বাংলার বাণী
ঢাকা : ৬ই নভেম্বর, বুধবার, ১৯৭৪, ১৯শে কার্ত্তিক, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ
ভুট্টোর প্রতি সোভিয়েত নেতৃবৃন্দের পরামর্শ
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো গত মাসের শেষের দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বিরাজমান বিভিন্ন সমস্যা ছাড়াও উপমহাদেশ ও আন্তর্জাতিক সমস্যাদি নিয়ে সোভিয়েত নেতৃবৃন্দের সাথে তিনি আলাপ-আলোচনা করেছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে বিবদমান সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য সোভিয়েত নেতৃবৃন্দ জনাব ভুট্টোকে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা করবার পরামর্শ দিয়েছেন। এ ছাড়া সোভিয়েত নেতৃবৃন্দ আরো সুস্পষ্টভাবে জনাব ভুট্টোকে ভারতের সাথে বাণিজ্য সহ অন্যান্য বিষয়ে ঘনিষ্ঠতর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠারও পরামর্শ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরকালে যে যুক্ত ইশতেহার প্রকাশিত হয় তাতে এই মর্মে আশা প্রকাশ করা হয়েছে যে, উপমহাদেশের দেশগুলো নিজেদের সমস্যাসমূহের পরিপূর্ণ সমাধান ও সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ ত্বরান্বিত করার ব্যাপারে নতুন গঠনমূলক পদক্ষেপ নেবে। ইতিমধ্যে স্বাক্ষরিত চারটি চুক্তি যা উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে তাকে বাস্তবায়নের প্রচেষ্টাও অব্যাহত থাকবে। ইশতেহারে ১৯৭৪ সালের ৪ঠা এপ্রিল নয়াদিল্লীতে স্বাক্ষরিত ত্রিপক্ষীয় চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানী নাগরিকদের ফিরিয়ে নেবার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। মস্কোতে জনাব ভুট্টোর সম্মানে দেয়া এক ভোজ সভায় সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী মিঃ কোসিগিন এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলেছেন, উপমহাদেশের তিনটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ব্যাপারে পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীরা যে উদ্যোগ নিয়েছেন তার সফল সমাপ্তিই তাঁর কাম্য। এ ব্যাপারে সোভিয়েত নেতৃবৃন্দ আরো বলেছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্কের অগ্রগতিও পাক-ভারত বাণিজ্যিক সম্পর্কের অগ্রগতির উপর নির্ভরশীল। বস্তুতঃ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বিবদমান সমস্যাদির সমাধান হওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যে আগ্রহ ইতিপূর্বেই প্রকাশ করা হয়েছিল তা পাকিস্তানের মনোভাবের দরুণ অনেকখানি ব্যাহত হয়ে গেছে। আমরা পূর্বাপর উপমহাদেশের শান্তি, প্রগতি ও নিরাপত্তার প্রশ্নে সোচ্চার ছিলাম। সরকার বার বার তাদের মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। পাকিস্তানের সঙ্গে সে ব্যাপারে বাংলাদেশ আলাপ-আলোচনাও করেছেন। জনাব ভুট্টো যখন বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন তখনও উভয় দেশের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যাদির সমাধানের প্রশ্নে বাংলাদেশ তার মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু জনাব ভুট্টোর নেতিবাচক মনোভাবের দরুণ তা সম্ভব হয়নি। জনাব ভুট্টোর সাম্প্রতিককালের সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরের সময় সোভিয়েত নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যকার বিরোধসমূহের নিষ্পত্তির ব্যাপারে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা করার যে পরামর্শ দান করেছেন তা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত এবং বিবেচনা প্রসূত। ইতিপূর্বে আমরা জেনেছি—বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের পূর্বে চীনা নেতৃবৃন্দও পাকিস্তানের নেতাদেরকে বাংলাদেশের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পরামর্শ দান করেছিলেন। সে কারণেই বোধ করি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের বিষয়টি ত্বরান্বিত হয়েছিল। আমরা পাকিস্তান তথা উপমহাদেশের প্রত্যেকটি প্রতিবেশী এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই। সে কারণে বিভিন্ন সময় যে কয়েকটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে তার বাস্তবায়নের জন্যও আমরা সমভাবে আগ্রহী। আশা করি পাকিস্তানও তাদের গোটা রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের মনোভাব পুনর্বিবেচনা করে উপমহাদেশের শান্তি, প্রগতি ও নিরাপত্তার স্বপক্ষে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
যৌথচুরির মজা ভারী !
নিশ্চয়ই সব কালোবাজারী এক জাত। সবার প্রকৃত চরিত্র ও অসৎ প্রবণতা প্রায় একই রকম। তাই কোনো সমস্যা এলে বা ব্যবসায়ের উপর হুমকি অথবা তদন্তের ইশারা পেলে জবাবটাও সবাই দেয় একই ভাষায়। ঘটনাই তার প্রমাণ দেয়। গতকালকের ‘বাংলার বাণী’র প্রতিবেদন সূত্র জানাচ্ছে যে, নারায়ণগঞ্জ মহকুমার বিভিন্ন ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় রিলিফের জন্য বরাদ্দকৃত গম ও রিলিফের অন্যান্য দ্রব্যাদি শতকরা ২০ থেকে ৩০ মণ করে ওজনে কম হয়। বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও জনগণের অভিযোগকে কেন্দ্র করেই প্রতিবেদন সূত্র ঐ তথ্য সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু ওজন কমের কারণটা জানা যায়নি।
সাধারণতঃ বিভিন্ন ইউনিয়নের জন্য বরাদ্দকৃত গম সংশ্লিষ্ট গুদাম থেকেই ডেলিভারী নেয়া হয়। বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানগণ তাদের ইউনিয়নের জন্য বরাদ্দকৃত গম গুদাম থেকে নিয়ে ওজন করে দেখেন যে, শতকরা ৩০ মণ করে গম তাঁদেরকে ওজনে কম দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে চেয়ারম্যানগণ ও জনগণ বিভিন্ন সময়ে সিও (ডেভ) সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি নেতিবাচক উত্তর দিয়ে বলেন যে, এক্ষেত্রে তার কিছু করার নেই।
একই ধরনের অভিযোগ রূপগঞ্জ, আড়াই হাজার, মনোহরদী ও শিবপুর থানার বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে পাওয়া যায়। এবং সেখানকার থানা সিও-রাও জানিয়েছেন, এক্ষেত্রে তাদের কোনো দায়িত্ব নেই এবং তাঁরা এসবের কিছুই জানে না।
অতঃপর উচ্চপর্যায়ে মহকুমা প্রশাসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান যে, বরাদ্দকৃত মালামাল প্রাথমিক সরবরাহের সময় তাঁরা ওজনে ঠিকই দিয়ে থাকেন। তবে মাঝে মাঝে সি.এস.ডি থেকে যে সব মাল নেওয়া হয়, সেখানে কম দেওয়া হয় কি না সে খবর তিনি জানেন না।
সি.এস.ডি’র কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান যে, তাঁদের তরফ থেকে মাল সরবরাহের সময় ওজনে ঠিকই দেয়া হয়। অর্থাৎ পরের খবরে কেমন করে মালগুলো ওজনে কমে যায় বা যাচ্ছে সে কথা তারাও জানেন না। কিন্তু তবু ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় রিলিফের জন্য বরাদ্দকৃত খাদ্যশস্যাদি ওজনে কম থাকছে। জনগণের কষ্ট বাড়ছে এবং তারই প্রেক্ষিতে দেখা যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের হাট বাজারে রিলিফের গম বিকোচ্ছে প্রকাশ্যে।
কিন্তু এতো আর ডিটেকটিভ উপন্যাসের কাহিনী নয় যে ঘনায়মান রহস্য যতই ঘনীভূত হবে আমরা ততই উৎসাহে আকুল হবো? এই ‘জানি না’র রহস্য তাই আমাদের আনন্দবর্ধন করে না—করে ক্রোধের উদ্রেক। এ কথা স্বতঃসিদ্ধ যে, রিলিফের মাল যাঁদের কাছ থেকে যাদের হাতে বন্টনের নিমিত্তে আসছে—রহস্য সেই পরিসরেই লুকিয়ে আছে। এবং বাজারে বিকানো গমের মধ্যেও তার কিছুটা সূত্র আছেই।
আমরা লক্ষ্য করেছি রেশনের দোকান সম্বন্ধেও এ ধরনের অভিযোগ পত্রিকান্তরে ছাপা হয়েছে। রেশনের দ্রব্যাদি ওজনে কম দেওয়া তো হয়ই জিনিস দোকানে নেই বলে অসহায় খদ্দেরকে দেয় ঘুরিয়ে তারপর সেই গম যায় খোলা বাজারে। এমনিভাবেই ভোজ্য তেল, চিনি, চাল এবং আরো বহু প্রকার সরকার নিয়ন্ত্রিত দ্রব্যাদি বাজারে প্রকাশ্যে চড়া দামে বিক্রি হয়। সেখানেও কেউ কিছু জানেনা। এবং প্রকৃতপক্ষে কোনো সূত্র থেকেই সত্য বের করার সৎ চেষ্টা নেওয়াও হয় না। কারণ হয়তো জেগে ঘুমানো। এখন এ কথা সর্বজনবিদিত যে, সম্প্রতি দেশে চুরির অগুণতি পথ আবিষ্কৃত হয়েছে। যে কোনো স্থানে যে কোনো বরাদ্দকৃত জিনিস অসদুপায়ে হজম করা, লঙ্গরখানার মালামাল চুরি করা, গুদাম থেকে দ্রব্যাদি দেওয়ার সময়ে ওজনে মেরে দেওয়া, ত্রাণ-সামগ্রী বিলি-বন্টনের সময় আত্মসাৎ করা এসবই এখনকার হাল রেওয়াজ। যে যেভাবে পারে দেদার চুরি করে যায়। সবাই জানে সবার কথা—কিন্তু মুখ খোলেনা কেউ। ঐ যে কথায় বলে চোরে চোরে মাসতুতো ভাই তার আর কি।
তাই বলতে হচ্ছে, পারস্পরিক সমঝোতামূলক স্বার্থে যদি সবাই সবার পাপ হজম করতে চেয়ে জেগে ঘুমানোর ভান করে তাহলে তাদেরকে চিরকালের জন্য ঘুম পাড়ানোর বাস্তব পন্থা নেওয়া হোক। কেউ ‘জানেনা’র রহস্য উন্মোচন করে মুখোশধারী কালোবাজারীদের প্রকৃত চেহারা খুলে দেওয়া হোক সমাজের সামনে। এবং ত্রাণ-সামগ্রী যৌথভাবে চুরি করার অনায়াস লীলায় যারা পাশবিক উল্লাসে অংশ নিয়ে টাকায় পাহাড় তৈরী করছে এবং সর্বপ্রকার দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছে অমানুষের মতো ন্যায় দন্ডের নির্মম আঘাতে বিচূর্ণিত হোক তাদের অস্তিত্ব।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক