You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.15 | একাত্তরের খণ্ডচিত্র - সংগ্রামের নোটবুক

একাত্তরের খণ্ডচিত্র

একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে সম্পৃক্ত বহু ঘটনা ঘটেছে দেশে, কখনও দেশের বাইরে। দেশের ভেতর কখনও যুদ্ধের মাঠে, কখনও অন্য স্থানে, আবার কখনও জাতিসংঘে বা ভারত মহাসাগরে। ঘটনাগুলাে কৌতুহলােদ্দীপক, মজাদার, হাসির আবার কখনও কোনাে ব্যক্তির প্রকৃত পরিচয় উন্মোচক, কখনােবা ইতিহাসের মূল্যবান উপাদান। ঘটনাগুলাে আপাত বিচ্ছিন্ন কিন্তু অনর্থ নয়। এ রিণেই মুক্তিযুদ্ধের অনুসন্ধিৎসু পাঠকের জন্য প্রতিটি ঘটনার সূত্র দেয়া হলাে।[  পাকিস্তানি ডুবােজাহাজের সলিল সমাধি এবং… একাত্তরের যুদ্ধে পূর্বাঞ্চলের সব সময় কার্যক্রম সমন্বয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে অবস্থিত ইন্ডিয়ান ইস্টার্ন আর্মি কমান্ড (EASTCOM) হেডকোয়ার্টার্সকে। জেনারেল অফিসার কমান্ডার ইন চিফ ছিলেন লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরা। ইস্টার্ন নেভাল কমান্ডের হেডকোয়ার্টার্স ছিল ভারত মহাসাগরের পূর্ব উপকূলের পােতাশ্রয় বিশাখাপত্তমে। ফ্লাগ অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ ছিলেন ভাইস এডমিরাল এন কৃষ্ণান। আসামের শিলংয়ে অবস্থিত ছিল ইস্টার্ন এয়ার হেডকোয়ার্টার্স। এয়ার অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ ছিলেন এয়ার মার্শাল দেওয়ান। ইন্টার্ন আর্মি কমান্ডের চিফ অব স্টাফ ছিলেন মে. জেনারেল জেএফআর জ্যাকব। হেডকোয়ার্টার্সে আর্মি কমান্ডের অধীনে অপারেশনের মূল দায়িত্ব চিফ অব স্টাফের।  মে. জেনারেল জ্যাকব লেখেন : ৩ ডিসেম্বর সকালে আমাদের ইস্টার্ন নেভাল কমান্ডের ফ্লাগ অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ এডমিরাল কৃষ্ণান আমাকে টেলিফোন করলেন এটা বলার জন্য যে বিশাখাপত্তমে ঢােকার পথে জেলেরা পাকিস্তানি একটি ডুবােজাহাজের ভগ্নাবশেষ পেয়েছে। ইতােমধ্যে পাকিস্তানি সাবমেরিন পিএনএস গাজীর বেতার কথােপকথনে আড়ি পেতে সাবমেরিনটি যে বঙ্গোপসাগরে ঢুকছে সে খবর পাই। এডমিরাল কৃষ্ণান বললেন যে, ১ বা ২ ডিসেম্বর মাইন লাগানােরত অবস্থায় সাবমেরিনটি বিস্ফোরিত হয় এবং সেটা হয়েছে ঈশ্বরের ইচ্ছায়। তিনি বললেন, এর ফলে তাদের নৌবাহিনীর অবাধ যাতায়াতের সুবিধা আরও বাড়বে। পরদিন, ৪ ডিসেম্বর এডমিরাল কৃষ্ণান। আমাকে আবার টেলিফোন করে জানতে চাইলেন, পাকিস্তানি সাবমেরিন গাজী” ডােবার বিষয়ে আমরা দিল্লিকে জানিয়েছি কীনা। আমি বললাম, আমি ধারণাকরেছিলাম আপনারা জানাবেন, তাই জানাইনি। আশ্বস্ত হয়ে তিনি আমাকে ধন্যবাদ জানালেন এবং এ বিষয়ে পূর্বে যে কথাবার্তা হয়েছে তা ভুলে যেতে বললেন।

পরে ভারতীয় নৌবাহিনীর সরকারি ভাষ্যে বলা হয়, ভারতীয় ইস্টার্ন নেভাল কমান্ডের যুদ্ধজাহাজ ৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সাবমেরিন ‘গাজী’ ডুবিয়েছে। কর্নেল মােহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানীকে (অব.) পাকিস্তানিরা ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৭ অবসর প্রদান করে এবং তিনি সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সদস্য (এমএনএ) নির্বাচিত হন। চাকরিতে থাকাকালীন এবং অবসর গ্রহণের পরও তিনি সক্রিয় ও সচেষ্ট ছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাঙালির সংখ্যা ও সম্মান বাড়াতে। তিনি ১৯৩৯ সালে আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি থেকে ভূগােলে এমএ পাস করেন। ১৯৪০ সালের ৫ অক্টোবর তিনি ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমী, দেরাদুন থেকে কমিশন লাভ করেন। বাংলা, বাঙালি এবং বাংলাদেশ ছিল তার হৃদয়ের অন্তঃস্থলে। তিনি চিন্তায়। ও বিশ্বাসে ছিলেন আদি ও পুরননা। অত্যন্ত সাদাসিধা যার জীবনযাপন কিন্তু খাবারের ব্যাপারে তিনি ছিলেন ব্রিটিশ নিয়মাচারী। ১৫ জুলাই ১৯৭১ থেকে তাকে। পুনরায় সক্রিয় চাকরিতে ভর্তি করা হয়। ১৪ জুলাই ১৯৭১ বাংলাদেশ সরকার তাকে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ নিয়ােগ করে। কর্নেল ওসমানী তার নিজ নামে এবং তার একজোড়া সাদা গোঁফে ছিলেন সবার পরিচিত। আচরণে কখনও কঠোর, কখনও কোমল। ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অফিসারদের সঙ্গে মর্যাদার প্রশ্নে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সংবেদনশীল। চাকরি এবং বয়সে কর্নেল ওসমানী ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল শ্যাম হরমুজজি ফ্রেমজি জামশেদজি মানেকশ’র সমসাময়িক। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, তিনি দেশ ত্যাগ করেছেন, তিনি দেশচ্যুত হননি। তার যােদ্ধারা যুদ্ধে ব্যর্থ হয়েছে কিন্তু পরাজিত হয়নি। অনেকেই তার ভাবগাম্ভীর্য এবং বাস্তবতাবিবর্জিত আচরণ নিয়ে সমালােচনা করতেন। কিন্তু তার কঠোর নিন্দুকরাও কর্নেল ওসমানীর দেশপ্রেম, সততা, নিষ্ঠা এবং আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেনি। তিনি “সেকেলে’ হিসেবে অভিযুক্ত হয়েছেন প্রায়শই। তারপরও যুদ্ধ চলাকালীন তিনি নিজেকে কখনােই জেনারেল পদে উন্নীত করতে চাননি, যা হয়তাে তিনি চেষ্টা করলে পারতেন। এটা করলে তার পক্ষে ভারতীয় সিনিয়র অফিসারদের সঙ্গে কাজকর্ম সহজতর হতাে।

কর্নেল ওসমানীর এমন এক অস্বাভাবিক আচরণ সম্পর্কে মে. জেনারেল। সুখওয়ান্ত সিং লেখেন, আমার মনে আছে তিনি (ওসমানী) তার বিমানের (হেলিকপ্টার) পাইলটকে (কলকাতার দমদম বিমান বন্দরে) অবতরণ করতে অনুমতি দেননি, যতক্ষণ ভারতীয় আর্মি কমান্ডার (লে, জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরা) তাকে অভ্যর্থনা জানানাের জন্য তৈরি হননি। যদিও তার হেলিকপ্টার জেনারেল অরােরার হেলিকপ্টারের আগেই দমদম পৌছে। ওসমানীর বিমানের অসহায় পাইলট বিমানবন্দরের আশপাশে দশ মিনিট উড়ন্ত অবস্থায় থাকে যতক্ষণ না টাওয়ার থেকে জানানাে হয় যে, জেনারেল অরােরা তাকে অভ্যর্থনা জানাতে প্রস্তুত। পাকসেনাদের বিদেশি নির্যাতন একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশে যে আচরণ করেছে তা ইতর প্রাণীর আচরণকেও হার মানায়। তারা শুধু বাঙালিদের ওপরই লুট, হত্যা, ধর্ষণ চালায়নি, বিদেশিরাও তাদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পায়নি। বিদেশিদের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে তা কখনও পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযােগ আকারে উত্থাপিত হয়েছে, কখনও তারা গােপন করেছে লজ্জা ঢাকার জন্য। তারপরও পাকিস্তানিদের পশুপ্রবৃত্তির প্রসারই ঘটেছে। মহাখালীতে কলেরা হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. হেয়ারের (আমেরিকান)। গুলশান আবাসিক এলাকায় বাসা। ২ এপ্রিল সকাল দশটায় দুই পাকিস্তানি সেনা ডা. হেয়ারের ঘরে জোর করে ঢােকে, একজনের সঙ্গে রাইফেল, অন্যজনে হাতে গ্রেনেড। তারা গ্রেনেডের ভয় দেখিয়ে মিসেস হেয়ারের হাতঘড়ি, দেয়ালঘড়ি, কার্পেট ও অন্যান্য | সামগ্রী নিয়ে যায়। বাড়ির কাজের লােকজনের ঘড়ি এবং ছােটখাটো সামগ্রী নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় বাড়ির সবাইকে শাসিয়ে যায় যে, এ খবর জানাজানি হলে সবাইকে হত্যা করা হবে।

পরদিন ডা, হেয়ারের বাড়ির কাছে কলেরা ল্যাবরেটরির ডা. ডােয়েল জে  ইভানস ও তার স্ত্রীকে দুই পাকসেনা আটক করে। তারা গাড়িতে ছিলেন। পাকসেনারা তাদের কাছ থেকে নগদ ৬৬ ডলার, একটি হাতঘড়ি ও একটি আংটি নিয়ে যায়। দুই পাকিস্তানি সেনা যখন ডা. ভােয়েলদের পাসপাের্টও নিতে চায় তখন তারা এই বুঝিয়ে তাদের ক্ষ্যান্ত করে যে, এগুলাে তাদের কোনাে কাজে আসবে না। ঢাকাস্থ আমেরিকান কনসাল জেনারেল আর্চার কে ব্লাড জানান সরকারি চাকরিজীবী নন এমন একজন আমেরিকান নাগরিকের স্ত্রীকে এক পাকিস্তানি ধর্ষণ করে। সে  আমেরিকান নাগরিক পাকিস্তানি ধর্ষক সৈন্যটিকে হত্যা করে। ঘটনাটি গােপন করার জন্য পাকসেনার মৃতদেহটি তার বাড়ির ভেতর লনে গর্ত করে ঢুকিয়ে রাখে।  চট্টগ্রাম পাকিস্তানিদের মেকি আত্মবিশ্বাস ২৫ মার্চ রাতে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে কেবল একটি পশ্চিম পাকিস্তানি ইউনিট ছিল-২০ বেলুচ রেজিমেন্ট। ইউনিটের অধিনায়ক ছিলেন লে. কর্নেল এএইচ ফাতমি। এ ইউনিটটি সমুদ্রপথে করাচি যাওয়ার জন্য চট্টগ্রামে আসে। অগ্রগামী দল ইতােমধ্যে করাচি চলে যায়। চট্টগ্রামে অবশিষ্ট থাকে প্রায় পাঁচশ সৈন্য। অপরদিকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার (রিক্রুটসহ), ৮ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইপিআর (বর্তমানে বিডিআর) মিলে মােট সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ হাজার। ইবিআরসি’র কমান্ড্যান্ট ছিলেন বিগ্রেডিয়ার মাহমুদুর রহমান মজুমদার (বাঙালি) এবং চিফ ইন্সট্রাক্টর ছিলেন লে. কর্নেল মুজিবর রহমান চৌধুরী (বাঙালি)। উচ্চতর রাজনৈতিক নির্দেশনার জন্য ব্রিগেডিয়ার মজুমদার বাঙালি অফিসারের মাধ্যমে ঢাকায় যােগাযােগ করে নির্দেশনা পাননি। স্থানীয়ভাবে তিনি জনাব এমআর সিদ্দিকীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রক্ষা করেন। মূলত রাজনৈতিক নির্দেশনার অভাবেই চট্টগ্রামে বাঙালি সৈনিকরা সংগঠিত হতে পারেনি।

প্রধানত এ কারণেই সম্ভব হয়েছে ২০ বেলুচের পাঁচশ সৈন্য দিয়ে বাঙালি হত্যা করা। চট্টগ্রামে ২০ বেলুচের অসহায়ত্বের কথা ভেবে ২৫ মার্চ রাতে কুমিল্লা থেকে ৫৩ বিগ্রেডকে বিগ্রেডিয়ার ইকবাল শফির নেতৃত্বে সড়কপথে চট্টগ্রামে পাঠানাে হয়। তার আগেই কুমিল্লা থেকে ৩ কমান্ডে ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল জহির আলম খানের নেতৃত্বে ইউনিটটিকে চট্টগ্রামে পাঠানাে হয়। তারা বেসামরিক পােশাকে আশ্রয় নেয় বেসামরিক এলাকায় বিহারিদের বাড়িতে বেশিরভাগ পাহাড়তলী এলাকার রেলওয়ে কলােনিতে। ২৫ মার্চ ২ কমান্ডাে ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল সােলায়মানের নেতৃত্বে পাকিস্তান থেকে ঢাকা এনে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে রাখা হয় এবং পরদিন সি-১৩০ সামরিক পরিবহন বিমানে করে চট্টগ্রামে পাঠানাে হয়। ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি তার বিগ্রেড নিয়ে প্রথমে শুভপুর এবং পরে কুমিরায়। মুক্তিবাহিনীর প্রবল প্রতিরােধের সম্মুখীন হন। প্রচুর হতাহত হয় পাকিস্তানিদের। ৫৩ ব্রিগেডের ২৪ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের অধিনায়ক লে. কর্নেল শাহপুর খান বখতিয়ার নিহত হন কুমিরার যুদ্ধে। ৫৩ বিগ্রেড ঢাকা এবং চট্টগ্রামের সঙ্গে সব যােগাযােগ হারিয়ে ফেলে। ১৪ ডিভিশনের জিওসি মে. জেনারেল খাদিম হােসেন রাজা হেলিকপ্টার নিয়ে ৫৩ ব্রিগেড খুঁজতে বের হন। তিনি চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অবতরণ করে লে. কর্নেল ফাতমির সঙ্গেও স্বল্পক্ষণিক যােগাযােগ করেন। ঢাকা ফেরার পথে তার হেলিকপ্টার বাঙালি সৈনিকদের গুলিতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। তিনি ঢাকায় ফেরত আসেন।

২৭ মার্চ বিকেলে মে, জেনারেল আবুবকর ওসমান মিঠা ২ কমান্ডাে ব্যাটালিয়নের অধিনায়ককে আদেশ দেন তার ইউনিট নিয়ে চট্টগ্রাম-ঢাকা পথে অগ্রসর হয়ে ৫৩ ব্রিগেডের সঙ্গে মিলিত হতে। আশঙ্কা করা হয় যে, ৫৩ ব্রিগডে হয়তাে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ২ কমান্ডাে ব্যাটালিয়ন বাংলাদেশের পথঘাট কিছুই চেনে না এবং এখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কেও অবগত নয়। ক্যাপ্টেন সিদ্দিকী নামে এক বিহারি অফিসারকে দেয়া হয় তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। নৌবাহিনী থেকে গাড়ি ধার করে ২ কমান্ডাে ব্যাটালিয়ন বিকেল পাঁচটায় যাত্রা শুরু করে। লে. কর্নেল সােলায়মান গাড়িগুলােকে বহরে চলার নির্দেশ দেন। লে. কর্নেল জেএ খান যিনি ৩ কমান্ডাে ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক হিসেবে গত কয়েকদিন বাঙালি সৈন্যদের সঙ্গে লড়ছেন, তাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, এটা সাধারণ বেসমারিক সরকারের সাহায্যের মতাে ডিউটি নয়, যুদ্ধাবস্থা। নবাগত লে. কর্নেল সােলায়মান জবাবে বলেন, তােমরা যারা দীর্ঘদিন। পূর্ব পাকিস্তানে আছে তাদের স্নায়ু দুর্বল হয়ে গেছে। লে. কর্নেল জেডএ খানের পরামর্শের কথা ভ্রুক্ষেপ না করে তিনি যাত্রা শুরু করেন। চট্টগ্রামের টাইগারপাসে একটি নৌ স্থাপনা ছিল। লে. কর্নেল জেডএ খানের কাছে রাত সাড়ে সাতটায় চট্টগ্রাম নৌঘাটিতে একটি টেলিফোন আসে। বিকেলে যাত্রা করা ২ কমান্ডাে ব্যাটালিয়নের এক নায়েক টেলিফোন করেছে তার ইউনিট মুক্তিবাহিনীর এম্বুশে পড়েছে, সবাই মারা গেছে এবং সে-ই একমাত্র বেঁচে আছে। রাত এগারােটার দিকে এম্বুশ থেকে বেঁচে এসে মেজর ইকবাল নৌঘাটিতে কর্নেল জেডএ খানকে জানায়, শহর ছেড়ে কুমিল্লা রাস্তায় আধা মাইল যাওয়ার পর তারা এম্বুশে পড়ে। লে. কর্নেল সােলায়মান, ক্যাপ্টেন সিকান্দার এবং ক্যাপ্টেন সিদ্দিকী মারা গেছে এবং সে হতাহতদের নিয়ে এসেছে। নৌঘাটিতে একটি ছােট এমআই রুম (ডাক্তারখানা) ছিল। তার দায়িত্বে ছিলেন লে. কমান্ডার পদবীর এক নৌবাহিনীর ডাক্তার। প্রথমে আহতদের নামিয়ে মেঝেতে রাখা হয়, তারপর মৃতদের। লে. কর্নেল (ডাক্তার) এসে এতাে মৃতদেহ, আহত এবং রক্তের মাখামাখি দেখে নিজেই অজ্ঞান হয়ে যান। তাকে দ্রুত সেখান থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। 

এই এম্বুশে লে. কর্নেল সােলায়মানসহ তিনজন অফিসার, একজন জেসিও এবং উনিশজন সৈনিক মারা যায়। আহত হয় আরও বিশজন। জেনারেল আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খান আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খান। জন্ম : পেশােয়ারের কাছে, ফেব্রুয়ারি ১৯১৭। জন্মগতভাবে সৈনিক। পার্সি শাসক নাদির শাহ যিনি অষ্টাদশ শতাব্দীতে দিল্লি দখল করেন তার তুখােড় যােদ্ধাবংশের উত্তরসূরি। শিক্ষাগতভাবে সৈনিক। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি দেরাদুনে ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমীতে যােগদান করেন এবং ক্লাসে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ড্রিলের মাঠে ছিলেন উঁচু মাথায় সৈনিক এবং সতীর্থদের থেকে শিক্ষায় এগিয়ে। আচরণে সৈনিক, মননে, চলনে ও বলনে ইয়াহিয়া ছিলেন নিখাদ সৈনিক। যেখানে যেতেন, যে পােশাকে যেতেন তার চলন ছিল প্রত্যয়দীপ্ত ও আত্মবিশ্বাসে ভরা, হাতের নিচে সার্বক্ষণিক থাকতাে একটা ব্যাটন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইয়াহিয়া কৃতিত্ব ও সাহসের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে ও ইতালিতে যুদ্ধ করেন। ইতালিতে তিনি জার্মানদের হাতে বন্দি হন এবং সেখান থেকে পালিয়ে আসতেও সক্ষম হন। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভাগের পরে তিনি পাকিস্তান স্টাফ কলেজের কমান্ড্যান্ট নিযুক্ত হন।

সেখানে তিনি ছাত্রদের সেনাবাহিনীতে এগিয়ে যাওয়ার বাস্তব শিক্ষা দিতেন। ৩৪ বছর বয়সে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কনিষ্ঠতম বিগ্রেডিয়ার, ৪০ বছর বয়সে কনিষ্ঠতম মেজর জেনারেল এবং ৪৯ বছর বয়সে তিনি কমান্ডার ইন চিফ হন। ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ ৫২ বছর বয়সে তিনি তিনটি টুপি ধারণ করেন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, চিফ মার্শাল ল’ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর এবং পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ। যত দ্রুত তিনি সাফল্যের মই বাইলেন, কোনাে মই ছাড়াই তার চেয়ে দ্রুতগতিতে তিনি নিচে নামলেন। সুরা আর রমণীতে তিনি তার ভুবন গুটিয়ে ফেললেন। রাজনীতির শিক্ষা ও চর্চা ছাড়াই তিনি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। ৫৪ বছর বয়সে এই জেনারেল নিজের মুখে চুনকালি মেখে এবং পাকিস্তানবাসীদের বিশ্বের কাছে অপমানিত করে গ্লানির চরমে উঠে সফলভাবে পাকিস্তান ভাঙতে সক্ষম হলেন। ২০ ডিসেম্বর ১৯৭১ তাকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে লজ্জাজনকভাবে। অপসারিত করা হয়। পাকিস্তানি মহিলারা বিক্ষোভে রাস্তায় নেমে তাকে চুড়ি পরতে নির্দেশ দেয়। একাত্তরে তার মন্ত্রণাদাতা জুলফিকার আলী ভুট্টো তাকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত। গৃহবন্দি করে রাখেন। বন্দি অবস্থায় মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে বিকলাঙ্গ হয়ে যান। ইয়াহিয়া। বাহাত্তরে মুক্তি পেয়েও ইয়াহিয়া শারীরিকভাবে অথর্ব ও অক্ষম থাকেন। ১৯৮০ সালের ১০ আগস্ট তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর আজও তিনি ইতিহাসে বেঁচে আছেন নির্মম, নিষ্ঠুর এবং মানবতাবিরােধী এক কলঙ্কময় ব্যক্তি হিসেবে। হায় পরিণতি হয় পাকিস্তানি লেখকদের হিন্দু বিদ্বেষ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অথবা একাত্তরে পাক-ভারত যুদ্ধের ওপর পাকিস্তানি লেখকদের কিছু বই যেমন :

  1. Tragedy of Errors-East Pakistan Crisis-Lt Gen Kamal Matinuddin 2. East Pakistan to Bangladesh-Brig Sadullah Khan 3. Witness to Surrender-Siddiq Salik 4. TRhe Betrayal of East Pakistan-Lt Gen AAK Niazi 5. How Pakistan Got Divided-Maj Gen Rao Farman Ali Khan 6. The 1971 Indo-Pak War-Maj Gen Hakeem Arshad Qureshi 7. East Pakistan: The Endgame-Brig A R Siddiqui. প্রভৃতি বইগুলােয় একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়-লেখকদের হিন্দু বিদ্বেষ। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা হিন্দু বংশােদ্ভূত, তাদের ওপর হিন্দুর প্রভাব উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তানে সব শিক্ষিত ব্যক্তি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষক হিন্দু এবং তারা বাঙালি মুসলমান ছাত্রদের হিন্দু শিক্ষায় দীক্ষিত করছে। ভারতের নাম তুলতেও হিন্দু ভারত’ বলেন তারা। আমাদের বাঙালি মুসলমানদের যেন কোনাে স্বকীয়তাই নেই। ওপরের লেখকদের বিশেষ করে যারা সামরিক বাহিনীর, তাদের অনেকেই জানি না অবচেতনে কীনা তাদের বইতে তাদের রমণীপ্রীতি, পরশ্রীকতারতা আর শরাবের প্রতি তাদের আসক্তির কথা লিখেছেন। অবশ্য সবার কলমেই ইসলামী উম্মাহ’র প্রাধান্য। তাদের মূলকথা-পাকিস্তানের ক্ষতির অর্থ ইসলামের ক্ষতি, পাকিস্তান ভাঙার অর্থ ইসলামের পরাজয়। তাদের উপলব্ধিতে কখনােই আসে না যে আদতে ইসলাম ইসলামের স্থানেই আছে, অধঃপতন হয়েছে পাকিস্তানিদের। একাত্তরে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সমরনায়করা মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ তাে দূরের কথা, এ সম্পর্কিত বিষয়ে মাঠে বা চুক্তিতে মুক্তিবাহিনীর নাম আনারও ঘাের বিরােধী ছিল। আত্মসমর্পণের পরপরই ভারতীয় অফিসারদের সঙ্গে এই পাকিস্তানিদের কী অদ্ভুত সখ্য। তাদের আদি বাড়ি ভারতের কোন স্থানে, কোন রাজপুত রেজিমেন্টে তার কমিশন, কার প্রথম পােস্টিং জব্বলপুরে- সে আলাপের শেষ নেই। যেন কতাে যুগ পরে আত্মার সম্মিলন। | সিলেটে পাকিস্তানি ৩১৩ ব্রিগেডের অধিনায়ক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার ইফতেখার রানা। মেজর হিসেবে ১৯৬৪ সালে তিনি কাবুলে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমীর প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন। তারই ক্যাডেট ছিলেন মেজর আবু জাফর মােহাম্মদ আমিনুল হক। মেজর আমিনুল হক সিলেটে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আমাদের ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক। ব্রিগেডিয়ার ইফতেখার রানা ভারতীয়দের সঙ্গে চুটিয়ে গল্প করছেন। মেজর আমিন তার প্লাটুন কমান্ডারকে স্যালুট করলেন। ইফতেখার রানার ধড়ে পানি এলাে। মেজর আমিনের কানের কাছে মুখ এনে ভারতীয়দের দিকে চোখ ইশারা করে বললেন, ‘Don’t beleive these bustards’. ১৭ ডিসেম্বর কুমিল্লার কোটবাড়িতে পাকিস্তানি অফিসাররা ভারতীয়দের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ২ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর এটিএম হায়দারও ছিলেন সঙ্গে। যাওয়ার সময় তিনি আমাকেও নিয়ে গেলেন। পাকিস্তানি অফিসাররা এক সারিতে দাঁড়িয়ে একে একে যার যার পিস্তল/রিভলভার মাটিতে নামিয়ে রাখছেন। এক পাকিস্তানি মেজর পিস্তল বের করতে করতে কাঁদতে কাঁদতে ভারতীয় অফিসারকে বলছেন, “Today you are arresting us, tomorrow you will cry for us. you don’t know the Bangalis.” শেষ কথা : প্রচণ্ড হিন্দুবিদ্বেষী এই পাকিস্তানি অফিসাররাই প্রায় ৮৪ হাজার সৈন্য নিয়ে বেসামরিক ব্যক্তি, প্যারা-মিলিটারি ফোর্স এবং পশ্চিম পাকিস্তানি পুলিশ বাদে ‘হিন্দু ভারতের সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে (যদিও আত্মসর্পণের দলিলে ভারত বাংলাদেশ যৌথ বাহিনী’)। সেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল স্যাম হরমুজজি ফ্র্যামজি জমশেদজি মানেকশ ছিলেন পার্সি, ভারতীয় ইস্টার্ন আর্মি কমান্ডার লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরা, যার কাছে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিলেন ছিলেন শিখ এবং জেনারেল অরােরার চিফ অব স্টাফ মে, জেনারেল জ্যাকব ছিলেন একজন ইহুদি। কেউই হিন্দু ছিলেন না।». Lt Gen JFR Jacob, Surrender at Dacca–Birth of a Nation. TheUniversity Press Limited. Dhaka, 1997.P. 104 3. Maj Gen Sukhwant Singh, The Liberation of Bangladesh, Lancer

    Publishers, New Delhi, 1980. P. 34. 9. Archer K. Blood, The Cruel Birth of Bangladesh, The University

    Press Limited, Dhaka, 2002, P. 238

    Ibid, p. 232 Q. Siddiq Salik, Witness to Surrender, The University Press Limited,

    Dhaka, 1997, p. 80 4. Brig ZA Khan (Retd) The Way It Was, Dynavis (Private) Ltd.

    Karachi, 1998, pp. 275-277. 4. Jack Anderson, The Anderson Papers, Millington Ltd. 1973,

    London. pp. 215-216 and The Hutchinson Family Encyclopedia.

সূত্র : পতাকার প্রতি প্রণোদনা – মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া (অব.)