দেশভাগ বাংলাভাগ জাতীয়তাবাদ থেকে সাম্প্রদায়িকতায়
বর্তমান আলােচনায় ভারতভাগের পটভূমিতে বাংলাভাগের কারণ খুঁজতে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ-বিরােধী আন্দোলন, এমনকি তার পূর্বসূত্রও বিবেচনায় আনতে হয়। অবশ্য বঙ্গভঙ্গ রদের সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন শুধু বঙ্গেরই নয়, ভারতীয় রাজনীতির বিচারেও এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, মাইলফলক বললেও অত্যুক্তি হয় না। কারণ এর অর্জন ও বিসর্জন দুই-ই তাৎপর্যপূর্ণ। আর সে তাৎপর্য বুঝতে ১৯ শতকের বঙ্গীয় রেনেসাস ও তার নায়কদের ভূমিকা উল্লেখ করা দরকার পড়ে। প্রথম ও শেষ বঙ্গবিভাগ, দুটোর প্রতিক্রিয়াই আর্থসামাজিক রাজনীতির হিসাব-নিকাশের সঙ্গে যুক্ত এবং তা উভয় সম্প্রদায়কে বিবেচনায় নিয়ে খুব সংক্ষিপ্ত সূত্রাকারে বলা যায়, ১৯ শতকে এলিট হিন্দু সম্প্রদায়ে রাজধানী কলকাতাভিত্তিক যে সামাজিক নবজাগরণ তা পাশ্চাত্য সভ্যতা-সংস্কৃতিভিত্তিক হলেও সে আধুনিকতার সঙ্গে ধর্মীয় চেতনার গভীর মিশ্রণও এক অবাঞ্ছিত ও অনাধুনিক বাস্তবতা। সেই মিশ্র চরিত্র নিয়ে বঙ্গভিত্তিক ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশ এক্ষেত্রে বঙ্গের ভূমিকা, বঙ্গীয় হিন্দু এলিট তথা ‘ভদ্রলােক’ শ্রেণিরই একক ভূমিকা। পরবর্তী পর্যায়ে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রেরণা ও উদ্দীপক শ্লোগান যেমন বন্দেমাতরম’ এই সামাজিক ধ্যান-ধারণা থেকেই এসেছে। বিষয়টি বর্তমান আলােচনায় একাধিক প্রসঙ্গের তাগিদে বারকয় উল্লেখ করতে হয়েছে পুনরাবৃত্তির ক্রটি মনে রেখেও। ইংরেজ শাসনের পৃষ্ঠপােষকতা ও দাক্ষিণ্যে সৃষ্ট এই ভূস্বামী ও এলিট শ্রেণি একদিকে রাজভজনায় ব্যস্ত, অন্যদিকে এদের উত্তরসূরি ব্রিটিশবিরােধী তথা শাসকবিরােধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জনক (যেমন নিয়মতান্ত্রিক তেমনি বিপ্লববাদী) ।ট্রাজেডি হচ্ছে বহুজাতি-বহুভাষাভিত্তিক ভারতবর্ষে একক ভারতীয় জাতীয়তার উদ্ভব না ঘটায় শাসকবিরােধী আন্দোলনের জাতীয়তাবাদ ধর্মীয় চেতনায় নিষিক্ত হয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ জন্মের সুযােগ তৈরি করে।
এর সামাজিক-রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা আধুনিকতার সঙ্গে মেলে না। যদিও এ দুটোই শিক্ষিত হিন্দু এলিট শ্রেণির অবদান, বিশেষভাবে বঙ্গে, সেই প্রভাবে অন্য কয়েকটি প্রদেশে । মেলে না ধর্মীয় উপাদান প্রেরণা হিসেবে আধুনিকতা ও রাজনীতি, দেশপ্রেম ও স্বাদেশিক তৎপরতার সঙ্গে একাকার করে নেয়ার কারণে। আধুনিক চেতনা ও সনাতন হিন্দু ভারতীয় ঐতিহ্যের মিশ্রণে যে রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদের প্রকাশ, স্বভাবতই তাতে ছিল প্রচণ্ড স্ববিরােধিতা, ছিল আধুনিকতার সঙ্গে রক্ষণশীলতার প্রকাশ। মুসলমান সমাজ একই পথ ধরেছে যদিও বেশ কিছু সময় পরে । এ কাজে তাদের সহায়তা দিয়েছে ব্রিটিশ শাসকশ্রেণি । এলিট হিন্দু শিক্ষিত শ্রেণির এ জাতীয় স্ববিরােধিতা ‘মনু ও মার্কসের মিশ্রণ’ বলে রসিকতা করেছেন তাদেরই কেউ কেউ। স্ববিরােধিতা মুসলমানদের ক্ষেত্রেও ছিল। তবে উত্তর ভারতীয় মুসলমানরা এদিক থেকে কয়েক পা এগিয়ে। মহাবিদ্রোহের (১৮৫৭) ইতিবাচক ভূমিকা শেষে একদিকে স্যার সৈয়দ আহমদ ও আলীগড়গােষ্ঠী যেমন আধুনিক শিক্ষার পক্ষে দাড়িয়ে ব্রিটিশ সমর্থক এবং একই সঙ্গে ধর্মীয় সম্প্রদায়বাদী, অন্যদিকে দেওবন্দ উলেমাগণ প্রচ্ছন্ন ব্রিটিশবিরােধী ও অসাম্প্রদায়িক। কিন্তু মাদ্রাসাশিক্ষা ও ধর্মীয়চেতনার প্রসার আধুনিকতার সঙ্গে পরস্পরবিরােধী অবস্থানে। দেওবন্দের ছাত্র মওলানা ভাসানী সমাজবাদী স্বার্থের রাজনীতিক হলেও বাংলাদেশে একই ঘরানার বর্তমান হেফাজতিপ্রধান (চট্টগ্রামের) মাওলানা আহমদ শফি কট্টর রক্ষণশীল। ধর্মীয়চেতনার প্রাধান্য তাই গণতন্ত্রী অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচ্য। মওলানা কেরামত আলী জৌনপুরীদের ধর্মীয় হেদায়েত বঙ্গীয় মুসলমানদের আধুনিকতার অঙ্গন থেকে পিছু হটতে সাহায্য করেছে। যেমন করেছে মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসার বঙ্গীয় মুসলমানদের দুর্দশার কারণ ইতিহাসের অমােঘ ঘটনাবলী, ইংরেজের বঙ্গদেশ দখল ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত থেকে তাদের ভেদনীতি, সম্প্রদায়ভিত্তিক পৃথক শিক্ষানীতি (মাদ্রাসা শিক্ষা) ইত্যাদি। ক্ষমতাবান জমিদার, সুদখাের মহাজন- এ দুইয়ের শাসন-শােষণের শিকার দরিদ্র কৃষক-কারিগর শ্রেণি (যাদের অধিকাংশ মুসলমান)। দারিদ্র-মাদ্রাসাশিক্ষা-দারিদ্র্য এই বিষচক্রের পরিণামে ধর্মীয় চেতনার সঙ্গে যুক্ত হয় সম্প্রদায় চেতনা। উত্তর ভারতের ভূস্বামী ও শিক্ষিত শ্রেণীর তুলনায় বঙ্গে মুসলিম শিক্ষিত শ্রেণির বিকাশ দেরিতে, তার এলিট উপশ্রেণী তাে আরাে দেরিতে। ফলে বঙ্গে নানাভাবে সৃষ্ট হিন্দুমুসলমানের আর্থ-সামাজিক বৈষম্য ও দূরত্ব রাজনীতির জন্য অশনিসঙ্কেতই বলতে হয়।
এ বৈষম্যের বিচ্ছিন্নতাকে রাজনৈতিক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ বিবেচনা করেছেন অনেকে। তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, এস ওয়াজেদ আলী, অধ্যাপক সুশােভন সরকার, অশােক মিত্র (আই-সিএস) প্রমুখ, পরবর্তী সময়ে অনেকে, বিশেষত কেমব্রিজ অক্সফোর্ড গ্রুপের রিভিশনিস্টগণ। উনিশ শতকের বঙ্গীয় রেনেসাস তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক চরিত্রের স্ববিরােধিতার মধ্যেই হিন্দুত্ববাদ ও সাম্প্রদায়িক চেতনার প্রকাশ ঘটিয়ে বিশ শতকের রাজনীতিকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল। এর ফল শুভ হয়নি। এতে করে সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতার পথ প্রশস্ত হয়েছে। অথচ এই রেনেসাঁসের চরিত্র নিয়ে অন্ধ প্রশস্তিই প্রাধান্য পায়। অধ্যাপক সুশােভন সরকার এ সম্বন্ধে অবশেষ বিচারে নম্র ভাষায় লেখেন : এদেশের ব্যাপকসংখ্যক সাধারণ মানুষের সঙ্গে আমাদের রেনেসাঁসের কর্ণধারদের দূরত্ব ছিল যােজন সমান। …আন্দোলনের আলােকপ্রাপ্ত ‘দ্রলােকদের মধ্যে হিন্দুসুলভ প্রবণতাটা ছিল একান্তই স্পষ্ট। ফলে দূরে সরে গিয়ে ছিল মুসলিমরা।’ এ জাতীয় বক্তব্য আরাে তীক্ষ্ণ ও লক্ষ্যভেদী হয়ে উঠতে দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন সূত্রের লেখায় এবং আশােক মিত্রের বিশ্লেষণে । মার্কসবাদী ঘরানার কেউ কেউ যেমন ভবানী সেন, বিনয় ঘােষ তির্যক বাক্যবন্ধে রেনেসাঁসের সীমাবদ্ধতা ও তার সম্প্রদায়বাদী প্রবক্তাদের সমালােচনা করেছেন। লক্ষ্যণীয় এদের রচনাতেই বর্তমানের বহুকথিত ‘ভদ্রলােক’তত্ত্বের সূচনা, যে তত্ত্ব একালের বিশ্লেষকগণ নানা শাখায়, নানা প্রসঙ্গে বিকশিত করে তুলেছেন। এ ধারাবাহিকতায় বিশ শতকের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ (প্রথম বঙ্গবিভাগ) ও তার প্রতিক্রিয়ায় ব্যাপক প্রতিবাদী আন্দোলন যা শুধু রাজধানী কলকাতাই নয়, দেশের বেশ কিছু শহরেও আন্দোলনের চরিত্র নিয়ে ধরা দিয়ে ছিল। মূলত হিন্দু শিক্ষিত শ্রেণির হাতে সূচিত হলেও জাতিগত সচেতনতার টানে বেশ কিছুসংখ্যক বিভিন্ন পেশার শিক্ষিত মুসলমান এ আন্দোলনে অংশ নেন।
এ আন্দোলন চরিত্র বিচারে শিক্ষিত ভদ্রলােক’ শ্রেণির। প্রতিবাদের ঝড় এ উপলক্ষে বয়ে যায় এবং জাতীয়তাবাদভিত্তিক স্বদেশিয়ানার গঠনমূলক তৎপরতা প্রকাশ পায় (শিক্ষা এবং কারিগরি ও শিল্পখাতে)। এ ঘটনা বাঙালি জাতির জন্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু তাতে ক্রমশ প্রতীকে, বক্তব্যে, প্রচারে হিন্দুত্ববাদের প্রকাশ ঘটতে থাকে । সরকারের দমননীতিও সেই সঙ্গে তীব্র হতে থাকে। কিন্তু একাধিক সূত্রে এর স্ববিরােধিতা ও সীমাবদ্ধতার প্রকাশও দেখা যায়। চরিত্র বিচারে এ আন্দোলন শ্রেণিবিশেষের এবং নগর ও শহর কেন্দ্রিক। এ সম্বন্ধে সুশােভন সরকারের উক্তি উল্লেখযােগ্য : অনেক বিখ্যাত জমিদার, বড় বড় ব্যবসায়ী, বিভিন্ন পেশার নামকরা লােকেরা যােগ দিলেন এই গণআন্দোলনে। কিন্তু উল্লেখযোেগ্য যে শ্রমিক বা কৃষকদের সংগঠিত করা বা জাগিয়ে তােলার জন্য কোনাে উদ্যোগ নেয়া হলাে না।’ এখানে আন্দোলনের প্রকৃত দুর্বলতা এবং দ্রলােক’ শ্রেণির পক্ষে সেটাই স্বাভাবিক ছিল তাদের শ্রেণিস্বার্থ-বিবেচনায় । রবীন্দ্রনাথ যে বলেছিলেন, ‘গ্রাম পড়ে আছে মধ্যযুগে, শহর আধুনিক যুগে, এ সত্য নেতাদের উপলব্ধিতে ধরা পড়েনি। স্বদেশী জিনিস কিনুন’ এ আহ্বানে দরিদ্র কৃষক, কারিগর, জেলে, জোলা, তাঁতি সাড়া দেয়নি। এর কারণ রবীন্দ্রনাথের ব্যাখ্যায় উঠে এসেছে। মুনাফালােভী বােম্বাই-আহমেদাবাদের মিলমালিকরা কাপড়ের দাম এত বাড়িয়ে দেয় যে তা বিলেতি কাপড়কে ছাড়িয়ে যায়। এ বিষয়ে স্বদেশীদের জবরদস্তির প্রতিবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথ নিমূবর্গীয় মুসলমান জনতার পক্ষ নিয়ে। প্রবন্ধ ছাড়াও তার ঘরে বাইরে’ উপুনলে এর কিঞ্চিৎ আভাস মিলবে। যুক্তবঙ্গের পক্ষে একটি বিশাল সম্ভাবনাময় দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন নিছক বিচক্ষণতার অভাব ও সম্প্রদায়বাদী সঙ্কীর্ণতার কারণে (বঙ্গভঙ্গ রদ হলেও) সমন্বয়বাদী রাজনীতির পথ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে নবাব সলিমুল্লাহ, জমিদার নওয়াব আলী চৌধুরী প্রমুখের সম্প্রদায়বাদী প্রচার পূর্ববাংলার মুসলমান জনতাকে আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পেরেছিল ।
বিক্ষিপ্তভাবে সাম্প্রদায়িক সংঘাতও দেখা দেয় শাসকশ্রেণীর মদতে এবং উল্লিখিতদের সাম্প্রদায়িক প্রচারের ফলে। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য স্বদেশী আন্দোলনের এ ব্যর্থতার জন্য হিন্দু ভদ্রলােক শ্রেণির স্বার্থপরতা ও আচার-আচরণগত সঙ্কীর্ণতাকেও দায়ী করেছেন। ‘চাষা ব্যাটা বনাম বাবু ভদ্রলােক’তত্ত্বের বিষয়টি রবীন্দ্রনাথ সরস ভাষায় নানা উপলক্ষে তুলে ধরেছেন। এমন কথাও লিখেছেন ‘যাহাদিগকে আমরা ‘চাষা বেটা’ বলিয়া জানি, …সুদিনে-দুর্দিনে আমরা যাহাদের ছায়া মাড়াই না, আজ হঠাৎ তাহাদের নিকট ভাই সম্পর্কের পরিচয় দিয়া চড়া দামে জিনিস কিনিতে ও গুর্খার তা খাইতে আহ্বান করিলে আমাদের উদ্দেশ্যের প্রতি সন্দেহ জন্মিবার কথা।’ অন্যত্র আমরা যে মুসলমানদের বা দেশের জনসাধারণের যথার্থ হিতৈষী তাহার কোনাে প্রমাণ কোনাে দিন দিই নাই।’ বড় কঠিন, অপ্রিয়। সত্য! হিন্দু-মুসলমান বিচ্ছিন্নতার সুস্পষ্ট যাত্রা এভাবে চিহ্নিত হয় সামাজিক। অঙ্গন থেকে, ছড়িয়ে যেতে থাকে রাজনৈতিক অঙ্গনে। বঙ্গদেশ থেকে এর সূচনা হলেও পাঞ্জাব মারাঠা তাতে কম জ্বালানি যােগ করে নি। তবে সাম্প্রদায়িক সাহিত্যের মাধ্যমে বিভেদ-বিদ্বেষের তীব্র সূচনা। ঘটান বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার উপন্যাসমালায়, বিশেষ করে ‘আনন্দমঠ’, ‘চন্দ্রশেখর’ ও ‘সীতারাম’-এ। প্রচণ্ড মুসলমান-বিদ্বেষ জারিত ‘আনন্দমঠ’-এর। মহামন্ত্র ‘বন্দেমাতরম’ হয়ে ওঠে জাতীয়তাবাদ ও বিপ্লববাদের সঞ্জীবনমন্ত্র, রাজপথের শ্লোগান যা গ্রহণ করতে পারেনি বঙ্গীয় মুসলমান । পরিবর্তে তাদের। শ্লোগানও হয়ে ওঠে ধর্মীয় পঙক্তি ‘আল্লাহু আকবর’ । ব্যস, তাদের পথ ভিন্ন। হয়ে যায়। দুঃখজনক যে পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী ধীমানদের অনেকে বঙ্কিমচন্দ্রের সাম্প্রদায়িকতা সম্বন্ধে যুক্তিহীনভাবে উদার। ব্যতিক্রম তরুণ। প্রজন্মের কেউ কেউ। ক্রমে বঙ্কিম-বিরােধী প্রতিক্রিয়া মুসলমান সমাজে এতটা তীব্রতা নিয়ে দেখা । দেয় যে, কলকাতার রাজপথে পােড়ানো হয় ‘আনন্দমঠ’। অগ্রসর চেতনার। শিক্ষিত হিন্দু এলিট শ্রেণি এই মুসলিম মানসকে বুঝতে চায়নি, বােঝার প্রয়ােজন বােধ করেনি । পশ্চাদপদ যাত্রীকে নিয়ে কে মাথা ঘামায়। দীর্ঘকাল। পর সেই ভদ্রলােক তথা এলিট শ্রেণিরই স্বনামখ্যাত কবি এই পূর্ববঙ্গীয়দের। কপালে চন্দন টিপ পরিয়ে দেন বায়ান্নর ভাষাশহীদদের উদ্দেশে শহীদ বাংলা’ কবিতা লিখে ‘ওরাই মুক্তির দূত বাঙালি জাতির ভয়ত্রাতা/বাঙালি মুসলিম ওরা। বাঙালি হিন্দুর মুক্তিদাতা’- বিমলচন্দ্র ঘােষ । আর একাত্তরের যুদ্ধ শেষে স্বাধীন। বাংলা পত্তনের (১৯৭১) সাফল্যে উদ্বেল কবি বিষ্ণু দে লেখেন জ্যেষ্ঠ তােমরা । গড়ে দিলে প্রতিভাস’।
এহ বাহ্য! এ রােমান্টিকতাই যে শেষ কথা নয়, তার প্রমাণ মিলেছে আরাে পরে । আপাতত সে কথা থাক, তা পরে বিবেচ্য। সাহিত্য থেকে রাজনীতি, সাম্প্রদায়িক চেতনার প্রভাব এমনি যে বিদগ্ধ পণ্ডিতজনও এই বিভেদচেতনা। বুঝেশুনে, ভেবেচিন্তে তাদের ধ্যানধারণা ও কর্মে এর বিস্তার ঘটিয়েছেন। যেমন । বিপ্লবী অরবিন্দ ঘােষ, সমাজ সংস্কারক স্বামী বিবেকানন্দ (জয়া চ্যাটার্জি, ‘বেঙ্গল। ডিভাইডেড’)। এদের সঙ্গে যােগ করা যায় উগ্রজাতীয়তাবাদী ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, বিপিনচন্দ্র পালসহ একাধিক জনের নাম। তাদের বক্তব্যও উদ্ধার করা যায় । জাতীয়তাবাদ (ভারতীয় বা বাঙালি) স্বভাবতই আর শুদ্ধ গণতান্ত্রিক চেতনার জাতীয়তাবাদ থাকেনি, ভারতে তাে বটেই (তিলক, লালা লাজপত প্রমুখ নেতার কল্যাণে) এবং বঙ্গে। এমনকি সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতাে মধ্যপন্থীরাও এ স্রোতে গা ভাসিয়েছেন, বলেছেন সুস্পষ্ট বিভেদপন্থী জাতীয়তার কথা। এসবই তৎকালীন বাঙালি ভদ্রলােক তথা এলিট শ্রেণির অবদান। বঙ্গভঙ্গ বিরােধিতায় হিন্দু-মুসলমানের মহামিলনযাত্রা চোরাবালিতে তলিয়ে যায় (অবশ্য বেশ পরে)। কলকাতা জামে মসজিদে রবীন্দ্রনাথের সৌহার্দ্য চেতনার। ‘রাখিবন্ধন’ অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমীরা অতিশয় সংখ্যালঘু । তবু এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের চেষ্টা নিরন্তর। স্বদেশী আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিবেচনায় সে সম্বন্ধে কয়েক অনুচ্ছেদ লেখা। শিক্ষা-সংস্কৃতিতে অগ্রসর সম্প্রদায়ের এ বিভ্রান্তি ও সঙ্কীর্ণ মানসিকতা প্রত্যাশিত ছিল না। জাতিসত্তা-জাতীয়তা ভিত্তিক স্বদেশী আন্দোলন (১৯০৫ থেকে) প্রবল জাতীয়তাবাদী আবেগ ধারণ করেও ধর্মীয় চেতনার টানে সম্প্রদায়বাদী রাজনীতির পথ তৈরি করে (জয়া চ্যাটার্জি ব্রিটিশ-বিরােধিতার কারণে একে সম্প্রদায়বাদী হিসেবে চিহ্নিত করেননি)। এ ধারা মাঝে মধ্যে ব্যাহত হলেও শেষপর্যন্ত বিভেদপস্থারই জয় হয়েছে । নিশ্চিত পথ তৈরি হয়েছে বিচ্ছিন্নতার । সুযােগ বুঝে ব্রিটিশরাজ নিয়মিত তাতে জ্বালানি যােগ করেছে। মূল আলােচনায় ব্রিটিশ ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। যেমন বঙ্গভঙ্গ রদ করার বিপরীতে সান্ত্বনা স্বরূপ ১৯০৯ সালে মলিমিন্টো সংস্কার প্রস্তাবে স্বতন্ত্র নির্বাচন ও সংখ্যালঘুর জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা, ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠায় শাসক সহযােগিতা, ১৯১৯ সালে মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কারে স্বতন্ত্র নির্বাচন ও মুসলিম সুবিধাদি । এতে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদচেতনা ও উত্তেজনা বাড়ে। গান্ধী খিলাফত সৌহার্দ্য (রজত রায় কথিত ধর্মনির্বিশেষ ‘ভাইফোঁটা’ অনুষ্ঠান) বেশি দিন টেকেনি।
হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী (রিভাইভালিস্ট) প্রচেষ্টা, ভবানীপূজা, শিবাজি উৎসব ইত্যাদি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিচ্ছেদ প্রবণতা আরাে বাড়িয়ে তােলে। চৈত্রমেলা হিন্দুমেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। নবগােপাল মিত্র (আইসিএস), রাজনারায়ণ বসুর মতাে শীর্ষ ভদ্রলােক শ্রেণির ব্যক্তিরও হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারে কোনাে অসুবিধা হয়নি। সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিকই বলেছেন, এই এলিটদের জীবনে আধুনিকতা ও সনাতনী বিশ্বাস হাত ধরাধরি। করে চলেছে। বিশেষ করে আচার-আচরণে, ধর্মীয় সংস্কারে, সর্বোপরি বিশ্বাস ও যুক্তির ক্ষেত্রে। চৈতন্যের গভীরে এমনি ধারা স্ববিরােধিতা শিক্ষিত শ্রেণি লালন করেছে। সে তুলনায় গ্রামীণ সমাজ অনেকটাই একমুখী, দ্বিচারিতায় আসক্ত নয়। বঙ্গদেশে হিন্দু-মুসলমানের রাজনৈতিক সৌহার্দ্য ভেঙে যাওয়ার একাধিক কারণের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি উদাহরণ স্বরাজ্য দলের প্রধান চিত্তরঞ্জন দাসের সম্প্রদায়গত সময় চেষ্টার মৃত্যু। পিছিয়ে পড়া মুসলমান সমাজ, বিশেষ করে এর শিক্ষিত শ্রেণিকে এগিয়ে আনার উদ্দেশ্য নিয়ে চিত্তরঞ্জন যে সমঝােতা চুক্তি করেন তা ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ (১৯২৩) নামে খ্যাত। এতে বঙ্গীয় মুসলমানদের জন্য বিশেষ সংরক্ষণমূলক সুবিধাদির ব্যবস্থা ছিল। বিশেষ করে স্থানীয় সংস্থাগুলাের নির্বাচনে। এর সুফল দেখা যায় বঙ্গীয় রাজনীতির সম্প্রদায়গত ক্ষেত্রে। প্রমাণ মুসলমান আসনগুলােতে স্বরাজ্য পার্টির প্রার্থীদের বিপুল জয় । কিন্তু চিত্তরঞ্জন দাসের অকাল প্রয়াণের (১৯২৫) পর কংগ্রেসের উদ্যোগে ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ বাতিল করা হয় (১৯২৬)। বীরেন্দ্র শাসমল প্রমুখ চিত্তরঞ্জন অনুসারী স্বরাজ্য-নেতাদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। আবার দেখা দেয় সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা । মূল কংগ্রেসী নেতাদের সম্প্রদায়ু দৃষ্টিভঙ্গি ও তৎপরতা লক্ষ্য করে কংগ্রেস থেকে মুসলমান জাতীয়তাবাদী নৈর্তাদের একে একে নিক্রমণ । তাদের দৃঢ়বিশ্বাস জন্মে যে, কংগ্রেস মূলত হিন্দুস্বার্থ রক্ষার প্রতিষ্ঠান।
জয়া চ্যাটার্জি তার বইতে বেঙ্গল ডিভাইডেড) তমিজউদ্দিন খানের লেখার উদ্ধৃতি দিয়েছেন, যাতে কংগ্রেসের হিন্দু সম্প্রদায়বাদিতার উল্লেখ রয়েছে। তবু কিছুসংখ্যক মুসলমান তখনাে কংগ্রেসে টিকে ছিলেন সেটিকে সেকুলার জাতীয়তাবাদী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে। চল্লিশের দশকে পৌছে তাদেরও অনেকের ভুল ভাঙে, বিশেষ করে বঙ্গে। এর পেছনেও ছিল একাধিক ঘটনা। যেমন ১৯২৮ সালে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব সংশােধন বিলের বিরুদ্ধে স্বরাজ্য দলাহ কংগ্রেস সদস্যরা জোটবদ্ধ হন। তারা কৃষক-প্রজা স্বার্থের বিরুদ্ধে জমিদার ভূস্বামীদের পক্ষে অবস্থান নেন। প্রমাণ হয় যে, কংগ্রেস মুসলিম। লীগের মতােই ভূস্বামী, বিত্তবান ও শিক্ষিত শ্রেণির প্রতিনিধি এবং এদের স্বার্থরক্ষা তাদের রাজনৈতিক দায়দায়িত্ব, দরিদ্র কৃষক প্রজাদের স্বার্থরক্ষা নয় । নানা উপলক্ষে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা যেমন সারা ভারতে, তেমনি বিশেষভাবে বঙ্গে যত না রাজনীতিনির্ভর ঘটনা, তারচেয়ে অনেক বেশি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানভিত্তিক। একাধিক লেখকের গবেষণাভিত্তিক বিবরণে তা প্রকাশ পেয়েছে। সেই গৌণ সমস্যা নিরসনের দিকে দুই সম্প্রদায়ের শীর্ষ নেতাদের তেমন কোনাে আগ্রহ দেখা যায়নি। বরং উভয় সম্প্রদায়ে গড়ে উঠতে দেখা যায় রক্ষণশীল ধর্মীয় সামাজিক সংগঠন যা ছিল হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির সহায়ক এবং সেটা দীর্ঘ সময় থেকে। যেমন হিন্দু সম্প্রদায়ে আর্য সমাজ’, ‘শুদ্ধি আন্দোলন’, ‘গাে-রক্ষা সমিতি’র মতাে সংগঠন যেগুলাের তৎপরতা সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় জ্বালানি যােগ করেছে। অন্যদিকে মুসলমান সমাজে ধর্মীয় সংস্কার, শুদ্ধ ইসলাম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সৃষ্ট উত্তর ভারতীয় মৌলানাদের তৎপরতার প্রভাব দেখা গেছে বঙ্গে, বিশেষ করে শহর ও গ্রামাঞ্চলে (রফিউদ্দিন আহমেদ : ‘দ্য বেঙ্গল মুসলিমস’)। স্থানীয় মােল্লা-মৌলভীদেরও তাতে উৎসাহ বাড়ে। প্রসঙ্গত কেরামত আলী জৌনপুরীর ধর্মীয় প্রচারের কথা অন্যত্র উল্লেখ করা হয়েছে। এ জাতীয় ধর্মীয় সংস্কারের প্রভাব পড়ে মানুষের সাম্প্রদায়িক মানসিকতায় ।। এসবের সঙ্গে রাজনীতির যােগসাজশ ঘটলে সােনায় সােহাগা।
কথাটা ইতিপূর্বে উল্লিখিত যে কংগ্রেসের একাংশে হিন্দুত্ববাদের প্রভাব নিতান্ত কম ছিল সরদার প্যাটেল প্রমুখ রক্ষণশীল নেতাদের কথা বাদ দিলেও গান্ধী নিজেও যেমন ছিলেন হিন্দুত্ববাদী ও সনাতনপন্থী তেমৰি চলেছেন মদনমােহন মালব্য, মুঞ্জে প্রমুখ কট্টর হিন্দুমহাসভাপন্থীদের হাত ধরে। ভেবে দেখেননি এর প্রতিক্রিয়া মুসলমান সমাজে কীভাবে দেখা দিতে পারে । অথচ তিনি তাে ছিলেন হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি ও ঐক্যের প্রবক্তা। | মােপলা কৃষক বিদ্রোহ ছিল বিভ্রান্তিকর সাম্প্রদায়িক মূল্যায়নের একটি বড়সড় উদাহরণ । দক্ষিণের শােষিত মােপলা কৃষকদের উত্থানের বড় কারণ ছিল ভূস্বামীদের প্রবল অর্থনৈতিক শােষণ ও সামাজিক অবজ্ঞা । শােষকশ্রেণি বৰ্ণহিন্দু বিধায় বিষয়টি সাম্প্রদায়িক চরিত্রে চিহ্নিত হয়। অবশ্য এর সঙ্গে মােপলাদের সাম্প্রদায়িক তৎপরতাও জড়িত ছিল। যেমন দেখা গেছে বাংলার ময়মনসিংহে বা একাধিক কৃষক আন্দোলনের দ্বিমুখী চরিত্রে। মােপলা বিদ্রোহ সম্পর্কে হিন্দু মহাসভা নেতা মুঞ্জের একপেশে রিপাের্ট রবীন্দ্রনাথকেও প্রভাবিত করেছিল। সাম্প্রদায়িক সংঘাতের পেছনে যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও শিক্ষিত শ্রেণির সংশ্লিষ্টতা বরাবরের, নিরপেক্ষ ইতিহাসে তার প্রমাণ ধরা রয়েছে। পূর্বোক্ত ঘটনাদির বিপরীতে উল্লেখ করা যায় কলকাতার সাম্প্রদায়িক সংঘাতে উচ্চশিক্ষিত রাজনৈতিক নেতা শহীদ সােহরাওয়ার্দী বা স্যার আবদুর রহিমের মতাে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা বা ইন্ধন জোগানাের ঘটনাদি। প্রকৃতপক্ষে দুই সম্প্রদায়েরই ‘দ্রলােক’ শ্রেণি এ বিষয়ে যত নষ্টের গােড়া । এরাই বিরাজমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থায়ী বা সংহত হতে দেয়নি, বরং বিভেদচেতনা নানাভাবে উস্কে দিয়েছে ।
তাতে তাদের শ্রেণিস্বার্থ অনেক ক্ষেত্রে হয়তাে রক্ষিত হয়েছে। এদেরও নেপথ্যে ছিল উভয় সম্প্রদায়ের পুঁজিপতি শ্রেণি। যেমন একদিকে বিড়লাদের মতাে একাধিক গােষ্ঠী তেমনি অন্যদিকে ইস্পাহানিদের মতাে গ্রুপ। এদের উদ্দেশ্য ছিল নিজ নিজ অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণ ও বৃদ্ধি। ইংরেজ বণিক বা শাসক রাজনীতিকদের চাতুর্যের খেলায় ভারত কখনাে পেরে ওঠেনি। কী মুঘল ভারত কিংবা নবাবী বাংলা । সে এক সহৃদয় নির্বুদ্ধিতা বা উদারতার ইতিহাস- বলা চলে প্রাচ্য প্রকৃতি। বিশ শতকের চল্লিশের দশকে পৌছে রাজনীতির শতরঞ্জ খেলায় ইংরেজ শাসকের চাতুর্যের কাছে লীগকংগ্রেসের হার- লীগের কম, কংগ্রেসের বেশি। এ পরাজয় উভয়েরই কারণে, তবে এ ক্ষেত্রে লীগের তথা জিন্নার দায়দায়িত্ব বেশি।
ভারতবিভাগের সঙ্গে বঙ্গবিভাগের যােগসূত্র অনস্বীকার্য। ভারতীয় রাজনীতির নাট্যমঞ্চে নাটকের কুশীলবদের কল্যাণে এবং নানা অনভিপ্রেত ঘটনার টানে অখণ্ড ভারতের স্তম্ভগুলাে ৪৫ থেকে ৪৭-এর প্রথমার্ধ সময়ে এক এক করে ভেঙে পড়ছে দেখেও সতর্ক হয়নি কংগ্রেস নেতৃত্ব ও বামঘরানার রাজনীতিকগণ। একই সঙ্গে যুক্তবঙ্গের সম্ভাবনাও ক্রমশ দূরে সরে গেছে বাঙালি হিন্দু-মুসলিম রাজনীতিক তখনও সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার চাপে ভারাক্রান্ত । প্রথম বঙ্গভঙ্গ-বিরােধী নেতাদের পরবর্তী কংগ্রেসী ও হিন্দুমহাসভা নেতৃত্ব পরিস্থিতির টানে এ পর্বে বিপরীতমুখী- মূলত সাম্প্রদায়িক চেতনার ব্যাপক প্রভাবে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাও উভয় পক্ষকে পরস্পরের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে সাহায্য করেছে। তবু রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা বলে কথা আছে না? সেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাজ করেনি। করেনি বিশেষ করে কংগ্রেস হাইকম্যান্ড ও বঙ্গীয় খাদিপন্থীদের মধ্যে। তাদের আত্মঘাতী রাজনীতির একাধিক উদাহরণ তুলে ধরেছেন জয়া চ্যাটার্জি। বঙ্গের সমাজ ও রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার যেমন সম্প্রদায়বাদী মুসলিম লীগের তৎপরতায় তেমনি হিন্দুমহাসভা ও দক্ষিণপন্থী কংগ্রেসেরও মাধ্যমে। সামাজিক বিভেদ রচনায় হিন্দু ‘দ্রলােক সাম্প্রদায়িকতা” (‘দ্রলােক। কমিউনালিজম’)কে মূলত দায়ী করেছেন জয়া চ্যাটার্জি পূর্বোক্ত বইতে। রবীন্দ্রনাথ থেকে একাধিক চিন্তাবিদ সমকালে একই কথা বলেছেন যদিও সংখ্যায় তারা খুবই অল্প।
এমন সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ও সম্ভাব্য ভারতভাগের অঘটনে দ্বিতীয় বঙ্গবিভাগ যে অনিবার্য হয়ে উঠবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস উপলক্ষে সংঘটিত কলকাতা হত্যাকান্ড ঠিকই দেশভাগের অন্যতম প্রধান কারণ। কিন্তু এর নেপথ্যে রয়েছে দূষিত সামাজিকরাজনৈতিক পরিবেশ যা উভয় সমাজের হাতে তৈরি, তাতে বাতাস দিয়েছে ব্রিটিশ রাজ। এসব কারণে ভারতভাগের পূর্বক্ষণে বঙ্গবিভাগ প্রতিরােধে যুক্তবঙ্গের শ্লোগান হালে পানি পায় নি। সােহরাওয়ার্দি-আবুল হাশিম এবং শরৎ বসুকিরণশংকর রায়ের ঐক্য ও সম্প্রীতির আহ্বান কাজে আসে নি। পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তর জনসংখ্যা তাতে সায় দেয় নি । দেয়নি বিশেষ করে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি প্রমুখের নেতৃত্বে হিন্দুমহাসভার ব্যাপক সাম্প্রদায়িক প্রচারের তীব্রতা ও বঙ্গভঙ্গের পক্ষে প্রচারের কারণে। কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থীরাও এ প্রচারের অংশীদার। মূলত পশ্চিমবঙ্গবাসী শিক্ষিত হিন্দু ভদ্রলােক’ শ্রেণী বঙ্গভঙ্গে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। দেশভাগের পঞ্চাশ বছর পালনের সময় থেকে সেকুলার হিন্দু লেখক বুদ্ধিজীবীদের এ সত্য স্বীকার করতে দেখি। এমন কি ছিন্নমূল মানুষের অর্থাৎ পশ্চিন্তে পাঞ্জাবি হিন্দু ও শিখদের, এবং পূর্ববঙ্গ থেকে বাস্তুত্যাগী বাঙালি হিন্দুর অবিশ্বাস্য যন্ত্রণা ও আর্তি, দুঃসহ জীবন, ভারতভাগ ও বঙ্গভাগের অসঙ্গতি সচেতন মানুষের চেতনায় রক্তাভ ছায়া। ফেলে । অবশ্য এটা ব্যাপক ক্ষেত্রে নয়। কারণ খাস পশ্চিমবঙ্গীয় বনেদি ও এলিটশ্রেণীর বাঙাল-অবজ্ঞা র্তো বিভাগপূর্ব কালের ঘটনা। সে ধারা এখনাে ২০১৩ সালে পৌছেও অব্যাহত। কদিন আগে একটি ভারতীয় টিভি অনুষ্ঠানে অপ্রাসঙ্গিক ভাবে বাঙালদের ‘অ্যাকার’, ‘এ’কার উচ্চারণ নিয়ে কী রসিকতাই না করলেন অভিনেতা মনােজ মিত্র যা শুনলে বাঙাল মাত্রেরই গা জ্বলে যাবে। ১৯৪৭-এ মুন্সীগঞ্জের উদ্বাস্তু বন্ধুটি হয়তাে এসব শুনে বলতাে : ‘ভাই, নেবু-নুচি-নিচু’র কথা বলছেন না কেন? আর বাশ (বাস), পাশপাের্ট উচ্চারণ? পশ্চিম-দক্ষিণবঙ্গের বা রাঢ়বঙ্গের আঞ্চলিক বাচন কি খুব শ্রবণসুভগ? বিষয়টি অসীম রায়ের উপন্যাস’একালের কথায় সরস ভাষ্যে ব্যক্ত। পশ্চিমবঙ্গে, রাজধানী কলকাতায় ‘বর্বর’ ‘বিচ্ছিরি’ বাঙাল তথা রিফিউজিদের নিয়ে স্থানীয় বাঙালি কম ঘেন্না-অবজ্ঞা দেখায় নি। এই পশ্চিমবঙ্গীয় মানসিকতাও সম্ভবত দ্বিতীয় বঙ্গভঙ্গের অন্যতম প্রধান কারণ। একই কারণে উদ্বাস্তু বাঙালের শেষগতি দূর দণ্ডকারণ্যে, আন্দামানে।
শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি প্রমুখ খাস পশ্চিমবঙ্গীয় নেতাদের লক্ষ্য ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক স্বপ্নের বঙ্গদেশ গড়া। সর্বভারতীয় ভিত্তিতে তা কতটা অর্জিত হয়েছে একালের পশ্চিমবঙ্গবাসী বাঙালি তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। পাচ্ছেন রাজনীতিতে, ভাষা-সংস্কৃতিতে হিন্দিবলয়ের দাপটে । হয়তাে এসব ভেবেই ক্ষমতা গ্রহণের পঞ্চাশ বছরের সাল-তামামিতে ড. অশােক মিত্র একটু খেদের সঙ্গে সংযত ভাষায় লেখেন : ‘এই অবস্থায় আমরা কি পেলাম এবং কি পেতে পারতাম তা নিয়ে পর্যালােচনায় ঈষৎ সার্থকতা আছে বৈকি ।… আমার বাঙালি সত্তাকে আমি যদি (অন্যদের) সমপর্যায়ের মর্যাদার ব্যবস্থা না করতে পারি তাহলে আমাদের ভারতীয় সত্তাও খানিকটা সঙ্কুচিত হয়ে আসতে বাধ্য। সেই হেতু আমরা কি কি পেলাম না, আর্থিক বিচারের নিরিখে তা নিয়ে সামান্য একটু আলােচনা হয়তাে দৃষ্টিকটু নাও হতে পারে। আমি প্রথমেই ভাষার কথা বলব (প্রসঙ্গ : বাংলা ভাষা, ঈশান’, জানুয়ারি, ১৯৯৮)। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ নীতীশ বিশ্বাস সম্পাদিত ‘ঐকতান গবেষণা পত্রের প্রচ্ছদলিপি : ‘আক্রান্ত মাতৃভাষা । আসুন প্রতিরােধ করি’ (২০১০) প্রসঙ্গত স্মর্তব। পঞ্চাশ ষাট বছর পর বাঙালি হিন্দু শিক্ষিতশ্রেণীর একাংশ ঠিকই বুঝতে পারছেন যে স্বাধীন ভারতের যুক্তবঙ্গে বাঙালি জাতিসত্তা একটি শক্তিমান। অবস্থানে দাঁড়াতে পারতাে। শুধু সাহিত্য-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে নয়, অর্থনৈতিকরাজনৈতিক ক্ষেত্রেও। অন্যদিকে এ পারে বাংলাদেশকে বর্তমান রাজনৈতিক নৈরাজ্যে (ইসলামি) ধর্মীয় জঙ্গিবাদের মােকাবিলা করতে হতাে না। সাম্প্রদায়িকতাও সংযত অবস্থানে, হয়তাে বা পিছু হটতে বাধ্য হতাে। প্রসঙ্গটি দীর্ঘ আলােচনার । দুচার অনুচ্ছেদে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে এই বােধােদয় ১৯৪৭-এ সম্ভব ছিল না। পরিস্থিতিও অনুকূল ছিল না। কেউ কেউ তখন গণভােটের কথাও বলেছিলেন। কিন্তু তখনকার মত্ত, তামসিক পরিবেশে গণভােট যুক্তবঙ্গের পক্ষে যেতাে কিনা বলা কঠিন। হয়তাে তাই কমিউনিস্ট পার্টির এসেম্বলি সদস্য জ্যোতি বসু পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গের পক্ষে ভােট দেন। অথচ এর বিপরীত ঘটনাও তখন দেখা গেছে। যেমন কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র স্বাধীনতা’য় যুক্তবঙ্গের পক্ষে রাঢ়বঙ্গ থেকে মধ্যবঙ্গের বিভিন্ন সংগঠনের বিবৃতি ।
একটি উদ্ধৃতি মেদিনীপুর থেকে-“আমরা বঙ্গভঙ্গ চাই না, জননেতাদের ডাকে সাড়া দিন ।…গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের নামে, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের নামে, স্বাধীন বাংলার শেষ নবাব সিরাজদ্দৌলার নামে, বিপ্লবী বীর ভগৎ সিং, ক্ষুদিরাম আর সূর্য সেনের নামে আমাদের এই ডাক । আমাদের ডাকে সাড়া দিন না, এ ডাকে সাড়া মেলেনি যদিও স্থানীয় কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টির কমিটি, নারী সমিতি, ছাত্র ফেডারেশন থেকে ছিল এ আহ্বান (স্বাধীনতা, ০৩.০৬.১৯৪৭)। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ স্বাধীনতার পাতায় (৯ এবং ১০ এপ্রিল, ১৯৪৭) কমিউনিস্ট পার্টির ঘােষণা : স্বাধীন ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র, স্বাধীন ও ঐক্যবদ্ধ বাংলার জন্য আওয়াজ তুলুন। বঙ্গভঙ্গ চাই না, সােহরাওয়ার্দী সাহেবের বৃহত্তর বঙ্গও চাই না। আমাদের দাবী (১) স্বাধীন ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে ঐক্যবদ্ধ বাংলা। বাংলাদেশ ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে যােগ দেবে কিনা সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক বাঙ্গালীর ভােটে তার মীমাংসা চাই’। এ বক্তব্যের স্ববিরােধিতা ও সহজবােধ্য। এরপর আমরা দেখি বঙ্গীয় কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি ভবানী সেনের বিবৃতি : ‘ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ব্যবচ্ছেদ ও বঙ্গভঙ্গ রােধ করিবার জন্য শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র বসুকে সভাপতি ও শ্রীযুক্ত কামিনীকুমার দত্তকে সম্পাদক নির্বাচিত করিয়া যে কমিটি গঠিত হইয়াছে উহাতে আমাদের পার্টির পক্ষ হইতে অভিনন্দন জ্ঞাপন করিতেছি। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীর কূটনেতিক চাল ব্যর্থ করিবার জন্য আমাদের পার্টি বঙ্গভঙ্গ বিরােধী কমিটির সঙ্গে বন্ধুত্বমূলক সহযােগিতার নীতি অনুসরণ করিবে’ (স্বাধীনতা ২৭.০৪.১৯৪৭)। | এতদসত্ত্বেও বিধানসভার ভােটাভুটিতে কমিউনিস্ট-প্রতিনিধি বঙ্গভঙ্গের পক্ষে সমর্থন জানান। এ-স্ববিরােধিতার ব্যাখ্যা তাদের কাছে কেমন ছিল জানি না। তবে আমার ধারণা বঙ্গভঙ্গ অনিবার্য হয়ে ওঠার কারণে হয়তাে তারা শাস্ত্রবাক্য মাফিক বঙ্গভঙ্গ অর্থাৎ অর্ধেক ত্যাগই সমীচীন মনে করেছিলেন। | তবু বঙ্গীয় মুখ্যমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দির শেষ চেষ্টায় ক্ষান্তি ছিল না । মাউন্টব্যাটেনের চাতুরি তিনি বুঝতে পারেন নি। ভাইসরয় বঙ্গের ব্যাপারে দুদিকে খেলেছেন যদিও সীমান্ত প্রদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে সােজাসুজি ‘না’ বলতে দ্বিধা বােধ করেন নি। এর কারণ পূর্বে আলােচিত। আর হডসনের বক্তব্য (পৃ. ২৪৬) যদি সঠিক হয় তাহলে মানতে হবে যে কলকাতাবিহীন বাংলার বিকল্প হিসাবে স্বাধীন বাংলার প্রস্তাব জিন্না মেনে নিয়েছিলেন। কারণ বুদ্ধিমান জিন্নার হয়তাে বিশ্বাস ছিল, মুসলমান-প্রধান স্বাধীন বঙ্গ ঠিকই একদিন পাকিস্তানে যােগ দেবে। আমার বিশ্বাস, এমন আশংকা থেকেই কংগ্রেস ও হিন্দুমহাসভা নেতৃবৃন্দ স্বাধীন বঙ্গের বিরােধিতা করেছেন। এবিষয়ে পূর্ববঙ্গীয় হিন্দুজনতার মতামত নিলে পরিস্থিতি কোথায় দাঁড়াতাে কে জানে!
এভাবে দ্বিতীয় বঙ্গভঙ্গ বাঙালির ভবিতব্য হয়ে ওঠে। এবং তা হিন্দুপ্রধান পশ্চিমবঙ্গ ও মুসলমান-প্রধান পূর্ববঙ্গ হিসাবে বিভাজিত হয়ে । যে যুক্তিতে ভারতভাগ, একই যুক্তিতে বাংলা ও পাঞ্জাবভাগ । বাংলার ভাগ্য নির্ধারিত হয়। ২০-এ জুন (১৯৪৭) বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় ভােটাভুটিতে। পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানে, পশ্চিমবঙ্গ হিন্দুস্থানের পক্ষে অন্তর্ভুক্তির ইচ্ছা প্রকাশ করে। মাউন্টব্যাটেনের সরসভাষায় ‘পুওর ওল্ড ফ্রেড্রি’র সমর্থন সত্ত্বেও হাশিমসােহরাওয়ার্দির স্বপ্ন ভেঙে চুরমার। বঙ্গ বিভক্ত। কার্জনের ইচ্ছাপূরণ প্রথম বঙ্গভঙ্গের ৪২ বছর পর। এরই নাম ব্রিটিশ রাজনীতির জটিল কূটচাতুর্য! কিন্তু ভারতভাগের মতাে বঙ্গভাগেও যে সমস্যার সমাধান ছিল না, পরবর্তী ঘটনাবলী তা প্রমাণ করেছে। পাঞ্জাবের হিন্দু-শিখদের মতােই পূর্ববঙ্গের ছিন্নমূল হিন্দুসম্প্রদায়ের জীবনযন্ত্রণা এবং পশ্চিমবঙ্গীয় স্থানীয় হিন্দুদের অবজ্ঞা তার প্রমাণ । পাঞ্জাবের উদ্বাস্তু কাহিনী কিছু কিছু লেখায় উঠে এসেছে, তুলনায় বঙ্গীয় ছিন্নমূলকথা কম । সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর একটি তুলসীগাছের কাহিনী’র মতাে গুটিকয় গল্পে পূর্ববঙ্গে সে ট্রাজেডির সাংস্কৃতিক সমাপন। আমাদের বাংলাদেশী লেখকদের হাতে দেশভাগ ও উদ্বাস্তুর মর্মবেদনাকেন্দ্রিক উপন্যাসের দেখা মেলে না, যেমন লেখা হয়নি খাস পশ্চিমবঙ্গীয় লেখকদের কলমে। কারণ তাদের এবং একই ভাবে পূর্ববঙ্গীয় মুসলমানদের তাে উদ্বাস্তুর যন্ত্রণা ভােগ করতে হয় নি। তাই দু’প্রান্তে বাস করেও তাদের একই পথে গতি । পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য এ বিষয়ে তিনটি উপন্যাসের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’, প্রফুল্ল রায়ের ‘কেয়াপাতার নৌকাও রমেশচন্দ্র সেনের পুব থেকে পশ্চিম’ । দেশভাগ-বাংলাভাগ যে পূর্বরঙ্গীয় হিন্দুসপ্রদায়ের আর্থ-সামাজিক ও পারিবারিক স্থিতি নষ্ট করেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই সঙ্গে পূর্ববঙ্গীয় সমাজ-সংস্কৃতিরও ভারসাম্য নষ্ট, বিশেষ ভাবে সামাজিকরাজনৈতিক বিন্যাস। এ অবস্থার সংশােধন অসম্ভব।
প্রসঙ্গত স্বাধীন বাংলাদেশ নিয়ে একটি বহুকথিত বিষয় আলােচনার দাবি রাখে । বাংলাদেশের শিক্ষিত শ্রেণীতে অতি প্রচলিত একটি কথা : পাকিস্তান না হলে বাংলাদেশ হতাে না। পাকিস্তানবাদীদের মুখেই প্রধানত কথাটা শােনা যায়। পাকিস্তানের গুরুত্ব ও বাস্তবতার প্রমাণ হিসাবে । তাৎক্ষণিক বিচারে এ মন্তব্য অনেকেই মেনে নেন এই ভেবে : ‘ঠিকই তাে, পাকিস্তান হওয়াতেই না এর পূর্বপশ্চিমের বৈষম্য, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, যুদ্ধ, পরিণামে বাংলাদেশ।’ আপাত বিচারে এ হিসাব ভুল মনে হয় না। কারণ মুদ্রার অপর পিঠের ইতিহাসতথ্য কেউ পড়েন না। ধরা যাক, কোনাে কারণে ভারতভাগ হয়নি, পাকিস্তানও হয়নি। সেক্ষেত্রে তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিচারে বাস্তবতা হচ্ছে অখণ্ড ভারতে ফেডারেশন ও যুক্তবঙ্গ- যে যুক্তবঙ্গের জন্য ১৯৪৭-এ হাশিমসােহরাওয়ার্দীদের আপ্রাণ চেষ্টা, বঙ্গীয় মুসলিম লীগের এ দুই বড় নেতা চেয়েছেন কলকাতাকেন্দ্রিক যুক্তবঙ্গ যেবঙ্গে জনসংখ্যায় মুসলিম প্রাধান্য । যেখানে তিরিশের দশক থেকে মুসলিম মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত শ্রেণীর দ্রুত বিকাশ ঘটছে- শিক্ষা, চাকুরি, ব্যবসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে। তারা চেয়েছিলেন এ ধারা বজায় রাখতে বৃহত্তর পরিবেশে। এর বিকল্প ছিল মন্ত্ৰীমিশন প্রস্তাব মাফিক আসাম-বঙ্গ মিলে বৃহদ্বঙ্গ যেখানে অধিকতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা মূলত আসামের প্রাকৃতিক সম্পদের কারণে। তবে অসুবিধার সম্ভাবনাও ছিল আদি অহমিদের বঙ্গাল-বিরূপতার কারণে। এখন যেমন দেখা যাচ্ছে আসামে চলমান বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। তবে এ দুই বিকল্প বর্তমান বিভক্ত বঙ্গের উভয় অংশের অর্থনৈতিক অবস্থার তুলনায় অধিকতর সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। এ দুই সম্ভাবনা তৎকালীন শীর্ষনেতাদের কারণে ভণ্ডুল হয়। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক বিচারে দুর্বল রাজ্য। আর স্বাধীন হয়েও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক দিক থেকে খুব যে সবলতা নয়। কাজেই পাকিস্তান না হলে বাঙালি মুসলমানের খুব ক্ষতি হতাে না’বিভাগপূর্বকালে ভূখণ্ড ভাঙনের টালমাটাল অবস্থায় দু-এক জন বিশ্লেষক মন্তব্য করেন যে বিভক্ত বঙ্গের উভয় অংশই একাধিক কারণে, অন্তত অর্থনৈতিক দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে না। তাদের হিসাব ভুল প্রমাণিত হয় নি।
বিষয়টা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ সম্ভব। এ বিষয়ে প্রবীণ সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী পাকিস্তানবাদী এক বাংলাদেশী লেখকের বক্তব্য (আমাদের সূচনা বাক্য) খণ্ডন করেছেন প্রায় একই যুক্তিতে। দীর্ঘ আলােচনাশেষে তার মন্তব্য : পাকিস্তান না হলে বাংলাদেশের জন্ম হতাে না এর চেয়ে অসত্য ও উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা আর কিছু হতে পারে না। পাকিস্তান না হলে সমগ্র বাংলা ও আসাম মিলে হয় ভারতীয় ফেডারেল কাঠামাের মধ্যে অথবা আবুল হাশিমশরৎ বােস পরিকল্পনার মতাে যে স্বাধীন, অসাম্প্রদায়িক বৃহত্তর বাংলা গড়ে উঠত তা হতাে দক্ষিণ এশিয়ার সর্বাধিক সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী দেশ। তাতে বাংলাদেশী মুসলমানরাই বেশি উপকৃত হতাে’ (যুগান্তর, ১০ অক্টোবর, ২০১১)। এ বাস্তবতায় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বাদেও যেদিকটি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি তা হল যে-কোনােরকম যুক্তবঙ্গে মুসলিম শিক্ষিতশ্রেণীর প্রতিযােগিতামূলক মেধাবী বিকাশ ঘটতাে। সে বিকাশের রয়েছে সামাজিক গুরুত্ব। সেক্ষেত্রে বর্তমান বাংলাদেশে ফাপা, অন্তঃসারহীন শিক্ষিত সমাজের প্রাধান্য তৈরি হতাে না। মেধাবী ও মননশীল শিক্ষিত শ্রেণী একটি দেশের মননশীল চরিত্র গঠনে উন্নতির সহায়ক। অখণ্ড বঙ্গ উভয় সম্প্রদায়ের আত্মশক্তি নিয়েই আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে পৌঁছে যেতে পারতাে। সেক্ষেত্রে আজকের মতাে দুই বঙ্গ তথা দুই বাংলাভাষী ভূখণ্ডের কিছু সংখ্যক রাজনীতিমনস্ক, নিরপেক্ষ, সমাজসচেতন মানুষকে আক্ষেপ করতে হতাে না। তাদের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে, একদা-বঙ্গের ঐতিহ্য স্মরণ করে । কিন্তু ব্রিটিশ ভারতে শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের দুর্বুদ্ধির কারণে যা ঘটে গেছে। (অর্থাৎ ভারতভাগ বঙ্গভাগ) এর কোনাে চারা নেই। বর্তমান রাষ্ট্রনৈতিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন সম্ভাবনা দূর অস্থ। সেটাই বাস্তবতা।
সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক