এসব কি ইসলামের আদর্শ ও শিক্ষা
বাংলাদেশের সচেতন নাগরিকরা সবাই জানেন, পবিত্র ইসলামের মুখােশধারী এদেশের একটি বিশেষ মহল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর সক্রিয় সহযােগিতা করেছে। তারা রাজাকার, আল বদর ও আল শামস বাহিনী গঠন করে। ধর্মমত নির্বিশেষ বাঙালিদের হত্যা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলােতে, এমনকি পরবর্তীকালেও পাঞ্জাবি-পায়জামা টুপি পরা লােক দেখলে সাধারণত মনে হতাে এরা রাজাকার-আলবদর। এই ধারণা এখনাে রয়েছে। দেশে প্রচলিত এই ধারণা বস্তুনিষ্ঠ নয়। কারণ সকল পাঞ্জাবি-পায়জামা টুপিধারী, অন্যভাবে বলা যায়, সব আলেম-ওলামা রাজাকার-আল বদর কিংবা পাকিস্তানী হানাদারদের সহযােগী ছিল না। বস্তুত জামাত, নেজামে ইসলাম ও অধিকাংশ মুসলিম লীগপন্থীরা হানাদার বাহিনীর সহযােগিতা করেছে। আর দেশের সব আলেম জামাত ও নেজামে ইসলামপন্থী ছিলাে না এবং এখনাে নেই। আলেমদের একটা অংশ সেদিন জামাত-নেজামী রাজনীতি করতাে এবং এখনাে করে। এই শ্রেণীটিই মুক্তিযুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর সহযােগিতা করেছে। কিন্তু তাই বলে রাজাকার-আলবদর সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা পােষণকারীদেরও দোষারােপ করা চলে না। কারণ তারা দেখেছে, সংবাদপত্র ও অন্যান্য গণমাধ্যমে বিবৃতিবাজ সচিত্র ইসলামের মুখােশধারী সবাই হানাদার পাকিস্তানীদের সমর্থন করেছে। এ থেকে স্বভাবতই এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে, আলেম-ওলামা বলতে সবাই রাজাকার-আলবদর ও পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযােগী। তবে হ্যা উক্ত বিশেষ মহলটির বাইরের আলেম সমাজ ইচ্ছে করলে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলােতেই রাজাকার-আলবদর, আল শামস সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণার অবসান ঘটাতে পারতেন। তারা পত্রপত্রিকা, বিভিন্ন গণমাধ্যম, এমনকি ওয়াজ মাহফিল করে ঘােষণা করতে পারতেন, যারা পবিত্র ধর্মের মুখােশ পরে রাজাকার আলবদর বাহিনী গঠন করেছে, গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযােগ ও লুটতরাজে হানাদার বাহিনীকে সহযােগিতা করছে আমরা তাদের সাথে নেই। এসব কুকর্ম আমরা সমর্থন করি না, পবিত্র ইসলামের দৃষ্টিতে এসব জঘন্য পাপাচার। পবিত্র ইসলাম রক্ষার নামে ধর্ম ও মানবতাবিরােধী এসব পাশবিকতার বিরুদ্ধে আমাদের দেশের আলেম সমাজকে সেদিন টু শব্দটিও করতে শােনা যায়নি। মহানবী (সঃ) বলেছেন, “অত্যাচারী শাসকের নিকট সত্য কথা বলা উত্তম জেহাদ।”
অপর এক হাদীসে তিনি বলেছেন, “যে ব্যক্তি সত্য কথা বলা থেকে নীরব। থাকে সে বােবা শয়তান।” অথচ তখনাে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে বর্তমান শায়খুল হাদীস মওলানা আজিজুল হক, বায়তুল মােকামের খতিব মওলানা ওবায়দুল হকসহ বহু রাজনীতি সচেতন বড় বড় আলেম ছিলেন। তারা যদি সেদিন নিজেরা ব্যক্তিগতভাবে মহানবীর (সঃ) এসব বা অনুসরণ করতেন এবং আপামর জনসাধারণকে পাকিস্তানী হায়েনাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত করতেন তাহলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তারা অমর হয়ে থাকতেন। হানাদাররা এদেশে এতটা ধ্বংসযজ্ঞ চালাবার সুযােগ পেত না। আলেম সমাজকেও বর্তমানে ঢালাওভাবে রাজাকার-আলবদরের দুর্নাম বহন করতে হতাে না। ইসলাম বিরােধী এই নীরবতার জন্য পাকিস্তানী হায়েনাদের নিকটও অনেক আলেমকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি একজন মৌলবী সাহেব সম্পর্কে জানি, বৃহত্তর কুমিল্লার এক নিভৃত পল্লীতে তার বাড়ি। একদিন হানাদার বাহিনীর কয়েকজন মৌলবী সাহেবদের গ্রামে যায়। তিনি উর্দুতে বাতচিত করার জন্য এগিয়ে যান। বাড়িতে ডেকে আনেন। বৈঠকখানায় বসিয়ে গাছ থেকে পেড়ে তাজা ডাব খাওয়ান। এরপর এক পর্যায়ে হায়েনারা মুকুত খোজার নাম করে অন্দরে ঢুকে পড়ে। মৌলবী সাহেবের স্ত্রী ইজ্জত রক্ষার জন্যে পুকুরের পানিতে পালিয়ে থাকার চেষ্টা করেন। তাকে পুকুর থেকে উঠিয়ে এনে কয়েক হায়েনা বেইজ্জতি করে। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলােতে এ ধরনের ঘটনা একটা নয়, দু’টো নয়, বহু ঘটেছে। সে যাই হােক, ইসলাম ও পাকিস্তান রক্ষার স্লোগান তুলে এদেশের আলেম হিসেবে পরিচিত একটি শ্রেণী সেদিন পাকিস্তানী হায়েনাদের জঘন্য তৎপরতার সহযােগিতা করেছেন। আবার কেউ কেউ নীরব থেকেছেন। এটাও পরােক্ষ সমর্থনই বলা চলে। কিন্তু আল্লাহতায়ালা পবিত্র ইসলামের নামে তাদের ইসলাম বিরােধী ভূমিকা গ্রহণ করেননি। যদি গ্রহণ করতেন বাংলাদেশ স্বাধীন হতাে না, পাকিস্তানই থেকে যেতাে। এ থেকে প্রমাণিত হয় পাকিস্তানী হায়েনাদের বিরুদ্ধে আমাদের সশস্ত্র সংগ্রাম আল্লাহতায়ালা পছন্দ করেছেন, গ্রহণ করেছেন। আর আল্লাহর পছন্দ ও গ্রহণ করার ফলশ্রুতিই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের বিরােধীরা যে আল্লাহতায়ালার ইচ্ছার পরিপন্থী কাজ করেছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তাদের বােধােদয় ঘটেনি। স্বাধীনতার পর কয়েক বছর তারা ঘাপটি মেরে থাকে। সত্তরের দশকের শেষার্ধ থেকে ক্ষমতাসীন বিভিন্ন সরকারের প্রশ্রয়, আশ্রয় ও পৃষ্ঠপােষকতায় তারা আবার পুরনাে খেলায় মেতে ওঠে। তারা নানান নন ইস্যুকে ইস্যু হিসেবে দাঁড় করিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবােধ ধ্বংস করার তৎপরতায় লিপ্ত হয়।
এভাবে বাংলাদেশের সামাজিক সম্প্রীতি ও পরমতসহিষ্ণু পরিবেশকে বিপন্ন করে তােলা হয়। দেশ ও জাতির অগ্রগতি ও সংহতি বিরােধী এই তৎপরতায় বিশেষ মহলটি কখনাে প্রত্যক্ষ আবার কখনাে কৌশলগত কারণে পরােক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করে। আরেকটা ব্যাপার এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, সারা বছরের মধ্যে নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ মাসগুলাে আমাদের জাতীয় জীবনে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত পাকিস্তানী শােষকদের বিরুদ্ধে। আমাদের প্রতিটি আন্দোলন প্রতিটি সংগ্রামের সূচনা কিংবা সমাপ্তি হয়েছে এসব মাসের কোন না কোনটিতে। তাই আমরা এসব মাসে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরি। তাদেরকে এ সবের প্রতি উদ্বুদ্ধ করি। কিন্তু পাকিস্তানের দালাল ও স্বাধীনতা বিরােধীরা সাধারণ মানুষকে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে এসব মাসেই নানান ইস্যু পড়া করানাের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। কারণ ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম, বুদ্ধিজীবী হত্যা প্রভৃতি সম্পর্কে অনুষ্ঠানাদিতে ঘাতক দালালদের পাশবিক চেহারাটা বেরিয়ে পড়ে। এটা তাদের নিকট অসহনীয় ব্যাপার। সুতরাং তারা বাঙালিদের গৌরবগাথা ও সংগ্রামী ঐতিহ্যের ধারক বাহক মাসগুলােকে ভিন্নধর্মী উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টির ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। আর এসব করে তারা পবিত্র ইসলামের নামে। এ জন্য প্রয়ােজন হলে তারা ভারত, পাকিস্তান কিংবা অন্য কোন দেশে গিয়ে সমমনাদের সাথে সলাপরামর্শ করতেও দ্বিধা করে না। ভারতীয় হিন্দু মৌলবাদীগােষ্ঠী কর্তৃক বাবরী মসজিদ ধ্বংসের আগে বাংলাদেশের জামাত নেতারা দিল্লী গিয়ে বিজেপি নেতা লাল কৃষ্ণ আদভানির সাথে সাক্ষাৎ করেন। | এক ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের অন্যায়ের জন্য আল্লাতায়ালা পরকালেও অপর কোন ব্যক্তি কিংবা সম্প্রদায়কে শাস্তি দিবেন না। কিন্তু ভারতীয় হিন্দু মৌলবাদীদের অপকর্মের শান্তি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের হিন্দুদের ভােগ করতে হলাে। এই দুটো দেশের বহু মন্দির ভাঙচুর ও বাড়িঘর দোকানপাট লুট করা হলাে। বহু পুরােহিত, বহু নারীকে লাঞ্ছিত করা হলাে। বস্তুত ইসলাম এ ধরনের অমানবিক তৎপরতা সমর্থন করে না। ইসলামের প্রাথমিক যুগে সামরিক অভিযানকালেও মহানবীর (সঃ) কঠোর নির্দেশ ছিল, কারাে উপাসনালয় যেন ধ্বংস করা না হয়। কোন পুরােহিতকে যেন অপমান করা না হয়। কোন রমণীকে যেন স্পর্শ করা না হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এসবই করা হলাে পবিত্র ইসলামের নামে, ইসলাম রক্ষার শ্লোগান দিয়ে। সে সময় ইসলাম কায়েমের সােল এজেন্সির দাবিদাররা কেউ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরােধী তৎপরতার বিরুদ্ধে সংবাদপত্রে একটা বিবৃতিও দিলেন না।
উল্টো বরং এই পরিস্থিতির আরাে অবনতি ঘটিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লােটার চেষ্টা করা হয়েছে। খেলাফত মজলিশের উপদেষ্টা শায়খুল হাদীস মওলানা আজিজুল হক নেমে পড়লেন লংমার্চ কর্মসূচি নিয়ে। এই কর্মসূচির পরিণতিতে কয়েক ব্যক্তি অকালে প্রাণ হারায়। মওলানা সাহেব একজন বিজ্ঞ আলেম। প্রায় চার দশক থেকে হাদীস-কোরআনের অধ্যাপনায় নিয়ােজিত আছেন। সম্ভবত তিনি শেখুল হিন্দু মওলানা হােসাইন আহমদ মাদানীর ছাত্র হবেন। ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলনে হযরত মাদানীর ভূমিকা ও অবদান উপমহাদেশের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায় কিন্তু তার নিকট শিক্ষা লাভকারী মওলানা আজিজুল হকের লংমার্চ কর্মসূচি দেখে আমরা বিস্মিত হয়েছি। মওলানা সাহেব লংমার্চ কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন অযােধ্যার উদ্দেশ্যে। ভারতে অবস্থিত অযােধ্যা। ভারতের সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে রয়েছে। উভয় দেশের মধ্যে পারস্পরিক ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃত সীমান্ত রয়েছে। কিন্তু তিনি ভারতে জোরপূর্বক প্রবেশের কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। একজন ইসলামী বিশেষজ্ঞ হিসেবে মওলানা সাহেব কিভাবে এই ইসলাম বিরােধী কর্মসূচি গ্রহণ করলেন, আমরা ভেবেই পাই না। ইসলাম তাে অন্য দেশে দূরের কথা, অপরের ঘরেও বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করার অনুমতি দেয় না। পবিত্র কোরআনে পরিষ্কার বলা হয়েছে, “হে মুমিনগণ, তােমরা নিজেদের ঘর ছাড়া অন্য কারাে ঘরে তাদের অনুমতি না নিয়ে এবং সালাম না। দিয়ে প্রবেশ করে না। এটাই তােমাদের জন্য উত্তম, যাতে তােমরা উপদেশ গ্রহণ কর।” (সূরা নূরঃ ২৭) পবিত্র কোরানের এই স্পষ্ট নির্দেশ মওলানা আজিজুল হক ও তার সহযােগী আলেম-ওলামারা কেন অনুসরণ করলেন না তার কোন যুক্তিগ্রাহ্য কারণ কেউ দেখাতে পারবে না। অবশ্য একটা বিষয় সরকারের বিভিন্ন গােয়েন্দা সংস্থার অজানা থাকার কথা নয় যে, লংমার্চের সময় দু’জন পাকিস্তানী মওলানা বাংলাদেশে অবস্থান করছিলেন। লংমার্চ কর্মসূচির কিছু দিন পর শায়খুল হাদীস মওলানা আজিজুল হকও দেশের বাইরে। যান। উক্ত বিশেষ মহলটির একটা স্ট্যান্ডিং হাতিয়ার হচ্ছে আহমদিয়া সম্প্রদায়কে সরকারিভাবে অমুসলিম ঘােষণার দাবি। হাতে নতুন কিছু না থাকলে এটা নিয়ে মাঠে নামা হয়। আর নামা হয় সাধারণ বছরের এই সময়টাতেই। গত বছরও ঢাকার বশী। বাজার আহমদিয়াদের মসজিদে হামলা করে ভাঙচুর করা হয়। সংঘর্ষে কয়েক জন আহত হয়। মসজিদে রাখা কোরআন শরীফ ও অন্যান্য ধর্মবিষয়ক বই পুস্তকে অগ্নিসংযােগ করা হয়। বিস্ময়কর ব্যাপার হলাে, বাংলাদেশের কোন আলেমকেই এই সন্ত্রাসী তৎপরতার নিন্দা বা প্রতিবাদ করতে দেখা যায় নি। আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ধ্যান-ধারণা আমরা সমর্থন করি না। তারপরও কথা আছে।
কথা হলাে, মুসলমানদের মধ্যে আহমদিয়ারাই একমাত্র ভিন্ন মতাবলম্বী বা বাতিল সম্প্রদায় নয়। বাহায়ী, আগাখানী, শিয়া, সুন্নী, দেওবন্দী, বেরেলবী মাইজভান্ডারী, এনায়েতপুরী, আটরশি প্রভৃতি ধ্যান-ধারণার অনুসারী মুসলমান রয়েছে। | মহানবী (সঃ) নিজেই বলেছেন, “(হযরত) মুসার উম্মতের মধ্যে বাহাত্তর ফেরকা। ছিল। আমার উম্মতের মতে তিহাত্তর ফেরকা হবে। … এই হাদিসের সার কথা হচ্ছে, হযরত মুসার (আঃ) উম্মতের মধ্যে যতাে দলউপদল ছিলাে, হযরত মুহম্মদের (সঃ) উম্মতের মধ্যে তার চেয়েও বেশি হবে। এসব ফেরকা বা দলের মধ্যে একটি ছাড়া সবই বাতিল ফেরকা এবং নরকবাসী হবে। মহানবী (সঃ) এসব বাতিল ফেরকাকেও তার উম্মত বলেই উল্লেখ করেছেন। তিনি এ কথাও বলেননি যে, এসব বাতিল ফেরকার লােকেরা আল্লাহর নাম নিতে পারবে না, আমার নাম নিতে পারবে না, পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করতে পারবে না, মসজিদে নামাজ পড়তে পারবে না, এমনকি আরবী ভাষাও ব্যবহার করতে পারবে না। মহানবী (সঃ) ও তার চার খলিফা কোন মানুষের প্রতি এসব বাধ্যবাধকতা আরােপ করে। রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন বিধিবিধানও জারি করেননি। মহানবী (সঃ) বলেছেন, “মানুষের মধ্যে যে ব্যক্তি নিজেকে মুসলমান বলে তাকে আমার জন্য তালিকাভূক্ত করে নাও।” (বােখারী) তিনি অপর এক হাদিসে বলেছেন, “যে আমাদের মত নামাজ পড়ে, আমাদের কিবলামুখী হয় এবং আমাদের জবাই করা প্রাণীর মাংস খায় সেই মুসলমান। তার দায়িত্ব আল্লাহ ও তার রাসূল নিয়েছেন। সুতরাং আল্লাহর দায়িত্বে তােমরা হস্তক্ষেপ করাে না (বােখারী)। এই হাদিস দুইটি অত্যন্ত স্পষ্ট। কোন প্রকার ব্যাখ্যার প্রয়ােজন নেই। আলেম সমাজ হচ্ছে মহানবীর (সঃ) উত্তরাধিকারী। তিনি মানব জাতিকে ন্যায় ও সত্যের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, মানুষের কল্যাণ কামনা করেছেন, ন্যায় ও সত্য গ্রহণে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। কাউকে অমুসলিম সার্টিফিকেট দিয়ে দূরে সরিয়ে দেননি। মহানবীর (সাঃ) উত্তরাধিকারী হিসেবে তার এই আদর্শ ও শিক্ষা প্রচার সম্প্রচারের দায়িত্বই আলেম সমাজের উপর বর্তায় এর বাইরে নয়।
বলছিলাম, মুসলমানদের মধ্যকার দল-উপদলের কথা। একটা বিষয় এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, শিয়াদের মধ্যে একটা উপদল মনে করে আল্লাহতায়ালা ওহী পাঠিয়েছিলেন হযরত আলীর (রাঃ) নিকট। কিন্তু হযরত জিবরাইল ভুলক্রমে সে ওহী বা আল্লাহর বাণী হযরত মুহম্মদের (সঃ) নিকট পৌছে দেন। এদের সম্পর্কে তাে আমাদের দেশের আলেমদের কিছু বলতে শােনা যায় না। এসব তাে অনেক দূরের কথা, বর্তমানে বাংলাদেশে আল্লাহর আইন ও সৎ লােকের শাসন কায়েমের স্লোগানধারী জামাতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মওলানা মওদুদী তার তফসীর ও অন্যান্য পুস্তকে নবী-রাসূল সাহাবা ও অন্যান্য মুসলিম মনীষীদের সম্পর্কে বহু আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। তিনি লিখেছেন, “মহানবী (সঃ) মনগড়া কথা বলেছেন। নিজের কথায় তিনি নিজেই সন্দেহ করেছেন।” “হযরত ইউনুস নবুয়াতের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেননি।” “হযরত দাউদ এক বিবাহিতা যুবতীর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন।” সাহাবাদের অনেকে মনগড়া হাদিস বর্ণনা করেছেন।” “ফেরেস্তা একই বস্তু যাকে ভারত, গ্রীস প্রভৃতি দেশের পৌত্তলিকরা দেব-দেবী স্থির করেছে।” “ওলামা কেরাম ও মুফতি সাহেবরা সবাই পথভ্রষ্ট।” এসব হচ্ছে মওলানা মওদুদীর মন্তব্য। তার তফসীর ও বই পুস্তকে এ ধরনের বহু আপত্তিকর মন্তব্য রয়েছে। বাংলাদেশের জামাতীরা তাদের গুরুর এসব কথা সঠিক মনে করে। মওদুদীর তফসীর ও বই-পুস্তক বাংলায় অনুবাদ করে হাজার হাজার কপি বাংলাদেশে ছাড়া হচ্ছে। উপ মহাদেশের সকল মত ও পথের আলেমগণ মওদুদীর এসব আপত্তিকর ধ্যানধারণা ভ্রান্তবলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। মুসলমানদেরকে জামাতীদের থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। এমনকি শায়খুল হাদীস মওলানা আজিজুল হক এবং বায়তুল মােকাররমের খতিব মওলানা ওবায়দুল হকও জামাতীদের বিরুদ্ধে সােচ্চার ছিলেন। এখন অবশ্য কৌশলগত কারণে নীরব হয়ে রয়েছে।
তাদেরই পূর্বসূরী মরহুম হযরত মওলানা তাজুল ইসলাম বলেছেন, “জামাতীরা কাদিয়ানীদের চেয়ে নিকৃষ্টতর।” বস্তু আহমদিয়াদের বই-পুস্তকে মহানবী (সঃ), অন্যান্য নবী-রাসূল ও মুসলিম মনীষীদের সম্পর্কে মওদুদীর মত ধৃষ্টতামূলক মন্তব্য করা হয়নি। | মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুয়ত বা খতমে নবুয়ত সংরক্ষণ মজলিসের গত কিছুদিনের তৎপরতায় দেশের সচেতন নাগরিকদের মধ্যে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তারা বলেন, “মহানবী (সঃ) সর্বশেষ নবী ও রাসূল এবং তার প্রবর্তিত ধর্ম ইসলাম সর্বশেষ ধর্ম”। এটা কোন স্থল বস্তু নয় যে, আইন প্রয়ােগ করে সংরক্ষণ করতে হবে। মসজিদে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযােগও খতমে নবুয়ত সংরক্ষণের পদ্ধতি নয়। সামাজিক সম্প্রীতি বিনষ্ট কিংবা সাধারণ মানুষের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি খতমে নবুয়ত সংরক্ষণের পদ্ধতি হতে পারে না। এ ধরনের তৎপরতার মাধ্যমে অন্য সুযােগ সুবিধা অর্জিত হলেও এসব খতমে নবুয়ত সংরক্ষণের পদ্ধতি হতে পারে না। কারণ ধর্মীয় ব্যাপারে জোরজবরদস্তি ও বলপ্রয়ােগ ইসলাম অনুমােদন করে না। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “ধর্ম সম্পর্কে কোন প্রকার বল প্রয়ােগ নেই।” (সূরা বাকারা ঃ ২৫৬) ইসলাম মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রতি অত্যন্ত যত্নবান। এ ক্ষেত্রে ইসলামের মূল শিক্ষা হচ্ছে জোর করে কারাে উপর চাপিয়ে দেয়া কোন সত্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিকট আর সত্য থাকে না। সত্যের অন্বেষণ এবং অনুসরণের অপরিহার্য শর্ত হলাে বিবেকের স্বাধীনতা। এ জন্য ইসলাম কারাে বিবেকের উপর হস্তক্ষেপ করে না। বিবেক সঠিক পথে থাকলে পরকালে আল্লাহতায়ালা পুরস্কৃত করবেন। ভুল পথে থাকলে তার জন্য শাস্তি ভােগ করতে হবে। খতমে নবুয়ত বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত করতে হলে মানুষের বিবেককে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। যারা ভিন্নমত পােষণ করে তাদেরকে যুক্তিগ্রাহ্য পদ্ধতিতে বুঝানাের ব্যবস্থা করতে হবে।
আজকের কাগজ ঃ ২২-১২-৯৩
সূত্র : বঙ্গবন্ধু ও ইসলামী মূল্যবোধ – মওলানা আবদুল আউয়াল