You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.29 | ভারতীয় আক্রমণ কৌশল সম্পর্কে নিয়াজির লেখা - সংগ্রামের নোটবুক

আক্রমণ

ভারতীয়রা সীমান্তে হামলা ও আর্টিলারি ফায়ার বৃদ্ধি করে। ইতােমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছিল তাদের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ। ইয়াহিয়া সরকারের ত্রুটিপূর্ণ পররাষ্ট্র নীতি এবং অপপ্রচাররােধে ব্যর্থতার কারণে পাকিস্তান কূটনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে পুরােপুরি বিছিন্ন হয়ে পড়ে। ভারতীয় অপপ্রচার এত সুসংগঠিত এবং এত কার্যকর ছিল যে, এতে শুধু বাংলাদেশের স্বার্থের প্রতি আন্তর্জাতিক সহানুভূতিই বৃদ্ধি পায় নি বরং ধর্ষণ, অগ্নিসংযােগ, লুটতরাজ এবং লাখ লাখ শরণার্থীদের দেশত্যাগ সম্পর্কে ভিত্তিহীন ও সাজানাে কাহিনীও মানুষ বিশ্বাস করতে আক্রমণের সময়টি ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য অত্যন্ত অনুকূলে। নভেম্বরে শেষ হয় বর্ষা এবং ভ্রাম্যমান অপারেশনের জন্য ভূমি হয় উপযুক্ত। সময়টি আরাে অনুকূল ছিল এ কারণে যে, তখন চীনের পক্ষ থেকে কোনাে হুমকি ছিল না—কারণ শীতকাল শুরু হওয়ায় বরফ পড়তে শুরু করে এবং এতে চীন-ভারত সীমান্তের গিরিপথগুলাে বন্ধ হয়ে যায়। এজন্য এরুটে চীনা সৈন্যদের ভারতে প্রবেশ সম্ভব ছিল।  ভারতীয় সেনাবাহিনী হামলার তারিখ নির্ধারণের আগে বর্ষা ও চীনের সম্ভাব্য হস্তক্ষেপের বিষয়টি বিবেচনায় এনেছিল।  শক্রর প্রস্তুতি সম্পর্কে তথ্য পাচ্ছিলাম আমরা এবং পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তের ওপারে তাদের সৈন্য সমাবেশের প্রতি নজর রাখছিলাম। এ পরিস্থিতিতে আমরা নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকি নি। আমরা আমাদের সৈন্য মােতায়েন এবং আমাদের প্রতিরক্ষা সামর্থ্য ও অবস্থান শক্তিশালী করছিলাম। ১৯৭১-এর নভেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদ আমাদের সৈন্য পুনঃমােতায়েন, পুনর্গঠন এবং প্রতিরক্ষা অবস্থানে গােলাবারুদের মজুদ গড়ে তােলার কাজ শেষ হয়। জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স থেকে। ভারতের আসন্ন হামলা সম্পর্কে খবর পাওয়ার পর সৈন্যদেরকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। করা হয়। আমরা প্রার্থনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম এবং ২০/২১ নভেম্বরের রাতে জেগে। ছিলাম যেটা ছিল ঈদের রাত।

যুদ্ধের তারিখ

পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের খােলাখুলি যুদ্ধ নিয়ে আমার আলােচনা করার আগে কখন সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়েছিল সে ব্যাপারে একটি ভুল ধারণা সংশােধন করা প্রয়ােজন।  ১৯৭১-এর মার্চ থেকেই আমাদের ভূখণ্ডে ভারতের চোরাগুপ্তা হামলা এবং গেরিলা তৎপরতা শুরু হয় এবং এতে উভয়পক্ষে জানমালের প্রচুর ক্ষতি হয়। উভয়পক্ষ বরাবরই আর্টিলারি ব্যবহার করছিল এবং ১৯৭১-এর নভেম্বরের গোড়ার দিকে ট্যাংক ও জঙ্গীবিমান অংশগ্রহণ করে। এখানে একমাত্র পার্থক্য হচ্ছে যে, আমরা তখন এসব অস্ত্র ব্যবহার করছিলাম আমাদের ভূখণ্ডে আমাদের নিজস্ব প্রতিরক্ষা কৌশল অনুযায়ী এবং ভারতীয় হামলাকারীদের উচ্ছেদ অথবা আমাদের এলাকায় তাদের অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে। অন্যদিকে, ভারতীয়রা এসব অস্ত্র ব্যবহার। করছিল তাদের নিজেদের এবং আমাদের উভয় ভূখণ্ড থেকে। আগস্টের শেষ থেকে নভেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত ভারতীয়রা পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি সেক্টরে প্রায়ই কয়েক ব্যাটালিয়ন অথবা ব্রিগেড আকারের শক্তি নিয়ে হামলা করতাে। ১৯৭১-এর ২০/২১ নভেম্বরের রাতে ভারতীয় সেনাবাহিনী সব দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানে হামলা করে। এ হামলায় ভারতীয় ট্যাংক ও আর্টিলারি অংশগ্রহণ করে। তবে ভারতের অধিকাংশ হামলাই প্রতিহত করা হয়। ভারতীয়রা তাদের হামলাকে একটি লাইটনিং ক্যাম্পেইন, হিসেবে প্রমাণ করার স্বার্থে তাকে সীমিত যুদ্ধ অথবা সীমান্ত সংঘর্ষ হিসেবে প্রচার করতে থাকে।  পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের ভূখণ্ডে ভারতীয় হামলা অথবা বিদ্রোহ সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তানে খুব একটা লেখালেখি হয় নি। একইভাবে জনগণকে একথা জানানাে হয় নি যে, ১৯৭১-এর ২১ নভেম্বর থেকে পূর্ব পাকিস্তানে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু হয়েছে। কিছু লেখক ৩ ডিসেম্বরের সঙ্গে যুদ্ধের তারিখ গুলিয়ে ফেলছেন। পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানে সত্যিকারভাবে কী ঘটেছিল সেব্যাপারে জনগণকে জানানাের তাগিদ বােধ করে নি।  ১৯৭১ সালে ৩ ডিসেম্বর পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারতের বিরুদ্ধে আমাদের সর্বাত্মক ও ঘােষিত যুদ্ধ শুরু হলে পূর্ব রণাঙ্গনে আমাদের ৪ হাজার সৈন্য নিহত এবং প্রায় সমপরিমাণ আহত হয়। মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আমরা পশ্চিম পাকিস্তানে এক হাজার নয়শাে আহত সৈন্যকে পাঠিয়েছিলাম। ৩ ডিসেম্বরের আগে আমরা ভারতীয় সৈন্যদের সঙ্গে লড়াইয়ে ১২টি ট্যাংক ও তিনটি জঙ্গী বিমান হারাই। দুটি হিলাল-ইজুরাত, ১০টি সিতারা-ই-জুরাত, ১২টি তামগা-ই-জুরাত এবং আরাে কিছু পদক প্রদানের জন্য সুপারিশ করা হয় এবং পদকগুলাে দেয়া হয়। এসব বীরত্বসূচক পদক প্রাপ্তির জন্য অবশ্যই কোথাও না কোথাও যুদ্ধ করতে হয়েছে। এসব পদক। ১৯৭১-এর ৩ ডিসেম্বরের আগে দেয়া হয়। ১৯৭১-এর ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বীরত্বপূর্ণ পদকের জন্য আরেকটি তালিকা জমা দেয়া হয়। কিন্তু জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স এসব বীরত্বপূর্ণ পদক প্রদান করে নি। আমরা যুদ্ধ

ক্যাম্পের ভারতীয় জেল থেকে ফেরার পর এসে দেখতে পাই যে, এ তালিকাটি উধাও হয়ে গেছে । ধন্যবাদ গুল হাসানকে। 

জেনারেল ইয়াহিয়া বলেছিলেন যে, পাকিস্তানের যে কোনাে অংশের ওপর হামলার প্রতিশােধ নেয়া হবে। কিন্তু ভারতীয়দের স্বার্থে এবং ভুট্টোর পরামর্শে ১৯৭১-এর ২১ নভেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে হামলা চালানাে সত্ত্বেও তিনি তৎক্ষণাৎ প্রতিশােধ নেন নি। তার বদলে তিনি বলেছিলেন, “পাকিস্তানের জন্য আমি কী করতে পারি? আমি শুধু পারি প্রার্থনা করতে।” এবং এ পর্যন্ত তিনি। করেছিলেন। আমাদের সার্বিক পরিকল্পনা অনুযায়ী জেনারেল ইয়াহিয়া তৎক্ষণাৎ প্রতিশােধ নিলে অথবা তৎক্ষণাৎ নিরাপত্তা পরিষদকে ভারতীয় আগ্রাসন সম্পর্কে অবহিত করলে ভারতীয়রা ২১ নভেম্বর সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হওয়ার তারিখকে ৩ ডিসেম্বর হিসেবে উল্লেখ করে বিভ্রান্ত করার অবস্থানে থাকতে পারতাে না। এবং এটাকে দু’সপ্তাহের একটি ক্যাম্পেইন হিসেবেও আখ্যায়িত করার সুযােগ পেত না।

“১৯৭১-এর নভেম্বরের প্রথম তিন সপ্তাহে ভারতীয় সামরিক তৎপরতা উল্লেখযােগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভারতীয় ইউনিটগুলাে পূর্ব । পাকিস্তানে তাদের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করে তৎক্ষণাৎ ভারতীয় ভূখণ্ডে ফিরে যেত। ২১ নভেম্বর রাতের পর এ কৌশলে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। তা হলাে, ভারতীয়। সৈন্যরা আর ফিরে যায় নি। ২১ নভেম্বর থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কয়েকটি ডিভিশন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত হয়ে সাজোয়া ও বিমান বাহিনীর সমর্থন নিয়ে। সকল দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানের সকল গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত অঞ্চলে একযােগে সামরিক হামলা শুরু করে।” | (আর, সিমন এবং এল.ই.রােজ : ওয়্যার অ্যান্ড সিজেশন : পাকিস্তান, ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য ক্রিয়েশন অভ বাংলাদেশ, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, করাচি, ১৯৯২, পৃষ্ঠা-২১৩)

ভারতের কৌশল সম্পর্কে ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তাগণ তাদের বই-পুস্তকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এসব সামরিক কর্মকর্তা ১৯৭১ সালে বিভিন্ন কমান্ডিং পদে ছিলেন। তারা স্বীকার করেছেন যে, ২১ নভেম্বর তাদের ইউনিটগুলাে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে। তাদের একজন বলেন, ‘ভারত ২২ নভেম্বরকে হামলার ডি-ডে হিসাবে নির্ধারণ করেছিল। ঈদের জন্য তারা তারিখ একদিন এগিয়ে ২১ নভেম্বর নিয়ে আসে। ভেবেছিল যে, পাকিস্তানি সৈন্যরা ঈদের আনন্দে ব্যস্ত থাকবে এবং এভাবে অসতর্ক হয়ে পড়বে।’ (মেজর জেনারেল লক্ষণ সিং, ইন্ডিয়ান সাের্ড স্ট্রাইকস ইন ইস্ট পাকিস্তান,

বিকাশ, নিউদিল্লি, ১৯৮০)

তাছাড়া আমার চিফ অভ স্টাফ জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে সিজিএস তাকে জানান যে, ঈদের দিনে ভারত পূর্ব পাকিস্তানে হামলা চালাবে। একথা জানিয়ে তিনি তাকে ঢাকা ছুটে যেতে বলেন। | একটি প্রতিবেশী দেশের ভৌগােলিক অখণ্ডতা ও সীমান্তের প্রতি কোনােরূপ শ্রদ্ধা প্রদর্শন ছাড়া ভারতীয় সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর সীমান্ত অতিক্রম করে এবং সব দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানে হামলা চালায়। পদাতিক বাহিনী এবং ট্যাংক প্রবেশ করার আগ মুহূর্তে পেছনে মােতায়েন গােলন্দাজ বাহিনী সীমান্ত। বরাবর মূল টার্গেটগুলােতে প্রায় ৪ ঘণ্টা একটানা গােলাবর্ষণ করে। ভারতীয়রা বিরাট আড়ম্বর শক্তি প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে পুর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করে। এসময় ট্যাংক, মর্টার ও ভারী কামান থেকে মুহুর্মুহু গােলাবর্ষণ করা হচ্ছিল। মেশিনগান থেকে ঠা-ঠা করে অফুরন্ত গুলি ফুটছিল, ঝাঁকে ঝাঁকে জঙ্গীবিমান চক্কর দিচ্ছিল এবং ছােট-বড় সব ধরনের অস্ত্র একসঙ্গে গর্জন করছিল। পক্ষান্তরে, পদাতিক সৈন্য ছাড়া। আমাদের আর কোনাে সহায় ছিল না। আমাদের পদাতিক বাহিনীর অস্ত্রগুলাের ওপর কয়েক ঘণ্টা ধরে বােমাবর্ষণ করা হয়। যে কয়েকটি ফিল্ড আর্টিলারি ছিল সেগুলােও নিস্তার পাচ্ছিল না। তবে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল সুরক্ষিত ও দুর্ভেদ্য। আমাদের সৈন্য ও অফিসাররা ছিলেন যুদ্ধে অভিজ্ঞ। ট্যাংকের ঘড় ঘড় শব্দ, হাজার হাজার যানবাহনের চিৎকার, জঙ্গীবিমানের কানফাটা আওয়াজ এবং অগণিত অস্ত্র থেকে গােলাগুলিতে রণাঙ্গন কেঁপে ওঠে। ভারতীয় পদাতিক বাহিনী প্রবেশ করার আগে আমাদের সৈন্যদের ভীত-সন্ত্রস্ত ও তাক লাগিয়ে দেয়াই ছিল এর উদ্দেশ্য। তবে ভারতীয়দের এ শক্তি প্রদর্শন আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভাঙতে অথবা আমাদের সৈন্যদের মনােবলে চিড় ধরাতে ব্যর্থ হয়। দক্ষ নেতৃত্ব না থাকায় এ তথাকথিত “ব্লিৎসক্রিগ’ ও ‘পরিকল্পিত ছত্রছায়া” দারুণভাবে ব্যর্থ হয়। ভারতীয় বাহিনীতে আমাদের মতাে দক্ষ জেনারেল ছিল না। তাই তাদের ‘ব্লিৎসক্রিগ আমাদের স্ক্রিন পজিশনের কাছাকাছি আসা মাত্রই সীমান্তে মুখ থুবড়ে পড়ে। তাদের অসংখ্য বহরের গতিরােধ করা হয় এবং একটি বহর থেকে আরেকটি বহরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয় এবং ঢাকা থেকে বহু দূরে এদের আটকে ফেলা হয়।  ভারত পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধের স্থায়িত্ব এবং প্রকাশ্য যুদ্ধ শুরু হওয়ার তারিখ সম্পর্কে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। যুদ্ধের মােট স্থায়িত্বকাল হচ্ছে নয় মাস—এর মধ্যে আট মাস হচ্ছে বিদ্রোহ ও সীমান্ত সংঘর্ষ এবং বাকি ২৬ দিন হচ্ছে সর্বাত্মক যুদ্ধ, দু’ সপ্তাহ নয়।

আক্রমণ ১৬ ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল নজর হােসেন শাহ জানান যে, ভারতীয়রা পূর্ণ শক্তি নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করেছে এবং তাদের পূর্ণাঙ্গ হামলা চলছে। তাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম তিনি কীভাবে জানলেন যে এটি পূর্ণাঙ্গ হামলা এবং ভারতীয়রা এতদিন যে ধরনের হামলা চালিয়ে এসেছে এটি সে ধরনের হামলা নয়? নজর বললেন যে, অগ্রবর্তী অবস্থানে তিনি নিজে গিয়ে দেখে এসেছেন। তিনি বললেন, “প্রচুর গােলাগুলি চলছে। এটা যেন লাহােরে হর্স শােতে আমাদের আতশবাজির মতাে। গােটা সীমান্ত জুড়েই প্রতিটি ফ্রন্টে ভারতীয়দের তৎপরতা শুরু হয়েছে। এটা কোনাে একটি নির্দিষ্ট সেক্টরে সীমাবদ্ধ নয়।” | আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “কোনাে নির্দিষ্ট রুট অথবা সেক্টর বরাবর কোনাে। বহর এগিয়ে আসার খবর পাওয়া গেছে কিনা?”  তিনি আমার প্রশ্নের না সুচক জবাব দেন। “মনে হচ্ছে তারা বুঝতে পেরেছে যে, এঁটে উঠতে পারবে না তারা। প্রধান প্রধান রুটে আমাদের চৌকিগুলাে। তাদেরকে শক্ত জবাব দিচ্ছে এবং শত্রর প্রচুর ক্ষতি সাধন করছে। স্যার, ভারতীয়দের চরিত্র হচ্ছে যুদ্ধের চেয়ে কোলাহল বেশি— বর্ষণের চেয়ে গর্জন বেশি।” | অন্যান্য সেক্টর থেকেও খবর পাওয়া যাচ্ছিল যে, ভারতীয়রা সবদিক থেকে পূর্ব । পাকিস্তানের ওপর সর্বাত্মক হামলা শুরু করেছে। ভারতীয়রা ঢাকার মতাে গভীর। অভ্যন্তরের লক্ষ্যবস্তুতে নয়, কেবলমাত্র সীমান্তের আট থেকে দশ মাইলের মধ্যে তাদের জঙ্গিবিমান ব্যবহার করে। তাদের নৌবাহিনীও আমাদের বন্দর অথবা সমুদ্র। অবরােধে এগিয়ে আসে নি। তারা এমন করছিল আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার ভয়ে নয়। কারণ তারা কখনাে আন্তর্জাতিক মতামতের তােয়াক্কা করে নি বরং একটা ভুল ধারণা থেকেই তারা এমন করছিল।

ভারতীয়রা ধারণা করতাে যে, পাকিস্তান ইন্টার্ন কমান্ড সীমান্তের কাছে একটি সরু রেড লাইনে ছড়িয়ে রয়েছে এবং তারা আকস্মিক হামলায় তা গুঁড়িয়ে দিতে পারবে। ভারতীয় কৌশলবিদগণ ও গােয়েন্দা সংস্থাগুলাে আরেকটি ভুল করে। তাদের এ ভুল ছিল প্রথমটির চেয়ে বড়। ১৯৭১-এর এপ্রিলে। তারা প্রথম ভুল করে। ভারতীয়রা তখন ভেবেছিল যে, আমি আমার পূর্বসূরি টিক্কার। মতাে বড় বড় শহর ও ক্যান্টনমেন্টের আশপাশে লড়াই করব এবং একটি ক্ষুদ্র, অর্ধসজ্জিত ও অবরুদ্ধ বাহিনী নিয়ে অগ্রাভিযান শুরু করার সামর্থ্য আমার নেই। কিন্তু আমি তাদের ধারণা ভেঙে দিয়ে হামলা শুরু করি এবং দু’মাসেরও কম সময়ের ভেতর এক ত্বরিত অভিযানে পূর্ব পাকিস্তানের মাটি থেকে গেরিলাদের উচ্ছেদ করি। দ্বিতীয় বার আমরা ভারতীয়দের বােকা বানাই। সেটা ছিল আমাদের সৈন্য। মােতায়েন সম্পর্কে। আমি ভারতীয়দের এটা বুঝতে দেই যে, আমার মিশনের। প্রকৃতি অনুযায়ী আমাকে আমার সকল সৈন্য সীমান্তে মােতায়েন করতে হয়েছে এবং দেশের অভ্যন্তরে আমার হাতে কোনাে সৈন্য নেই। মানচিত্রে আমরা দেখাই যে, সকল সৈন্য একটি সরু রেখায় সীমান্তে মােতায়েন করা হয়েছে। সীমান্তে মােতায়েন সৈন্যদের অবস্থান বড় করে বৃত্ত এঁকে দেখানাে হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সীমান্তে খুব। সামান্য সৈন্যই ছিল, অধিকাংশ সৈন্য মােতায়েন করা হয় সীমান্ত থেকে অনেক দূরে। আমরা মানচিত্রে সৈন্য মােতায়েন যেভাবে চিহ্নিত করে দেখিয়েছিলাম তাতে ভারতীয় এবং আমাদের হাই কমান্ড উভয়েই সন্তুষ্ট হয়েছিল। আমাদের হাই কমান্ডের অভিপ্রায় ছিল ভারতীয় ও বাঙালিদের চেয়েও জঘন্য। আমার হাই কমান্ড আমাকে ভারতের প্রথম হামলায়ই ধরাশায়ী দেখতে চেয়েছিল। এজন্য আমাকে ভূখণ্ড না হারানাের নির্দেশ দেয়া হয়।

এ নির্দেশ পালনে সীমান্ত বন্ধ এবং সীমান্ত বরাবর সৈন্য মােতায়েন করা অপরিহার্য ছিল। আমাকে ভারতীয়দের সহজ শিকারে পরিণত করার জন্যই এরকম নির্দেশ দেয়া হয়। আমি আমার পরিকল্পনায় সামান্য সমন্বয় করি। তবে আমি সৈন্য সমাবেশ করা পরিত্যাগ করি না। আমাকে পরাজিত করার জন্য ভারতীয়দের যথেষ্ট সময় ও সুযােগ করে দেয়ার লক্ষ্যে ইয়াহিয়া আমাদের সার্বিক পরিকল্পনা অনুযায়ী পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধ শুরু অথবা ভারতীয় হামলার বিষয়টি জাতিসংঘে নিয়ে যায় নি। পূর্ব পাকিস্তানকে সরকারবিহীন অবস্থায় পরিত্যাগে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যই পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধ শুরু করা হয় নি এবং বিষয়টি তৎক্ষণাৎ জাতিসংঘে নিয়ে যাওয়া হয় নি। আমি পরাজিত হলেই পূর্ব পাকিস্তান পরিত্যাগে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর পরিকল্পনা সফল হতাে। অতঃপর নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তা হয়ে যায় ইয়াহিয়ার অংশগ্রহণ। ১৯৭১-এর ২১ নভেম্বর আমি আমার সৈন্যদের কাছে নিম্নোক্ত বার্তা পাঠাই:  ‘বিদ্রোহ, চোরাগুপ্তা হামলা, ক্ষয়ক্ষতি সাধন ও পরােক্ষ যুদ্ধের কৌশল অবলম্বনে পূর্ব পাকিস্তান গ্যারিসনকে বিকল এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মিশন ব্যর্থ হওয়ায় ভারতীয়রা ২০/২১ নবেম্বরের মধ্যবর্তী রাতে প্রকাশ্যে পূর্ব পাকিস্তানে হামলা করেছে। পাকিস্তানের বীর সৈন্যরা গােটা ফ্রন্ট বরাবর তাদের হামলা প্রতিহত করেছে। তাদেরকে তাদের থাবা বিস্তার করার সুযােগ দেয়া যাবে না। আল-বদর ও আল-শামস যােদ্ধাদের ভারতের গভীর অভ্যন্তরে লক্ষ্যবস্তুতে পাঠাও। ভারতীয়দের ট্যাংক সংরক্ষণাগার, গান এরিয়া ও তাদের যােগাযােগ ব্যবস্থায় হামলার জন্য। স্থানীয় গেরিলা ও নিজস্ব কমান্ডােদের ব্যবহার কর। রাতে তাদের ভীতি প্রদর্শন কর। তাদের যান্ত্রিক পরিবহন (এমটি), ট্যাংক ও জঙ্গিবিমানের কোনাে অভাব নেই। পেট্রোলেরও ঘাটতি নেই কোনাে । তাদেরকে ভ্রাম্যমান যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার সুযােগ দিও না। নদী, খাল-বিল, হ্রদ ও হাওরগুলােকে বিচক্ষণতার সঙ্গে ব্যবহার কর এবং যান্ত্রিক পরিবহনকে রাস্তায় উঠতে বাধ্য করার জন্য কৃত্রিম বন্যার সৃষ্টি কর এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের অধিকাংশ সৈন্যকে নির্ধারিত পথ ধরে চলতে বাধ্য কর। তােমাদের মঙ্গল হােক। আল্লাহ তােমাদের সঙ্গে রয়েছেন।”

সব দিক থেকে হামলা চালিয়ে জায়গায় জায়গায় আমাদের অবস্থান ঘেরাও এবং পরিশেষে ঢাকা দখল করাই ছিল পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় হামলার মূল লক্ষ্য। তারা তিনটি কোর ও ডিভিশনাল সদর দপ্তর হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী একটি কমিউনিকেশন জোন নিয়ে আমাদের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ডিভিশনের শক্তিসম্পন্ন কিলাে ফোর্স ব্যবহার করা হয়। তারা ১৭ স্কোয়াড্রন আধুনিক জঙ্গিবিমান ব্যবহার করে। এছাড়া ১২৫টি হেলিকপ্টারও তারা ব্যবহার করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের চারদিকে তাদের বিমানঘাঁটি ছিল। তাদের নৌবাহিনীতে ছিল ১২টি বৃহদাকার যুদ্ধ জাহাজ ও ‘বিক্রম” নামে একটি বিমানবাহী রণতরী। এ রণতরীটি একটি ভ্রাম্যমান বিমানঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা যেত। ২১ নভেম্বর আমার চিফ অভ স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বাকির জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সে ভাইস চিফ অভ জেনারেল স্টাফ মেজর জেনারেল কোরেশীর কাছে টেলিফোন করেন এবং ভারতীয় হামলা সম্পর্কে একটি লিখিত সংকেত পাঠান। আমি চিফ অভ জেনারেল স্টাফ জেনারেল গুল হাসানের সঙ্গে কথা কথা বলার চেষ্টা করি । কিন্তু তার সঙ্গে যােগাযােগ করতে ব্যর্থ হই। তিনি ঈদ উদযাপনের জন্য লাহাের চলে গিয়েছিলেন। ২১ নভেম্বর ভারত পূর্ব পাকিস্তানে হামলা চালাবে, একথা ভালােভাবে অবগত হয়েও তিনি লাহাের যান। আমি এরপর চিফ অভ স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি।

তাকেও পাওয়া যায় নি। পরে জানতে পেরেছি যে, জেনারেল হামিদ ও প্রেসিডেন্ট পাখি শিকারের জন্য শিয়ালকোট গিয়েছিলেন। কিন্তু বলা হয়েছিল যে,তারা সৈন্যদের সঙ্গে দেখা করার। জন্য সেখানে গিয়েছেন। কোনাে মুসলিম রাষ্ট্রের সি-ইন-সি ঈদের দিনে সৈন্যদের সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারেন না। সেনাবাহিনীর এ তিন শীর্ষ কর্মকর্তার এ নিষ্ঠুর আচরণ এটাই প্রমাণ করে যে, পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলীতে এবং পাকিস্তানের সংহতি রক্ষায় তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। ঢাকা যখন পুড়ছিল তারা তখন সম্রাট নিরাের মতাে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। তাদের কার্যকলাপে আমি মােটেও হতাশ। হই নি। কারণ আমি তাদের দুরভিসন্ধি আঁচ করতে পেরেছিলাম। আমার চিফ অভ স্টাফ আমাকে আগেই জানিয়েছিলেন যে, তারা পূর্ব পাকিস্তান ও আমাদের পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিষয়টিকে জাতিসংঘ অথবা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে। যাওয়া অথবা একটি যুদ্ধবিরতিতে পৌছানাে অথবা কোনাে রাজনৈতিক মীমাংসায় পৌছানাের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া অথবা পররাষ্ট্র মন্ত্রী ভুট্টো কারাে তরফেই কোনাে প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয় নি। | “পশ্চিম রণাঙ্গনে হামলা শুরু না করে ইয়াহিয়া খান ইস্টার্ন গ্যারিসনের অস্তিত্ব রক্ষা করা অসম্ভব করে তােলেন… | এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের হামলাই সম্ভবত একমাত্র নজির যেখানে জাতিসংঘের একটি সদস্য রাষ্ট্রের ওপর আরেকটি সদস্য রাষ্ট্রের সশস্ত্র আগ্রাসন সত্ত্বেও আক্রান্ত দেশটি তৎক্ষণাৎ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বিষয়টি উত্থাপন করে নি।” | (ফজল মুকিম : পাকিস্তান’স ক্রাইসিস ইন লিডারশিপ, ন্যাশনাল বুক

ফাউন্ডেশন, ইসলামাবাদ, ১৯৭৩)

ভারতীয়রা তাদের রুশ প্রভুদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, তারা এক সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তান এবং ১২ দিনে ঢাকা দখল করবে এবং এ প্রক্রিয়ায় পূর্ব পাকিস্তান গ্যারিসন ধ্বংস করে দেবে। কিন্তু শুরুতেই তাদের হামলা প্রতিহত করা হয়। ২১ নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৩ দিন ভারতীয় বাহিনীকে সীমান্তে ঠেকিয়ে রাখা হয়। এ লজ্জা ঢাকা দেয়ার জন্য ভারতীয়রা ২১ নভেম্বর যুদ্ধ শুরু হওয়ার তারিখ অস্বীকার করছে এবং বলছে যে, ৩ ডিসেম্বর হচ্ছে দু’দেশের মধ্যে প্রকাশ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার দিন।

ভারতের ইচ্ছা ও পরিকল্পনা

ভারতীয়দের ইচ্ছা, তাদের পরিকল্পনা ও আনুষঙ্গিক প্রচেষ্টা তখন ছিল পুরােপুরি পরিষ্কার। তারা নিম্নলিখিত পথ ধরে অগ্রসর হচ্ছিল :

যশাের সেক্টর : ঢাকা দখলে সদ্য গঠিত ভারতীয় দ্বিতীয় কোরে (কমান্ডার লে. জেনারেল রায়না) ছিল ৪ মাউন্টেন ডিভিশন, ৯ পদাতিক ডিভিশন; ৫০ (১) প্যারা ব্রিগেড গ্রুপ; দুটি ট্যাংক রেজিমেন্ট ও ৫টি বিএসএফ ব্যাটালিয়ন। | বগুড়া সেক্টর : রংপুর-বগুড়া দখল এবং সিরাজগঞ্জ থেকে ঢাকা পৌছার লক্ষ্যে ৩৩ কোরে (কমান্ডার লে. জেনারেল থাপন) ছিল ৪৭১তম ইঞ্জিনিয়ার্স ব্রিগেড, ২০ মাউন্টেন ডিভিশন; ৬ মাউন্টেন ডিভিশন; ৩৪০(১) ব্রিগেড এপ; ৩৩ কর্পস আর্টিলারি ব্রিগেড; ৬৯ ক্যাভালরি (পিটি-৭৬), ৭২ সাজোয়া রেজিমেন্ট (টি-৫৫); ১০ বিএসএফ ব্যাটালিয়ন।

ময়মনসিংহ সেক্টর : ভারতীয়রা ৫টি স্বতন্ত্র ব্রিগেড নিয়ে এ সেক্টরে প্রবেশ করে। কিন্তু পরে ৬৩ ব্রিগেড এনে এ সেক্টরে শক্তি বৃদ্ধি করা হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার শাহ বেইগের নেতৃত্বে মুক্তি বাহিনীর একটি ব্রিগেডও এ সেক্টরে তৎপরতা চালাচ্ছিল। সমগ্র সেক্টর ছিল ১০১ কমিউনিকেশন জোনের কমান্ডে। সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল জি,এস, গিল এক মাইন বিস্ফোরণে একটি পা হারান। এরপর এক্স-২ ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল নাগরা তার স্থলাভিষিক্ত হন। আমরা ঢাকায় থেকেই এ ডিভিশনের গােটা স্টাফকে এ সেক্টরের অপারেশন পরিচালনা করতে দেখেছি।

সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও লাকসাম সেক্টর এ সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন। ভারতের চতুর্থ কোরের কমান্ডার লে. জেনারেল সগত সিং। চতুর্থ কোরে ছিল ৮, ২৩ ও ৫৭ ডিভিশন । এছাড়া, এতে ছিল মুক্তিবাহিনীর একটি ব্রিগেড, ৪৭১ ইঞ্জিনিয়ার ব্রিগেড, বেশ কয়েকটি ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ন ও ১৭টি বিএসএফ ব্যাটালিয়ন। চতুর্থ কোরকে ইস্টার্ন সেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হয় এবং তুরা-ময়মনসিংহ। থেকে অন্যান্য সহায়ক বাহিনী নিয়ে ঢাকা দখল করাও ছিল এ কোরের কাজ। ৬টি ব্রিগেডকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-ভৈরবাজার-দাউদকান্দি- ঢাকা এলাকা-২৩ ডিভিশনকে লাকসাম; চাদপুর-ফেনী-চট্টগ্রাম অঞ্চল; এবং একটি ডিভিশনের শক্তি সম্পন্ন একটি বিশেষ বাহিনী (কিলাে) কে রাঙ্গমাটি-কাপ্তাই ও উত্তর-পশ্চিম চট্টগ্রাম দখলের দায়িত্ব দেয়া হয়।

১৯৭১-এর ২১ নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের অভিযান। সৈন্য মােতায়েনে পরিবর্তন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় এবং সর্বাত্মক যুদ্ধের আগে ভারতীয় হামলাকালে এ সৈন্য মােতায়েন কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়। আর্টিলারি ও মর্টারের সমর্থনে ভারতীয়রা হামলা চালাচ্ছিল। বিদ্রোহীরা পেছন থেকে আমাদের মূল অবস্থানে হামলা করছিল এবং শক্রদেরকে গােয়েন্দা তথ্য দিচ্ছিল। শােনা গেছে যে, বিদ্রোহীরা দিকনির্দেশনা দিয়ে তাদেরকে আমাদের অবস্থান পর্যন্ত নিয়ে আসে এবং তারা তাদেরকে রাস্তাঘাট দেখিয়ে দেয়। আমাদের প্রতিটি অবস্থানই ছিল ভারতীয়দের চেনা। আট মাসের অব্যাহত লড়াইয়ে ক্লান্তি, অফিসার ও সাজসরঞ্জামে ঘাটতি এবং হতাহতদের অপসারণে প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও আমার নগণ্য সৈন্যদল বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছে। আমি সব কটি ফরমেশন ও ইউনিট সফর করি এবং এতে সৈন্যদের মনােবল বৃদ্ধি পায়। 

এটা খুবই দুঃখের বিষয় যে, ঐ আট মাসে প্রেসিডেন্ট ও সি-ইন-সি, প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার, অ্যাডজুট্যান্ট-জেনারেল, কোয়ার্টার মাস্টার-জেনারেল অথবা মাস্টারজেনারেল অর্ডন্যান্স কেউই আমাদের দেখতে আসেন নি। চিফ অভ স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ ও সিজিএস লে. জেনারেল গুল হাসান পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের সময় ইস্টার্ন কমান্ড পরিদর্শন করা দূরে থাকুক, আমাদের একবার টেলিফোন করার প্রয়োজনও অনুভব করেন নি। এতে আমরা দমে যাই নি। আমার সৈন্যরা ভারতীয়দের আমাদের পবিত্র ভূমির এক খণ্ড মাটিও দখল করে নিতে দেয় নি। | উপরে বর্ণিত সময়টা ছিল মূলত সীমান্ত লড়াইয়ের। যুদ্ধ শুরু হলে ভারতীয়রা (তাদের নিয়মিত সৈন্য এবং বিএসএফ) মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় সীমান্তে হামলা শুরু করে। স্থলবাহিনীকে সহায়তাদানে চোরাগুপ্তা বিমান হামলা শুরু হয়। দেশের। অভ্যন্তরে মুক্তিবাহনীর তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। ধরনটা ছিল এরকম যে, ট্যাংক ও কামানের সমর্থনের ভারতীয়রা একটি নির্দিষ্ট অবস্থানে হামলা করবে এবং মুক্তিবাহিনী একই অবস্থানে হয় প্রবেশ করবে নয়ততা এড়িয়ে গিয়ে পেছন দিকে এ  অবস্থান অবরােধ করবে যাতে আমাদের সৈন্য প্রত্যাহার অসম্ভব হয়ে পড়ে। সাধারণত ব্যাটালিয়ন অথবা ব্রিগেড পর্যায়ে এসব হামলা হতাে। এগুলােতে অন্তত ৮টি করে ট্যাংক থাকত । এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল একমাত্র হিলি। এখানে একটি পুরাে রেজিমেন্ট হামলায় অংশগ্রহণ করে। ভারতীয়রা এক একটি অবস্থানে হামলা করে তা দখল করার চেষ্টা করত এবং সেখানে কয়েকদিন কাটিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়ার উদ্যোগ নিত।

১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ অবস্থা চলছিল। এরপর হামলার ব্যাপ্তি ও তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। বিমান ও নৌবাহিনী পূর্ণোদ্যমে যুদ্ধে নামে। আমরা তখনাে তাদেরকে আটকে রেখেছিলাম সীমান্তে। ভারতীয়রা বিমান বাহিনীর ছত্রছায়া না পেলে অথবা আমি আমার কোটা অনুযায়ী ট্যাংক, দূরপাল্লার কামান ও বিমান বিধ্বংসী আর্টিলারি পেলে আমাকে কখনাে সীমান্ত থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে হতাে না। আমি শক্রদেরকে সেখানেই আটকে রাখতে পারতাম।  ভারতীয়দের কৌশল ছিল আমাদের নিয়মিত সৈন্যদের ওপর হামলা করা এবং তাদেরকে ঢাকা প্রত্যাহারের বাধা দেয়া। যত দ্রুত সম্ভব একটি বড় শহর দখল এবং এ শহরকে বাংলাদেশ হিসেবে ঘােষণা করা এবং এটাকে স্বীকৃতি দিয়ে নিজেদেরকে ত্রাণকর্তা হিসেবে জাহির করাই ছিল তাদের লক্ষ্য। যশাের থেকে আমাদের সৈন্য। প্রত্যাহারের পর তারা তাই করেছে। ৩০ ঘণ্টা পর তারা যশাের দখল করে এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর একটি যৌথ কমান্ড প্রতিষ্ঠা করে।  তারা আমাদের সৈন্যদের হত্যা এবং যানবাহন, গাড়ির ইঞ্জিন, রেললাইন, নৌকা ও ফেরি ধ্বংস করে। আমাদের যােগাযোেগ কাঠামাে ও যানবাহন ধ্বংসে। মুক্তিবাহিনী তাদের সহযােগিতা করে। সত্যি বলতে কি, তারা আমাদের পরিবহন। ব্যবস্থা ধ্বংসে সফল হয়। তবে শেষদিন পর্যন্তও পশ্চাদ্ভাগ ও ঢাকায় আমাদের কিছুটা চলাচলের সুযােগ ছিল।  উভয়পক্ষে হামলায় এয়ারফোর্স অংশ নেয়। ৮টি ভারতীয় ন্যাট ও মিগ-২১ আমাদের তিনটি এফ-৮৬-এর ওপর হামলা চালায়। ২৩ নভেম্বর যশােরে ভারতের একটি বিপরীতে আমাদের দুটি বিমান খােয়া যায়। সর্বাধিনায়ক হিসেবে প্রেসিডেন্ট এক বার্তায় আমাদের তৎপরতার প্রশংসা করেন এবং অভিনন্দন জানান।

১৯৭১-এর ২৯ নবেম্বরের মধ্যে আমরা প্রচণ্ড প্রতিরােধ গড়ে তুলি এবং তাদের। অগ্রাভিয়ান স্তব্ধ হয়ে যায়। তাদের প্রচুর প্রাণহানি ঘটে। | ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৩ দিনের যুদ্ধে ভারতীয়দের সকল সুবিধা। সত্ত্বেও তারা বিজয়ী হতে পারে নি। অন্যদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানে ৪ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ দিনের যুদ্ধে তারা হাজার হাজার বর্গমাইলব্যাপী ভূখণ্ড দখল করে নেয় এবং শিয়ালকোট ও ওয়াজিরাবাদে হুমকি সৃষ্টি করে। ভারতীয় নৌবাহিনী করাচি পােতাশ্রয় ও পাের্ট কাসিমে প্রাধান্য বিস্তার করে। এ সময় আমাদের। নৌবাহিনী অদৃশ্য হয়ে যায়। ভারতীয় বিমান বাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানের আকাশে আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করে। কিন্তু পাকিস্তান বিমান বাহিনী কোথাও কার্যকর প্রতিরােধ গড়ে তুলতে পারে নি। এ পর্যায়ে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতিকূল পরস্থিতির কারণে। (প্রসিডেন্ট আমাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। আমি অস্বীকৃতি জানালে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল হামিদ ব্যক্তিগতভাবে আমার সঙ্গে যােগাযােগ করেন এবং পশ্চিম পাকিস্তান রক্ষায় আমাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। 

পরিদর্শন

যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমি সবচেয়ে নাজুক এলাকাগুলাে সফর করি। সেগুলাে হচ্ছে : | ২৫ নভেম্বর আমি যশােরে ডিভিশন ও ব্রিগেড কমান্ডারদের সঙ্গে যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনা করি এবং নির্দেশ দেই যে, যে কোনাে মূল্যে সকল ঘাঁটি রক্ষা করতে হবে এবং অনুমতি ছাড়া অথবা ৭৫ শতাংশ হতাহত হওয়ার আগে সৈন্য। প্রত্যাহার করা যাবে না। সদর দপ্তরে ফেরার পর আমি আমার চিফ অভ স্টাফকে এ ব্যাপারে একটি লিখিত সংকেত পাঠানাের নির্দেশ দেই। নভেম্বরের শেষদিকে দর্শনা। থেকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দানের জন্য আমাকে অনুরােধ করা হয়। কয়েকটি ট্যাংক। নিয়ে মুক্তিবাহিনীর একটি প্লাটুন এ অবস্থান পেছনে ফেলে এগিয়ে গেলে আমাকে এ অনুরােধ জানানাে হয়। আমি ৯ ডিভিশনের জিওসি ও ৫৭ ব্রিগেডের কমান্ডারকে যতক্ষণ সম্ভব ততক্ষণ দর্শনা ধরে রাখার এবং পরে পরবর্তী প্রতিরক্ষা ব্যুহে পিছু হটার নির্দেশ দেই, কিন্তু ২ ডিসেম্বর দর্শনার পতন ঘটে। | ২৬ নভেম্বর আমি ১৬ ডিভিশনের জিওসির সঙ্গে যুদ্ধের পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনা করার জন্য নাটোর পরিদর্শন করি। পঞ্চগড়ে ২৩ ব্রিগেড যেভাবে লড়াই করছিল আমি তাতে সন্তুষ্ট হতে পারি নি। এজন্য জিওসি ব্রিগেড কমান্ডারকে কমান্ড থেকে অব্যাহতি দেন। আমি হিলিতে ২০৫ ব্রিগেডের অপারেশনে পুরােপুরি সন্তুষ্ট ছিলাম। হিলির দক্ষিণে ১০৭ ব্রিগেড মােতায়েন সম্পূর্ণ করায় সন্তুষ্ট হই আমি। সিলেট, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের আশেপাশে মােতায়েন ১৪ ডিভিশনে আমার সফরের ফলে তাদের অবস্থানে কিছুটা সমন্বয় করা হয়। এসব অবস্থান যেভাবে লড়াই। করছিল আমি তাতে পুরােপুরি সন্তুষ্ট হই। | সি-ইন-সি হিসেবে প্রেসিডেন্টকে আমাদের লড়াইয়ের প্রশংসা করতে হয়। ১৯৭১-এর ২৯ নভেম্বর তিনি এক বার্তায় বলেন :  সি-ইন-সি’র পক্ষ থেকে কমান্ডারের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে শত্রুর সর্বশেষ চ্যালেঞ্জ মােকাবিলায় আপনার কমান্ডের সকল সৈন্য ও আপনার বীরত্বপূর্ণ তৎপরতায় আমি অত্যন্ত মুগ্ধ। সমগ্র জাতি আপনার জন্য গর্বিত এবং আপনার প্রতি তাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। শক্রর অশুভ অভিপ্রায় নস্যাতে আমাদের সৈন্যদের সাহসী ভূমিকা সকল দেশবাসীর প্রশংসা অর্জন করেছে। শত্রুর মনোেবল চূর্ণ এবং আমাদের পবিত্র ভূমি থেকে তাদের পুরােপুরি নির্মূল না করা পর্যন্ত আপনাদের মহৎ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখুন। আল্লাহ আপনাদের সঙ্গে আছেন।

৩০ নভেম্বর ১৯৭১ আমি জবাব দিলাম :

“সি-ইন-সি’র প্রতি ইন্টার্ন কমান্ডের কমান্ডারের পক্ষ থেকে আমাদের জাতীয় জীবনের এ ক্রান্তিকালে আপনাকে পুনরায় আশ্বাস দিচ্ছি এবং নতুন করে শপথ দিচ্ছি। আমাদের ওপর ন্যস্ত অগাধ বিশ্বাসকে আমরা ইনশাল্লাহ পুরােপুরি সম্মান  করব এবং আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি রক্ষায় কোনাে ত্যাগই আমাদের কাছে বড় বলে। বিবেচিত হবে না। সর্বশক্তিমান আল্লাহর রহমতে আমরা ভারতের প্রাথমিক হামলা। নস্যাৎ করে দিয়েছি। আল্লাহ চান তাে, আমরা ইসলামের সর্বোচ্চ ত্যাগের আদর্শে অবিশ্বাসীদের অসৎ উদ্দেশ্য চূড়ান্তভাবে নস্যাৎ করে দিতে যুদ্ধকে ভারতের মাটিতে নিয়ে যাব। দোয়া করুন এবং বিশ্বাস করুন যে, চূড়ান্ত পর্যায়ে আমরাই বিজয়ী হব। ইনশাল্লাহ।” ২১ নভেম্বর থেকে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমরা ভারতীয়দের সীমান্তে ঠেকিয়ে রাখি এবং পূর্ব পাকিস্তান ও ভারতে কমান্ডাে ও গেরিলা তৎপরতা চালাই। কিন্তু ৩ ডিসেম্বর এ। পরিস্থিতি দ্রত ভিন্ন দিকে মােড় দেয় নেয়। সেদিন আমাদের প্রেসিডেন্ট। আমাদেরকে অবহিত না করে পশ্চিম রণাঙ্গনে বিলম্বিত, উদ্দেশ্যবিহীন ও। অপ্রয়ােজনীয় যুদ্ধ শুরু করেন। পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধ শুরু করতে যথেষ্ট বিলম্ব করা। হয়। বিলম্বে যুদ্ধ শুরু করায় সােভিয়েত ইউনিয়ন প্রকাশ্যে ভারতের পক্ষে যুদ্ধে। নামার সুযােগ পেয়ে যায়। এর ফলাফল হয়ে দাঁড়ায় মারাত্মক। আমি খুব সততার । সঙ্গে বিশ্বাস করি যে, ভারতীয়রা তাদের পাকিস্তানি অনুচরদের মাধ্যমে জেনারেল ইয়াহিয়াকে এ ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিভ্রান্ত করেছিলেন।

আমরা ভারতীয়দেরকে সীমান্তে থামিয়ে দিতে সফল হই। আমাদের ঘাটি ও দুর্গে অবস্থানরত কোম্পানি, ব্যাটালিয়ন ও ব্রিগেড়গুলােকে আমরা পূর্ণগঠিত করি। এবং ভারতীয় ভূখণ্ডে গােলাবর্ষণ করতে থাকি। এছাড়া, আমরা ভূখণ্ডের ভেতরেও লড়াই চালাতে থাকি। আমাদের চলাচলের যথেষ্ট সুযােগ ছিল এবং আমরা আমাদের পছন্দসই টার্গেটে হামলা এবং আমাদের নিজেদের ভূখণ্ডে সড়ক। অবরােধে সক্ষম ছিলাম। আমরা ভারতীয়দের জন্য বিস্তর ঝামেলা সৃষ্টি করছিলাম। ইয়াহিয়া পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধ শুরু না করলে ভারতীয়দের জন্য এ ঝামেলা। উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পেত। আমাদেরকে সাহায্য করার প্রয়ােজনে এ হামলা করা হয়ে। থাকলে তা করা উচিত ছিল ২১, ২২ অথবা বড়জোড় ২৩ নবেম্বর। তবে এ হামলা এমন এক সময় করা হয় যখন তা ভারতীয়দের জন্য সহায়ক বলে প্রমাণিত হয়।

কমান্ড রিজার্ভের অপারেশন

৫৩ ব্রিগেড ছিল কমান্ড রিজার্ভ। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, জেনারেল হেড। কোয়ার্টার্সের নির্দেশে এটাকে চাঁদপুর-লাকসাম সেক্টরে পাঠানাে হয়। নভেম্বরে। আমাকে ৮টি ব্যাটালিয়ন দেয়ার কথা ছিল। এ ব্যাটালিয়নগুলাে পাঠানাে হলে। আমার শক্তি বেড়ে যেত। ১৭ অক্টোবর সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল হামিদ আমার। হে একটি বার্তা পাঠান। এ বার্তায় তিনি বলেন : ‘বিদ্রোহী তৎপরতা সম্পর্কে আপনার ধারণা এখানে প্রাপ্ত রিপাের্টের আলােকে সত্য। বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। রিজার্ভের সাহায্যে বিদ্রোহ নির্মূলের পাশাপাশি ভারতের বিরুদ্ধে আপনার লড়াইয়ের একটি সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। আপনার কমান্ড রিজার্ভ ও প্রাপ্ত অন্যান্য রিজার্ভকে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে হবে। আপনার অতিরিক্ত সৈন্য পাঠানাের অনুরােধ বিবেচনাধীন রয়েছে।’ এটা পরিষ্কার যে, আমি কমান্ড রিভান্ডের গুরুত্বের কথা ভুলে যাই নি। জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স প্রতিশ্রত ব্যাটালিয়ন না পাঠিয়ে আমার সঙ্গে ইচ্ছাকৃতভাবে প্রতারণা করেছে। তাই রিজার্ভ পুনর্গঠনের চেষ্টা করি এবং খুলনায় কর্নেল হামিদের নেতৃত্বাধীন এডহক ব্রিগেডকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনি। ৩ ডিসেম্বরের মধ্যে চতুর্দশ ডিভিশনের একটি ব্যাটালিয়ন এবং সাবেক ৯ম ডিভিশনের কিছু সৈন্যও ঢাকায় পেীছে যায়। জেনারেল রহিমের এডহক ডিভিশনকে ঢাকা প্রত্যাহার করা হয় এবং নারায়ণগঞ্জে মােতায়েন করা হয়। ৯৩ এডহক ব্রিগেডকে ঢাকা তলব করা হয় এবং মিরপুর এলাকার বিপরীত দিকে তারা অবস্থান গ্রহণ করে। আমি ঢাকার প্রতি ইঞ্চি ভূমির জন্য লড়াই করতে প্রস্তুত ছিলাম এবং লড়াই করার জন্য সরকারি কোয়ার্টারগুলােতে অবস্থান গ্রহণ করি।

অঘােষিত যুদ্ধের পক্ষে ছিলাম আমি। কারণ এ যুদ্ধ অধিকাংশ ক্ষেত্রে সীমান্ত এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। তখন ভারতীয় বিমান বাহিনী আমাদের গভীর অভ্যন্তরে লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করতে আসে নি। ভারতীয় নৌবাহিনীও সমুদ্র অবরােধ অথবা নদী বন্দর কিংবা সমুদ্র উপকূলে হামলা চালাচ্ছিল না। এমনকি তারা আমাদের নদীতেও প্রবেশ করেনি। পিআইএ ফ্লাইট পশ্চিম পাকিস্তান থেকে চলাচল করছিল এবং ডাক ও কিছু অফিসার আসা-যাওয়া করতে পারছিলেন। মারাত্মক আহত ও রুগ্নদের পশ্চিম পাকিস্তানে অপসারণ সম্ভব হচ্ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরেরও কিছু কিছু বিমান চলাচল সম্ভব ছিল। নদী ও সড়ক পথেও যাতায়াত করা যেত। উদাহরণস্বরূপ, ২৫ নভেম্বর আমি যশাের যাই এবং ৯ ডিভিশনের একটি সেক্টরে যুদ্ধ তৎপরতা প্রত্যক্ষ করি। ২৬ নভেম্বর আমি ১৬ ডিভিশনের এলাকায় যাই এবং লে. কর্নেল মমতাজকে সঙ্গে নিয়ে হিলি সেক্টর পরিদর্শন করি। লে. কর্নেল মমতাজকে লে. কর্নেল আব্বাসীর স্থলাভিষিক্ত করা হয়। ৪ এফএফ-এর কমান্ডিং অফিসার কর্নেল আব্বাস আহত হয় এবং আগের দিন তাকে সরিয়ে আনা হয়। ৩ ডিসেম্বর আমি ময়মনসিংহ সেক্টরে যাই এবং ব্রিগেডিয়ার কাদির নিয়াজির নেতৃত্বাধীন ৯৩ এডহক ব্রিগেড পরিদর্শন করি। একইভাবে সমুদ্রপথও নিরাপদ ছিল। কারণ তখনাে ভারতীয় নৌবাহিনী সমুদ্রপথ অবরােধ করে নি। এজন্য জাহাজ চলাচলে কোনাে বাধা ছিল না। 

ভারতীয় এলাকায় গােলাবর্ষণের সুবিধাও আমার ছিল। তখন পর্যন্ত আমরা ভারতীয় এলাকায় গােলাবর্ষণ করছিলাম এবং কমান্ডাে ও গেরিলা হামলা চালাহিলাম। আমাদের এসব তৎপরতা কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়। ভারতীয়দের গােলাবারুদও অস্ত্রশস্ত্রের মুজদ ছিল তাদের নিজেদের ভূখণ্ডে। এগুলাের ওপর আমাদের হামলার আশংকায় আশপাশের বেসামরিক লােকজন ভারতীয় সীমান্ত থেকে ভেতরের দিকে সরে যাচ্ছিল। এতে শরণার্থী সমস্যা দেখা দেয়। তখনাে রুশরা প্রকাশ্যে যুদ্ধে যােগ দেয় নি। কিন্তু পশ্চিম রণাঙ্গনে অসময়ে ও দূরদর্শিতাপূর্ণ লড়াই শুরু হওয়ায় আমরা এতদিন যে সুবিধা কাজে লাগাচ্ছিলাম তা হাতছাড়া হয়ে যায়। তখন আমি বুঝতে পারলাম যে, এখন যা কিছু ঘটবে তা শুধু আমাদের ভূখণ্ডেই ঘটবে। | ২১ নভেম্বর ভারত যে অঘােষিত যুদ্ধ শুরু করেছিল পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধ শুরু হওয়ায় তার অবসান ঘটে। অঘােষিত যুদ্ধকালে আমরা তিন সপ্তাহ ভারতীয়দের সীমান্তে আটকিয়ে রেখেছিলাম। ইয়াহিয়া খান পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধ শুরু না করলে আমরা ভারতীয়দের সেখানে ঠেকিয়ে রাখতে পারতাম। অবশেষে চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হয় এবং তা পূর্ব পাকিস্তানের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে।

সীমান্তে অবস্থানরত বাঙালিরা দলে দলে ভারতীয়দের সঙ্গে যােগদান করে। ভারতীয় নৌবাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সমুদ্র যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তারা আমাদের নদীতে প্রবেশ করে। আমাদের উভয় পার্শ্বে ও পেছনে সৈন্য নামায়। আমাদের নৌকা ও ফেরির ওপর গােলাবর্ষণ শুরু করে এবং সমুদ্র উপকূল ও নদীর তীরে আমাদের অবস্থানে হামলা করে। আমাদের ৪টি গানবােট ভারতীয় যুদ্ধজাহাজে সামনে দাঁড়াতেই পারছিল না। ভারতীয় বিমান বাহিনী কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের চলাচল বিপর্যস্ত করে দেয়। ৬ ডিসেম্বর আমাদের একমাত্র বিমান ঘাঁটি ঢাকা বিমান বন্দরও বিধ্বস্ত হয় এবং আমাদের এক স্কোয়াড্রন জঙ্গি বিমান অকেজো হয়ে যায়। আমাদের অধিকাংশ সেতু, ফেরি, ফেরিঘাট, রেললাইন, রেলইঞ্জিন ও তেল মজুদ ধ্বংস হয় এবং আমাদের অবস্থান ও চলাচলের ওপর অবিরাম বিমান হামলা চলতে থাকে। ভারতীয় বিমান হামলায় আমাদের যেসব প্রয়ােজনীয় সাজ-সরঞ্জাম তখনাে ধ্বংস হয় নি বাঙালিরা সেগুলােও ধ্বংস করে। রুশরা ময়মনসিংহ সেক্টরে আমার সৈন্যদের বিরুদ্ধে বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহার করে। আমি আগেই কম-বেশি বিচ্ছিন্ন ও অবরুদ্ধ ছিলাম। কিন্তু পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধ শুরু হওয়ায় আমি পুরােপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই এবং পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরেও আমার যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দিনের বেলা চলাফেরা করার অর্থই ছিল। হয়তাে প্রাণহানি নয়তাে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি।

পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধের বিস্তার

১৯৭১ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৭২ সালের মার্চ পর্যন্ত পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধ শুরু করতে পরামর্শ দিয়েছিলাম আমরা এবং আরাে বলেছিলাম যে, যেখানে মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় ভারত আমাদের বিরদ্ধে সীমিত লড়াই করছে সেখানে সে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে পারে না। কিন্তু আমাদের এসব পরামর্শ ও নিষেধ উপেক্ষা করে পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধ শুরু করা হয়। আমরা জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সকে সতর্ক করে দিয়েছিলাম যে, ভারতের সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধের পরিণাম হবে খুবই ভয়াবহ। ১৯৭১-এর ২১ নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত যুদ্ধে আমাদের ধারণাই সঠিক বলে প্রমাণিত হয়। এ সময়ের যুদ্ধে শক্র উল্লেখযােগ্য সাফল্য লাভে ব্যর্থ হয় এবং ভারতীয় সৈন্যরা আত্মরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণে বাধ্য হয়। সকল ফ্রন্টে ভারতীয় সৈন্যদের ঠেকিয়ে রাখা হয়। ১৯৭১-এর ৩ ডিসেম্বর আমি সেনাবাহিনী প্রধানের কাছ থেকে একটি বার্তা পাই। বার্তায় আমাকে বলা হয়, “পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের সর্বাত্মক হামলার আশঙ্কা থাকায় আপনাকে বিদ্যমান পরিস্থিতির আলােকে সৈন্য মােতায়েন করতে হবে এবং নতুন নতুন অবস্থান দখলের প্রচেষ্টা চালানাের সময় কৌশলগত, রাজনৈতিক ও সামরিক গুরুত্ব রয়েছে এমন সব এলাকাকে বিবেচনায় আনতে হবে। একই দিন আমার কাছে আরেকটি বার্তা পাঠানাে হয়। এতে বলা হয় যে, ভারত কাশীর ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়েছে। আমি ১৯৭১-এর ২১ নভেম্বর যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিকল্পনা অনুযায়ী নয়া অবস্থান দখলে নির্দেশ জারি করেছিলাম । সেনাবাহিনী প্রধানের নির্দেশও ফরমেশন কমান্ডারদের কাছে পৌছে দেয়া হয়।

১৩ দিন পর সেনাবাহিনী প্রধান কৌশলগত, রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কেন নতুন করে সৈন্য মােতায়েনের নির্দেশ জারি করলেন, আমি তার কারণ বুঝতে পারি নি। কারণ ১৯৭১-এর ২১ নভেম্বর থেকে ভারতের সঙ্গে লড়াইয়ে ইতােমধ্যেই আমাদের সৈন্য মােতায়েন করা ছিল। সেনাবাহিনী প্রধান নিজেও এ ব্যাপারে পুরােপুরি অবহিত ছিলেন। মাত্র দু’সপ্তাহ আগে তিনি আমাদের যুদ্ধ পরিকল্পনা ও সৈন্য মােতায়েন অনুমােদন দিয়েছিলেন। এছাড়া, ২৯ নভেম্বর আমাদের তৎপরতার প্রশংসা করে সি-ইন-সি একটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন। জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স আমাদেরকে জানিয়েছিল যে, ভারত পশ্চিম পাকিস্তানে হামলা করেছে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, আমরাই পশ্চিম রণাঙ্গনে লড়াই শুরু করেছিলাম। জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স আমাদেরকে এ ভুল সংবাদ কেন পরিবেশন করেছিল, আমি তাও বুঝতে ব্যর্থ হই। জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স কি কয়েকদিন আগে একজন কুরিয়ারের মারফত পশ্চিম রণাঙ্গনে তাদের পরিকল্পিত হামলা সম্পর্কে আমাকে অবহিত করতে পারত না? অথবা তারা কি একজন কর্মকর্তাকে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠাতে জয় পালিয়েন এজেকি তাদের পূর্ব পাকিস্তান পরিত্যাগের পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যেত। অথবা ক্ষমতা থাকায় তাদের উগ্র মনোভাব ক্ষতি গ্রস্থ হতো। 

১৯৭১-এর ৫ ডিসেম্বর সেনাবাহিনী প্রধান নিম্নোক্ত বার্তা পাঠান :

শক্র আপনার বিরুদ্ধে চাপ জোরদার করেছে এবং তারা সম্ভবত এ চাপ সর্বোচ্চ মাত্রায় নিয়ে যাবে। শত্রু শিগগির পূর্ব পাকিস্তান দখলের চেষ্টা চালাবে এবং এরপর অধিকাংশ সৈন্য পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মােতায়েনের জন্য সেখানে তাদের স্থানান্তর করবে। এটা কোনােমতেই হতে দেয়া যাবে না। সামান্য ভূখণ্ড ছেড়ে দিতে হলে ছেড়ে দেবেন। তবে শক্রর অধিকাংশ সৈন্যকে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যস্ত রাখার জন্য আপনাকে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সৈন্য মােতায়েন অব্যাহত রাখতে হবে। খুব শিগগির চীনের সহযােগিতা পাওয়া যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। আপনার মঙ্গল কামনা করি এবং এ ধরনের প্রচণ্ড প্রতিকূলতার মুখেও আপনার চমৎকার নৈপুণ্য বজায় রাখুন।”

ওপরের বার্তা থেকে এটা স্পষ্ট যে পশ্চিম রণাঙ্গনে বিজয়ের ফয়সালা করার জন্য আমাদেরকে পূর্ব রণাঙ্গনে অধিকাংশ ভারতীয় সৈন্যকে যুদ্ধে ব্যস্ত রাখতে হবে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সুযােগ না দিতে আমাদেরকে ইতিপূর্বে যে দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছিল, সেনাবাহিনীর প্রধানের বার্তায়ও একই দিকনির্দেশনা ছিল। আমাদের কৌশলগত ধারণা থেকে ভাবছিলাম যে, ৫ ডিসেম্বরের পর যে কোনাে সময় চূড়ান্ত লড়াই শুরু হবে এবং সেনাবাহিনী প্রধান অত্যন্ত জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, কোনােক্রমেই সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে না। এতে একথাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, প্রেসিডেন্টের রাজনৈতিক নির্দেশনার আওতায় জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স অনুমােদিত পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদেরকে তখনাে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে । আমার ওপর ন্যস্ত নতুন মিশন সম্পন্ন করার কাজ আত্মসমর্পণের নির্দেশ দানের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এগিয়ে চলছিল। | হাই কমান্ডের যদি এই পরিকল্পনাই ছিল যে, ভারতের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের তরফ থেকে বড় ধরনের হামলা ছাড়াই ইস্টার্ন কমান্ডকে শত্রুদেরকে অনির্দিষ্টকাল আটকিয়ে রাখতে হবে তাহলে ৩ডিসেম্বর সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করা ছিল হাই কমান্ডের সবচেয়ে বড় ভুল। পশ্চিম রণাঙ্গনে তারা যদি যুদ্ধ শুরু করার পরিকল্পনা করে থাকে এবং এ পরিকল্পনায় ব্যর্থ হয়ে থাকে তবে এককভাবে তারাই দায়ী। ইস্টার্ন কমান্ডকে বাদ দিয়ে ভারতের সঙ্গে আমাদের শক্তির সর্বোত্তম ভারসাম্য ছিল। পশ্চিম পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে পদাতিক বাহিনীতে ছিল সমতা। এছাড়া, ভারতের সাজোয়া ডিভিশন যেখানে ছিল তিনটি সেখানে পাকিস্তানের হিল পাঁচটি। এজন্য আমি অবশ্যই বলব যে পাকিস্তানের জয়ের সম্ভাবনা ছিল পুরােপুরি। আমাদের কখনাে ভারতের সঙ্গে শক্তিতে এমন শ্রেষ্ঠত্ব ছিল।

এবং আমি মনে করি না যে, আমরা সেই জায়গায় কখনাে যেতে পারব। হাইকমান্ডের বােকামি ও সিদ্ধান্তহীনতা এবং রিজার্ভ বাহিনী নিয়ে পরিকল্পিত আঘাত হানতে জেনারেল টিক্কার ব্যর্থতার দরুন শক্তির ভারসাম্য শক্রর অনুকূলে চলে যায়। কৌশলগত ধারণা অনুযায়ী, পশ্চিম রণাঙ্গনে এ হামলার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর থেকে চাপ কমাননা এবং পশ্চিম রণাঙ্গনে অধিকৃত ভূখণ্ডের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের হারানাে ভূখণ্ড ফিরে পেতে দর কষাকষি করার কথা ছিল। | হাই কমান্ডের নিষ্ক্রিয়তা থেকে একথা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, পূর্ব পাকিস্তান। রক্ষায় তাদের কোনাে পরিকল্পনা ছিল না। চীন তৎপরতার উদ্ধৃতিতে আমরা ধারণা করতে থাকি যে, চীনের সহায়তায় পশ্চিম রণাঙ্গনে সর্বাত্মক যুদ্ধ চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারণ করবে। পূর্ব রণাঙ্গনে শক্রর অধিক সৈন্যকে ব্যস্ত রাখা এবং চীনা সহায়তার মানে ছিল যে, পশ্চিম রণাঙ্গনে আমাদের সুনির্বাচিত, সুরক্ষিত ও সুসজ্জিত অবস্থান থেকে চূড়ান্ত লড়াই শুরু হবে এবং এতে আমাদের ভাগ্যের ফয়সালা হবে। আমরা শত্রু বাহিনীকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার জন্য বেশ কটি হামলা চালাই এবং তাদেরকে এক মেরু থেকে আরেক মেরুতে স্থানান্তরে বাধ্য করি। আমরা তাদের চলাচল ব্যাহত করি এবং কয়েকটি রুটে তাদের প্রাধান্যকে ১:২ অথবা ১:৩ অনুপাতে নামিয়ে আনি। দেশের ভেতরে আমাদের সর্বশেষ লড়াইয়ের অবস্থানগুলােতে যেসব সড়ক ও মহাসড়ক এসে মিলিত হয়েছে সেগুলােতে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকি। আমাদের কমান্ডাে তৎপরতা এবং অন্যান্য অভিযান এবং আমাদের ধারাবাহিক প্রত্যাহারের মাধ্যমে আমরা সর্বোচ্চ সংখ্যক ভারতীয় সৈন্যদের ব্যস্ত রাখায় সফল হই। সক্ষম হই শক্রদেরকে আমাদের সুবিধাজনক অবস্থানের কাছাকাছি নিয়ে আসতে। বস্তুত, আমরা শক্রর ৬ মাউন্টেন ডিভিশনকে ঠেকিয়ে রাখি। তারা এ ডিভিশনকে পশ্চিম পাকিস্তানে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছিল।

১৯৭১-এর ৪ ডিসেম্বর আমরা জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স থেকে একটি সংকেত পাই। এতে আমাদেরকে ফেনির উত্তর-পূর্বদিকে সীমান্ত চৌকি পুনরায় দখল করার নির্দেশ দেয়া হয়। দৃশ্যত জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স আমাদেরকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিতে চেয়েছিল। পক্ষান্তরে, আমি সুরক্ষিত ঘাঁটিতে আমার অবস্থান সংহত করে তুলি। ৬ ডিসেম্বর জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সে আমার কৌশলগত ধারণা সম্পর্কে আমি একটি বার্তা পাঠাই এবং শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে লড়াই করার সংকল্প প্রকাশ করি । “এক :৩ ডিসেম্বর থেকে শত্রু সর্বাত্মক লড়াই শুরু করেছে এবং পূর্ব রণাঙ্গনের সকল ফ্রন্টে শক্রর হামলা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ৪টি পূর্ণাঙ্গ ট্যাংক রেজিমেন্টের সমর্থনে শত্রুর ৮ ডিভিশন সৈন্য এ হামলায় অংশ নিচ্ছে। এদের সঙ্গে আরাে রয়েছে ৩৯ ব্যাটালিয়ন বিএসএফ এবং ৬০ থেকে ৭০ হাজার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিদ্রোহী । বিমান বাহিনীর ছত্রছায়ায় শত্রুরা হামলা চালাচ্ছে। ভারতীয় বিমান বাহিনী আমাদের যােগাযােগ ব্যবস্থা ও মাধ্যমসহ সকল উপায়-উপকরণের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত উপকরণগুলাের মধ্যে রয়েছে সড়ক/সেতু/ফেরি/নৌকা প্রভৃতি । স্থানীয় জনগণও আমাদের বিপক্ষে। অভাবে শক্তিবৃদ্ধি, ঘাটতি পূরণ অথবা অবস্থানের পুনর্বিন্যাস কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। চট্টগ্রামের সঙ্গেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে যােগাযােগ। এতে আমাদের যােগাযােগ ব্যবস্থার আরাে অবনতি ঘটবে। ভারতীয় নৌবাহিনী চট্টগ্রাম বন্দরের প্রতি মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করেছে। এছাড়া, তারা সব নদীও অবরােধ করার চেষ্টা করছে। রংপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লাকসাম, চাঁদপুর ও যশােরের ওপরও প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়েছে। পরিস্থিতি হয়ে উঠতে পারে আরাে জটিল।

দুই নিজেদের সৈন্যরা গত নয় মাস ধরেই সক্রিয় লড়াইয়ে জড়িত রয়েছে এবং তারা আরাে তীব্র লড়াইয়ের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কার্যত তাদের কোনাে স্বস্তি অথবা বিশ্রাম নেই। বিগত ১৭ দিনের তীব্র লড়াইয়ে সৈন্য ও সাজ-সরঞ্জাম উভয় ক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা উল্লেখযােগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। নিজেদের ট্যাংক, কামান ও বিমানের ছত্রছায়া না থাকায় পরিস্থিতির ঘটেছে অবনতি। অস্ত্রসহ রাজাকারদের স্বপক্ষ ত্যাগের ঘটনাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিজেদের সৈন্যরা শত্রুদের ক্ষতি করেছে অনেক এবং সম্ভাব্য সর্বাধিক শত্রু সৈন্য হত্যা করেছে। স্থল হামলায় প্রতিটি সফলতার জন্য শত্রুকে প্রচুর মূল্য দিয়ে হয়েছে।  তিন এ কমান্ডের আওতায় ফরমেশনগুলাের বর্তমান তৎপরতা পূর্ব পরিকল্পিত প্রতিরক্ষা লাইনে পৌঁছেছে। দুর্গ অথবা সুরক্ষিত ঘাঁটিগুলােতে আশ্রয় গ্রহণ : শত্রুরা নীতিবিবর্জিত উপায়সহ সকল ধরনের পন্থা অবলম্বন করবে। আমরা শেষ রক্তবিন্দু ও শেষ বুলেট থাকা পর্যন্ত লড়াই করব।” সিজিএস ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ এক সংকেতের মাধ্যমে সুরক্ষিত দুর্গে সৈন্য প্রত্যাহারে আমার কৌশলগত ধারণা অনুমােদন করেন। উপরে বর্ণিত ঘটনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, যুদ্ধের শুরু থেকে যে কৌশলগত ধারণা গ্রহণ করা হয় এবং ইস্টার্ন কমান্ডের ফরমেশনে যা অনুসরণ করা হতাে জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সের কাছে তা গ্রহণযােগ্য বলে বিবেচিত হয়েছিল। এ কৌশলগত ধারণার লক্ষ্য ছিল শক্রর সর্বোচ্চ ক্ষতিসাধন, সর্বাধিক সংখ্যক শত্রু সৈন্যকে যুদ্ধে জড়িত করা, সময় নেয়া ও প্রত্যাহার করা এবং সুরক্ষিত দুর্গ ও অবস্থানে আশ্রয় নিয়ে যতক্ষণ সম্ভব ততক্ষণ লড়াই করা। ৮ ডিসেম্বর আমি সিজিএস এর কাছ থেকে জি-০৯১২ নম্বর আরেকটি সংকেত পাই। এতে বলা হয়, “তৎপরতা শুরু হয়েছে। ৭ ডিসেম্বর প্রেরিত জি-০৯০৭ সংকেত অনুযায়ী আপনি লড়াই অব্যাহত রাখুন।” “তৎপরতা’ বলতে মূলত চীনাদের তৎপরতার কথাই বােঝানাে হয়। জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স আমাকে ধােকা দিচ্ছিল। কারণ চীনারা তখনাে কোনাে যােগাযােগ করে নি অথবা সংকেত দেয় নি। ৬ ডিসেম্বর আমি যে বার্তা পাঠিয়েছিলাম তাতে শেষ রক্তবিন্দু ও শেষ বুলেট অবশিষ্ট থাকা পর্যন্ত লড়াই করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলাম। চিফ অভ জেনারেল স্টাফ আমার কৌশলগত ধারণা অনুমােদন করেছিলেন। এরপর আমার সঙ্গে কেন এ প্রতারণা করা হলাে?

 “এতে কোনাে সন্দেহ নেই যে, ৬ ডিসেম্বরের পর ইস্টার্ন ফ্রন্টে লড়াইয়ে ভারতের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। কারণ ভারতীয় সেনাবাহিনী সকল সুবিধা ভােগ করছিল। তাদের সৈন্য সংখ্যা ছিল উল্লেখযােগ্যভাবে বেশি। তারা ছিল অধিকতর সুসজ্জিত এবং আকাশ ও সমুদ্র পথে তাদের ছিল পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ । ভারতীয় সেনাবাহিনী সীমান্ত পর্যন্ত চমক্কার সরবরাহ লাইন প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং পূর্ব পাকিস্তানের নদনদী ও সড়ক-মহাসড়কে তাদের অবাধ বিচরণ ছিল। পক্ষান্তরে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং তাদের সরবরাহও ছিল অপর্যাপ্ত। পাকিস্তানিদেরকে স্থানীয় বৈরি জনগণেরও মােকাবেলা করতে হয়েছে। অন্যদিকে, মুক্তিবাহিনী ও আওয়ামী লীগ ভারতীয়দের সহায়তা দিয়েছে। ভারতীয়দের স্থানীয় গােয়েন্দা নেটওয়ার্কও ছিল চমৎকার। এগুলাে পাকিস্তানিদের ওপর জয়লাভে ভারতীয়দের যথেষ্ট সহায়ক হয়। উপরন্তু, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধিকাংশ। ইউনিট অন্তত ৬ মাস বিদ্রোহী বাহিনীর বিরুদ্ধে জটিল লড়াইয়ে জড়িত ছিল। এতে তারা শারীরিক ও মানসিক উভয় দিকে ক্লান্ত হয়ে পড়ে।”

(আর. সিসন ও এল. ই. রােজ-পৃষ্ঠা ২১৪)

সূত্র : দ্য বিট্রেয়াল অভ ইস্ট পাকিস্তান – লে. জে. এ. এ. কে. নিয়াজি (অনুবাদ)