You dont have javascript enabled! Please enable it! 1980.04.18 | জাসদের রাজনীতি | সাপ্তাহিক বিচিত্রা - সংগ্রামের নোটবুক

প্রচ্ছদ কাহিনী

জাসদের রাজনীতি

।। কাজী জাওয়াদ।।

‘৬৯ এর আগে থেকে ছাত্রলীগের মধ্যে যারা আপেক্ষিক প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা করতেন তাদের নেতা হিসেবে সিরাজুল আলম খান পরিচিত ছিলেন। এর আগে ছাত্রলীগের মধ্যে গণতান্ত্রিক সমাজবাদ নিয়ে আলোচনা হতো। এক সময় ছাত্রলীগ কার্যালয়ে গণতান্ত্রিক সমাজবাদ নিয়ে ৫ দিনব্যাপী আলোচনা হয়। তখন থেকেই কর্মীদের মাঝে এই ধারণা দানা বাঁধছিল যে, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র পাশাপাশি চলতে পারে না। সমাজতন্ত্র ছাড়া জনগণের মুক্তি আসতে পারে নাই। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব তখন পিডিএমে (পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট) যোগদান করে। ছাত্রলীগ ৬ দফা প্রচার করতে গিয়ে অর্থনৈতিক রাজনৈতিক মুক্তির কথাও প্রচার করে। ‘৭০ এর নির্বাচনের সময় একটি সাইক্লোস্টাইল করা পত্রিকাও বিলি করা হয় – যাতে স্বাধীনতার কথা মোটামুটি স্পষ্ট ভাবে বলা হয়। নির্বাচনের পর ৫ দিন ৫ রাত ধরে ছাত্রলীগের এক বর্ধিত সভা হয়। সভার আলোচ্য বিষয় ছিল স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ। তখন ছাত্রলীগের একটা অংশ পরিপূর্ণ স্বাধীনতার বিরোধিতা করতে থাকে। সভার পর শেখ মুজিবের বাসায় গেলে তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা বাড়াবাড়ি করছো।’ ৩ রা মার্চ পল্টন ময়দানে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন শাজাহান সিরাজ এবং পতাকা উত্তোলন করেন আ, স, ম আবদুর রব। শেখ মুজিব এই সভায় এসে উপস্থিত হন।

স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারতীয় মেজর জেনারেল ওবানের প্রত্যক্ষ পরিচালনায় বি এল এফ নামে একটি বাহিনী গঠন করা হয়৷ যা পরে মুজিব বাহিনী হিসেবে পরিচিত হয়। (সিরাজুল আলম খান ছিলেন তার অন্যতম নেতা) যদিও বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব বাহিনী যুদ্ধরত ছিল। শেখ মুজিবের অবর্তমানে তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতারা ভারতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা পোষণ করতে থাকেন। সিরাজুল আলম খান ছাত্রলীগের এরই একটি অংশের নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

৭২ এ শেখ মুজিব ফিরে আসার পর আওয়ামী লীগের (মূলতঃ ছাত্রলীগ) ‘র্যাডিক্যাল ‘ গ্রুপ তাকে পার্টি প্রধান হওয়ার প্রস্তাব দেন। পাশাপাশি একটি ফোরাম গঠন করা হয়। ফোরামের অস্তিত্ব আগেও ছিল। তাতে আবদুর রাজ্জাক, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব, আরিফ আহমেদ, আ ফ ম মাহবুবুল হক, শেখ ফজলুল হক মনি, হাসানুল হক ইনু, শরীফ, নুরুল আম্বিয়া প্রধানতঃ এরাই সমাজতন্ত্রের সদস্য ছিলেন। ছাত্রলীগের মধ্যে দিয়ে বক্তব্য তুলে ধরা হয়। ডাকসু নির্বাচন এল। নির্বাচনের আগে সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ কায়েম করার ব্যাপারে বটতলায় এক সভা হবে। ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের দুটি প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এবং দুটোই পরাজিত হয়। ছাত্রলীগের সম্মেলনে স্পষ্ট বক্তব্য সিদ্ধান্ত আকারে আসে যে ‘শ্রেণী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই আমাদের লক্ষ্য। ‘ ছাত্রলীগের অপর অংশ মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে শরীক হয়। শ্রমিক লীগের মধ্যেও এই বক্তব্য নিয়ে বিভক্তি হয়। ৭২ এর মার্চ মাসে শ্রমিক জোটের মাধ্যমে বিপ্লবী সরকার গঠনের প্রস্তাব করা হয়, এর ফলে বিরোধ তীব্র হয়ে ওঠে।

১৯৭২ সালের ১৭ ই সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবস উপলক্ষে পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগ আয়োজিত জনসভায় আ স ম আবদুর রব একটি পার্টি গঠন করার ইঙ্গিত দেন। ৩১ শে অক্টোবর জাসদের ৭ সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জলিল এবং প্রাক্তন ছাত্রনেতা আ স ম আবদুর রব। সদস্যরা হলেন শাজাহান সিরাজ, নূরে আলম জিকু, বিধান কৃষ্ণ সেন, সুলতানউদ্দিন আহমেদ এবং রহমত আলী। ১৩ ই নবেম্বর সিদ্দিক মাস্টারের লাশ সহ সাংবাদিক সম্মেলন করা হয়। ২৪ শে ডিসেম্বর এক্সট্রা কাউন্সিল করে ১০৫ সদস্যের সাংগঠনিক কমিটি গঠন করা হয়। প্রথমে শোনা যায় আবু তাহের এই নতুন দলের নেতা হবেন। কিন্তু পরে তাকে কোন কমিটিতেই দেখা যায় নি। এলেন মেজর (অবঃ) জলিল।

আত্মপ্রকাশের আগে থেকেই জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সম্ভাব্য কাঠামো আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বৈরিতা প্রকাশ করে আসছিল। এই বৈরিতার প্রকাশ সভা সমিতি মিছিল ইত্যাদিতে সীমাবদ্ধ ছিল। মূলতঃ ছাত্রলীগ এবং শ্রমিক লীগের সাংগঠনিক আওতায় আন্দোলন পরিচালিত হতো৷ এই সব আন্দোলন চালানোর জন্য এই সময় থেকেই জাসদকে সরকারী হামলার স্বীকার হতে হয়। বৈরীতার ফলশ্রুতিতে জনগণের কাছে এটা আওয়ামী লীগের অন্তর্দ্বন্দ্ব হিসেবে আর থাকলো না। নতুন সংগঠিত শক্তি হিসেবে জাসদের অভ্যুদয় ঘটলো।

ছাত্রলীগের এক বিরাট কর্মী বাহিনী জাসদের হয়ে কাজ করার ফলে জাসদ পার্টি হিসেবে বিস্তৃতি লাভ করে। তাছাড়া স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পর অন্য কোন সুগঠিত রাজনৈতিক দল না থাকায় জাসদের জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়ার যথেষ্ট উপযুক্ত ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে আওয়ামী লীগের এক তরুণ অংশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেনি কিন্তু বিশ্বাস করতো আওয়ামী লীগ জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন করতে পারবে না। তাই বিকল্প রাজনৈতিক দল হিসেবে এরা জাসদকে গ্রহণ করেন।

জাসদের একজন নেতৃস্থানীয় কর্মী এ সময়ের বর্ণনায় বললেন, ‘আওয়ামী লীগ শাসনামলে অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে জাসদ একের পর এক কার্যক্রম গ্রহণ করে। তাই জনগণও আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেয়। ১৯৭৩ সালে ডাকসু নির্বাচনে আ ফ ম মাহবুবুল হকের নেতৃত্বে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। কিন্তু সরকারী ছাত্রলীগ ব্যালট বাক্স ছিনতাই করলে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হতে পারেনি৷ শেখ মুজিব সরকারের অব্যবস্থা এবং গণতন্ত্র হত্যার খেলার বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যকার চাপ অসন্তোষ জাসদ অত্যন্ত কুশলীভাবে জনসমর্থন আদায়ের জন্য সংগঠিত করতে সক্ষম হয়। শেখ মুজিব সরকার জাসদের মিটিং মিছিল বানচাল করে দেয়ায় প্রায় প্রতি সভাতেই ভাড়াটিয়া বাহিনী দিয়ে হামলা করতো। এক পর্যায়ে আওয়ামী নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরও এসব হামলায় নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে। দেশে তখন চলছিল হত্যা গুম খুন জেল জুলুম অত্যাচার।

জাসদ সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য ঘোষণা করায় এবং সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলনের ডাক দেয়ায় অনেক বামপন্থী কর্মীও জাসদে যোগদান করেন।

১৯৭৫ সালে সমস্ত রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ করে বাকশাল গঠন করার পর জাসদ গোপনে গণবাহিনী গঠন করার ডাক দেয়। তখন গণবাহিনীর পক্ষ থেকে ‘লাল ইশতেহার ‘ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করা হয়। এ সময় গণবাহিনী সশস্ত্র বাহিনী হিসেবে গড়ে উঠতে থাকে৷

‘৭৫ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর জাসদ আবার প্রকাশ্যে সংগঠিত হতে থাকে এবং ৭ ই নবেম্বর সিপাহী জনতার অভ্যুত্থান সংগঠিত করে বলে দাবী করে।

৬৫/৬৬ সালে ছাত্র নেতাদের মধ্যে যে রাজনৈতিক আদর্শের বীজ রোপিত হয় ১৯৭৫ সালের ৭ ই নভেম্বর সে আদর্শ একটি সুনির্দিষ্ট পরিণতি লাভ করে।

ঘোষণাপত্র

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল প্রথম যে ঘোষণা পত্র প্রকাশ করে বর্তমান পরিস্থিতিতে তা সংশোধন করা অপরিহার্য বলে মনে করে। তাই সে ঘোষণাপত্র জাসদ কার্যালয় থেকে সংগ্রহ করা যায়নি। কোন রাজনৈতিক এবং আর্থ- সামাজিক কারণে একটি দলের জন্ম তা ঘোষণাপত্রেই বিস্তারিত লেখা থাকে। সময়ের প্রেক্ষিতে ঘোষণাপত্র হয়তো পরিবর্তিত হতে পারে কিন্তু প্রথম ও মূল ঘোষণাপত্র ছাড়া কোন দলের রাজনীতির ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব নয়। সম্ভব নয় দলটি সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা ছিল কিনা তা বিচার করা।

ঘোষণাপত্র না পাওয়া গেলেও জাসদের পক্ষ থেকে একটি কর্মসূচী আমাদের দেয়া হয়। এ কর্মসূচী এ বছরের ১৯ শে জানুয়ারী এক সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করা হয়। কর্মসূচীর শুরুতে একটি মুখবন্ধ রয়েছে। যেহেতু ঘোষণাপত্র ছাড়া কোন কর্মসূচীর উপযোগিতাই বিবেচ্য হতে পারে না তাই এ কর্মসূচী সমালোচনা গ্রাহ্য নয়। এ কথা সত্য যে জাসদ একটি বৃহৎ বিরোধী দল৷ ছাত্র সমাজের মধ্যে এক বিরাট অংশ জাসদের সমর্থক এবং এর রয়েছে এক বিরাট শৃঙ্খলাবদ্ধ শিক্ষিত কর্মী বাহিনী। তাছাড়া আন্দোলন করেই জাসদ জনপ্রিয় হয়েছে এবং আন্দোলনের মধ্যেই জাসদ এখনও রয়েছে বলে দাবী করা হয়। আমরা মনে করি এই কর্মসূচীর মুখবন্ধ বর্তমানে জাসদের ঘোষণাপত্র বলে বিবেচিত হতে পারে। জাসদের পক্ষ থেকে আমাদের তেমন আভাসই দেওয়া হয়েছে।

আন্দোলন ঘটনা – ৭ নভেম্বর

জাসদের আন্দোলনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ১৭ ই মার্চে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও, ৭ ই নভেম্বর সিপাহী জনতার অভ্যুত্থান এবং ১৯৭৬ সালের মার্চ মিছিল। এর একটিকেও শেষ পর্যন্ত জাসদ চূড়ান্ত পরিণতিতে নিয়ে যেতে পারেনি। ১৭ ই মার্চের ঘেরাও আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে রক্ষীবাহিনীর গুলিবর্ষণ এবং গ্রেফতার, ৭ ই নভেম্বর অভ্যুত্থান গ্রেফতার, বায়তুল মোকারমের সভায় পুলিশের গুলী ও ধরপাকড়, ঘোষিত লংমার্চ ব্যর্থ এবং মার্চ মিছিল হামলা ব্যর্থতা এবং গ্রেফতারের মধ্যে দিয়ে শেষ হয়।

৭ ই নভেম্বরের পর ভারতীয় হাই কমিশনে হামলা জাসদের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটে ব্যর্থতা এবং মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে।

দ্বন্দ্ব

যে কোন রাজনৈতিক দলের মধ্যেই রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকতে পারে। এ দ্বন্দ্ব না থাকলে সে দলের বিকাশ ঘটেনা। ‘৭৫ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর জাসদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব তীব্র হতে থাকে। এসব দ্বন্দ্বের ফলশ্রুতিতেই রাজনৈতিক দলবিধি চালু করার পর জাসদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয়। জাসদ নেতৃবৃন্দ জাসদ কখনও বিভক্ত হয়নি এ কথা বললেও দুটো জাসদের অবস্থিতিই জাসদের বিভক্তিকে প্রকাশ করে।

সম্মেলন ১৯৮০

জাসদের দ্বিতীয় জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এ বছরের ২৯ ও ৩০ মার্চ ঢাকার রমনা গ্রীনে। সম্মেলনে সকল মতানৈক্য অপ্রকাশিত রেখে একটি জাতীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সম্মেলনে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো লক্ষীপুর সাংগঠনিক জেলার নামে প্রচারিত একটি পুস্তিকা।

সম্মেলনে কার্যনির্বাহী সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ ‘রাজনৈতিক রিপোর্ট’ পেশ করেন। রিপোর্টটি জাসদ এখনও প্রকাশ করতে চাইছে না সংশোধনের জন্য।

দ্বিতীয় জাতীয় সম্মেলনে জাসদের মূল শ্লোগান ছিল ‘স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।’

সমালোচনা / আত্মসমালোচনা

প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই সমালোচকরা জাসদকে ভারতের পঞ্চম বাহিনী বলে অভিহিত করেন। সমালোচকদের তীব্র সমালোচনা এবং বিভিন্ন গৃহীত কর্মসূচী সম্পর্কে স্পষ্ট ব্যাখ্যা না থাকায় জাসদ সম্পর্কে ব্যাপক জনগণ বিভ্রান্ত হতে থাকে। স্বাধীনতার পর থেকে নবগঠিত দল জাসদের চরিত্র সম্পর্কে কোন পরিষ্কার ধারণা না থাকায় জাসদ সম্পর্কে দ্বিধা ও সন্দেহ সাধারণ মানুষের মন থেকে কখনও কেটে যায়নি। জাসদ গৃহীত কর্মসূচী জনতার অজ্ঞাতেই গৃহীত হয়েছে বলে কালাতিক্রমে সে সন্দেহ আরও বদ্ধমূল হয়েছে৷

এ বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায় শাজাহান সিরাজের রাজনৈতিক রিপোর্টে। ‘শ্রমিক শ্রেণী ও জনতার অজ্ঞাতেই আমাদের দেশে ৭ নবেম্বর সংগঠিত হয়েছে। অভ্যুত্থান সম্পর্কে কোন ধারণা তাদের ছিল না, আমরা পূর্বে এ সম্পর্কে তাদের কোন ধারণাও দেইনি। গুরুত্ব সহকারে তাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গেও আমরা শারিরীক ভাবে সম্পর্কিত ছিলাম না। কাজেই বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করে অভ্যুত্থান সম্পর্কে ধারণা দেয়ার দুরূহ কাজটি আমরা করিনি। (বস্তুতঃ সত্যি বলতে কী অভ্যুত্থান সম্পর্কে আমাদেরও তেমন স্পষ্ট ধারণা ছিল না।)

৭ নবেম্বর সকালে সামরিক আইন জারি, শহীদ মিনারের জমায়েত এবং পরদিন বায়তুল মোকাররমের জনসভায় গুলী বর্ষণ ইত্যাদি ঘটনাবলী অভ্যুত্থানে আমাদের পরাজয়ের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। এরপরও সংগঠিত ভাবে পশ্চাদপসরণের কৌশল গ্রহণ না করে আমরা আরও শক্তি সংগ্রামে অবতীর্ণ হলাম। স্বাভাবিক ভাবেই, রাষ্ট্রশক্তির বেপরোয়া আঘাতে আমরা অসহায় হয়ে গেলাম। বিরক্ত জনগণও আমাদের কার্যক্রমে সাড়া দেননি, কারণ তখন জনগণের মনে কামনা ছিল একটু স্বস্তি।

৭ নবেম্বরের পর থেকে সংগঠনের উপর সরকারী আক্রমণ যেভাবে নেমে আসছিলো, তাকে মোকাবিলা করতে আমরা সক্ষম হইনি। এমনি চরম প্রতিকূল অবস্থায় গোপনে সংগঠন ও আন্দোলন পরিচালনা করা সম্ভবপর ছিল না। প্রয়োজন দেখা দিল প্রকাশ্য ভাবে আত্মপ্রকাশ করার। এরই ধারাবাহিকতায় সরকার যখন রাজনৈতিক দলবিধি (পি পি আর) বাস্তবায়নে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কিত ঘোষণা দেয়, আমরা তার সুযোগ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিই। এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কোন দ্বিমতের অবকাশ থাকতে পারে না৷

১৯৭২ সালে জনগণের রায় (!) নিয়ে সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য জাসদের প্রতিষ্ঠা হলেও তৎকালীন সরকার সম্পর্কে কোন স্পষ্ট ব্যাখ্যা জাসদের নেই।

জাসদ জনগণের দূর্দশার কথা বলে জাসদ প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা খুঁজতে চাইছে৷ কিন্তু এ দূর্দশা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে এ সম্পর্কেও কোন সুস্পষ্ট বক্তব্য মুখবন্ধে নেই।

সাম্রাজ্যবাদ এবং তৃতীয় বিশ্বের জনগণের অন্যতম প্রধান শত্রু দুই পরাশক্তির ভূমিকা সম্পর্কেও কোন সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা জাসদের কাছ থেকে পাওয়া যায় না। একটি ‘বৈজ্ঞানিক ‘ রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে এগুলো আশা করা সংগত। কারণ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করেই একটি রাজনৈতিক দল জনগণকে রাজনৈতিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত করে তোলে।

জাসদ সভাপতি বলেছেন, দেশের বর্তমান শাসকরা মার্কিস সাম্রাজ্যবাদের তল্পি বহন করছে। (সাক্ষাৎকার – মেজর (অবঃ) জলিল দ্রষ্টব্য) এবং জাসদ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করবে। মার্কসবাদ অনুশীলনকারী যে কোন ব্যক্তিই স্বীকার করবেন যে, দেশে সাম্রাজ্যবাদের অবস্থান থাকলে বিপ্লব সমাজতান্ত্রিক হতে পারে না। সেক্ষেত্রে দেশকে সাম্রাজ্যবাদের কবল মুক্ত করাই হবে প্রধান কাজ। এটা করতে গেলে জাতীয় ধনীরাও বিপ্লবের বা বিপ্লবী পার্টির মিত্র হিসেবে কাজ করতে পারে।

জাসদ বিপ্লবের স্তর নির্ধারণ করেছে সমাজতান্ত্রিক। (সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সাক্ষাৎকার দ্রষ্টব্য) এ ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের মত একটি অনগ্রসর দেশে বিপ্লবের স্তর সমাজতান্ত্রিক হতে পারে কিনা এ ধরণের প্রশ্ন রয়েছে। মার্কসবাদ যারা অনুশীলন করেন তারা নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেন যে, পুঁজির চূড়ান্ত বিকাশের পরই একটি দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হতে পারে। কোন দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আর একটি পূর্বশর্ত রয়েছে। তা হলো কোন দেশে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার পরই কেবলমাত্র দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হতে পারে। বাংলাদেশে এখনও জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়নি। জাতীয় গণতান্ত্রিক অধিকারও অসম্পূর্ণ রয়েছে। (সাক্ষাৎকার – মেজর (অবঃ) জলিল)

উপরের শর্তগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ইউরোপের দেশগুলোতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হতে পারে। এ ছাড়া যে সব দেশে পুঁজিবাদের চরম বিকাশ ঘটেছে অর্থাৎ কোন সাম্রাজ্যবাদী দেশেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হতে পারে। লেনিন রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করেছিলেন যখন রাশিয়া শিল্পোন্নত দেশ ছিল। সে দেশের সাম্রাজ্য বিস্তারের আকাংক্ষা ছিল, উপনিবেশও ছিল। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সমূহের মধ্যে সমগ্র বিশ্ব ভাগাভাগি করে নেয়ার লক্ষ্যে এই দেশটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণও করেছিল৷

তাছাড়া অনুধাবন করতে হবে যে, আমাদের দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বর্তমান অবস্থা থেকেই করা সম্ভব কিনা। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে জনগণকে সামিল করতে হলে বিপ্লবের আহবান নিয়ে যেতে হবে জনগণের কাছে৷ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্য নির্ধারিত হবে ব্যক্তি মালিকানা উচ্ছেদ এবং উৎপাদনের সামাজিকীকরণ। আমাদের দেশেন যে ৫৭% ভাগ ভূমিহীন কৃষক তারাও ব্যক্তিমালিকানা উচ্ছেদের বক্তব্যে কোন দৃশ্যতঃ লাভ খুঁজে পাবে না এবং সে জন্যই তাদের কাছে বিপ্লব মনে হবে অর্থহীন। পর্যায়ক্রমে অগ্রসর না হলে সামান্য জমি বা সম্পদ যাদের হাতে আছে তারাও বিপ্লবের মিত্র হবে না।

জাসদ প্রধান শত্রু হিসেবে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকারকে, যদিও জাসদের ক্ষমতা দখলের কোন লক্ষ্য এখন নেই। (মেজর (অবঃ) জলিলের সাক্ষাৎকার দ্রষ্টব্য) এ দুটি বক্তব্য পরস্পর বিরোধী। জাসদের ক্ষমতা দখলের কোন লক্ষ্যই যদি না থাকে তবে জাসদ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করবে কেন? বর্তমান সরকারকে উৎখাত করে জাসদের নেতৃত্বে জনগণ কি অন্য কোন শত্রুকে এনে ক্ষমতায় বসাবে? জনগণ যদি আজই চায় তবে জাসদ কি জনগণের প্রত্যাশাকে পূরণ করতে পারবে?

জাসদ সভাপতি বলেছেন, আফগানিস্তানে রাশিয়া আগ্রাসন হামলা চালিয়েছে এবং রাশিয়া একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ। বিশ্ববিপ্লবের নেতা হওয়ার যোগ্যতা রাশিয়ার আছে। (সাক্ষাৎকার দ্রষ্টব্য) মার্কসবাদ অনুশীলন এবং অধ্যয়ন কারী যে কোন ব্যক্তিই জানেন যে একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ কখনও আগ্রাসী হতে পারে না।

স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে জাসদ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের আহবান জানিয়েছে। জাসদ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে। জাসদ সভাপতি বলেছেন, আওয়ামী লীগ বাকশাল বাদ দেয়নি। যেমন জাসদ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বক্তব্য বাদ দেয়নি। কিন্তু যদি উভয়কেই আপোষ ফর্মুলার ভিত্তিতে ‘সমাজতন্ত্র ‘ ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র বাদ দিতে হয় তবে ৭২ এর আওয়াজ লীগের কেন্দ্রবিন্দুতে ফিরে যাওয়ার প্রবণতা বলে জনগণ সন্দেহ করবে। জাসদ কর্মীদের মধ্যে তা প্রতিবাদ হিসেবে এসেছে।

জাসদকে বলা হচ্ছে একটি সমাজতান্ত্রিক গণসংঠন এবং এর পরিচালণায় রয়েছে বিপ্লবীরা। জাসদ একটি রিক্রুটিং প্লট ফরম কিসেবে কাজ করে। (সাক্ষাৎকার)। রিক্রুটিং গণসংগঠনের মাধ্যমে বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার প্রক্রিয়া আমাদের দেশে একাধিকবার পরিক্ষিত হয়েছে এবং সেসব ক্ষেত্রে বিপ্লব সফল হয়নি। গণসংগঠনের মাধ্যমে যে প্রতিবিপ্লবী অনুপ্রবেশ ঘটে তা কি রোধ করা যায়? জাসদ কি প্রতিবিপ্লবীদের অনুপ্রবেশ এবং ভাঙ্গনের প্রক্রিয়া রোধ করতে পেরেছে?

জাসদ বা সম্ভাব্য বিপ্লবী সংগঠনের নেতৃত্ব ‘সমাজতান্ত্রিক গণসংগঠনে’ র তত্ত্বটি হয়তো সঠিকভাবে দিতে পারছেন না। যে কারণেই জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি এবং বিভেদ আরো বেড়ে যাবে।

মেজর (অবঃ) জলিল বলেছেন যে, ১৭ ই মার্চ জাসদ কোন হঠকারিতা করেনি৷ হঠকারিতা করেছে রক্ষী বাহিনী। (সাক্ষাৎকার) । এখানে ১৭ মার্চের আন্দোলন সম্পর্কে রাজনৈতিক রিপোর্ট থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে।

“১৭ মার্চ আন্দোলন সম্পর্কে সেদিন যে মূল্যায়নই আমরা করি না কেন, বস্তুতঃ এটি আন্দোলন বিকাশে সহায়ক হয়নি বরং আমাদের জন্য বয়ে এনেছে একটি শিক্ষা পরবর্তী ঘটনাবলী ও জনগণের প্রতিক্রিয়াই তার প্রমাণ। ১৭ মার্চের পূর্বে বাংলাদেশের সমাজ কাঠামো সম্পর্কে আমাদের কোন সুস্পষ্ট বক্তব্য ছিল না। স্বভাবতই শত্রু মিত্র নির্ধারণ ও আন্দোলনের রূপ রেখা সম্পর্কে আমাদের বিজ্ঞান ভিত্তিক ধারণা ছিল অনুপস্থিত। শ্রমিক ও পেশাভিত্তিক জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে না তুলে, সে আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করে এবং গণতান্ত্রিক ধারাকে পরিহার করে সংগ্রামের দিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়ার কারণেই আমাদের বহু কাঙ্ক্ষিত সংগঠন ও আন্দোলনকে সঠিক লক্ষ্যে এগিয়ে নিতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। বস্তুতঃ তৎকালীন পরিস্থিতিতে আমাদের উচিৎ ছিলো শ্রমিক ক্ষেতমজুর কর্মচারী সহ নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর পেশাভিত্তিক আন্দোলনের ওপর সর্বাধিক জোর দেয়া এবং এর ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আঘাতে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা’ (পৃঃ ১৪, ১৫)।

জাসদকে গুণ সংগঠন হিসেবে নির্ণিত করলে জাসদের মধ্যে সমাবেশ ঘটেছে প্রতিক্রিয়াশীল বিভিন্ন ধারাও। এ কারণেই জাসদের মধ্যে সুস্পষ্ট একটি দ্বন্দ্ব দেখা যাচ্ছে। দ্বন্দ্বের একদিকে রয়েছে আপোষের মনোভাব যাকে রাজনৈতিক ভাষায় বলা যায় ডান বিচ্যুতি এবং অন্যদিকে বাম হঠকারিতা বা চে গুয়েভারা ধরণের বিপ্লবী লাইন। বাম হঠকারী চিন্তার উপস্থিতির জন্যই জাসদের অভ্যুত্থান করে ক্ষমতা দখলের মনোভাব দূর হয়ে যায় নি। জাসদের মধ্যেকার এ ডান বিচ্যুতি এবং বাম হঠকারী লাইনের দ্বন্দ্বের একটি প্রমাণ পাওয়া যায় ‘রাজনৈতিক রিপোর্ট ‘ এবং লক্ষ্মীপুর জেলা কমিটির প্রচারিত পুস্তিকা থেকে৷

বিভ্রান্তি

প্রতিষ্ঠালগ্নের আগে থেকেই জাসদ সম্পর্কে জনমনে সন্দেহ বিরাজ করছিল। প্রতিষ্ঠার পর সে বিভ্রান্তি অপেক্ষাকৃত দৃঢ় ভিত্তি লাভ করে। কারণ স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে শেখ মুজিবের ভাবমূর্তির উপর জাসদের আঘাত জনগণকে বিভ্রান্ত করে।

তাছাড়া জাসদ ছাত্রভিত্তিক রাজনীতি করেছে শুরু থেকেই আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে থেকেও জাসদের বিপ্লবী লাইনের অনুসারীরা। এ কারণে সামাজিক সংস্কার থেকে জনগণ একে ধরে নিয়েছে ছাত্রদের (তরুণদের) পার্টি হিসেবে। যে জন্যে জনমনে আস্থা পেতে জাসদের অসুবিধা হচ্ছে।

জাসদের অন্যতম তাত্ত্বিক এবং মূলনেতা সিরাজুল আলম খানকে (জাসদ কর্মীরা দাদাভাই বলে সম্মোধন করেন)। অনেকে মনে করেন তিনি ট্রটস্কিপন্থী৷

শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর তার সম্পর্কে জাসদের মূল্যায়ন বিভ্রান্তি আনছে৷ যেমন সভাপতি বলেছেন, ‘শেখ মুজিব সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী ‘ এবং রাজনৈতিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘জনগণের সামনে নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল আওয়ামী লীগ। পূর্ব বাংলার জনগণের মুক্তির প্রশ্নে আওয়ামী লীগের দুটি ধারার স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এর একটি ছিল আপোষমুখী, অন্যটি ছিল স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক প্রশ্নে আপোষহীন। এই আপোষহীন ধারার প্রতিনিধিরাই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগে ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশে’ র প্রস্তাব উথ্বাপন করেছিলো। পরবর্তী কালে জাতি অবাক বিষ্ময়ে লক্ষ করেছে সত্তর সালের সূচনাপর্বে পূর্ব বাংলায় জনগণের আন্দোলন যখন সশস্ত্র লড়াইয়ে রূপান্তরিত হওয়ার পথে, সেই ক্রান্তিকালীন সময়ে জনগণের ম্যান্ডেট লাভকারী দল আওয়ামী লীগের নেতা জনাব শেখ মুজিবুর রহমান একটি আপোষ মিমাংসায় উপনীত হওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় মশগুল। ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সেই পর্বে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের আপোষহীন ধারার প্রতিনিধিদের নেতা জনাব সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বাধীন যুব ছাত্র নেতৃত্বের চাপে এবং গণঅভ্যুত্থানের তোড়ে শেষ পর্যন্ত শেখ মুজিব স্বাধীনতার পক্ষে বক্তব্য রাখতে ব্যর্থ হন। তারপর পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা পাগল জনগণের দুনিয়া কাঁপানো গণজাগরণঃ যে সশস্ত্র লড়াইয়ের সূচনা করে, তাই ছিল আমাদের মহান গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধ। ‘

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দুই পরাশক্তির ভূমিকা এবং রাশিয়া সম্পর্কে মূল্যায়ন যথেষ্ট বিভ্রান্তি এবং জাসদের মধ্যে দুই ধারার বিভক্তির কারণ হিসেবে বিরাজ করছে। যেমন জাসদ সভাপতি বলেছেন, রাশিয়া সমাজতান্ত্রিক দেশ এবং বিশ্ববিপ্লবের নেতা (সাক্ষাৎকার)। কিন্তু রাজনৈতিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক প্রতিটি দেশের নীতি হচ্ছে, এসব দেশের নিপীড়িত জনগণের শ্রেণী সংগ্রাম ও জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে দৃঢভাবে সাহায্য করা। এ ক্ষেত্রে প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েট ইউনিয়নের সংশোধনবাদী কর্মকান্ড বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে দারুণ বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সংশোধন বাদী বিচ্যুতি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম, পুঁজিবাদ বিরোধী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে প্রভৃতি পরিমাণে ক্ষতি সাধন করছে। ‘ (পৃঃ ২৮, ২৯)।

অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে জাসদের কার্যক্রম কিভাবে বিভ্রান্ত করছে তা শাজাহান সিরাজের ‘রাজনৈতিক রিপোর্টের ১৭, ১৮ পৃষ্ঠায় মোটামুটি বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। এতে বলা হয়, ‘৭৮ সালের প্রথম দিকে জিয়া সরকার বুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্যে দ্বন্দ্ব ও আন্তর্জাতিক চাপে তার ফ্যাসিবাদী কার্যক্রমের ওপর আইনী প্রলেপ দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অন্য দিকে যে কারণে আমরা রাজনৈতিক দলবিধির অধীনে স্বীকৃতির জন্য আবেদন করেছিলাম, সে কারণগুলো তখনো পুরোমাত্রায় বিরাজ করছিল। এই বিবেচনায় বিভিন্ন মহলের সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ‘৭৮ সালের ২৪ এপ্রিল জাসদ সরকারী স্বীকৃতি লাভ করে। স্বীকৃতি পাওয়ার কিছুদিন পূর্বে হাই কোর্টের রায়ে কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করি আমি, মোহম্মদ শাজাহান রুহুল আমিন ভূইয়া, নূরে আলম জিকু প্রমুখ৷

স্বীকৃতিলাভের পরপরই আমাদের লক্ষ্য ছিলো বুর্জোয়া শ্রেণীর অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে ব্যবহার করে মেহনতী শ্রেণীর রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করা। আমাদের রাজনৈতিক লাইন অনুযায়ী আন্দোলনের সাধারণ রূপ গোটা বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে হলেও বিশেষ রূপ কিন্তু বুর্জোয়া গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলন রচনা করা। কিন্তু রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় আমরা আমাদের রাজনীতিকে সঠিকভাবে প্রতিনিধিত্ব করতে পারিনি। আমাদের নিজস্ব পত্রিকা ও অন্যান্য প্রকাশনা না থাকাটা যদিও একটি কারণ, তবুও স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, সে সময়ে আমাদের বক্তব্য ক্ষমতাসীনদের চাইতে ক্ষমতার বাইরের বুর্জোয়া গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শাণিত হয়েছে বেশী৷ ফলে জনমণে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পর সারাদেশে পেশাভিত্তিক জনগণ ও শ্রমিকরা শুরু করে মিছিল, ধর্মঘট। সামরিক আইনের ভ্রুকুটিকে উপেক্ষা করে এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সরকারী প্রতিষ্ঠান সমূহেও৷ এমনি সময়ে সরকার সংসদ নির্বাচনেরও তারিখ ঘোষণা করে। আমাদের সাংগঠনিক শক্তি তখনও দূর্বল, পুনর্গঠন ও প্রস্তুতি নেয়ার পালা তখনও শেষ হয়নি। ইতিমধ্যে হঠাৎ নতুন করে আমাদের নেতা কর্মীদের গ্রেফতার ও হয়রানী শুরু হয়।

এমনি অবস্থায় মূলতঃ আমাদের প্রচেষ্টায় দশ দলীয় ঐক্য গড়ে ওঠে। দশ দল সহ প্রায় সমস্ত দল পাঁচ দফা শর্ত সাপেক্ষে নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয়। কয়েকদিন পরেই মুসলীম লীগ সিপিবি ন্যাপ নির্বাচনে যোগ দিয়ে একটি নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। কিন্তু দশ দলও একমাত্র বায়তুল মোকাররমে জনসভা করা ছাড়া আর কোন কর্মসূচী ঘোষণা করতে ব্যর্থ হয়। ফলে শরীক দলগুলোর মধ্যে অবিশ্বাস ও দোদুল্যমানতা দেখা দেয়। অপরদিকে নিজস্ব সাংগঠনিক শক্তির অভাবের কারণে আমরাও নিজস্ব প্ল্যাটফরম থেকে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারিনি। এরকম সিদ্ধান্তহীন অবস্থায় জাসদসহ সাতটি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কারণে বিভিন্ন দল বিশেষ করে দশ দলের কয়েকটি শরীক দল আমাদের বিরুদ্ধে মারাত্বক অপপ্রচার শুরু করে। এ প্রসঙ্গে বলে নিতে চাই, দশ দলের শরীক কয়েকটি দলের মারাত্মক আন্দোলন বিমুখ ভূমিকার কারণেই বস্তুতঃ পরবর্তী সময়ে দশ দল কোন কর্মসূচী দিতে পারেনি। (এমনকি জনসভা পর্যন্ত।)

লিফলেট আন্দোলন শব্দটি ব্যবহারেও তাদের আপত্তি ছিলো। তাই বলা সঙ্গত যে, বস্তুতঃ এই দলগুলোর আন্দোলন বিমুখতার কারণেই দশ দলীয় ঐক্যও ধরে রাখা সম্ভব হয়নি, আন্দোলনও গড়ে ওঠেনি। অন্যদিকে যে আওয়ামী লীগ আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েছিল, তারাই বিরোধীদলীয় সমঝোতাকে ভঙ্গ করে সর্বপ্রথম প্রেসিডেন্ট জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলো। নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত ঘেষিত হওয়ার পর সরকার একটি নাজুক অবস্থায় পতিত হলেও কর্মসূচী ঘোষণা ও আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারার কারণে আশানুরূপ দাবি আদায় সম্ভব হয়ে ওঠেনি। আবার জাসদ সহ অন্যান্য দল এমন পদ্ধতিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে যা জনমনে বিভিন্ন প্রশ্নের উদ্রেক করে। স্বভাবতই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময়ে যে বিভ্রান্তি জন্ম হয়েছিলো, বয়কটের সূচনা ও পরিসমাপ্তি, সিদ্ধান্ত ঘোষণার মারাত্মক পদ্ধতিগত ত্রুটি – তা আরও বাড়িয়ে দেয়। প্রতিক্রিয়াশীল মহলগুলোর লাগাতার মিথ্যা অপপ্রচার তাকে উস্কিয়ে দেয় আরও।

বয়কট আন্দোলনকে তার সফল পরিণতির দিকে পৌছে দিতে না পারার কারণ শরীক দলগুলোর কয়েকটির আন্দোলন বিমুখতা, আমাদের ঐক্যফ্রন্টের আন্দোলনের পূর্ব অভিজ্ঞতার অভাব, অতীত আন্দোলনে বিপর্যয়ের কারণে অতি সতর্কতা, আন্দোলন সম্পর্কিত স্বচ্ছ ধারণার অভাব, সুদৃঢ় আদর্শগত ঐক্য ও একটি বিপ্লবী পার্টির অনুপস্থিতি।

আমাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সময় বিচারে আত্মপ্রকাশ থেকে স্বীকৃতিলাভের পূর্ব কাল এবং স্বীকৃতিলাভের পর থেকে সংসদ নির্বাচনের পরবর্তী কিছু সময় এই দুটি পর্যায় চিহ্নিত করে দেখা যায়, প্রথমটিতে বাম ঝোঁক এবং দ্বিতীয়টিতে ডান ঝোঁক স্পষ্ট।

ভারতবর্ষের বাম আন্দোলনের ইতিহাস মূল্যায়ন করলে দেখা যায়, উপ- মহাদেশের অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি ও পরবর্তী কালে বিভিন্ন পার্টি আন্দোলন রচনা করতে গিয়ে একবার হঠকারী – সন্ত্রাসবাদী ধারা আরেকবার ডানপন্থী সুবিধাবাদী ধারা- এই দুই ধারার মধ্যে ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো ধাক্কা খেয়ে ফিরছে। আমাদের দেশের কমিউনিস্ট নামধারী পার্টিনও গ্রুপগুলোর ইতিহাসও তাই। গণ-আন্দোলনের মধ্য থেকে সমাজতান্ত্রিক শক্তি গড়ে তোলার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সামাজিক প্রভাব ও অন্যান্য বাম পার্টিগুলোর ঝোঁকগুলো থেকে আমরা অনিবার্য কারণে মুক্ত হতে পারিনি। আমাদের সঙ্গে, চূড়ান্ত বিশ্লেষণে, এসব পার্টির কার্যক্রম ও আন্দোলন রচনার ধারায় এক আশ্চর্য সাদৃশ্য লক্ষণীয়। “

বস্তুতঃ গণআন্দোলনের মধ্য থেকে সমাজতান্ত্রিক শক্তি গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় জাসদ সাফল্য লাভ করতে পারেনি৷ জাসদ সীমাবদ্ধ রয়েছে ছাত্রদের মাঝে। জাসদের নেতৃত্বে রাজধানী কাঁপানো শ্রমিক বা কৃষকের আন্দোলন আজও সংগঠিত হয়নি। এমনকি কোন একটি বিশেষ এলাকা বা বিশেষ শ্রেণী জাসদের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়নি৷ যতখানি হয়েছে কয়েকটি ‘কম্যুনিস্ট নামধারী গ্রুপের’ নেতৃত্বে।

জাসদের এসব ব্যর্থতার কারণে জাসদ সম্পর্কে লক্ষ্মীপুর জেলা কমিটিকে সাংগঠনিক ফোরামের বাইরে বক্তব্য রাখতে হয়েছে পুস্তিকার মাধ্যমে। যাতে বলা হয়েছে, “সর্বহারার সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাসী প্রতিটি বিপ্লবী কর্মীই বিশ্বাস করেন যে, এ যুগে শ্রমিক শ্রেণীর পার্টির নেতৃত্ব ছাড়া কোন আন্দোলনই তার যৌক্তিক পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে পারে না। শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্ব ছাড়া যত বাস্তব উপযোগী কর্মসূচীই প্রহণ করা হোক না কেন – তার ফসল প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতে যেতে বাধ্য। আমাদের অনেককেই বলতে শুনা যায় – ‘আন্দোলন কর’ ‘আন্দোলনের মধ্য দিয়েই পার্টি গড়ে উঠবে’, কিন্তু কার আন্দোলন কে করবে? যে শ্রমিক শ্রেণীর পার্টির নেতৃত্বে বিপ্লব সফল হবে তাদের রাজনৈতিক আদর্শের চর্চা কোথায়? মতাদর্শগত সংগ্রাম চালাবার কেন্দ্র কোথায়? সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় চিন্তার ঐক্য ও কাজের ঐক্য কোথায়? মতাদর্শগত সংগ্রাম চালাবার কেন্দ্র কোথায়? কেন্দ্র থেকে নীচের স্তর পর্যন্ত সমালোচনা আত্মসমালোচনার রীতি চালু করার প্রক্রিয়া কোথায়? গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার অনুশীলন কোথায়??? শুধু আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এভাবে পার্টি গড়ে তোলার শিশুসুলভ উক্তি সর্বহারা রাজনীতির দৃষ্টিভঙ্গীর পরিপন্থী।

” সংগ্রামী সাথীরা,
জাসদকে বাকশালের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একই প্ল্যাটফরম থেকে হরতাল পালন করায় সচেতন জনগণ কতখানি বিভ্রান্ত হয়েছে ও আসাদেরকে কতটুকু ভুল বুঝেছে, তা প্রত্যেক আন্তরিক বিপ্লবী মনা কর্মীরই উপলব্ধিতে আছে। এরপর নেতৃবৃন্দ বাকশালের সঙ্গে ঐক্যকে আরো সুদৃঢ় করার জন্য নীতি বহির্ভূত সকল অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে পরিষ্কার ভাবে বলতে চাই – সংগঠনের মৌলিক আদর্শকে সবকিছুর উর্ধ্বে তুলে ধরে – যদি নেতৃবৃন্দ সর্বহারা আন্দোলনের বিকাশ ঘটাবার কোন প্রক্রিয়ায় পরিচালিত না হন, তবে আমরা মার্কসবাদ লেনিনবাদের শিক্ষানুসারে এ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে বাধ্য হবো।”

মার্কসীয় তত্ত্ব অনুসারে, গণসংগঠনকে রিক্রুটিং প্ল্যাটফরম হিসেবে ব্যবহার করতে গেলে বিপ্লবী কর্মকান্ড ব্যহত হয়। কারণ গণসংগঠনের নেতা পেটি বুর্জোয়া ভাবাদর্শকে গ্রহণ করে বিপ্লবী লাইন থেকে বিচ্যুত হতে পারেন। এবং তখনই গণসংগঠনকে কুক্ষিগত করার প্রচেষ্টায় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত নিজ নামকে ব্যবহারের চেষ্টা চালান।

জাসদ দাবী করে যে এটি একটি সমাজতান্ত্রিক গণসংগঠন (পার্টি নয়)। লর মাধ্যমে মার্কসবাদ অনুশীলন করে একটি সাচ্চা বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলা হবে। কিন্তু জাসদের কর্মকাণ্ড থেকে বিচ্যুতি যে কোন সময়ে আসতে পারে। যেসব বিপ্লবী লাইন জাসদ অনুশীলন করতে চাইছে তার সব কটিই কোন না কোন গ্রুপ কর্তৃক পরীক্ষিত হয়েছে। তদুপরি জাসদের নেতৃত্বে রয়েছে সংকর শ্রেণী – সামরিক আমলা, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, আমলা প্রভৃতি পেটি বুর্জোয়া শ্রেণী থেকে আগত ব্যক্তিবর্গ। পেটি বুর্জোয়ারা বিপ্লবের নেতৃত্ব দিতে পারে তবে সবসময়ই আশংকা থাকে পেটি বুর্জোয়া সুবিধাবাদ কবলিত হওয়ার। বিপ্লবী চিন্তাধারার অনুসারী নেতা ও কর্মীরাই জাসদকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারেন। এজন্য দরকার অধ্যয়ন – অনুশীলন – আবার অধ্যয়ন। অবশ্য জাসদের তরুণ কর্মীরা মনে করেন এমন সময়ে সিরাজুল আলম খানের উপস্থিতি জাসদের রাজনীতিতে গুণগত এবং পরিমাণগত পরিবর্তন আনতে পারতো।

জাসদের সাচ্চা ত্যাগী কর্মীরা বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করার প্রক্রিয়ায় যথাসাধ্য পরিশ্রম করে যাচ্ছেন – ‘জাসদ’ সম্পর্কে জাসদ অভ্যন্তরের বিপ্লবী শক্তির এখনই একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে রাজনৈতিক মহল ধারণা করেন।

তর্কের খাতিরে হয়তো তেং শিয়াও পিং – এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা যেতে পারে, বিড়ালটি কালো কি সাদা সেই বিতর্ক অনর্থক। দেখা উচিত বিড়ালটি ইঁদুর মারে কিনা? কিন্তু মনে রাখা দরকার যে চূড়ান্ত বিশ্লেষণে এটি একটি সুবিধাবাদী উক্তি ছাড়া কিছু নয়।

***

সাক্ষাৎকার

জাসদের এখনই ক্ষমতা দখলের লক্ষ্য নেই
– মেজর (অবঃ) জলিল

প্রশ্ন – আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিরোধের জন্য জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) জন্ম হয়েছিল?

উত্তরঃ আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমাদের মূল দ্বন্দ্ব হচ্ছে আদর্শগত তাই ক্ষেত্র বিশেষের প্রাধান্য আমরা দিচ্ছি না। স্বাধীনতার পর থেকে আওয়ামী লীগ যেভাবে অত্যাচার শুরু করে, বিভিন্ন প্রাইভেট বাহিনী দিয়ে নির্যাতন শুরু করে, এসব দেখে জনগণ দারুণভাবে হতাশ হয়েছিল। আওয়ামী লীগের এসব অপকর্মের বিরুদ্ধেই আমরা মনে করেছিলাম এমন একটা রাজনৈতিক শক্তির জন্ম দেয়া উচিত যা ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর এসব কার্যকলাপে রুখে দাড়াতে পারবে। মূলতঃ স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের দাপটের সামনে এমন কোন বিরোধীদল ছিল না যা কার্যকরী ভাবে তার বিরোধীতা করতে সক্ষম। মোজাফফর ন্যাপ একবার আঘাতের ফলেই শেখ সাহেবের সঙ্গে আপোষ করে৷

প্রশ্ন – তাহলে বিরোধী দল হিসাবে জন্ম নেয়ার জন্যই জাসদের জন্ম?

উত্তর – না, এটা হলো একটা দিক। অন্য দিকটা হলো আদর্শগত দিক। একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য শ্রেণীহীন শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যেই জাসদের জন্ম হয়।

প্রশ্ন – জাসদের এখন যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের অনেকেই মুজিব বাহিনীর নেতা ছিলেন। এর কারণ কি?

উত্তর – এটা একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে হয়েছিল। স্বাধীনতার সময়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সকল শ্রেণীই যোগদান করে। যদিও আমি কোনদিনই আওয়ামী লীগের ছিলাম না তবু আপনারা আমাকে সেখানে দেখেছেন। ছাত্রসমাজ স্বাধীনতার পক্ষে যত সোচ্চার ছিল আমার মনে হয়, আওয়ামী লীগের কর্মীরা তত সোচ্চার ছিল না। তারা সত্যিকারের স্বাধীনতা চেয়েছিল কিনা, এটা এখনও বিবেচনার বিষয়৷

প্রশ্ন – আওয়ামী লীগের অনেক নেতা জাসদে এসেছিলেন। এখনও কি এ প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে?

উত্তর – আওয়ামী লীগের দু’ একজনকে আমরা পেয়েছিলাম। তবে ব্যাপক একটা নয়৷ অবশ্য কর্মী বাহিনী আমরা পেয়েছি – সে অবশ্য আওয়ামী লীগের ছাত্র ফ্রন্ট থেকে।

প্রশ্ন – ছাত্র ফ্রন্ট থেকে কর্মীরা এসেছিলেন কি নেতৃত্বের আকর্ষণে?

উত্তর – ছাত্রদের মধ্যে একটা বিক্ষোভ ছিল। শেখ সাহেবের প্রতি তাদের অন্ধবিশ্বাস ছিল, ভালবাসা ছিল। তার কাছ থেকে চাওয়া পাওয়া ছিল। কিন্তু শেখ সাহেব যখন পাকিস্তান থেকে ফিরে আসেন তখন তার ব্যবহার ছাত্র সমাজকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। এবং তারা পরে জাসদে যোগ দেয়।

প্রশ্ন – আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতার জাসদে যোগদানের কথা ছিল?

উত্তর – আমার কাছে তেমন তালিকা ছিল না। তবে প্রাথমিকভাবে একটা কথা ছিল তাজউদ্দীন সাহেব হয়তো বের হয়ে আসতে পারেন।

প্রশ্ন – আওয়ামী লীগ লক্ষ্য হিসেবে বলছে তারা সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চায়, আপনারা বলছেন ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র ‘ কায়েম করবেন। আপনারা বৈজ্ঞানিক কথাটা জুড়ে দিলেন কেন?

উত্তর – বৈজ্ঞানিক কথাটা আমরা জুড়ে দেই নি। মার্কস এবং এঙ্গেলস বিভিন্ন ধরণের সমাজতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ের জন্য এ কথাটা জুড়ে দেন। আসলে এটাই হচ্ছে সমাজতন্ত্রের প্রকৃত নাম।

প্রশ্ন – আওয়ামী লীগের সমাজতন্ত্রের সাথে আপনাদের মৌলিক বিরোধটা কোথায়?

উত্তর – সমাজতন্ত্রের জন্য চরিত্রের প্রয়োজন। সমাজতন্ত্রের জন্য সর্বহারা পার্টি বা ত্যাগী মনের মানুষ দরকার। আওয়ামী লীগের সে ধরণের পার্টি নেই, নেতৃত্বও নেই। তাদের নেতৃত্ব পেটি বুর্জোয়া চরিত্রের। কর্মসূচীর মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হয় একটা পার্টি কি চায়। তাদের নেতৃত্বেরও তেমন চরিত্র নেই৷ এজন্য যে ব্যবহার, পড়াশুনা জ্ঞান থাকা দরকার তা তাদের নেই।

প্রশ্ন – জাসদ কোন শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে?

উত্তর – জাসদ মার্কসবাদী পার্টি নয়। জাসদকে আমরা সমাজতান্ত্রিক গণসংগঠন বলছি। এখানে বিভিন্ন শ্রেণীর সমন্বয় ঘটবে। এখানে আন্দোলনের মাধ্যমে কর্মী তৈরী হবে। যেমন ধরুন, আপনি মাখন তৈরী করতে চান। তাহলে আপনাকে একটি কড়াইয়ে দুধ জ্বাল দিতে হবে৷ দুধ গরম হলে মাখন উঠবে আপনি তা তুলে রাখবেন। মাখন উঠবে আবার তুলে রাখবেন। এখানে জাসদ হচ্ছে কড়াই আর জনগণ হচ্ছে দুধ।

প্রশ্ন – এ ধরণের প্রক্রিয়া জাসদের মধ্যে আছে কি?

উত্তর – হ্যাঁ আছে। আমাদের নেতৃত্বের মধ্যেও আছে। যেমন ধরুন, আমি সৈনিক জীবনে বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করতাম, এখানে এসে আমার মধ্যে পরিবর্তন এসেছে৷ আমি মনে করি আমি শ্রেণীচ্যুত হয়ে চলে এসেছি। তবে এখনও মনে মনে ভাল খাওয়ার ইচ্ছে করে। তাই মনে হয় আমি পুরোপুরি শ্রেণীচ্যুত হতে পারিনি। ভাল খাওয়ার প্রশ্নটি আমার মনে হয় আমাকে সেই পুরনো দিনগুলো ডাক দিচ্ছে।

প্রশ্ন – ভালো খাওয়ার আশা ত্যাগ করাটা কি আপনি মহত্ব বলে মনে করেন?

উত্তর – আমি মনে করি, মহত্বের ব্যাপার এটি নয়৷ আমি যে শ্রেণীকে প্রতিনিধিত্ব করি তারা তো না খেয়ে আছে, আমার মনে ভালো খাওয়ার ইচ্ছেটা আসবে কেন? লেনিন নিজেই বলেছেন যে, কম্যুনিস্ট হতে হলে ‘ছেড়া’ কাপড় পরতে হবে এমন কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। কম্যুনিস্ট হওয়া মানে সর্বহারাদের বস্তি থেকে তুলে কম্যুনিস্টের স্তরে নিয়ে আসা।

প্রশ্ন – ভারতীয় দর্শনের ত্যাগীর ধারণা এক্ষেত্রে আপনাকে প্রস্তাবিত করে কিনা?

উত্তর – মার্কসবাদ ত্যাগে বিশ্বাস করে না। আমি কোন কিছু ত্যাগ করছি বলে মনে করি না। বরং আমার মনে বাসনা আছে নেতা হবো বা আমি অমর হয়ে থাকবো। আমাকে তো সবাই শ্রদ্ধা করে। আমার তো ত্যাগ নেই৷ আমি তো ছোট জীবন থেকে বৃহত্তর জীবনে প্রবেশ করেছি।

প্রশ্ন – জাসদ যে সমাজতন্ত্র কায়েম করবে সে সমাজতন্ত্র কায়েম করার পথ কি?

উত্তর – সমাজতন্ত্র কায়েমের পথ নির্ভর করে শাসকগোষ্ঠীর উপরে। রাশিয়ার সামন্ত শ্রেণী ছিল যেখানে কৃষকদের মধ্যে সেখানে বিক্ষোভ ছিল। চীনেও তাই৷ আমাদের এখানে সামন্ত শ্রেণী নেই। এখানে পুঁজিপতি শ্রেণীও নেই। কাজেই এমন কোন শক্তি নেই যা দিয়ে তারা সমাজতান্ত্রিক সমাজকে ঠেকাতে পারবে। সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম হয় কৃষক শ্রমিক সর্বহারা শ্রেণীর মৈত্রী গড়ে তুলে। শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে কৃষক শ্রমিক সর্বহারা শ্রেণীর সমন্বিত সংগ্রামের মাধ্যমে এটা প্রতিষ্ঠিত হয়। একে সর্বহারার বিপ্লব বলা হয়। এই বিপ্লব যে সব সময় সশস্ত্র হবে এমন কোন কথা নেই। আজকের যে শাসক শ্রেণী তারা যুগ যুগ ধরে বিশেষ একটি শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করছে, বিশেষ একটি শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করছে৷ এই শ্রেণীর সঙ্গে বাইরের কোন কোন শক্তির হাত আছে। তারা এই শ্রেণীকে অস্ত্র দিচ্ছে। আমরা তো আর কোন দেশের সঙ্গে যুদ্ধ করবো না। তাহলে এই অস্ত্র আনা হচ্ছে কেন? আসলে এই অস্ত্র আসছে যারা বাঁচার দাবীতে সংগ্রাম করছে তাদের বিরুদ্ধে এ অস্ত্র ব্যবহার করা হবে। তাই সর্বহারা শ্রেণীকেও এ অস্ত্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র ভাবেই লড়তে হবে। সশস্ত্র সংগ্রাম সর্বহারা শ্রেণীর আবেগের বা খুশীর বিষয় নয়৷

প্রশ্ন – আমাদের রাজনীতির ‘৪৭ থেকে ‘৭১ এবং ‘৭১ থেকে এখন পর্যন্ত যে অবস্থা তাকে আপনারা কিভাবে ব্যাখ্যা করেন?

উত্তর – ‘৪৭ থেকে ‘৭১ এ সময়টি ছিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের যুগ৷ ‘৪৭ সালে মানুষ মনে করেছিলযে দরশ স্বাধীন হয়েছে এবার তাদের আশা পূরণ হবে। কিন্তু দেখা গেল তা হয়নি। কিছু লোক হয়তো রাতারাতি ধনী হয়ে যায় কিন্তু কোন সমাজের কাঠামোগত কোন পরিবর্তন হয়নি। ৪৮ সালে উর্দু রাষ্ট্রভাষা হবে এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে একটি উপনিবেশ বানানোর মনোভাবের প্রকাশ ঘটে। তখন থেকেই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জোয়ার বইতে থাকে। তারপর থেকে আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে। এবং শেখ সাহেবই হচ্ছেন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূল নায়ক। অবশ্য অন্যান্য দলেরও ভূমিকা রয়েছে। শেখ সাহেব সম্পর্কে একটা মূল্যায়ন এখানে অবশ্যই দিতে হয়। শেখ সাহেবের মৃত্যুটা হচ্ছে একটা ট্রাজেডি, ইটস এ ট্রাজেডি ফর দ্য নেশন। শেখ সাহেবের ইমেজ এই জাতি ব্যবহার করতে পারতো৷ কিন্তু সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি হলো আমরা তা ব্যবহার করতে পারিনি। শেখ সাহেবের মৃত্যুর জন্য তিনি যতটা দায়ী আমার মনে হয় জাতি হিসেবে আমরাও কম দায়ী নই। জাতীয়তাবাদী চেতনাটার যেভাবে মৃত্যু ঘটলো তা আমি সহজে মেনে নিতে পারিনা। এখনও মেনে নিতে পারছি না। ইতিহাস শেখ সাহেবকে মহানায়ক হিসেবে, আমার মনে হয় সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী হিসাবে চিহ্নিত করবে।

‘৭১ এর পর জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পরবর্তী কালে অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলনের পর্যায় ছিল এটা। এই সময়ে সমাজতান্ত্রিক চিন্তা চেতনার বিকাশ ঘটে এবং এই চিন্তা চেতনা তরুণ শ্রেণীর মধ্যেই আসে। আমরা দেখলাম যে, শেখ সাহেবও কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়। কারণ যে পুলিশ এন এস আই ৫ দিন আগেই পাকিস্তান চেয়েছে সে এখনই বাংলাদেশ চাইতে পারে না। অর্থাৎ কাঠামোগত পরিবর্তন প্রয়োজন। এই যুগে কাঠামোগত পরিবর্তন প্রয়োজন। এই যুগে কাঠামোগত পরিবর্তন বা সমাজতন্ত্র আনয়ন সম্ভব এ নিয়ে চিন্তা ভাবনা চলতে থাকে।

প্রশ্ন – কিন্তু শেখ সাহেবের কাছ থেকে আপনারা এটা আশা করেছিলেন কেন?

উত্তর – তার কাছ থেকে আমরা এটা আশা করিনি। কারণ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন যে করে তার নিজস্ব সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সে সমাজতন্ত্র চায় না।

প্রশ্ন – কিন্তু শেখ সাহেব তো সংবিধানে সমাজতন্ত্রের কথা বলে গেছেন?

উত্তর – সমাজতন্ত্রের কথা বলা এবং সমাজতন্ত্রের পক্ষে কাজ করা এক কথা নয়। যারা সমাজতন্ত্রের কথা বলবে তারা শ্রেণীগত দিকটা আগে দেখতে হবে। শেখ সাহেবের সেই শ্রেষীগত চরিত্র ছিল না।

প্রশ্ন – কিন্তু আপনি বলেছেন যে শেখ সাহেবকে দিয়ে অনেক পরিবর্তন ঘটানো যেত….?

উত্তর – এক ব্যক্তি যদি কোন ইমেজ হয় তাহলে সেই ব্যক্তির যদি দূরদর্শিতা থাকে তবে পরিবর্তন আনা যায়৷ তাই প্রমাণিত হয় যে সংবিধানে সমাজতন্ত্রের কথা বললেও সমাজতন্ত্রে তিনি আদৌ বিশ্বাসী ছিলেন না।

প্রশ্ন – ‘৭১ পরের সময়টাকে আপনারা বলেছেন সমাজতন্ত্রের উদ্ভবের সময়। এ সময় মূল শত্রু ছিল কারা?

উত্তর – এ সময় মূল শত্রু ছিল শাসক শ্রেণী। কারণ শাসকগোষ্ঠী যে ওয়াদা করেছিল তা পালন করেনি৷ গনবিরোধী কালাকানুন পাশ করিয়ে নেয়া হয়েছিল। আমি মনে করি শেখ সাহেব সিরাজ শিকদারের মৃত্যুর জন্য জড়িত ছিলেন। সুতরাং শাসক গোষ্ঠীকে রুখতে হবে এটাই ছিল আমাদের মূল লক্ষ্য।

প্রশ্ন – বর্তমান সরকার সম্পর্কে আপনাদের মূল্যায়ন কি?

উত্তর – শ্রেণীর দিক থেকে বর্তমান সরকার বা পূর্ববর্তী সরকারের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। শেখ সাহেব যেমন নগণ্য শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করতেন, বর্তমান সরকারও তাই করছে।

প্রশ্ন – রাজনৈতিক সংজ্ঞা অনুযায়ী এরা কোন শ্রেণী?

উত্তর – এদের কোন চরিত্র আছে বলে খুঁজেই পাবেন না। এখানে সামরিক, বেসামারিক আমলা, বুর্জোয়া, পেটি বুর্জোয়া রয়েছে। এদের চরিত্র নির্ধারণ করা কঠিন ব্যাপার। ইট ইজ এ গুড ককটেল। এদেরকে আমরা বলি সুবিধাবাদী, মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া এবং পাতি বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী৷

প্রশ্ন – আওয়ামী লীগ কোন শ্রেণীর সংগঠন?

উত্তর – পাতি বুর্জোয়া শ্রেণীর।

প্রশ্ন – আপনারা আওয়ামী লীগের সাথে ঐক্য ফ্রন্ট করলেন কেন?

উত্তর – স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে যারাই সংগ্রাম করতে চায় তাদের সঙ্গেই ঐক্য হতে পারে। স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তির সঙ্গে ঐক্য গড়ে তোলা দরকার। গণতান্ত্রিক শক্তি হোক বা না হোক স্বৈরতন্ত্র বিরোধী হলেই তার সঙ্গে ঐক্য হতে পারে৷

প্রশ্ন – আপনারা কি ডেমোক্রেটিক লীগকে সঙ্গে নেবেন?

উত্তর – আমরা বলেছি, আমাদের দরোজা খোলা। স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে যারাই আসতে চাইবে তাদের সঙ্গেই আমাদের ঐক্য হবে।

প্রশ্ন – বাংলাদেশে বিপ্লবের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের প্রয়োজন হলে তার রূপ ও স্তর কি হবে?

উত্তর – বর্তমান আন্দোলনের পর্যায় হচ্ছে গণতান্ত্রিক, বিপ্লবের স্তর হচ্ছে সাম্প্রদায়িক। সর্বহারার বিপ্লব সশস্ত্র ভাবেই সংগঠিত হয়। এটা যেমন বুর্জোয়াদের সারভাইভালের প্রশ্ন তেমনি সর্বহারাদেরও সারভাইভালের প্রশ্ন। এখানে সারভাইভাল অব দি ফিটেস্ট কথাটি এসে যায়।

প্রশ্ন – আমরা দেখছি আরও একটি ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট রয়েছে বামপন্থীদের নেতৃত্বে। তাদের সঙ্গে আপনারা ঐক্যবদ্ধ হলেন না কেন?

উত্তর – তাদের সঙ্গে আমরা দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা করেছিম আজ নয়, ‘৭৫ সাল থেকে। তারা নিজেদের বিপ্লবী মনে করেন। একটা কথা হচ্ছে বিপ্লবী অবিপ্লবী কে তা নিজেদের বলা উচিৎ নয়। জনগণ তা বলতে পারে। এ ধ্যান ধারণা থেকে সংকীর্ণতার জন্ম নেয়। সেজন্য তথাকথিত বামপন্থীদের সঙ্গে ঐক্য হতে পারে না।

প্রশ্ন – কিন্তু তারা আপনাদের আহবান জানিয়েছে….?

উত্তর – আমরাও তাদের আহবান জানিয়েছি। আওয়ামী লীগ সম্পর্কে তাদের যে কথা, এরা যদি রাশিয়ার বিরুদ্ধে কথা না বলে তাহলে ঐক্য করা যাবে না – এ ধরণের ডগম্যাটিক এ্যাপ্রোচ হতে পারে না। ঐক্যে লেনদেন আছে। বিশেষ বিস্ফোরণ দিয়ে আপনি ঐক্যবদ্ধ করতে পারবেন না জনগণকে। ঐক্য চাইলে সেখানে ভাষার পরিবর্তন হবে। আপনি যদি একটা কন্ডিশন দিয়ে দেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে হবে তা না হলে ঐক্য হবেনা – তাহলে ঐক্য হচ্ছে না।

প্রশ্ন – আপনারা কি বিনাশর্তে ঐক্যে গিয়েছেন?

উত্তর – শর্ত তা নয়। গিয়েছি কর্মসূচীর ভিত্তিতে। এখানে অমুকের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে হবে এটা চাইল্ডিস এপ্রোচ। জনগণের সমস্যা, জাতীয় সমস্যা, আন্তর্জাতিক সমস্যা সম্পর্কে চিন্তা করছি না, কে নেতা হবে, তারপর কার বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে হবে আমরা তা নিয়েই ব্যস্ত হচ্ছি। আমার মনে হয় আমরা দারুণ সংকীর্ণতার পরিচয় দিচ্ছি। উই মাস্ট বি ব্রড, ব্রড এন্ড ব্রড৷ তারা আমাদের এখনও মনে করেন আমরা ভারতে দ্বিতীয় ফ্রন্ট। তারা যদি আমাদের সম্পর্কে ধ্যান ধারণা না পাল্টান তাহলে আমাদের কিছু করার নেই৷ কিন্তু রুশ – ভারত অক্ষের বিরুদ্ধে আমরা সংগ্রাম করেছি সক্রিয়ভাবে।

প্রশ্ন – কিন্তু ‘৭১ এর পর ভারতীয় সৈন্যদের বিরুদ্ধে যারা অস্ত্র ধরেছিল, আপনারা তাদের সঙ্গে ঐক্য করেননি কেন?

উত্তর – ভারতীয় সৈন্যের বিরুদ্ধে কে প্রথম অস্ত্র ধরেছিল দ্যা ইজ নট, দ্যা ইজ মেজর জলিল। সে কথা আপনাদের ভুললে চলবে না। অনেকে তো স্বাধীনতাই স্বীকার করেনি৷ রুঢ় বাস্তবতাকে তো অস্বীকার করা যায় না। এটা তো জনযুদ্ধ ছিল যা অসম্পূর্ণ রয়েছে। রাজনৈতিক ভৌগোলিক স্বাধীনতাকে যারা অস্বীকার করে তারা কি ধরণের বামপন্থী? শেখ মুজিব বললেন ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করতে। ভারতীয় সৈন্য ফিরিয়ে নেয়া হল৷ এটা কি রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়?

প্রশ্ন – আপনারা রুশ – ভারত বিরোধী পদক্ষেপ গ্রহন নিয়েছেন, তার সবগুলোই কি সঠিক ছিল?

উত্তর – জনগণ যখন এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তখন আমাদের বলতেই হবে যে, এসব পদক্ষেপ সঠিক ছিল। তবে বলতে পারেন, কাজ করতে গেলে কিছু হঠকারিতা হয়, কিছু সুবিধাবাদী প্রবণতাও আসে।

প্রশ্ন – ‘৭৪ এর ১৭ মার্চের আন্দোলনকে আপনারা কি হঠকারিতা বলবেন?

উত্তর – ১৭ মার্চের আন্দোলন হঠকারিতা নয়। এদিন শেখ মুজিবের মুখোশ খুলে গিয়েছিল যে তিনি আসলে গণতন্ত্র চান না। তিনি ফ্যাসিবাদী রূপে প্রকাশিত হয়েছিলেন জনগণের সামনে, ১৭ মার্চ ছিল জনগণের স্বতস্ফুর্ত বিক্ষোভ মিছিল। জনগণ সেদিন একটি স্মারকলিপি হস্তান্তর করতে গিয়েছিল। এটা আমাদের হঠকারিতা নয়। হঠকারিতা যদি করে থাকে সেটা রক্ষী বাহিনী করেছে।

প্রশ্ন – এ মুহূর্তে আপনারা প্রধান শত্রু বলে কাকে চিহ্নিত করছেন?

উত্তর – এ মুহুর্তে প্রধান শত্রু শাসকগোষ্ঠী, বর্তমান সরকার।

প্রশ্ন – এই শত্রুকে উৎখাত করার জন্য আপনারা বাকশালি আওয়ামী লীগ এবং অন্যান্য দের সঙ্গে ঐক্য ফ্রন্ট গঠন করেছেন?

উত্তর – উৎখাত করার জন্য নয় – একটি শক্তিশালী বিকল্প রাজনৈতিক ঐক্যফ্রন্ট গঠন করা হয়।

প্রশ্ন – ফ্রন্টের লক্ষ্য বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলা নয় কি?

উত্তর – দেখা যাচ্ছে এ মুহূর্তে এককভাবে কোন দলই নেই যে, রাজনৈতিক শুন্যতা পূরণ করতে পারে৷ তাছাড়া প্রধান শত্রুকে যত বিচ্ছিন্ন করতে পারি, যুদ্ধ পরিচালনা করতে আমার ততই লাভ। আরেকটি দিক হলো স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তির ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করা।

প্রশ্ন – আওয়ামী লীগকে আপনারা গণতান্ত্রিক শক্তি বলে মনে করেন?

উত্তর – আওয়ামী লীগ মাইনাস বাকশাল কনসেপ্ট। আওয়ামী লীগকে বাকশাল কনসেপ্ট বাদ দিতেই হবে। এ কথা তাদের স্পষ্ট করে বলা আছে৷ বাকশাল কনসেপ্টকে তাদের ভুলে যেতে হবে। এক দলীয় ব্যবস্থা আমরা মেনে নিতে পারি না। আমরা সংসদীয় গণতন্ত্র চাই।

প্রশ্ন – বাকশাল গঠনের আগে আপনারা আওয়ামী লীগের ভূমিকাকে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল বলে মনে করেন কি?

উত্তর – না। গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে তখন তারা বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। সেটা প্রত্যেক শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতাসীন যখন হয়, তাদের ওয়াদার কথা তারা ভুলে যায়। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য গণতন্ত্র বিরোধী আইন কালাকানুন চাপিয়ে দেয় জনগণের উপরে। তবে আওয়ামী লীগের মধ্যে গণতান্ত্রিক শক্তি নেই এটা আমরা বলতে পারি না। যেমন আজকের যে শাসকগোষ্ঠী তাদের মধ্যেও ভালো লোক আছে। তাদের যদি সুযোগ দেয়া হয় ভাল একটি দল গঠন করতে তাহলে তারা সেখানে আসতে পারে। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক সংগঠনেই প্রগতিশীল এবং গণতান্ত্রিক শক্তি রয়েছে।

প্রশ্ন – দশ দলের চূড়ান্ত লক্ষ্য কি?

উত্তর – চূড়ান্ত লক্ষ্য নির্ধারিত হয়নি এখনও। তা নির্ভর করছে শাসকগোষ্ঠীর মনোভাব এবং জনগণের সম্পৃক্তির উপর।

প্রশ্ন – নির্দিষ্টভাবে কি ক্ষমতা দখলের লক্ষ্য নেই?

উত্তর – এ ঐক্য টিকবে না, এ কথা বলা যাবে না। এভাবে হুমজুক্যালী বলা হয়।

টিকবে কি টিকবে না তা নির্ভর করছে জনঘণের সম্পৃক্তির উপর। ঐক্য সম্পর্কে আমি আশাবাদী। একে আরও সম্প্রসারিত করতে হবে।

প্রশ্ন – পাঁচ দলীয় ঐক্য ফ্রন্ট জাসদকে লক্ষ্য করে আহবান জানিয়েছে, তাতে আপনারা সাড়া দেননি কেন?

উত্তর – তাদের উচিৎ আমাদের সঙ্গে আসা। তারা যদি মনে করেন যে, দশদল করে জাসদ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তবে তাকে রক্ষা করার জন্যই আমাদের সঙ্গে এসে কোন শক্তির বিরুদ্ধে তাদের আপত্তি থাকলে তার বিরুদ্ধে লড়াই করা।

প্রশ্ন – উভয়পক্ষের আহবান থাকা সত্ত্বেও ঐক্য হচ্ছে না কেন?

উত্তর – দশ দল, পাঁচ দল বড় কথা নয়, দেখতে হবে সমাজে তাদের কতটুকু প্রভাব আছে। দশ দলের মধ্যে মূলতঃ আওয়ামী লীগ, জাসদ। এদের জনগণকে সংগঠিত করার যে শক্তি রয়েছে তা পাঁচ দলের নেই। তারা সব সময় বিভিন্ন শক্তিকে চিহ্নিত করে তাদের শাসকগোষ্ঠীর দিকে ঠেলে দিয়েছে৷ কম্যুনিস্টরা হচ্ছে বীজ। জনগণ হচ্ছে ভূমি। যেখানে ভূমি সেখানে বীজ ছড়ালে কিছু না কিছু ফল পাওয়া যাবেই। তথাকথিত বামপন্থীরা জনগণের কাছে যেতে চান না। আমি মনে করি, এটা তারা ভুল করছেন। এ ভুল তারা বারবার করে যাচ্ছেন। ১৭ লক্ষ যে মাদ্রাসা ছাত্র রয়েছে তাদের মধ্যেও তো আমাদের কাজ করতে হবে। আমার মনে হয় এই বামপন্থীদের জনগণের মধ্যে কাজ করা সম্পর্কে ভীতি রয়েছে। আমি যদি মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ি তবে আমি মোল্লা হয়ে যাব না। বরং একটা মোল্লাকে আমার পক্ষে নিয়ে আসতে পারবো এতটা আত্মবিশ্বাস আমার থাকতে হবে।

প্রশ্ন – জাসদের এককভাবে ক্ষমতা দখলের কোন কর্মসূচী আছে কি?

উত্তর – না। জাসদ তেমন কোন চিন্তাভাবনা করে না। জাসদের নেতা ও কর্মীদের এখনও অনেক প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। এবং অনেক সময় শিক্ষা শৃঙ্খলার প্রয়োজন রয়েছে। সেজন্য অনেক সময় প্রয়োজন। ক্ষমতা দখল করাটাই বড় কথা নয়।

প্রশ্ন – আমরা এটা কবে নাগাদ আশা করবো?

উত্তর – জাসদ ক্ষমতায় যাবে কি যাবে না সেটা বড় কথা নয়। জাসদ একটা বিপ্লবী শক্তি গড়ে তুলতে চায়। এ জন্য সকল বামপন্থীর সমন্বয় ঘটানোর লক্ষ্য আমাদের রয়েছে।

প্রশ্ন – কিন্তু জাসদ একটি রাজনৈতিক দল তো?

উত্তর – নিশ্চয়ই।

প্রশ্ন – ক্ষমতা দখল নিশ্চয়ই এর উদ্দেশ্য?

উত্তর – হ্যাঁ, তবে এককভাবে না ঐক্যবদ্ধ ভাবে করবে তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা চলছে। অচিরেই ক্ষমতা দখলের লক্ষ্য জাসদের নেই।

প্রশ্ন – ক্ষমতা দখলের লক্ষ্য না থাকলে সংসদ নির্বাচনে আপনারা অংশগ্রহণ করলেন কেন?

উত্তর – সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা আর ক্ষমতা দখল করা এক কথা নয়। নির্বাচনে অংশগ্রহণে উদ্দেশ্য হলো সংসদে জনগণের পক্ষে তাদের দাবি – দাওয়া তুলে ধরা।

প্রশ্ন – বর্তমান সরকারনকোন শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে?

উত্তর – মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া।

প্রশ্ন – যদি মুৎসুদ্দি হয় তাহলে কোন বিদেশী শক্তির প্রতিনিধি হয়ে এরা কাজ করছে?

উত্তর – মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীর।

প্রশ্ন – বুর্জোয়া হিসাবে এরা কোন পুঁজু প্রতিনিধিত্ব করে?

উত্তর – ফিন্যান্স ক্যাপিটাল।

প্রশ্ন – তার বিরুদ্ধে আপনাদের কর্মসূচী কি?

উত্তর – দলীয় ১৮ দফা কর্মসূচীতে তা রয়েছে।

প্রশ্ন – আওয়ামী লীগ সরকার কোন শ্রেণীর ছিল?

উত্তর – পাতি বুর্জোয়া।

প্রশ্ন – তাদের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের কি কোন সম্পর্ক ছিল?

উত্তর – ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যে কোন শক্তির সাথে আঁতাত তারা করতো। তাদের মধ্যে দুটো গ্রুপ ছিল, একটি ছিল রুশ ভারতের পক্ষে, অন্যটি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে। এ দু’ য়ের সংঘাতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের গ্রুপটি অবশেষে ক্ষমতা দখল করে ১৫ ই আগস্ট মোশতাকের মাধ্যমে।

প্রশ্ন – বর্তমান আওয়ামী লীগ রুশ- ভারতের এজেন্সী হিসেবে কাজ করবে কি?

উত্তর – তাদের দূর্বলতা রয়েছে সে দিকে।
তাদের সে দূর্বলতা থাকা স্বাভাবিক কারণ এ দেশ যখন স্বাধীন হয় তখন রুশ – ভারত সাহায্য করেছিল।

প্রশ্ন – রুশ – ভারত সম্পর্কে আপনাদের মূল্যায়ন কি?

উত্তর – আমরা কারও লেজুড়বৃত্তি করতে চাই না। বিশ্বের সকল সমাজতান্ত্রিক দেশ থেকেই আমরা সাহায্য পাবো বলে আমরা আশা করি। কিন্তু দেশের স্বাধীনতাকে বিকিয়ে নয়। সম্পর্ক হবে বন্ধুসুলভ। কারো প্রতিই আমাদের দূর্বলতা নেই, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতিতে আমরা বিশ্বাসী।

প্রশ্ন – এই দুই সম্পর্কে আপনাদের মূল্যায়ন কি?

উত্তর – দুই পরাশক্তির চরম সংঘাতে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো নাটকীয় ভাবে পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। বামপন্থীরা যদি জনগণকে সংগঠিত করতে না পারে তবে একেক পর এক নাটক ঘটে যাবে এবং জনগণ নিরব দর্শের ভূমিকা পালনে বাধ্য হবে। যে কোন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হবে।

প্রশ্ন – আফগানিস্তানে রুশ হস্তক্ষেপকে আপনারা কি মনে করেন?

উত্তর – এটা আগ্রাসন।

প্রশ্ন – ভিয়েতনাম চীন যুদ্ধকে আপনারা কী মনে করেন?

উত্তর – এটা নিন্দনীয়। চীন বিগ ব্রাদার এটিচ্যুড দেখিয়েছে। এ ভূমিকায় চীনের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে।

প্রশ্ন – ভিয়েতনাম কম্বোডিয়ায় যা করছে?

উত্তর – এটাও এক ধরণের আগ্রাসন। এগুলো নিন্দনীয়। আমরা মনে করি সঠিকভাবে সমাজতান্ত্রিক ধ্যান ধারণার অনুশীলন হচ্ছে না। সে জন্য কোন সমাজতান্ত্রিক শক্তির লেজুড়বৃত্তি করা আমরা সমর্থন করি না।

প্রশ্ন – রাশিয়াকে আপনারা সমাজতান্ত্রিক দেশ বলে মনে করেন?

উত্তর – উৎপাদন ব্যবস্থা অনুযায়ী রাশিয়া সমাজতান্ত্রিক দেশ।

প্রশ্ন – তাহলে একটি দেশ একাধারে সমাজতান্ত্রিক এবং আগ্রাসী ও আধিপত্য বাদী হতে পারে?

উত্তর – গ্লোবাল পলিটিক্সে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে। আমাদের কাছে এখনও পুরো তথ্য নেই। কিন্তু গ্লোবাল কনটেক্সট – এ ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য চীন এবং রাশিয়ার বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হবে।

প্রশ্ন – তাহলে আবার রুশ আগ্রাসনকে নিন্দা করছেন কেন?

উত্তর – এটাকে যেমন নিন্দা করছি তেমন সাম্রাজ্যবাদের পায়তারারও নিন্দা করছি।

প্রশ্ন – তাহলে রাশিয়া যে বলছে সাম্রাজ্যবাদকে প্রতিহত করার জন্য তারা এটা করছে তাকে আপনারা সমর্থন দিচ্ছেন না কেন?

উত্তর – সাম্রাজ্যবাদ তো সেখানে তেমন কিছু করেনি। আসলে একটা দেশের জনগণ যা চায় তার বিরুদ্ধে কোন কিছু করাই আগ্রাসন। মার্কসবাদ লেনিনবাদ দমন নীতিতে বিশ্বাসী নয়।

প্রশ্ন – আপনার মতে চেকোশ্লোভাকিয়া বা হাঙেরিতে যা করেছে তাও তাহলে আগ্রাসন?

উত্তর – সমাজতান্ত্রিক দেশ মুক্তিযুদ্ধ রত যে কোন দেশকে সাহায্য করবে। যদি কোন সমাজতান্ত্রিক দেশ বিপদে পড়ে তাহলে তার সাহায্য করতে পারে। সুতরাং সবগুলোকে আমরা আগ্রাসন বলতে পারি না।

প্রশ্ন – চেকোশ্লোভাকিয়ার ক্ষেত্রে কি তা আগ্রাসন ছিল না?

উত্তর – আমি তা মনে করি না।

প্রশ্ন – ‘৭৫ এর পরিবর্তনের পর রাশিয়া আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য যদি কিছু করতো তবে কি তা অনুমোদন যোগ্য ছিল?

উত্তর – না, তা ছিল না। কারণ জনগণ ‘৭৫ এর পরিবর্তন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে গ্রহণ করেছিল।

প্রশ্ন – ‘৭১ এ রাশিয়ার ভূমিকা?

উত্তর – প্রশংসনীয়।

প্রশ্ন – শেখ মুজিবের শাসনামলে রাশিয়ার পররাষ্ট্র নীতি কি গ্রহনযোগ্য ছিল?

উত্তর – আমি মনে করি এটা ছিল শেখ মুজিব সরকারের দূর্বলতা। রাশিয়ার পররাষ্ট্র নীতি সম্পর্কে আমি কোন মূল্যায়ন করতে চাই না।

প্রশ্ন – দুই পরাশক্তির মধ্যে কোনটি বর্তমানে বেশী আগ্রাসী?

উত্তর – রাশিয়া বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশ। তাই তার আকাংক্ষা, যোগ্যতা এবং ক্ষমতা দুই আছে বিশ্ব বিপ্লবের নেতৃত্ব দেয়ার। চীনের তা নেই। চীন অনেক পিছিয়ে আছে। তাই রাশিয়া স্বাভাবিক ভাবেই যেখানেই সাম্রাজ্যবাদ সেখানেই তাকে উৎখাত করতে সাহায্য করবে।

প্রশ্ন – তাহলে রাশিয়া এঙ্গোলা, ইথিওপিয়া, আফগানিস্তানে যা করছে তার নিন্দা আমরা করবো কেন?

উত্তর – জনগণ যেটাকে গ্রহণ করবে না আমরা তার নিন্দা করবো। আফগানিস্তানে রাশিয়ার পদক্ষেপ পুরো সঠিক বলে আমরা তা মনে করি না। কিন্তু বর্তমান সরকার যদি আমাদের উপর আঘাত করে আর আমরা যদি তার সাহায্য চাই তবে তা আগ্রাসন হবে না।

প্রশ্ন – আওয়ামী লীগ যদি সাহায্য চায় তবে সমর্থন করবেন কি?

উত্তর – আওয়ামী লীগ গণধীকৃত শক্তি হিসেবে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। এটা আবার রাশিয়ার সাহায্য নিয়ে জনগণের কল্যাণ সাধন করবে এটা মেনে নিতে পারি না।

প্রশ্ন – জাসদ কি তাহলে গণধীকৃত আওয়ামী লীগকে দশ দলের মধ্যে এনে মর্যাদা দানের চেষ্টা করছে না?

উত্তর – আপনাকে আমি পাল্টা প্রশ্ন করবো ণা যে জাসদ নয়, সরকারই আওয়ামী লীগকে মর্যাদা দান করে্ে। সব রকম সাহায্য দিয়ে পুনর্বাসিত করেছে।

প্রশ্ন – বর্তমান সরকার যে উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসিত করেছে জাসদ কি তাকেই গ্রহন করছে না?

উত্তর – দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ থেকে আমরা জানি যে দুই বিপরীত ধারার মিলনেই বস্তুর সৃষ্টি। আমরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বস্তুকেই সৃষ্টি করছি। তাছাড়া তারা আমাদের প্রধান শত্রু বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে।

প্রশ্ন – মুসলিম লীগও বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে লড়ছে?

উত্তর – হ্যাঁ, আমরা বলছি তো যে এ ঐক্য নয় দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।

প্রশ্ন – জামাত ইসলামও আসতে পারে?

উত্তর – যারাই স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে চায় তার সঙ্গেই ঐক্য হতে পারে।

প্রশ্ন – ‘৭৫ এর ৭ নভেম্বরের ঘটনাবলী আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

উত্তর – ৭ নভেম্বর স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে কোন ঘটনা ঘটেনি। এটা একটা সংগঠিত ঘটনা ছিল এবং জাসদ তা সংগঠিত করে। এ সম্পর্কে আপনারা পরে জানতে পারবেন। আমার মনে হয় এখনো সময় আসেনি।

প্রশ্ন – প্রেসিডেন্ট জিয়া কি তখন আপনাদের সঙ্গে ছিলেন?

উত্তর – আমাদের সঙ্গে ছিলেন না তবে ওয়াদা করেছিলেন আমাদের সঙ্গে আসবেন।

প্রশ্ন – ক্ষমতা দখলের লক্ষ্য না থাকলে জাসদ ৭ নভেম্বরের ঘটনাকে সংগঠিত করলো কেন?

উত্তর – রুশ ভারতের হামলাকে প্রতিহত করার জন্য। লক্ষ্য ছিল জাতীয় সরকার গঠন করা।

প্রশ্ন – জাতীয় সরকার গঠনের জন্য অন্য কোন দলের সঙ্গে আপনারা কি আলোচনা করেছিলেন?

উত্তর – ৭ নভেম্বরের পরের ঘটনার গতি এত তীব্র ছিল যে আমাদের কোন কন্ট্রোল ছিল না। ১১ নভেম্বর মোশতাক সাহেবের বাসায় আমি একটি বৈঠক করি জাতীয় সরকার গঠনের লক্ষ্যে। কিন্তু ২৩ নভেম্বর পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করে।

প্রশ্ন – আপনি বলেছেন আপনারা রুশ ভারতের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন, সরকার মার্কিন সমর্থক। তাই যদি হয়ে থাকে তবে রুশ ভারতের আধিপত্যের বিরুদ্ধে যারা লড়াই করছে তাদের সরকার সমর্থন করবে না কেন?

উত্তর – মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা জানে জাসদ এ দেশে একটি বিপ্লবী শক্তি। সরকারের প্রয়োজন নেই জাসদের সমর্থনের। আমরা বার বার বলেছি আমরা সমর্থন দেবো। কিন্তু আমাদের সমর্থন তো তারা নেবে না, নিচ্ছে না। তার মানেই হচ্ছে জাসদ একটা বিপ্লবী সংগঠন। জাসদকে তারা সঙ্গে নিতে পারে না।

প্রশ্ন – রুশ ভারত সমর্থন কারী আওয়ামী লীগ সরকার জাসদের উপর এত জুলুম চালিয়েছিল কেন?

উত্তর – কারণ তাদের প্রত্যেকটি অপকর্মের বিরুদ্ধে জাসদই ছিল একমাত্র সক্রিয় শক্তি।

প্রশ্ন – আপনি বলেছেন রাশিয়া বিপ্লবী শক্তি, আরেকটি বিপ্লবী শক্তির উপর আঘাত করতে কি করে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে?

উত্তর – তখন আমাদের পরিষ্কার আহবান ছিল চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার।

প্রশ্ন – আওয়ামী লীগের প্রতি রাশিয়ার সমর্থন তখন কি বৈপ্লবিক ছিল না?

উত্তর – জনগণ যা সমর্থন করে না তা সমাজতান্ত্রিক হতে পারে না।

প্রশ্ন – কিন্তু রাশিয়া তো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতা হতে পারে আপনি বলেছেন?

উত্তর – তা বলেছি ক্ষমতার দৃষ্টিভঙ্গীতে। রাশিয়ার সে ক্ষমতা আছে৷ চীন আমাদের হতাশ করেছে৷

প্রশ্ন – রাশিয়া হতাশ করেনি?

উত্তর – আমরা রাশিয়াকে দেখছি৷

প্রশ্ন – এ দেখার মধ্যে আশাবাদ কতখানি?

উত্তর – আমরা লেজুড়বৃত্তি করছি না। পুরো তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে আমরা দেখছি৷ মূল্যায়ন করতে হলে আমাদের তথ্যের প্রয়োজন, তথ্য কতটুকু আমাদের হাতে আছে।

প্রশ্ন – জাসদ কেন শ্রেণী সংগঠন?

উত্তর – জাসদ সমাজতান্ত্রিক গণসংগঠন। এখানে বিভিন্ন শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব রয়েছে৷ আমরা মনে করি নিরন্তর আন্দোলনের মাধ্যমে এই পার্টি একটি বিপ্লবী শক্তি জন্ম দেবে।

প্রশ্ন – মার্কসবাদ অনুসারে, বিভিন্ন শ্রেণীর দল আসলে বুর্জোয়া দল, যদি তার সর্বহারা একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য না থাকে?

উত্তর – জাসদকে আমরা বিপ্লবী সংগঠন বলছি না৷ আমরা বলছি এটা সমাজতান্ত্রিক গণসংগঠন।

প্রশ্ন – জাসদ কোন শ্রেণীর জন্য ক্ষমতা দখল করবে?

উত্তর – জাসদ ক্ষমতা দখলের জন্য একটি বিপ্লবী শক্তির জন্ম দেবে৷ জাসদ বিপ্লবী পার্টি নয়৷ আমরা দেখেছি যারা অতীতে শ্রমিকদের দিয়ে মার্কসবাদী পার্টি গঠন করতে চেয়েছে তারা শুধু শ্রমিকদের মাঝেই সীমাবদ্ধ থেকেছে – শুধু ট্রেড ইউনিয়নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। যারা কৃষকদের নিয়ে পার্টি করতে চেয়েছেন তারা বিশেষ এলাকায় সীমাবদ্ধ রয়েছেন, যারা বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে পার্টি করতে চেয়েছেন তাও সীমাবদ্ধ রয়েছেন। মার্কসবাদী পার্টি তৈরী করা যায় না, এটি জন্ম নেয় একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে। এখানে খাঁটি অর্থে শ্রমিক নেই – ব্যাপক জনগণের মধ্যে সংগঠন করতে হবে। এখানে ক্লাসিকাল অর্থে প্রলেতারিয়েত নেই৷ এখানে অর্থনীতি হচ্ছে পেটি বুর্জোয়া প্রাধান্যের অর্থনীতি। এখানে বিশেষ একটা গ্রুপকে শ্রেণীচ্যুত হয়ে সংগঠিত করতে হবে কৃষক এবং প্রলেতারিয়েতদের। জাসদের মধ্যে এই শ্রেণীচ্যুত হওয়ার প্রক্রিয়াটা রয়েছে।

প্রশ্ন – জাসদে যারা আসবে তারা কি শ্রেণীচ্যুত হওয়ার জন্য আসবে?

উত্তর – হ্যাঁ, তারা শ্রেণীচ্যুত হওয়ার জন্যই আসবে। তবে সবাই শ্রেণীচ্যুত হবে এমন কোন কথা নেই৷ গণসংগঠন বহুদিন পর্যন্ত থাকবে। ক্ষমতা দখলের পরও থাকতে পারে। কারণ সমাজতান্ত্রিক সমাজ শ্রেণীহীন সমাজ নয়। সেহেতু গণসংগঠন সেখানেও থাকতে পারে।

প্রশ্ন – গণসংগঠন আর রাজনৈতিক দল এক জিনিস নয়। রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য হচ্ছে ক্ষমতা দখল। জাসদ আসলে কি?

উত্তর – এটা হচ্ছে একটা প্ল্যাটফরম। এই সংগঠনটি আন্দোলন করার সংগঠন।

প্রশ্ন – জাসদের মধ্যে বুর্জোয়া এবং প্রলেতারিয়েত দ্বন্দ্বের সমাধান আপনারা কিভাবে করছেন?

উত্তর – দ্বন্দ্বকে আমরা ভয় পাই না। জাসদের যারা নিয়ন্ত্রক তারা বিপ্লবী। ৭ বছর ধরে আমরা বিভিন্ন আঘাতের সম্মুখীন হয়েছি। কিন্তু জাসদ আজও ভাঙ্গেনি।

প্রশ্ন – বুর্জোয়া পেটি বুর্জোয়াদের ভবিষ্যৎ না থাকলে তারা এ পার্টিতে আসবে কেন?

উত্তর – ভবিষ্যৎ রয়েছে। যারা এ পার্টিতে আসবে তারা বিপ্লবকে মেনে নিয়েছে।

প্রশ্ন – দশ দলের আন্দোলনের ফলে যদি সরকারের পতন হয় তবে জাসদ আওয়ামী লীগের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করবে কি?

উত্তর – এটা আমি একা বলতে পারবো না। পার্টি সিদ্ধান্ত নেবে।

প্রশ্ন – তাহলে এ সরকারের পর আমরা কি আশা করব?

উত্তর – নতুন একটি সরকার।

প্রশ্ন – তার সঙ্গে জাসদের কি সম্পর্ক হবে?

উত্তর – টাইম উইল ডিসাইড। টাইম ইজ দ্য ফ্যাক্টর। ওয়েট এন্ড সি।

এরপর বিচিত্রার প্রতিনিধি দেশের অর্থনীতি সম্পর্কে প্রশ্ন করতে চাইলে জাসদ সভাপতি সময়াভাবের কথা বলে সাক্ষাৎকারের পরিসমাপ্তি ঘটান।

***

জনগণ ক্ষমতায় পাঠালেই জাসদ ক্ষমতায় যাবে

– শাজাহান সিরাজ

প্রশ্ন – জাসদ শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে কি কি রাজনৈতিক কর্মসূচী গ্রহণ করেছে?

উত্তর – শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থার কর্মসূচী বাস্তবায়ন করতে গেলে দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের প্রয়োজন। বর্তমান পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে হবে এবং একই সঙ্গে বন্টন ব্যবস্থারও পরিবর্তন করতে হবে। মেহনতি খেটে খাওয়া মানুষের নেতৃত্বে সংগঠিত ভবিষ্যতের সংগ্রামের সফলতার দ্বারে পৌছানো সম্ভব। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য মেহনতি মানুষের প্রতিটি আন্দোলনেই তার বীজ নিহিত থাকতে হবে৷

প্রশ্ন – সুস্পষ্ট ভাবে কি কি অর্থনৈতিক কর্মসূচী এ জন্য থাকা দরকার?

উত্তর – অর্থনীতি ক্ষেত্রে ব্যক্তি মালিকানার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানা আনতে হবে। সমস্ত জনগণ শ্রমের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে, তাদের দক্ষতা এবং শ্রম অনুযায়ী তারা মজুরী পাবে।

প্রশ্ন – ব্যক্তি মালিকানা?

উত্তর – সাধারণভাবে থাকবে না।

প্রশ্ন – সাধারণ ভাবে থাকবে না তাহলে ব্যতিক্রম ঘটবে কোন ক্ষেত্রে?

উত্তর – চীন রাশিয়ায় আমরা দেখছি প্রত্যেকের একটা করে বাড়ি, বাগান করার অধিকার আছে, তা থাকতে পারে।

প্রশ্ন – ব্যক্তিগত সঞ্চয় করা চলবে কি?

উত্তর – ব্যক্তিগত ভাবে একজন মানুষ এমন কিছু করতে পারবে না যা আরেকজকে শোষণ করতে পারে।

প্রশ্ন – কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় এ পরিবর্তন কেমন করে আনা হবে?

উত্তর – ধাপে ধাপে হবে। আমরা অনেকে মনে করি রাতারাতি বোধহয় পরিবর্তন এসে যাবে। আসলে তা নয়। সঙ্গে সঙ্গেই কোন কিছু হবে না। জনগণকে সচেতন করতে হবে এটা হরতে হলে। জোর করে তা করা যাবে না। এজন্য দীর্ঘদিন সময় লাগবে।

প্রশ্ন – আপনারা বলেন শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লব…. এই শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবের নেতৃত্ব দেবে কে?

উত্তর – শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি।

প্রশ্ন – জাসদ কি শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি?

উত্তর – জাসদ শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি নয়। জাসদ সমাজতান্ত্রিক গণসংগঠন। শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি যাতে গড়ে ওঠে জাসদ সে জন্য সব শ্রেণীর জনগণের মধ্যে আন্দোলন করে যাচ্ছে। এটাই তার দায়িত্ব।

প্রশ্ন – গণসংগঠন জাসদ শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবের নেতৃত্ব দিতে গেলে তার মধ্যে বিচ্যুতির আশংকা কি নেই?

উত্তর – জাসদ যদি শ্রেণীর নেতৃত্ব দিতে পারে তবে জাসদই বিপ্লব করবে।

প্রশ্ন – বিভিন্ন শ্রেণীর সংগঠন জাসদের বিচ্যুতির সম্ভাবনা আছে কিনা?

উত্তর – সাচ্চা কম্যুনিস্ট পার্টির মধ্যেও বিচ্যুতি আছে। কার মধ্যে আছে আর কার মধ্যে আসবে এটা এই মুহূর্তে বলা যায় না।

প্রশ্ন – ক্ষেত্র বিশেষে অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার কিভাবে জাসদ পরিবর্তন ঘটাবে?

উত্তর – সরকারী হিসাবেই ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা শতকরা ৫৭ ভাগ। এটা হচ্ছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কারণেই। এদের বাদ দিয়ে কোন কর্মসূচীই সফল হতে পারে না। তাই আমাদের দেশে জমির সিলিং করতে হবে।

প্রশ্ন – আমাদের দেশে সিলিং তো আছে?

উত্তর – যা আছে তা কাগজে কলমে – বাস্তবে নেই৷ পরিবারের সংজ্ঞা এবং প্রয়োজন নির্ধারণ করে সিলিং করা হবে। খাস জমি উদ্ধার করতে হবে৷ সিলিং অতিরিক্ত জমি, খাস জমি ভূমিহীনদের দিতে হবে এবং কৃষি উপকরণ নাম মাত্র মূল্যে বা বিনামূল্যে দেয়া হবে।

প্রশ্ন – কিন্তু আপনাদের গৃহীত ব্যবস্থাও যে ব্যর্থ হবে না তার নিশ্চয়তা কি?

উত্তর – আমাদের যে অর্থনৈতিক কর্মসূচী আছে তা বর্তমান প্রশাসনিক কাঠামোর পরিবর্তন ছাড়া বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এ জন্য গ্রাম সরকার গঠন করতে হবে। বিভিন্ন পেশা ভিত্তিক মানুষের প্রতিনিধিত্ব এ সরকারে থাকবে৷ সকল প্রশাসনিক ব্যবস্থা এই গ্রাম সরকারের অধীনে থাকবে।

প্রশ্ন – জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে আপনাদেন বক্তব্য কি?

উত্তর – আমরা মনে করি আমাদের সম্পদের সঠিক বন্টন করতে পারলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি আমাদের জন্য কোন সমস্যা হিসাবে থাকবে না।

প্রশ্ন – প্রশাসনিক কাঠামোর পরিবর্তনের জন্য বিপ্লব আবশ্যক। আমাদের দেশে কিভাবে বিপ্লব ঘটানো সম্ভব?

উত্তর – বিপ্লব জনগণ করবে। বিপ্লব মানে জনগণের উৎসব। জনগণ যখন প্রয়োজন মনে করবে তখন বিপ্লব সংঘঠিত হবে। যেদিন জনগণ মনে করবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই, তখন জনগণ আন্দোলনের মাধ্যমে বিপ্লব সম্পন্ন করবে।

প্রশ্ন – আমাদের দেশে বিপ্লবের স্তর কি?

উত্তর – সমাজতান্ত্রিক ।

প্রশ্ন – বিপ্লবের পর যে সরকার হবে তা কি সমাজতান্ত্রিক হবে?

উত্তর – যদি বিপ্লবী পার্টির নেতৃত্বে বিপ্লব হয় তবে সমাজতান্ত্রিক সরকার হবে।

প্রশ্ন – জাসদের বিপ্লবী পার্টি আছে কি না?

উত্তর – জাসদ বিপ্লবী পার্টি যাতে গড়ে ওঠে সে জন্য কাজ করে যাচ্ছে৷

প্রশ্ন – আমরা কি ধরে নেব এখন সে ধরণের বিপ্লবী পার্টি নেই?

উত্তর – তা ধরে নিতে পারেন।

প্রশ্ন – জাসদ যে টোটালেটারিয়ান সমাজ ব্যবস্থার কথা বলছে, তাতে সংবাদ পত্রের ভূমিকা কি হবে?

উত্তর – সংবাদ পত্র স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ হবে।

প্রশ্ন – রাজনৈতিক দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকে। জাসদের মধ্যে কি দ্বন্দ্ব আছে?

উত্তর – পার্টির মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকা স্বাভাবিক। আমাদের লক্ষ্যের প্রশ্নে কোন দ্বন্দ্ব নেই। আছে আন্দোলনের পথ নিয়ে। কাজেই কৌশলের প্রশ্নেও দ্বন্দ্ব থাকতে পারে। দ্বন্দ্বকে আমরা বৈজ্ঞানিক ভাবেই মোকাবিলা করি। আমাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে কিন্তু সে দ্বন্দ্ব ভাঙ্গার জন্য নয়। সে দ্বন্দ্ব বিকাশের জন্য।

প্রশ্ন – গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার বা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব – এ নিয়ে কোন ‘দ্বন্দ্ব’ আছে কিনা?

উত্তর – এ নিয়ে কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। সমাজতন্ত্রের প্রশ্নে আমরা সবাই একমত। গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার আন্দোলন ও কৌশলের ব্যাপার হতে পারে। তা নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকতে পারে।

প্রশ্ন – জাসদ সাতদিনের মধ্যে ক্ষমতায় যাওয়ার আশা করে?

উত্তর – সেটা হিসেব করে বলা সম্ভব নয়। জনগণ যেদিন ক্ষমতায় পাঠাবে আমরা সেদিনই ক্ষমতায় যাব। জনগণকে বাদ দিয়ে অন্য কোন পথে ক্ষমতায় যেতে আমরা বিশ্বাসী নই৷

প্রশ্ন – বিচিত্রার উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?

উত্তর – এটা আমাদের রাজনীতির জন্য শুভ লক্ষণ এই যে বিচিত্রার মত সাপ্তাহিক দেশের রাজনীতিকে জনগণের সামনে তুলে ধরছে। আমি মনে করি তা দেশের সার্বিক উন্নতিতে শুভ প্রভাব ফেলবে।

***

জাতীয় কমিটি

জাসদের দ্বিতীয় জাতীয় সম্মেলনে নির্বাচিত জাসদের জাতীয় কমিটিঃ

সভাপতি – মেজর (অবঃ) এম, এ, জলিল

সহ-সভাপতি – মির্জা সুলতান রাজা, রুহুল আমিন ভূইয়া, ডাঃ আজহারউদ্দীন আহমদ, চিত্তরঞ্জন গুহ, আবদুল্লাহ সরকার।

সম্পাদক – আ স ম আবদুর রব

যুগ্ম – সম্পাদক – শাজাহান সিরাজ

সাংগঠনিক সম্পাদক – নূর আলম জিকু

দফতর সম্পাদক – মাজহারুল হক টুলু

সহকারী দফতর সম্পাদক – হুমায়ুন কবির হিরু, সুমন আহমেদ।

প্রচার সম্পাদক – মোবারক হোসেন

সাংস্কৃতিক ও সমাজসেবা সম্পাদক – মেসবাহউদ্দিন আহমদ

শ্রম বিষয়ক সম্পাদক – জাফর সাজ্জাদ খিচ্চু

কৃষি বিষয়ক সম্পাদক – এ বি এম শাহজাহান

তথ্য ও গণ-সংযোগ বিষয়ক সম্পাদক – খালেকুজ্জামান ভূঁইয়া

আইন বিষয়ক সম্পাদক – আসাফদ্দৌলা

মহিলা বিষয়ক সম্পাদক – মমতাজ বেগম

সহ-সম্পাদক – আবদুল লতিফ মির্জা, শাহজাহান খান, গোলাম মোস্তফা, একারামুল হক ও আনিসুর রহমান।

কোষাধ্যক্ষ পদে কাউকে নির্বাচন করা হয়নি। জাতীয় কমিটির সদস্য পদে আরও ৩৬ জন নির্বাচিত হয়েছেন।