You dont have javascript enabled! Please enable it! 1975.08.15 | ব্যক্তি আক্রোশের ডুগডুগি - মুজিব হত্যাকাণ্ড - সংগ্রামের নোটবুক

ব্যক্তি আক্রোশের ডুগডুগি

শুধু তৃতীয় বিশ্ব নয়, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিশাল ব্যক্তিত্ব এবং নেতৃত্ব প্রায় সকল দেশেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। চলনে, বলনে, কাজকর্মে তার বিশালতার ছাপ ছিল আকর্ষণীয়। এমন একজন বিরাট ব্যক্তি মানুষকে হত্যা করার নেপথ্যেও থাকে এক ব্যাপক সূক্ষ্ম, নিপুণ ও বিশাল পটভূমিকা এবং নির্ভুল বুপ্রিন্ট। বঙ্গবন্ধু হত্যার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তও ছিল অনুরূপ

১.  কেউ যদি বলেন, সামরিক বাহিনীর কতিপয় অফিসার ব্যক্তিগত আক্রোশে কিংবা হঠকারী উচ্চাভিলাষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে অথবা কথাটিকে ঘুরিয়ে যদি এভাবে বলা যায়— মানুষ মাত্রেরই ভুল ত্রুটি থাকে। মানুষ মুজিবের ভুল ত্রুটি থাকবে না। এটা হতে পারে না। তবে তার এমন কোনাে ভুল ভ্রান্তি দৃশ্যমান কিনা যা পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্তে পৌছানাে যায় মুজিব হত্যা ব্যক্তিগত আক্রোশের ফলশ্রুতি। নিচে দুই একটি উদাহরণ তুলে ধরা বিশেষ প্রয়ােজনীয়। কেননা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর আন্তর্জাতিকভাবে প্রচার করা হয়েছে ব্যক্তিগত আক্রোশে শেখ মুজিব নিহত হয়েছেন। এ সব আন্তর্জাতিক রিপাের্ট থেকে সমগ্র বিশ্বে বিশেষকরে বাংলাদেশের মানুষের কাছেও এ কথা বিশ্বাসযােগ্য করার প্রয়াস চলেছিল যে, মুজিব হত্যা ব্যক্তিগত আক্রোশের নির্মম ফলশ্রুতি।

১.১ যেমন বিখ্যাত সাংবাদিক এন্থনী মাসকারেনহাস “কিসে ভুল হল শিরােনামে লন্ডনের সানডে টাইমস-এ এক বিরাট রিপাের্ট প্রকাশ করেন। রিপাের্টটি নিম্নরূপ। “১৯৭২ সালে নব প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে ফিরে এসে শেখ মুজিবুর রহমান বীরের সম্বর্ধনা পেয়েছিলেন। তিনি তখন সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। গত সপ্তাহে এক সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছেন। দুটি ঘটনার মাঝখানে কয় বছর তার সম্পর্কে বাংলাদেশের জনগণের মােহ কেটে গেছে এবং সােনার বাংলার স্বপ্ন মিলিয়ে গেছে। কিসে ভুল হলাে? মুজিবের ট্র্যাজেডি এই যে, চার বছরের কম সময়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর উচ্চতর মর্যাদা হারিয়ে বঙ্গদুশমনে পর্যবসিত হলেন। তার বিপর্যয়ের রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় প্রধানত তিনটি উপকরণ মিশে আছে। প্রথমত সামরিক বাহিনীর প্রধান হওয়া সত্ত্বেও মুজিব সেনাবাহিনীকে বিশ্বাস করতেন। সেনাবাহিনীর এবং বাংলাদেশ আন্দোলনে প্রশংসনীয় ভূমিকা রয়েছে এমন অনেক সামরিক অফিসারের মর্যাদা ক্ষুন্ন করার। কোনাে সুযােগ তিনি ছাড়তেন না। মুজিবের প্রতি ব্যক্তিগতভাবে অনুগত উচ্চ ট্রেনিং প্রাপ্ত সুসজ্জিত ইউনিফরমধারী রক্ষীবাহিনীকে অস্ত্রেশস্ত্রে বেতন ভাতায় ব্যয় বরাদ্দে সামরিক বাহিনীর চেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়া হতাে। উভয়ের মধ্যে স্বার্থের অনেক সংঘাতেই মুজিব অন্ধভাবে রক্ষীবাহিনীকে সমর্থন করতেন। অদ্ভুত ব্যাপার এই যে সেনাবাহিনী সম্পর্কে দীর্ঘদিনের সন্দেহ ও ভীতি থাকা সত্ত্বেও মুজিব গত বছর পাচার ও দুর্নীতি উচ্ছেদ অভিযানে সেনাবাহিনীকেই নিয়ােগ করেছিলেন। তার এই রাজনৈতিক চাতুরী মারাত্মকভাবে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। এতদিন সেনাবাহিনী সরকারের অবৈধ কার্যকলাপের কথা গল্প গুজব শুনছে মাত্র। এবার তারা এর ব্যাপকতার মুখােমুখি দাঁড়াল। দুর্নীতি নির্মূল অভিযানে বাধা আসল রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে।

এতে তাদের অসন্তোষ আরও বেড়ে গেল, তার অবশ্যম্ভাবীরূপে তাদের আক্রোশ নিবদ্ধ হলাে মুজিবের উপর। সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুজিবের বিরােধের ফলে একটা ঘটনা যাতে গত শুক্রবারের সামরিক অভ্যুত্থানের মুখপাত্র মেজর ডালিম জড়িত ছিলেন। এক বিয়ের অভ্যর্থনা মজলিশে মুক্তিবাহিনীর এই বীর যােদ্ধার পত্নীকে ঢাকা নগর আওয়ামী লীগের প্রধান ও মুজিবের বিশ্বস্ত প্রিয়পাত্র গাজী গােলাম মােস্তফার ছেলে একদল গুণ্ডা এনে সমবেত মেহমানদের সামনে ডালিম দম্পতিকে বল পূর্বক উঠিয়ে মােস্তফার বাড়িতে নিয়ে যায়। খবর পেয়ে অবিলম্বে তিনটি লরী বােঝাই যুবক সিপাহী মােস্তফার বাড়ির উদ্দেশ্যে ধাওয়া করে। গােলমাল আশংকা করে মােস্তাফা মেজর ডালিম ও তার পত্নীকে নিয়ে মুজিবের বাসভবনে উপস্থিত হলাে। অল্পক্ষণের মধ্যেই দুইপক্ষ মুখােমুখি হলে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। ডালিম দম্পতিকে মুক্তি দিলেও মুজিব তরুণ অফিসারদের বিশৃংখলার জন্য তীব্র ভৎর্সনা করেন। এখানে শেষ নয়, কয়েকমাস পর মুজিব নয় জন অফিসারকে বরখাস্ত করেন এবং প্রশংসনীয় সার্ভিস রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও মেজর ডালিমকে ২৮ বছর বয়সে অবসর করিয়ে দেন। এই ভূতপূর্ব মেজরই গত শুক্রবার ভােরে মুজিবের স্বৈরতন্ত্রের অবসানের খবর ঘােষণা করেন।

১.২  বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সানডে টেলিগ্রাফ, লন্ডন থেকে এক বিশেষ রিপাের্ট প্রকাশিত হয়। সে রিপাের্টে বলা হয় যে সমস্যার মােকাবেলা না করে মুজিব গুণ্ডা বদমাইস নিয়ে ৫ হাজার লােকের রক্ষী বাহিনী খাড়া করেছিলেন যাতে সেনাবাহিনী তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সাহস না। পায়। উক্ত রিপাের্টে আরাে বলা হয় যে, মুজিবের এ সব ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের একজন হলাে গাজী গােলাম মােস্তফা, যিনি বাংলাদেশে বড় চোর বলে কুখ্যাত। মুজিবের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে তিনি আইনের উর্ধ্বে ছিলেন। প্রকাশিত রিপাের্টে আরাে বলা হয়, বিগত চার বছরে শেখ মুজিবের আপন ভাই শেখ আবু নাসের যতবার ঢাকা থেকে স্বীয় আদি ব্যবসা কেন্দ্র খুলনায় গিয়েছেন তার চেয়ে বেশি বার লন্ডনে এসেছেন। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সম্পাদক জিল্লুর রহমান লন্ডনে বেড়াতে আসেন। ফেরার সময় তিনি ২৩টি বড় বড় বাক্স বােঝাই করে সওদা নিয়ে গেছেন। বিজ্ঞ আন্তর্জাতিক রিপাের্টারগণ ব্যক্তিগত পর্যায়ে শেখ মুজিবের পাশে কে কি করেছেন তার বিশদ বিবরণ ছাপিয়ে মুজিব হত্যাকে জাস্টিফাই করতে চেয়েছেন ব্যক্তিগত আক্রোশ রূপে।

১.৩ এ প্রসংগে এ, এল খতিব-এর লেখা হু কিন্তু মুজিব বইতে বিস্তারিত আলােকপাত করা হয়েছে। যেমন, কলকাতা হতে প্রকাশিত সানডে পত্রিকায় ডালিম ও তার ফেয়ার লেডি’ তাসমিন- এর ছবি ছাপিয়ে একটি চমকপ্রদ গল্প ফাদা হয়। গল্পে বলা হয়েছে ডালিমের স্ত্রী তাসমিন বিবাহ উত্তর সম্বর্ধনায় গাজী গােলাম মােস্তফার ছেলে কর্তৃক উত্যক্ত হয়। এর বিরুদ্ধে ডালিম শেখ মুজিবের নিকট বিচার প্রার্থনা করলে বিচার তাে শেখ মুজিব করেননি বরং ডালিমকে তিরস্কৃত করেন। ফলে প্রতিবেদনের ভাষায়, “And Major Dalim come out with a vow to revenge. A vow that was Serupulously observed (emphasis added). রিপাের্টটি কিছুটা ভুল তথ্যের উপর দাঁড়ানাে। ডালিমের বিয়ে হয় ১৯৭১ ‘ সনে। স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্যে। ঘটনা ডালিমের বােনের বিয়েতে গাজী গােলাম মােস্তফার ছেলে তাকে উত্যক্ত করলে ডালিম উক্ত ছেলেকে চড় মারে। তখন ডালিমকে গাজী গােলাম মােস্তফার অনুগত সমর্থকগণ ঘেরাও করে রাখে। গাজী এ কথা জানতে পেরে এবং পরিস্থিতি অনুধাবন করে ডালিম ও তার স্ত্রীকে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে নিয়ে আসেন। বঙ্গবন্ধুর মধ্যস্থতায়। বিরােধের নিষ্পত্তি হয় এবং গাজী এবং ডালিম পরস্পর হাত মিলায় এবং এক সংগে মিষ্টি খেয়ে প্রায় মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধুর বাসা হতে বিদায় নেয়। কিন্তু ঘটনার এখানেই শেষ নয়। মধ্যরাতে ডালিম সেনানিবাস থেকে এক ট্রাক সৈন্য এনে গাজীর নয়া পল্টনস্থ বাড়ি তছনছ করে এবং কতিপয় আর্মি অফিসার এই বলে হুমকি প্রদান করে যে, ডালিমের কিছু হলে শহরে ভায়ােলেন্স সংঘটিত হবে। সেনাবাহিনীর অফিসারদের এ ধরনের আচরণের বিষয়ে স্বাভাবিকভাবে জি এইচ কিউ তদন্ত চালায়। তদন্তে যে সমস্ত অফিসার গাজীর বাড়ি আক্রমণে সংশ্লিষ্ট ছিলেন এবং আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সুপারিশ করা হয়। সেনাবাহিনীতে শৃংখলা ভঙ্গ গুরুতর অপরাধ বলে বিবেচিত হয়। শেখ মুজিবের কিছু করার ছিল না। কেননা- It is the decision of the Army GHO এবং আর্মি হেডকোয়ার্টারের সিদ্ধান্ত— “The officers who had taken law into their own hands could not be allowed to go unpanished.” তারপরও বঙ্গবন্ধু ডালিমের ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপারে সাহায্য করেন। ডালিম বেগম মুজিবকে মা বলে সম্বােধন করত এবং প্রায়শই বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাতায়াত করত। ডালিম, ডালিমের স্ত্রী এবং স্ত্রীর মা হেনা ভাবী ঘন ঘন বেগম মুজিব ও শেখ হাসিনার নিকট যেত। যাহােক এখানে প্রশ্ন এসে দাঁড়ায় গাজী গােলাম মােস্তফা ১৫ই আগস্টে নিহত হননি পরবর্তীতে হয়েছিলেন বন্দি। ডালিম তাকে হত্যা করেনি কেন? ব্যক্তিগত আক্রোশে মুজিবকে নয় গাজী গােলাম মােস্তফাকে হত্যা করাই ছিল ডালিমের পক্ষে যুক্তিযুক্ত।

১.৪  ব্যক্তিগত আক্রোশে শেখ মুজিব নিহত হয়েছেন এ কথাটি প্রমাণ করার জন্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সাংবাদিকগণ ডালিম, ডালিমের স্ত্রী, গাজী গােলাম মােস্তফা, কামাল, নাসের প্রমুখের নামে গল্প ফেঁদেছেন নামীদামী সব সংবাদপত্রের পাতায়। এ সব গল্পের ভিত্তি কতটুকু তার বিচার ভবিষ্যৎ গবেষকগণ করবেন। তবে এ সব গল্পের বিশ্বাসযােগ্যতা প্রমাণের কোনো ত্রুটি সেদিন হয়নি। এ সব গল্পের উৎস সম্পর্কে একটি তথ্য প্রদান করা হয়েছে “কনফিডেনসিয়াল ডায়েরিতে। উক্ত বই হতে এখানে কিছু উদ্ধৃত করা প্রয়ােজন— “এনায়েতুল্লা খান আমাকে বললেন, বাজারে সবাই বলছে যে, মেজর ডালিমের সঙ্গে শেখ সাহেবের ঝগড়া ছিল এবং ঐ কারণবশত সে শেখ মুজিবকে খুন করেছে। খবরটি ভুল। দুনিয়ার সংবাদপত্রের কাছে এই খবরটি এবং পরবর্তীকালে আর একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ খবরের রং ফলিয়ে বলা হয়েছিল যে মেজর ডালিম ছিলেন হত্যাকারীদের নেতা। এই খবরটি প্রচার করেছিলেন বি. বি. সি এবং রয়টার সংবাদ সরবরাহ প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশের সংবাদদাতা আতিকুল আলম। ২০শে আগস্ট প্রায় দুই ডজন বিদেশী সাংবাদিক ঢাকাতেই একটি বিশেষ প্লেনে করে ঢুকেছিলেন। কোনাে কারণবশত এই সাংবাদিকদের হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আটকে রাখা হয়। কিন্তু আতিকুল আলম গিয়ে এদের সঙ্গে দেখা করেন এবং সবাইকে বলেন যে, শেখ মুজিবুর রহমানকে খুন করার প্রধান কারণ কোনাে রাজনৈতিক নয়, ব্যক্তিগত। আর এই ব্যক্তিগত কারণটি হলাে শেখ মুজিবুর রহমান এবং মেজর ডালিমের ঝগড়া। কি উদ্দেশ্যে আতিকুল আলম এই মিথ্যা খবরটি প্রচার করেছিলেন তার সঠিক কারণ জানা যায়নি। আতিকুল আলম মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান রেডিওতে কাজ করতেন এবং আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের বিরােধী কাজ করতেন। যুদ্ধের পর বেশ কিছুদিন তাকে জেলখানায় আটক রাখা হয়। পরে শেখ মুজিবুর রহমানের আদেশে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।”

২.  আবার অনেকে বলেন দুর্নীতির জন্য শেখ মুজিবকে নিহত হতে হয়েছে। পৃথিবীর বিশেষ বিশেষ সংবাদ পত্রগুলােতে রং মাখিয়ে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, লুটপাট ও কালােবাজারের কাহিনী ফলাও করে ছাপানাে হতে থাকে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এই সমস্ত সংবাদপত্রগুলাে পুঁজিবাদী দেশ থেকে প্রকাশিত। তাদের ঐ সব প্রকাশিত রিপাের্ট দুই একটি উদ্ধৃত করা প্রয়ােজন

২.১ এ ব্যাপারে কারাের সন্দেহ নেই যে দুর্ভিক্ষ সামলাবার জন্য বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ সাহায্যের প্রয়ােজন। কিন্তু সাহায্যকারী দেশগুলাের ধারণা এই যে বন্যার অজুহাতে বাংলাদেশ সরকার অধিকতর খয়রাত আদায় করে নিজেদের দুর্নীতি খােরাক যােগাতে চাচ্ছে। নিজের সাহায্যের জন্য নিজেও সাহায্য কর—এ কথা বাংলাদেশে অর্থহীন। কেননা যত সাহায্য এসেছে তা আওয়ামী লীগ নেতাদের ব্যক্তিগত পকেটে গিয়েছে। মিঃ টনি হেগেন যিনি বাংলাদেশের জাতিসংঘের দেয়া সাহায্যের কাজে ছিলেন প্রকাশ করেছিলেন যে যাবতীয় খয়রাতি শিশুখাদ্য ও কম্বলের অতি অল্পই ঠিক জায়গায় পৌঁছেছে। বাদবাকী কালাে বাজারে বিক্রি হয়েছে অথবা পাচার হয়ে ভারত চলে গেছে। সে অবস্থার আজও পরিবর্তন হয়নি। ঢাকার সংবাদ পত্রে ঘােষণা করা হলাে যে, বন্যা পীড়িতদের জন্য এক উড়ােজাহাজ ভর্তি গুড়াে দুধ বিমান।

বন্দরে আসছে ঠিক তার পরদিনই ঢাকার হােটেল ম্যানেজারেরা এগুলাে কিনতে বাজারে তাদের লােক পাঠিয়ে দিলেন। বস্তুত এই ভাবেই বাংলাদেশে বন্যার্তদের জন্য দেয়া বিদেশী সাহায্য বিতরণ করা হয়ে থাকে। যে সকল শিয়ালকে হাঁস পাহারা দিতে দিয়েছেন; অর্থাৎ যে সরকার কুখ্যাত জোচ্চোর (দেশে ও বিদেশে) গাজী গােলাম মােস্তাফাকে জাতীয় রেডক্রসের সভাপতি নিযুক্ত করেছেন, সে সরকার সম্পর্কে কোনাে কিছুতেই বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। মােস্তফা ও পদ পেয়েছেন যেহেতু তিনি ঢাকা আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। এই গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকায় তার অনেক বেশি মওকা মিলেছে। তিনি শুধু গুড়ােদুধই কালাে বাজারে বিক্রি করেননি, অনেক ওষুধপত্রও আত্মসাত করেছেন। বাংলাদেশের রেডক্রস সভাপতি এখন ৩৭টি ওষুধের দোকানের মালিক।১০

২.২  আজ দেশের সচেতন নাগরিক মাত্রই বুঝতে পারবেন যে ঐগুলাে ঐ সময়ের যথার্থ রিপাের্ট না নির্লজ্জ মিথ্যা কাহিনী। ১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্টের পর গাজী গােলাম মােস্তফাকে গ্রেফতার করে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযােগ আনা হয়—যা কোর্টে মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়। শুধু তাই নয় ৩৭টি ওষুধের দোকানের মালিক নাকি। গাজী গােলাম মােস্তফা। তার মালিকানা আছে কোথায়? তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে গাজীর এমন কোনই সম্পদ ছিল না।

২.৩ অন্য একটি রিপাের্টে বলা হয়েছেদেশের সম্পদ বিদেশে চলে যাচ্ছে। তা সম্ভব হচ্ছে সরকারের অভ্যন্তরে ব্যাপক দুর্নীতির জন্য। বাংলাদেশের ‘জর্জ ওয়াশিংটন’ প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান নিজে হয়ত কোনদিনই ঘুষ গ্রহণ করেন নি। কিন্তু সর্বত্র। গুজব ছড়িয়ে রয়েছে যে, প্রধান মন্ত্রীর স্ত্রী ঘুষ খান। সরকারি কর্মকর্তারা যে ঘুষ খান তাতে কোন সন্দেহ নাই। তবে তারা যদি ঘুষ না খেতেন তাহলে হয়ত চোরাচালান সম্ভব হত না। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে যাই প্রচার করা হােক না তার মূল লক্ষ্য ছিল প্রকৃত ঘটনা এবং ষড়যন্ত্রকারীদের কারসাজিগুলাে যেন সহজে বেরিয়ে না আসতে পারে। বলাবাহুল্য সার্বিকভাবে তাদের এই উদ্দেশ্য সাধনে তারা সক্ষম হয়েছিল। কোন সত্যকে হাজার মিথ্যার প্রলেপ দিয়েও যেমন আড়াল করা যায় না। সত্য। আজ হােক কাল হােক তা যেমন বেরিয়ে আসবেই, মুজিব হত্যার প্রকৃত ঘটনা ও লক্ষ্য ধীরে হলেও প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে।

৩. মুজিব হত্যা সম্পর্কে ওয়াশিংটন পােস্ট লিখছে, “The young officers were motivated more personal grivences with Mujib than by ideological and political differences”১২ এখন দেখা যাক এই আদর্শিক ও রাজনৈতিক পার্থক্যগুলাে কি?

৪. ১৯৭৯ সনের ৪ঠা আগস্ট, ৪’ Days’ পত্রিকায় ‘দি ম্যান হু কিল্ড মুজিব’, শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। উক্ত পত্রিকায় এক সাক্ষাতকারে মেজর রশীদ বলেছেনঃ তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করা।১৩

৫. বঙ্গবন্ধু হত্যার পরবর্তী পাশ্চাত্য সংবাদ জগতে অত্যন্ত কৌশলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকে কতিপয় সেনা-অফিসারদের কারসাজী হিসেবে উপস্থাপন করার অপপ্রয়াস চালালেও সম্প্রতি আত্মস্বীকৃত খুনী চক্র বঙ্গবন্ধু হত্যা সম্পর্কে। সকল গালগল্প ও ব্যক্তি আক্রোশের কথা দ্ব্যর্থহীনভাবে অস্বীকার । করেছে। খুনী রশীদ দাবী করেছে তাদের হত্যা পরিকল্পনা ছিল। রাজনৈতিক।১৮ বঙ্গবন্ধু হত্যার এই রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে সমাজ প্রগতির ধারা থেকে সম্পূর্ণরূপে প্রতিক্রিয়াশীল পুঁজিবাদী ধারায় নিয়ে যাওয়া।

 

সূত্র : ফ্যাক্টস্- এন্ড ডকুমেন্টস্–বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড – অধ্যাপক আবু সাইয়িদ