You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.09 | জয় বাংলা ৯ জুন ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা - সংগ্রামের নোটবুক

জয় বাংলা ৯ জুন ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা

মূল পত্রিকা পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

জয় বাংলা
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপত্র
মুজিবনগরঃ প্রথম বর্ষ, ৫ম সংখ্যাঃ। বুধবার, ২৫শে জ্যৈষ্ঠ, ১৩৭৮, ৯ই জুন ১৯৭১
বাস্তু ত্যাগীরা তাদের সম্পত্তি ফেরত পাবেই
বিগত সপ্তাহে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন যার জন্য তারা সমগ্র জাতির অভিনন্দন দাবি করতে পারেন।
সিদ্ধান্তটা হলো বাস্তু ত্যাগীদের নিজ নিজ সম্পত্তিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার বিষয়ে। স্বাধীনতার জন্য মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত বাঙালি জাতির কাছে মার খেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের নব্য উপনিবেশবাদীরা আজ নানা ছলাকলার আশ্রয় নিচ্ছে। বাংলাদেশের ওপর নিজেদের কায়েমি স্বার্থ অক্ষুণ্ন রাখার জন্য তারা পরিকল্পিত উপায়ে চেষ্টা করছে বাংলাদেশের সংখ্যা গুরুত্ব বিনষ্ট করার। সেজন্য তারা খুন করেছে কয়েক লাখ লোককে। তারা ভেবেছিল তাদের এ জঘন্য গণহত্যার বিষয় বিশ্ববাসী জানতেই পারবে না। কিন্তু ভারতীয় বেতার ও পত্র-পত্রিকা এবং বিশ্বের বিবেকবান মানুষের মাধ্যমে তা জানাজানি হয়ে গেল সারা দুনিয়ায়। তাছাড়া একজন একজন করে কোটি দু-একের মত লোক হত্যা করা সহজও নয়, সম্ভবও নয়। অথচ, অন্ততঃ দুই কোটির মতো লোক মারতে না পারলে পাকিস্তানে বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু তো নষ্ট করা সম্ভব নয়। তাই তারা এখন ভিন্ন পথ ধরেছে তারা সাধারণভাবে সমগ্র হিন্দু জনসংখ্যা এবং আওয়ামী লীগের কর্মী ও নেতৃত্ব ব্যক্তিদের বাংলাদেশ থেকে বিতাড়নের কর্মসূচি নিয়েছে। সব জায়গায় সৈন্যবাহিনীর যাওয়া আসা সম্ভব নয় বিধায় তারা কাজটা করছে অতি সূক্ষ্ম ভাবে। তারা কনভেনশন জামায়াতের দালালদের ডেকে নিয়ে তাদের বক্তব্য বলে দিচ্ছে। তারপর তারা স্থানীয় গুন্ডা-বদমাশ, চোর, ডাকাতদের সহায়তায় কাজটা সুরাহা করছে। এ চোর, গুন্ডা, বদমাশের দল হিন্দু সম্প্রদায় ও আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের বাড়িতে ডাকাতি করছে লুটপাট করছে। তাতেও বাড়িঘর না ছাড়লে বাড়িঘরে আগুন দিয়ে তাদেরকে বাধ্য করছে সীমান্ত পাড়ে চলে যেতে। অতঃপর সামরিক বাহিনীর সহায়তায় কনভেনশন জামায়াতের গুন্ডা-বদমাশ শ্রোতাদের পরিত্যক্ত বাড়ি ঘর জায়গা জমি ও দোকানপাট নিজেদের দখলে নিয়ে যাচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে বাস্তুত্যাগী দের পরিত্যক্ত বিশ-ত্রিশ হাজার টাকার সম্পত্তি ও সামরিক বাহিনীর দালালরা একশো-দুশো টাকায় নিলামে কিনে নিচ্ছে।
কিন্তু এসব নরপিশাচ গুন্ডা-বদমাশ হয়তো জানে না যে পশ্চিমা সামরিক বাহিনী বেশিদিন তাদের রক্ষা করতে পারবে না। মরণজয়ী বাঙালি মুক্তিবাহিনীর হাতে পরাভূত হয়ে তাদেরকে বাংলাদেশের পবিত্র ভূমি ত্যাগ করতেই হবে।
পাইকারিভাবে বাংলাদেশ থেকে অমুসলমানদের বিতাড়নের অন্য গূড় উদ্দেশ্যও রয়েছে। বাংলাদেশ ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার কবর হয়েছে অনেক আগে। বাঙ্গালীরা এ ক্যান্সার রোগটা আর পুনরুজ্জীবিত করতে প্রস্তুত নয়। কারণ বাঙালিরা বিগত ২৪ বছরে দেখেছে এবং হারে হারে অনুভব করেছে যে দ্বিজাতি তত্ত্বের মাধ্যমে পাকিস্তানের অর্জন করে ইসলাম ও সংহতির নামে পশ্চিমারা শুধুমাত্র অমুসলমানদেরই শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট করেনি, বাঙালি মুসলমানদেরও সমভাবে করেছে। ওদের দ্বিজাতিতত্ত্ব, ওদের ইসলাম ও সংহতি আসলে নিজেদের শাসন ও শোষণের জাতাকল মজবুত রাখার জন্যই। সুতরাং বাংলাদেশের ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার পুনরুজ্জীবন সম্ভব নয় বলেই পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিবাদী শোষক ও শোষিত ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার ‘বিভেদের দ্বারা শাসন কর’ নীতি কার্যকারী করতে চায়। তারা জানে পাইকারিভাবে বাংলাদেশ থেকে ও মুসলমানদের তাড়িয়ে দিতে পারলে তাতে দ্বিবিধ ফল ফলবে। প্রথমতঃ এর ফলে ভারতের সাথে সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটবে। যার দরুন আন্তর্জাতিক রাজনীতির দাবা খেলায় বাংলাদেশের মূল সমস্যাটি ধামাচাপা পড়ে যাবে। দ্বিতীয়তঃ লাখো লাখো মুসলমানের বাস্তু ত্যাগের ফলে ভারতের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করা যাবে। এবং এতদুদ্দেশ্যে বাস্তুত্যাগীদের ভীড়ের মধ্যে তারা কিছু কিছু ট্রেনিংপ্রাপ্ত লোকও পাঠাচ্ছে। আমাদের জানামতে কলকাতা নিযুক্ত সাবেক ডেপুটি হাইকমিশনার মেহেদী মাসুদ এর পরিচালনায় তারা বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির অপচেষ্টা করছে। তাদের আশা, এ পরিকল্পনা মোতাবেক ভারতে একটা দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধানোর গেলে সেখান থেকে লাখো লাখো মুসলমান হিজরত করে বাংলাদেশে চলে আসবে তারপর এদেরকে মিরপুর, মোহাম্মদপুর এর ন্যায় বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে চিরস্থায়ী বসতি গড়ে দেওয়া হবে। এরা বংশানুক্রমে পাঞ্জাবীদের সমর্থনে থাকবে। আর ইয়াহিয়ার সর্বশেষ ধাপ্পাবাজি ও কতিপয় বিদেশি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সমাধানের (political settlement)ঔষধ কার্যকরী হলে এদের ভোটগুলো পশ্চিমা পুঁজিপতিদের স্থানীয় দালালদেরই পক্ষে যাবে সবসময়। এভাবে দশ বারটা আসন হাত করতে পারলেই ইয়াহিয়ার কল্পিত পাকিস্তান পার্লামেন্টে বাঙালিদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করা যাবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঔপনিবেশিক শাসকরা অনুরূপ ধরণের নানা পরিকল্পনা অতীতে করেছে। ইয়াহিয়া সাহেব ও তাই চেষ্টা করে দেখছেন। কিন্তু বাস্তবের রূঢ় আঘাতে ইয়াহিয়া খান সাহেব কয়েকদিন পরেই দেখতে পাবেন তার পরিকল্পনার পরি উড়ে গেছে, শুধু পড়ে আছে ‘কল্পনা’।
সে যাই হোক, ইয়াহিয়া খানরা তাদের পরিকল্পনার প্রথম অংশটুকু বর্তমানে মরিয়া হয়ে বাস্তবায়নের চেষ্টা করে চলেছেন। ফলে লাখো লাখো হিন্দু-মুসলমান আজ তাদের বাপ-দাদাদের ভিটেমাটি ছেড়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে।
এমতাবস্থায়, বাংলাদেশ সরকারের আশ্বাসবাণী অত্যন্ত সময়োচিত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথেই বলেছেন যে হানাদারদের সমূলে উৎখাতের পর বাংলাদেশ সরকার বাস্তুত্যাগীদের নিজ নিজ ভিটেমাটিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন এবং তাদের নিজ নিজ সম্পত্তিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবেন। বাংলাদেশ সরকার এ প্রসঙ্গে কনভেনশন লীগ ও জামায়াতের গুন্ডা বদমাইশদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন যে তাদের বিনা ক্ষতিপূরণেরই কেবল সম্পত্তি ছেড়ে দিতে হবে না, উপযুক্ত শাস্তির জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে।
আমরা জানি বাস্তুত্যাগীদের অনেকেই তাদের সম্পত্তির দলিল পত্র নিয়ে যেতে পারেননি। কারো দলিলপত্র পুড়ে গেছে, কারো দলিলপত্র লুটতরাজ হয়ে গেছে আবার কারো দলিলপত্র পথে হারিয়ে গেছে। এতদ্বসত্ত্বেও তাদের নিজ নিজ সম্পত্তি ফিরে পেতে কোন অসুবিধা হবেনা। বাংলাদেশ সরকার তা হতে দেবে না। প্রয়োজনবোধে প্রতিটি ক্ষেত্রে উপযুক্ত তথ্য অনুসন্ধান চালিয়ে প্রতিটি বাস্তুত্যাগীকে জায়গা- জমি ও দোকানপাট ফিরিয়ে দেওয়া হবেই হবে। এতে যেন কারো মনে সামান্যতম সংশয় ও না থাকে।
উপসংহার হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে প্রতিটি বাঙালির প্রতি আমাদের আবেদন, আপনারা কোনক্রমেই ইয়াহিয়া খানের পাতা ফাঁদে পা দেওয়ার মতো আত্মঘাতী কাজেই করবেন না। ওদের সাম্প্রদায়িকতার ফাঁদে পা দিলে আমাদের মুক্তির সংগ্রাম ব্যাহত হবে। তাতে আপনি আমি সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবো। তখন তাদের ঘরবাড়ি ফেরত পাওয়ার কোন সম্ভাবনা তো থাকবেই না বরং সমগ্র বাঙালি জাতিকে আরো একশ বছর গোলামীর জিঞ্জির পড়ে থাকতে হবে।
রণাঙ্গনেঃ মুক্তিবাহিনী প্রচন্ড আক্রমণে আরও পাঁচ শতাধিক খানসেনা খতম
বাংলা মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে বেইমান পাকহানাদার বাহিনীর উপর অব্যাহত ভাবে আক্রমণ চালিয়ে আরো সাফল্য লাভ করেছে।
গত ২৮শে মার্চে কসবার সালদানদী এলাকায় মুক্তিবাহিনী চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালিয়ে ৩১তম বেলুচ রেজিমেন্টে মেজর দুররানি সহ ২৭ জন হানাদার সৈন্যকে খতম করে। এছাড়া ৩১ শে মার্চ বাংলাদেশের গজারিয়া, চাদহাট, রাজনগর এবং ফরিদপুরের বিভিন্ন এলাকায় স্বাধীনতাকামী সৈন্যদের হাতে আরো ৫৫ জন পাকফৌজ প্রাণ হারায়।
আমাদের মুক্তিবাহিনীর বগুড়া এলাকায় আক্রমণ আরো তীব্রতর করেছে। এখানে পাক ফৌজ মুক্তিবাহিনীর গেরিলা (গত ৬ই জুন রাজশাহী সেক্টরে মুক্তিবাহিনী এক প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে সাফল্যের সাথে হানাদার বাহিনীর একজন মেজর সহ ৫৯ জন সৈন্যকে বন্দী করতে সক্ষম হয়। এই আক্রমণে বেশকিছু অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিবাহিনীর হস্তগত ও হয়েছে।) আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়ে রণাঙ্গন থেকে পিঠটান দেয়। হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে তিনটি বেতার সেট ও ৬ টি স্টেন গান স্থান দখল করে নিয়েছে।
পশ্চিম বগুড়ায় মুক্তিবাহিনী পাকসেনাদের একটি গাড়ি দখল করে নেয় ও কয়েকজন থানাকে হতাহত করে। মুক্তি বাহিনীর একটি গেরিলা স্কোয়ার্ড সাফল্যের সাথে তিস্তা ও চিলাহাটি, ডোমার ও সানিয়াজান এবং কাকিনা ও তুসবাজারের মধ্যে মধ্যবর্তীকার তিনটি রেলওয়ে সেতু ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে সৈন্য চলাচলের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। রংপুরের ডিমলা ও বাউরিয়া এলাকায় মুক্তিবাহিনী পাকহানাদার বাহিনীর পদলেহী দালাল মুসলিম লীগের সাত জন পান্ডাকে হত্যা করেছে।
দিনাজপুরের চারজন সৈন্যসহ হানাদার বাহিনীর একজন মেজর জিপে করে অন্যত্র গমন করে পথিমধ্যে একজন মহিলাকে গুলি করে হত্যা করার জন্য নিজের আর্দালি কে নির্দেশ দেয়। আর্দালি এ আদেশ অমান্য করলে মেজর তাকে গুলি করে। ঘটনার এই ভয়াবহতা জীবের আরোহী সৈন্যরা লাফিয়ে পড়ে নাটকীয় ভাবে বেইমান মেজরকে মেশিনগানের গুলিতে হত্যা করে।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সাতক্ষীরার ভোরি নামক স্থানে মুক্তি বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে একজন ক্যাপ্টেন সহ ৫০ জন সৈন্য নিহত এবং একশত জন গুরুতর আহত হয়। এ সংঘর্ষ বাংলা বাহিনীর একজন তরুণ যোদ্ধা যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়েছেন।
এদিকে ঊর্ধ্বতন অফিসারের আদেশ অমান্য করার অভিযোগে পাক-সামরিক কর্তৃপক্ষ সৈন্য বাহিনীর একজন বেলুচি ক্যাপ্টেনকে গ্রেপ্তার করেছে বলে স্বাধীন বাংলা বেতারের এক খবরে প্রকাশ। একই অভিযোগে ইতিপূর্বে নয় জন সৈন্য কে পাক-সামরিক কর্তৃপক্ষ গ্রেপ্তার করে।
গত পয়লা ও দোসরা জুন বরিশাল এলাকায় মুক্তিফৌজের সঙ্গে প্রচণ্ড সংঘর্ষে দুই জন নিহত ও একজন আহত হয়। রাঙ্গামাটিতে স্বাধীনতাকামীদের হামলায় একজন পাকফৌজ খতম হয়। ফেনী মহাকুমার বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা প্রায় একশত হানাদার সৈন্যকে হত্যা করে। রংপুরের ভূরুঙ্গামারী এলাকায় এক অতর্কিত হামলা চালিয়ে মুক্তি বাহিনী সাত সৈন্যকে খতম করে।
গত ২৩ জুন মুক্তি বাহিনি ২৮ মাইল দূরে বড় বরবলদিং ও খান জাহানপুরে এক অতর্কিত হামলা চালিয়ে পাকফৌজকে পর্যদুস্ত করে ফেলে। মুক্তিবাহিনী এই হামলায় গাড়িতে সুসজ্জিত চারটি বেতার সেট দখল করেছে। রংপুর সেক্টরে বাংলা বাহিনীর কমান্ডো পশ্চিম পাক সৈন্য বাহিনীর দুটি গানবোট ধ্বংস করে দিয়েছে। মেহেরপুরের ইছাখালী মুক্তিবাহিনীর হাতে চার জন পাকসেনা খতম হয়েছে। সিরাজগঞ্জ এলাকায় মুক্তিবাহিনী একটি রেল সেতু ধ্বংস করে দিয়েছে। ফলে খানসেনা বহনকারী ঈশ্বরদি- সিরাজগঞ্জ ঘাটের মধ্যকার একমাত্র ট্রেন যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল।
যশোর রণাঙ্গনে খান সেনাদের একটি ক্যাম্পের উপর মুক্তিযোদ্ধারা মেশিনগান ও মর্টার দিয়ে আক্রমণ চালিয়ে বিশ জন পাকসেনাকে খতম করে এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নেয়।
কুমিল্লা সেক্টরে কলোনেল বাজার এলাকায় মুক্তিবাহিনী এক প্রচণ্ড হামলা চালিয়ে ২৫ জন বেঈমান সেনাকে খতম করে।
গোয়ালপাড়া ও গয়েশপুরে পাক ফৌজের ১৫ জন গণমুক্তিফৌজের হাতে নিহত হয়। এছাড়া দর্শনার ধোপাখালীতে মুক্তিবাহিনী ও পাকফৌজের মধ্যে ৫ ঘন্টা ব্যাপী এক প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। এই আক্রমণে খানসেনারা নাস্তানাবুদ হয়ে ওই স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।

বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের আকুল আবেদন
গত পহেলা জুন তিন সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদলের সদস্যরা দিল্লিতে ভারতীয় পার্লামেন্টের উভয় পরিষদের সদস্যদের এক যুক্ত সভায় বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের জন্য ভারত সরকারের প্রতি আকুল আবেদন জানান।
ভারতীয় পার্লামেন্টের লোকসভার স্পিকার মিঃ জি এস ধীলনের সভাপতিত্বে পার্লামেন্টের ঐতিহাসিক সেন্ট্রাল হলে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল যখন তাদের মাতৃভূমিতে পশ্চিম পাকিস্তান সেনা বাহিনীর বর্বরতার, নৃশংসতা, নারী ধর্ষণ ও গণহত্যার মর্মান্তিক কাহিনী বর্ণনা করে থাকেন তখন সভায় উপস্থিত অনেকের চোখ অশ্রু সজল হয়ে উঠতে দেখা যায়। বক্তৃতার একপর্যায়ে প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন কেঁদে ফেলেন।
সভার প্রারম্ভে লোকসভার স্পিকার ধীলন ভারতীয় পার্লামেন্ট সদস্যদের সাথে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের পরিচয় করিয়ে দেন।
সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে প্রতিনিধি দলের নেতা মিঃ ফনিভূষণ মজুমদার ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র স্বার্থে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের জন্য ভারত সরকারের প্রতি আবেদন জানান। তিনি বলেন ভারতের মতো আমরাও ধর্মনিরপেক্ষতা গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। তিনি বলেন আমরা বুঝতে পারি না স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে কেন ভারত গড়িমসি করছে। তিনি অভিমত প্রকাশ করেন যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া হলে তা ভারত ও বাংলাদেশ উভয়েরই স্বার্থানকুল হবে। তাছাড়া ভারত আমাদের স্বীকৃতি দিলে ভারতের অনেক বন্ধুরাষ্ট্র এ ব্যাপারে তাদের এ মহৎ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে।
মিঃ মজুমদার বলেন এ ব্যাপারে ভারত সরকার বোধহয় তথাকথিত পাকিস্তানের সঙ্গে সম্ভাব্য সংঘর্ষ ও আন্তর্জাতিক জটিলতার কথা ভাবছেন। কিন্তু খোদা না-খাস্তা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে যদি আমাদের পরাজয় ঘটে তবে তা ভারতের জন্য ডেকে আনবে অর্থনৈতিক সংকট। তাতে ভারতের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে।
সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে জাতীয় পরিষদ সদস্যা বেগম নুরজাহান বর্ষের তথাকথিত রাজনৈতিক সমাধানেরা বিষয় উল্লেখ করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন বাংলাদেশে সমস্যার কোনো রাজনৈতিক সমাধান যদি হতে হয় তবে তা আমাদের শর্তেই হতে হবে। তিনি বলেন বাংলাদেশের বুকে শত শত মাইলাই ঘটনার পর এ ব্যাপারে একটি মাত্র শর্তই হতে পারে এবং তাহলে বাংলাদেশ থেকে সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্য প্রত্যাহার এবং স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি। বেগম নূরজাহান মুর্শিদ বলেন আমরা যুক্তবাংলা বা বৃহত্তর বাংলায় বিশ্বাসী নই। আমরা চাই নিজেদের স্বাধীনতা নিয়ে সকলের সাথে বন্ধুত্ব রেখে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে।
সভার অপর বক্তা বাংলাদেশ পরিষদের সদস্য শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন তার আবেদনের বাংলাদেশের বিগত ২৩ বছরের শোষণ-বঞ্চনার করুন ইতিহাস বর্ণনা করেন। তিনি বলেন আমরা পাকিস্তানকে এক রাখার বহু চেষ্টা করেছি; কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিরা তা হতে দিলো না। তারাই পাকিস্তানকে হত্যা করেছে। আমরা সেই লাশ সসম্মানে দাহন করছি মাত্র।
বাংলাদেশ পর্লামেন্টারি প্রতিনিধিদলের সদস্যগণ ভারতের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। প্রধানমন্ত্রীর সাথে পৌনে এক ঘণ্টা স্থায়ী বৈঠকে তারা বাস্তুত্যাগী সমস্যা ও বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের বিষয়টি আলোচনা করেন।
লাখো শহীদের লাশের তলায় পাকিস্তানকে কবর দিয়েছে কারা- আমরা না তোমরা? – তাজউদ্দীন
হিসাব নিয়ে জানা গিয়েছে, পহেলা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চের মধ্যে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সহ অতিরিক্ত এক ডিভিশন সৈন্য বাংলাদেশে আমদানি করা হয়। ব্যাপারটা নিরাপদ করার জন্য ঢাকা বিমানবন্দরকে বিমান বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। সমগ্র বিমানবন্দর এলাকায় আর্টিলারি ও মেশিনগানের জাল বিস্তার করা হয়। যাত্রীদের আগমন নির্গমনের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা হয়। ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও হত্যাকাণ্ডের সংগটনে ট্রেনিংপ্রাপ্ত একটি এস-জি কমান্ডো বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ছেড়ে দেওয়া হয়। ২৫শে মার্চের পূর্ববর্তী দুইদিনে ঢাকা ও সৈয়দপুরে যেসব কুকান্ড ঘটে এরাই সেগুলো সংগঠন করেছিল। সামরিক হস্তক্ষেপের অজুহাত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে স্থানীয় ও স্থানীয়দের মধ্যে সংঘর্ষের সৃষ্টি মাধ্যমে একটা উত্তেজনাকর পরিবেশ খাড়া করাই ছিল এসবের উদ্দেশ্য।
প্রতারণার ভন্ডামীর এই স্ট্র্যাটেজি গোপন করার অংশ হিসেবেই শেখ মুজিবের সাথে তার আলোচনায় আপোষমূলক মনোভাব গ্রহণ করেছিলেন। ১৬ই মার্চ আলোচনা শুরু হলে ইয়াহিয়া তৎপূর্বে যা ঘটেছে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন এবং সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আন্তরিক আগ্রহ প্রকাশ করেন। শেখ মুজিবের সাথে আলোচনার এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে ইয়াহিয়ার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল আওয়ামী লীগের ক্ষমতা হস্তান্তরের চার দফা শর্ত প্রতি সামরিক জান্তার মনোভাবটি কি। জবাবে ইয়াহিয়া জানা যায় এ ব্যাপারে তাদের তেমন কোনো আপত্তি নেই। তিনি আশা করেন যে চার দফা শর্ত পূরণ ভিত্তিতে উভয়পক্ষের উপদেষ্টাগণ একটা অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র প্রণয়নে সক্ষম হবেন।
আলোচনাকালে যেসব মৌলিক প্রশ্নে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয় সেগুলি হল:
(১) মাশাল্লাহ বা সামরিক আইন প্রত্যাহার করে প্রেসিডেন্টের একটি ঘোষণার মাধ্যমে একটা বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর ।
(২) প্রদেশগুলোতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সমূহের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর।
(৩) ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট থাকবেন এবং কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করবেন।
(৪) জাতীয় পরিষদের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সদস্যগণ পৃথক পৃথকভাবে বৈঠকে মিলিত হবেন। তারপর শাসনতন্ত্র চূড়ান্তকরণের উদ্দেশ্যে এক যুক্ত অধিবেশনে মিলিত হবেন।
আজ ইয়াহিয়া ভুট্টো জাতীয় পরিষদে পৃথক পৃথক অধিবেশনের প্রস্তাবের বিকৃত ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। অথচ ইয়াহিয়া নিজেই ভুট্টোর মনোরঞ্জনের জন্য এ প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এ প্রস্তাবে সুবিধা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইয়াহিয়া সেদিন নিজেই বলেছিলেন যে, ছয় দফা হলো বাংলাদেশ এবং কেন্দ্রের মধ্যকার সম্পর্ক নির্ণয় এর এক নির্ভরযোগ্য নীল নকশা। পক্ষান্তরে এটার প্রয়োগ পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সৃষ্টি করবেন নানারূপ অসুবিধা। এমতাবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তানী এম, এন এদের পৃথকভাবে বসে ছয় দফার ভিত্তিতে রচিত শাসনতন্ত্র এবং এক ইউনিট ব্যবস্থা বিলোপ এর আলোকে একটা নতুন ধরনের ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুযোগ অবশ্যই দিতে হবে।
শেখ মুজিব এবং ইয়াহিয়ার মধ্যকার এই নীতিগত মতৈক্যের পর একটি মাত্র প্রশ্ন থেকে যায় এবং অন্তর্বর্তী পর্যায়ে কেন্দ্র ও বাংলাদেশের মধ্যে ক্ষমতা বন্টন। এক্ষেত্রেও উভয়পক্ষ এই মর্মে একমত হয়েছিলেন যে, ছয় দফার ভিত্তিতে অদূর ভবিষ্যতে যে শাসনতন্ত্র রচনার হতে যাচ্ছে মোটামুটি তার আলোকে কেন্দ্র ও বাংলাদেশের মধ্যে ক্ষমতা বন্টন হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন মীমাংসার এই অংশটি সম্পর্কে একটা পরিকল্পনা তৈরির উদ্দেশ্য প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা জনাব এম এম আহমেদকে বিমানে করে ঢাকায় আনা হয়। আওয়ামী লীগ উপদেষ্টাদের সাথে আলাপ আলোচনায় তিনি স্পষ্ট ভাবে একথা বলেন যে, রাজনৈতিক মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ছয় দফা ও কার্যকরী করার প্রশ্নে দুর্লঙ্ঘ্য কোন সমস্যা দেখা দেবে না। এমনকি অন্তর্বর্তী পর্যায়েও না।
আওয়ামী লীগের খসড়ার উপর তিনি যে তিনটি সংশোধনী পেশ করেছিলেন তাতে একথাই প্রমাণিত হয়েছিল যে, সরকার এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে তখন যে ব্যবধান টুকু ছিল তা নীতিগত নয় বরং কোথায় কোন শব্দ বসবে সে নিয়ে। ২৪শে মার্চের বৈঠকে ভাষার সামান্য রদবদলসহ সংশোধনীগুলো আওয়ামী লীগ গ্রহণ করে। অতঃপর অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র চূড়ান্তকরণের উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া ও মুজিবের উপদেষ্টাদের শেষ দফা বৈঠকে মিলিত হওয়ার পথে আর কোন বাধাই ছিল না।
এ প্রসঙ্গে একটা জিনিস পরিষ্কার করে বলতে হয়। কোন পর্যায়েই আলোচনা অচলাবস্থার সম্মুখীন হয়নি। অথবা ইয়াহিয়া বা তার উপদেষ্টারা আভাসে ইঙ্গিতেও এমন কোনো কথা বলেননি যে তাদের এমন একটা বক্তব্য আছে যা থেকে তারা নড়চড় করতে পারেন না।
গণহত্যাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ইয়াহিয়া ক্ষমতা হস্তান্তরে আইনগত ছত্রছায়ার প্রশ্নেও আজ জোচ্চুরির আশ্রয় নিয়েছেন। আলোচনায় তিনি এবং তাঁর দলবল একমত হয়েছিলেন যে ১৯৪৭ সালে ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের মাধ্যমে যেভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছিল তিনিও সেভাবে একটা ঘোষণার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। ক্ষমতা হস্তান্তরের আইনগত ছাত্র ছায়ার ব্যাপারে ভুট্টো পরবর্তীকালে যে ফ্যাকড়া তুলেছেন ইয়াহিয়া তাই অনুমোদন করেছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার ইয়াহিয়া মুজিবকে এ সম্পর্কে কিছু জানাননি। ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ভারতীয় পরিষদের একটা অধিবেশন বসার দরকার ইয়াহিয়া যদি আভাসে ইঙ্গিতে এ কথা বলতেন তাহলে আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই তাতে আপত্তি করত না। কেননা এমন একটা সামান্য ব্যাপার কে উপলক্ষ করে আলোচনা বানচাল হতে দেয়া যায় না’। তাছাড়া জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগুরু দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভয় করার কিছুই ছিল না। দেশের দুই অংশের জাতীয় পরিষদের সদস্যদের পৃথক পৃথক বৈঠকে যে প্রস্তাবে আওয়ামী লীগ সম্মতি দিয়েছিল তা শুধু ভুট্টোকে খুশি করার জন্যই করা হয়েছিল। এটা কোন সময়েই আওয়ামী লীগের মৌলিক নীতি ছিল না।(চলবে)
তবে কি তিনি লাখ ইঁদুর মেরে বিড়াল তপস্বী বনে গেলেন?
আজ দুই মাসেরও বেশী দিন হয়ে গেল পাক জঙ্গি বাহিনী বাংলাদেশে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছে। তাদের বর্বর হামলা থেকে বাংলাদেশের চিন্তাশীল ও বুদ্ধিজীবী সমাজ থেকে শুরু করে সাধারণ কৃষক শ্রমিক -নারী শিশু ও বৃদ্ধ কেউই রেহাই পায়নি। বর্বর পাক বাহিনী বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল কলেজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ, বাজার হাট কলকারখানা সবকিছুই ধ্বংস করেছে। বাংলাদেশি নিরস্ত্র ও শান্তিপ্রিয় মানুষের উপর স্থল ও বিমান বাহিনীর সাহায্যে তারা সর্বাত্মক হামলা চালিয়েছে। গ্রামের পর গ্রাম তারা পুড়িয়ে দিচ্ছে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ নিরীহ ও অসহায় মানুষকে তারা নির্বিচারে হত্যা করে চলেছে।
বাংলাদেশের ইতিহাস চমকানো হত্যাযজ্ঞের খবর যাতে বাইরে ছড়াতে না পারে পাকিস্তান সরকার ও জঙ্গী বাহিনী তার কোনো চেষ্টায় ত্রুটি রাখেনি। গত ২৫ শে মার্চ পাক হানাদার বাহিনীর শরবত হামলার সময় যেসব বিদেশি সাংবাদিক বাংলাদেশের ছিলেন তাদের কাগজপত্র ফিল্ম ক্যামেরা সব কিছু কেড়ে নিয়ে তাদের বের করে দেওয়া হয়। কিন্তু এসব ত্রুটিহীন সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেই সত্বেও পাক বাহিনীর বর্বরতা ও ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ খবর বহির্বিশ্বে পৌঁছে গেছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচারের ফলে নারী শিশু বৃদ্ধসহ ৩৫ লক্ষের মত শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। সারা দুনিয়ার সাংবাদিক, কূটনৈতিক মিশনের প্রতিনিধিগণ ও মানবদরদী সংস্থাসমূহের প্রতিনিধিবৃন্দ এইসব শরণার্থীদের কাছ থেকে পাকিস্তানের জল্লাদ বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের কাহিনী শুনেছেন এবং এদের মর্মান্তিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছেন। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রাক্তন বাহিনীর যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ও ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালিয়েছে পৃথিবীর মানুষের কাছে তা আজ আর অজানা নয়।
কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিপাগল মানুষ ইয়াহিয়া ও তার বর্বর বাহিনীর এই হত্যাযজ্ঞকে মেনে নেয়নি। হানাদারের বিরুদ্ধে আজ তারা মরণপণ করে রুখে দাঁড়িয়েছে। সারা বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদারের বিরুদ্ধে দূর্বার লড়াই চলেছে। বাঙালির প্রতিরোধেরমুখে একদিকে তারা বাংলাদেশে ব্যাপক গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে এবং অন্যদিকে তাদের ভেঙে পড়া অর্থনীতি ও বেকায়দায় পড়া সামরিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য ভিক্ষার ঝুলি হাতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধি পাঠাচ্ছে। এখানে শরম থাকতে পারে যে মাত্র কয়েকদিন আগেই ব্যাপক গণহত্যা নায়ক জল্লাদ ইয়াহিয়া খান এক বিবৃতিতে এ ঘোষণা করেছিল যে বাংলাদেশ খাদ্যশস্য ঔষধপত্র ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর কোন প্রয়োজন নেই। ইয়াহিয়ার এই ঘোষণা অবশ্য হানাদার বাহিনীর চণ্ডনীতির দিক থেকে ঠিকই ছিল। কারণ জঙ্গী বাহিনীর রাজনীতির মূল কাজ যেখানে বাংলাদেশে ব্যাপক গণহত্যা ও বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে গুড়িয়া মিশমার করে গোটা বাঙালী জাতটাকে ধ্বংস করে সেখানে বাঙালিদের জন্য খাদ্য সামগ্রী ঔষধপত্র ব্যবহার্য সামগ্রী প্রয়োজন থাকে কি করে? কিন্তু ইয়াহিয়া বিবৃতির মাত্র কয়েক দিন পরেই পাকিস্তানের পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এম এম আহমদ ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে হাজির হলেন। বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে জঙ্গ লাগিয়ে পাকিস্তান যে দেউলিয়া হয়ে গেছে সে কথা জানিয়ে সাহায্যের জন্য বহু কান্নাকাটি করে এলো। এখানে সবার মনে একটি প্রশ্ন উঠতে পারে যে পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যেখানে বললেন -না, আমাদের কোনো সাহায্যের প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশের জন্য খাদ্য, শস্য ইত্যাদি ওই ধরনের কোনো সাহায্যের প্রয়োজন নেই, সেখানে তারই প্রধান উপদেষ্টা ও বিশেষ দোস্ত এমএম আহমেদ বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে হাজির হলেন কেন? তবে কি ইয়াহিয়া লক্ষ ইঁদুর মেরে বিড়াল তপস্বীর মত শেষ পর্বে সাধু হয়ে গেলেন?- না, তা নয়। এর প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাবে পাকিস্তান সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইরান ও তুরস্কের প্রভৃতি দেশগুলোর কাছে যেসব জিনিস চেয়েছে সেগুলোর আসল তাৎপর্য বিশ্লেষণ করলেই। পাকিস্তান সরকার অবশ্য দায় এড়ানোর জন্য জানিয়েছে যে অল্পস্বল্প খাদ্যশস্যের ও তাদের প্রয়োজন রয়েছে, তবে তাঁদের এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হল উপকূল অঞ্চলে ও বাংলাদেশের নদ নদী সমূহ চলাচল উপযোগী দ্রুতগামী নৌকা ও যানবাহনবাহী বজরা ইত্যাদি। একথা বুঝতে আজ আর অসুবিধা হয় না যে এতদিন পর পাকবাহিনীর এসব যানবাহনের প্রয়োজন হলো কি করে? বর্ষা সমাগত। বর্ষাকালে বাংলাদেশের প্রায় সকল এলাকায় স্বাভাবিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বর্ষাকালে মুক্তিবাহিনীর হাতে পাকহানাদারদের মার খাবার সমুহ সম্ভাবনা। কারণ বর্ষায় স্বাভাবিক সৈন্য চলাচল ও সামরিক সরবরাহ ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হবে এবং পরে বিমান বাহিনীও প্রায় অকেজো হয়ে উঠবে। বর্ষার এই সুযোগেই মুক্তিসেনারা গ্রামবাংলা থেকে হানাদার পাকবাহিনীকে ঝেঁটিয়ে দূর করতে পারবে। বর্ষার পাকবাহিনীকে অবশ্যম্ভাবী চরম বিপদের কথা চিন্তা করেই ইয়াহিয়া সরকারের কাছ থেকে এ ধরনের সাহায্য চেয়েছে। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণের জন্য তারা কোনো সাহায্য চায়নি। কারণ তারা বাংলাদেশের কৃষকদেরকে তাদেরকে ক্ষেত থেকে পাকা ধান কাটছে দিচ্ছে না। পাকা ধানের ক্ষেতে তারা আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে, ধানক্ষেত মারিয়ে দিচ্ছে। মাঠে কর্শনরত কৃষকদের নির্বিচারে গুলি করে মারছে। ঢাকা, ফরিদপুর, পাবনা, কুষ্টিয়া, যশোর, দিনাজপুর ও রংপুরে তারা বিমান থেকে ক্ষেতের উপর ফসল নষ্ট কারী রাসায়নিক বিষ ছিটিয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশের জনগণের অসহযোগিতার জন্য তারা এখনো কোথাও অসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করতে পারেনি। বাংলাদেশের সর্বত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনও অচল হয়ে আছে।
পাক সরকারের এই নারকীয় চক্রান্ত ও দুরভিসন্ধি প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি না করতে পেরে বিশ্বের কোন কোন রাষ্ট্র নাকি ইয়াহিয়া সরকারকে সাহায্যদানের কথা চিন্তা করছেন। কিন্তু পাকিস্তান সরকারকে যেকোনো ধরনের সাহায্য ও সহযোগিতা দেওয়ার আগে বাংলাদেশে হানাদার বাহিনী ও পাক সরকারের নারকীয় তৎপরতা সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলে আমরা মনে করি। কারণ বাংলাদেশের জনগণের নামে পাক সরকার যে সাহায্যে নিক না কেন তা ব্যবহার করা হবে বাংলাদেশের সম্পদ ধ্বংসে এবং মানুষ নিধনে পাক হানাদার বাহিনীর সাহায্যের কাছে। সমগ্র বাঙালী জাতটাকেই তারা যেখানে খতম করার জন্য এক প্রাগৈতিহাসিক বর্বরতায় মেতেছে সেখানে তাদের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ ও বাংলাদেশকে সাহায্যের কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। বাংলাদেশের মানুষ ও সম্পদ নষ্টের জন্য তারা বুলেট ও আগুন ছাড়া আর কোন কিছুই দিচ্ছে না। বাংলাদেশে তারা ব্যাপক গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। ইয়াহিয়ার পাঞ্জাবি চক্র ও তাদের সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের কোন সম্পর্ক নেই। গত ২৫শে মার্চের পর থেকে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের কোন সম্পর্ক নেই একথা আমরা আর একবার দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিতে চাই। বাংলাদেশের মাটি থেকে হানাদার প্রতিটি পশ্চিম পাকিস্তানীকে নিধন না করা পর্যন্ত আমাদের বিরাম নেই। আমাদের এ যুদ্ধ বাঙালি জাতির বাঁচা-মরার যুদ্ধ। অতএব এই অবস্থায় পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে যেকোনো সাহায্য ও সহযোগিতা অর্থ দাঁড়াবে বাংলাদেশের পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তাতে প্রত্যক্ষ ভাবে অংশগ্রহণ করা। আমরা বিশ্বের সকল দেশের শান্তিকামী জনগণের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি যে তারা যেন তাদের সরকারকে পাকিস্তানে জঙ্গি সরকারকে সাহায্য ও সহযোগিতা করা থেকে বিরত রাখেন।
পশ্চিমাদের আঁতে ঘা লাগছে কিভাবে –
(২)
গত সংখ্যার আলোচনা থেকে দেখা গেছে যে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী ইসলাম ও সংহতি নামে গালভরা চিৎকারে অভ্যস্ত হলেও আসলে ওদের দৃষ্টি হচ্ছে সব সময় বাংলাদেশের পকেটের দিকে। কি করে বাংলাদেশের পকেট মেরে নিজেদের সম্পদ বাড়াবে এটাই ছিল তাদের চিন্তা। তাই যেখানে নিজেরা ২ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে পারল সেখানে বাংলাদেশ নিজের আয়ের সম পরিমাণ অর্থও ব্যয় করতে পারল না। লাখো লাখো বাঙালিকে গুলির আঘাতে মেরে তাদের পাকিস্তান রাখবার প্রচেষ্টার মূল রহস্য ও এখানে। কারণ তারা জানে বাংলাদেশ আলাদা হয়ে গেলে খান সাহেবদেরই সমস্ত দেনা শোধ করতে হবে। তখন ঋণ করে ঘি খাওয়ার শখ মিটে যাবে।
এ প্রসঙ্গে আরেকটা বিষয় আলোচনা করা যেতে পারে। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের কলকারখানায় বলুন অন্য কিছুই বলুন সবকিছুর জন্যই প্রয়োজন হয় যন্ত্রপাতিও সাজ-সরঞ্জামের। আর ওগুলো আনতে হয় বিদেশ থেকে এবং সেজন্য প্রয়োজন হয় বিদেশী মুদ্রার। আভ্যন্তরীণ মুদ্রা একজনের হাতে যতই থাকুক বিদেশি মুদ্রা ছাড়া তা অকেজো। পশ্চিম পাকিস্তানিরা বিগত ২৩/২৪ বছর বাংলাদেশের ঘাড়ে বন্দুক রেখে বিদেশ থেকে দেদার ধারে সরঞ্জামের এনেছে এবং তা দিয়ে নিজেদের এলাকায় কলকারখানা গড়ে তুলেছে।
এ তো গেল বৈদেশিক বাণিজ্যের কথা, এবার আন্ত আঞ্চলিক তথা পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যকার বাণিজ্য আলোচনা করে যাক। এই বাণিজ্য চলে দুইভাবে। একটা চলে সরকারি খাতে মানে দুই অঞ্চলের সরকারের মধ্যে। শুধু এটারই একটা হিসাব থাকে। এছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন বেসরকারি পার্টির মাধ্যমে বাণিজ্য চলে তার কোন হিসাব কেউ দিতে পারবে না। যেমন আপনি করাচি থেকে যদি বছরে পাঁচশত টাকার মাল এনে থাকেন তার কোন হিসাব সহকারী খাতাপত্রে নাই। সুতরাং অর্থনীতিবিদদের মতে, সাবেক পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে বেসরকারি পর্যায়ে ব্যবসা-বাণিজ্য চলেছে তার পরিমাণ কমপক্ষে সরকারি পর্যায়ে বাণিজ্যের চার গুণ হবে। যদি তাই হয় তবে এবার দেখা যাক সরকারিখাতে আন্ত আঞ্চলিক বাণিজ্যের পরিমাণটা কত ছিল?
সাপের পাকিস্তান সরকারের প্রকাশিত পরিসংখ্যান বুলেটিনের তথ্যানুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের একাউন্টে ১৯৪৯-৫০ থেকে ১৯৬৮-৬৯ সাল পর্যন্ত সময়ে মোট ১৩৪০ কোটি ৯০ লাখ টাকার পণ্য বাংলাদেশে রপ্তানি হয়েছে। তাদের হিসাব করি সঠিক বলে ধরে নেওয়া হয় তাহলে বাংলাদেশে আলোচ্য সময়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মোট পণ্য রপ্তানি হয়েছে কমপক্ষে পাঁচ হাজার কোটি টাকার।
পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তান পারতপক্ষে বাংলাদেশ থেকে কিছু আমদানি করে নি। তাছাড়া তাদের কেনার মত কোন জিনিস উৎপাদনের ব্যবস্থা তাদের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশ করেওনি। কারণটা অতি সুস্পষ্ট। তাদের আগাগোড়াই লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে তাদের সংরক্ষিত বাজার হিসেবে ব্যবহার করা। তো দুপুরে তাদের যেসব জিনিসের দরকার সেগুলো তারা বিদেশ থেকে আমদানি করে প্রয়োজন মিটেয়েছে। সে যেন তাদের বিদেশি মুদ্রার কোনদিন অভাব হয়নি। অবাক হয়েছে শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে।
পশ্চিম পাকিস্তানিদের যেটা সবচেয়ে বড় ভয় তাহল বাংলাদেশের সংরক্ষিত ছাড়া হয়ে গেলে তাদের কারখানাগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। অথবা সেগুলোর মনোনয়ন করতে হবে। বাংলাদেশের বিরাট বাজার সংরক্ষিত থাকায় তারা তাদের নিজেদের খেয়ালখুশি মাফিক নিম্নমানের মাল তৈরি করে সেগুলো বাংলাদেশের বাজারে পাঠিয়েছে। আর বহির্বাণিজ্য বাংলাদেশ সরকারের কর্তৃত্বে না থাকায় বাঙালিরা নিজেদের পছন্দমত ও প্রয়োজনমতো মালামাল বিদেশ থেকে আনতে পারেনি। তাই বাধ্য হয়েই বাংলাদেশের মানুষকে পশ্চিম পাকিস্তানের নিম্নমানের বাল বেশি দরে ব্যবহার করতে হয়েছে। অপরদিকে নিম্নমানের দরুন পশ্চিম পাকিস্তানি মাল বিদেশে চালানো সম্ভব ছিল না। তাছাড়া সংরক্ষিত বাজার হাতে থাকলে পণ্যের মান উন্নয়নের চেষ্টা কেইবা করে।
সুতরাং বাংলাদেশের সংরক্ষিত বাজার হাত ছাড়া হয়ে গেলে খান সাহেবের নিজেদের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করতে হবে। বিদেশি মাল চালান দিতে হলে অন্যান্য বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে হলে পণ্যের মানোন্নয়ন অবশ্যই করতে হবে। অন্যথায় মান ও দামের প্রতিযোগিতায় তারা হেরে যাবে। বিদেশে তাদের মাল চলবে না। ফলে দেশের কলকারখানা বন্ধ করে দিতে হবে। অবশ্য এর একটা বিকল্প যে নেই তা নয়। তাহলে কল কারখানাগুলোর আধুনিকরণ এবং পণ্যের উৎপাদন ব্যয় হ্রাস। কিন্তু সে জন্য প্রয়োজন প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার। এতদিন না হয় বাংলাদেশের উদ্বৃত্ত থেকে নিজেদের প্রয়োজনে মিটিয়েছে বাংলাদেশকে বন্ধক রেখে ঋণ করে খেয়েছে। কিন্তু এখন?
এখন তো তা সম্ভব নয়। তদুপরি আধুনিকরণ তো আর বললেই হয় না। সে জন্য যথেষ্ট সময়ের দরকার। ওদিকে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করা সম্ভব নয়। কেননা তাদের শ্রমিকদের মজুরি দেওয়া হয়েছে তা আজ আর হ্রাস করা সম্ভব নয়। বরং তা আরো বাড়াতে হবে। ১৯৪৯-৫০ সাল থেকে বাংলাদেশে তাদের রপ্তানি ও শতকরা হার থেকেই বোঝা যাবে খান সাহেব রা নিজেদের উৎপন্ন পণ্য রপ্তানির ব্যাপারে বাংলাদেশের উপর কিভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। (চলবে)

একটি যুদ্ধঃ বহু ইতিহাস
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
পরের দিন সকালে কারফিউ প্রত্যাহারের সাথে সাথে প্রতিবেশীর হোন্ডায় চেপে ইসলাম ও সংহতির নামে ঢাকায় পাক ফৌজের ধ্বংসলীলা দেখতে বের হয়ে পড়লাম। প্রথমে গেলাম রাজার বাগ পুলিশ লাইনে। ওটা ছিল পূর্ব পাকিস্তান পুলিশের প্রাদেশিক সদর দপ্তর। ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে ইয়াহিয়া টিক্কা খানের যৌথ বাহিনীর দ্বারা বিনা নোটিশে আক্রান্ত হয়ে অমিত বিক্রমে লড়েছিল পুলিশের লোকেরা। বাঙালের বুদ্ধি আছে তার প্রমাণ দিয়েছিল সেই রাতে আমাদের পুলিশ। আক্রান্ত হওয়ার পর তারা হতভম্ব হয়নি। কিছুসংখ্যককে অস্ত্রাগার রক্ষার দায়িত্বে রেখে অন্যরা ছড়িয়ে পড়েছিল চতুর্পাশে। কেউ পজিশনে ছিল রাস্তার পাশে, দালানের ছাদে কেউ পজিশন নিয়েছিল অলিতে গলিতে। তাই প্রথম ধাক্কা সামলে ওঠার পর শুধুমাত্র রাইফেল হাতে পশ্চিমা সৈন্যদের তারা পাল্টা আক্রমণ করলো চতুর্দিক থেকে। ফলে তাদের পাল্টা আক্রমণে কুকুরের মত করেছে পশ্চিমা সৈন্যরা। মেশিনগান, মর্টার, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল দিয়েও তারা পারছিল না পুলিশের মোকাবিলা করতে। তাই তারা নামিয়ে আনে ট্যাংক বহর। কিন্তু তাতেও প্রদমিত হয়নি আমাদের পুলিশ বাহিনী। তাদের সাথে একটাই মাত্র শপথ ছিল; আমরা জান দেব তো বাঙালির মান দিব না। তাই তারা নড়েছে মরেছে এবং মেরেছে।
পুলিশ লাইনের কাছে গিয়ে দেখি কুৎসিত ও বিকট দর্শন পাঞ্জাবি সৈন্যরা চারপাশে মেশিনগান, মর্টার ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র পেতে প্রস্তুত হয়ে আছে। মনে হল ওরা যে কোন সময় গুলি করতে পারে। তবু দমলাম না। ভাবলাম ঢাকায় যখন আটকা পড়েছি তখন ওদের ওদের দোসরদের হাতে আজ হোক কাল হোক মরতেই হবে। সুতরাং মরার আগে ওদের ইসলাম প্রীতির নমুনাটা অন্ততঃ দেখে যাই।
কোথাও দাঁড়ালাম না। সামনে চলতে চলতে শুধু তাকিয়ে দেখলাম। হিরোশিমা নাগাসাকি ধ্বংস লীলা স্বচোখে দেখিনি, ছবিতে দেখেছি। রাজার বাগ পুলিশ সহ সদরের সামনে দিয়ে যেতে যেতে মনে হয়েছে হিরোশিমা-নাগাসাকির ধ্বংসলীলার ছবি দেখছি। সহস্র হাত লম্বা পুলিশ ব্যারাক সম্পূর্ণ ধুলিস্যাৎ। তখনো ধ্বংসস্তূপ থেকে একটু একটু ধোঁয়া উঠছে। প্রশাসনিক দপ্তরটিও গোলার আঘাতে আঘাতে প্রায় সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত। দেয়ালের গায়ে কামানের গোলার অসংখ্য গর্ত এক একটা যেন আগ্নেয়গিরির গহ্বর।
রাজার বাগ পুলিশ লাইনের পাশে বিরাট বসতি এলাকা। এলাকার অধিবাসীদের অবস্থা জানার ইচ্ছে হলো। তাই চলে গেলাম সাথীর এক আত্মীয়ের বাড়িতে। যে রেখে তাদের বাস ঘরের দেয়ালেও অসংখ্য গোলাগুলির দাগ। বাড়িওয়ালা কেউ নেই। একটা তালা দিয়ে সপরিবারে ২৫শে মার্চ রাতেই কোথায় চলে গেছে। তার এক প্রতিবেশীর সাথে দেখা হলো। তিনি জানালেন যে স্ত্রী পুত্রদের মাইল চারেক দূরে এক গ্রামে রেখে তিনি কিছুদিন জিনিসপত্র নিতে এসেছেন। খবর নিয়ে জানলাম শাহজাহানপুর, মনিবাগ, চামেলিবাগ, সিদ্ধেশ্বরীর এমন কোন বাড়ি নেই যাতে গোলাগুলি পড়েনি এবং ওইসব এলাকার শতকরা ৯৯ জন অনির্দিষ্টের পথে রওয়ানা হয়ে গেছে।
পাশে ছিল এক সাংবাদিক বন্ধুর বাসা। দেখলাম তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছেন। বললাম, পাড়া ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে। তিনি বললেন, বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষ যখন মরতে পারে তখন আর তিনি পালাতে চান না। মরতে হয় ওখানে মরবেন। সেখানে আরো শুনলাম রাজার বাগ পুলিশ লাইন এর ভেতর তখনও অসংখ্য লাশ পড়ে আছে স্তূপীকৃত অবস্থায়। তাছাড়া আহতদের হাত-পা বেঁধে একটা হল ঘরে ফেলে রাখা হয়েছে।
রাজার বাগ থেকে ইংরেজি দৈনিক ‘দি পিপল’স পত্রিকার অফিসের দিকে গেলাম। ওদিকে আসার পথে দেখলাম রাস্তার দু’পাশে প্রত্যেকটা বাড়িতে গোলাগুলির চিহ্ন স্পষ্ট। ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে এসে থামলাম। দেখলাম এলাকার মধ্যে এই ভবনটি কেবল সম্পূর্ণ অক্ষত রয়েছে। হয়তো সেখানে ভুট্টো অবস্থান করছিলেন বলেই পাঞ্জাবি সেনারা ভবনটিকে অতি পবিত্র ভেবে তাকে গুলি করে নি। কিছু কিছু বিদেশি মেহমান ও হোটেলে ছিলেন‌ হয়তো এই ভয়ে ও পাঞ্জাবি সেনারা ভবনটিকে কিছু করেনি। ‘ দি পিপল’স পত্রিকার অফিস হোটেল কন্টিনেন্টাল এর ঠিক পশ্চিম দিকে। কামানের গোলা ধ্বংস করে ফেলেছে ওরা। কেবল গুলি করে ক্ষান্ত হয়নি পাক ফৌজ । তারপর দিয়েছে আগুন, পাশেই লাগানো নিপুন মোটর কোম্পানি একইভাবে ধ্বংস করা হয়েছে ওটা কে। ভস্মীভূত হয়ে পড়ে আছে প্রায় শ’খানেক মোটরগাড়ি।
দি পিপলস এর অফিসের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ঢুকতেই না কে আসল ভোঁতকা গন্ধ। ভেতরে ঢুকে দেখি কয়েকটা লাশ পড়ে আছে, প্রায় ১৫ টার মত গুনলাম। চেহারা চেনার কোন উপায় নেই। আগুনে পুড়ে একেবারে গলে গেছে। কি অপরাধ ছিল এদের? বাংলাদেশের মানুষ এরা, বাঙালির স্বার্থে কথা বলতো পত্রিকা। সে যেন মেশিনগান দিয়ে হত্যা করা হয়েছে এদের। মাথাটা ঝিমঝিম করছিল এমন সময় কে এসে বললে এই যে দেখে যান পাশের কামরায় আরেকটি লাশ। দেখে মনে হয় কোন মহিলার। বললাম আমার পক্ষে আর সহ্য করা সম্ভব নয়। যা দেখেছি এ কোনদিন ভুলবো না। আর দেখতে পারব না।
স্কুটার চলছে বেলা প্রায় সাড়ে দশটা। অসংখ্য মিলিটারি গাড়ি রাস্তায় টহল দিচ্ছে। নিউ মার্কেটের কাছে এসে দেখিয়ে কাঁচাবাজারের কোন অস্তিত্ব নেই এটি নিউমার্কেটের ঠিক উত্তর-পূর্ব কোণে ছিল। যারা আগে কাঁচা বাজারি দেখেননি তাদের কথা ধারণা করাই মুশকিল হবে দুদিন আগেও এখানে হাট বাজার বসতো। নানারকম শাকসবজি তরিতরকারি বিক্রি করতো শহরের উপকণ্ঠের দরিদ্র বাসিন্দারা। এখন কিছুই নেই। পাথরের উপর আক্রমণের সাক্ষ্য হিসেবে বর্তমানে ওখানে রয়েছে ভষ্মিভূত দোকানের ছাই। নিউ মার্কেট এর ভেতরের দোকানগুলো অবশ্য জ্বালায়নি তারা, তবে গোলাগুলির চিহ্ন দেখতে পেলাম অনেক দোকানে। নিউমার্কেট থেকে বাসায় ফিরে আসব ঠিক করলাম। কিন্তু মত পাল্টিয়ে রওনা দিলাম শেখ সাহেবের বাসার দিকে। দেখি না কি অবস্থা। ৩২ নম্বর রোডের কাছে আসতে দেখলাম পাঞ্জাবি সেনারা কড়া পাহারা দিয়ে বসে আছে চারিদিকে, কাছাকাছি যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। ভাবলাম ওইতো কিছুদিন আগেই কি সরগরম ছিল শেখ সাহেবের বাসা, মিছিলের পর মিছিল আসছে। কত আশা আকাঙ্ক্ষা ও বাসনা প্রতিচ্ছবি দেখেছি নিত্য প্রবাহমান মিছিলের মুখে। আর এখন খাঁ খাঁ করছে সমস্ত বাড়িটা। দরজা-জানালা সব খোলা। মনে হয় পাঞ্জাবি সৈন্যরা লুটপাট করে সব নিয়ে গেছে। দোতালার দেয়ালে গুলির চিহ্ন রয়েছে অনেক। ছাদের উপর থেকে ভেসে আসলো কাকের ডাক, খুব করুণ ক্লান্ত একটানা কা, কা, কা ধ্বনি।
ফেরার পথে দেখলাম রাজপথে নেমেছে মানুষের ঢল। কোন মিছিল নয়। আতঙ্কিত বাঙালি প্রাণভয়ে পালাচ্ছে বাপ-দাদার ভিটেমাটি উজাড় করে কোথায় যাচ্ছে, কোথায় থাকবে, কি খাবে সে হুঁশ কারো নেই। ঢাকা ছেড়ে পালিয়ে যাবার জন্য যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, তরুণ-তরুণী, কিশোর ও শিশু কেউ বাদ নেই। সামান্য পোঁটলাপুঁটলি নিয়ে গাড়ি, রিকশা, ঠেলাগাড়ি পায়ে হেঁটে দলে দলে লোক পালাচ্ছে শহর ছেড়ে। কানে আসলো একটি কচিকণ্ঠের কান্না -“আম্মা ভাইয়া কোথায়, ভাইয়াকে ছাড়া আমি যাব না।”চোখ দুটো ছল ছল করে উঠলো। সাথীকে বললাম তাড়াতাড়ি চলো বাসায়, কারফিউ সময় হয়ে আসছে। (চলবে)
বিশ্ব জনমতঃ দুনিয়ার মানুষ আর কতদিন চোখ বুজে বাংলাদেশের নৃশংসতার দৃশ্য দেখে যাবে?
সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি গত ২রা জুন মার্কিন সিনেটের তার সর্বশেষ বক্তৃতায় জিজ্ঞেস করেন সারাবিশ্ব আর কতদিন বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতা চোখ বুজে দেখে যাবে?
তিনি আরো জিজ্ঞেস করেন পাকিস্তান সরকারই বা আর কতদিন বাংলাদেশের স্বাভাবিকতা ফিরে আসছে বলে চিৎকার করে বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবে।
সিনেটর কেনেডি বলেন লক্ষ লক্ষ বাঙালি যখন প্রাণ বাঁচানোর জন্য ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে তখন পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের অবস্থা স্বাভাবিক বলে চিৎকার করতে ছাড়ছে না।
তিনি বাংলাদেশের নির্যাতিত মানুষের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসার জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আবেদন জানান।
সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি সম্প্রতি একটি চিঠিতে মার্কিন সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক সেক্রেটারী মিঃ উইলিয়াম রজারসকে জানিয়েছেন যে, বাংলাদেশের ব্যাপারে বৃহৎ শক্তিবর্গের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কেনেডি তার চিঠিতে বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা ও উদাসীনতার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সংকট সৃষ্টি করছে। এই সংকটের ফলে বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হওয়া অসম্ভব নয়। ভারত উপমহাদেশে বর্তমানে যা ঘটেছে তা খুবই উদ্বেগজনক।
* * * *
বিদেশ থেকে যে ছয় জন সাংবাদিককে পাক সরকার বাংলাদেশ দেখাতে নিয়ে এসেছিলেন, তাদের অন্যতম জর্জ সাইকার বলেছেন, চট্টগ্রাম শহরের অনেক অঞ্চলে এখন আর ঘরবাড়ির কিছু অবশিষ্ট নাই। এইসব ঘরবাড়ি কামানের গোলার আঘাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে।
বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অনেক জায়গায় রেলপথ উঠিয়ে ফেলেছে। ফলের গুরুত্বপূর্ণ স্থান সমূহের মধ্যে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। কুমিল্লা ও ফেনীর মধ্যেকার সড়কটি একেবারে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।
* * * *
থাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন চীনের উপর দিয়ে থাইল্যান্ড হয়ে যেসব পাক বিমান আসত থাইল্যান্ড তাদের তেল সরবরাহ করতো। কিন্তু এখন থাইল্যান্ড পাক বিমানকে আর তেল সরবরাহ করবে না। থাই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ ঘোষণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তেলের অভাবে পাক বিমান থাইল্যান্ড হয়ে আর বাংলাদেশে আসতে পারবে না। এর ফলে চীন থেকে থাইল্যান্ড হয়ে অস্ত্রশস্ত্র আনা চলবে না। ফলে পাকিস্তানের অস্ত্র সরবরাহে আরো জটিলতা সৃষ্টি হল। প্রসঙ্গত বলা দরকার যে ইতিপূর্বে বার্মা সরকারও পাক বিমানকে তেল সরবরাহ করতে অস্বীকার করেছে।
* * * *
ব্রিটিশ শ্রমিক দলের সদস্য মিঃ বার্ণস বলেছেন বাংলাদেশে সমস্যা সমাধানের পাকিস্তান রাজি না হলে পাকিস্তানকে বৃটেনের কোন অর্থনৈতিক সাহায্য দেওয়া চলবে না। তিনি বলেন পশ্চিমী দেশগুলির পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করতে হবে, পাকিস্তানের অর্থনীতি ভেঙে পড়লে বিশ্বের কোন দেশ যাতে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে না পারে তেমনি অবস্থার সৃষ্টি করতে হবে এবং ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলোতে বিপুল পরিমাণে আন্তর্জাতিক সাহায্যের ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রমিকদলের আর একজন সদস্য মিঃ বেসওয়ার্ড বলেন ঃ বাংলাদেশের মানুষের উপর ইয়াহিয়া সরকার কিনারে কি অত্যাচার চালিয়েছে তা লন্ডন-নিউইয়র্ক বা প্যারিসে বসে অনুমান করা যাবে না। ইতিহাসে এরকম বর্বর বীভৎস গণহত্যার দৃষ্টান্ত নেই।
* * * *
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন ঊর্ধ্বতন সেনাপতি বলেছেন পাক ফৌজ এর পক্ষে কখনই বাংলাদেশকে পদানত রাখা সম্ভব হবে না। কারণ সে দেশের সমস্ত লোকেই তাদের বিরোধী। বাংলাদেশ এখন পুরোপুরি শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা চলছে। সেনা শক্তির দ্বারা এই শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা অবসান ঘটানো সম্ভব নয়।
* * * *
ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকিতে অনুষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক আন্তর্জাতিক এ প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে যে, বাংলাদেশের যুদ্ধ অবিলম্বে বন্ধ করা হোক। এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পৃথিবীর ৪০টি দেশের ১৫০ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোর কয়েকটি দিক
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
সরকারি খাত ও জাতীয়করণ
শুধুমাত্র ক্রমবর্ধমান ট্যাক্স ধার্য করে এবং নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে সম্পদ পুঞ্জিভূত করেন এবং অর্থনীতির প্রধান সেক্টরগুলোর নিয়ন্ত্রণের অধিকার থেকে সুবিধাভোগী কোটারিকে বিরত রাখা সম্ভব নয়। কার্যকরভাবে এই সেক্টরগুলোর জাতীয়করণ এবং ভবিষ্যতে মূল সেক্টরগুলো সরকারি খাতের অন্তর্ভুক্ত করার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। সামাজিক ন্যায়বিচারের অভিলক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অর্থনৈতিক উন্নতি করতে হলে এ ধরনের জাতীয়করণের কর্মসূচি গ্রহণ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পূর্ব শর্ত। অবশ্য অত্যন্ত সুসামঞ্জস্য পরিকল্পনা সহকারে জাতীয়করণ কর্মসূচি রূপায়ণ করতে হবে। প্রশাসনে কর্মচারীর এবং সর্বোপরি দক্ষতার ওপর অতিরিক্ত চাপ না পড়ে সেদিকে লক্ষ্য রেখে জাতীয়করণের মাত্রা, গতি, গঠন বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থা উদ্ভাবিত না হলে মূল্যনির্ধারণ নীতির ত্রুটি এবং আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও নিয়ন্ত্রণের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত সংগঠনগুলো অদক্ষতায় আক্রান্ত হতে পারে-সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ থাকা এবং এটা সুস্পষ্ট দেখা যায় যে, রাষ্ট্রায়ত্ত সংগঠনগুলোর পরিচালনার জন্য নতুন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সবচেয়ে ভালো পেশাদার কর্মচারী নিয়োগ করলে ব্যবস্থাপনা দক্ষতা সর্বোচ্চ মানে পৌঁছানো যেতে পারে। উপরোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রেখে জাতীয় করনের জন্য অগ্রাধিকারের তালিকাটি নিচে দেওয়া হল।
(১) ব্যাংকিং। (২) বিমা।
(৩) লোহা ও ইস্পাত, খনি, মেশিন যন্ত্রপাতি, ইঞ্জিনিয়ারিং, পেট্রোকেমিক্যাল, সার, সিমেন্ট, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সহ ভারী শিল্প।
(৪) বৈদেশিক বাণিজ্য -বিশেষতঃ নিম্নলিখিত পাট ছাড়াও লৌহ ও ইস্পাত দ্রব্য, কয়লা, খাদ্যশস্য, সিমেন্ট এবং সার সহ প্রধান প্রধান পণ্যের আমদানি রপ্তানি।
(৫) পাট ব্যবসা।
(৬) শিপিং সহ-প্রধান যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পরিবহন।
(৭) পরিকল্পনা সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিতব্য অপরাপর মূল শিল্প কারখানা।
ক্রমবর্ধমান করঃ
দেশের বর্তমান কর প্রথায় মুষ্টিমেয় বিশেষ সুবিধাভোগীর প্রতি চিরাচরিত আনুকূল্যেই প্রতিফলিত হয়েছে এবং এই কর প্রথা পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা পশ্চাদমুখী। উচ্চতর উপার্জনকারী শ্রেণীর উপর ধার্য করেন বোঝা আন্তর্জাতিক মানের হিসাবে সবচেয়ে কম। সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠাকল্পে সাধারণ মানুষের স্কন্ধে পরোক্ষ করের মাধ্যমে যে বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তার জায়গায় প্রত্যক্ষ করার মাধ্যমে অধিক পরিমাণে অর্থ আদায়ের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য কর কাঠামোর আমূল রদ-বদল প্রয়োজন। এজন্য আয় করে একটি সত্তিকারের ক্রমবর্ধমান প্রথা প্রচলন এবং মূলধনের লাভ (capital gains), মুনাফা, সম্পদ, উপহার ও উত্তরাধিকারের উপর থেকে মোটা পরিমাণের ট্যাক্স আদায় করা আবশ্যক। উপরন্তু বর্তমানে প্রচলিত ছাড় ( deduction) অব্যাহতি ( exemptions) এবং ট্যাক্স হলিডে প্রথার সামাজিক অসাম্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে এবং সম্পদ পুঞ্জিভূত করতে সাহায্য করছে। এসকল বিষয় ব্যাপকভাবে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন এবং উপরে উল্লেখিত সামাজিক উপলক্ষে সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এ ধরনের ছাড়, অব্যাহতি ও ট্যাক্স হলিডে বিলোপ করতে হবে। (চলবে)
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের প্রশ্নে কারো আপত্তি থাকা উচিত নয় -মাওলানা ভাসানী
গত ৩১শে মেয বাংলাদেশের কোন এক স্থানে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের সকল প্রকার প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দেন। বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের মুক্তির দাবিতে যাদের মুখে সবসময় খই ফোটে বাংলাদেশের প্রশ্নে সেই সমস্ত সমাজতান্ত্রিক দেশের পূর্ণ নিরবতায় মওলানা ভাসানি বিস্ময় প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশ সমস্যার ইতিহাস ব্যাখ্যা করে মাওলানা ভাসানী বলেন, বাংলাদেশের বর্তমানে সংঘর্ষ আদতে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী সামন্ত প্রভু ও আমলাতন্ত্রের নিরবচ্ছিন্ন শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছাড়া আর কিছু না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনভাবে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না। তিনি বলেন এটা বাংলাদেশের মানুষের একটা বিপ্লব। তবে এ বিপ্লব বাইরের কোন দেশ থেকে আমদানি করা হয়নি, কোন সমাজতান্ত্রিক দেশ থেকে নয়ই মৌলানা ভাষণে বলেন, বাংলাদেশের এ বিপ্লবের গুরুত্ব কোন অংশেই চীন ও রাশিয়ার বিপ্লবের চেয়ে কম নয়। এটা বাংলাদেশের মানুষের সর্বাত্মক বিপ্লব। সুতরাং এ বিপ্লব সমর্থন করা ও দুনিয়ার সকল দেশের মানুষ ও সরকারের কর্তব্য। ভারতই বাংলাদেশের বর্তমান বিপ্লবের জন্য দায়ী বলে তথাকথিত পাকিস্তান সরকার যে প্রচার অভিযান শুরু করেছে তার উল্লেখ করে মলানা ভাসানি বলেন, এটা একটা জঘন্য মিথ্যা কথা। বিশ্বের মানুষের জানা উচিত যে, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের নির্লজ্জ ও অমানুষিক অত্যাচার, নিপীড়ন ও শোষণেই বাঙালিকে ঢেলে দিয়েছে বিপ্লবের পথে। এ বিপ্লবের রাশিয়া-চীন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইউরোপ বা ল্যাটিন আমেরিকার কোন দেশের কোন অবদান নেই। তবে আমরা আশা করেছিলাম এরা সর্বপ্রকারের আমাদের সাহায্য করবে।
মৌলানা ভাসানি বলেন, দুইশত বছরের শাসনকালের ব্রিটিশ যতটুকু না করেছে তার চেয়েও অনেক বেশি শোষণ করেছে বিগত ২৪ বছরে পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিপতি, সামন্ত প্রভু, আমলাতন্ত্র ও শাসকগোষ্ঠী বাঙালিকে। নির্মম শোষণে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের শরীরে হাড় চামড়া ছাড়া আজ আর কিছুই নেই। মাওলানা জিজ্ঞাসা করেন পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের সাথে কি করে রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব? মাওলানা বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বিগত ২৪ বছর ধরে বাঙালিকে যে কষ্ট দিয়েছে আজ যদি তার ক্ষতিপূরণ ও করতে চায় তবুও তাদের সাথে কোন আপোষ মীমাংসা সম্ভব নয়। কেননা আমরা বুঝতে পেরেছি ওদের সাথে এক রাষ্ট্রে কোন রকমেই বাস করা সম্ভব নয়।
প্রসঙ্গক্রমে মাওলানা ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করেন। উক্ত প্রস্তাবকে পাকিস্তানের ভিত্তি হিসেবে অভিহিত করে মলানা বলেন, এ প্রস্তাবের সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল যে ভারতের উত্তর-পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের দুটো স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠিত হবে। মুসলমান প্রভাবিত প্রদেশ গুলোর গ্রুপিং ব্যবস্থা মেনে নিয়ে জিন্নাহ সাহেব আসলে লাহোর প্রস্তাবের মূল কথাই মেনে নিয়েছিলেন। সুতরাং কোন রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলতে গেলে এই সময় মৌলিক বিষয়ের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
বাংলাদেশকে কিভাবে শোষণ করা হয়েছে তার নজির পেশ করতে গিয়ে মাওলানা শাহ বলেন প্রথমে করাচি এবং পরে কেন্দ্রীয় রাজধানী নির্মাণের নামে ১৩ শত কোটি টাকার বেশি ব্যয় করা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের জীবন-মরণ সমস্যা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে ৬শত কোটি টাকার ব্যবস্থা ১৬ বছরেও হয়নি। এমনকি বিগত নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্থ লাখো লাখো মানুষের জন্য এরা কিছুই করেনি। এরপরেও যদি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সেরা রাজনীতিবিদগণ বাঙ্গালীদের উপর একটা রাজনৈতিক সমাধান চাপিয়ে দিতে চান তবে তারা হতাশ হবেন। কেননা সাড়ে সাত কোটি বাঙালির আজ একটি মাত্র পণ, হয় তারা স্বাধীন জাতি হিসেবে বাঁচবে, না হয় মরবে। মৌলানা ভাসানি বলেন, বাংলাদেশের উপর ইয়াহিয়া খান যে নির্মম অত্যাচার নিপীড়ন চালিয়েছে তাতে সে এজি কেও হার মানিয়েছে।
মলানা দুঃখ করে বলেন, ভিয়েতনামে বিদেশি হামলার প্রতিবাদে এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামের অস্থায়ী সরকারের স্বীকৃতির প্রশ্নে বাংলাদেশের মানুষ গ্রামে গ্রামে আন্দোলন করেছে। অথচ বাংলাদেশের মানুষের এই চরম দুর্দিনে রাশিয়া, চীন, আলবেনিয়া বা ভিয়েতনামের মতো সমাজতান্ত্রিক দেশ গুলো আজ বাঙালীদের জন্য কিছুই করলো না।
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনার জন্য সর্বদলীয় সরকার গঠন সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে মৌলানা বলেন, আমি সর্বদলীয় জগাখিচুড়িতে বিশ্বাস করিনা। বাংলাদেশের উভয় অংশ আমরা সর্বদলীয় সরকারের কাণ্ডকারখানা দেখেছি। তাতে কোন কাজের মতো কাজ হয় না। তিনি বলেন, সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মুক্তিই আজ সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। সুতরাং সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের প্রশ্নে আমাদের কারো কোনো আপত্তি থাকা উচিত নয়।
ইয়াহিয়া ইতিহাসের নিকৃষ্টতম বিশ্বাসঘাতক -কামরুজ্জামান
বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র ও পুনর্বাসন মন্ত্রী জনাব এ এইচ এম কামরুজ্জামান জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম বিশ্বাসঘাতক ও রক্তপিপাসু দানব বলে অভিহিত করেছেন।
সাবেক পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সম্পর্কিত দ্বিতীয় দফা দাবি সম্পর্কে মন্তব্য করতে বলা হলে জনাব জামান উপরোক্ত মত ব্যক্ত করেন। জনাব জামান বলেন, ইয়াহিয়া খানের মতো এত বড় মিথ্যাবাদী, বেইমান, বিশ্বাসঘাতক দুনিয়ার বুকে দুটি জন্মায়নি। তার কথায় বাংলাদেশের মানুষ তো দূরের কথা বহির্বিশ্বের কোন মানুষ ও বিশ্বাস স্থাপন করবে না। ইয়াহিয়া নিজেকে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম বিশ্বাসঘাতক ও রক্ত পিপাসু বলে প্রমাণ করেছে।
জনাব কামরুজ্জামান বলেন, শেখ মুজিবের সাথে আলোচনায় ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগের সমস্ত দাবি মেনে নিয়েছিলো। তিনি কথা দিয়েছিলেন ২৫ শে মার্চ এক ঘটনার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করার ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু তার বদলে ইয়াহিয়া ওই রাতে বাঙালিদের ওপর লেলিয়ে দেয় তার বর্বর সৈন্যবাহিনীকে।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের ক্ষমতা সম্পর্কে প্রশ্ন করার অধিকার জঙ্গী চক্রের নেই। শতকরা ৯৮ ভাগেরও বেশি লোক আমাদের সমর্থন করেছেন, আমাদের বিচার করার ক্ষমতা কেউ কোন জঙ্গি চক্রকে দেয়নি। তারা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ হীন, ক্ষমতা মত্ত দানব। আওয়ামী লীগ আলোচনা ভেঙে দেয় নি, যুদ্ধের কথা ও চিন্তা করেনি। প্রস্তুতির প্রশ্নই আসে না। এখন যখন যুদ্ধ আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তখন আমাদের পবিত্র ভূমি থেকে হানাদারের বিতারিত না করা পর্যন্ত আমরা তা চালিয়ে যাব। নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়াই এসে দাঁড়াবেন তারাই মহৎ। তাদেরকে আমরা বন্ধু বলে মনে করব।