You dont have javascript enabled! Please enable it! বইমেলায় মুক্তিযুদ্ধ - সেন্টার ফর বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার স্টাডিজ - সংগ্রামের নোটবুক

বইমেলায় মুক্তিযুদ্ধ

“সেন্টার ফর বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার স্টাডিজ’ মুক্তিযুদ্ধের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। আমাদের মূল লক্ষ্য পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালি। জাতির শৌর্য, বীর্য, আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেমের প্রণােদনা রেখে যাওয়া। মায়ের ভাষা ও দেশের মাটির জন্য একাধারে কানাকড়ির দামে প্রাণ দিয়েছি গােটা পৃথিবীতে শুধু আমরাই। আমরা বর্তমানে দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। দুঃসময় কোন জাতির নেই বা ছিলাে না। কাজেই আমরা ক’জন সম্মুখ সমরের যােদ্ধা মিলে যে প্রতিষ্ঠানটি গঠন করেছি তার এগিয়ে যাওয়াও থামবে না।  ২০০৭ থেকে প্রতিষ্ঠানটি অমর একুশে গ্রন্থমেলায় অংশগ্রহণ করে আসছে। মেলায় আমাদের স্টলে নিজেদের প্রকাশিত বই ছাড়াও দেশের অন্যান্য প্রকাশকের প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের বই বিক্রি করি। এ বিষয়ে বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষের বিশেষ অনুমােদন গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকাশকরা তাদের মুক্তিযুদ্ধের বই বিক্রি করছেন, সঙ্গে আমরাও তাদের বই বাংলা একাডেমীর অনুমােদিত কমিশনে বিক্রি করছি। ক্রেতারাও একটি নির্দিষ্ট স্টলে মুক্তিযুদ্ধের মােটামুটি সব বই কিনতে পারছেন। আমাদের স্টলের স্লোগান-‘শুধুই মুক্তিযুদ্ধের বই’। আমি প্রতি সন্ধ্যায় স্টলে বসি। বসে বসে দেখি কোন বয়সের ক্রেতারা মুক্তিযুদ্ধের বই কেনেন, মুক্তিযুদ্ধের কী ধরনের বই কেনেন। মেয়েরা কী ধরনের বই চান। স্কুলের ছেলেমেয়েদের আর শিক্ষকদের চাহিদা কেমন। বলা যায়, এক ধরনের ক্রেতা-পাঠক জরিপ। কাজটা করি আমি খুব আনন্দের সঙ্গে। ক্লাস ফোরের এক ছেলে এসে বই চাচ্ছে, যার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আছে। আমি তিন ফুট চওড়া কাউন্টারকে লম্বায় চার ফুট এবং উচ্চতায় দুই ফুট দেখিয়ে বললাম, ‘এত বড় একটা বই হবে, তারপরও সবকিছু হয়তাে থাকবে না।’ ও কী বুঝল কে জানে। মুখে বললাে, “ও আচ্ছা’। আরও ছােট এক ক্রেতা এসে বলল, ‘দাদু (মুখে একগাল সাদা দাড়ির কারণে), আমি বাসায় মুক্তিযুদ্ধ করি’। স্বভাবতই ক্রেতার বয়স এবং উক্তি আমার জ বাকিয়ে ফেললাে। বললাম, ‘কীভাবে’।

‘আমি ভিডিও গেমসে পাকিস্তানি সৈন্যদের মারি’। আমার ভালাে লাগে, অনুপ্রাণিত হই। অন্তত পাঁচটি বই শিশু-কিশােরদের জন্য আগামী বইমেলার আগে লিখবাে, নিজে নিজেই প্রতিজ্ঞা করে ফেলি। ১৯৯৯ সালের জানুয়ারি মাসের জনযুদ্ধের গণযােদ্ধা নামের একটি বই লিখেছিলাম। বইটিতে আমাদের সম্মুখসমরে নিম্নবর্গের যােদ্ধাদের সাহস, দেশপ্রেম এবং আত্মত্যাগের কাহিনী বর্ণনা করেছি। এখানে আছে নৌকার মাঝি, এইট পাস ছেলে, গেরস্থের কামলাসহ মাটিবর্তী মানুষের অবদানের কথা, তাদের বুকভাঙা কষ্টের কথা- যারা ছিলাে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল নিয়ামক।  একদিন বইমেলা থেকে হঠাৎ জরুরি কাজে বাইরে যাবাে। এমন সময় কচি মুখাবয়বের ফরসা লম্বা একটা ছেলে স্টলের সামনে দাড়িয়ে বললাে স্যার আপনার জনযুদ্ধের গণযােদ্ধা বইটি পড়েছি। খুব ভালাে লেগেছে। ছেলেটি আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে বলল, ‘স্যার কিন্তু…’। ছেলেটির কিন্তু শুনে প্রচণ্ড ব্যস্ততায় ও সােজা হয়ে দাঁড়ালাম। বললাম, বলাে, কোন অংশ তােমার ভালাে লাগেনি। ছেলেটি অবলীলায় সবিনয়ে অথচ দৃঢ় উচ্চারণে প্রশ্ন করলাে, তাহলে স্যার দেশটা এমন হলাে কেনাে? তাকিয়ে দেখি ছেলেটির দুচোখ থেকে পানির ফোটা মাটিতে পড়ছে। ছেলেটির প্রশ্নে আমার সব ব্যস্ততা উবে গেছে ততােক্ষণে। আমি রাষ্ট্র বিজ্ঞানী নই, সমাজ বিজ্ঞানীও না। এ প্রশ্নের জবাব দেবার আমি কেউ নই। আমি কম জানার মানুষ। ডান হাতের তালুটা ছেলেটার মাথার উপরে রেখে বললাম, ‘বাবা, ভালাে থেকো’। 

সূত্র : পতাকার প্রতি প্রণোদনা – মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া (অব.)