বঙ্গবন্ধু ও পরবর্তীকালে মােশতাক মন্ত্রী সভার অন্যতম মন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলীর সাক্ষাৎকার
তখন শ্লোগানের শব্দ আমাদের কানে এলাে। শ্লোগানটা আস্তে আস্তে বেশ জোরদার হচ্ছে। তখন বেলা কেবল উঠেছে। আর কোথাও গােলাগুলি শােনা যাচ্ছে না। শ্লোগানটা এগিয়ে আসছে বলে মনে হলাে। আমার বাসা ত্রিমােহনার কাছে (বর্তমান শেরাটন হােটেলের কাছে হেয়ার রােড যেখানে মিন্টু রােডের সাথে মিশেছে) তখন দেখলাম একটা জীপ আর দুটো ট্রাক। ট্রাকে অনেকেই শ্লোগান দিচ্ছে নারা-এ-কবীর আল্লাহু আকবার । এইটাই শ্লোগান ছিল। জীপটায় যে আছে সে একটা ওয়ারলেস ইউজ করেছে। তখন আমার মনে প্রশ্ন এলাে, এরা কারা? ট্রাকে যাদের দেখলাম তাদের অধিকাংশই পরনে লুঙ্গি আর খাকি হাফ শার্ট কেউবা হাফ সার্ট গায়। কারাে পরনে হাফ প্যান্টও ছিল। কারাে গায়ে স্যান্ডাে গেঞ্জি বিভিন্ন রকম পােশাক। ঠিক এক ধাচের নয়। তবে সবারই হাতে কোন না কোন অস্ত্র। ট্রাক আর জীপগুলি ইন্টারকনের দিকে (বর্তমানে হােটেল শেরাটন) গিয়ে আবার ফিরে এলাে। জীপটা ব্যাক করে পুরাতন গণভবনের দিকে চলে গেল। সামনে গিয়ে দরজা খুলে দেখি তখন শপথ গ্রহণ চলছে। দেখলাম সামনে অনেক অফিসার তাদের মধ্যে চিনি কেবল জিয়াউর রহমান আর শফিউল্লাহকে। অন্য কেউ চেনা থাকলেও তখন পর্যন্ত নজরে আসেনি বা আমার মনে পড়ছে না এখন। তখন শফিউল্লাহ সাহেব আমাকে হাত ইশারা করে কাছে ডাকলেন।
প্রশ্ন : বঙ্গভবনে কোন রুমে শপথ হল?
উত্তর : এখন যেখানে ক্যাবিনেট মিটিং হয় সেই রুমে।
এরপর আমার শপথ হয়ে গেল। যখন শপথ হলাে তখন মাগরিবের নামাজের ওয়াক্ত শুরু হয়েছে। প্রেসিডেন্টের দুই জন এডিসিই সেই মুহূর্তে উপস্থিত। তাদের একজনকে ডেকে আমি বললাম, আমি নামাজ পড়তে যাব পাশে কোথাও। প্রেসিডেন্ট সাহেব যদি আমার খোঁজ করেন তাহলে জানাবেন। আমি উঠতে যাৰ এমন সময় দেখি, এডিসি সেই মুহূর্তেই প্রেসিডেন্ট সাহেবের কানে কানে বলছে, আমার নামাজ পড়ার কথাই বলছে। কানে কানে বলার সংগে মােশতাক সাহেব আমাকে হাত ইশারা করে বসতে বললেন। তখন তিন চার জনের শপথ গ্রহণ করানাে বাকী। শপথ গ্রহণ করানাের পর আমরা নামাজ পড়লাম। নামাজ পড়ার পর প্রেসিডেন্টের মিলিটারী সেক্রেটারী আমাদের বললেন, প্রেসিডেন্ট সাহেব আমাদের সাথে কথা বলবেন। বঙ্গভবনের যে রুমে এখন প্রেসিডেন্ট সাহেবের চেয়ার সেই রুমেই মােশতাক সাহেবও বসতেন। তাঁর সীটিং এরেঞ্জমেন্ট চেঞ্জ হয়ে গেছে। সব শপথ নেয়া মন্ত্রী সাহেবরা গেলেন। অনেক সিভিল ও ইউনিফর্ম অফিসাররা আছেন। আমরা ওখানে গেলে খন্দকার মােশতাক সাহেব কাকে যেন বললেন, একটু চা খাওয়া যাক। কোন একজন অফিসার তখন সালাম করে চলে গেলেন। তারপর দুই তিন মিনিটের সাইলেন্স। একেবারে সবাই চুপচাপ, কেউ কোন কথা বললেন না। তখন খন্দকার মােশতাক সাহেব বললেন, শাফিউল্লাহ যা হবার তা হয়ে গেছে। আর যেন একটাও গুলি ছােড়া না হয়। অরি যেন একফোটা রক্ত না ঝরে, অবস্থা নরমাল করার জন্য যা প্রয়ােজন তা তোমরা। করাে। এমনি করে শুরু করে কয়েক মিনিট কথাবার্তা বললেন, এর মধ্যে চা এসে গেল। চা খেলাম। তখন উনি বললেন, আমাদের উঠতে হবে। তার আগে একটা কথা আমাদের খেয়াল নাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর বা মুজিব ভাই কিভাবে তিনি তখন সম্বােধন করেছিলেন। বললেন ওনার ডে বডি টুঙ্গী পাড়া যাবে। আপনারা কেউ একমপানী করবেন? আমাদের কেউ কোন উত্তর দিলেন না। খন্দকার সাহেব কয়েক মিনিট চুপচাপ ছিলেন আমাদের উত্তরের প্রতীক্ষায়। আমাদের কেউ প্রশ্ন করেননি ঢাকায় দাফন হবে না কেন—কেউ বলেননি আমরা কেউ সংগে যাব। অতঃপর তিনি কাকে যেন ডেকে বললেন, টুঙ্গিপাড়ায় লাশ পাঠানাের ব্যবস্থা করুন। বেরিয়ে যাবার আগে বললেন—আপনাদের যার যা পাের্টফলিও ছিল আপাততঃ সেটাই থাকবে। যে যে বাড়িতে আছেন সে সেই বাড়িতেই থাকবেন। আপনারা অফিস করতে থাকুন। পরে দেখা যাবে কি করা যায়। পরে জানতে পারলাম বঙ্গবন্ধুর বাসার কথা, সেরনিয়াবাতের কথা, শেখ মনির কথা।
প্রশ্ন : খন্দকার মােশতাক সাহেব কখনও ১৫ই আগস্ট ঘটনাবলির কোন ব্যাখ্যা দেননি।
উত্তর : না। প্রশ্ন : আপনারা কখনাে জিজ্ঞাসা করেননি?
উত্তর : খন্দকার সাহেবের বক্তব্য হলাে ঃ ১৫ই আগস্ট সকালে এসে আমাকে নিয়ে গেছে। দেশকে রক্ষার জন্য তিনি সেই সময় বিপদ এবং বদনাম আসবে জেনেও রাজী হয়েছেন। আল্লাই সবকিছুই জানেন।
তবে হেনা ভাই (মন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান) আমাকে জানান বঙ্গবন্ধু হত্যার আগে হেনা ভাইয়ের তিন নম্বর রােডের (ধানমণ্ডি) বাসায় ডালিম তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। ডালিম তাকে ডেকেছে। হেনা ভাই নামেননি। হেনা ভাই বললেন, ডালিম আমার সাথে আগেও যােগাযােগ করেছিল এবং প্রস্তাবও নিয়ে এসেছিল। তাই জানতাম, সে কি কথা বলতে এসেছিল। তাই দরজা খুলিনি। হেনা ভাই আমাকে বললেন, ডালিমরা জানিয়েছিল এ রকম একটা ঘটনা ঘটবে। বঙ্গবন্ধুকে খুন করা হবে তা বলেনি—তবে তাকে বাসা থেকে নিয়ে যাবে এবং আবার হেনা ভাইয়ের নেতৃত্বে পাওয়ার নেয়া হবে। হেনা ভাই আমাকে বললেন, আমি তাতে তখন রাজী হইনি। ১৪ই আগস্ট তারিখে তাই নিচে নামিনি। ডালিম পরে গালাগালি করে যায়। ১৩ কিংবা ১৪ই আগস্ট ১৯৭৫ তারিখেই সৈয়দ নজরুল। ইসলাম সাহেবের বাসায় যাই। উনি ভাইস প্রেসিডেন্ট পুরাতন গণভবনে থাকেন। তখন সন্ধ্যা হয়েছে। আমি দেখি উনি পাঞ্জাবী পরে পায়চারী করছেন। সালাম দিলাম। কোন উত্তর দিলেন না। খুব গম্ভীর। উনিতাে এমনি একটু কম শুনতেন। নজরুল ভাইয়ের বাসায় প্রায় ডেইলী যেতাম। তখন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ছিল রােজ বিকেলে গণভবনে গিয়ে ৪৫ মিনিট তাকে নিয়ে পায়চারী করতে হবে। সেখানেও যেতাম। শেষের দিকে তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এটা মনে হয় ১৩ তারিখ দিনগত রাত্রে।
চৌদ্দ তারিখ তাে-ওনার সংগে আমার দেখা হয়নি। উনি গম্ভীর হয়ে চুপচাপ করে পায়চারী করছেন। আমিও উনার সংগে পায়চারী করছি। কোন কথা বললেন কিছুক্ষণ পর উনি আমাকে বেশ একটু উত্তেজিত স্বরে বললেন, ভাবছেন কী? নজরুল ইসলাম সাহেবকে আমরা সবাই শ্রদ্ধা করতাম। বঙ্গবন্ধুও ওনাকে স্যার বলতেন। আপনি করে কথা বলতেন ওনার সংগে। মােশতাক, তাজউদ্দিন, কামরুজ্জামান বা মনসুর আলী সাহেবদের বঙ্গবন্ধু তুমি করে বলতেন, কিন্তু সৈয়দ সাহেবকে তিনি আপনি করে বলতেন, আমরাও স্যার বলতাম। | তিনি খুব লার্নেড লােক ছিলেন, কিন্তু শেষ দিকে খুব মন খারাপ করে অভিমান করে থাকতেন। তার কারণ আর একদিন সময় করে বলব। যখনই তিনি দেখলেন বঙ্গবন্ধু কারও প্রভাবে এমন একটা পথে গেছেন, যে পথ আমাদের কারও জন্য ভাল বা কল্যাণ বয়ে আনবে না, তখনই তিনি অভিমান করে দূরে সরে থাকতেন। সেটা আরও খারাপ হলাে আমাদের জন্য। বঙ্গবন্ধুর অন্তরের বন্ধু প্রকৃত পক্ষে সৈয়দ সাহেব ছিলেন। সৈয়দ নজরুল সাহেব কি ভাবছেন? কি করছেন? প্রশ্নের জবাবে বললাম, স্যার কি হয়েছে? তিনি বললেন, কী হতে বাকি আছে? আমাদের পায়ের তলায় মাটি নেই– নিজেদের ঘর সামলাতে পার না, আমরা আবার কথা বলি। তখন বুঝলাম, উনি তাে খুব রেগে আছেন। কারণ জানি না। চিন্তা করার জন্য বললাম, স্যার উপরে চলুন চা খাব। উপরে গেলাম। দুই জনে উপরে এক ঘরে বসলাম। এই দেখেন আমি আপনকে বলি নাই আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে। দিনের পর দিন কি হচ্ছে । কেউ কথা শােনে না আমার, কারও কথা শােনে না। এখন কি অবস্থা হবে?
আমি বললাম কি হয়েছে? কী হবে? নজরুল সাহেব বললেন, পায়ের তলায় মাটি আছে? আমি বললাম, স্যার কার। কথা বলছেন আপনি? সৈয়দ সাহেব বললেন, কার আবার? বঙ্গবন্ধুর কথা বলছেন। আমি বললাম কেন? কি হয়েছে? বললেন, যা দেখছি এতাে ভালাে মনে হচ্ছে না। আমার কাছে লােক আসছিল আমার কাছে পাওয়ার দেবার প্রস্তাব নিয়ে আসছিল। কেন? কামরুজ্জামান হেনা সাহেবও ঐ দিনই আমাকে বলেছিলেন আজও উনি। আমাদেন নেতা। ওনাকে দিয়ে চলবে না। ক্ষমতা আমাকে নিতে হবে এটা কেমন কথা। উনিতাে আমার সংগে আলাপ করতে চান না। আমি বললাম, আপনি ৩২ নম্বর যান সেখানে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বলেন। দেখেন কী করতে পারেন। সৈয়দ সাহেব বললেন, না তিনি যখন সব কথা খুলে বলতে চান না, তখন আর কী করব। তখন আমি বললাম, তাহলেতাে চলবে না। আপনার জন্য আপনি না যান, দেশের জন্য, আমাদের জন্য যান। আজকে যাবেন। তিনি বললেন, না। | তারপর ঠিক হলাে পরদিন উনি যাবেন। সে সুযােগ মনে হয় আর হয়নি। হেনা ভাই আর সৈয়দ সাহেবের কথা মনে হয় খন্দকার মােশতাক সাহেব ছাড়াও অন্য যে কাউকে দিয়ে তারা টেকওভার করে ফেলতাে।
সূত্র : ফ্যাক্টস্- এন্ড ডকুমেন্টস্–বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড – অধ্যাপক আবু সাইয়িদ