অভ্যুত্থানে জড়িত ছিল সি.আই.এ
—লরেন্স লিফশুলজ
(১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার ঘটনা কি শুধু একদল উচ্ছল সেনাসদস্যের ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ও সামরিক উন্মত্ততার উদাহরণ? নাকি এর পেছনে আরাে গভীর ষড়যন্ত্র ছিল। প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ প্রায় তিন দশক ধরে এ বিষয়ে দীর্ঘ অনুসন্ধান করেছেন। অনুসন্ধনে অভ্যুথানকারী সেনাবাহিনীর ক্ষুদ্র অংশের সঙ্গে খােন্দকার মােশতাক ও ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের একাংশের ঘনিষ্ঠ যােগাযােগের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেছে। এই যােগাযােগের বিষয়টি লিফশুলজকে জানিয়েছিলেন অত্যন্ত বিশ্বাসযােগ্য সূত্রে। গত ৩০ বছর ধরে সূত্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রক্ষা করে গেলেও কখনাে তার নাম বলেননি তিনি। ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারির ‘ডিপ ব্রোটের মতাে কৌতুহল ছিল এই সূত্রের নাম নিয়ে। এবার সেটি প্রকাশ করলেন। লিফশুলজ। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ইউক্রেন বােস্টার ছিলেন তার সূত্র । ষড়যন্ত্র ও ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডকে কখনােই মেনে নিতে পারেননি বােস্টার। গত ৭ জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তেমন গুরুত্ব না থাকলেও তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের রােষানল থেকে রক্ষা পায়নি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। কিসিঞ্জার কখনাে ভুলতে পারেননি। তার পরামর্শ বা নির্দেশ উপেক্ষা করে দেশটির জন্ম হয়েছে। আর তারই পরিণতি ১৫ আগস্ট। বিভীষিকাময় সে ঘটনাবলির নেপথ্য কাহিনী অনুসন্ধানে লরেন্স লিফশুলজ মার্কিন সূত্রগুলাে এবং মােশতাক ও অন্যদের সঙ্গে কথা বলেছেন। গত ৩০ বছর এ বিষয়ে অনুসন্ধানের ভিত্তিতে তিনি নতুন করে লিখেছেন সেই কাহিনী । তিন কিস্তির এই প্রতিবেদনটি দৈনিক প্রথম আলাে থেকে সংগৃহীত। তারিখ ১৫ আগস্ট ২০০৫ সন।
১. বাংলাদেশের ১৫ই আগস্টের সামরিক অভ্যুত্থানের ৩০তম বার্ষিকী মার্কিন লেখক উইলিয়াম ফকনারের কথা আবার মনে করিয়ে দিল, “অতীতের মৃত্যু নেই। এমনকি অতীত কখনাে অতীত হয় না। আমাদের মতাে যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৭০-এর দশকের প্রত্যক্ষদর্শি, আমরা স্মরণ করতে পারি ঐ দিনগুলাে, যা একটি যুগের মাইলফলক। এ সব ঘটনা যে পথ নির্দেশ করেছিল সে । পথ ধরে আমরা গন্তব্যে চলেছি, অনেকেই সে গন্তব্যে পৌছাতে পারেনি।”
২. ৩০ বছর পরও ১৫ই আগস্টের সহিংস সেই রাতের ঘটনাবলি আজও বাংলাদেশে জীবন্ত। ১৯৭১ সালের মার্চের কালরাত্রির মাত্র চার বছর পরের ঘটনা। ‘৭১-এর মার্চেই পাকিস্তানি সৈন্যরা জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেয়ার পরিবর্তে দেশের মানুষের উপর ট্যাঙ্ক চালিয়ে দিয়েছিল। অথচ এ ফলাফল মেনে নিতে বাঙালিরা সম্মত হয়েছিল। আর স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মাথায় বাংলাদেশ সেন বাহিনীর ছােট্ট একটি অংশ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নােংরা ধারা অনুসরণ করে অভ্যুত্থান ঘটায়।
৩, একটি সামরিক অভ্যুত্থানের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বাংলাদেশের অনেক মানুষের কাছে স্বাধীনতার প্রতীক শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন। অভুত্থানকারীরা খুনের নেশায় উন্মত্ত হয়ে গিয়েছিল। মুজিব এবং তার পুরাে পরিবারকে হত্যা করা হয়, হত্যা করা হয় তার স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, তাদের স্ত্রী সুলতানা কামাল ও রােজী জামালকে। এমন কি হত্যা করা হয় শিশুপুত্র শেখ রাসেলকে, যার বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। ঐ রাতে সেনাবাহিনীর। দলটি ছােট ছােট দলে বিভক্ত হয়ে সারা শহরে দাপিয়ে বেড়ায় মুজিবের আত্মীয়স্বজনদের হত্যার উদ্দেশ্যে। নিহত হন মুজিবের ভাই শেখ আবু নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার জীবন বাঁচাতে ছুটে আসা কর্নেল জামিল।
৪. এক গর্ভবতী নারী আরজু তার স্বামী শেখ ফজলুল হক মনিকে বাঁচানাের। চেষ্টা করেছিলেন, এ অপরাধে তাকেও হত্যা করা হয়। মনি ছিলেন শেখ মুজিবের ভাগ্নে। মুজিবের দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ঐ সময় দেশের বাইরে ছিলেন। শেখ হাসিনা পরে দেশের প্রধানমন্ত্রী হন। তাকেও মাত্র এক বছর আগেও প্রকাশ্যে দিবালােকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। এ হামলা আবার প্রমাণ করে ফকনারের সেই বাক্য, “অতীত আসলে অতীত নয়। এটা খুবই বর্তমান।”
৫. ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্টের ঘটনায় জড়িতদের উত্তরসূরিরাই বর্তমান বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া প্রয়াত জেনারেল জিয়াউর রহমানের স্ত্রী, যিনি ঐ সময় সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান ছিলেন এবং পর্দার অন্তরালে থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, যা পরবর্তীতে অভ্যুত্থান ও অন্যান্য। ঘটনা ঘটায়।
৬. ঢাকায় মার্কিন দুতবাসে ঐ রাতে রাজনৈতিক ও গােয়েন্দা কর্মকর্তারা অভ্যুত্থান বিষয়ে ঘটতে থাকা ঘটনাগুলাের উপর নজর রাখতে শুরু করেন। কিন্তু মার্কিন দূতাবাসে তখন একজন ব্যক্তি ছিলেন, যিনি ঘটনাগুলাে জানতেন এবং তিনি। অস্থির ছিলেন। কিছু বিষয় তিনি কাউকে বলতে পারতেন না। অ্যুত্থানের কয়েক মাস আগেই এমনটা ঘটবে বলে তিনি আশঙ্কা করেছিলেন এবং তা ঠেকাতে সর্বোচ্চ প্রয়াস চালিয়েছিলেন। | ৭. অভ্যুত্থানের তিন বছর পর ওয়াশিংটনে আমি এই লােকের সঙ্গে দেখা করি। তিনি আমার খবরের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হয়ে উঠেন। আমি এ আশায় থাকি। যে, তিনি আমাকে এ ব্যাপারে যে সব তথ্য দেবেন তা একদিন অস্বস্তিকর সত্য হয়ে বেরিয়ে আসবে এবং যারা এর সঙ্গে জড়িত ধাদের জবাবদিহি করতে হবে। ত্রিশ বছরের মধ্যে এই প্রথমবারের মতাে আমি তার পরিচয় জানতে পারি। এতগুলাে বছর তার সঙ্গে আঠার মতাে লেগে থাকার পরও তার পরিচয় প্রকাশ না করার ব্যাপারে অত্যন্ত আস্থার সঙ্গে সংযম পালন করেছি, যা থেকে আমি এখন মুক্ত। ধৈর্য ধরুন, কেন এবং কীভাবে আমি এ ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলাম, তা বলব। ৮. যে সব বিদেশী সাংবাদিক এ অভ্যুত্থানের ঘটনা কভার করেছিলেন, আমি ছিলাম তাদের একজন। তবে এদের মধ্যে একমাত্র আমি, যে সাংবাদিক হিসেবে বাংলাদেশে বাস করে একটি বড় পত্রিকার জন্য এ বিষয়ে প্রতিবেদন পাঠাই। ১৯৭৪ সালে আমি ছিলাম ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউর ঢাকা সংবাদদাতা। পরের বছর আমি নয়াদিল্লি চলে যাই, আমাকে ঐ পত্রিকার দক্ষিণ এশীয় প্রতিনিধি হিসেবে নিয়ােগ দেয়া হয়। মুজিবের নৃশংস হত্যা আমাকে বিষয়টি অনুসন্ধানে আকর্ষিত করে। এ ঘটনা জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে আমাকে প্রভাবিত করে। আর এমন ঘটনা ঘটবে তা আমি কখনাে ধারণা করতে পারিনি।
৯, আমার অচিরাচরিত সূত্রটি মার্কিন দূতাবাসে কাজ করতেন। ঐ রাতে তিনিই তার সততা ও দায়বদ্ধতার গুণে বিষয়টির গভীরে যেতে আমাকে উৎসাহিত করেন। ঐ সময়কার সরকার আমলাতন্ত্রের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যদের থেকে আলাদা। অভ্যুত্থানে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড নিয়ে তিনি অত্যন্ত হতাশ ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন সচেতন ব্যক্তি এবং এমন কিছু জানতেন যা অন্যরা জানতেন না। এ জানাটাই তার বিবেক দংশনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমারটাও ছিল ঐ ধরনের নৈতিক দায়িত্ববােধের ব্যাপার, যা তার সঙ্গে একাধিকবার মুখােমুখি করেছিল। একজন তরুণ রিপাের্টারের জন্য যা ছিল খুবই স্মরণীয় ঘটনা। | ১০. মুজিবের বিরুদ্ধে অ্যুত্থানের পর এ বিষয়ে ক্ষমতাসীনদের সরকারিভাবে প্রচারিত কাহিনী এবং ঐ সময় সরকারের তল্পিবাহক সংবাদপত্রগুলাের প্রতিবেদন আমাকে বিপাকে ফেলে দেয়। এই দুই পক্ষের বক্তব্য এক ছিল না। অধিকন্তু দুই কাহিনীর মধ্যকার ফাক দিয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে গুরুত্বপূর্ণ যােগসূত্র ও পূর্ববর্তী ঘটনাবলি।
১১. এ ঘটনা সম্পর্কে বলা হয়, ছয় জন জুনিয়র অফিসারের নেতৃত্বে তিন শ সেনা একবারে নিজেদের সিদ্ধান্তে শেখ মুজিবকে ক্ষমতাচ্যুত করে। মুজিব ও তার সহযােগীদের বিরুদ্ধে কিছু অফিসারের ব্যক্তিগত ঈর্ষা এবং ঐ সময়ে ব্যাপক দুর্নীতির কারণে সাধারণ মানুষের হতাশার বহিঃপ্রকাশ ছিল ঐ অভ্যুত্থান, ছিল একতরফা চিন্তার ফসল, এক বছর বা তার চেয়ে বেশি সময়ের কোনাে পরিকল্পনা এটা ছিল না।
১২. যেদিন ভােরে মুজিব এবং তার পরিবারকে হত্যা করা হয়, ঐ সকালেই তরুণ অফিসাররা পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হিসেবে খােন্দকার মােশতাক আহমদের নাম ঘােষণা করে। আওয়ামী লীগে মােশতাককে ডানপন্থি মুক্তির প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মুজিবের পতনে তার ব্যক্তিগত ভূমিকা সম্পর্কে মােশতাক মুখে কুলুপ এটে ছিলেন। অভ্যুত্থানে তিনি তার সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার বা অস্বীকার কোনােটাই করেননি। জনসমক্ষে আলােচনায় এ বিষয়ে কোনাে প্রশ্ন এলে তিনি সহজভাবে তা এড়িয়ে গেছেন। আসলে তিনি তার সরকারকে স্থিতিশীল করতে সর্বতােভাবে চেষ্টা চালিয়েছিলেন।
১৩, অ্যুত্থানের তিন মাসের মধ্যে মােশতাককেও ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর দুর্নীতির অভিযােগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পর পুরান ঢাকার বাসভবনে এক সাক্ষাৎকারে মােশতাক এ অভ্যুত্থানের ব্যাপারে তার আগাম ধারণা অথবা অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে কোনাে বৈঠকের কথা অস্বীকার করেন। আর অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত জুনিয়র অফিসারদের এ ঘটনার চার মাসের মধ্যেই দেশের বাইরে যেতে বাধ্য করা হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে অস্থিরতার সুযােগে তাদের বাইরে পাঠানাে হয়। এরপর বেরিয়ে আসে ভিন্ন কাহিনী। | ১৪, অভ্যুত্থানের ব্যাপারে তাদের পৃষ্ঠপােষক ও মিত্রদের কাজে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে এই জুনিয়র অফিসারদের অধিকাংশ ব্যাংকক এবং অন্যত্র সাংবাদিকদের কাছে সাক্ষাৎকার দিয়ে মুখ খুলতে শুরু করে। অভ্যুত্থানের আগে মােশতাক ও তার সহযােগীদের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি তারা নিশ্চিত করে। তখন এ কাহিনী বেরিয়ে আসে যে, মুজিবকে হত্যা ও ক্ষমতাচ্যুত করার এক বছর আগে থেকেই মােশতাক ও তার রাজনৈতিক মিত্ররা বেশ কয়েক দফা গােপন বৈঠক পরিকল্পনা করেছিল।
১৫. অভ্যুত্থানের কয়েক মাস পর মার্কিন দূতাবাসের একজন মধ্যম সারির কর্মকর্তা আমাকে বলেন, আগস্টের ঘটনা নিয়ে মার্কিন দূতাবাসের মধ্যেই চাপা উত্তেজনা ছিল। তিনি বলেন, ঐ সময় দূতাবাসে এ রকম খবর ছড়িয়ে পড়ে যে সি.আই.এর স্টেশন চিফ ফিলিপ চেরি কোনাে না কোনভাবে অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত। এ নিয়ে চেরি ও মার্কিন রাষ্ট্রদূত ইউজেন বােস্টারের মধ্যে উত্তেজনা চলছে। তিনি বলেন, ‘আমি বুঝতে পারছিলাম এমন একটা কিছু ঘটছে যা ঘটা উচিত নয়।’ তিনি আমাকে বিষয়ের আরাে গভীরে যেতে আহ্বান জানান। ১৬. যুক্তরাষ্ট্র কেন এ অভ্যুত্থানে জড়াবে তা আমার মাথায় আসছিল না। যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেসের দুটো কমিটি সিআইএর গােপন বেআইনি কর্মকাণ্ড তদন্ত করার জন্য তৈরি। হচ্ছিল। তখন ওয়াশিংটনে চলছিল সি.আই.এর হাতে বিদেশী নেতাদের খুন হওয়ার ঘটনার তথাকথিত চার্চ ও পাইক কমিটির শুনানি। এ শুনানি যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিক ও গােয়েন্দাদের মধ্যে বড় মাপের আতঙ্ক ও উদ্বেগ তৈরি করে। মার্কিন পত্রপত্রিকাগুলাে খােলাখুলি লিখতে শুরু করে চিলিসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে অবৈধ গােপন তৎপরতা চালানাের দায়ে উর্ধ্বতন মার্কিন গােয়েন্দা কর্মকর্তাদের কারাদণ্ডও হতে পারে। | ১৭, গ্রীষ্মকালে মার্কিন নাগরিকরা মনগােজ, কয়েনটেলপ্রাে, এএমল্যাশ, জাতীয় শব্দ সংক্ষেপের সঙ্গে প্রথমবারের মতাে পরিচিত হতে শুরু করে এবং কঙ্গোয় লুমুম্বা, কিউবায় কাস্ত্রো এবং চিলিতে আলেন্দেকে হত্যার ষড়যন্ত্রের বিশদ বিবরণ তারা পেয়ে যায়। আসলে মার্কিন ক্ষমতার অদৃশ্য হাত বিশ্বের সর্বত্র পেীছে গিয়েছিল। হিমশৈলের চূড়াটি প্রথমবারের মতাে মার্কিনিদের চোখে স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। আর এ সব কিছু ঘটছিল ওয়াশিংটন থেকে বহুদূরে ভাপসা ও গুমােটপূর্ণ এক পরিবেশে, যেমনটা দক্ষিণ এশিয়ায় বর্ষাকালে দেখা যায়।
১৮, শেখ মুজিবের মর্মান্তিক মৃত্যু সম্পর্কে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। ইন্দিরা গান্ধী বলেন, এর নেপথ্যে অবশ্যই বিদেশী শক্তির হাত রয়েছে। স্বাভাবিকভাবে তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলেননি। ভারতে জরুরি অবস্থার দিনগুলােতে তার সমর্থক মস্কোপন্থি সিপিআইর বক্তব্য ছিল আরাে স্পষ্ট। দলটি বলে এ অভ্যুত্থানের পেছনে রয়েছে সি.আই.এ। তবে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ না থাকায় আমি একে অপপ্রচার বলে নাকচ করে দিই।
১৯, তাহলে কীভাবে অভ্যুত্থানটি হলাে? অ্যুত্থানের কুশলিবরা নিজেদের আড়াল করতে কীভাবে নানা গােলকধাধা তৈরি করে তাতে বিচরণ করে এবং শেষ পর্যন্ত ১৫ আগস্টের ঘটনা ঘটতে সক্ষম হয় সে বিষয়ে আমার তখনাে অনেক কিছুই। অজানা ছিল। অভ্যুত্থানের পর প্রায় তিন বছর আমি ইংল্যান্ডে ছিলাম। আমি ওয়াশিংটনে গিয়ে আমার এক সহকর্মী নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত দ্য ন্যাশন সাময়িকীর সম্পাদক কাই বার্ডের সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিই। কাই একজন খ্যাতিমান মার্কিন লেখক।
২০, কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস শীর্ষক একটি গবেষণার সূত্র ধরে কাই বার্ড কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাতে পেয়ে যান। কার্নেগি মার্কিন নীতি ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণার উদ্দেশ্যে একটি প্রকল্প হাতে নেন। প্রকল্পের প্রধান ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জারের সাবেক সহকর্মী রজার মরিস। কিন্তু অস্পষ্ট এক পরিবেশে প্রকল্পটি পরিত্যক্ত হয়। মরিস পরে বলেন, প্রকল্পটিকে বাদ দেয়ার জন্য কিসিঞ্জার নিজে চাপ দিয়েছিলেন। তারপরও কিছু ফাইল ছিল যেগুলাে সত্যিকারের জহুরির কাছে সােনার খনির মতােই মূল্যবান। এসব ফাইলে মূলত পেন্টাগন, সি.আই.এ এবং পররাষ্ট্র দপ্তরের দেড় শ মার্কিন কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎকার ছিল। | ২১. ওয়াশিংটন সফরের সময় আমি ইউজেন বােস্টারের সঙ্গে যােগাযােগ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ‘৭৫ এর অভ্যুত্থানের সময় ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনকারী বােস্টার তখন ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরে কর্মরত। ঢাকায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বােস্টারের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। একবার নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যানিয়েল ময়নিহান সংক্ষিপ্ত সফরে বাংলাদেশে গিয়ে আমাকে দেখা করতে বললে আমি বােস্টারের বাড়িতে যাই। ওয়াশিংটন পােস্টে প্রকাশিত আমার একটি লেখা নিয়ে আলােচনা করতে ময়নিহান আমাকে ডেকেছিলেন। লেখাটিতে তার সম্পর্কে কিছুটা সমালােচনা ছিল। করমর্দনের পর লাউঞ্জের এক কোনার টেবিলে আমরা বসলাম। রাষ্ট্রদূত বােস্টার তার বাসভবনে আপ্যায়নের ফঁাকে তিন জনের মধ্যে এটি ছােটখাটো বৈঠকের আয়ােজন করেন। অবশ্য ‘৭৫ এর অভ্যুত্থানের পর আমি বােস্টারের সঙ্গে আর সাক্ষাৎ করিনি। তাকে দেখার জন্য আমি প্রস্তুতও ছিলাম না। আমি চেয়েছিলাম তাকে যে সব প্রশ্ন আমি করব সেগুলাে আমার স্পষ্ট হওয়ার পরই যেন আমাদের দেখা হয়।
২২. ওয়াশিংটনে পেীছে আমি বােস্টারের সঙ্গে যােগাযােগ করে দেখলাম তিনিও সাক্ষাতের ব্যাপারে খুব আগ্রহী। বাংলাদেশ বিষয়ক আমার সব লেখা তিনি বছরের পর বছর ধরে পড়ে গেছেন। বৈঠকের দিনক্ষণ ঠিক হলাে। কাই বার্ড ও আমি পররাষ্ট্র দপ্তরে বােস্টারের সঙ্গে দেখা করলাম। করমর্দনের পরপরই লাউঞ্জের কোনার একটি টেবিল দখল করলাম আমরা। এ টেবিল ঘিরেই সারা সকাল আমাদের মধ্যে গুরুগম্ভীর আলােচনা হলাে। আমি বােস্টারকে বললাম, আমি জানার চেষ্টা করছি কীভাবে সেদিন অভ্যুত্থানটির পরিকল্পনা করা হয়েছিল। আমি তাকে এও বললাম, আমার কাছে এ বিষয়ে তথ্য রয়েছে যে, ১৯৭১ সালেই মােশতাকের সঙ্গে কলকাতায় মার্কিন কর্মকর্তাদের যােগাযােগ ও সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং এর জের ধরে তাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সহযােগিতায় তাকে গৃহবন্দি করে। | ২৩. কলকাতায় মােশতাক ছিলেন যােগাযােগের মধ্যমণি। কিসিঞ্জার আওয়ামী লীগ সরকারের একটি নির্বাসিত অংশের মধ্যে বিভাজন তৈরির চেষ্টা করেছিলেন, যাতে তাদের দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটি সমঝােতায় পৌছানাে যায়। তবে শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগকে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে দেশ শাসন করতে দেয়া হবে। এ ধরনের কোনাে প্রতিশ্রুতি পাকিস্তানিরা দেয়নি। পূর্ব পাকিস্তানে, যা তখন বিশ্বে বাংলাদেশ নামে পরিচিতি পেয়ে গেছে, যখন যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে শেখ মুজিব তখন পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দি।
২৪. মােশতাক প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারে তার উর্ধ্বতন সহকর্মীদের অগােচরেই মার্কিনিদের মাধ্যমে এ মধ্যস্থতার প্রক্রিয়া চালান। বিষয়টি জানাজানি হলে মােশতাকের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোেগ ওঠে এবং তাকে গৃহবন্দি করা হয়। আমি এ সব খবর জানতে পারি কলকাতায় মােশতাকের একজন প্রধান সহকর্মীর মাধ্যমে। এ সহকর্মীটি মােশতাকের ঐ মধ্যস্থতা পরিকল্পনার বিরােধিতা করেছিলেন। এ বিষয়টি কলকাতার তৎকালীন কনসাল জেনারেল হার্ব গর্ডনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে নিশ্চিত হয়েছিলাম। ২৫. পররাষ্ট্র দপ্তরে সে দিনের বৈঠকে আমি বােস্টারকে বলেছিলাম, এ বিষয়টি। খুবই কৌতুহলােদ্দীপক যে, চার বছর পর শেখ মুজিব খুন হলে মােশতাক একজন। “কিং’ হিসেবে আবির্ভূত হলেন। এ কথা বলে কাই বার্ড ও আমি বুঝতে চাইলাম যুক্তরাষ্ট্র ও মােশতাক গ্রুপের মধ্যকার ১৯৭১ সালের সম্পর্কটির নবায়ন হয়েছিল, নাকি ঘটনাটি ছিল নিছকই কাকতালীয়। এক পর্যায়ে আমরা আসল প্রশ্নটি করলাম, যে মহলটি শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা ও তা সংঘটিত করে তার সঙ্গে মার্কিন দূতাবাসের কি আগে থেকে কোনাে ধরনের যােগাযােগ ছিল? আমরা ভেবেছিলাম বােস্টার যথারীতি কূটনৈতিকসুলভ জবাব দেবেন, যা আমাদের কোনাে কাজেই লাগবে না।
২৬. বােষ্টার আমাদের চোখে চোখ রাখলেন এবং এমন কিছু তথ্য দিলেন, যা শুনব বলে আমরা আশাও করিনি। আমার মনে হলাে বােস্টার একটি বােমা ফাটালেন। পরে বিষয়টি আমরা এভাবে লিখলাম : “নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মার্কিন দূতাবাসের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, ১৯৭৪ সালের শেষ দিকে কিছু লােক শেখ মুজিবুর কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে। দূতাবাস সূত্রমতে, ১৯৭৪-এর। নভেম্বর থেকে ১৯৭৫-এর জানুয়ারির মধ্যে দূতাবাস কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের কয়েক দফা বৈঠক হয়। উধ্বর্তন ওই দুতাবাস কর্মকর্তা আরাে জানান, ‘৭৫-এর জানুয়ারিতে দূতাবাসের মধ্যে আমরা একটি সমঝােতায় আসি যে, আমরা এ বিষয়টি থেকে এবং এ সব লােক থেকে দূরে থাকব। তবে জানুয়ারি থেকে আগস্টের (৭৫) মধ্যে এ লােকগুলাের কেউ দূতাবাসে এসেছিল কি না তা আমি বলতে পারছি না। ঐ সময়ের আগে তারা আমাদের সঙ্গে যােগাযােগের চেষ্টা করেছিল।”
২৭, আমাদের প্রতিবেদনের এ বিশেষ বিবৃতির উৎস ছিলেন ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনকারী এই ইউজেন ডেভিস বােস্টার। বােস্টার সেদিন আমাদের আরাে অনেক কথাই বলেছিলেন। তিনি নিশ্চিত করেন যে, ১৯৭৪ এর নভেম্বর থেকে ১৯৭৫-এর জানুয়ারি মাসের মধ্যে দূতাবাস কর্মকর্তাদের সঙ্গে যে লােকগুলাে বৈঠক করে তারা আসলে মােশতাক গ্রুপেরই লােক। বােস্টার আরাে বলেন, ‘৭৫ এর জানুয়ারিতে তিনি দূতাবাসের সবার প্রতি কঠোর নির্দেশ জারি করেন কেউ যেন আর ভবিষ্যতে এই গ্রুপ কিংবা অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রকারী আর কোনাে গ্রুপের সঙ্গে যােগাযােগ না রাখে। এ নির্দেশ সি.আই.এ স্টেশন চিফ ফিলিপ চেরি এবং তার সব স্টাফের জন্যও প্রযােজ্য ছিল।
২৮. বােষ্টারের ধারণা, সম্ভবত রাষ্ট্রদূত হিসেবে তার কর্তৃত্বকে পাশ কাটিয়ে ঘটনাটি ঘটানাে হয়েছে। ঠিক যে লােকগুলাের সঙ্গে সব ধরনেরর যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তারাই অভ্যুত্থানের দিক দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয় এবং ক্ষমতা গ্রহণের ঘােষণা দেয়। এ যােগসূত্র থেকে বােস্টার মনে করেন, এটি একটি সরল কাকতালীয় ঘটনা নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু। আমরা বােস্টারকে প্রশ্ন করেছিলাম, তার অগােচরে ফিলিপ চেরি কিংবা সি.আই.এ স্টাফরা শেখ মুজিবকে অপসারণের ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে যােগাযােগ অব্যাহত রেখেছিল কি না। বােস্টার বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাইরে গিয়ে তাত্ত্বিকভাবে আমি প্রশ্নটির জবাব দিতে চাই। আমি বলব, না স্টেশন চিফ এ ধরনের কোনাে কাজ করেননি, তবে একজন আমেরিকান হিসেবে আরেকজন আমেরিকানকে বলব, যােগাযােগটা ছিল। আসলে অনেক ফাঁক-ফোকর ছিল। স্টেশন চিফের দায়িত্ব হচ্ছে তার সব কর্মকাণ্ড বা যােগাযােগের ব্যাপারে আমাদের অবহিত রাখা। রাষ্টদতের অনুমােদনবহির্ভূত কোনাে যােগাযােগ চেরি বাইরের কারাে সঙ্গে রখেননিএ গ্যারান্টি আমি দিতে পারি না। এখানে আমরা একমত হই যে বােস্টার রাষ্ট্রদূত বলতে নিজেকেই বুঝিয়েছেন। বােস্টার নিশ্চিত ছিলেন যে, ঐ যােগাযােগ অব্যাহত ছিল এবং অ্যুত্থানটি যারা করেছে, তারা ভেবেছিল মুজিব চলে গেলেই যুক্তরাষ্ট্র তাদের গ্রহণ করবে। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে আমরা জানব তারা কারা ছিল, তবে তারা সফল হলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের স্বীকৃতি দেবে।
২৯, সেটা ছিল একটা ব্যতিক্রমী মুহূর্ত। মার্কিন রাষ্ট্রদূত দুই মার্কিন সাংবাদিকের কাছে অভিযােগ করলেন, তার সুস্পষ্ট নির্দেশের বাইরে গিয়ে তার , সি.আই.এ স্টেশন প্রধান অভ্যুত্থানে সাহায্য-সহযােগিতা করেছে।
৩০, একই সঙ্গে আমরা এটাও ভাবছিলাম, ওয়াশিংটন ও ল্যাংলেতে কার এমন কর্তৃত্ব ছিল যিনি ‘সবুজ সংকেত দিয়েছিলেন এবং রাষ্ট্রদূতের নির্দেশনা বাতিল করেছিলেন। এক বছর আগে রিচার্ড নিক্সনের পদত্যাগ এবং জেরাল্ড ফোর্ড দুর্বল মার্কিন রাষ্ট্রপতি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পর ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্রনীতির কাণ্ডারি বলতে একজনই ছিলেন এবং তিনি হেনরি কিসিঞ্জার । কিন্তু ছােট ছােট দেশকে শক্তিধর রাষ্ট্রের অনুগত করার জন্য হেনরি কিসিঞ্জার কি এ ধরনের অ্যুত্থানকে বিবেচনায় রাখবেন?
| ৩১. কিসিঞ্জার বাংলাদেশ থেকে এত দূরে থেকে কিভাবে সামরিক অভ্যুত্থান। পরিকল্পনার অস্পষ্ট দিক সম্পর্কে অবগত হতেন, সে বিষয়টিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে সংশয়ে ছিলাম। কিসিঞ্জারের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের সাবেক সহযােগী রজার মরিসের সাক্ষাৎকার নেয়ার পরও আমার মধ্যে আরাে কিছু সময় এ সংশয় ছিল। তিনি সেই রজার মরিস, যিনি তার সাবেক নিয়ােগকর্তা সম্পর্কে সমালােচনামুখর একটি জীবনী লিখেছিলেন। জীবনীগ্রন্থটির নাম ছিল ‘আনসার্টেন গ্রেটনেস : হেনরি কিসিঞ্জার অ্যান্ড আমেরিকান ফরেন পলিসি’।
৩২. ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ও হেনরি কিসিঞ্জার সম্পর্কে কথা বলার জন্য মরিসের সঙ্গে বসেছিলাম। তার সঙ্গে কেউ একমত হন বা না-ই হন তার মন্তব্যগুলাে ছিল সুনির্দিষ্টভাবে অকাট্য। মরিসের পর্যবেক্ষণ এবার তুলে ধরা যাক—
৩৩, ১৯৭৫ সালের গােড়ার দিকে আমি আমার বইয়ের জন্য একজনের সাক্ষাঙ্কার নিচ্ছিলাম, যিনি তখন কিসিঞ্জারের ঘনিষ্ঠ সহযােগী ও সবচেয়ে সিনিয়র আস্থাভাজন ছিলেন। আমার সঙ্গে তার ভালােই জানাশােনা ছিল। কিসিঞ্জারের নীতির সমালােচনা করে নয়, বরং গুরুত্বের সঙ্গেই তিনি বললেন, কিসিঞ্জার যুগে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির তিনটি প্রতিশােধের ঘটনা ঘটেছে। কিসিঞ্জারের বিদেশী শক্রর তালিকায় সবচেয়ে ঘৃণিত তিন ব্যক্তি ছিলেন চিলির আলেন্দে, ভিয়েতনামের থিউ এবং বাংলাদেশের শেখ মুজিব। এটা বন্ধু বা শত্রু অথবা প্রতিপক্ষের বিষ ছিল না। আসলে এই লােকগুলাে নানাভাবে বাধা হয়ে উঠেছিল। আলেন্দের বিষয়টি পরিষ্কার। স্বাভাবিকভাবে তিনি থিউর কথা ভেবেছিলেন; কারণ বর্তমানের রেকর্ড ঘেঁটে দেখা যায়, উত্তর ভিয়েতনামের সঙ্গে কোনাে সমঝােতার জন্য থিউ প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছিলেন। সায়গনে গিয়ে বােমা মেরে কিংবা অন্য কোনােভাবে থিউকে সমঝােতায় সম্মত করাতে কিসিঞ্জার চেয়েছিলেন।
৩৪, মুজিব তাদের এই দলভুক্ত নন। তা সত্ত্বেও কিসিঞ্জার সেই সময় (১৯৭১) অনুভব করেছিলেন যে, তার চীনানীতি, যার উপর অনেক কিছুই নির্ভর করছিল, সেটিকে ক্ষতি করার মতাে বিপর্যয়কর অবস্থা বিরাজ করছিল পূর্ব পাকিস্তানে। ভিয়েতনাম আলােচনার অনেক কিছুই তখন বাকি ছিল। অথচ এখানকার পরিস্থিতি হয়ে উঠেছিল বিরক্তিকর। কিসিঞ্জারের মনে হচ্ছিল, এখানে একজন রাজনীতিক যথাযথ আচরণ করছিলেন না। বােঝাপড়ার পরিবর্তে তার লােকজন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। তবে বিষয়টা এমন নয় যে, তা হেনরি কিসিঞ্জার অথবা তার বিশ্ব পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেবে। তা সত্ত্বেও এটি কিসিঞ্জানের কূটনীতির ব্যক্তিগত বিষয় হয়ে দাঁড়ায় এবং এক পর্যায়ে তা প্রতিশােধের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। | ৩৫. মরিস বলতে লাগলেন, কেউ কেউ মনে করেন হেনরি কিসিঞ্জার উনিশ শতকের একজন গতানুগতিক কূটনীতিক। কারণ তার আদর্শিক গুরু, অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব এবং নায়করা সব উনিশ শতকের। তাহলে কেউ মনে করতে পারেন, তার নীতি হবে এমন, “স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু বলে কিছু নেই, আছে শুধু স্থায়ী স্বার্থ। “এ নীতির ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র তাৎক্ষণিকভাবে শেখ মুজিবকে স্বাগত জানাতে পারত, তার সরকারকে কাছে টেনে রাখতে পারত। কিন্তু আমি যেমন বলেছি, কিসিঞ্জার ছিলেন প্রতিশােধপরায়ণ লােক এবং ভাবতেন যে মুজিব আমাদের লােক নয়। যদি তিনি আমাদের লােক না হয়ে থাকেন, তাহলে স্থায়ী স্বার্থ বলেও কিছু নেই। এখন যেটা করতে হবে তাহলাে, আমাদের লােকজনকে ক্ষমতায় বসাতে হবে এবং তাদের উৎখাত করতে হবে। ঐ সময়ের মার্কিনিদের নথিপত্রে লজ্জা-শরম বা দ্বিধাসংকোচের কোনাে উপাদান কেউ খুঁজে পাবে না। বাংলাদেশর বিষয়টি তত বড় নয়, এ নিয়ে কোনাে শােরগােলের ব্যাপার নেই এবং সেখানে কিছু ঘটানাে খুবই সহজ। | ৩৬, আমি মরিচের তত্ত্বের বিষয়ে এখনাে সংশয়ে আছি। ১৯৭৯ সালের এপ্রিলে কাই বার্ড ও আমি হেনরি কিসিঞ্জারকে লেখা এক চিঠিতে ১৯৭১ সালে খন্দকার মােশতাক গােষ্ঠীর সঙ্গে গােপন যােগাযােগের বিষয়ে সাতটি প্রশ্ন করেছিলাম। আমরা জানতে চেয়েছিলাম, ১৯৭৪-৭৫ সালে অ্যুথানের আগের মাসগুলাের মার্কিন দূতাবাস কর্মকর্তাদের সঙ্গে মােশতাক গােষ্ঠীর যােগাযােগের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে তিনি অবগত ছিলেন কি না। ১৯৭৪ সালে মােশতাক গােষ্ঠীর সঙ্গে নতুন করে যােগাযােগ ও অভ্যুত্থানের সময় কিসিঞ্জার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। মােশতাক ও তার অভ্যুত্থান পরিকল্পনাকারীদের সঙ্গে যােগাযােগ বন্ধ রাখতে রাষ্ট্রদূত বােস্টারের নির্দেশ সম্পর্কে কিসিঞ্জারের অবহিত থাকার কথা। কারণ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার সুবাদে সব ধরনের চিঠিপত্র দেখা ও পড়ার সুযােগ তার ছিল।
পরের মাসে কিসিঞ্জার জবাবে আমাদের বিরুদ্ধে ‘বিস্ময়কর চিঠি’র অভিযােগ তুলে বললেন, আমাদের প্রেস ডেডলাইন অনুযায়ী উত্তর দেয়ার জন্য তাকে যথেষ্ট সময় দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, “দোষারােপ আর অস্পষ্ট ধারণার মিশ্রণে লেখা আপনাদের অস্বাভাবিক চিঠিটির কোনাে জবাব আমি দিতে পারি না। শুধু এটাই বলতে পারি, বিষয়বস্তুর দিক থেকে এটি সত্য থেকে অনেক দূরে। আমি আপনাদের তথ্য সরবরাহকারীর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছি। কিসিঞ্জারের এ জবাবের পর আমরা জুনে আবার লিখলাম, ভবিষ্যতে এ বিষয়ে একটা নিবন্ধ লিখব। সে ক্ষেত্রে প্রেস ডেডলাইন নিয়ে তার মাথা ঘামানাের প্রয়ােজন নেই। আমাদের ধৈর্য আছে। তার কাছে শুধু প্রশ্নগুলাের উত্তর চাই।
৩৭, জুন মাসের চিঠিতে আমরা কিসিঞ্জারকে বললাম, আপনি প্রশ্নগুলােকে সত্য থেকে অনেক দূরে’ বললেও আমরা তা মনে করি না। বরং সত্য জানার জন্যই প্রশ্নগুলাে তৈরি করা হয়েছে। যথার্থ সত্য জানার জন্য আমাদের অন্য কোনাে পদ্ধতি জানা নেই। কোন বিষয় বা ঘটনা, নাম অথবা ঘটনাক্রমের সঙ্গে আপনি একমত নন, সেটাই বরং আমরা জনতে চাই। ১৯৭১ সালের যোগাযােগ ও ১৯৭৪ সালের যােগাযােগ সম্পর্কে আপনার মনােভাব কি? আমাদের মতে, বিস্মিত হওয়াটা চিঠির কোনাে সুনির্দিষ্ট জবাব হলাে না। ২৬ বছর পর কিসিঞ্জার এখনাে চিঠির জবাব তৈরি করতে পারেনি। এর মধ্যে কত ‘প্রেস ডেডলাইন’ এসেছে আর গেছে। | ৩৮, আমাদের মূল চিঠিতে আমি কিসিঞ্জারকে এ কথা লিখতে ভুলে গেছি যে, ১৯৭৬ সালে পুরান ঢাকার বাসায় খন্দকার মােশতাক আহমদের সঙ্গে চা খেতে খেতে সাক্ষাতের সময় তাকেও এই প্রশ্ন করেছিলাম। এ সাক্ষাৎটি হয়েছিল মুজিব। হত্যাকাণ্ড এবং জিয়াউর রহমান তাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার পর। প্রশ্ন শুনে। মােশতাক দাঁত খিচিয়ে বলে উঠলেন, আমি তাকে এ ধরনের প্রশ্ন করতে পারি না। তিনি আমাকে বললেন, এ সব প্রশ্ন বিষয়ে মােশতাকের বক্তব্য শুনে কিসিঞ্জার। বিস্মিত হতেন। যে কোনভাবেই হােক আমার মনে হচ্ছিল, আমাদের প্রশ্নের যে। উত্তর তারা দেবে তাতে বেশ পার্থক্য থাকবে।
৩৯, পররাষ্ট্র দপ্তরে আমরা ইউজেন বােস্টারের সাক্ষাৎকার নেয়ার পর নিজস্ব কারণেই তিনি ঐ সময় প্রকাশ্যে এ বিষয়ে কিছু বলতে চাননি। সম্ভবত এ কারণে যে, এ সব ঘটনায় নাটের গুরু কিসিঞ্জারের যােগসূত্র পরিষ্কার হচ্ছিল না। পরবর্তী কয়েক বছর আমি রাষ্ট্রদূত বােন্টারের সঙ্গে নিয়মিত যােগাযােগ রক্ষা করে চলেছি। এ বিষয়ে নানা অগ্রগতি ও নতুন নতুন মােড় সম্পর্কে লেখা বিভিন্ন নিবন্ধ ও চিঠি পাঠিয়েছি।
৪০, ঢাকায় ১৯৭৫ সালের ঘটনাবলির বিষয়ে কংগ্রেসীয় তদন্তের জন্য আমার প্রচেষ্টা সম্পর্কে বােস্টার জানতেন। আমরা জানতাম, মার্কিন রাজনীতিতে বাংলাদেশ চিলি, ভিয়েতনাম কিংবা ইরান নয়। কয়েক বছর আগে ওয়াশিংটনে থাকাকালে আমি তার সঙ্গে দেখা করেছিলাম। ঐ সময় আমি তাকে বােঝাতে চেষ্টা করেছিলাম, তিনি যা জানেন তা প্রকাশ করাই শ্রেয়। তিনি আমার সঙ্গে দ্বিমত পােষণ করলেন। , বরং তার মনােভাব এমন ছিল যে আমার বেঁচে থাকতে নয়।’ এ কথার মাধ্যমে। আমি বুঝলাম, তার মৃত্যুর পরই আমি সূত্র হিসেবে তার নাম ব্যবহার করতে পারব।
৪১, চলতি বছর আমি ভার্জিনিয়ায় তার সঙ্গে দেখা করার পরিকল্পনা। করেছিলাম। গত মাসের (জুলাই) তৃতীয় সপ্তাহে তার সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল। অভুথানের ত্রিশতম বার্ষিকী সামনে রেখে তার একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করার জন্য তাকে রাজি করা, কিন্তু তা আর হলাে না। ইউজেন বােস্টার গত ৭ জুলাই হৃদরােগে আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন। আমি আবারও মাত্র দুই সপ্তাহের জন্য তার সঙ্গে সাক্ষাতর সুযোগ হারালাম। | ৪২, সি,আই, এর স্টেশন-প্রধান যে সব ঘটনা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন এবং যেগুলাের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন, সে বিষয়ে খুব কমই ‘অন দ্য রেকর্ড’ সাক্ষাৎকার রয়েছে। সেটা ছিল এক অস্বাভাবিক সময় এবং বর্তমানে এটা ধারণাতীত যে একজন প্রতিবেদক এবং একজন সি.আই.এ কর্মকর্তা এ রকম একটি বিষয় নিয়ে মুক্ত ও খােলামেলা আলােচনা করতে পারেন। ফিলিপ চেরি ১৯৭৫ সালের আগস্টে ঢাকায় সি.আই.এর স্টেশন প্রধান ছিলেন। ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বরে তার সঙ্গে অ্যুত্থান বিষয়ে আমার কথা হয়, তখন তিনি নাইজেরিয়ার সাবেক রাজধানী লাগােসে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র থেকে আমরা অভ্যুত্থানে জড়িত থাকার বিষয়ে যে অভিযােগ পেয়েছিলাম, সে সম্পর্কে আমি তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম। আমরা টেলিফোনে প্রায় ২০ মিনিট কথা বলি।
৪৩, মুজিব সরকারকে উৎখাতের পরিকল্পনাকারী কোনাে গােষ্ঠীর সঙ্গে তিনি অথবা তার দপ্তরের কেউ যােগাযােগ রেখেছিলেন বলে সে অভিযােগ ওঠে, তা তিনি পুরােপুরি অস্বীকার করেন। চেরি আমাকে বলেন, ‘বাংলাদেশীরা নিজেরাই এটি করেছে।” বাইরের সরকারগুলাের সম্পৃক্ততার কারণে যে কোনে অভ্যুথান সংগঠিত হয়, এ ধরনের চিন্তাভাবনা খুবই ভুল বলে তিনি মন্তব্য করেন। চেরি বলেন, জনগণ নিজেরাই সব সময় অধিকাংশ অ্যুথান সংগঠিত করে।
৪৪, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মােশতাকের নেটওয়ার্কের গােপন যােগাযােগের আগের ইতিহাস সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে চেরি বলেন, “রাজনীতিবিদরা প্রায়ই দূতাবাসগুলােয় যান এবং সম্ভবত তাদের সেখানে যােগাযােগ থাকে। তারা ভাবেন, তাদের এ ধরনের যােগাযােগ আছে। কিন্তু কোনাে দূতাবাস অভ্যুথানে সম্পৃক্ত থেকে তাদের সহযােগিতা করবে, এটা খুবই অচিন্তনীয় ব্যাপার। চেরি দাবি করে, তিনি মার্কিন রাষ্ট্রদূত ইউজেন বােস্টারের পুরােপুরি তত্ত্বাবধানে ছিলেন। তিনি বলেন, “আমরা জানতাম, মুজিব বিপদের মধ্যে আছেন। আমরা এ-ও জানতাম, সেখানে যা-ই হােক, আমাদের কিছু যায়-আসে না। কে মুজিবকে ক্ষমতাচ্যুত করল বা কী কারণে মুজিব ক্ষমতাচ্যুত হলেন, সেটাও আমাদের বিবেচনার বিষয় নয়। আরাে জানতাম, এ ঘটনার জন্য আমাদের দায়ী করা হবে। তাই ভীষণ পরিষ্কার থাকার জন্য আমরা অতিরিক্ত সতর্ক ছিলাম। রাষ্ট্রদূত বােস্টারের নির্দেশনা মেনে চলার বিষয়টি আমরা নিশ্চিত করেছিলাম। সব ধরনের যােগাযােগ আমরা বন্ধ। করেছিলাম। আমরা পুরােপুরি রাষ্ট্রদূত বােস্টারের নির্দেশনা অনুসরণ করেছিলাম।
৪৫, যদিও বােন্টার নিজেই এই মত প্রকাশ করেছিলেন, যে ১৯৭৫ এর প্রথমদিকে তিনি যে ধরনের নির্দেশনা দিয়েছিলেন, সি.আই. এর স্টেশন প্রধান সে অনুযায়ী এ ধরনের যােগাযােগ বন্ধ করেননি। এটা সম্পূর্ণ বােস্টারের নিজের মতামত। যখন আমি চেরিকে জিজ্ঞেস করি, দূতাবাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা কেন এ ধরনের অভিযােগ করেন, তখন চেরি বারবার দাবি করেন, এ ধরনের অভিযােগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। নিজের পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, “সেখানে সম্ভবত কেউ ছিলেন, যিনি কারাে কারাে ব্যাপারে ঈর্ষান্বিত ছিলেন। এ কারণে এখন তিনি এ ধরনের বিবৃতি দিচ্ছেন, কিন্তু আমি আপনাকে সাক্ষী রেখেই এ বিষয়ে তার সঙ্গে মােকাবিলা করা এবং আলােচনার সুযােগ নিতে আগ্রহী।” ৪৬. ফিলিপ চেরি অবশ্য এ ধরনের সুযােগ পাননি। রাষ্ট্রদূত বােস্টার যখন আমাদের সঙ্গে কথা বলতেন, তখন তিনি উদ্ধৃত হতে বা ‘অন দ্য রেকর্ড’ চিহ্নিত হতে অনিচ্ছুক ছিলেন। আমার ধারণা, যুক্তরাষ্ট্রে তখন যে ধরনের পরিবেশ বিরাজ করছিল, রাষ্ট্রদুত সে পরিস্থিতিতে একটি তদন্ত আশা করেছিলেন। অবশ্যই এ ধরনের তদন্তের নিশ্চয়তা ছিল না, কেবল সম্ভাবনা ছিল। চার্চ এবং পাইক কমিটির প্রতিবেদনের কারণে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রে একটা মনােভাব তৈরি হচ্ছিল। যদি কংগ্রেসের কোনাে তদন্ত হতাে, এটা আমার বিশ্বাস যে রাষ্ট্রদূত বােন্টার এ বিষয়ে এগিয়ে আসতেন এবং শপথ নিয়ে সাক্ষ্য দিতেন।
৪৭, ১৯৭৮ সালে সাক্ষাৎকারে চেরির বক্তব্যের সঙ্গে ১৯৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বক্তব্যে মিল পাওয়া যায়নি। পররাষ্ট্র দপ্তর কংগ্রেসম্যান, স্টিফেন সােলার্জের কাছে স্বীকার করে, ১৯৭৪ সালের নভেম্বর এবং ১৯৭৫-এর জানুয়ারির মধ্যে অবশ্যই বৈঠক হয়েছিল। আর ঠিক এ বিষয়টি কয়েক বছর আগেই দূতাবাসে আমাদের প্রধান সূত্র (ইউজেন বােস্টার) সঠিকভাবেই এ তথ্য জানিয়েছিলেন। সােলার্জের বক্তব্যকে নাকচ করে যে, “কোনাে বাংলাদেশী আমাদের অফিসে আসেননি। এবং অভ্যুত্থান বা অন্য কোনাে বিষয়ে পরিকল্পনা সম্পর্কে আমাদের কিছু বলেননি।”
৪৮, প্রথমেই দুটি সম্ভাব্য বিকল্পের একটি চিন্তায় আসে। জানুয়ারির পরেও মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে হয় মােশতাক গােষ্ঠীর লােকজন যােগাযােগ অব্যাহত ছিল যেটা বােন্টার বিশ্বাস করতেন; অথবা চেরির দাবিমতে, এ যােগাযােগ ছিল না। যদিও এখানে তৃতীয় একটি সম্ভাবনা থেকে যায়। চেরি যদি সত্য বলে থাকেন, যা এখনাে অস্পষ্ট রয়ে গেছে, এটা সম্ভব যে মােশতাকের সহযােগীরা ওয়াশিংটনের। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একটি স্বাধীন যােগাযােগ প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। আর এটা করা হয়েছিল দূতাবাস বা সি.আই. এর চ্যানেলকে পাশ কাটিয়ে। | ৪৯, এভাবে সম্ভবত চেরি রাষ্ট্রদূত বােস্টারের নির্দেশ অনুসরণ করেছিলেন। আর পূর্ব চ্যানেলের বাইরেও যােগাযােগ অব্যাহত ছিল। এটা সম্ভব যে মােশতাকের সহযােগীদের কেউ বাংলাদেশ থেকে বাইরে যুক্তরাষ্ট্র অথবা অন্য কোথাও গিয়ে অ্যুত্থানের পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠক করেন। পেন্টাগনের প্রতিরক্ষা গােয়েন্দা সংস্থার। অ্যাটাসে বা কর্মকর্তাদের দ্বারা এটি সম্ভব। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তাদের গভীর ঐতিহাসিক যােগাযােগ রয়েছে। এরাও অ্যুত্থান পরিকল্পনা তদারকি করতে থাকতে পারে। | ৫০, এই পরস্পরবিরােধী দাবিগুলাে আধাবিচারিক ক্ষমতাসম্পন্ন কংগ্রেসনাল তদন্তের মাধ্যমে নিস্পত্তি হতে পারত। বাংলাদেশে অ্যুত্থানের বিষয়ে কংগ্রেসম্যান স্টিফেন সােলার্জ এবং তার সহযােগী স্ট্যানলি রােথের চেষ্টা সত্ত্বেও কোনাে তদন্ত পর্যন্ত হয়নি। | ৫১. বাংলাদেশ থেকে পাওয়া আরাে কিছু প্রামাণিক তথ্যে জানা গেছে, মার্কিন কর্মকর্তারা অভ্যুত্থান পরিকল্পনাকারীদের সঙ্গে যােগাযােগ রাখতেন এবং অ্যুথান ঘটানাের আগ পর্যন্ত এ পরিকল্পনার উপর নজর রাখতেন। অ্যুত্থান ঘটানাের আগ পর্যন্ত এ পরিকল্পনার উপর নজর রাখতেন। অ্যুত্থান পরিকল্পনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও এ বিষয়ে সরাসরি অবগত ছিলেন, এমন এক নির্ভরযােগ্য সূত্রের সঙ্গে আমি ১৯৯৭ সালে সাক্ষাৎ করি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এ কর্মকর্তা আগস্টের অ্যুত্থান পরিকল্পনার ভেতরে থেকে নিখুঁতভাবে এ কাজ করেছেন এবং ধাপে ধাপে এ পরিকল্পনা এগিয়ে নিয়েছেন। ১৯৭৫ সালেও ঐ ব্যক্তির সঙ্গে অল্প সময়ের জন্য আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল এবং আবার দেখা করব বলে আশা করেছিলাম।
৫২, আমাদের মধ্যে সে সাক্ষাৎ হয়েছে ঠিকই, তবে এর মধ্যে কেটে গেছে দুই দশকেরও বেশি সময়। তিনিই মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে আমার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য অনুরােধ জানান। তার নিজের প্রয়ােজনেই আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। মধ্যস্থতাকারী যাতে আমি বিশ্বাস করতাম, তার মাধ্যমে দীর্ঘ কথাবার্তার পর যুক্তরাষ্ট্র থেকে রওনা হলাম এবং একটি ইউরােপীয় দেশের রাজধানীতে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলাে। তিনিও অন্য এক মহাদেশ থেকে এসেছিলেন। আমরা পাঁচ ঘণ্টা ধরে কথা বললাম।
৫৩, তার সঙ্গে অনেক বিষয়েই কথা হয়েছে। অভ্যুত্থানের ছয় মাসেরও আগে থেকে মােশতাক ও জেনারেল জিয়াউর রহমান উভয়ের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা এবং মেজরদের সঙ্গে তাদের আলােচনার ব্যাপারে তার কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলাে জানা হলাে। মেজর রশিদ আলাদাভাবে জিয়া ও মােশতাকের সঙ্গে যে সব বৈঠক করতেন, তেমন অনেক বৈঠকেই তিনি ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত ছিলেন। ১৯৭৬ সালের আগস্টে মেজর রশিদ একটি ব্রিটিশ টেলিভিশনকে একটি সাক্ষাঙ্কার দিয়েছিলেন। দ্য সানডে টাইমসের সাংবাদিক এন্থনি মাসকারেনহাসের নেয়া সে। সাক্ষাঙ্কারে জেনারেল জিয়ার সঙ্গে ১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ অনুষ্ঠিত এক বৈঠকের বিবরণ দেন রশিদ। অভ্যুত্থানের পাঁচ মাস আগের ঐ বৈঠকে অত্যুত্থান পরিকল্পনার বিস্তারিত আলােচনা হয়েছিল বলে রশিদ জানান। অভ্যুত্থানের পাঁচ মাস আগে সে বৈঠক হয়েছিল। আমার এই সূত্র সে বৈঠকে উপস্থিত ছিল এবং দাবি করেন, এটা অ্যুথান পরিকল্পনা বিষয়ে প্রথম বৈঠক ছিল না। ৫৪, সে সময় সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান জেনারেল জিয়া প্রস্তাবিত অ্যুথান। পরিকল্পনার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। তবে এ ব্যাপারে সামরিক তৎপরতার নেতৃত্ব দিতে অনাগ্রহ দেখান। রশিদ জেনারেল জিয়াকে বলেন, জুনিয়র কর্মকর্তারা। ইতিমধ্যে একটি পরিকল্পনা তৈরি করে ফেলেছে, এরা শুধু তার সমর্থন আর নেতৃত্ব চায়। জিয়া কিছুটা সময় নিলেন। মাসকারেনহাসকে দেয়া মেজর রশিদের সাক্ষাৎকারের তথ্য এবং আমার সেই সূত্রমতে, জিয়া রশিদকে বলেছিলেন, একজন। সিনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে তিনি এতে সরাসরি জড়িত হতে চান না। তবে জুনিয়র কর্মকর্তারা যদি প্রস্তুতি নিয়েই ফেলে, তাহলে তাদের এগিয়ে যাওয়া উচিত।
৫৫, আমার তথ্যদাতার মতে, মেজররা শেষ পর্যন্ত আশা করেছিলেন যে জিয়াই অভুথনের নেতৃত্ব দেবেন। যদিও তারা মােশতাকের সঙ্গে সারাক্ষণ সতর্ক যােগাযােগ রেখেছিলেন, কিন্তু তারা চাইছিলেন এমন একটা ভালাে উপায়, যা মােশতাককে নতুন সরকারের প্রধান করবে না। মেজরদের দিক থেকে সবচেয়ে ভালাে উপায়টি ছিল অত্যুত্থানের পর কর্তৃত্বকারী হিসেবে একটি সামরিক কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করা। বস্তুতপক্ষে মেজর রশিদই তার গােষ্ঠীর জন্য উপায়গুলাে নির্ধারণের জন্য দায়িত্বে ছিলেন। তাদের আশা ছিল, জিয়াই এ ধরনের কাউন্সিলের নেতৃত্ব দেবেন। তবে সম্ভবত জুনিয়র কর্মকর্তারা জিয়ার নেতৃত্বে সিনিয়র কর্মকর্তাদের অ্যুত্থান আশা করছিলেন। জেনারেল জিয়ার নিরপেক্ষতা অথবা নীরব সমর্থন নিশ্চিত হলে জুনিয়র কর্মকর্তারা শঙ্কামুক্ত থাকতে পারেন যে, সংকটের মুহূর্তে জিয়া তার বাহিনীকে তাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেবেন না। | ৫৬, আমার গুরুত্বপূর্ণ সেই সূত্র একটি চমকে দেয়া তথ্য জানিয়ে বললেন, জিয়া ও মােশতাকের সঙ্গে আলাদা দুটি বৈঠকে তিনি উপস্থিত ছিলেন। সেখানে মেজর রশিদ নিজেই প্রশ্ন তুললেন, পরিকল্পিত অভ্যুত্থানের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের মনােভাব কী হবে? ঐ সামরিক কর্মকর্তা জানালেন, জিয়া ও মােশতাক উভয়েই আলাদাভাবে আমাদের বললেন, তারা এ বিষয়ে মার্কিনিদের মনােভাব জেনেছেন।
দুই জনের উত্তরই একই রকম ছিল। তারা বললেন, এটা (মুজিবকে সরানাে) মার্কিনিদের জন্য কোনাে সমস্যা নয়। আমি তখন অনুভব করলাম, মার্কিনিদের সঙ্গে জিয়া ও মােশতাকের আলাদা যােগাযােগের চ্যানেল রয়েছে। পরে আর এ বিষয়ে কথা হয়নি। ৫৭, মেজররা শেষ পর্যন্ত আশা করেছিলেন, অ্যুত্থানের পরপরই যে সামরিক কাউন্সিল গঠিত হবে, জিয়া তার নেতৃত্ব দেবেন। এমনকি ১৫ই আগস্টও তাদের বিশ্বাস ছিল, এখনাে সে সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু এই সূত্র জানান, যখন শেখ মুজিব ও তার অন্য আত্মীয়দের বাড়িতে পুরুষদের পাশাপাশি নৃশংসভাবে নারী-শিশু গণহত্যা ঘটে গেল, তখনই জেনারেল জিয়া ছায়ার আড়ালে পিছিয়ে যান। ৫৮, সূত্রমতে রশিদ নিজেও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মর্মাহত হয়েছিলেন। পরবর্তী কয়েক বছর তার মধ্যে এ বিশ্বাস জন্মেছিল যে অভূত্থান পরিকল্পনার মধ্যেও আরাে একটা লুকানাে পরিকল্পনা ছিল যেটা সম্পর্কে তিনি জানতেন না বা এর উপর তার নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তা সত্ত্বেও দুই জুনিয়র সেনা কর্মকর্তা রশিদ ও ফারুক জনসমক্ষে হত্যাকাণ্ডের দায় অস্বীকার করেননি। বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখেও তারা তাদের অনুগত এ ছছাট সেনাদলের কাজের দায় নিয়েছেন।
৫৯, এই সূত্র দাবি করেছেন, কিছু হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা ১৫ আগস্ট দিনটির জন্যই করা হয়েছিল। কথা ছিল কমপক্ষে চার জন আওয়ামী লীগ নেতাকে তাদের বাসভবন থেকে তুলে সুনির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে হত্যা করা হবে। এ পরিকল্পনায় শেখ মুজিবকে হত্যা করার বিষয়টিও ছিল। তবে সূত্র দাবি করেন, এরপরও অত্যুত্থান। সংগঠক কর্মকর্তাদের এমন কোনাে পূর্বপরিকল্পনা ছিল না যে তারা পরিবারগুলাের উপর গুলি চালাবে। এই ধরনের অন্যান্য পরিস্থিতির মতাে সেদিনও অনকাক্সিক্ষত বর্বরতা ঘটে যায়। | ৬০, অভ্যুত্থানের পর পরস্পরবিরােধী যে ধারণা জন্মেছিল, তা নিয়ে খুব কম বিশ্লেষণ হয়েছে। অভ্যুত্থানের দুই বছর আগে থেকে দেশের বামপন্থি দল, যেমনজাসদ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী), সর্বহারা পার্টির মতাে গােপন দলগুলাে মুজিব শাসনের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করেছে। কিন্তু বামপন্থিদের ‘বিপ্লব’ যেমনটি আশঙ্কা করা হচ্ছিল, তা শেখ মুজিবের পতন ঘটায়নি বরং ষড়যন্ত্রটা করেছিল ডানপন্থিদের একটি সংকীর্ণ গােষ্ঠী। | ৬১, কট্টরপন্থি জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলাে যে চ্যালেঞ্জ গড়ে তুলেছিল এবং এগিয়ে নিয়েছিল, আগস্টের ঘটনা তাতে আরাে গতিসঞ্চার করে। এ অ্যুত্থানটি ঘটিয়েছিল মুজিবের নিজের দল, তার মন্ত্রিসভা, তার সচিবালয়, তার জাতীয় গােয়েন্দা সংস্থা এবং জাতীয় সেনাবাহিনীর ডানপন্থি অংশ যারা মনে করছিল তাদের স্বার্থে বামপন্থি চ্যালেঞ্জ মােকাবিলায় মুজিবের নেতৃত্ব আর সক্ষম নয়।
সূত্র : ফ্যাক্টস্- এন্ড ডকুমেন্টস্–বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড – অধ্যাপক আবু সাইয়িদ