মুক্তিবাহিনী ও আমাদের বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনী
মুক্তি বাহিনী
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সামরিক অভিযানের প্রতিক্রিয়ায় সব পূর্ব পাকিস্তানি পুলিশ, পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস, আনসার, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর কয়েকটি নিয়মিত ইউনিটের পূর্ব পাকিস্তানি সদস্যরা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এসব লােক নেতৃত্বসহ মুক্তিবাহিনীর নিউক্লিয়াস গঠন করে। ২৫ মার্চ ১৯৭১-এর পর বিদ্রোহী বাঙালি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৬২ হাজার। ভারতীয় ও রুশরা পর্যায়ক্রমে আরাে ১ লাখ ২৫ হাজার বেসামরিক লােককে প্রশিক্ষণ দেয়। এভাবে মুক্তিবাহিনীর মােট সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ ৮৭ হাজার ৫শ’। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৫০ হাজার লােক মুক্তিযােদ্ধাদের ছদ্মবেশে তাদের সঙ্গে যােগ দেয়। এছাড়া, হাজার হাজার সশস্ত্র বাঙালি সহায়তা দেয় মুক্তিবাহিনীকে। ২১ নভেম্বর ভারত পূর্ব পাকিস্তানে হামলা চালানাের আগ পর্যন্ত ৮ মাস আমরা পূর্ব পাকিস্তানে এ বিশাল বাহিনীকে কোণঠাসা করে রেখেছিলাম। ভারতীয় সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানে আগ্রাসন চালালে মুক্তিবাহিনী তাদের সঙ্গে যােগ দেয়। আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য বামপন্থী সংগঠনগুলাে রাজনৈতিক সংকটকালে গােপনে তাদের জঙ্গি গ্রুপগুলােকে সংগঠিত এবং তাদেরকে হালকা অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেয়। ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও প্রাক্তন সৈন্যরা বিপুল সংখ্যায় এসব সংগঠনে যােগদান করেন। তারা বিদ্রোহী নেতৃত্বের নিউক্লিয়াস গঠন করেন। ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল এসব লােক একত্রিত হয় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিবাহিনী নামে একটি পৃথক বাহিনী গঠন করে। ১৪ এপ্রিল কর্নেল এমএজি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।
প্রশিক্ষণ
১৯৭১ সালের মে নাগাদ পঞ্চাশ শতাংশ বিদ্রোহীকে নিরস্ত্র করা হয়। বাকিরা তাদের পূর্ব পরিকল্পিত নিরাপদ ঘাঁটিতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ভারতীয়রা সীমান্ত বরাবর ৫৯টি ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। এসব ক্যাম্পে বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রসজ্জিত করা হতাে। তাদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মধ্যে ছিল উদ্বুদ্ধকরণ ও আদর্শিক দীক্ষা দান। মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দানে ভারতীয়রা একজন মেজর জেনারেলকে নিযুক্ত করে। এসব ক্যাম্পে যেসব মৌলিক প্রশিক্ষণ দেয়া হতাে সেগুলাের মধ্যে অন্যতম ছিল অস্ত্র চালনা। তবে কমান্ডাে প্রশিক্ষণ এবং বিস্ফোরক, মাইন, গ্রেনেড প্রভৃতি ব্যবহারের ওপরও গুরুত্ব দেয়া হতাে। প্রশিক্ষণার্থীদের বােঝানাে এবং অপপ্রচার চালানাের জন্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে এমএনএ ও এমপিএ এবং অধ্যাপকদের নিয়ে যাওয়া হয়। তারা গেরিলাদের নিয়ােগ করছিলেন। দেশের অভ্যন্তরে এভাবে রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা গড়ে ওঠে। নদী যােগাযােগ বিঘ্ন করার লক্ষ্যে ভারতীয়রা পানির নিচে প্রশিক্ষণ দানের ওপর বিশেষ মনােযােগ দেয়। ভারতীয় নৌবাহিনীর কর্মকর্তারা সম্ভাব্য প্রশিক্ষণার্থীদের প্রাথমিক পরীক্ষা সম্পন্ন করত। এরপর তাদেরকে বিশেষ প্রশিক্ষণ শিবিরে পাঠানাে হতাে। প্রশিক্ষণের জন্য প্রায় ৩শ’ বিদ্রোহীকে আগরতলা থেকে কোচিনে পাঠানাে হয়। জানা গেছে যে, প্রায় ৩শ’ ডুবুরিকে পশ্চিমবঙ্গে ভাগিরথী নদীর তীরে পলাশীতে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এ প্রশিক্ষণ দেয়া হয় ভারতী নৌবাহিনী ও পাকিস্তান নেভির কয়েকজন স্বপক্ষত্যাগী প্রশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে। শিক্ষাগত যােগ্যতার ভিত্তিতে প্রশিক্ষণার্থীদের তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে এ প্রশিক্ষণ দেয়া হয় : বিজ্ঞানে স্নাতক :তাদেরকে দেয়া হয় দু’মাসের কারিগরি প্রশিক্ষণ। স্নাতক ডিগ্রির নিচে : তাদেরকে হালকা অস্ত্র, মর্টার, রকেট লাঞ্চার ও গ্রেনেড ব্যবহারে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। মানচিত্র পঠন এবং কমান্ডাে কৌশলও শিক্ষা দেয়া হয় তাদের।
ম্যাট্রিকের নিচে : তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় অন্তর্ঘাতক হিসেবে। তাদের বিভিন্ন ধরনের বিস্ফোরক, মাইন ও গ্রেনেড ব্যবহার এবং সেতু, কালভার্ট ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা উড়িয়ে দেয়ার প্রশিক্ষণও দেয়া হয়। লক্ষ্ণৌ ও দেরাদুনে প্রতিষ্ঠিত বিশেষ কেন্দ্রে আর্টিলারি ও সিগনাল প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আরাে জানা গেছে যে, ৮ জন রুশ বিশেষজ্ঞের একটি দল ভারতে বিদ্রোহীদের গেরিলা প্রশিক্ষণ দিয়েছে। বিদ্রোহীদের অভ্যন্তরে একটি কমান্ড কাঠামাে প্রতিষ্ঠায় নির্দিষ্ট সংখ্যক ছাত্রকে স্পেশাল অফিসার কমিশন প্রদান করা হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এসব তরুণ অফিসারকে তিন মাসের একটি প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। জানা গেছে যে, দেরাদুনে ভারতীয় সামরিক একাডেমিতে এ ধরনের প্রায় ৬শ’ তরুণ অফিসারকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
সংগঠন
বিদ্রোহীদেরকে সাধারণত মুক্তিযােদ্ধা সংক্ষেপে বলা হতাে এফএফ। তাদেরকে নিয়মিত ইউনিটে সংগঠিত করা হতাে। প্রতিটি ইউনিট ৫শ’ সদস্য নিয়ে গঠিত হয়। এসব ইউনিট স্বাধীন বাংলা রেজিমেন্ট (এসবিআর) হিসেবে পরিচিত ছিল। বিদ্রোহী ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর এবং কিছু বিদ্রোহী ছাত্রদের ব্যাটালিয়নে পুনর্গঠিত করা হয়। এটা জানা গেছে যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী তুরায় বিদ্রোহীদের দুটি ব্রিগেড গঠন করেছিল। প্রতিটি ব্রিগেডে সদস্য ছিল প্রায় ৩ হাজার। ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদেরকে সংগঠিত, প্রশিক্ষিত ও অস্ত্রসজ্জিত করে। মহিলাদের সংগঠিত করার কথাও জানা গেছে। কিন্তু তাদের উল্লেখযােগ্য কোনাে সাফল্যের কথা জানা যায়নি। বিদেশি সংবাদ মাধ্যমের অপপ্রচারে তাদের কর্মকাণ্ড ত্বরান্বিত হয়। গােটা প্রদেশকে ভাগ করা হয় ৮টি সেক্টরে। এসব সেক্টরের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয়ের দায়িত্ব ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বা বিএসএফ’র ওপর দেয়া হয়। পরে ভারতীয় সেনাবাহিনী এ দায়িত্ব গ্রহণ করে। প্রতিটি বাঙালি ব্রিগেডের সার্বিক কমান্ডের দায়িত্ব অর্পন করা হয় ভারতের নিয়মিত সেনাবাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ারের ওপর। ব্রিগেডিয়ার শাহ বেইগ সিং ও ব্রিগেডিয়ার জগজিৎ সিং আগরতলা ও তুরায় অবস্থিত বাঙালি ব্রিগেডগুলাের সার্বিক দায়িত্ব পালন করেন। বিদ্রোহীরা তুফান বাহিনী ও বিমান বাহিনী নামে আরাে দুটি বাহিনী গঠন করে। জানা গেছে যে, ভারতীয়রা রাশিয়ার আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় বেতাই এলাকায় বিদ্রোহীদের জন্য একটি বিমান ক্ষেত্র নির্মাণ করেছিল। বাংলাদেশের পতাকা সম্বলিত দুটি বিমান সীমান্তের কাছাকাছি দেখা গেছে। পাকিস্তান এয়ার ফোর্স অকেজো হয়ে গেলে এ দুটি বিমান তৎপরতা শুরু করে।
শক্তি
জুনের শেষ দিকে প্রায় ৩০ হাজার বিদ্রোহীকে তড়িঘড়ি করে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় । তাদেরকে হালকা অস্ত্র, গ্রেনেড, রকেট লাঞ্চার ও বিস্ফোরক ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। নভেম্বরের শেষ নাগাদ আমরা জানতে পারি যে, ইতােমধ্যে ৭০ হাজার বিদ্রোহীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে এবং বিভিন্ন ক্যাম্পে আরাে ৩০ হাজার লােককে দেয়া হচ্ছে। বিপুল সংখ্যক বিদ্রোহী ক্যাম্প ত্যাগ করে ভারত থেকে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসে। তারা তাদের বাড়ি-ঘরে নিষ্ক্রিয়ভাবে অবস্থান করতে থাকে। ভারতীয় বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের দিকে অগ্রাভিযান শুরু করলে তারা মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যােগ।
দেয়
অস্ত্রশস্ত্র ও সাজ-সরঞ্জাম ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের সেকেলে অস্ত্র দিয়ে মুক্তিবাহিনীকে সজ্জিত করে। তবে আধুনিক কিছু অস্ত্রও দেয়া হয়। এছাড়া, মুক্তিবাহিনী তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল বিভিন্ন বিদেশি সূত্র যেমন- ইসরাইল, সােভিয়েত ইউনিয়ন, বেলজিয়াম ও চেকোশ্লোভাকিয়া এবং হংকংয়ের মতাে দূরপ্রাচ্যের বাজার থেকে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমাদের সৈন্যরা বিদ্রোহী ডুবুরিদের কাছ থেকে রাশিয়ায় তৈরি লিমপেট মাইন উদ্ধার করে। বিদ্রোহীদের কাছ থেকে কিছু মার্কিন অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। চট্টগ্রামে একটি মার্কিন ৫৭ এমএম রিকয়েললেস রাইফেল উদ্ধার করা হয়। ইতিপূর্বে চুয়াডাঙ্গা থেকে আরাে দুটি মার্কিন রিকয়েললেস রাইফেল (আরআর) উদ্ধার করা হয়। জানা গেছে যে, ভারতের পরামর্শে বাংলাদেশী নেতৃবৃন্দ ২৫ লাখ ডলার মূল্যের বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রসহ ভারী অস্ত্র ক্রয়ের জন্য জাপানে ইসরাইলী কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। ইসরাইল দু’মাসের মধ্যে ২০ লাখ ডলার মূল্যের ভারী অস্ত্র বাংলাদেশে সরবরাহে সম্মত হয়।
যােগাযােগ
ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের পুরনাে মজুদ থেকে বিদ্রোহীদের কয়েকটি ওয়্যারলেস সেট ও অন্যান্য যােগাযােগ সরঞ্জাম সরবরাহ করেছিল। গেরিলা তৎপরতার সুনির্দিষ্ট প্রয়ােজন মেটাতে বিদ্রোহীরা জাপানে তৈরি কয়েকটি নতুন বহনযােগ্য নেতার যন্ত্রও ব্যবহার করেছিল। তবে তারা যােগাযােগ সরঞ্জাম বিশেষ করে রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের ব্যাপারে পুরােপুরি ভারতের ওপর ছিল নির্ভরশীল।
নতুন গেরিলা কৌশল
ক) গেরিলাদের অনুপ্রবেশ : ভারতীয় সৈন্যদের তীব্র গােলাবর্ষণের আড়ালে সর্বদা গেরিলাদের অনুপ্রবেশ ঘটত। গেরিলারা রাইফেল গ্রুপ’ ‘বিস্ফোরক গ্রুপ’ নামে দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে অনুপ্রবেশ করত। রাইফেল গ্রুপ বিস্ফোরক গ্রুপের অনুপ্রবেশ আড়াল এবং আগাম হুঁশিয়ারি ও প্রতিরক্ষা প্রদানে এ গ্রুপের আগে আগে এগিয়ে আসত। এছাড়া, রাইফেল গ্রুপ সৈন্যদের ব্যস্ত রাখার দায়িত্ব পালন করত। এ ফাকে বিস্ফোরক গ্রুপ তাদের মিশন সম্পন্ন করে নিরাপদে সরে যেত। প্রতিটি গ্রুপের জন্য স্থানীয় অপারেশন এলাকার অভিজ্ঞ গাইড ছিল।
খ) গেরিলা তৎপরতা : প্রতিটি থানা এলাকাকে একটি সাব-সেক্টর হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং প্রতিটি সাব-সেক্টরকে আবার চার ভাগে ভাগ করা হয়। একটি ভাগে। মাত্র গেরিলা তৎপরতা চালানাে হতাে এবং বাকি তিনটি ভাগকে আশ্রয় কেন্দ্র ও গােপন আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করা হতাে। দেশের ভেতরে গেরিলা তৎপর চালানাের জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিদ্রোহী ছাত্রদের পাঠানাে হতাে। অন্যদিকে নিয়মিত বাহিনী, প্রাক্তন এবিআর ও ইপিআরকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সীমান্ত এলাকায় মােতায়েন করা হতাে। বিদ্রোহীরা অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়ার লক্ষ্যে শক্তি প্রয়ােগে সরকারি কর্মকর্তা, কৃষক ও শ্রমিকদেরকে কাজে যােগদান থেকে বিরক্ত রাখত। অক্টোবরের শেষ নাগাদ ভারতীয় সেনাবাহিনীর আওতায় বিদ্রোহীরা তাদের প্রশিক্ষণ প্রায় সম্পন্ন করে ফেলে এবং তারা সুসজ্জিত হয়। কয়েকটি কমান্ড কাঠামাের ব্যবস্থা থাকায় তারা ভালােভাবে সংগঠিত হয়। তখন পর্যন্ত তারা অপ্রচলিত ও সীমিত লড়াই করার মতাে অবস্থায় ছিল। তাদের মূল দুর্বলতা নিহিত ছিল লজিস্টিক ও ফায়ার সাপাের্টে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় এ ঘাটতি অনেকখানি পূরণ হয়। বিদ্রোহীদেরকে সীমান্ত চৌকি (বিওপি) দখলে পাঠানাে হয় এবং সীমান্তের বাইরে থেকে তাদেরকে আর্টিলারি ফায়ার সাপাের্ট দেয়া হয়। | অত্যন্ত শিক্ষিত ও রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিদের নিয়ে বিদ্রোহীদের মূল অংশ গঠিত হয়। সময়ের ব্যবধান এবং ভারতীয়দের সক্রিয় সমর্থনে বেড়ে যায় তাদের। মনােবল। ভারতীয় সাহায্যে মুক্তিবাহিনী দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। মুক্তিবাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য একটি শ্রেষ্ঠতম সম্পদ হিসেবে প্রমাণিত হয়। এ কারণে ভারত তাদেরকে যুদ্ধের সব ক্ষেত্রে মূল্যবান সহযােগিতা প্রদান করে।
গ) ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রতি সমর্থন : বাঙালি জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য একটি বিরাট সুবিধা। এটা আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় বিপর্যয় হিসেবে বিবেচিত হয়। বাঙালি জনগণ ভারতীয় সেনাবাহিনীকে মূল্যবান গােয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করে। বাঙালিদের কাছ থেকে এ ক্ষেত্রে সহযােগিতা না পেলে ভারতীয়দেরকে টহল দল পাঠিয়ে এবং প্রচুর রক্তের বিনিময়ে গােয়েন্দা তথ্য পেতে হতাে। মুক্তিযােদ্ধারা ভারতীয় সেনাবাহিনীকে শ্রম ও বস্তুগত সহযােগিতা দিয়েছে এবং তারা তাদেরকে আমাদের অবস্থান চিনিয়ে দিয়েছে। তারা আমাদের সৈন্য চলাচল সম্পর্কে শত্রুকে আগাম তথ্য সরবরাহ। করেছে এবং আমাদের ওপর হামলা চালাতে তাদের সাহায্য করেছে। স্থানীয় লােকজনের সক্রিয় সহযােগিতা ও দিকনির্দেশনায় ভারতীয় কমান্ডাররা তাদের অপারেশন এলাকা পরিদর্শন এবং তাদের ওপর আবদ্ধ কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম। হয়। স্থানীয়রা সেতু, কালভার্ট ও সড়ক নির্মাণে শ্রম দেয়। তারা ভারতীয় সৈন্য পারাপারে দেশি নৌকা, ইঞ্জিনচালিত নৌকা, গরুর গাড়ি, সাইকেল, রিক্সা এমনকি কুলি পর্যন্ত সরবরাহ করে। তারা শত্রুর গতি ও চলাচল বৃদ্ধিতে সহায়তা দেয়।
“লিবারেশন ওয়ার’-এ ভারতীয় লেখক বলেছেন যে সমগ্র জনগণ পক্ষে থাকায় ভারতীয় সেনাবাহিনীকে দেশব্যাপী অভিযান চালাতে অথবা পাকিস্তানি সৈন্যদের সম্পর্কে গােয়েন্দা তথ্য পেতে মােটেও বেগ পেতে হয়নি। স্থানীয় জনগণের সহায়তা না পেলে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সীমান্তে যুদ্ধ করতে হতাে। ভারতীয় ও রুশরা সহায়তা না দিলে বাঙালিরা কখনাে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সাহস পেত না। বাঙালি ও রুশরা সহযােগিতা না দিলে ভারতীয়রা কখনাে সীমান্ত অতিক্রম করার দুঃসাহস দেখাতে পারতাে না। আমাকে মার-খাওয়া ও পিছু-হটা গেরিলাদের পশ্চাদ্ধাবনে ভারতে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হলে এসব ঘটনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যেত। ভারত দ্বিখণ্ডিত হয়ে যেত, বাঙালিরা একটি উচিৎ শিক্ষা পেত এবং পাকিস্তান ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারতাে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথমদিকে বিদ্রোহীদের সাফল্য সম্পর্কে ভারতীয় প্রচার মাধ্যমে অতিরঞ্জিত ও বানােয়াট কাহিনী প্রচার করা হতে থাকে। কিন্তু প্রকৃত যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে ভারতীয় প্রচার মাধ্যম মুক্তিবাহিনীর সফলতাকে খাটো করার চেষ্টা করে। এটা ছিল মুক্তিবাহিনীর ভূমিকাকে তুচ্ছ করে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে গৌরবান্বিত করা এবং ভারতীয় সৈন্যদেরকে কৃতিত্বের সকল ভাগ দেয়ার একটি প্রচেষ্টা। মুক্তিবাহিনীর ছদ্মবেশে ভারতীয় সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করেছিল। কিন্তু ভারত সরকার কখনাে তা স্বীকার করতাে না। তবে হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল এবং কয়েকটি সেতু ধ্বংসের ঘটনায় ভারতীয় সৈন্যদের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রমাণিত হয়।
আমি ভারতে যুদ্ধবন্দি হিসেবে থাকাকালে ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় এসব ঘটনা পড়েছি। এছাড়া কিছু বই-পুস্তকেও ভারতীয় সৈন্যদের অনুপ্রবেশের বিবরণ ছাপা হয়। আমি সেগুলােও পড়েছি। কিছু কিছু ভারতীয় নেতৃবৃন্দ প্রকাশ্য যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে অনুগত পূর্ব পাকিস্তানিদের ওপর হামলা, অন্তর্ঘাতমূলক কাজ, মাইন পোঁতা প্রভৃতিতে মুক্তিবাহিনীর ছদ্মাবরণে ভারতের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্যদের বিশাল অংশগ্রহণের কথা স্বীকার করেছেন। | পাকিস্তানের ভাঙনে মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সাম্রাজ্যবাদী দুরভিসন্ধি ও ম্যাকিয়াভেলীয় কৌশল অবলম্বনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযােগ্য সাক্ষ্য দিয়েছেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মােরারজি দেশাই। মােরারজি দেশাই স্বীকার করেছেন যে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ ছিল মিসেস গান্ধীর ইচ্ছাকৃত ও পরিকল্পিত। তিনি আরাে বলেছেন যে, মিসেস গান্ধী মুক্তিবাহিনীর ছদ্মবেশে সাদা পােশাকে হাজার হাজার ভারতীয় সৈন্যকে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠিয়েছিল এবং ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত লড়াইয়ে ৫ হাজার ভারতীয় সৈন্য নিহত হয়েছে। দেশাই আরাে বলেছেন, অধিকাংশ মুক্তিবাহিনী ছিল মূলত ভারতীয় সৈন্য । এ জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর চিফ অভ স্টাফ জেনারেল মানেকশ প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর কাছে গিয়ে বলতে বাধ্য হন, এটা হতে পারে না। এভাবে ভারতীয় সৈন্যদের মরতে দেয়া যায় না। আপনি হয় তাদের ব্যারাকে ফিরিয়ে আনুন নয়তাে পাকিস্তানের সঙ্গে প্রকাশ্য যুদ্ধে তাদের লড়াই করতে দিন।
বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনী
পূর্ব পাকিস্তান বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনী (ইপকাফ)
মার্চে সামরিক অভিযানের পর ইপকাফ গঠন করা হয়। এ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল ১৩ হাজার। পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের অবাঙালিদের নিয়ে মূলত এ বাহিনী গঠন করা হয়। তাদের অস্ত্রশস্ত্র, সাজ-সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ সুবিধার মারাত্মক ঘাটতি ছিল। তারা সীমান্তে বিওপি প্রহরায় প্রয়ােজনীয় কাজের যােগান দেয় এবং মারাত্মক বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে । তারা ভেতরেও কয়েকটি অবস্থানে শক্তি বৃদ্ধি করে। যেখানে তারা সেনাবাহিনীর সহযােগিতা পেয়েছে সেখানে তারা বেশ দক্ষতা দেখাতে পেরেছে। কিন্তু যেখানে তারা সেরকম সহযােগিতা পায়নি সেখানে তারা শত্রুর বিরুদ্ধে টিকে থাকতে পারেনি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রথম আঘাতেই তারা তাদের। অবস্থান ত্যাগ করেছে।
ভালনারেল পয়েন্ট ফোর্স (ভিপিএফ)। ৩ হাজার সদস্য নিয়ে গঠিত এ বাহিনীর কাজ ছিল গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা ও রেল সেতু, গ্যাস ও বিদ্যুৎ স্থাপনা, যােগাযােগ কেন্দ্র প্রভৃতি রক্ষা করা। এ বাহিনীতে ছিল ২২টি কোম্পানি। এর মধ্যে ৮টি কোম্পানি গঠিত হয় প্রাক্তন সৈনিকদের নিয়ে। এদেরকে। নিয়ােগের সঙ্গে সঙ্গে মােতায়েন করা হয়। বাকি ১৪টি কোম্পানি গঠিত হয় প্রশিক্ষণবিহীন লােকজন নিয়ে। এ কারণে এদের প্রশিক্ষণে মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয়। ফলে এদের মােতায়েন করতে বিলম্ব ঘটে। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি নাগাদ তাদেরকে মােতায়েন করা যাবে বলে ধারণা করা হয়েছিল।
শিল্প নিরাপত্তা বাহিনী (আইএসএফ)। এ বাহিনীর গঠন ও শক্তি ছিল অনেকটা ভিপিএফ-এর মতাে। পশ্চিম পাকিস্তানি লােকজনকে নিয়ে এ বাহিনী গঠন করা হয়। তাদেরকে মিলকারখানা ও শিল্পাঞ্চলের মতাে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলাে রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়। এ বাহিনীর ২২টি কোম্পানির মধ্যে ৮টি গঠিত হয় প্রাক্তন সৈন্যদের নিয়ে। সুতরাং পূর্ব পাকিস্তানে গিয়ে পৌছানাে মাত্র আমরা তাদেরকে মােতায়েন করতে পারতাম। বাদবাকিরা ছিল। প্রশিক্ষণবিহীন। তাদের প্রশিক্ষণেও একইভাবে মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয়। তাই তাদেরকে সরাসরি সার্ভিসে পাঠানাে যায়নি। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি নাগাদ তাদেরকে সার্ভিসে পাঠানাে যাবে বলে আশা করা হচ্ছিল।
ইপকাফ বিশেষ বাহিনী সর্বোচ্চ ১০ হাজার সদস্য নিয়ে একটি বিশেষ ইপকাফ বাহিনী গঠন করা হয়। এ বাহিনীর লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানে ইপকাফের শক্তি বৃদ্ধি করা। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় এ বাহিনীকে পূর্ব পাকিস্তানে মােতায়েন করা সম্ভব হয়নি।
পুলিশ প্রদেশে পুলিশ বাহিনীর মােট শক্তি ছিল সাড়ে ১৬ হাজার। সাবেক পূর্ব পাকিস্তান পুলিশ বাহিনীর সাড়ে ১১ হাজার এবং পশ্চিম পাকিস্তান পুলিশের আরাে ৫ হাজার সদস্য নিয়ে নয়া পূর্ব পাকিস্তান পুলিশ বাহিনী গঠন করা হয়। পুরনাে পূর্ব পাকিস্তান পুলিশ : পুরনাে পূর্ব পাকিস্তান পুলিশ বাহিনীর সদস্য নিয়ে মূলত এ বাহিনী গঠন করা হয়। পুলিশ বাহিনীর এসব সদস্য ২৫ মার্চের সামরিক অভিযান প্রত্যক্ষ করেছিল। সামরিক অভিযানের শুরুতে ব্যাপকভাবে দল ত্যাগ করায় পূর্ব পাকিস্তান পুলিশ বাহিনীর বাদবাকি অংশ হতােদ্যম ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। প্রথমদিকে তাদেরকে নিরস্ত্র করতে হয়। তবে পরে নতুন নিয়ােগ এবং পশ্চিম পাকিস্তান পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্যকে বদলি করে এদের সঙ্গে একত্রিত করা হয় এবং এ বাহিনীকে শক্তিশালী করা হয়। তাদেরকে মফস্বল এলাকায় থানা রক্ষায় মােতায়েন করা হয়। বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়াইয়ে তারা সাধারণত নিষ্ক্রিয় থাকত এবং দ্বিধাগ্রস্ত হতাে। বস্তুতপক্ষে, তারা ছিল অকার্যকর এবং তারা প্রশাসন অথবা সেনাবাহিনীর কোনাে কাজেই আসেনি। তারা ছিল অবিশ্বস্ত এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী। তারা আনুগত্য পরিবর্তন করত। তাদের কারাে কারাে সঙ্গে বিদ্রোহীদের যােগাযােগ। ছিল। সময় সুযোেগ মতাে তারা তাদের অবস্থান ত্যাগ করত।
নতুন পূর্ব পাকিস্তান পুলিশ : ব্যাপকভাবে দলত্যাগ ও পলায়নের ফলে পূর্ব পাকিস্তান পুলিশ বাহিনীতে ঘাটতি দেখা দেয়। এ ঘাটতি পূরণে এ বাহিনীতে নতুন করে সাড়ে ১১ হাজার সদস্যকে নিয়ােগ দিতে হয়। এ নতুন বাহিনী বিদ্রোহীদের মােকাবিলা এবং থানায় তাদের হামলা রােধে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে। সন্তোষজনক কার্যকলাপের জন্য তাদের কারাে কারাে দ্রুত পদোন্নতি ঘটে। এ বাহিনী যথেষ্টভাবে অস্ত্রসজ্জিত না হওয়ায় তারা তাদের চেয়ে উন্নততর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও অধিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বিদ্রোহীদের সামনে দাঁড়াতে পারত না। পশ্চিম পাকিস্তান পুলিশ : পূর্ব পাকিস্তান পুলিশ বিশেষ করে মফস্বল এলাকায় কর্মরত পুলিশের শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান পুলিশের ৫ হাজার সদস্যের একটি দলকে প্রদেশে নিয়ে আসা হয়। গােটা পূর্ব পাকিস্তানে এদের ছড়িয়ে দেয়া হয়। তারা শুরুতেই যথেষ্ট উৎসাহ প্রদর্শন করে এবং থানায় বিদ্রোহীদের হামলা মােকাবিলায় অত্যন্ত সাহসের পরিচয় দেয়। মুজাহিদ নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে কয়েকটি মুজাহিদ ব্যাটালিয়ন ও স্বতন্ত্র মুজাহিদ কোম্পানিকে অপারেশনাল ডিউটিতে মােতায়েন করা হয়। তাদের কমান্ডাররা ১৯৭১ সালের নভেম্বরে পূর্ব পাকিস্তানে পৌছতে শুরু করে। এদের অস্ত্রশস্ত্র ও সাজ-সরঞ্জামের
অভাব ছিল। জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সে মিলিটারি অপারেশন ও ইনফ্যান্ট্রি ডাইরেক্টরেটের নজরেও বিষয়টি ছিল। কিন্তু তাদের নিজস্ব সীমাবদ্ধতার জন্য তারা কিছু করতে পারেনি। মুজাহিদ বাহিনীর অধিকাংশ সদস্যই ছিল স্থানীয় । তবে তাদের খুব কম সদস্যই ক্যাম্প ত্যাগ করেছে। রাজাকার একটি সংগঠিত রাজাকার বাহিনী গঠনের প্রস্তাব দীর্ঘদিন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দপ্তর ও জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সে বিবেচনাধীন ছিল। এদের নিয়ােগ আগে থেকে শুরু হলেও ১৯৭১ সালের আগস্টে রাজাকার বাহিনী গঠনের অনুমােদন দেয়া হয়। একটি পৃথক রাজাকার ডাইরেক্টরেট প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং সমগ্র কাঠামাে একটি পরিপূর্ণ রূপ নিতে থাকে। আল-বদর ও আল-শামস নামে আরাে দুটি পৃথক বাহিনী গঠন করা হয়। স্কুল-মাদ্রাসায় শিক্ষালাভকারীদের আল-বদর বাহিনীতে। নিয়ােগ দেয়া হয়। তাদের স্পেশাল অপারেশনের জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আলশামসকে সেতু, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও অন্যান্য এলাকা রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়। | সেনাবাহিনী যেখানে তাদের নিয়ন্ত্রণ ও কাজে লাগাতে পারবে বলে ধারণা করে। সেসব এলাকায় রাজাকারদের মােতায়েন করা হয়। পূর্ণাঙ্গভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত না হওয়ায় স্থানীয় প্রভাবের কারণে তাদের মধ্যে দলত্যাগের মনােভাব জেগে ওঠে। ১৯৭১ সালের অক্টোবর তাদের স্বপক্ষত্যাগের ঘটনা বিস্ময়করভাবে বৃদ্ধি পায়। এসব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও যেসব এলাকায় ডানপন্থী দলগুলোর শক্তি ও স্থানীয় প্রভাব ছিল সেসব এলাকায় নিয়ােজিত রাজাকাররা অত্যন্ত সহায়ক বলে বিবেচিত হয়েছে। বিদ্রোহীরা তাদের ও তাদের পরিবারের ওপর নির্যাতন চালিয়ে এবং ভয়-ভীতি প্রদর্শন করেছে। রাজাকারদের প্রশিক্ষণের খুবই প্রয়ােজন ছিল। কিন্তু প্রতিকূলতার জন্য ইস্টার্ন কমান্ড তাদের প্রয়ােজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে পারেনি। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে স্পেশাল ট্রেনিং টিম পাঠানাের জন্য জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সে সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনাে সাড়া পাওয়া যায়নি। | রাজাকার বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল ৫০ হাজার। প্রদেশের প্রায় সব জেলাতে তাদের মােতায়েন করা হয়। এরা তাদের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ৭০ শতাংশ অর্জন করেছিল। রাজাকার প্লাটুন ও কোম্পানি কমান্ডারদের প্রশিক্ষণ দানে ব্যাটল স্কুল। প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এ বাহিনীকে একটি কার্যকর কমান্ড কাঠামাে প্রদানে প্রায় ৬০ জন তরুণ অফিসারকে রাজাকার গ্রুপ কমান্ডার হিসেবে নিয়ােগ দানের জন্য। বাছাই করা হয়।
রাজাকারদের অত্র যুদ্ধ ক্ষেত্রে যারা ছিলেন এবং যাদের সঙ্গে রাজাকার ছিল তাদের প্রত্যেকেরই অভিমত ছিল যে, রাজাকার বাহিনীকে একটি সত্যিকার বাহিনী হিসেবে গড়ে তােলার লক্ষ্যে তাদেরকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সজ্জিত করতে হবে। রাজাকারদের যেসব অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছিল, বিদ্রোহীদের অস্ত্রশস্ত্র ছিল সেগুলাের চেয়ে অনেক উন্নত । প্রতিটি রাজাকার প্লাটুনকে একটি করে হালকা মেশিনগান ও একটি স্টেনগান দিতে হলে আমাদের কমপক্ষে ২৫০০টি হালকা মেশিনগান ও সমপরিমাণ স্টেনগানের প্রয়ােজন ছিল। কিন্তু আমরা তাদেরকে মাত্র ২৭৫টি এলএমজি ও ৩৯০টি স্টেনগান দিতে পেরেছিলাম। এতে রাজাকারদের মনােবল মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাদের এ মানসিকতার প্রকাশ ঘটে। রাজাকাররা ধারণা করতে শুরু করে যে, তাদেরকে বিশ্বাস করতে না পারায় আমরা তাদের উন্নত অস্ত্রশস্ত্র দিচ্ছি না। ভারতীয় অপপ্রচার এবং স্থানীয় নেতিবাচক প্রভাবে তাদের এ ধারণা আরাে বদ্ধমূল হয়। তাদের নিয়ন্ত্রণ এবং যথাযথভাবে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে পশ্চিম পাকিস্তান পুলিশ ও অবাঙালি অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে রাজাকারদের মিশ্রিত করা হয়।
সূত্র : দ্য বিট্রেয়াল অভ ইস্ট পাকিস্তান – লে. জে. এ. এ. কে. নিয়াজি (অনুবাদ)