মুজিব হত্যার হাতিয়ার
লজ্জাহীন মিথ্যাচার—১
১. ঐ সমস্ত অতিউগ্র বামপন্থী দলগুলাে গােপনে সশস্ত্র দল, স্কোয়াড গঠন করতে থাকে। থানা, ব্যাংক লুট করা হয়। খুন-হত্যা, রাহাজানি, ডাকাতি জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তােলে।
১.১ পাশাপাশি তাদের ‘মাস ফ্রন্টের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ১৯৭২ সন হতে ১৯৭৪ সনের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিনা বাধায় চলতে থাকে। রাজনীতির নামে ডাকাতি, রাজনীতির নামে লুট, রাজনীতির নামে হাইজ্যাকিং অবাধে অগ্রসর হয়। ১৯৭২ সনে গৃহীত শাসনতন্ত্রের উল্লেখিত মৌলিক অধিকারসমূহের অবাধ সুযােগ নিয়ে ঐ সমস্ত দল ও চক্র অজস্র বানােয়াট মিথ্যাচারসমূহ বিভিন্নভাবে প্রচার করে জনগণকে সার্বিকভাবে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়। ঐ সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলাে যে সমস্ত মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার পটভূমিকায় তার উল্লেখ প্রয়ােজন এ জন্য যে, এ থেকে বােঝা যাবে ঐ সমস্ত দলগুলাে সকল ন্যায়বােধ, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি বিসর্জন দিয়ে শুধু গুজব আর মিথ্যাচার দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার কৌশল গ্রহণ করেছিল। ১.২ এখানে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, পাকিস্তান আন্দোলনের মধ্যদিয়ে যে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানাে হয়েছিল জনগণের একাংশের মনে তার প্রতিক্রিয়া কখনই একেবারে মুছে যায়নি। ভারত সম্পর্কে একটা অহেতুক ভীতি ও হিন্দু বিদ্বেষ উসকে দিয়ে গণ-অসন্তোষকে তীব্রতর করা এবং তা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে প্রয়ােগের জন্য মওলানা ভাসানী শাণিত কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরপরই বিভিন্ন সময়ে যে স্বাধীনতা বৈরী শক্তি, হলিডে চক্র’ মওলানা ভাসানীকে সামনে রেখে ও নেতৃত্ব মুক্তিযােদ্ধার ভাবমূর্তি নিয়ে মিথ্যাচার প্রচার করেছিল তার প্রধান বিষয়সমূহ ছিল—
ক. ভারত বাংলাদেশের অর্থনীতি ধ্বংস করার মতলবে গােপনে বিপুল অংকের জাল নােট বাজারে ছেড়েছে।
খ. বাংলাদেশের শিল্প কারখানার কলকজা ভারতে পাচার করা হয়েছে।
গ. বাংলাদেশের সব গাড়িকে পাচার করা হয়েছে।
ঘ. বাংলাদেশ হতে ৬০০০ কোটি টাকার সম্পদাবলী ভারতে স্থানান্তরিত করা হয়েছে এবং সর্বোপরি যে অভিযােগটি সবচেয়ে বেশি আলােচিত ছিল, তা হলাে —
ঙ. ভারতের সঙ্গে একটি গােপন চুক্তি স্বাক্ষর করে বঙ্গবন্ধুর সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৗমত্ব বিকিয়ে দিয়েছে।
চ. মুজিব ভারতের পুতুল সরকার এবং বাংলাদেশ ভারতের তাবেদার রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।
ক. প্রথমেই আসা যাক জাল নােট প্রসঙ্গে। একটা গুজব রটে গেল যে, বঙ্গবন্ধুর সরকার ভারত সরকারকে যে পরিমাণ নােট ছাপাতে দিয়েছিল ভারত সরকার ইচ্ছেকৃতভাবে দেশের অর্থনীতিকে দেউলিয়া করে দেবার জন্য তার দ্বিগুণ নােট ছাপিয়েছে। এ সময় একই নম্বরের দুই একটি নােট পাওয়া যাচ্ছিল এবং সংবাদপত্রে তা ছাপা হচ্ছিল। অন্যদিকে টাকার মূল্যও কমে যাচ্ছিল শীঘ্র ভারতীয় নােট বাজার থেকে তুলে নেয়া হােক। বঙ্গবন্ধুর সরকার ভারতীয় নােট প্রত্যাহারের জন্য এক মাস সময়। দিলেন। শুরু হয়ে গেল অপপ্রচার। বলা হলাে আওয়ামী লীগ নেতাদের লক্ষ লক্ষ টাকা ভারতে রয়েছে তা বদলানাের জন্যই এত দীর্ঘ সময় দেয়া। হয়েছে। পাকিস্তানের নােট অচল ঘােষণায় মাত্র ৫ দিন সময় দেয়া হয়েছিল। আর ভারতীয় নােট প্রত্যাহারের জন্য প্রথমে ১ মাস ও পরে আরাে ১৫ দিন সময় বাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। এই মিথ্যা অভিযােগের জবাবে অর্থমন্ত্রী তাজুদ্দিন সাহেব বললেন যে, পাকিস্তানের টাকার ব্যাপারটা হলাে ডিমনিটাইজেশন ভারতের টাকার ব্যাপারটা হলাে উইথড্রয়াল, প্রথমটা হলাে নির্দিষ্ট তারিখের পর অচল ঘােষণা আর পরেরটা হলাে ভারতীয় সমস্ত টাকা প্রত্যাহার করে নেয়া। তিনি বললেন, ভারত থেকে মােট ৩৫০ কোটি টাকার নােট ছাপানাে হয়েছে। সত্যিই ভারত নির্দেশিত ৩৫০ কোটি টাকার বেশি নােট চেপে। বাজারে ছেড়েছে কিনা সেটা আমি জানতে চাই। লম্বা সময় দিলাম যাতে সমস্ত নােট জমা হতে পারে এবং আমরা প্রকৃত অবস্থাটা বুঝতে পারি। ৩৫০ কোটি টাকার বেশি নােট জমা হলেই আমরা ভারত সরকারকে দায়ী করে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারব। অন্য প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন যে, এক টাকার নােট এত বিপুল পরিমাণ হওয়ায় নম্বরে দুই একটি ত্রুটি হতে পারে। ১৯৭৩ সনের ৩১ মে ভারতে মুদ্রিত টাকা জমাদানের তারিখ অতিবাহিত হলে দেখা গেল বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক মূলত ইস্যুকৃত মােট অংকের চাইতে ৫৩ লক্ষ ৫৪ হাজার ৪৮০ টাকা কম জমা পড়েছে। এতে পরিষ্কার প্রমাণিত হয় যে, দ্বিগুণ ছাপা বা নােট ছাড়ার ব্যাপারটি সম্পূর্ণ গুজব। কিন্তু স্বাধীনতা বৈরীদের ব্যাপক প্রচারে বঙ্গবন্ধু ও তার সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে বিভ্রান্ত করার এটা ছিল এক মােক্ষম হাতিয়ার।
খ. জাসদ, হলিডে চক্র এবং মওলানা ভাসানী এবং স্বাধীনতা তৈরি শক্তিসমূহ পচার করতে থাকে যে, মুক্তিবাহিনীর সাথে বাংলাদেশে যে মিত্র বাহিনী প্রবেশ করেছিল তারা যাবার সময় শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে সকল কলকজা। খুলে নিয়ে গেছে। ফলে দেশব্যাপী শিল্প উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশে তথা পূর্বপাকিস্তানের শিল্পকারখানার অধিকাংশ মালিকই ছিল তখন পশ্চিম পাকিস্তানী শিল্পপতিগণ। সরকারের এক জরিপে দেখা গেছে, পশ্চিম পাকিস্তানী শিল্পপতি ও বিরাট কারবার প্রতিষ্ঠান ওয়ালারা বাংলাদেশ থেকে কলকজা, যন্ত্রপাতি, বাংক আমানত ও নগদ অর্থে ৭৮৫ কোটি টাকা সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে। বহুক্ষেত্রে শিল্পপতিরা সমগ্র কারখানা বা কলকজা অংশে অংশে খুলে পাকিস্তানে পাচার করছে। ফলে স্বাধীনতার পর পরই অনেক শিল্প কারখানা চালু করা সম্ভব হয়নি। এই প্রকৃত অবস্থা গােপন রেখে সারা দেশে ভারতের উপর এ সব দোষ চাপানাে হলাে এবং ভারত বিরােধী প্রচার চালানাে হলাে।
গ. মওলানা ভাসানী অভিযােগ করেন যে, কলকাতার রাস্তায় বাংলাদেশের মােটর যানে ভর্তি হয়ে গেছে। কথাটির ভিত্তি মিথ্যার উপর দাড় করানাে। স্বাধীনতা যুদ্ধে কেউ কেউ গাড়ি নিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। এই সকল গাড়িকে সনাক্ত করে কলকাতা পুলিশ WIB সংকেতে পৃথক নম্বর দিয়েছিল। দেশ স্বাধীন হলে দেশে প্রত্যাগমনের সময় ঐ সকল গাড়ি তারা সংগে নিয়েই বাংলাদেশে ফিরে আসে।
ঘ. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আমলে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পদ স্থানান্তর কতটুকু হয়েছে বা না হয়েছে এ কথা বিচার-বিশ্লেষণ না করেই অভিযােগ করা হয়েছে ৬০০০ কোটি টাকার মালামাল ভারতে স্থানান্তরিত হয়েছে। সরকারি পর্যায়ের লেনদেনের হিসাবে বিশ্বব্যাংক ১৯৭৬ সালে যে রিপাের্ট প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে যে, ১৯৭২ সনের জানুয়ারি হতে ১৯৭৫ সনের জুন পর্যন্ত ভারত বাংলাদেশকে সাহায্য দিয়েছে ১৩৫ কোটি টাকারও বেশি। বে-সরকারিভাবে যদি ধরেও নেয়া যায় ব্যাপক চোরাচালান রয়েছে, তা হলেও বলতে হয় চোরাচালান সব সময়ই দ্বিমুখী। তাছাড়া কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডরু বি বেডডাওয়ে প্রণীত আরেকটি গবেষণামূলক নিবন্ধে দাবী করা হয় এ ধরনের চোরাচালান ও চোরা কারবারের পরিধি ও পরিমাণ কখনই বিপুল হয় না। ১৯৭৫ সনে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর চাল, পাট ও অপর কয়েকটি সামগ্রীর। দাম কমে যাওয়ায় ঢাকার শাসক চক্র বলে যে চোরাচালান দমনেই এ ফল অর্জন করা গেছে। প্রকৃত ঘটনা হলাে ঐ সময় বাংলাদেশে ও ভারতে বিপুল ফসল উৎপাদিত হয়। বিশ্বজুড়ে খাদ্য শস্যের দামও তখন হ্রাস পেয়েছে। ১৯৭৩ সনে তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে যে ভয়াবহ বিশ্ব মুদ্রাস্ফীতি ও সংকট সৃষ্টি হয়েছিল তখন ধাতস্থ হয়ে এসেছে।
ঙ. উগ্র ডান ও বামপন্থী এবং স্বাধীনতা বিরােধী শক্তি অত্যন্ত জোরে প্রচার চালায় যে বঙ্গবন্ধুর সরকার ভারতের সঙ্গে একটি গােপন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নেই, বাংলাদেশ ভারতের তাবেদার রাষ্ট্র বৈ কিছু নয়। বলাবাহুল্য আন্তর্জাতিক বিশ্বে এমনি ধরনের প্রােপাগান্ডা চালাচ্ছিল পাকিস্তান, সৌদি, চীন মার্কিনসহ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ। বঙ্গবন্ধু হত্যার দশ বছর পরও আজ পর্যন্ত মােশতাক, সায়েম, জিয়া, সাত্তার ও এরশাদ এ সব বঙ্গবন্ধু বিরােধী। শাসকগণ সেই কথিত গােপন চুক্তি জনসমক্ষে তুলে ধরতে পারেনি বা এমন কিছু তথ্য উপস্থাপন করতে পারেনি যার ফলে জনগণ বুঝতে পারে। সত্যিই এ ধরনের চুক্তি ছিল। ১৯৭২ সনের ১৯শে মার্চ ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফরে এসে ২৫ বছরের বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বলাবাহুল্য এটা কোনাে গােপন চুক্তি নয়, প্রকাশ্য চুক্তি যা পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সহায়তা, সার্বভৌমত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। অথচ এই প্রকাশ্য চুক্তিকেই গােপন চুক্তি বলে অপপ্রচার চালানাে হয়েছিল। এই চুক্তি যদি দিল্লীর নিকট দাসখত বলে প্রমাণিত হয় তাহলে বঙ্গবন্ধু পরবর্তী দেশপ্রেমিক শাসককুল’ এই চুক্তিকে বাতিল করছেন না কেন? চুক্তিটি সম্পর্কে এখনাে স্বাধীনতা বিরােধী চক্র অপপ্রচার করে থাকে। সে জন্য পুরাে চুক্তিটি পরিশিষ্টে প্রদত্ত হলাে। বলাবাহুল্য, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্রের মধ্যে সম্পাদিত এই চুক্তিটি সােভিয়েত ইউনিয়ন-ভারতীয় চুক্তির অনুরূপ।
চ. বাংলাদেশ মুক্ত হবার পর পরই মওলানা ভাসানী, জাসদ, অতি বাম, চৈনিকপন্থী দল ও তার সহযােগীরা বলতে লাগলেন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ভারতীয় নেতাদের হাতে পুতুল ছাড়া আর কিছু নয়, ভারতের আঙ্গুলি হেলনেই তারা চলে। আজো শেখ মুজিব ও মুজিব অনুসারীদের ভারতের দালাল হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হলেও এ পর্যন্ত এ সমস্ত অভিযােগ ভিত্তিহীন বলেই প্রমাণিত হচ্ছে। জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ ও জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনসমূহে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য বঙ্গবন্ধুকে শােষিত বিশ্বের মহান নেতৃত্বের প্রথম সারিতে উন্নীত করেছিল। দিল্লীর অনীহা সত্ত্বেও ইসলামিক সম্মেলনে পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর গমন ও সদস্যপদ লাভ, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে সক্রিয় সদস্য এবং সৌদি আরবসহ মুসলিম জাহান ও চীনের মতাে পাকিস্তানের পয়লা নম্বর দোস্তদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য বারবার চেষ্টার কথা স্মরণ রাখলে বঙ্গবন্ধুর নীতি যে ভারতের লেজুড় বৃত্তি ছিল না তা দিবালােকের মতাে স্পষ্ট। বঙ্গবন্ধু পরিচালিত সরকারের পররাষ্ট্র নীতি যে দিল্লীর আঙ্গুলি নির্দেশে চলত না অথবা দিল্লীর তাবেদার ছিল না সে জন্যই এখানে প্রাসঙ্গিক ঘটনা তুলে ধরা প্রয়ােজন। যতদূর মনে পড়ে ১৯৭৩ সনের অক্টোবর মাসের কথা। পার্লামেন্টের সাব কমিটি রুমে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা জন কয়েক কাজ করছিলাম। তখন বিকেল হয়ে এসেছে। এমন সময় হঠাৎ করে বঙ্গবন্ধু ঘরে ঢুকলেন। দেখলাম বিশাল ব্যক্তিত্বশালী চেহারায় যেন আগুন ঝরে পড়ছে। বুঝলাম কিছু একটা হয়েছে, কিন্তু কি হয়েছে। বুঝতে পারলাম না। আমরা সবাই দাঁড়িয়ে। বঙ্গবন্ধু বললেন, “ইউ সি, বৃহৎ প্রতিবেশীর নিকট ক্ষুদ্র প্রতিবেশী থাকলে স্বভাবতই ডমিনেন্স এসে যায়। বাংলাদেশের ব্যাপারে এটা হতে পারে না।” এই বলে ক্রোধােদ্দীপ্ত বঙ্গবন্ধু প্রস্থান করলেন। এমনকি ঘটনা ঘটেছে যার ফলে বঙ্গবন্ধু এ কথা বললেন—এটা জানার ঔৎসুক্যে ঐ দিন রাতে আমি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এম, মনসুর আলীর বাসায় যাই এবং জানতে পারি বরিশাল সমুদ্র এলাকার তেল খননকারী স্ট্রাকচার ইণ্ডিয়ান গানবােট এসে ভেঙ্গে দিয়েছে। জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে তার দেশপ্রেম ছিল তুলনাহীন, কিন্তু দেশদ্রোহীগণ গােয়েবলসীয় প্রচারকেও হার মানিয়েছিল।
১.৩ কিন্তু এত সব মিথ্যা প্রচারে জনগণ বিশ্বাস না করলেও তারা যে বিভ্রান্ত হয়েছিল তা নিঃসন্দেহে বলা যায় এবং এ সব মিথ্যা প্রচারের কিছু ভিত্তিও তৈরি হয়েছিল। এর মধ্যে সীমান্ত বাণিজ্য চুক্তি এবং রক্ষীবাহিনী গঠন। সীমান্ত বাণিজ্য চুক্তির ফলে সেদিনের সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত বাংলাদেশ কতখানি উপকৃত হয়েছিল বা হয়েছিল না, সে বিচারের চাইতে প্রচার হতে লাগল—গেল, গেল সবই গেল, ভারতে চলে গেল। আসলে প্রকৃত ঘটনা তলিয়ে দেখবার মতাে অবস্থা সেদিন সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত অস্থির জনগােষ্ঠীর ছিল না। অন্যদিকে রক্ষীবাহিনী নিয়েও নানা কথা প্রচার হতে থাকল। যেমন রক্ষীবাহিনীর পােশাক ভারতীয় সেনাবাহিনীর পােশাকের মতাে। রক্ষীবাহিনীর ট্রেনার ভারতীয় অফিসাররা এবং রক্ষীবাহিনীকে দ্রুত গড়ে তােলা হচ্ছিল, তাদের জন্য নতুন ব্যারাক তৈরি হচ্ছিল। ১৯৭২ সনের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে রক্ষীবাহিনী গঠনের সময় হতে ১৯৭৫ সনের মধ্যে। রক্ষীবাহিনীর সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ২০ হাজার। ফলে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে বিক্ষোভ, ঈর্ষা এবং বিভ্রান্তি দানা বাধতে থাকে। কিন্তু তদানীন্তন রাজনৈতিক, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এবং দেশকে সেই বিশৃঙ্খল প্রতিবিপ্লবী তৎপরতা ঠেকাতে রক্ষীবাহিনীর গঠন অনস্বীকার্য ছিল। সেনাবাহিনীকে দল মতের উর্ধ্বে সম্মানে রাখার জন্যই; দৈনন্দিন অভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলার প্রয়ােজনে সেনাবাহিনীর ব্যবহার কখনও যুক্তিযুক্ত নয়। বাংলার দামাল মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে সংগঠিত হয়েছিল রক্ষীবাহিনী, তাদের বিরুদ্ধে চালানাে হলাে অপপ্রচার। লক্ষ্য সেনাবাহিনীর ভেতর অসন্তোষ জাগিয়ে তােলা এবং রক্ষীবাহিনী সম্পর্কে জনমনে ভীতি ও বিভ্রান্তি জাগিয়ে তােলা।
সূত্র : ফ্যাক্টস্- এন্ড ডকুমেন্টস্–বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড – অধ্যাপক আবু সাইয়িদ