দেশবিভাগ বিচার একুশ শতকে দাঁড়িয়ে-২
ভারতীয় রাজনীতির দুর্ভাগ্য যে সে যুক্তিবাদী ও সেকুলার চিন্তার বিচক্ষণতায় ভর দিয়ে বরাবর চলতে পারে নি। বরং স্ববিরােধিতা তার চলার পথ নিয়ন্ত্রণ করেছে। ইতিপূর্বে আলােচনায় এটা স্পষ্ট যে ওই ‘প্যারাডক্স’ যেমন আদর্শে তেমন ব্যক্তিনেতৃত্বে এই উভয় দিকে পরিস্ফুট। বিগত শতকের ১৯০৫ সন থেকে চার দশকের রাজনৈতিক ঘটনাবলী ও নেতাদের আচরণে তেমন আভাস মেলে। প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতাদের ব্যক্তিত্বেও ছিল যথেষ্ট স্ববিরােধিতা। গান্ধি (১৮৬৯-১৯৪৮) বিলেতি ব্যারিস্টার হয়েও গভীর ভাবে সনাতন ধর্মে ও গাে-রক্ষায় বিশ্বাসী। রামরাজ্য স্থাপন তার রাজনৈতিক আদর্শের জীবন সাধনা। খাদি-চরকা সে আদর্শের ব্রত তবু হিন্দু-মুসলিম ঐক্যে বিশ্বাস নিয়ে আলীভ্রাতাদের সঙ্গে কথিত ইলমি রক্ষার খিলাফত আন্দোলনে যােগ দিতে তার আদর্শে বাধেনি। ওটা হয়ে ওঠে রাজনৈতিক কৌশল । অন্যদিকে ধর্মাচরণে যে অনাগ্রহী, পুরােপুরি বিলেতি কেতার জীবনাচরণে অভ্যস্ত সেই বিলেতি ব্যারিস্টার মােহাম্মদ আলী জিন্না (১৮৭৬-১৯৪৮) মুসলিম রাজনীতির হাতেখড়ি নিয়ে এক পর্যায়ে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের দূত হয়েও শেষ পর্যন্ত ধর্মীয় রাজনীতিকে লক্ষ্য অর্জনে হাতিয়ার করে তােলেন (১৯৪০)। এমন কি পালটে ফেলেন নিজেকে—থ্রিপিস্ স্যুট-টাই থেকে টুপি-শেরওয়ানিতে। প্রচারে বক্তৃতায় প্রধান বিষয় ইসলাম ও ইসলামি সংস্কৃতি, তাও মধ্যপ্রাচ্যের । আর খিলাফত-প্রধান মাওলানা মােহাম্মদ আলী (১৮৭৬-১৯৩১) আধুনিক শিক্ষায় মেধাবী রাজনীতিবিদ, লেখক, সুবক্তা ও সম্পাদক (উর্দু ‘হামদর্দ’, ইংরেজি ‘কমরেড’ পত্রিকার) এবং জামিয়া মিল্লিয়ার মতাে সেকুলার প্রতিষ্ঠানের সহ-প্রতিষ্ঠাতা (১৯২০) হয়েও ধর্মীয় রাজনীতিকে বর্জন করতে পারেন নি। অথচ ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা-অর্জন তার রাজনৈতিক আবেগের অংশ যা গান্ধির ক্ষেত্রে প্রচ্ছন্ন । ১৯২১ সালে কংগ্রেসের আহমেদাবাদ অধিবেশনে হসরত মােহানি উত্থাপিত ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি গান্ধির বিরােধিতায় বাতিল । স্বাধীনতাসংগ্রামী এই মােহানিও লীগ-কংগ্রেসের মতাে দুই নৌকোর যাত্রী। একই দোলাচলবৃত্তি ও স্বদেশী আন্দোলনে হিন্দু ধর্মীয় আচারের প্রবক্তা ছিলেন বিলেতিকেতায় অভ্যস্ত, দেশনায়ক সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (সুমিত সরকার)।
চিত্তরঞ্জনও এ দ্বিচারিতা থেকে খুব একটা মুক্ত ছিলেন না (বেঙ্গল প্যাক্ট প্রসঙ্গ বাদে)। | আরেক খাস কংগ্রেস নেতা হাকিম আজমল খান (১৮৬৩-১৯২৭) সেকুলার রাজনীতিক ও স্বাধীনতাসংগ্রামী হয়েও খিলাফত প্রধান, লীগ-প্রেসিডেন্ট, কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট, জামিয়া মিল্লিয়ার প্রতিষ্ঠাতা, একই সঙ্গে জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী। প্রায় একই কথা খাটে কংগ্রেস-নেতা ডা. এম, এ, আনসারি সম্পর্কে। ভিন্ন নন হসরত মােহানি। তবে মােহানি কট্টর ব্রিটিশ-বিরােধী, কবি, স্বাধীনতাসংগ্রামী । এরা ভারত স্বার্থের পাশাপাশি মুসলিম রাজনৈতিক স্বার্থকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন। যে জন্য কংগ্রেস-লীগ উভয় অঙ্গনে তাদের বিচরণ। অথচ রাজনৈতিক বিচারে বিচক্ষণতার প্রকাশ ঘটতাে যদি এরা দুই পরস্পর-বিরােধী অঙ্গনে বিচরণ না করে জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের মুসলিম স্বার্থনির্ভর ভারতীয় স্বাধীনতার আদর্শে ভিত্তিতে পৃথকভাবে সংগঠিত করে স্বতন্ত্র সেকুলার রাজনৈতিক শক্তির সংগঠন গড়ে তুলতেন। তাহলে কংগ্রেসের ওপর মুসলিম স্বার্থবিষয়ক চা য়েমন থাকতত তেমনি জিন্নার হাত ধরে মুসলিম লীগ দ্বিজাতিতত্ত্বের মাধ্যমে মুসলমান স্বার্থের একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে প্রবল শক্তিমান হয়ে উঠতে পারতাে না। স্ববিরােধিতা অনেকাংশে হ্রাস পেতে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রতিরােধের সম্মুখীন হতাে। ভারতবিভাগের পথ বাধাগ্রস্ত হতাে।
কিন্তু এরা স্বনামখ্যাত রাজনীতিক হওয়া সত্ত্বেও জিন্নার মতাে এক লক্ষ্যমুখী অর্জুন’ হতে পারেন নি। রাজনীতিতে উদারতা ও নমনীয়তার সংমিশ্রণ ঘটানােতে অভ্যস্ত বিধায় এরা মুসলিম সেকুলার রাজনীতিকে শক্তিমান সাফল্যে পৌছে দিতে পারেন নি। অন্যদিকে কংগ্রেস তার ঘােষিত সেকুলার জাতীয়তাবাদী আদর্শের মর্যাদা রক্ষা করতে পারেনি মূলত গান্ধি ও দক্ষিণপন্থী রক্ষণশীলতার প্রাধান্যের কারণে । সরদার প্যাটেল (কথিত লৌহমানব)-এর জাতীয়তাবাদী চেতনায় হিন্দুত্ববাদের প্রভাব ছিল যথেষ্ট। কংগ্রেস রাজনৈতিক চেতনা বিচারে দক্ষিণী আদর্শে প্রভাবিত। তাই সেকুলার বাম জাতীয়তাবাদী, প্রবল স্বাধীনতাকামী সুভাষচন্দ্র দু’বার কংগ্রেস সভাপতি হয়েও কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত । হিন্দি বলয়ে নীতিগতভাবে তার সমর্থক শীর্ষনেতা না থাকায় শুধু বঙ্গের পরিণত অংশ নিয়ে কেন্দ্রীয় কংগ্রেসকে সেকুলার রাজনীতিতে পৌছে দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয় নি। সাম্প্রদায়িক প্রশ্নে কংগ্রেস এজাতীয় দ্বিচারিতা থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি । কথিত সেকুলার জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে এ ধরনের স্ববিরােধিতা ও নৈরাজ্য সত্যি বলতে কি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক পটভূমিতে কংগ্রেসকে দুর্বল করে তুলেছিল। বিশেষ করে ১৯৪০-এ লাহাের প্রস্তাবে জিন্নার জিহাদি ডাকের পর থেকে সেটা আরাে স্পষ্ট। স্বতন্ত্র নির্বাচনে স্বধর্মীয় বলয়ে একাট্টা বিজয় সর্বসম্প্রদায়ের রাজনৈতিক লেনদেনে যে যথেষ্ট নয় তার প্রমাণ তাে পরবর্তী সাত বছরের ঘটনাবলী। প্রতিপদে কংগ্রেস পিছু হটেছে। তার আদর্শবাদী অন্তরশক্তিতে ক্ষয় ধরেছিল। হিন্দুত্ববাদী প্রভাব ক্রমশ বেড়েছে। আজাদ বা নেহরুর সাধ্য কি তা ঠেকায় । বিশ শতকের শুরু থেকে মধ্যপর্বের সালতামামিতে দেখা যায় গান্ধির মধ্যপন্থী দোদুল্যমানতা, তিলক-লাজপত প্রমুখের সঙ্গে মালব্য-মুঞ্জে প্রমুখ হিন্দুত্ববাদীর সখ্য, চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বেঙ্গল প্যাক্টেরও অকাল মৃত্যু (১৯২৬), কলকাতা সম্মেলন (১৯২৮) ও ঐক্য প্রসঙ্গে ডানপন্থী প্রভাবিত কংগ্রেসের অযৌক্তিক জিন্না বিরােধিতাবঙ্গে প্রজাপার্টি এবং যুক্তপ্রদেশ ও বােম্বাইয়ে লীগের সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা গঠনে কংগ্রেসের অসম্মতি, সুভাষের বহিষ্কার, পাঞ্জাবে সিকান্দার হায়াত খানের অকালমৃত্যু (১৯৪২) ইত্যাদি ঘটনা সম্প্রদায়বাদী লীগ রাজনীতিকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। মুসলিম রাজনীতিতে জিন্নার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্রমশ নিশ্চিত হতে থাকে ভারতবিভাগের বাঞ্ছিত-অবাঞ্ছিত পথ।
বিভাগােত্তর ছয় দশকেরও বেশি সময়-পর্বের রাজনৈতিক ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে আজ প্রশ্ন উঠতে পারে, পূর্বোক্ত পরিস্থিতি কি এতটাই নিয়তিনির্ধারিত ছিল যে দেশবিভাগের কোনাে বিকল্প ছিল না? পথ কি মাত্র একটিই ছিল যে অন্য কোনাে পথে ক্ষমতার হস্তান্তর সম্ভব ছিল না? রাজনীতিতে বিশেষ করে বিতর্কিত সমস্যায় এমনটি সাধারণত দেখা যায় না। বিষয়টা তাে অভিমন্যুর মৃত্যুব্যুহ নয় যে এতে বিকল্প একাধিক পথ খােলা থাকবে না। পথ অবশ্যই ছিল। কিন্তু তা নিয়ন্ত্রণে আনার ক্ষমতা ও বিচক্ষণতা বহুমত-বিভক্ত কংগ্রেস নেতৃত্বের ছিল না। মন্ত্রীমিশন প্রস্তাবে আজাদের যথেষ্ট আগ্রহ ছিল, কিন্তু নেহরুর এক আলটপকা মন্তব্যে ও জিন্নার জিহাদি মনােভাবে সব ভণ্ডুল। এরপর শুধু নেতির তিক্ততা। এর মধ্যে দূর হতাশায়ও আজাদের ১৫ এপ্রিলের ফেডারেল ব্যবস্থার প্রস্তাবটি পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব ছিল। আজাদ বরাবরই পাকিস্তান-দাবির কট্টর বিরােধী। তবু অবস্থাদৃষ্টে তার ইচ্ছা ছিল মুসলিম স্বার্থে জিন্নাকে কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও ভারতের অখণ্ডতা রক্ষার চেষ্টা করা হােক। কখনাে কখনাে গান্ধিও এমন ধারণা পােষণ করেছেন। কিন্তু কংগ্রেসী চরমপন্থীরা ভারতমাতাকে খণ্ডিত করতে রাজী, তবু শক্তিশালী কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা হতাছাড়া করতে রাজী নন। প্যাটেল এদের মধ্যমণি । নেহরু বরাবরই শক্তিশালী কেন্দ্র ও দুর্বল প্রদেশের পক্ষে। তাই হয়তাে বহুজাতিক-বহুভাষিক প্রদেশের স্বশাসন-নির্ভর বিজ্ঞানসম্মত ফেডারেশন ব্যবস্থার কথা তার মনে ধরে নি। গণতান্ত্রিক সমাজবাদী ভাবনার প্রবক্তা নেহরুর পক্ষে এমন অবস্থান অবিশ্বাস্যই ঠেকে। | আর জিন্নার পথ তাে একটাই ছিল যে-পথের শেষে একটি মাত্র মাইলফলকে চাঁদতারা-সহ আট অক্ষরে খােদিত শব্দ পাকিস্তান’ (PAKISTAN)। বিচক্ষণ আইনজীবী এর বিপরীত বিচারে ভাবতে চান নি যে অখণ্ড ভারতে মুসলমান জনসংখ্যার প্রতিনিধি রীতিমত তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হতে পারে ।
অখণ্ড বঙ্গ, অখণ্ড পাঞ্জাব মুসলিম সংখ্যাগুরু প্রদেশ হিসাবে তার দাবার ছকে হতে পারতাে গজ ও ঘােড়া। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক রাজনীতি-সচেতন নেহরু ভেবে দেখেননি খণ্ডিত ভারতের তুলনায় উপমহাদেশীয় অখণ্ড স্বাধীন ভারতবর্ষ বিশ্বভুবনে এশিয়ার অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। এমন একাধিক শুভ সম্ভাবনা মাটি করেছে ভারত বিভাগ, যদি দুষ্ট উপসর্গগুলাের কথা বাদও দেই। আর যুক্তবঙ্গ উভয় হিসাবেই প্রান্তিক প্রদেশ হয়েও বর্তমানের তুলনায় অধিক রাজনৈতিক শক্তি ও আর্থ-সামাজিক সমৃদ্ধির অধিকারী হতে পারতাে। পশ্চিমবঙ্গীয় মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক দুরবস্থাও হ্রাস পেতাে। রাজনৈতিক নেতারা (বিশেষত জাতীয়তাবাদীগণ) সাধারণত দলীয় স্বার্থের বাইরে সুস্থ সামাজিক স্বার্থ ও জনস্বার্থ নিয়ে মাথা ঘামান না, বুঝেও বােঝেন। প্রগতিচেতনার শিক্ষিতশ্রেণী যেমন কবি, সাহিত্যিক সেসব বিষয় পূর্বাহ্নেই বুঝে নেন, প্রকাশ করেন তাদের রচনায়, ধারণ করেন সমকালীন সংকট ও উত্তরণপস্থা। দেশবিভাগ, সাম্প্রদায়িকতা, মানবিকতার বিপর্যয় ইত্যাদি প্রসঙ্গেও এমনটি দেখা গেছে। মুশিরুল হাসানের মতে চল্লিশের দশক থেকে জাতীয়তাবাদী লেখকগণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সাংস্কৃতিক সমন্বয় ও সহাবস্থানের ওপর গুরুত্ব আরােপ করেছেন তাদের রচনায়। আজ (১৯৯৩-এ লেখা) ভারত, পাকিস্তানের মানুষ ও তাদের সরকার দেশবিভাগের উত্তরাধিকার নিয়ে যন্ত্রণাবিদ্ধ, হতাশাগ্রস্ত। এবং দেশভাগের প্রভাব প্রশমনে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন (পৃ. ৩৫, ৪৩)। ফয়েজের কবিতা উদ্ধৃত করে তিনি কবি লেখক শিল্পীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সমাজে শান্তি ও প্রগতি প্রতিষ্ঠার কাজে এগিয়ে আসতে।
প্রশ্ন তুলেছেন, এদেরকে কীভাবে ভাগ করা যাবে? অর্থাৎ যাবে না। যেমন একইভাবে অন্নদাশংকর রায়ের মন্তব্য যে দেশভাগ হলেও ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’। প্রসঙ্গত স্মরণ করতে পারি তিরিশের দশকের শেষদিক থেকে চল্লিশে এসেও প্রগতি লেখক সংঘ, গণনাট্য সংঘের মহত্ম প্রতিষ্ঠানের গণসংস্কৃতিচর্চা, লেখকদের হাতে রচিত বিপুল পরিমাণ প্রগতি সাহিত্য’-এর কথা যা বিষাক্ত রাজনীতির ওপর সুপ্রভাব ফেলতে পারেনি। মুরাজ, মান্টো, ফয়েজ, কৃষাণ চন্দর, মাজাজ, সাজ্জাদ জহির ও হীরেন মুখার্জি থেকে সলিল চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়দের সব চেষ্টা বৃথা গেছে। কুলদীপ নায়ার ফয়েজের কবিতা উদ্ধৃত করে লিখেছেন ‘দেশভাগজাত স্বাধীনতা নররক্তে রঞ্জিত স্বাধীনতা’। ফয়েজের প্রশ্ন ‘এই কি মুক্তির সকাল, রাতের আঁধারবিদ্ধ সকাল? ১৯৪৮-এও কিছু সংখ্যক মানুষ বঁটা আজাদির সত্য উপলব্ধি করেছিলেন। বিদেশী শাসন থেকে মুক্তির আনন্দে সাধারণ মানুষ, এমন কি শিক্ষিত শ্রেণীর সিংহভাগ মানুষ তা বুঝতে পারেন নি। দিন যত গেছে ক্রমে বিষয়টা স্পষ্ট হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ভারতীয় টিভি’র জমজমাট অনুষ্ঠানে অনেক শিক্ষিতকে আজাদি সম্পর্কে, দেশবিভাগ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করতে শুনেছি। এরা হয়তাে সংখ্যায় অল্প । ভারত-পাকিস্তানের মানুষ দেশবিভাগ সংক্রান্ত সম্প্রদায়চেতনার ‘আদিপাপ’ থেকে এখনাে মুক্ত হতে পারেনি। এমন কি ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যার ঘটনাবলীর ইতিহাস সামনে রেখেও বাংলাদেশ সংকীর্ণ ধর্মীয় চেতনার (১৯৪৭) প্রভাব থেকে পুরােপুরি মুক্ত হতে পেরেছে বলে মনে হয় না ।
যে দ্বিজাতিতত্ত্ব ও ধর্মীয় চেতনার ভিত্তিতে দেশবিভাগ (১৯৪৭) নানা কারণে এবং বিশেষ করে সেকুলার গণতন্ত্রী শাসনের তথা সুশাসনের অভাবে উপমহাদেশীয় সমাজ সে প্রভাব থেকে পুরােপুরি মুক্ত হতে পারে নি। এটা দেশবিভাগের অন্য এক ট্রাজেডি । কংগ্রেস প্রমাণ করতে পারেনি তারা সংখ্যালঘুর স্বার্থে আন্তরিক। বিভাগােত্তর ভারত সর্বজনীন স্বার্থের পরিচর্যায়। ব্যর্থ জিন্নার পাকিস্তান প্রতিশ্রুতির পরও ভারতীয় মুসলিম স্বার্থের একাংশের সঙ্গে প্রতারণা করেছে, অন্যদিকে মূলত পাঞ্জাবি ও ভারত প্রত্যাগত আমলা, উচ্চ ও উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণী ও পুঁজিপতি স্বার্থ রক্ষা করেছে, সেই সঙ্গে সামরিক শ্রেণীর সমৃদ্ধি । জনস্বার্থ বিপন্ন। দেশবিভাগের রাজনৈতিক লাভক্ষতির হিসাব সম্প্রদায়গত প্রেক্ষাপটে মিলাতে গেলে ক্ষতির ভার মুসলমানের দিকে। এর দায় জিন্না ও তার পাকিস্তানের। পাকিস্তান মেনে কংগ্রেস তথা হিন্দুজনতার ক্ষতি কিছুটা ভৌগােলিক বাকি সবটুকু নান্দনিক এবং তা ভারতমাতার অঙ্গচ্ছেদে। তবে পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে ক্ষতিটা বাস্তবিক। র্যাডক্লিফু স্বীকার করেছেন (কুলদীপ নায়ারের কাছে) যে তিনি ভাগবাটোয়ারায় পঞ্জিাবি অমুসলমান (হিন্দু-শিখ) ও বাঙালি মুসলমানদের প্রতি অবিচার করেছেন। উভয়েরই অধিকতর ভূখণ্ড প্রাপ্য ছিল (পৃ : ৫৯)। কিন্তু কেন করেছেন? সে জবাব তিনি দেন নি। তবে আর্থ-সামাজিক দিক থেকে ছিন্নমূল পাঞ্জাবি হিন্দু ও শিখ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত, তেমনি তুলনায় কিছু কম হলেও ক্ষতিগ্রস্ত পূর্ববঙ্গের সচ্ছল ও বিত্তবান শ্রেণীর ছিন্নমূল তথা উদ্বাস্তু হিন্দু সমাজ যাদের ভারতে গিয়েও ন্যূনতম মাত্রার জীবন যাপনের জন্য দীর্ঘকাল লড়াই করতে হয়েছে। নিমবিত্ত বা মুরুব্বিহীন উদ্বাস্তুদের নিরাপত্তাহীন জীবনযাত্রা শেয়ালদা স্টেশন চত্বর হয়ে এক রিফিউজি ক্যাম্প থেকে আরেক রিফিউজিক্যাম্প এবং ধুবুলিয়া-কুপার্স-দণ্ডকারণ্যমরিচঝাপির অজস্র কলােনিতে’ (দীপক পিপলাই) জীবনের দুর্দশা চিহ্নিত করেছে।
কোথায় কলকাতা, হুগলি, হাওড়া, ২৪ পরাগণা, আর কোথায় মধ্যপ্রদেশের দুর্গম দণ্ডকারণ্য! সবই জিন্না-নেহরু-প্যাটেল ও মাউন্টব্যাটেন সাহেবদের হাতে কাটা দেশবিভাগের দান! | দেশবিভাগের বিপজ্জনক কুহকে পড়ে ভারতীয় হিন্দু-মুসলমান পরাধীনতামুক্ত স্বদেশে সঠিক গন্তব্যে পৌছাতে পারেনি। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ঝড় মুক্তবুদ্ধি আচ্ছন্ন করে স্থায়ী ঠিকানা তছনছ করে দিয়েছিল। অবশ্য সবার নয়। মূলত সংখ্যালঘুদের। তারা হিন্দু নন, মুসলমান নন, শিখ নন, তারা সংখ্যালঘু। জিন্নার দ্বিজাতিতত্ত্ব আসলেই ছিল ‘মাইনরিটি তত্ত্ব। সে তত্ত্ব ধর্মনির্ভর ও মীমাংসাহীন । তাই মাইনরিটি তত্ত্বের যন্ত্রণা ত্রিধাবিভক্ত উপমহাদেশকে এখনাে বহন করতে হচ্ছে। কথিত সর্বসমস্যাহর (প্যানেশিয়া) দেশবিভাগ অনেক উপসর্গের মতাে মাইনরিটি উপসর্গ’ও দূর করতে পারেনি। করতে হলে গােটা উপমহাদেশকে ঢেলে সাজাতে হতাে যা বাস্তবে অসম্ভব এক প্রকল্প। দেশবিভাগ নামক ঘটনাটিকে (১৯৪৭-আগস্ট) দীর্ঘসময় পর আজ ২০১৩ আগস্টে দাঁড়িয়ে এ পর্যন্ত সংঘটিত নানা ঘটনার দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে দেখলে মূল ঘটনার উত্তরপ্রভাবজনিত সমস্যা ও উপসর্গ ক্রমশ বেড়ে চলছে। বলে মানতে হয়। নেহরু কথিত তত্ত্বালীন ‘দুষ্ট আবেগের জয়’ এখনাে প্রশমিত হয় নি। বরং নানা খাতে এর উপসর্গাদির এমন বিস্তার ঘটে চলেছে যে এর নিরাময়যােগ্য ভেষজের সন্ধান মিলছে না। তাই নানাজনের নানা লেখার সার সংকেত এমনই হয়ে দাঁড়াচ্ছে যে দেশবিভাগ আদপেই যুক্তিসঙ্গত ছিল না। কোনাে যুক্তিসঙ্গত প্রকল্পের পরিণাম এত অশুভ,এত অমানবিক হয়ে ওঠে না। যুক্তিসঙ্গত নয়, তবু সে অযৌক্তিক ঘটনা কেন ঘটেছে, এ প্রশ্ন একালে সেকালে অনেকের। ঘটার অনেক কারণ একসঙ্গে এসে শেষ পর্যন্ত বিস্ফোরক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল, তাই অঘটন। তার আগে একটি প্রবাদ কথা- যার শেষ ভালাে, তার সব ভালাে। সেই শেষ ভালাে তথা উত্তর-প্রভাবের অশুভ, অমঙ্গল ও অবাঞ্ছিত ঘটনাবলীর বিবেচনাতেই এমন ধারণা যে দেশবিভাগ যুক্তিসঙ্গত ছিল -নিয়তির মতাে পরিস্থিতি তাকে সেদিকে টেনে নিয়ে গেছে। অবাঞ্ছিত বহুঘটনার জটিল পরিণতির নাম ‘দেশবিভাগ (পার্টিশন)। এমনই এর শুভঅশুভ মাহাত্ম যে ইংরেজি ‘পার্টিশন’ শব্দটিও বাঙালির মুখে মুখে রপ্ত হয়ে গেছে।
মূল আলােচনায় আমরা দেখিয়েছি কীভাবে বিশ শতকের শুরু থেকে (এমন কি তার আগেও) শাসকশ্রেণীর চেষ্টা দুই সম্প্রদায়কে দুই স্বতন্ত্রপথে চালনার। তবে তা বিশেষভাবে শুরু ১৯০৫-এ সূচিত বঙ্গভঙ্গ বিরােধী আন্দোলনের জবাব দিতে- প্রথমত ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠনে সহায়তা, ১৯০৯ সালে মর্লি মিন্টো সংস্কার প্রস্তাবে স্বতন্ত্র নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন, তার সম্প্রসারিত প্রকাশ ১৯১৯-এ মন্টেগু-চেমসফোর্ড প্রস্তাবে এবং এ বিষয়ে সবচেয়ে মারাত্মক ১৯৩২-এ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র্যামজে ম্যাকডােনাল্ডের সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ যা ১৯৩৫-এ ভারত শাসন আইনে পরিণত । ঐক্যের কফিনে বড়সড় পেরেক। যাত্রা ভিন্ন, তবু ঐক্যের সম্ভাবনা মাঝে মধ্যে উঁকি দিয়ে গেছে, রোয়েদাদের আগে ও পরে। যেমন ১৯২৮-এ কলকাতা সম্মেলনে, ১৯৩৭-এর নির্বাচনশেষে লীগ-কংগ্রেস যুক্তমন্ত্রীসভা গঠনের সম্ভাবনায়। কংগ্রেসের একগুঁয়েমিতে তা পণ্ড। প্রতিক্রিয়ায় এরপর (১৯৪০) থেকে জিন্নারও জেদি বিপরীত পথে হাঁটা, সাম্প্রদায়িক প্রচার, দ্বিজাতিতত্ত্ব, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা। বিশেষ করে ১৯৪৬-আগস্টে কুখ্যাত কলকাতা গণহত্যার ধারাবাহিকতায় নােয়াখালি, বিহার, দিল্লি, বােম্বাই- সে এক অবিশ্বাস্য অমানবিক হত্যাউৎসব। সেসবের সঞ্চিত পরিণামে ভারত-বিভাগ ও স্বতন্ত্র ভুবন পাকিস্তান আদায়। তাতে জিন্নানেহরুদের রাজনৈতিক চিন্তা ও সিদ্ধান্ত কি ন্যায়বােধে দাঁড়াতে পেরেছিল? পরবর্তী প্রতিক্রিয়াতে তা মনে হয় না। | মাত্র কয়েকজনের সিদ্ধান্তে বহুজনের অগনিয়ন্ত্রণ’? বিষয়টা আসলে তাই । অনেক উদাহরণের মধ্যে দু চারটে ঘটনাই বিভাজনের অসঙ্গতি প্রমাণের জন্য যথেষ্ট, থিসিস রচয়িতাগণ সেক্ষেত্রে যাই বলুন না কেন। ব্যাপক নররক্তস্রোত ও ছিন্নমূল মানুষের যন্ত্রণার মতাে বিষয়াদি দেখেই বােধহয় কমবেশি আত্মগ্লানিতে ভুগেছেন দেশবিভাগের কারিগরগণ- কারাে মন্তব্য আগে, কারাে বা পরে। আর্জাদ, নেহরু, গান্ধি, এমন কি সম্ভবত জিন্নাও। আজাদ বলেছিলেন, “দেশভাগের জন্য উত্তরপুরুষ আমাদের ক্ষমা করবে না’ । গাফফার খানদের প্রতিবাদ তাে আগেই ক্ষুব্ধ গান্ধির নীরবতাই যথেষ্ট, তবে স্বাধীনতার সূর্য যে রক্ত ও ঘৃণার অন্ধকারে কালাে হয়ে গেল নিজের জীবন দিয়ে গান্ধি তা প্রমাণ করে গেলেন আর নেহরু তার একাধিক মন্তব্যে ‘দুষ্ট আবেগের জয়’ ছাড়াও তাদের ভুলের কথা, অসহিষ্ণু ক্লান্তির কথা (লেনার্ড মােসূলে) বলেই ইতি টানেন নি। মাউন্টব্যাটেনকে দেশভাগ সম্বন্ধে বলেন “তুমি এবং আমরা হয়তাে ভুল করেছি’ (স্ট্যালি উলপার্ট)। তিনি আরাে বলেন, উত্তর। প্রজন্মের ইতিহাসবিদগণ আমাদের ভুলভ্রান্তি নির্ধারণ করবে।
হ্যা, আমরা করছি। আর মােহাম্মদ আলী জিন্না? আশ্চর্য, পাকিস্তানের নিরন্তর প্রবক্তারও জানা ছিল না, পরিণতি বিচারে দেশবিভাগ সঠিক কি বেঠিক? অবশ্য তা সব কিছু ঘটে যাবার পরবর্তী ভাবনা। তার একান্ত সচিব কে, এইচ, খুরশিদের প্রশ্ন : ‘স্যার, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা কি ঠিক কাজ ছিল’? দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে জিন্নার জবাব : জানি না। একমাত্র ভবিষ্যত প্রজন্মই সে বিচার করতে পারবে’ (কুলদীপ, পৃ. ১৭)। মুল কারিগর সবাই তাদের কৃতকর্মের বিচার শেষ পর্যন্ত ভবিষ্যত সময় ও প্রজন্মের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। কুলদীপ নায়ার একাধিক শীর্ষ লীগ নেতার মনস্তাপের কথাও উল্লেখ করেছেন প্রসঙ্গত। হ্যা, দীর্ঘ ছয় শতক ধরে ভারতভাগের ঠিক-বেঠিক নিয়ে অনেক লেখক, ইতিহাসবিদ, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী নিজ নিজ মেধামাফিক বিচার ব্যাখ্যা করেছেন পক্ষে-বিপক্ষে। কিন্তু এর পরিণাম নিয়ে নিশ্চিত সদর্থক কথা উচ্চারণ কারাে পক্ষে সম্ভব হয়নি, যদিও এর দায় যে-যারমত প্রতিপক্ষের কাঁধে চাপিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। কিন্তু রক্তের সমুদ্রে ভাসমান মানুষের উত্তরপুরুষ, ছিন্নমূল যন্ত্রণাদীর্ণ মানুষ বা তাদের পরবর্তী প্রজন্ম অথবা মানবিক চেতনা সম্পন্ন বুদ্ধিজীবী কি মহাদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী মহাবিভাগের নায়কদের ক্ষমা করতে পেরেছেন (রবীন্দ্রপঙক্তি স্মর্তব্য)। বিশেষ করে যারা বুঝে শুনে এই মহাবিপর্যয় ঘটিয়েছিলেন? পূর্বোক্ত কারাে কারাে লেখা বা বক্তব্য থেকে মনে হয় ক্ষমা তারা করতে পারেন নি। তারা রাজনৈতিক নেতাহ ব্রিটিশরাজকেও এ অগ্রহণযােগ্য সর্বনাশের জন্য দায়ী করেছেন। জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার উপাচার্য ড. বশীরউদ্দিন আহমদ তাে দেশভাগের জন্য প্রধানত স্বতন্ত্র নির্বাচন ব্যবস্থাকে দায়ী করেছেন (যশবন্ত সিং পৃ. ৪৯৪)। যশবন্ত সিংহের মতে দেশভাগের প্রাপ্তির ক্ষেত্রে জিন্না-নেহরু-প্যাটেল কেউ সফল নন, পেছনে মূল কারিগর (তার ভাষায় ‘ধাত্রী’) ব্রিটিশরাজ। তার বিচারে জিন্না যেমন পাকিস্তানে রাষ্ট্র’ ও ‘জাতি’ (নেশন) তৈরিতে ব্যর্থ, তেমনি তিনি এবং নেহরু-প্যাটেলমাউন্টব্যাটেন ভারত ভেঙে জনসাধারণকে বিভক্তই করেছেন কিন্তু জাতির আবির্ভাব নিশ্চিত করতে পারেন নি (পৃ. ৫১৫)। বিষয়টা আসলে জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রশ্ন।
কিন্তু বহুজাতি-বহুভাষী অধ্যুষিত উপমহাদেশে একক জাতিররাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়। বহুজাতিক ফেডারেল ব্যবস্থার রাষ্ট্রগঠন বরং স্বাভাবিক ছিল যা উভয় পক্ষের অনড় অবস্থানের কারণে সম্ভব হয়নি, চেষ্টাও চলে নি। সে সম্ভাবনা ভারত-পাকিস্তানে এখনাে বাস্তবায়িত হয়নি। ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। কিন্তু সেখানেও সমস্যা রয়েছে। দেশভাগ নিয়ে যেখানে নেতির ভার এত বেশি, সফলতার চেয়ে ব্যর্থতাই প্রধান সে দেশবিভাগ কি কোনাে যুক্তির ভিত্তিতে দাঁড়ায়? কী তাহলে দেশবিভাগের ইতিবাচক অর্জন, স্বপ্নের পাকিস্তান প্রাপ্তি নিয়ে? উপমহাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি (নৈরাজ্য) সে প্রশ্নের সঠিক জবাব। এমন আলােচনা শেষে পাঠক কি ভাববেন যে দেশবিভাগের অর্জন বলতে কিছু নেই, এর সবই নেতিবাচক। না, অর্জন অবশ্যই আছে আর তাহল স্বদেশী। রাজনীতিকদের হাতে শাসন ক্ষমতার হস্তান্তর যা দেশবিভাগের সূত্রে এবং ভারতীয় মুসলমানদের একাংশের জন্য স্বতন্ত্র ভুবন যা নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। তবে নিয়মতান্ত্রিক পথে সমঝােতায় ক্ষমতা অর্জনের সীমাবদ্ধতা অনেক, সমস্যা অনেক বিশেষ করে যখন বিদেশী শাসকের মর্জিমাফিক একটি দেশ বিভক্ত করা হয়। এবং সব কিছুই পূর্বকাঠামাে মাফিক থাকে। তাই অবাক হবার কিছু নেই যে, বিভাজিত ভূখণ্ডে ঔপনিবেশিক কাঠামাে, তার আমলাতন্ত্র, পুলিশতন্ত্র সবই পূর্বচরিত্র বিচারেও অক্ষুন্ন রয়ে গেছে। আর সাম্রাজ্যবাদ-নির্ভর পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশও ঘটে চলেছে ঠিক সেভাবে যা আকাক্ষিত ছিল হিন্দুমুসলমান পার্সি ও অনুরূপ সব সমপ্রদায়ের মুৎসুদ্দিধনিকদের। বরং বলা যায় ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপােষকতায় এদের বড় অস্বাভাবিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটে চলেছে। সঙ্গে দুর্নীতি মহীসহায়ক শক্তি পর্দার আড়ালে এরাই প্রকৃত শাসক আর পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এক মহাবাড়তি শক্তি সমরতত্র । তাই ১৯৪৭-আগস্টে যে বিশাল জনগােষ্ঠী মহানন্দে স্বাধীনতার পক্ষে শ্লোগান তুলেছিল তাদের অনেকে এখন নিরানন্দ শ্লোগান তুলতে পারে এই বলে যে সবার উপরে পুঁজিবাদ সত্য, তাহার উপরে নাই’ তবে দেশভাগের সূত্রে যা সবচেয়ে বড়াে, স্থায়ী সত্য হয়ে থাকল তা হচ্ছে সাম্প্রদায়িক চেতনার ব্যাধি বা পাপ, যা প্রথম দুই ভূখণ্ডেই নয়, ত্রিধাবিভক্ত উপমহাদেশের জন্যই সামাজিক রাজনৈতিক সত্য। দেশবিভাগ তা দূর করতে পারেনি। অথচ নীতিগত প্রত্যাশা ছিল ঐ ব্যাধি থেকে মুক্তির। মানুষ আশাবাদী।
তাই তাদের প্রত্যাশা- মানবীয় গণতান্ত্রিক মূল্যবােধসম্পন্ন সেকুলার, বৈষম্যহীন সমাজের জন্য। কিন্তু তেমন স্বদেশ তাে আপসে আপ ধরা দেয় না বা গড়ে ওঠে না। সেজন্য দরকার শুদ্ধ আদর্শ ও শ্রম ভাবছি মৃত্যুঞ্জয়। মানুষ এ উপমহাদেশকে এর সর্বপ্রকার ব্যাধি ও পাপ থেকে একদিন মুক্ত করবে বাঞ্ছিত সমাজ পরিবর্তনের মাধ্যমে। দেশভাগজনিত রক্তের ঋণ কি তাতে শােধ হবে? তখনকার ও পরবর্তী সময়ের বিপুল ক্ষয়ক্ষতির কি পূরণ হবে? দায়মুক্ত হতে পারবেন কি দেশভাগের কারিগরগণ? সর্বশেষ প্রশ্ন : ইতিহাস কি অপরাধীকে ক্ষমার অধিকার রাখে? এমনি প্রশ্নের মুখে দেশভাগের যুক্তি ও সঙ্গতি নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই থাকবে। কেউ কেউ হয়তাে এমন সিদ্ধান্তেও আসবেন যে দেশবিভাগ সঠিক ছিল , আবার কারাে মতে সঠিক। দেশবিভাগে বাস্তুচ্যুত ও প্রত্যক্ষদর্শী প্রবীণ সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার ও অনুরূপ কেউ কেউ সখেদে বলতেই পারেন যে ‘দেশভাগ ছিল একটি ভুল পদক্ষেপ। বলছেন পশ্চিম বাংলায় উদ্বাস্তু বাঙাল যাদের দ্যাশের জন্য এখনাে মন কান্দে’ যেমন কাদে প্রবীণ কুলদীপ নায়ারের । ওই বাঙালদের অনেকে ভাবেন‘দুই বাংলা আবার যদি এক হইতাে। কিন্তু বােঝেন স্বপ্নদেখা মানুষগুলাে, সে স্বপ্ন সত্য হবার নয়। তবু সেখানকার আলাপে, গল্পে-উপন্যাসে-নাটকে, এমনকি টিভি সিরিয়ালে ওই স্বপ্নের প্রকাশ ঘটাতে দেখি হয়তাে ওই সব মানুষের জন্য যারা পিতা-পিতামহের দ্যাশটাকে বুকের গভীরে ধরে রেখেছেন। ভাবছেন সাতচল্লিশের ভূলটাকে কি কেউ সংশােধন করতে পারবেন? ইতিহাসবিদ নন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হয়তাে ভাবতে পারেন, ইতিহাসের ধারায় ওই ভুলের আংশিক সংশােধন কি সম্ভব ‘উপমহাদেশের কনফেডারেশন বা ঐক্যবদ্ধ দক্ষিণ এশিয়া জোট’ গঠনে। যাকে বলে দুধের স্বাদ ঘােলে মেটানাে। রবীন্দ্রনাথ এক সময় ইউরােপীয় সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন ঠেকাতে ঐক্যবদ্ধ এশিয়া গঠনের আহ্বান জানিয়েছিলেন তার এক প্রবন্ধে (১৯৩৩)। এ সবই এখন নিছক তাত্ত্বিক ‘ডিসকোর্স’ বলা চলে। বাস্তবতা অনেক দূর।
সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক