বন্ধু তাজউদ্দিন দীর্ঘদিন আপনাদের পাশে পাশে সংগ্রাম করেছে, বহু জেল খেটেছে। আমার ভাই মোশতাক সাহেব, মনসুর সাহেব, কামরুজ্জামান সাহেব দীর্ঘকাল সংগ্রামের পরীক্ষিত সেনাপতি। তাদের উপর আপনার আস্থা স্থাপন করুন। এ কথা আমি বলব না, নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে সমালোচনা আপনারা করবেন না। সমালোচনা করার অধিকার আপনাদের আছে। সমালোচনার উদ্দেশ্যে হবে একটি -কি করে স্বাধীনতা সংগ্রামকে জোরদার করা যায়।
আর যদি বাংলার স্বাধীনতা এই মন্ত্রিসভার নেতৃত্বে একদিন অর্জিত হয়, সেই গৌরব আপনারা নেবেন, আওয়ামী লীগের কর্মীরা নিবেন, বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ নিবেন, মুক্তিযোদ্ধারা নিবেন। আর সেদিন শুধু কিছু ধন্যবাদ মন্ত্রিসভার সদস্যদের দেন, তবে আমি কৃতার্থ হবো। আপনাদের খাদেম আজকে এবং ভবিষ্যতে থাকবো। আপনাদের সবাইকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ। আসসালামু আলাইকুম।
যোদ্ধা জাতি
অনেক মনে করেন কোন কোন জাত স্বাভাবিকভাবেই রণ নিপুন। আবার অনেক জাত তা নয়। কারণ রণ নৈপুণ্য উপর নির্ভর করে কতগুলি জন্মগত বৈশিষ্ট্যের উপর। অন্যরা এই মতে বিশ্বাস করেন না। কারণ ইতিহাসে দেখা যায়, জাতীয় চরিত্র বদলায়। যে সমস্ত জাতি একসময় রণ নিপুণ ও ভয়ঙ্কর বলে পরিগণিত হয়েছে, পরবর্তীকালে তারা আর তা থাকেনি। অন্যদিকে এর উল্টো দৃষ্টান্তও দেখা যায়। একটা জাতির পক্ষে প্রয়োজনের তাগিদে রন নিপুন জাতিতে পরিণত হওয়া অসম্ভব নয়। এর একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আজকের চীন। চীন যখন জাপান কর্তৃক আক্রান্ত হয় তখন চীনারা জাপান বাহিনীর আক্রমণের সম্মুখে যেভাবে পরাজিত হচ্ছিল, তা থেকে কারও পক্ষে ধারণা করা সম্ভব ছিল না যে, চিনা দিন এত বিরাট একটা সামরিক শক্তিতে পরিণত হতে পারবে। চীনারা আজকের মত নির্ভীক মনের পরিচয় দিতে পারবে। বিভিন্ন জাতির ইতিহাস আলোচনা করলে এ সত্যই প্রমাণিত হয় ঃ যুদ্ধ নৈপুণ্য যত না জন্মগত তার চাইতে বেশী শিক্ষাগত ব্যাপার। যুদ্ধ না করে কেউ যুদ্ধ শিখতে পারেনা। যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটা জাতি মৃত্যু ভয় কে জয় করে ক্রমশ রণ নিপুন যোদ্ধা জাতিতে পরিণত হয়। বাঙালিকে মনে করা হতো, যোদ্ধা জাত নয় বলে। কিন্তু এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হচ্ছে, প্রয়োজন হলে বাঙালিও যুদ্ধবিদ্যা শিখতে পারে। রন নৈপুণ্য শিখতে বা প্রদর্শন করতে পারে।
বাঙালি যোদ্ধা (martial race) জাতি নয় একথা প্রচারিত হয়েছিল ইংরেজ আমলে। এ প্রচারের লক্ষ্যে ছিল বাঙালিকে সেনাবাহিনী থেকে দূরে সরিয়ে রাখা। ইংরেজদের ভয় ছিল, রাজনীতিসচেতন বাঙ্গালীদের সেনাবাহিনীতে গ্রহণ করলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ক্ষতি হবে। পাকিস্তান হবার পরে, এই প্রচারণা আবার চালু হয়। কারণ পাঞ্জাবীরা বুঝল বাঙালিকে সেনাবাহিনীতে ঢুকতে দেওয়ার অর্থ কেবল পাঞ্জাবির চাকরি কম পাওয়া নয়, গোটা পাকিস্তানের উপরে তাদের প্রভুত্ব চলে যাওয়া। তাই আবার রোজা শুরু হলো, বাঙালি যোদ্ধা জাত নয়।তাকে সেনাবাহিনীতে গ্রহণ করা হলে, পাক সেনাবাহিনী দুর্বল হয়ে পড়বে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ক্ষতি হবে। কিন্তু নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে অতি সামান্য অস্ত্র নিয়ে বাংলা বাহিনী আজ যেভাবে লড়াই করছে, তাতে সারাবিশ্বের সমর্থকদের আজ মত পাল্টাতে হচ্ছে খর্বকায়, অনাহারক্লিষ্ট বাঙালি জাত সম্পর্কে। বিলাতের বিখ্যাত রক্ষণশীল পত্রিকা দি টাইমস-এর বার্তাপ্রেরক লিখেছেনঃ বাংলাদেশের (পূর্ব পাকিস্তানের) সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি নবপর্যায় আরম্ভ হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর (মুক্তিফৌজ) সাথে কয়েক দিন কাটিয়ে আমার এই ধারণাই বদ্ধমূল হয়েছে-পাকিস্তানি মুজরা আর তাদের সাথে আগের মতো লড়াইয়ে এঁটে উঠতে পারছে না।
ঢাকা থেকে একজন ওলন্দাজ সাংবাদিক লিখেছেনঃ মুক্তিফৌজ সম্প্রতি গেরিলা যুদ্ধে খুবেই অগ্রগতির পরিচয় দিচ্ছে। খাস ঢাকা শহরে এখন বোমা বিস্ফোরণ হয়ে উঠেছে অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা। গেরিলারা ইয়াহিয়া সরকারের সহযোগি অনেক শান্তি কমিটির দালালদের খতম করে দিয়েছে। এমনকি ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনী ও এখন গেরিলাদের ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে।
এমনই অনেক বিদেশি ঝানু সাংবাদিকের কথার উদ্ধৃতি দেওয়া যায়। বাঙালির সাহস ও নৈপুণ্যে একথাই প্রমাণ করছে যে, ক্ষমতার গর্বে গর্বিত পশ্চিম পাকের জঙ্গিকে একদিন এদেশ ছাড়তে হবে। দখলদার বাহিনী বাংলাদেশ চিরদিন দখল করে রাখতে পারবে না।
বিখ্যাত ব্রিটিশ প্রগতিশীল সাপ্তাহিক ‘দি নিউ স্টেস ম্যান’- এর ১৩ই এপ্রিল তারিখের সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিলঃ’যদি রক্তই যদি হয় একটি জাতির স্বাধীনতার লাভের মূল্য, তবে বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই তা অতিরিক্ত দিয়েছে। সাম্প্রতিককালের ইতিহাসের সরকার পরিবর্তন, স্বাধীনতা লাভ ও দেশে সীমানার পুনঃর্নির্ধারণের জন্য যত রক্তপাত ঘটেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের সংগ্রাম সম্ভবত প্রমাণিত হবে সবচাইতে রক্তক্ষরা ও সংক্ষিপ্ত।…. তবে এই আন্দোলনকে যদি কোনভাবে আপাতত ধ্বংস করে দেওয়া সম্ভব হয়, তবে তাকে মনে করতে হবে একটি জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে একটা অতি সাময়িক ঘটনা।
বাঙালিরা অনেক রক্ত দিয়েছে। এখন দিচ্ছে। এত রক্তপাত কোন জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘটেনি। ঘটেনি এতো মানুষের এত ভয়াবহ যন্ত্রনা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সংক্ষিপ্ত হয়নি। সাময়িক ব্যর্থতা ও বরণ করেনি, সংগ্রাম চলেছে একটানা। প্রথমে যা ছিল জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুদয়, এখন তা নিতে চলেছে সংঘটিত সামগ্রিক রূপ। ঢাকায় জনৈক বিদেশি কূটনীতিক মার্কিন বিখ্যাত সাপ্তাহিক নিউজ উইকের সংবাদদাতার কাছে মন্তব্য করেছেন ঃ ‘ইয়াহিয়া ও তার জঙ্গী বিশারদরা মনে করেছিল নির্বিচার গণহত্যা ও অত্যাচার চালিয়ে বাঙ্গালীদের ভয় পাইয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু ফল ঘটেছে তার উল্টো। বাঙালি আজ বুঝতে পেরেছে একমাত্র পাল্টা বলপ্রয়োগ ছাড়া আর কোন উপায়ে মুক্তি সম্ভব নয়।
বাঙালি আজ যুদ্ধ করেই যুদ্ধ শিখছে। বাঙালির জাতীয় চরিত্র যাচ্ছে বদলে। শান্তিপ্রিয় বাঙালি আজ প্রমাণ করছে, প্রয়োজন হলে যুদ্ধ সেও করতে পারে। যুদ্ধের মাধ্যমে দখলদার বাহিনী কে উৎখাত করে করেই সে আনবে তার বাঞ্ছিত জাতীয় স্বাধীনতা।
বঙ্গবন্ধুর বিচার করার অধিকার কারও নেই-
খুনি ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে সারা বিশ্বের হুঁশিয়ারি
সারাবিশ্বে শান্তিকামী মানুষের সুহৃদ, অহিংস আন্দোলনের নেতা, সাড়ে সাত কোটি বাঙালির নয়নমণি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আজ গণতন্ত্রের হত্যাকারী রক্তপিপাসু দানব ইয়াহিয়ার কারাগারে লোকচক্ষুর অন্তরালে মিথ্যা বিচারের সম্মুখীন। প্রিয় নেতাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক কুচক্রীরা বিচার প্রহসনের নামে এক চক্রান্তের জাল বিস্তার করেছে। আর এরই প্রতিবাদে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে প্রতিবাদের ঝড় আর ধিক্কারের চাবুকে খুনি ইয়াহিয়ার মুখ ছিন্নভিন্ন হচ্ছে। সবাই এক বাক্যে বজ্রকঠোর আওয়াজ তুলেছেন। বন্ধ কর এ বিচার প্রহসন। মুজিবকে মুক্তি দাও।
উথান্টের তৎপরতা!
রাষ্ট্রসঙ্ঘের মুখপাত্র গত ১২ই আগস্ট জানান যে সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিচার সম্বন্ধে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে গোপনে কূটনৈতিক আলাপ-আলোচনা চালাচ্ছেন।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অভিযোগে গোপন সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর বিচার চলছে।
উক্ত মুখপাত্র বলেন এ ব্যাপারে সেক্রেটারি জেনারেল যা করছেন, তা চলছে গোপনে ও একান্ত ব্যক্তিগত স্তরে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর উত্থান্ট সহ প্রতিটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান কে শেখ মুজিবের জীবন রক্ষায় তাদের প্রভাব প্রয়োগের অনুরোধ জানিয়ে যে আবেদন প্রচার করেছেন উক্ত মুখপাত্রকে সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি উপরোক্ত মন্তব্য করেন।
রাশিয়ার গভীর উদ্বেগ
সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় শেখ মুজিব সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ পাচ্ছে।
‘প্রাভদা’য় বঙ্গবন্ধুর বিচার সম্পর্কে খবর প্রকাশিত হয়েছে।
কানাডীয় প্রধানমন্ত্রীর বার্তা
কানাডার প্রধানমন্ত্রী মিঃ পিয়ার ট্রুডো ইয়াহিয়ার কাছে এক বার্তায় বলেছেন যে ইয়াহিয়া যেন শেখ মুজিব সম্পর্কে ঔদার্য ও মানবিকতা প্রকাশ করেন।
শেখ আব্দুল্লাহ আবেদন
শেখ মুজিবের বিচার প্রত্যাহার করে তার সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা করার জন্য শেখ আব্দুল্লাহ পাকিস্তানে জঙ্গি খুনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে এক তার বার্তা প্রেরণ করেছেন। সকলের পক্ষে গ্রহণযোগ্য এবং সংশ্লিষ্ট সকলের পক্ষে সম্মানজনক এক রাজনৈতিক মীমাংসায় উপনীত হওয়ার উদ্দেশ্যে ওই আলোচনা শুরু করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
শেখ আবদুল্লাহ শেখ মুজিবের বিচারের প্রশ্নটিকে পুনর্বিবেচনা করে দেখার জন্য ইয়াহিয়াকে অনুরোধ জানিয়েছেন। শেখ আব্দুল্লাহ’র ঘনিষ্ঠ সূত্রে প্রকাশ শেখ মুজিবের বিচারের ব্যাপারে পাকিস্তান সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে বলে শেখ আব্দুল্লাহ মনে করেন।
পূর্ব জার্মানি
পূর্ব জার্মানি থেকে পাকিস্তানে জঙ্গি সরকারের কাছে শেখ মুজিবের বিচার বন্ধ করার এবং বাংলাদেশের সমস্যার রাজনৈতিক মীমাংসা করে নেয়ার জন্য জরুরী অনুরোধ পাঠানো হয়েছে। এই অনুরোধ রক্ষিত হলে ন্যায়, শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষীত হবে।
ইয়র্কাশায়ার পোস্টের হুঁশিয়ারি
ইয়র্কাশায়ার পোস্টে লিখেছেন, শেখ মুজিবের গোপন বিচারের বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত গ্ৰাহ্য করলে পাক-সামরিক কর্তৃপক্ষ ভালো করবেন।
উক্ত পত্রিকা প্রশ্ন করেছেন শেখ মুজিব যদি এতই খারাপ হয় তাহলে সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রকাশ্যে বিচার করছে না কেন?
ইয়র্কশায়ার পোষ্টে লিখেছেন শেখ মুজিবের যদি কিছু হয় তাহলে রাওয়ালপিন্ডির অবস্থাও খারাপ হবে।
বঙ্গবন্ধুর প্রাণদণ্ড হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে
যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান সিনেটর মিঃ চার্লস পার্সী এই আশা প্রকাশ করেছেন যে, শেখ মুজিবের বিচারের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান সরকারের উপর তার প্রভাব খাটাবে। তিনি বলেন যদি মুজিবের প্রাণদণ্ড হয় তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশ থেকে ব্যাপকহারে শরণার্থীরা ভারতে গমনের ফলে অর্থনীতিতে দারুন চাপ পড়েছে। এ সত্ত্বেও ভারত এই পরিস্থিতির মোকাবিলায় মিঃ পার্সী ভারতের প্রশংসা করেন।
ইয়াহিয়া অমানবিক আচরণ করেছে
যুগোস্লাভিয়ার বিশিষ্ট পত্রিকা ‘বোরবা’ বলেছে, মুজিবের প্রতি ইয়াহিয়া অমানবিক আচরণ করেছে। মুজিব পালাননি এবং তিনি অহিংস নীতির দ্বারা চালিত হয়েছেন। ইয়াহিয়া মুজিবের বিচার নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে পাকিস্তানের সমস্যার সমাধান কোনদিন হবে না। তাছাড়া ইয়াহিয়া একটা জাতির বিরুদ্ধে যে ভয়াবহ অত্যাচার করেছে তা মুজিবের বিচারের আড়ালে চাপা দেওয়া যাবে না।
বিশ্ব গির্জা পরিষদের ধিক্কার
বাংলার নয়ন মনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের গোপন বিচারের বিরুদ্ধে জেনেভায় অবস্থিত বিশ্ব গির্জা পরিষদ ইসলামাবাদ সরকারের নিকট গত ১২ই আগস্ট এক প্রতিবাদ জানিয়েছে।
জল্লাদ ইয়াহিয়ার নিকট প্রেরিত এক তারবার্তায় বিশ্ব গির্জা পরিষদের সেক্রেটারি প্যাষ্টের ইউজিন ব্লেক বিশ্বের প্রোটেস্ট্যান্ট গির্জা সমূহের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবের বিচার ব্যবস্থায় গভীর ধিক্কার জানিয়েছেন। সেক্রেটারি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে লোকচক্ষুর অন্তরালে এই বিচারব্যবস্থা শত্রুতা, সন্দেহ এবং মানবীয় দুর্গতিকেই শুধু বাড়াবে এবং তার ফলে সংঘর্ষ ও বিরোধের এলাকা সম্প্রসারিত হবে।
ক্রিশ্চিয়ান সাইন্স মনিটর
ক্রিশ্চিয়ান সাইন্স মনিটর গত ১২ই আগস্ট এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলেছেন,’আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের জন্য ইসলামাবাদের সিদ্ধান্তে পাকিস্তানের বন্ধুরা পর্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েছেন। একটি বিশেষ সামরিক আদালতে এই বিচার চলছে।’
‘এই মামলায় যেসব প্রশ্ন দেখা দিয়েছে তাতে বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ দেখা দেওয়াই স্বাভাবিক।’
‘এ বিচার ব্যবস্থায় বিদেশের সাংবাদিকদের উপস্থিত থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। বিদেশের সংবাদপত্র গুলির প্রতি ইসলামাবাদের এই অবিশ্বাস পাকিস্তানের কল্যাণ সাধন করবে না।’
বৃহৎ শক্তিবর্গের কাছে প্রধানমন্ত্রীর আবেদন মুজিবের প্রাণ রক্ষা করুন
শেখ মুজিবের প্রাণ রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ বিশ্বের বৃহৎ শক্তিবর্গের কাছে আবেদন জানিয়েছেন।
এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ বলেন যে, শেখ মুজিবের বিচার করার মতো আইনগত, সংবিধানগত অথবা অন্য কোনো অধিকার পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নেই। ক্ষমতা মত্ত পাঞ্জাবি পুঁজিপতিও সামরিক চক্রের এটা একটা গণহত্যারূপী চক্রান্ত।
জনাব আহমেদ বলেন যে বাংলাদেশের কল্যাণের স্বার্থে নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শান্তির জন্য শেখ মুজিবের উপস্থিতি প্রয়োজন।
শেখ মুজিবের জীবন নিয়ে কিছু করা হলে সমগ্র দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় দারুন সংকট দেখা দেবে বলে প্রধানমন্ত্রী সকলকে সতর্ক করে দিয়েছেন।
পাকিস্তানকে মার্কিন সাহায্য দান সম্পর্কে এক প্রশ্ন উত্তরে জনাব আহমেদ বলেন যে, বিশ্বের কোন বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন গণতান্ত্রিক দেশ ইয়াহিয়ার গণহত্যার যুদ্ধকে সাহায্য করতে পারে না।’
তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা বড় অংশ ও বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের দাবিকে সমর্থন করেছেন এবং ইয়াহিয়ার নিন্দা করেছেন।
তিনি আশা করেন মার্কিন সরকার শীঘ্রই তাদের ভুল বুঝতে পারবেন এবং বাংলাদেশের সংগ্রামকে সমর্থন জানাবেন।
ঢাকায় কালোদিবস
ঢাকা থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা গিয়েছে যে, অধুনালুপ্ত পাকিস্তানের জঙ্গি সরকার তথা কথিত স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের যে আয়োজন করেছিল। ঢাকা শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক ও প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা তার উপযুক্ত জবাব দিয়েছে। জঙ্গীশাহীর স্বাধীনতা দিবসের প্রস্তুতি পর্বের সূচনায় বুধবার রাত থেকেই গেরিলা আক্রমণ এর তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। ওই রাতে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল এ বোমা বিস্ফোরণের ফলে ২০ জন আহত হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
দালাল শান্তিবাহিনীর উদ্যোগে ঢাকার কুখ্যাত ও দাগী গুন্ডাদের নিয়ে গঠিত মুষ্টিমেয় লোকের একটি মিছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে ধ্বনি দিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করার সময় যে সামান্য গুটিকতক দোকানপাট খোলা ছিল তাও বন্ধ হয়ে যায়।
ঢাকায় অবরুদ্ধ বাঙালিরা জঙ্গি দিবসে অংশগ্রহণ না করে নীরব প্রতিবাদ এর ভেতর দিয়ে এই দিবসকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
প্রতিবছর পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক শক্তি প্রদর্শনের মহড় এই দিবসের কর্মসূচির একটি উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমণে বিব্রত পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক কর্তারা এবারে ঢাকাবাসীকে তাদের শক্তির মহড়া দেখাতে সাহস করেনি।