বাংলা বাণী
ঢাকাঃ ৪ঠা জুলাই, বৃহস্পতিবার, ১৯শে আষাঢ়, ১৩৮১
প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানি
জাতীয় সংসদে বাংলাদেশের গ্যাস রপ্তানির প্রসঙ্গটি উত্থাপিত হয়েছে। প্রাকৃতিক সম্পদ দপ্তরের মন্ত্রী ডক্টর মফিজ চৌধুরী জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তরে জানান যে, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য সরকার প্রাকৃতিক গ্যাস বিদেশে রপ্তানির সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন যে, গ্যাসের চেয়ে গ্যাস জাতীয় দ্রব্য যথা সার ও পেট্রোকেমিক্যাল ইত্যাদি রপ্তানি করতে পারলে অধিকতর লাভ হবে। আমরা জানি বাংলাদেশের ভূগর্ভে পর্যন্ত সাতটি (রশিদপুর, কৈলাসটিলা, তিতাস, হবিগঞ্জ, বাখরাবাদ, হরিপুর ও ছাতক) গ্যাসের আধার পাওয়া গেছে তার পরিমাণ ২০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট। বিশেষজ্ঞ সূত্রে পাওয়া সর্বশেষ তথ্য হলো এই। বিশেষজ্ঞ সূত্রে আরো বলছেন যে, গ্যাসের পরিমাণ আরো অনেক বেশি হতে পারে এবং বাংলাদেশের গ্যাস মান ও গুণের দিক দিয়ে উৎকৃষ্ট ও বটে। এ গ্যাসে শতকরা ৯৬ ভাগ থেকে ৯৯.৫ ভাগ পর্যন্ত মেথান (বিশেষ রাসায়নিক দ্রবণ) আছে।
বাংলাদেশের গ্যাস সম্পদ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের ধারণা হলো এদেশের গ্যাসের উৎস অঢেল। এবং শুধুমাত্র এই অফুরন্ত প্রায় গ্যাসই এদেশের অর্থনীতিকে ঢেলে সাজাতে পারে। একদিকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে এবং অন্যদিকে দেশের শিল্প কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধির কাজে ব্যবহার করে দেশের সার্বিক উন্নয়নে ভূমিকা পালন করতে পারে। এটা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য এই সম্পদের প্রাচুর্য নিঃসন্দেহে গভীর ভরসার কথা।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন কালে বিশেষ তথ্যে বলা হয়েছিল যে, আগামী ২০০০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের সর্ব প্রকার চাহিদা মেটাতে ১৩.৫ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট গ্যাস লাগবে। ৬.৫ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট গ্যাস থাকছে উদ্বৃত্ত। সে ক্ষেত্রে গ্যাস রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সক্রিয় বিবেচনাকে আমরা অভিনন্দন জানাই।
বর্তমান বিশ্বে জ্বালানি সংকট চলছে। তেলের দাম বেড়েছে। তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর জাতীয় সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে গিয়ে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। তেলের বিকল্প জ্বালানি হিসেবে গ্যাসও আদরণীয়। তাই আমাদেরকে এই সুযোগে সর্বোচ্চ পরিমাণ সদ্ব্যবহার করতে হবে। এবং এ বিপুল গ্যাস সম্পদ সম্পর্কে সুচিন্তিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
যদি কিছু সংখ্যক কলকারখানায় উৎপাদনের কাজে গ্যাস ব্যবহার করা হয়, তথাপি প্রধানত জ্বালানি হিসেবে আমরা সর্বাধিক গ্যাস ব্যবহার করছি। সে ক্ষেত্রে গ্যাস লাইন বসানোর সাপেক্ষ কাজও দেশে হয়েছে। ১৯৬৭ সালে প্রথম গ্যাস লাইন বসানোর কাজ শুরু হয়। তখন গ্যাস লাইন বসাতে যে খরচ হতো এবং যে দাম পাওয়া যেত তার মধ্যে একটা সমতা ছিল। কিন্তু গ্যাস লাইন বসানোর খরচ বেড়েছে বহুগুণ। সেই অনুপাতে খরচটা উঠে আসছে না। এটা নিঃসন্দেহে জাতীয় ক্ষতি। কারণ প্রতিটি বিনিয়োগের উদ্দেশ্যই হলো লভাংশ টেনে আনা। এই অবস্থা ও পরিকল্পনাবিহীন গ্যাস সম্পদ উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধক স্বরূপ বলে আমরা মনে করি। গ্যাস বিক্রি করে ডলার-পাউন্ড আনার চিন্তার সাথে আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও চিন্তার বিন্যাস রাখা হোক, এইটেই আমরা দেখতে চাই।
গ্যাস সম্পদের সর্বোচ্চ পরিমাণ সদ্ব্যবহারের প্রশ্নে গ্যাসজাত দ্রব্যের কথাও আসে। সেখানে বিকল্প হল দুটি। গ্যাস না গ্যাসজাত দ্রব্য তথা সার ও পেট্রোকেমিক্যাল রপ্তানি করা হবে? বলাবাহুল্য, গ্যাসজাত দ্রব্য রপ্তানি করলে অধিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভাবনা। সেকথাও মাননীয় মন্ত্রী উল্লেখ করেছেন। অতএব রপ্তানির ব্যাপারে সেদিকটাও ভালো করে ভেবে দেখতে হবে।
পরিশেষে আমাদের বক্তব্য হল–গ্যাস রপ্তানি করার সক্রিয় বিবেচনায় যেন তাড়াতাড়ি বাস্তবায়িত হয়। সেজন্য অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক খাতে গ্যাস ব্যবহার ও রপ্তানি করার ব্যাপারে অত্যন্ত সুশৃংখল একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। প্রয়োজনবোধে বিদেশি বিশেষজ্ঞের সাহায্যে যৌথভাবেও কাজ করা যেতে পারে। কারণ, আমাদের লক্ষ্য অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন । সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য যাকিছু করনীয়–আশু তাগাদার ভিত্তিতে তা করতে হবে। সম্পদ বুকে নিয়ে বসে থেকে লাভ নেই। আমরা গ্যাস সম্পদকে যক্ষের মতো পাহারা দিতে চাই না। তাই বিনিয়োগের ক্ষেত্র যত দ্রুত সম্ভব প্রসারিত করা যায় ততই মঙ্গল।
বিশ্ব নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন
গত ২রা জুলাইয়ে প্রকাশিত সংবাদে জানা গেছে যে, মস্কোতে অনুষ্ঠিত নিক্সন-ব্রেজনেভ শীর্ষ বৈঠকে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের ওপর আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। তবে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জার ও রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদ্রে গ্ৰোমিকোর মধ্যে অনুষ্ঠিত পারমাণবিক অস্ত্র সীমিতকরণ আলোচনায় অগ্রগতি সাধিত হয়েছে বলে সংবাদে প্রকাশ।
হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র রোনাল্ড জিগলার উল্লেখ করেছেন যে, আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী এবং ক্ষেপণাস্ত্র সীমিতকরণ ও ভূগর্ভে পারমাণবিক পরীক্ষা আংশিক নিষিদ্ধকরণের আলোচনায় অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।
নিক্সন-ব্রেজনেভ শীর্ষক বৈঠকের শেষ ফলাফল কি দাঁড়াবে তা আপাতত বলা না গেলেও এটা অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, দুই বৃহৎ শক্তিই অস্ত্র প্রতিযোগিতার অবসান হোক। প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি প্রধান লিওনিদ ব্রেজনেভ আশা প্রকাশ করেছেন আগামী বছরের মধ্যে তারা পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেন।
স্পষ্টতঃই বোঝা যাচ্ছে যে, দুই বৃহৎ শক্তিই অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধের জন্য আগ্রহী। তবে কতটা আগ্রহী তা নির্ভর করে উভয় দেশের ভবিষ্যৎ কর্মসূচির উপর। এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, যুদ্ধের উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে ধ্বনি ও দরিদ্র দেশগুলোর জাতীয় সম্পদের সিংহভাগ চলে যাচ্ছে সামরিক খাতে। এতে একদিকে উন্নয়ন যেমন ব্যাহত হচ্ছে অপরদিকে একটা উত্তেজনা উদ্বেগ থাকছে সবসময়। তাই আজকের দিনে সর্বাগ্রে প্রয়োজন অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ এবং নিরস্ত্রীকরণ সম্পর্কে বৃহৎ শক্তিবর্গের কাছ থেকে সুস্পষ্ট সুদৃঢ় ও কার্যকরী আশ্বাস।
সম্প্রতি জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মিঃ উইনৎসার জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের কাছে লেখাপত্রে একটি বিশ্ব নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনের প্রস্তুতি ও অনুষ্ঠানের জন্য তারা সরকারের সক্রিয় সহযোগিতার কথা পুনরায় উল্লেখ করেছেন।
ইউরোপের যুদ্ধরত সময়ের পরে যেসব চুক্তি হয়েছিল সেগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে মিঃ উইনৎসার বলেছেন শুধু ইউরোপে নয়, সমগ্র বিশ্বে উত্তেজনা প্রশমনে আগ্রহ লক্ষিত হয়েছে তা কাজে লাগাতে সবরকম চেষ্টা করতে হবে। তিনি আরো বলেন যে, এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সর্বোপরি রাজনৈতিক উপায়ে এবং জাতিসংঘ সনদের ভিত্তিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সংকটময় পরিস্থিতির মীমাংসা করা প্রয়োজন। এদিকে অগ্রগতি একটি বিশ্ব নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন আহ্বানের ও সাফল্যজনকভাবে অনুষ্ঠানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে।
সমরাস্ত্র সীমিতকরণ ও অস্ত্র প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এবং বিশেষ করে পারমাণবিক যুদ্ধ বন্ধ সমরাস্ত্র সীমিত করতে মার্কিন শক্তিসমূহের যে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র সে সম্পর্কে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন বলে মিঃ উইনৎসার পত্রে উল্লেখ করেছেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ইতিপূর্বে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের শতকরা দশভাগ সামরিক ব্যয় হ্রাস করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এ প্রস্তাব বেশিরভাগ সদস্য অনুমোদন করেন।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে এ পর্যন্ত সামরিক অস্ত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে যে অভাবনীয় ও পরিকল্পনায় অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তাতে এ কথা বলা যায় যে, আরেকটা যুদ্ধ যদি কোনক্রমে অনুষ্ঠিত হয় তাহলে বিশ্বের মানব সমাজ ও সভ্যতা সংস্কৃতিই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। যে কোন দেশ যে কোন দেশকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র মাধ্যমে। যেভাবে অস্ত্র নির্মাণ প্রতিযোগিতা চলছে তার শেষ কোথায় তাও কেউ বলতে পারেন না। কেন এবং কি জন্য ভয়াবহ অস্ত্র প্রতিযোগিতার সূত্রপাত হয়েছে তা আজ আর কারো অজানা নয়। বড় রাজ্য গ্ৰাসের সাম্রাজ্যবাদী লিপ্সা, প্রভুত্বের নেশা, শাসন-শোষণের মানসিকতাই অস্ত্র প্রতিযোগিতায় গোড়ার কথা। শুধু তাই নয়, অস্ত্র নির্মাণ করে এবং তা বিবদমান দুটি দেশের মধ্যে বিক্রি করে মুনাফা অর্জনের মানসিকতা অন্যতম কারণ। অথচ এ কথা তো অস্বীকার করার উপায় নেই, অস্ত্র নামক যে ক্রেঙ্কোষ্টাইনের সৃষ্টি করা হয়েছে তা একদিন সকলকে গ্রাস করে ফেলতে পারে। তাছাড়া অস্ত্র প্রতিযোগিতার নেশায় মেতে ওঠার জন্য আজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কঠিন সমস্যা, সংকট ও দারিদ্রের সম্মুখীন। তাই বিশ্ব মানবতার কল্যাণে সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য আজকের দিনের প্রয়োজন অস্ত্র প্রতিযোগিতায় অবসান ঘটানো। জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ উইনৎসারের ভাষাতেই আমরা বলবো যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উত্তেজনা প্রশমন এর ক্ষেত্রে অগ্রগতি দেখা গেছে তাতে অবিলম্বে একটি বিশ্ব নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনের প্রয়োজন অনুভূত হয়েছে। কারণ এছাড়া চূড়ান্তভাবে ক্রমবর্ধমান অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করা সম্ভব নয়।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক