You dont have javascript enabled! Please enable it! 1975.08.15 | বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ এক অন্তহীন আক্রোশ - মুজিব হত্যাকাণ্ড - সংগ্রামের নোটবুক

বঙ্গবন্ধু : বাংলাদেশ : এক অন্তহীন আক্রোশ …

১. বঙ্গবন্ধু হত্যা সম্পর্কে তথ্য পর্যালােচনা করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গে যে সমস্ত আন্তর্জাতিক চক্র জড়িত বাংলাদেশের স্বাধীনতার তারা ছিল দুশমন, শত্রু। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ধ্বংস করার সর্বপ্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও তাদের সে শত্রুতা ও আক্রোশ ফুরিয়ে যায়নি। তাদের সমস্ত আক্রোশ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশকে কেন্দ্র করেই বারবার ছােবল হানতে চেয়েছে।

১.১ পাকিস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত যােশেফ ফারল্যান্ড ১৯৭১ সনের মার্চে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে সাক্ষাৎ করে স্পষ্ট করে বলেছিলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামাে থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার যে কোনাে উদ্যোগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ নীতির পরিপূরক নয় বরং তাই এ ধরনের প্রচেষ্টাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করতে পারে না। ফারল্যান্ড বিশেষ করে সি, আই, এ পরিষ্কারভাবে বুঝেছিলেন যে, শেখ মুজিবের নিকট স্বাধীনতার বিকল্প কোনাে কিছুই গ্রহণযােগ্য নয়।

১.২  এ কথা বুঝতে পেরেই শক্তি প্রয়ােগের মাধ্যমে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের জন্য ১৯৭১ সনের ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী গণহত্যার যে বু প্রিন্ট হাতে নিয়ে কাজ করেছিল সে বু প্রিন্ট রচনায় সামরিক চক্রকে সাহায্য করেছিল রবার্ট জ্যাকসন। ২৫শে মার্চের পূর্ব হতেই তিনি ঢাকাতে ছিলেন এবং সামরিক চক্রের সঙ্গে সর্বদা যােগাযােগ রক্ষা করে চলতেন। জ্যাকসনের ছিল গণহত্যা পরিকল্পনার অতীত অভিজ্ঞতা—যে অভিজ্ঞতা তিনি অর্জন করেছিলেন দক্ষিণ ভিয়েতনাম ও ব্রাজিলে হত্যা ও ধ্বংসের পরিকল্পনা সরবরাহের মাধ্যমে।

১.৩ এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৬০ সাল থেকে ঢাকাস্থ মার্কিন কনসাল জেনারেলের সম্প্রসারিত অফিসের নামে শাহবাগ হােটেলের একটি স্যুটে গােপন অফিস স্থাপিত হয়। ১৯৬৪ সনে উক্ত অফিসের একজন উচ্চ পদস্থ কর্মচারী হঠাৎ করে চাকুরী ছেড়ে দেয়। তিনি প্রকাশ করেন যে, কতিপয় মার্কিনী অফিসার এ দেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে। 

ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি নেতা, গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও অন্যান্য উল্লেখযোেগ্য ব্যক্তিবর্গের ফটো, জীবনী এবং কর্মতৎপরতা সম্পর্কে রিপাের্ট সগ্রহ করে গােপন ফাইলে রাখা হচ্ছে। শাহবাগ হােটেলের এই গােপন ষড়যন্ত্রের কথা প্রকাশ হয়ে পড়লে এই গুপ্ত অফিসটি মতিঝিলস্থ আদমজী কোর্টে স্থানান্তরিত হয়। জ্যাকসন এই অফিসটির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার আরাে তিন জন সহকর্মী ছিল।

১.৪ পাকিস্তানী জেনারেল রাও ফরমান আলীর নিজের হাতে লেখা (২৮ পৃঃ) ডেস্ক ডায়েরিতে দেখা যাচ্ছে এটির ডানদিকের উপরে যে কয়টি শব্দ লেখা আছে তাতে U.S.A. (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) DGISI (ডিরেক্টর জেনারেল ইন্টার সার্ভিস ইনটেলিজেন্স), এর উপরে লেখা আছে মি, ডব্লিউ দেশপিক এবং নিচে মি, হেইট। আরাে নিচে লেখা রয়েছে পলিটিক্যাল ৬০-৬২ ও ৭০। কে এই হেইট? এর পুরাে নাম হাগ জি হেইট। জন্ম ৯ই সেপ্টেম্বর ১৯২৮। ১৯৪৬-৪৯ পর্যন্ত মার্কিন সেনাবাহিনীতে ছিলেন। ১৯৫৩-৫৪ সালে মার্কিন সেনাবাহিনীর বিশেষ গবেষণা বিভাগে কাজ করতেন। ১৯৫৪ সালে পররাষ্ট্র দফতরের মাধ্যমে সি, আই, এ পলিটিক্যাল এটাচি করে তাকে কয়েকটি দেশে এজেন্ট হিসেবে পাঠায়। কলকাতা, ঢাকা ও কায়রাে ছিল তার কর্মক্ষেত্র। ১৯৬০-৬২ সালে তিনি ঢাকায় ছিলেন। ১৯৭০ সালেও পুনরায় ঢাকায় আসেন।

১.৫ আর, ডাব্লিউ দেশপিক একজন বাস্তুত্যাগী পােলিশ, যিনি সরাসরি সি, আই. এর নেট ওয়ার্কে নিয়ােজিত ছিলেন। রাও ফরমান আলী, জ্যাকসন, হেইট ও দেশপিক একজোট হয়ে বাঙালি হত্যাযজ্ঞের ব্র প্রিন্ট তৈরি করেছিল। এবং ২৫শে মার্চের পূর্বেই এই শেষােক্ত দুইজন সি, আই, এর অন্যতম ঘাঁটি ব্যাংকক যাবার দুইখানা পি আই এ টিকিট যােগাড় করেছিল— যা উক্ত ডায়েরির পৃষ্ঠায় দেখা যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, ১৯৭১ সনের মধ্য মার্চের সি, আই, এ পেন্টাগণ ইলেকট্রোনিক গােয়েন্দা সূত্র থেকে ওয়াশিংটন পাক বাহিনীর ব্যাপক সামরিক প্রস্তুতির খবর জানলেও তা ঢাকাকে জানতে দেয়া হয়নি। অবশ্য ড. কিসিঞ্জার বারবার বলে এসেছেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার ব্যাপারে এ ধরনের সামরিক সমাধানের তিনি কোন সময়েই পক্ষপাতি ছিলেন না। কিন্তু কলামিস্ট জ্যাক এন্ডারসনের ফাস করে দেয়া কাগজপত্রে দেখা যাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তানকে সর্বতােভাবে সাহায্য দিয়েছে এবং দেবার জন্য প্রস্তুত ছিল। সে জন্য প্রখ্যাত বই ‘ম্যাসাকার’-এর লেখক বরার্ট পেইন  লিখেছেনঃ পূর্ব পাকিস্তানের অসহায় জনগণের জন্য ড. কিসিঞ্জার কোনাে প্রকার সহানুভূতি উচ্চারণ করেনি। পূর্ব পাকিস্তানের এই ম্যাসাকার ছিল তার চোখে একটি সহজ দুঃখজনক রাজনৈতিক ঘটনা যা শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। কিন্তু যা কোনােক্রমেই এই রাষ্ট্রের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবােধ বিনষ্ট করতে পারবে না। তারা একত্রে সমতা রেখে কাজ করে। যাবে—যতই ম্যাসাকার ঘটুক না কেন।৫

২.১ এই মধুর সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য নিক্সন প্রশাসন মিথ্যাচার করতেও কুণ্ঠিত হয়নি। পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠানাে হয়েছে অথচ বিশ্বকে বলা হয়েছে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ওয়াশিংটন পােস্ট-এর প্রকাশিত এক সংবাদে দেখা যাচ্ছে যে, পশ্চিম থেকে পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্যবাহিনী প্রেরণের জন্য মার্কিন বিমানগুলাে লিজ দেয়া হয়েছে। ১৯৭১ সনে ক্রোধােদীপ্ত সিনেটর ফুলব্রাইট সিনেট পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটিতে পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠানাে বন্ধ করার দাবী জানিয়ে এক প্রস্তাব গ্রহণ করেন। ফলে প্রকাশ্যতঃ ১৯৭১ সালের এপ্রিলের শেষাশেষি নিকসন সরকার পাকিস্তানে অস্ত্র বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করলেও গােপনে পাকিস্তানের নিকট অস্ত্র সরবরাহের প্রস্তাব পাঠায়। এ প্রস্তাব দানের যাবতীয় দলিল-পত্রও হঠাৎ করে এক সময় ফাস হয়ে পড়ে। এ দলিলগুলাে এন্ডারসন দলিল’ নামে পরিচিত।

২.২  জ্যাক এন্ডারসন কর্তৃক প্রকাশিত ঐ দলিল পত্র থেকে জানা যাচ্ছে যে পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি গােপন চুক্তির অস্তিত্ব রয়েছে।৭

৩.  বাংলাদেশের গণহত্যা দেখে ঢাকাস্থ মার্কিন কনস্যুলেট অনেক গােপন এবং উল্লেখযােগ্য ডিসপ্যাচ ওয়াশিংটনে প্রেরণ করে। ১৯৭১ সনের ২৮শে মার্চ একটি টেলিগ্রাম করে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত গণহত্যা বন্ধের জন্য ওয়াশিংটনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। এ সকল রিপাের্ট দেখে ইসলামাবাদের মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে বলতে বলা হয় এ সব রিপাের্ট ‘দুঃখজনক’ ‘অপরিপক্ক’ এবং বন্ধু দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের সামিল।৯

৩.১ এতদসত্ত্বেও সমস্ত কূটনৈতিক রীতিনীতি ভঙ্গ করে ১৯৭১ সনের ৬ই এপ্রিল ঢাকাস্থ মার্কিন কনস্যুলেটের উনিশ জন অফিসার, AID মিশন USIA একটি রেজিস্টার টেলিগ্রাম ওয়াশিংটনে প্রেরণ করে। টেলিগ্রামটি ৪৮ বয়স্ক ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাট তদানীন্তন ঢাকাস্থ মার্কিন কনস্যুলেট জেনারেল মিঃ আর্চার ব্লাড (Archer Blood) কর্তৃক অনুমােদন করানাে হয়। এ সম্পর্কে কিসিঞ্জার বলেছেন, “সেক্রেটারি রজার্স তাকে বলেছেন  যে তার ডিপ্লোম্যাটগণ রিপাের্ট না পাঠিয়ে দরখাস্ত লিখেছে। অন্যদিকে দিল্লীস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত কিনেথ কিটিং অনুরূপ রিপাের্টে এই হত্যাযজ্ঞ ও নৃশংসতায় সামরিক সাহায্য অবিলম্বে বন্ধের জন্য লিখে পাঠায়। এই দুটি রিপাের্ট ও আবেদনই বলা বাহুল্য প্রত্যাখ্যাত হয়।

৩.২ ঢাকাস্থ মার্কিন কনস্যুলেট কর্মচারীদের এবং কনস্যুলেট জেনারেল আর্চার। ব্লাডের আবেদন এবং দিল্লীর মার্কিন রাষ্ট্রদূতের রিপাের্টের প্রেক্ষিতে হােয়াইট হাউজ ও পেন্টাগণ কোনাে প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ রনি। কেননা প্রাক্তন সি, আই, এ বিশ্লেষক ও কিসিঞ্জারের দক্ষিণ এশিয়ার সহায়তাকারী হ্যারল্ড সান্ডার্স, যােশেফ সিসকো যিনি নিকট প্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক এসিস্টেন্ট সেক্রেটারি এবং উলিয়াম কার্গো—যিনি । অত্র এলাকার রিসার্ডসনের স্টান্ড অফিসার, এরা একত্রে মিটিংএ বসে ১৯৭১ সনের বসন্তে এই বিষয়ে ঐক্যমত পােষণ করে যে, বাঙালিরা। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর অত্যাচারের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য। হবে; এমনকি পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর নিকট গেরিলা তৎপরতাও ব্যর্থ হবে।১১

৩.৩  যেহেতু বিজয়ী হবে পাকিস্তান আর স্বাধীন বাংলাদেশের আন্দোলন পরাজিত হবে, সে জন্য জয়ের স্বপক্ষে কাজ করাই শ্রেয়। সুতরাং পাঠাও পাকিস্তানে অস্ত্র। দাও টাকা। মার্কিন ও বিশ্বজনমতকে শান্ত করার জন্য নিকসন সরকার বিভিন্ন প্রকার। কলা কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। পূর্বেই বলেছি পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ ঘােষণা দেয়া সত্ত্বেও পেন্টাগণ পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রেখেছিল। ১৯৭১ সনের ৩রা ডিসেম্বর পর্যন্ত মার্কিন সি-১৩০ মালবাহী বিমানে করে অস্ত্র পাঠিয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে মার্কিন সমরাস্ত্র কি পরিমাণে পাকিস্তানে এসেছিল তার কিছু বিবরণ —

ক. মার্কিন সহায়তা কর্মসূচি অনুযায়ী পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সাড়ে ৫ থেকে ৬ ডিভিশনকে অত্যাধুনিক মরণাস্ত্রে সুসজ্জিত করার এবং তাদের প্রশিক্ষণ দানের দায়িত্ব গ্রহণ করে পেন্টাগণ। পাকিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হতে আধুনিক ইনফ্যান্ট্রি অস্ত্রের মধ্যে রয়েছেসেমি অটোমেটিক রাইফেল, কারবাইন, হালকা ও মাঝারি মেশিনগান, ইনফ্যান্ট্রি মর্টার, ৪৭ ও ১০৬-এম এম ক্যালিবর রিকয়েললেস রাইফেল, ১০৫ ও ১৫৫ এম এম হােইৎসার, 

৩শ আমর্ড পারসােনাল ক্যারিয়ার,

২শ সােবম্যান, ২৫০টি শাফী, প্রায় ১০০ শ বুলডস, ৪শ ৬টি এম ৪৭

এম ৪৮ প্যাটন ট্যাঙ্ক।

এ ছাড়াও রয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং সরবরাহ এবং সংকেত পাঠাবার সমস্ত  উপকরণ। দুই মাসের উপযােগী গােলাবারুদ এবং উচ্চ শ্রেণীর ভ্যারিয়েবল টাইম ইলেকট্রনিক ফিউজ।

খ.  বিমান বাহিনী। ১০টি লকহিড, টি-৩৩ প্রশিক্ষণ বিমান, ৭টি লকহিড আরটি-৩৩-এ সন্ধানী প্রশিক্ষণ বিমান, ১২০টি এফ-৮৬ স্যার জেট জঙ্গী বােমারু বিমান, ২৬টি মার্টিন ক্যানবেরা বি-৫৭ বােমারু বিমান, ৬টি মার্টিন ক্যানবেরা আর বি-৫৭ বােমারু বিমান, ১৫ টি সিকোরগি এস ৫৫ হান্টার, ৪টি গ্রামান এইচ ইউ-১৬ এ আলবাট্রস সামুদ্রিক সন্ধানী বিমান, ১২টি লকহিড এফ-১০৪ এ স্টার ফাইটার, ২টি লকহিড এফ ১০৪ বি স্টার ফাইটার, ৬টি লকহিড সি-১৩০-ই হারকিউলিস পরিবহন বিমান, ৪টি ক্যামন এইচ-এইচ-৪৩ বি হাস্কি হান্টার এবং ২৫টি সেসনা টি-৩৭ বি জেট প্রশিক্ষণ বিমান। গ, নৌবাহিনী ৭টি উপকূলীয় মাইন সুইপার, ১টি আকর্ষক জাহাজ, ২টি তেলবাহী জাহাজ, ৪টি ব্যাটল জাতীয় পােত বিধ্বংসক, ২টি সি ভি জাতীয় পােত বিধ্বংসক, ২টি সি এইচ জাতীয় পােত বিধ্বংসক, এ ছাড়া একটি জলবাহী জাহাজ, দুটি আকর্ষক জাহাজ ও একটি তেলবাহী জাহাজ আমেরিকা ইতালির নিকট থেকে ক্রয় করে এবং তা পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়। একটি ডুবাে জাহাজ (পি এন এস গাজী) পাকিস্তানকে ধার দেয়া হয়।

৩.৪ এ ছাড়া বাংলাদেশে গেরিলা তৎপরতা বন্ধের জন্য বেশ কিছু নদীযান ও উপকূলীয় জল-যান পাকিস্তানকে আমেরিকা সরবরাহ করে। এ ছাড়া মার্কিন সামরিক সহায়তা কর্মসূচি অনুসারে পাকিস্তানের সকল বিমান ঘাঁটি ন্যাটোর মান অনুযায়ী তৈরি করা হয়। এই সব ঘাঁটিগুলাে হচ্ছে, মৌরীপুল, সামুঙ্গলি, দ্রিঘারােড, পেশােয়ার, কোহাট, রিশালপুর,  

লাহাের, সারগােদা, মুলতান, চাকলাল, নবাবশাহ, গিলগিট, চিত্রল, মাশির এবং মীরনশাহ। বাদিন, মুলতান ও পেশােয়ারে ভারতমুখী সেন্টো নির্ভর করা হয়। এই কর্মসূচিতে একটি মাইক্রোওয়েভ সংবাদ বিনিময় কেন্দ্রও তৈরি হয়।১২ অনেকের হিসেবে তখন পর্যন্ত পাকিস্তানকে দেয়া মার্কিন সামরিক সহায়তার মূল্যমান ১শ ২৯ কোটি ৫০ লক্ষ ডলার। এখানে এ কথা উল্লেখ করা নিষ্প্রয়ােজন যে, এ সব মার্কিন অস্ত্রশস্ত্রের প্রায় পুরােটাই ব্যবহৃত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এবং বাঙালি নিধন কার্যে।

৪. শুধুমাত্র এত সব মরণাস্ত্র পাঠিয়েই মার্কিন শাসকবৃন্দ সন্তুষ্ট থাকেনি। বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে ঠেকানাের সর্বশেষ প্রকাশ্য প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় বঙ্গোপসাগরে মার্কিন ৭ম নৌবহর বা টাস্ক ফোর্স-৭৪ পাঠানাের মাধ্যমে। ওয়াশিংটন স্পেশাল এ্যাকশন গ্রুপের (wSAG) পরামর্শ মনঃপুত না হওয়ায় নিকসন চাইলেন সােভিয়েতকে বুঝতে হবে সােভিয়েত অস্ত্র ব্যবহার করে পাকিস্তানকে বিভক্ত করা যাবে না।১৩।

৪.১  শুধু তাই নয়, আমেরিকা আশা করেছিল চীন পাকিস্তানের সহযােগিতায় এগিয়ে আসবে। যুদ্ধে চীন এগিয়ে এলে সােভিয়েত ইউনিয়ন নিশ্রুপ থাকবে না এবং তার ফলে আমেরিকার জড়িত হয়ে পড়াও অনিবার্য হয়ে উঠবে।

৪.২  নিকসন ব্যক্তিগতভাবে এই ঝুঁকি (পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধের) নিতে প্রস্তুত ছিলেন।১৪ এ ছাড়া রাশিয়া-মার্কিন হটলাইনের মাধ্যমে কিসিঞ্জার মস্কোকে অনুরােধ করেন যে, সে যেন পশ্চিম পাকিস্তান ধ্বংস করা থেকে ভারতকে নিবৃত্ত করে।১৫ ৪.৩ পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিপন্ন দেখে বঙ্গোপসাগরে টাস্ক ফোর্স বা সপ্তম নৌবহর পাঠানাের জন্য এডমিরাল মুরারকে নির্দেশ দেয়া হয়।১৬ এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বপ্রকার ঝুঁকি নিয়ে বল প্রয়ােগিক কুটনীতির ব্যবহার করতে আসে। বলাবাহুল্য বাংলাদেশের মূল ঘটনাবলির প্রতিই মার্কিন টাস্কফোর্সের লক্ষ্য ছিল। ৬ই ডিসেম্বর। ভিয়েতনামের টংকিন উপসাগরে অবস্থানরত নৌবাহিনীর কয়েকটি জাহাজ সমন্বয়ে টাস্কফোর্স-৭৪ গঠন করা হয় এবং ১০ই ডিসেম্বর এই বহর সিঙ্গাপুর পৌছে। ১২ই ডিসেম্বর টাস্কফোর্সকে বঙ্গোপসাগর অভিমুখে যাত্রা করার নির্দেশ প্রদান করা হয়। কিন্তু ইতিপূর্বেই রাশিয়া ৬-৭ তারিখের মধ্যেই ভারত মহাসাগরে রণপােতের প্রথম টাস্কফোর্স পাঠিয়েছিল এবং সপ্তম নৌবহরকে যথারীতি মােকাবিলার জন্য রাশিয়া দ্বিতীয় টাস্কফোর্স পাঠায়। এমতাবস্থায়, মার্কিন ৭ম নৌবহরকে  বঙ্গোপসাগর হতে ফিরিয়ে নিতে হয়। সম্পূর্ণ টাস্কফোর্সটি পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত ছিল এবং এর নেতৃত্ব দানকারী পারমাণবিক জাহাজটির নাম ছিল এন্টারপ্রাইজ। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই ৭ম নৌবহরটি আক্রমণাত্মক শক্তি সংগ্রহ করে বাংলাদেশের দিকে তীব্র গতিতে ছুটে এসেছিল। এই টাস্কফোর্স ৭ম নৌবহরে অন্তর্ভুক্ত ছিল—

ক.  ইউ.এস, এস, এন্টারপ্রাইজ, এটি ছিল ৭৫ হাজার টনের বিশাল ভারবাহিত জাহাজ, যা ছিল পৃথিবীর সর্ববৃহৎ যুদ্ধ জাহাজ এবং যে জাহাজটি ৫৭ দিনে ত্রিশ হাজার মাইল পুনঃতেল গ্রহণ ব্যতীত একটানা চলতে পারে। এটা আটটি অটোমেটিক রিয়্যাক্টরস শক্তিসম্পন্ন। এর চারটি গিয়ার বাষ্পীয় টারবাইন ৩৫ নট পর্যন্ত চলতে সক্ষম। স্বাভাকিভাবে ২৮৭০ জন পারসােনাল সত্ত্বেও জাহাজটি অরাে ২ হাজার লােকসহ ১০০টি বিভিন্ন ধরনের বিমান বহন করতে পারত। এই জাহাজের সঙ্গে ছিল ত্রিপােলী’—যা ছিল এমফিলিয়ান ম্যাসন্ট শিপ, ছিল গাইডেড মিসাইল সজ্জিত ‘কিং, তিনটি গাইডেড মিসাইল সজ্জিত ডোয়ার; ডেকাটুর; পরসনস এবং টারটার শ্যাম।

খ.  “দি ত্রিপােলী” ছিল ১৭ হাজার ১০ টন সম্পন্ন একটি বড় ধরনের এমফিবিয়ান য়্যাসন্ট যুদ্ধ জাহাজ। এই জাহাজটি বিশেষভাবে নির্মিত হয়েছিল যাতে ২৪টি মাঝারী, ৪টি বড় এবং চারটি পর্যবেক্ষক হেলিকপ্টার বহন করতে সক্ষম। সে ২১০০ জন অফিসার ও নৌসেনাসহ একটি নৌব্যাটালিয়ানকে অস্ত্রশস্ত্র, কামান, যানবাহন এবং অন্যান্য উপকরণ দ্বারা সজ্জিত করার ক্ষমতা বহন করত।

গ.  “দি কিং’ গাইডেড মিসাইল দ্বারা সজ্জিত ছিল। সে ভূমি থেকে শূন্যে ক্ষেপণাস্ত্র এবং টর্পেডাে দ্বারাও সজ্জিত ছিল।

ঘ. অনুরূপভাবে ডেস্ট্রয়ার, টারটার এবং ডেকাটরে ভূমি থেকে শূন্যে নিক্ষেপণযােগ্য ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা সজ্জিত ছিল এবং যা অত্যাধুনিক পারমাণবিক উপকরণ দ্বারা সমৃদ্ধ।১৭

৫.  স্বাধীনতা যুদ্ধের পরও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মার্কিন ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ১৯৭২ সনের ১৪ই ফেব্রুয়ারি মার্কিন প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কের বেতার থেকে একটি বার্তা প্রচার করা হয়েছিল। যার অনুবাদ উদ্ধৃত করা হলাে— বার্তাটির অনুবাদ । হেড কোয়াটার্স, আমেরিকান ফোর্সেস নেটওয়ার্ক, ইউরােপ এপিও, নিউইয়র্ক ৮৯৭৫৭ ১৭ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২। 

প্রিয় মহাশয়, ১৪ই ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ এই নেটওয়ার্ক বেতারের ০৮০০ সংবাদ প্রচারের অংশ হিসেবে প্রচারিত বাংলাদেশ সংক্রান্ত একটি খবরের পূর্ণ বিবরণের জন্য আপনি যে অনুরােধ জানিয়েছেন তার জবাবে আমরা সানন্দে এ সঙ্গে তা পাঠাচ্ছি “শিশু সাধারণতন্ত্র বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ দশ হাজারেরও বেশি লােককে আটক করেছেন বলে জানা গেছে। একজন সরকারি মুখপাত্র বলেছেন, গত বছরের শেষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে সহযােগিতার জন্য এদের গ্রেফতার করা হয়েছে। মুখপাত্র বলেন, আটক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক মামলা দায়েরের প্রত্যেকটি ঘটনাই পুরােপুরি তদন্ত করা হবে। সন্দেহক্রমে আটক ব্যক্তিদের সকলেই মুসলমান .. বাংলাদেশের নতুন শাসকেরা হিন্দু… এর মধ্যে কোন প্রীতির অবশেষও নেই। মার্কিন সশস্ত্রবাহিনীর সংবাদে আগ্রহের জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।”

ভবদীয় স্বাক্ষর—ডেভিড এইচ মিন্যাট

নিউজ ডিরেক্টর।১৯ এখানে বিশ্বজনমত বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বকে বিভ্রান্ত করার অপকৌশল গ্রহণ করেছিল নিকসন সরকার। স্বাধীনতা বিরােধী রাজাকার, আলবদর দালালদের স্বপক্ষে প্রচার এবং স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রপরিচালনায় অধিষ্ঠিত শেখ মুজিব ও তাঁর সরকারকে অপদস্ত করার জন্য এই সব বিভ্রান্তিকর অপকৌশল গ্রহণ করা হয়েছিল, শেখ মুজিবসহ তার সরকারকে হিন্দু বলে প্রচার করা হয়েছিল।

৫.১ এ প্রসঙ্গে স্বাধীনতা যুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ শুধুমাত্র অস্ত্রশস্ত্র, অর্থ সম্পদ ও নৌবহর দিয়ে পাকিস্তানকে সাহায্য করেই ক্ষান্ত হয়নি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ যেন অংকুরেই বিনষ্ট হয় তার অশুভ প্রয়াস চালিয়েছিল। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব হেনরি কিসিঞ্জার একটি বড় আকারের বই লিখেছেন। বইটির নাম দি হােয়াইট হাউস ইয়ার্স’। বইটির একুশতম অধ্যায়ের শিরােনাম ঃ “দি টিন্ট ঃ দি ইন্ডিয়া পাকিস্তান ক্রাইসিস অব ১৯৭১।” এই শিরােনামের মধ্যে ৮৬৯ থেকে ৮৭৩ পৃষ্ঠা পর্যন্ত একটি অধ্যায়ের নাম কনট্যাক্ট উইথ দ্য বাংলাদেশ একজাইলস্।” এই অংশে মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব হেনরী কিসিঞ্জার যা লিখেছেন সংক্ষেপে তা হলাে১৯৭১ সনের ৩০শে জুলাই প্রবাসী সরকারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্য জনাব কাইউম (কাজী জহিরুল কাইউম, যিনি মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর’ বইয়ের সাক্ষাৎকারে কিসিঞ্জারের কথিত মিঃ কাইউম যে তিনিই তা স্বীকার করেছেন) কলকাতাস্থ মার্কিন দূতাবাসে দেখা করে বলেন, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যােগাযােগ করার জন্য প্রবাসী সরকারের পক্ষে দায়িত্ব পেয়েছেন। কলকাতাস্থ মার্কিন কনস্যুল তাকে দুই সপ্তাহ পরে পুনরায় আসার জন্য অনুরােধ জানান এবং কলকাতা স্টেট চ্যানেলে বিষয়টি হােয়াইট হাউজকে জ্ঞাত করেন। এ সম্পর্কে কিসিঞ্জার লিখেছেন : ইসলামাবাদে এই গােপন সংযােগ প্রকাশিত হয়ে পড়লে তাদের জন্য মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে এবং ভারত এটা প্রকাশ করার জন্য যে উদ্যোগী হবে তা বলাই বাহুল্য; তা সত্ত্বেও বিষয়টি প্রেসিডেন্ট নিকসনকে অবহিত করে সংযােগ স্থাপন করার নির্দেশ প্রদান করা হয়। নির্ধারিত ১৪ই আগস্ট কাজী জহিরুল কাইউম পুনরায় দূতাবাসে উপস্থিত হন। তার প্রস্তাব ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝােতায় শেখ মুজিবকে উপস্থিত থাকতে হবে তাহলে তার গ্রুপ ছয় দফার ভিত্তিতে স্বাধীনতার চেয়ে কিছু কমে পাকিস্তানের সাথে সমঝােতায় আসতে রাজি আছে। কয়েক দিন পর দ্বিতীয় দফা বৈঠকে তিনি এই বলে মত প্রকাশ করেন যে, ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে এই ধরনের ‘ফেস সেভিং’ প্রস্তাব অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে, সে জন্য সমঝােতা প্রক্রিয়া দ্রুততর হওয়া প্রয়ােজন।

কিসিঞ্জার যােশেফ ফারল্যান্ডের মাধ্যমে ইয়াহিয়া খানকে বাংলাদেশ প্রবাসী সরকারের সঙ্গে সংযােগ করার কথা জানালে ইয়াহিয়া খান এই উদ্যোগকে স্বাগত জানায়। একই সাথে ফারল্যান্ড ইয়াহিয়া খানকে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার ও তাঁর সঙ্গে গােপন বৈঠকের পরামর্শ দিলে ইয়াহিয়া খান তাতে সম্মত হন। ২৭শে আগস্ট জনাব কাইউম এই সংযােগ দ্রুততর করতে চাইলে হােয়াইট হাউজ আরাে এক পা এগিয়ে আসে। ৪ঠা সেপ্টেম্বর ফারল্যান্ড ইয়াহিয়া খানকে বলেন যে, আমরা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে সংযােগ করেছি এবং জনাব কাইউমকে জানিয়ে দেয়া হয় ইয়াহিয়া খান এ ধরনের গােপন বৈঠকে রাজী আছেন। ৯ই সেপ্টেম্বর কলকাতার মার্কিন দূতাবাস জনাব কাইউমকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের আয়ােজন করতে বলে। কিন্তু জনাব কাইউম উল্টো সুরে শেখ মুজিবের মুক্তি দাবী করেই শুধু ক্ষান্ত হননি, তিনি পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানী সৈন্যের প্রত্যাহার, জাতিসংঘ কর্তৃক বাংলাদেশের নিরাপত্তার গ্যারন্টি এবং অবিলম্বে স্বাধীনতা দাবী করেন। 

[প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযােগ্য ইতিমধ্যে জনাব কাইউমের মার্কিন দূতাবাসের। সঙ্গে এই সংযােগ’-এর কথা ভারত সরকার অবগত হয়েছে এবং পররাষ্ট্র। মন্ত্রী খন্দকার মােশতাককে প্রকারান্তরে তখন থেকেই নজরবন্দি রাখা

১৪ই সেপ্টেম্বর জনাব কাইউম দূতাবাসকে বলেন যে, পররাষ্ট্র মন্ত্রী দেখা করতে অপারগ। ২১শে সেপ্টেম্বর ইয়াহিয়া খান ফারল্যান্ডের নিকট কলকাতার সংযােগ সম্পর্কে জানতে চান। ২৩শে সেপ্টেম্বর কাইউম তার প্রতিনিধি দ্বারা মার্কিন দূতাবাসকে জানান যে, ভারত সরকার তাদের সংযােগ’-এর কথা জেনে ফেলেছে এবং ফর্মালী হুঁশিয়ারী জানিয়েছে। বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ‘সংযােগের কথা বলাতে জনাব কাইউম অল্পক্ষণের মধ্যে দূতাবাসে এসে বলেন যে, ইন্ডিয়া চায় যে সমস্ত যােগাযােগ দিল্লীর মাধ্যমে হােক। ২৮শে সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কিন দূতাবাসে দেখা করে বলেন, বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছা—পূর্ণ স্বাধীনতা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ ব্যাপারে প্রভাব খাটানাে উচিত। ১৬ই অক্টোবর জনাব কাইউম মার্কিন কনস্যুল ও বাংলাদেশের এ্যাকটিং প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মিটিং নাকচ করে দেন। ২০শে অক্টোবর বাংলাদেশের উচ্চ পদস্থ অফিসার হােসেন আলী বলেন যে তার মিশন ইয়াহিয়া খানের নিকট বার্তা পাঠাতে আগ্রহী নয়। ‘অপরিহার্য সমাধান হলাে মুজিবের মুক্তি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা। অক্টোবরের শেষের দিকে ভারতীয় সংবাদপত্র ‘বিদেশী প্রতিনিধিদের সঙ্গে বাংলাদেশের যােগাযােগের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য হুমকি প্রদান করে। এইভাবে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের একাংশের সঙ্গে ও পাকিস্তানী সরকারের মধ্যে সমঝােতা প্রয়াস ব্যর্থ হয়।

৫.২  ড. হেনরি কিসিঞ্জারের এই অংশের সঙ্গে আরও কিছু তথ্যের সংযােজন প্রয়ােজনীয়। ‘দি কারেঞ্জি পেপারস্ এ বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক তথ্য রয়েছে। তার মধ্যে কলকাতার ‘নেগােশিয়েশন’ সম্পর্কে বলা হয়েছে, মার্কিন সরকার কলকাতায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে যােগাযােগ করেছিল। কিন্তু এরা এফেকটিভ ছিল না। স্টেট ডিপার্টমেন্ট সাের্স থেকে আরাে বলা হয় সেখানে কমপক্ষে আটটি কন্ট্যাক্ট মাের্স কাজ করছিল। ঐ সূত্র ধরে বলা হয়েছে তদানীন্তন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমদের সঙ্গে সি, আই, এ যােগাযােগ স্থাপন করেছিল। কিভাবে এবং কাদের মাধ্যমে যােগাযােগ স্থাপন করেছিল? ওয়াশিংটন সূত্র থেকে  প্রকাশ, স্যান্ডার্স আওয়ামী লীগের মােশতাক চক্রের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করেছিল।২২

৫.৩  হােক, মােশতাক চক্রের সঙ্গে যােগাযােগের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে আটকে দেয়া পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামাের মধ্যেই বাংলাদেশের জন্য অধিকতর স্বায়ত্তশাসন গ্যারান্টি করা। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাস। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের বৈঠক। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রী খন্দকার মােশতাকের নেতৃত্বে একটি দল জাতিসংঘের উদ্দেশ্যে রওনা হবে। প্রায় সব ঠিকঠাক, এমনকি টিকিট পর্যন্ত কাটা শেষ হয়েছে। এমন সময় ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে পড়ল। ষড়যন্ত্রের মূলকথা ছিল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমদ নিউইয়র্কে যাবেন এবং অকস্মাৎ মার্কিন নীতির কাছাকাছি একটি ঘােষণা দেবেন পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার বিকল্প হিসেবে। পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় কাঠামাের মধ্যে অধিকতর স্বায়ত্তশাসন অর্জনের লক্ষ্যে বাংলাদেশের কলকাতাস্থ থিয়েটার রােডের বিপ্লবী সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবেন এবং পাল্টা সরকার গঠন করবেন। আজ ভাবতে ভয় হয়, এই সর্বনাশা ষড়যন্ত্র ফাস না হলে না জানি আরাে কত লক্ষ প্রাণের আত্মহুতি দিতে হতাে এই স্বাধীনতা যুদ্ধে। এই গােপন আঁতাত প্রকাশিত হয়ে পড়লে প্রকারান্তরে খন্দকার মােশতাকের নজরবন্দি অবস্থায় দিন কাটাতে হয়। ফলে সি, আই. এ ও মােশতাকের ষড়যন্ত্র সে দিন সফল হয়নি।

৫.৪  এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি লিফলেট সেদিন মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। একাত্তরের অক্টোবর মাস মুজিবনগর সরকারের জন্য মারাত্মক সংকট কাল। নানা গুজব চারদিকে ছড়ানাে। নানা উপদলীয় কোন্দল। মুজিবনগর সরকারের আওতার বাইরে মুজিব বাহিনীর উপস্থিতি, পরামর্শ কমিটিতে ছােট ছােট চৈনিকপন্থীদের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য মৌলানা ভাসানীর চাপ, মন্ত্রী সভা সম্প্রসারণের জন্য রাজনৈতিক চাপ তখন প্রবল। তাছাড়াও যেটা সবচেয়ে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল তাহলে সরকারের অজ্ঞাতে পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝােতার প্রচেষ্টা। এমনি এক নাজুক অবস্থায় বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের অজান্তে মােশতাক চক্র বঙ্গবন্ধুর মুক্তিদানের শর্তে ছয় দফার ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় কাঠামাের আওতায় যুদ্ধ বিরতির জন্য প্রচেষ্টা শুরু করে। এই উদ্দেশ্যে সেদিন স্বাধীনতা না বঙ্গবন্ধু” এই মর্মে একটি প্রচারপত্র বিলি করা হয়। অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা চাইলে পাক জঙ্গী শাহী বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করবে। সুতরাং তাদের যুক্তি হলাে, পাকিস্তান  রাষ্ট্রীয় কাঠামাের ঢিলেঢালা কনফেডারেশন স্বীকার করে নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে আনা হােক, তারপর স্বাধীনতার বিষয়টি দেখা যাবে। কিন্তু কিসিঞ্জারের বইয়ের উল্লেখিত জনাব কাইউম সাহেব এক সাক্ষারে বলেছেন যে, খন্দকার মােশতাক বঙ্গবন্ধুকে আনার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছেন এটা আমি তাে বিশ্বাস করি না।২৪

৫.৫  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেখ মুজিবের জন্য চেষ্টা চালিয়েছে এ কথা মিথ্যা ও বানােয়াট। কেননা কিসিঞ্জারের সঙ্গে তদনীন্তন ওয়াশিংটনস্থ ভারতীয় রাষ্ট্রদূত টি.এন, কাউলের আলােচনায় কাউলের মনে এই প্রতীতিই জন্মলাভ করেছে যে, কিসিঞ্জারের ধারণা মুজিবকে বন্দি করে রাখা না হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঠেকানাে যাবে না। শুধু তাই নয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ বানচাল করার জন্য তার প্রয়াসের অন্ত ছিল।২৬

৫.৬ সকল চক্রান্তের পাশাপাশি ১৯৭১ সনের ২৬শে অক্টোবর যুগােশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো মার্কিন সি.বি.এস, টেলিভিশন নেটওয়ার্কের এক ইন্টারভিউ-এ একটি চাঞ্চলকর তথ্য প্রকাশ করেছিলেন। তিনি পাকিস্তান ভারতের আসন্ন সংঘাত এড়ানাের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিলেন যে, ইরানের শাহ আমাকে বলেছেন যে, তার এরকম ধারণা হয়েছে যে, ইয়াহিয়া খান যথেষ্ট নমনীয় হয়ে আসছে। অবশ্য আমি ইয়াহিয়া খানকে বলেছি যে, এটা শুধুমাত্র ভারত-পাকিস্তানের বিষয় নয়। বরং এটা যদিও পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ বিষয় তবুও এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রশ্ন। ২৭

৫.৭ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে লিফসুজ-এর সঙ্গে একটি তথ্য যোগ করে। বলেছেন যে, মার্কিন উদ্যোগে ইরানের শাহের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের অজান্তে মােশতাক চক্র পাকিস্তানের সঙ্গে একটি সমঝােতার কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছিল। এ সব চক্রান্ত ফাস হয়ে পড়েছিল। তাই লক্ষ্য করা যায় ১৯৭১ সালের ২৭শে নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ পররাষ্ট্র সচিব পদ হতে মাহবুব আলম চাষীকে সরিয়ে নেন এবং তার স্থানে এ ফতেহকে উক্ত পদে নিয়ােগ করেন।

৫.৮ মার্কিন প্রশাসন বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট নিকসন ও কিসিঞ্জার স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বে হতেই বাংলাদেশের অভ্যুদয় সম্পর্কে বৈরী মনােভাব গ্রহণ করে স্বাধীনতাকে বানচাল করার যাবতীয় প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। জুলাই মাসে হেনরি কিসিঞ্জার দিল্লী সফরের পর টি, এন, কাউল লিখেছেন, 

“remember meeting him when he landed in Delhi, I found him entirely Pro-Pakistan, anti-India, anti Bangladesh when I first met him.”২৮

৬.  বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি চীনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয় ১১ই এপ্রিল পিপলস্ ডেইলিতে ও জেনারেল ইয়াহিয়ার প্রতি চৌ-এন-লাইয়ের চিঠির মাধ্যমে। পিপলস্ ডেইলিতে সােভিয়েত প্রক্রিয়ার সমালােচনা করা হয় বাংলাদেশকে সমর্থনের জন্য। চৌ এন-লাই পাকিস্তানের জাতীয় স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষায় চীনের দ্ব্যর্থহীন সমর্থনের কথা জানান।২৯

৬.১  ১৯৭১ সনের জুন থেকেই পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্ত দিয়ে চীন প্রতিদিন একশতটি লরী ভর্তি সমর উপকরণ পাঠায়। এ ছাড়া অত্যন্ত অভিজ্ঞ সামরিক বিশেষজ্ঞ পাঠিয়েছিল যাদের উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীনতা বিরােধী। শক্তিকে ব্যাপক গেরিলাযুদ্ধবিরােধী প্রশিক্ষণ প্রদান।

৬.২  শুধু তাই নয়, শুধুমাত্র ১৯৭১ সালেই চীন পাকিস্তানে সরবরাহ করেছিল ৪৫ মিলিয়ন ডলারের সমর উপকরণ।

৬.৩  চীন পাকিস্তানকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিল যার অধিকাংশই ব্যবহার হয়েছিল বাঙালির হত্যাযজ্ঞে। পাকিস্তানকে চীন সরবরাহ করেছিল দুটি পদাতিক বাহিনী গঠনের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক সামরিক উপকরণ। যার মধ্যে ছিল এ. কে. রাইফেল, হালকা ও মাঝারী মেশিনগান, ৬০ এম এম, ৮০ এম, এম, ১২০ এম, এম, মর্টার ও ১০০ এম, এম, ফিল্ডগান। এ ছাড়া ২২৫টি টি-৫৯ মাঝারি ট্যাঙ্ক যা ঢাকার রাস্তায় দেখা যেত।

৬.৪ পাকিস্তান বিমান বাহিনীর জন্য চীন ১ স্কোয়াড্রন ১১.২৮ বােমারু বিমান ও স্কোয়াড্রন মিগ-১৯ ছাড়াও চীন ১৯৭১ মার্চের পরে সরবরাহ করেছিল বহু সংখ্যক গান বােট ও উপকূলীয় যান।

৬.৫ বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পরও চীনের বৈরীতা শেষ হলাে না। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর পরই ঢাকাস্থ চীনা কনস্যুল অপিস বন্ধ করার কথা চীন পাকিস্তানকে জানিয়ে দেয়। ১৯৭২ সনের ২১ আগস্ট চীন বাংলাদেশের জাতিসংঘ সদস্য অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে প্রথম ভেটো প্রয়ােগ করে। ১৯৭১ সনের বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে চৌ-এন-লাই এক অন্তহীন যুদ্ধের সূচনা মাত্র উল্লেখ করেছিলেন। তারই প্রেক্ষাপটে চীন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীল অবস্থা অব্যাহত রাখার কৌশল গ্রহণ করে। পশ্চিম জার্মানি ইরানের মাধ্যমে সরবরাহ করেছিল ৯০টি এফ-৮৬ স্যাবর  জেট এবং সরাসরি কোবরা ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ফ্রান্ডা সরবরাহ করে, ৬টি আলুম এত-৩ হেলিকপ্টার, ২৪টি মিরেজ ৩টি ফাইটার ও ৩টি ডুবাে জাহাজ।

৭.১ ইরান দিয়েছিল ২৪টি লকহিড সি-১৩০ হারকিউলিস পরিবহন বিমান।

৭.২  চীনের পাশাপাশি ইরান, সৌদি আরব ও লিবিয়া পাকিস্তানকে সমরাস্ত্র ও যুদ্ধের সময় বিমান বাহিনী দিয়ে সাহায্য করেছিল। ৮. বলাবাহুল্য বঙ্গবন্ধু হত্যার পূর্ব পর্যন্ত সৌদি আরব, চীন ও সুদান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করেনি। উল্লেখ যে, সুদান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তাবেদার রাষ্ট্র, যেখানে রয়েছে। মার্কিন সামরিক বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটিসমূহ।

 

সূত্র : ফ্যাক্টস্- এন্ড ডকুমেন্টস্–বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড – অধ্যাপক আবু সাইয়িদ