হারেম কেবিনেট
বহু বছর পাকিস্তানি উচ্চবিত্ত সমাজে পঁয়তাল্লিশ বছরের তারানা মুখরােচক গল্প হিসেবে সবার মুখে মুখে ছিল। ভারত ভাগের পূর্বে যারা বােম্বের ফিরে খোঁজখবর রাখতেন তারা এই উন্মাতাল, আত্মবিশ্বাসী তরুণী অভিনেত্রীকে খুব ভালাে করেই চিনে থাকবেন। তারানা বােম্বের অসংখ্য ছবির পার্শ্ব চরিত্রে সাহসী অভিনেত্রী হিসেবে কাজ করেছে। তার খােলামেলা অভিনয়ের জন্য সে অত্যন্ত সুপরিচিত ছিল। এমনকি সেই সময় তার উঠতি খােলামেলা সংকোচবিহীন অভিনয়ের জন্য তারানার পরিচয় সবার মুখে মুখে ছিল। আগ্রার সংগীত আর নৃত্য পরিবার থেকে আসা তারানা প্রযােজকদের মনােরঞ্জনের জন্য পর্দার ভেতরে ও বাইরে সব জায়গায় যে কোনাে ধরনের অভিনয় করতে সংকোচ করত না। তবে এটা ছিল শুরুর দিকের ঘটনা। সেই সময় বােম্বে ছবির জগতে তার পরিচয় ছিল অত্যন্ত সীমিত। তার পরিবার যখন পাকিস্তানে এসে বসবাস শুরু করল তখন তারানার। ভাগ্যের পরিবর্তন শুরু হলাে। পাকিস্তানে এসেও তার খােলামেলা অভিনয় বন্ধ হলাে না। তবে কিছু দিনের মাঝেই সে বুঝতে পারল ছবির নায়িকা হিসেবে তার এই আচরণ দিয়ে সে পাকিস্তানে টিকতে পারবে না। এর পর থেকে সে ছবির চরিত্রগুলাে খুব সাবধানে নির্বাচন করে অভিনয় করা শুরু করল। ইয়াহিয়া খানের সাথে তার পরিচয়ের পরই নিজের সাথে নিজের এই বাদানুবাদের পরিসমাপ্তি ঘটে। ১৯৭১ এর শুরুর দিকে একটা টিভি অনুষ্ঠানে ইয়াহিয়া খান সর্বপ্রথম তাকে চিহ্নিত করেন। ইয়াহিয়া খান সেই সময় নিজেকে শিল্প সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষক হিসেবে পরিচিত করার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তাকে প্রায় সময়ই বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, অভিনেতা অভিনেত্রীদের সাথে দেখা যেত। জেনারেল রানির মতে এক অনুষ্ঠানে ইয়াহিয়া খানের সাথে তারানাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। দেশের বাইরে কার্যরত জনৈক পাকিস্তানি দূতের কন্যা হিসেবে। প্রথম দেখাতেই ইয়াহিয়া খান মুগ্ধ হয়ে যান। তারানাকে করাচির গভর্নমেন্ট হাউসে নিমন্ত্রণ করেন। তারানার তখন চল্লিশের কাছাকাছি বয়স। তারপরেও তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ ছিলেন ইয়াহিয়া খান।
শুধু তাই নয় পাকিস্তানি দূতের কন্যা হিসেবে পরিচিত হওয়ার মিথ্যে উসিলাটুকু পরে প্রকাশ পেলেও ইয়াহিয়া খান সেটা নিয়ে কোনাে উচ্চবাচ্য করেননি। তাদের মধ্যে সম্পর্কের কোনাে ফাটল ধরেনি। এক সময় ভাগ্য তাদেরকে পৃথক করে দেয়। জেনারেল রানি অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে তারানাকে নানা ধরনের অবৈধ কাজের জন্য দায়ী করেছিল। তার মতে উচ্চ পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা তারানাকে ইয়াহিয়া খানের কাছে পরিকল্পিতভাবে পাঠিয়েছিল। তারানার মাধ্যমে তারা অনেক ব্যবসায়িক স্বার্থ হাসিল করত। এক সংবাদ সম্মেলনে তারানা দাবি করেছিল যে প্রেসিডেন্টের সাথে তার যে সম্পর্ক সেটা শুধু মাত্র একজন শিল্পীর সাথে আরেকজন শিল্প প্রেমীর সম্পর্ক ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রেসিডেন্ট শিল্প সংস্কৃতি ও এর সাথে জড়িত লােকজনদের খুব পছন্দ করেন। তারানা উল্টো দাবি কর যে জেনারেল রানি তাকে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের অপরাধমূলক কাজ করার জন্য চাপ দিত, ব্ল্যাক মেইল করত। জেনারেল রানি আর ইয়াহিয়া খানের কাছের বডিগার্ডদের নিয়ে তারানার বিতর্ক দীর্ঘদিন সংবাদ মাধ্যমের মুখরােচক সংবাদ হিসেবে প্রচার হচ্ছিল। ইয়াহিয়া খান আর তারানাকে নিয়ে আরাে একটি গল্প প্রচলিত ছিল। প্রথমবার যখন তারানাকে করাচির গভর্নমেন্ট হাউসে নিমন্ত্রণ জানানাে হলাে। তখন সে সন্ধের দিকে নির্দিষ্ট সময় তার স্পাের্টস গাড়িটা নিয়ে হাজির হলাে। কিন্তু প্রেসিডেন্সিয়াল গার্ড তাকে ভেতরে ঢুকতে দিতে রাজি হলাে না। কারণ। এই সময় প্রায় সকলের ভেতরে প্রবেশ নিষেধ ছিল। ইয়াহিয়া খান এই সময়। তার প্রিয় ব্ল্যাক ডগ স্কচ হুইস্কি নিয়ে বসেন। তারানা খুব দৃঢ়ভাবে তার নিমন্ত্রণের কথা বললে গার্ড তখন এডিসির সাথে যােগাযােগ করে বসের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তাকে ভেতরে যেতে দেয়।
বেশ কয়েক ঘণ্টা প্রেসিডেন্টের সাথে তারানার বৈঠকের পর সে যখন বের হয়ে আসে তখন যাওয়ার সময় তারানা গার্ডকে বলে তুমি বােকা গার্ড আমাকে এখানে ঢুকতে বাধা দিয়েছিলে, আমার সাথে শক্ত ব্যবহার করেছিলে, আমার সাথে যে আচরণ করেছিলে তার পরিণাম কী হতে পারে জান? গার্ডস খুব নরমভাবেই উত্তরে বলেছিল, ‘আপনি যখন এখানে এসেছিলেন তখন একজন সাধারণ তারানা ছিলেন, কিন্তু এখন যখন বের হচ্ছেন তখন আপনি কাওমি তারানা, আমাদের জাতীয় তারানা। আপনাকে স্যালুট।’ আমি যখন (লেখক) সর্বশেষ পাকিস্তানের ইসলামাবাদ আর লাহাের ঘুরে আসলাম তখন ইয়াহিয়া খানকে নিয়ে এই জাতীয় আরাে অসংখ্য মজার মজার ঘটনা শুনেছিলাম। তারানা দীর্ঘদিন সংবাদ মাধ্যমের উত্তপ্ত আলােচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। শুধু তাই নয় তারানা ছিল ইয়াহিয়া খানের হাতে গোনা কয়েকজন নারী বান্ধবীদের একজন যাদের সাথে ইয়াহিয়া খান দীর্ঘ সময় সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। করাচির একজন সাংবাদিক বলেন যে তারানার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক ছিল খুব মজার মজার বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতা। এটা দিয়েই সে প্রেসিডেন্টকে মুগ্ধ করে রাখত। ইয়াহিয়া খান প্রয়ােজন হলেই তারানাকে ডাকতেন। সেটা যত রাতই হােক না কেন। পাকিস্তানি সংবাদ মাধ্যমে আরেকটা প্রসিদ্ধ গল্প প্রচলিত ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধের সময় শেষের দিকে ইয়াহিয়া খান খুব অস্থির বােধ করতেন। নানা ধরনের কাজের জন্য তাকে সব সময় অস্থির থাকতে হতাে। এই অস্থির সময়ে তিনি একদিন গায়িকা নুরজাহানকে ডাকলেন গান গেয়ে তার অস্থিরতা দূর করার জন্য। কিন্তু কিছুক্ষণ নুরজাহানের গান শুনেই ইয়াহিয়া খান বিরক্ত হয়ে পড়লেন। তিনি সাথে সাথেই নুরজাহানকে গাড়ি বােচকা গুটিয়ে চলে যেতে নির্দেশ দিলেন। তার একটু পরে ডাক পড়ল তারানার। ইয়াহিয়া খান এরপর তারানার সাথে পুরাে রাত কাটিয়ে দিলেন। নুরজাহান অবশ্য এই ঘটনাকে অস্বীকার করেছিল। সে যুক্তি দিয়েছিল যে সেই সময় সে ইসলামাবাদেই ছিল না। এই ঘটনা সত্য মিথ্যে যাই হােক না কেন এমন সাদৃশ্যপূর্ণ আরাে অসংখ্য ঘটনা প্রেসিডেন্টের লাম্পট্য ও অতিমাত্রায় নারীকাতরতার বিষয়টাকেই প্রমাণ করে। ঘটনা যাই হােক না কেন তারানার সাথে ইয়াহিয়া খানের সম্পর্কের প্রথম চার মাস তারানাকে নিয়ে তেমন কোনাে সংবাদ প্রচারিত হয়নি। তবে তারানা সর্বপ্রথম আলােচনায় আসে মার্কেটে ডায়মন্ড কেনার ঘটনার ভেতর দিয়ে। তারানা এক ব্যস্ত মার্কেটে তার গাড়ি নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে এক জুয়েলারি দোকানে ঢুকে ডায়মন্ডের একটা নেকলেস সে পছন্দ করে। তারপর কোনাে রকম মূল্য না চুকিয়েই তড়িঘড়ি করে দোকান থেকে বের হয়ে আসে। নিজের গাড়িতে উঠে সে গাড়িটা ১০০ কিমি গতিতে ছাড়ে।
এই সময় তার গাড়ির ধাক্কায় একজন পথচারী আহত হয়। তার পা ভেঙে যায়। তাকে গ্রেফতার করা হলে কোর্টে তার আইনজীবীরা ম্যাজিস্ট্রেটকে এটা বুঝাতে সক্ষম হয় যে তারানা সেই ডায়মন্ডটা চুরি করেনি। আর রাস্তায় এত ভিড় ছিল যে ব্যস্ত আর। অমনােযােগী পথিক যাচ্ছেতাই অবস্থায় তার গাড়ির উপর এসে হামলে পড়ে। এখানে তারানার কোনাে দোষ ছিল না। কোর্ট থেকে সে হাল্কা কিছু মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পেয়েছিল। | তবে তারানাকে নিয়ে সবচেয়ে বড় কলংকজনক ঘটনা ঘটে ১৯৭৩ এর এপ্রিল মাসে তার এই ঘটনার সাথে শুধু মাত্র বড় বড় ব্যবসায়ী কিংবা রাজনীতিকরাই জড়িত ছিল না বরং একই সাথে অনেক বিখ্যাত পরিবারের মেয়েরাও জড়িয়ে পড়েছিল। তারানার নামে অভিযােগ ছিল যে সে অভিজাত পরিবারের মেয়েদেরকে দিয়ে লাহাের, মুরি, করাচি, ইসলামাবাদে অভিজাত বেশ্যালয় খুলেছে। সেখানে সমাজের অতি ভিআইপি আর কোটিপতিদের যাতায়াত ছিল। | লাহােরের একজন ব্যবসায়ী তারানার বিরুদ্ধে অভিযােগ করার পর ঘটনাটা আরাে বিস্তর আকারে ছড়িয়ে পড়ে। সেই ব্যবসায়ীর দাবি তারানা ফুসলিয়ে তার স্ত্রীকে বেশ্যালয়ে ব্যবহার করেছে। শুধু তাই নয় এই কাজে সে তার ভাই সাজ্জাদ পাশা, তার ষাট বছর বয়সের মাকে সাথে নিয়ে সমাজের আরাে অনেক অভিজাত পরিবারের মেয়েদেরকেও বিভ্রান্ত করছে। পত্রিকাওয়ালারা এই সুযােগে তাদের পাঠকদেরকে আবারাে মনে করিয়ে দিল। যে এই তারানা ছিল ইয়াহিয়া খানের সাপ্লই মন্ত্রী, তার সহযােগী ছিল আরেক লম্পট চরিত্র জেনারেল রানি যাকে বলা হতাে এই কাজের প্রধানমন্ত্রী এবং আরেক নারী গায়িকা নুরজাহান, সংবাদ মাধ্যম তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। ইয়াহিয়া খানের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী বলে।
তারানা প্রায়ই ইসলামাবাদে ইয়াহিয়া খানের রাজত্বকালে ঘনঘন প্রেসিডেন্সি হাউসে যেত। সে বহু সংখ্যক সুন্দরী মেয়েকে প্রেসিডেন্টের সেবায়। পাঠাত। এই জন্য সংবাদ মাধ্যম তাকে মিনিস্টার অব সাপ্লাই নামে ডাকত। পুলিশের তদন্তে বের হয়ে আসে যে তারানা ইয়াহিয়া খানের পতনের পর। পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলােতে দেহব্যবসা শুরু করে। অত্যন্ত অভিজাত আর সুরক্ষিত পতিতালয়গুলাে ছিল তারানার। যে পতিতালয়গুলাে এক সময় সামরিক ও সরকারি উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল তা এখন সাধারণ মানুষদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হলাে। অবশ্য প্রতি রাতের জন্য তাদেরকে ১০০০ থেকে ৫০০০ রুপি খরচ করতে হতাে। তারানার পতিতালয়ে এমন সব অভিজাত মেয়েরা থাকত যে তাদের কারণে তারানার সবগুলাে গেস্ট হাউজ প্রতি রাতেই পূর্ণ থাকত। পুলিশের তদন্তে ৯ বে হ এসেছিল যে তারা”” পতিতালয়গুলােতে পাকিস্তানের তির দেরকেও পাওয়া পুলিশের এই তদন্ত প্রকাশিত হওয়ার পর সাধারণ মানুষের কাছ থেকে দাবি উঠল যেন তারানার বিষয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে সেটা জনগণের সামনে প্রকাশ করা হােক। কিন্তু পরবর্তীতে তারানার হস্তক্ষেপে পাকিস্তানের দুনীতিবাজ প্রশাসন এবং তারানার অনুরােধে খুব উচ্চপদস্থ কিছু কর্মকর্তার কারণে পুলিশই পুরাে বিষয়টাকে ধামাচাপা দিয়ে দেয়। সংবাদপত্র ইয়াহিয়ার হারেমখানার আরেকজন সুন্দরীর কথা উল্লেখ করেছে। সে হলাে কোমল। ইয়াহিয়া খানের হারেমখানার সাথে তার গভীর সম্পর্ক ছিল। কোমল অবশ্য শক্তভাবে পত্রপত্রিকার এই দাবিকে অস্বীকার করেছে। প্রত্যুত্তরে সে বলেছে তাকে নিয়ে যা বলা হচ্ছে এই সব কিছুই গুজব। পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক শত্রুরা পাকিস্তানের অভিজাত ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গদের চরিত্র কলুষিত করার জন্য তাকে জড়িয়ে এই সব সংবাদ প্রকাশ করছে। সে আরাে দাবি করে যে ইয়াহিয়া খানের সাথে তার মাত্র এক থেকে। দুইবার সাক্ষাৎ হয়েছিল জনাকীর্ণ অনুষ্ঠানে। ইয়াহিয়া খানের ঘনিষ্ঠ সহচর যে ইয়াহিয়া খানের এই সমস্ত অভ্যন্তরীণ ও ব্যক্তিগত বিষয়গুলাে দেখা শােনা করত সে দাবি করে যে এই কোমল ইয়াহিয়া খানের হারেমখানার খুব শক্তিশালী একজন সদস্য ছিল। সে ব্ল্যাক বিউটির সাথেই কাজ করত। ব্ল্যাক বিউটি আর কোমলের ষড়যন্ত্রের কারণে জেনারেল রানিকে ইয়াহিয়া খানের বিরাগভাজন হতে হয়েছিল। ইয়াহিয়া খানের প্রেসিডেন্সিয়াল হারেমখানার নারী চরিত্রগুলাের মধ্যে নুরজাহান, তারানা, ব্ল্যাক বিউটি নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি ও সুপরিচিতির কারণে সংবাদ মাধ্যমগুলাের খুব দ্রুত দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল।
তবে অবশিষ্ট নারী চরিত্রগুলাে অনেক বেশি মূল্যের বিনিময়ে সংবাদ মাধ্যমের কাছ থেকে নিরাপত্তা পেয়েছিল। পাকিস্তানে অনেক বিদেশি সাংবাদিক নূর বেগম আর শরিফানের ভাগ্যে কী ঘটেছিল, ইয়াহিয়া খানের হাৱেম শরিফে তার অবস্থা কেমন ছিল এই সমস্ত বিষয় জানার অনেক চেষ্টা করেছিলেন। শুধু তাই নয় তারা কোমাল ও কাওসারের মতাে আরাে অনেক সুন্দরীর বিষয়েও অনেক আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানের দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতি আর সংবাদ মাধ্যমের কারণে অল্প কিছু নারী চরিত্র অধিক আলােতে পড়েছিল আর বাকিরা পিছলিয়ে বেঁচে গিয়েছিল। এটা খুবই আশ্চর্যের বিষয় ছিল ইয়াহিয়া খানের লাম্পট্য আর দুর্নীতি নিয়ে সংসদে, মিডিয়ায়, সংবাদ মাধ্যমে এমনকি কোর্টেও আলােচনা করার কিছুদিন পর দু-একটা রায় হয়ে গেলে পুলিশ প্রশাসন সমস্ত বিষয়টাকে ধামাচাপা দিয়ে দিল। শুধু তাই নয় জাতীয় সম্মেলনে স্বয়ং সরকারের বিরুদ্ধেও এমন অভিযােগ উঠল যে তারা বিশাল অংকের টাকার বিনিময়ে ইয়াহিয়া খানের সাথে সম্পর্কিত এই বিষয়গুলােকে নিয়ন্ত্রণ করছে। জামাতে ইসলামি পাকিস্তান ও জামাতে ওলামা সংসদে দাবি করল যে ইয়াহিয়া খানের উন্মাদ সময়গুলােতে যে সমস্ত নারী চরিত্রগুলাে তাদের নারী মাংসের বিনিময়ে ব্যবসা করেছিল আর ইয়াহিয়া খানকে বিপদগামী করেছিল তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। যাই হােক এই ক্ষেত্রে ইয়াহিয়া হারেমবাসীদের নেটওয়ার্ক ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। ফলে যে কোনাে ধরনের তদন্তই খুব অল্প দিনে মাঠে মারা গিয়েছিল। কারাে কারাে মতে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা থেকে সরে গেলেও তার বন্ধু ও শুভার্থীরা ছিল তার অত্যন্ত অনুগত। পরবর্তীতে তারা ইয়াহিয়া খানের রক্ষার বিষয়ে সমস্ত কলকাঠি নেড়েছিল।
ইয়াহিয়া খানের লাম্পট্য জীবনের এই সমস্ত ঘটনা প্রথম প্রথম সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর কেনই বা আবার চুপসে গেল, সমাজে এর প্রভাব কী ছিল এই সমস্ত বিষয় নিয়ে আমার (লেখক) এক জার্মান সাংবাদিক। বন্ধুর সাথে একবার কথা বলেছিলাম। তার মতে ইয়াহিয়া খানের পর বর্তমান ভুট্টো সরকার ইচ্ছে করেই বিষয়টাকে ধামাচাপা দিতে চেয়েছিল। তার মতে ভুট্টো সরকার চাইছিল না প্রাক্তন সরকারের কোনাে গােপন খবর প্রকাশের সাথে সাথে নিজেদের কোনাে থলের বেড়াল যেন বের হয়ে না যায়। কারণ ভুট্টো সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী জনাব মমতাজ আলী ভুট্টোর বিষয়েও শত শত গল্প প্রচলিত ছিল। শুধু তাই নয় জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সাথেও মমতাজ আলী ভুট্টোর গভীর সম্পর্ক ছিল। ইয়াহিয়া খানের হারেমখানায়ও তার যাতায়াত ছিল। এ ছাড়া পাকিস্তানের ঊর্ধ্বতন প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ মির রাসুল বাকস তালপুরেরও অনেক লাম্পট্যের পূর্ণ ঘটনা ছিল। তিনি ১৯৭২ সনে অবসরে এ ছাড়া পাঞ্জাব গভর্নর জি এম খায়ের যিনি মাধ্যমিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছিলেন এবং পরিচিত ছিল মেট্রিক ফেইলাের নামে তার সাথে এমন অসংখ্য ঘটনা জড়িত ছিল। জি এম খায়ের ছিলেন ভুট্টোর প্রবলেম শুটার, এমনকি ইয়াহিয়া খানের সময়ও ভুট্টোর সাথে তার সম্পর্ক ছিল একই সাথে তিনি ইয়াহিয়া খানেরও প্রবলেম শুটার হিসেবে কাজ করতেন।
শুধু তাই নয় ১৯৭১ সনে মার্চ মাসে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বর্জন করার আগে জি এম খায়েরকে ইয়াহিয়া খানের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে মধ্যস্থতা করার জন্য মনােনীত করা হয়েছিল। খায়ের নিঃসন্দেহে একজন প্রথম শ্রেণির পাঞ্জাবি বক্তা আর কৌশলী রাজনীতিক ছিলেন। তবে একই সাথে তার লাম্পট্যপূর্ণ জীবনেরও অন্ত ছিল না। ১৯৭২ এর ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি সপ্তম বারের মতাে বিয়ে করেন। করাচির হুররিয়াত পত্রিকা বলে যে খায়ের লাহােরের একজন ডেন্টিস্টের | সেক্রেটারি মিস শাহেরজাদকে বিয়ে করেছিলেন। জি এম খায়ের প্রায়ই সেখানে যেতেন। তার বিয়েতে জনাব ভুট্টো ও ভুট্টোর স্ত্রী এবং সরকারের খুব নির্দিষ্ট কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। পাকিস্তানি পত্রিকাগুলাে প্রায় সময় জি এম খায়েরর বিয়ের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কে মেতে উঠত। তার সপ্তম বিয়ে নিয়ে লাহােরের নাবাই ওয়াক্ত পত্রিকা লিখেছিল আমাদের রাজনিতিক জি এম খায়ের বিয়ের বিষয়ে বিশ্ব রেকর্ড করবে। পাকিস্তানের সংবাদপত্রের ধারণা অনুযায়ী ইয়াহিয়া খানের প্রাক্তন সহকারী। যারা পরবর্তীতে ভুট্টো সরকারে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন তাদের প্রচেষ্টায় ভুট্টো সরকার দেশের প্রাক্তন সরকার প্রধানের বিষয়গুলাে নিয়ে বেশি পরিমাণ হইচই করা থেকে বিরত ছিলেন। ইয়াহিয়া খানের সুন্দরী রমণীদের মধ্যে যে নারীটা সবচেয়ে বেশি অগােচরে ছিল এবং সংবাদপত্র যাকে নিয়ে খুব একটা নড়াচড়া করেনি সে। হলাে ফিরদৌসি। সে একজন নৃত্য শিল্পী ও অভিনেত্রী ছিল। ফেরদৌসি নামে অবশ্য ইয়াহিয়া খানের আরাে একজন দেহপসারিণী ছিল। যাই হােক এই নৃত্য শিল্পী ফেরদৌসি দাবি করে যে ইয়াহিয়া খান তাকে শারীরিকভাবে ভােগের জন্য কখনাে ব্যবহার করেননি। বরং মানসিক প্রশান্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে তার সাথে সময় কাটাতেন। পাকিস্তানের সংবাদপত্র অবশ্য দাবি করত যে ফেরদৌসি লিখতে ও পড়তে জানত না। বত্রিশ বছর বয়সী ফেরদৌসি ছিল ইয়াহিয়া খানের হারেম কেবিনেটের সবচেয়ে কম বয়স্ক সুন্দরী। ইয়াহিয়া খানের হারেমে আরাে ছিল পাকিস্তান ব্যাংকের প্রধান পরিচালক জনাব দুররানির স্ত্রী, অফিসিয়াল সিআইডি প্রধানের স্ত্রী মিসেস এম এ খান। ইয়াহিয়া খানের প্রাক্তন এই সমস্ত সহচারী সংঘবদ্ধ হয়ে পরবর্তীতে ইয়াহিয়া খানের সব বিষয় ধামাচাপা দিয়েছিল বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল।
সূত্র : প্রাইভেট লাইফ অফ ইয়াহিয়া খান – দেওয়ান বারীন্দ্রনাথ