You dont have javascript enabled! Please enable it! ভারতীয় রাজনীতিতে গান্ধি-জিন্না সমাচার - সংগ্রামের নোটবুক

ভারতীয় রাজনীতিতে গান্ধি-জিন্না সমাচার

ভারতীয় রাজনীতির বিশ শতকী মঞ্চনাট্যে দুই প্রধান নায়ক এম. কে. জি. (মােহনদাস করমচাঁদ গান্ধি) ও এম. এ. জে (মােহাম্মদ আলী জিন্না)। দেশবিভাগের ক্ষেত্রে জিন্না ও মুসলিম লীগ প্রধান ভূমিকা পালন করলেও সেক্ষেত্রে গান্ধি ও কংগ্রেসের শীর্ষনেতৃত্বের দায় কম ছিল না। এর প্রেক্ষাপটে ছিল হিন্দু মুসলমানের সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও পরিণামে বিচ্ছিন্নতা। নেপথ্যে তৃতীয় শক্তি ব্রিটিশ রাজের কূটকৌশলী চাতুর্য । পুনরুক্তি সত্ত্বেও এই ত্রয়ীর ভূমিকা উল্লেখ নানা প্রসঙ্গে অনিবার্য হয়ে ওঠে। এক সময় ‘জি’ ‘জে নিয়ে অনেক কথকতা দেখা গেছে, ইদানিং আলোচনায় এসেছেন আরেক ‘জে’ (জওহরলাল নেহরু)।  তবে সেক্ষেত্রে বিস্তারিত আলােচনায় জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে সরদার প্যাটেলের নামও উচ্চারিত হয়ে খাকে, তেমনি উঠে আসে উভয় সম্প্রদায়ের উগ্র ধর্মীয় স্বাতন্ত্রবাদী সংগঠনগুলাের কথা, তাদের দায়দায়িত্ব প্রসঙ্গক্রমে আলােচিত। আর গুরুত্বপূর্ণ বঙ্গ ও পাঞ্জাবের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ভূমিকা। বিভাজনের ত্রিপাক্ষিক জটিলতা নিয়ে বিস্তর লেখা হয়েছে প্রধানত ভারতীয় ও বিদেশী লেখকদের হাত দিয়ে। কিন্তু রাজনীতি-পাগল বাংলাদেশে যে কারণেই হােক এ বিষয়ে আগ্রহ কম, লেখাজোখাও কম । বিভাগপূর্ব অর্থাৎ ব্রিটিশ শাসনামলের ভারতীয় রাজনীতি বিশেষ করে ভারতবিভাগের রাজনীতি নিয়ে আলােচনায় গুরুত্ব পেয়েছে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক এবং বিশেষ রাজনৈতিক সংগঠন ও ব্যক্তিবিশেষ। রক্ষণশীল বা স্বাতন্ত্রবাদী ঘরানার লেখকগণ সম্প্রদায়গত ভিন্নতার বিষয়টা বড় করে দেখেছেন। অন্যদিকে সমন্বয়বাদীরা পালটা তুলে ধরেছেন মিল ও সহাবস্থানের বিভিন্ন দিক । অবশ্য এ আলােচনায় নিরক্ষরেখায় দাঁড়ানাে ইতিহাস-লেখকও আছেন, তবে সংখ্যায় তারা খুবই হাতেগােনা । যে কারণেই হােক বর্তমানে দ্বিতীয় ধারার কিছুটা প্রাধান্য, বিশেষ করে অক্সফোর্ড-কেজি ঘরানার গবেষক-লেখকদের কল্যাণে তবে তাদের  লেখাতেও কোথায় যেন রাজনীতির বিশেষ একটি ধারণার ছায়াপাত লক্ষ্য করা যায়। অর্থাৎ যুক্তিবাদী নিরপেক্ষতার কিছুটা অভাব। সেই সঙ্গে অমােঘ ঘটনাবলী ও সংশ্লিষ্ট নায়কদের একটু ভিন্নভাবে দেখার প্রবণতা বেশ স্পষ্ট। যার যার অবস্থান থেকে নিরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। 

বছর কয় আগে ভারতীয় জনতা পার্টি (বি. জে. পি.)’র শীর্ষস্থানীয় নেতা যশবন্ত সিং-এর ‘জিন্নাহ ইন্ডিয়া-পার্টিশন ইন্ডিপেন্ডেন্স’ শীর্ষক মােটাসােটা বইটিতেও (২০০৯ খ্রি.) উল্লিখিত ধারার প্রকাশ যেখানে দুই সম্প্রদায়ের সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে কিছু অপ্রিয় সত্যও পরিবেশিত হয়েছে। শাসকনীতি নিয়ে কিছু তথ্য রয়েছে যে দুই ধর্মের আচার-আচরণ-ভেদের ঊর্ধ্বে সরকার পক্ষের চেষ্টা রাজনীতিসহ ভাষা, শিক্ষার মাধ্যম, পাঠ্যবিষয় ও শিক্ষার ধারা নিয়ে উভয়কে পৃথক করা এবং তা গােড়া থেকেই সচল ছিল। অবশ্য সচেতন পরিকল্পনায়  গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টির তাৎপর্য লীগ-কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাগণ নিজ নিজ স্বার্থের আলােকে বিবেচনা করেছেন- সর্বজনীন জাতীয় স্বার্থে নয়। তাই দেখা যায় ধর্মীয় সম্প্রদায়কে জাতি হিসাবে চিহ্নিত করা ভারতীয় সমাজে বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায় উভয় সম্প্রদায়ের শীর্ষ সামাজিক-রাজনৈতিক এবং ধর্মবাদী বিশিষ্ট প্রচারকগণ এর জন্য দায়ী তাঁদের বক্তব্য, বিবৃতি ও কর্মতৎপরতা বিচার করে দেখলে সেটা বােঝা যায়। এরা ভারতবিভাজনের মূল হােতা  গান্ধি : জননেতা হয়েও বেনিয়া ও ‘রাজ’-সমর্থক ভারতবর্ষের উত্তরপশ্চিম অঞ্চলে কাথিয়াড়ের রক্ষণশীল হিন্দু-পরিবারে মােহনদাস করমচাঁদ গান্ধির জন্ম (১৮৬৯)। পােরবন্দর থেকে রাজকোটে আসা দেওয়ানজি পরিবারে বৈষ্ণব ও জৈন ধর্মীয় প্রভাবে বড় হয়ে ওঠেন এম, কে গান্ধি। বিলেত থেকে ব্যারিস্টার হয়ে আসা গান্ধির পক্ষে তাই বিলেতি কেতার বদলে অহিংসা ও সত্যাগ্রহ নিয়ে রাজনৈতিক ময়দানে আবির্ভূত হওয়া বােধহয় স্বাভাবিকই ছিল। এদিক থেকে মস্তবড় প্রভেদ গান্ধির সঙ্গে আরেক বিলেত ফেরত ইংরেজি কেতায় অভ্যস্ত ভারতীয় ব্যারিস্টার-রাজনীতিক মােহাম্মদ আলী জিন্নার  দুজনেই গুজরাটি কিন্তু স্বভাবে, জীবনাচরণে দুজনের মধ্যে মেরুপ্রমাণ প্রভেদ  অথচ এরাই ভারতীয় রাজনীতির নিয়তি নিধারণে প্রতিপক্ষ হিসাবে মুখােমুখি। 

জনরাজনীতিতে নিবিষ্ট হলেও সেজন্য গান্ধির পক্ষে বিশ্বে আলােচিত। ‘অর্ধনগ্ন ফকির’ পরিচিতির প্রয়ােজন ছিল না। তবু সেই বিসদৃশ বেশভূষা ও সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জীবনাচরণে নিজেকে বিশিষ্ট করে তােলেন গান্ধি । সেটা কি অর্ধাহারে অভ্যস্ত, অর্ধনগ্ন ভারতীয় তৃণমূল জনতার সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ ও চমক সৃষ্টির (গিমিক’) জন্য? সে যাই হােক অহিংস-নীতির রাজনৈতিক হাতিয়ার নিয়ে গান্ধি ভারতীয় জনতার কাছে গান্ধি মহারাজ’ এবং শিক্ষিতশ্রেণীর চোখে মহাত্মাজী হয়ে ওঠেন। আর কংগ্রেসে রাজনীতিক সহকর্মীদের জন্য সুদিনে-দুর্দিনে অভিভাবক হিসাবে ‘বাপুজি’ যদিও তিনি কংগ্রেসের চার-আনার প্রাথমিক সদস্য ছিলেন কিনা তাও প্রশ্ন সাপেক্ষ। বৃহৎ মুৎসুদ্দি বিড়লাদের জন্যও তিনি বাপু’। তার সরব বা নীরব সম্মতিবাদে কংগ্রেসের উচ্চতম কমিটি যেমন গঠিত হতাে না তেমনি নির্বাচিত হতাে না কংগ্রেস-সভাপতি  হলে বিপদ তার প্রমাণ সুভাষচন্দ্র বসু।

গান্ধির বিরুদ্ধে কোনাে কোনাে রাজনৈতিক বিশ্লেষকের বড় অভিযােগ তিনি। বরাবর আপসবাদী রাজনীতির প্রবক্তা, বিশেষ করে ব্রিটিশ রাজের সঙ্গে। চাপআন্দোলন-চাপ এই নিরামিষ রাজনীতির অনুসারী হয়ে তিনি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের বিরােধী। অহিংস সত্যাগ্রহ ছিল তার রাজনীতির মূল হাতিয়ার, যদিও ‘হাতিয়ার’ শব্দটি তার রাজনীতির সঙ্গে মানায় না। তার আপসবাদিতার চরম উদাহরণ ১৯১৯-এ ডায়ারি হত্যাকাণ্ডে তার প্রতিক্রিয়া এবং প্রতিটি সম্ভাবনাময় গণ-আন্দোলনের ক্লাশ টেনে ধরা। যেমন, চৌরিচৌরার ঘটনায় ও আগস্ট (১৯৪২) আন্দোলর্নের ব্যাপক তীব্রতায় আন্দোলন স্থগিত করা, সবশেষে ভারতীয় নৌসেনা বিদ্রোহে। অথচ হিন্দু-মুসলিম ঐক্যে প্রয়ােজনীয় নমনীয়তা দেখাতে পারেন নি তিনি। ভারতীয় রাজনীতির জন্য এটা ছিল। সবচেয়ে জরুরি  খিলাফতে তার যােগদান ছিল রাজনৈতিক ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার জন্য। মুসলিম ধর্মীয় রক্ষণশীলতার সঙ্গে সমঝােতা বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল।  শাসকশ্রেণীর সঙ্গে রাজনৈতিক আচরণে গান্ধি-জিন্নায় তফাৎ সামান্য। গান্ধি মাঝে মাঝে শাসকদের ওপর চাপ তৈরি করতে আন্দোলনের ডাক দিয়ে চরমক্ষণে তা স্থগিত করেছেন। কিন্তু জিন্না ব্রিটিশ-বিরােধী আন্দোলনের পথ মাড়ান নি। তার আন্দোলন এক পর্যায়ে সম্প্রদায়বাদী অর্থাৎ কংগ্রেস এবং শিক্ষিত ও বর্ণহিন্দুদের বিরুদ্ধে  এ কাজে তিনি কখনাে তপসিলী হিন্দু (অস্তজ  দলিত)-দের ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। কিন্তু তার সেই রাজনীতি শুদ্ধাচারী ছিল না। তপসিলী নেতা যােগেন মণ্ডলের ফের ভারত যাত্রা তার প্রমাণ।  প্রথম বিশ্বযুদ্ধ গান্ধিকে আফ্রিকা থেকে লন্ডন হয়ে ভারতীয় রাজনীতিতে প্রবেশের সুযােগ করে দেয়। এ কাজে প্ররােচনা বা প্রণােদনা ছিল ব্রিটিশ শাসকশ্রেণীর ব্যক্তিবিশেষের- যেমন তৎকালীন সহকারি ভারত সচিবের এবং তা ১৯১৫ সালে (সুনীতিকুমার ঘােষ, প্রাগুক্ত, দ্বিতীয় খণ্ড)। এর প্রধান কারণ যুদ্ধের নাজুক অবস্থায় ভারতে সন্ত্রাসবাদের তৎপরতা বৃদ্ধি। অন্যদিকে ভারতীয় কমপ্ৰেডর পুঁজিবাদী ও ভূস্বামীকুলের জন্য রাজনৈতিক সহায়তা দান। সর্বোপরি সন্ত্রাসবাদ রুখতে অহিংসার রাজনীতি ছিল খুবই কার্যকর দাওয়াই। মুৎসুদ্দি শ্রেণীর অর্থনৈতিক সেবা যেমন গান্ধি অকাতরে নিয়েছেন নিজের জন্য, কংগ্রেসের জন্য (বিড়লা সবচেয়ে বড় উদাহরণ) তেমনি পরিবর্তে তাদের মাথায় ছাতা ধরেছেন।

স্বদেশী আন্দোলনে বিলেতি বর্জন- সেখানেও শিল্পপতিদের বিপুল মুনাফাবাজি। অস্বীকারের উপায় নেই ভারতের শীর্ষ মুৎসুদ্দি ধনপতিদের উদার অর্থ দাক্ষিণ্যে গান্ধি সেবাশ্রম থেকে শুরু করে কংগ্রেসের সর্বপ্রকার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চলেছে, যেমন দেখা গেছে মুসলিম লীগের অর্থভাণ্ডারের ক্ষেত্রে মুসলিম বেনিয়াদের অকাতর সাহায্য। কাজেই এদের স্বার্থরক্ষা না করে গান্ধি জিন্নার উপায় ছিল না। তাছাড়া গান্ধি-পত্রাবলী এবং ঘনশ্যামদাস বিড়লার স্মৃতিকথা ‘ইন দ্য শ্যাডাে অব দ্য মহাত্মা’ধড়লে ভালােভাবে বােঝা যায় এইসব ধনপতির হাত দুদিকেই প্রভাব রেখেছে, অন্তত গভীর যােগাযােগ তাে বটেই-এক, ব্রটিশরাজ; দুই, গান্ধি জিন্না তথা কংগ্রেস লীগ। তবে এ বিষয়ে গান্ধির পাল্লাটা ভারি । এরা ভারতীয় রাজনীতিতে শীর্ষনেতাদের মাধ্যমে প্রভাবই রাখে নি, এরাই ভারতবিভাগের অন্যতম প্রধান আড়কাঠি এবং তা ছিল একদিকে টাটাবিড়লাদের অন্যদিকে ইস্পাহানি-আদমজিদের স্বার্থে। একদিকে গান্ধিকে তাই দেখতে হয়েছে দেশীয় মুৎসুদ্দি ধনিক ও ভূস্বামী স্বার্থ অন্যদিকে অংশত ‘রাজ’-স্বার্থ যেজন্য স্বরাজ দাবির পাশাপাশি এমন কথাও তাকে বলতে হয়েছে : ‘আমি চাই স্থায়ী ইন্দো-ব্রিটিশ পার্টনার শিপ’ (জি, ডি, বিড়লা, ‘বাপু’)। পূর্ণ স্বাধীনতার বদলে “ডােমিনিয়ন স্ট্যাটাস’ বা ‘কমনয়েল্থ’-এর স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে রাজশক্তির সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলার পক্ষপাতী ছিলেন গান্ধি। তাই একাধিকবার কংগ্রেস-অধিবেশনে উত্থাপিত স্বাধীনতা প্রস্তাব (মােহানি-নেহরু-সুভাষ কর্তৃক) নাকচ বা স্থগিত করেন গান্ধি । এই যদি গান্ধির নীতি হয়ে থাকে তাহলে প্রসঙ্গত কয়েকটি প্রশ্নের জবাব পাওয়া জননেতা গান্ধিকে বােঝার জন্য জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। প্রথমত এমন  একজন বিতর্কিত রাজনীতিক ‘গান্ধিমহারাজ’ ও ‘মহাত্মাজি’ হয়ে ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করেন কীভাবে? কেমন করে সম্ভব ভারতীয় স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে ওঠা? বিষয়টা নিয়ে দেশীবিদেশী একাধিক লেখক যা বলেছেন তাতে সবটুকু পরিস্কার হয়নি, অর্থাৎ পুরাে জবাব মেলেনি। আমার ধারণা কংগ্রেসে গান্ধির আবির্ভাবের (১৯১৫) আগে সেখানে বহুমাত্রিক চেতনার বিচক্ষণ জননেতার অভাব ছিল । সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি প্রান্তিক বাংলার মানুষ হওয়ার কারণেই কি রাজনীতির মুকুটহীন সম্রাট’ বা ‘দেশনায়ক’ হয়েও বিশাল অবাংলা-অবাঙালি বলয়ের ভারতীয় রাজনীতির স্থায়ী নেতা হতে পারেন নি? মুসলিম রাজনীতির ক্ষেত্রেও একই রকম ঘটনা দেখতে পাওয়া যায়। ভারতীয় রাজনীতিতে কী হিন্দু কী মুসলমান সম্প্রদায়ে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের প্রাধান্য স্থায়ী হতে দেখা গেছে। বঙ্গের ছিল ক্ষণিক প্রাধান্য। 

ব্যক্তিচারিত্র বৈশিষ্ট্য হিসাবে গান্ধির ছিল জনচেতনা বুঝে নেবার ক্ষমতা অন্য ভাষায় জনচিত্তজয়ের দূরদৃষ্টি, ক্ষমতা, আত্মবিশ্বাস, বিনয় ও সহিষ্ণুতা, একনায়ককে জননায়ক হিসাবে তুলে ধরার দক্ষতা। তবে ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে মিশিয়ে যেমন জনচিত্ত জয় করেছেন তেমনি তাতে কখনাে অসাম্প্রদায়িকতার আপাত মিশ্রণ ঘটিয়ে শিক্ষিত আধুনিক মনের সমর্থন কুড়িয়েছেন। বিস্ময়কর যে সামন্তবাদী চিন্তা, ধর্মীয় রক্ষণশীলত) ওঁ সনাতন বর্ণাশ্রমে বিশ্বাসী হয়েও গান্ধি আধুনিক হিন্দু শিক্ষিত শ্রেণীতে গভীর প্রভাব রেখেছিলেন। এমনকি ভারতপ্রেমী অ্যান্ড্রুজ তার ভক্ত অরি প্রগতিবাদী রলাঁ তাকে স্বাধীনতাসংগ্রামী হিসাবে উঁচুতারে বেঁধে রবীন্দ্রনাথকে অসহযােগ প্রসঙ্গে সমালােচনায় বিদ্ধ করেন। | একাধিক বিদেশী লেখক গান্ধি প্রশংসায় সােচ্চার হয়েছেন। অথচ আধুনিকতা, প্রগতিশীলতার মতাে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথ গান্ধির তুলনায় কয়েক পা এগিয়ে ছিলেন। সার্বক্ষণিক লেখক না হয়ে রবীন্দ্রনাথ রাজনীতিক হলে তুলনাটা আরাে স্পষ্ট হতাে। আর সেটা রাজনীতির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আংশিক সংশ্লিষ্টতা থেকেই বুঝতে পারা যায়। গাে রক্ষা, প্রতিমাপূজা, জন্মনিয়ন্ত্রণ, আধ্যাত্মিকতা ইত্যাদি নিয়ে গান্ধি ও রবীন্দ্রনাথের চিন্তার প্রভেদ স্পষ্ট। সেক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক, গান্ধি অনাধুনিক । একজন প্রগতিবাদী, অন্যজন প্রগতিবিরােধী। আমার বিশ্বাস অহিংসার রাজনীতিই মূলত গান্ধির জনপ্রিয়তার মূল কারণ, বিশেষ করে শিক্ষিত সমাজে। সেই সঙ্গে শাদামাঠা পরিচ্ছদ ও জীবনাচরণ আর সন্তসুলভ ধর্মাচরণ, রামধুন ও রামরাজ্যের রাজনৈতিক দর্শন তাকে রাজনৈতিক গুরু’তে পরিণত করে ব্যাপক জনসমাজে । ভারতীয় সমাজের বড়াে একটি প্রবণতা ভক্তিবাদ ও গুরুবাদী কাল্ট। বহুনন্দিত গুরুবাদ থেকে রবীন্দ্রনাথও মুক্ত থাকতে পারেননি (গুরুদেব)। ব্রমফিল্ডের ভাষায় গান্ধি ‘মাস্টার অব সিম্বােলিজম’।

আর যশবন্ত সিংহের বিচারে প্রতিবাদী রাজনীতির মাস্টার কারিগর’ । যে লবণসত্যাগ্রহ (ডান্ডি মার্চ) গান্ধিকে জনবান্ধব নেতায় পরিণত করে সেই অভিযানে সমর্থন জুগিয়ে প্রচার চালায় ইংরেজ প্রশাসন (সুনীতিকুমার ঘােষ)।  এতসব অর্জন সত্ত্বেও গান্ধি-রাজনীতির বড়াে ব্যর্থতা হচ্ছে তার ‘গুরুভাবমূর্তি শুধু ভারতের একটি সম্প্রদায়কেই মাতিয়ে ছিল। খিলাফতআঁতাত সত্ত্বেও তিনি মুসলমান সমাজকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করতে পারেন নি। তেমন গভীর চেষ্টা তার ছিল বলে মনে হয় না। একাধিক ঘটনা তার প্রমাণ । তাছাড়া যিনি নিজেকে ‘সনাতনী হিন্দু’ বলে জানান দেন এবং গাে রক্ষাকে তার ধর্ম’ বলে ঘোষণা করেন তার পক্ষে কি মুসলমানের হৃদয় জয় করা। সম্ভব? হয়তাে তা হতে পারতাে নিম্নবর্গীয় মুসলমানের জন্য যদি তার ও কংগ্রেসের রাজনীতি প্রজাস্বার্থের পক্ষে কাজ করতাে। পক্ষে দূরে থাক কৃষকবিরােধী ভূস্বামী স্বার্থরক্ষা ছিল তার প্রধান লক্ষ্য তাই দক্ষিণ আফ্রিকায় হিন্দুমুসলমান-পার্সি-খ্রিস্টানদের নিয়ে উচ্চবর্গীয়ও খনিশ্রমিকের পক্ষে সফল সামাজিক আন্দোলনের কারিগর গান্ধিকে ভারতে চরম ব্যর্থতা বরণ করতে হয় । দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৯১৩ সালে উল্লিখিতদের নিয়ে একটি স্মরণীয় ধর্মঘট ও দেশজোড়া পদযাত্রায় নেতৃত্ব দিয়ে ছিলেন গান্ধি। এই অভিজ্ঞতা তাকে সর্বভারতীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল। দক্ষিণ আফ্রিকা তাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়’ (সুমিত সরকার, প্রাগুক্ত)। প্রাথমিক পর্বে ভারতীয় রাজনীতিতে গান্ধি মিথ তৈরি হওয়ার পক্ষে ঐ সাফল্যও একটি বড় কারণ যেখানে মূল চাবিকাঠি অহিংস সত্যাগ্রহ। এবং চম্পারণ, ঘেড়া ও আহমেদাবাদে যথাক্রমে কৃষক ও শ্রমিকদের নিয়ে আপস-ফয়সালা তার রাজনৈতিক ভিত তৈরি করে। লবণ সত্যাগ্রহ তার জনমহারাজ রূপ উজ্জ্বল করে তােলে। কিন্তু সেকুলার রাজনীতির সুতােটা হাতে তুলে নিয়েও তা ধরে রাখতে পারেন নি গান্ধি। পারেন নি তার হিন্দুত্ববাদী প্রবণতা ও মহাসভাপন্থী সতীর্থদের প্রভাবে। আজাদ-আনসারি-আজমল-আসফ আলি-কিদোয়াই প্রমুখের সঙ্গে তার সত্যিকার রাজনৈতিক আদর্শগত ঐক্য তৈরি হয় নি। বিশের দশকে খিলাফতি আবেগের মধ্যেও ঐক্য তৈরি হয়নি সাম্রাজ্যবাদ-বিরােধী আলীভাইদের সঙ্গে। দেশবিভাগের প্রাক্কালে এ বিষয়ে তার কার্যক্রম সদর্থক হলেও মুসলিম রাজনীতিকদের কাছে তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে এই বক্তব্যে যে ‘শুধু নােনায়াখালি কেন, বিহার নয় কেন যে বিহারে মুসলমান হত্যার উন্মত্ততা ছিল। 

অনেক বেশি (সংখ্যাগত হিসাব সুমিত সরকারসহ একাধিক লেখকের)। তবে বিভাগােত্তর সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততা প্রতিরােধে তার ভূমিকা ‘মহাজনােচিত’। তাই স্বধর্মীর হাতে প্রাণ দিতে হল মহাত্মা নামখ্যাত গান্ধিকে। এবং তাও তার একান্তশিষ্য প্যাটেল-প্রসাদদের পরােক্ষ মদতে। কী ট্রাজেডি কংগ্রেসের সর্বাধিনায়ক মহাত্মা গান্ধির জন্য! অহিংস পদ্ধতিতে হিংসাকে জয় করা যায় কিনা এ প্রশ্নের সদর্থক জবাব গান্ধির কর্ম ও জীবন দিতে পারে নি । বরং প্রশ্নটা ভবিষ্যত কালের জন্য রেখে গেছে। জিন্না : ঠাণ্ডা মাথার কঠিন হিসেবি রাজনীতিক ভারত ভেঙে পাকিস্তান গড়ার স্থপতি মােহাম্মদ আলী জিন্না। কেমন ছিলেন তিনি ব্যক্তি ও রাজনীতিবিদ হিসাবে? অনেক লেখা হয়েছে তাকে নিয়ে বিশেষ করে গত কয়েক দশকে। ভারতে, পাকিস্তানে ও পশ্চিমা বিশ্বের অনেক বিশিষ্টজনের হাতে ইতিহাস তৈরি হয়েছে ভারতবিভাগ ও জিন্না-গান্ধি নিয়ে । সেসব মতামতের গ্রহণযােগ্যতা নিয়ে বিতর্কের অবকাশও রয়েছে, বিশেষত জিন্না বিষয়ক বক্তব্যে। আজ জিন্নার স্বভাব ও প্রকৃতি নিয়ে একটি কথা অনেকে বলেছেন : তার ছিল প্রচণ্ড অহবােধ। জিন্না অব পাকিস্তান এর লেখক স্ট্যানলি উলপার্ট জিন্নাপ্রশস্তির পরও তার মধ্যে দেখেছেন অহম্বােধ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও রাজনীতিতে প্রধান ব্যক্তি হওয়ার প্রবল ইচ্ছা । সেই সঙ্গে জিন্নাকে তিনি শীতল রক্তের ও অসীম ধৈর্য্যের মানুষ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। এইচ. ভি. হডসনও তাকে ‘শীতল স্বভাবের, নিরুত্তাপ ও নিঃসঙ্গ’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। তার ছিল প্রচণ্ড অহংকার। এবং তা এমনি যে অবহেলা তার কাছে রূঢ় আচরণ এবং উপেক্ষা অপমান বলে মনে হয়েছে। কংগ্রেস কর্তৃক তার দাবি প্রত্যাখ্যানের তিনি শােধ নিয়ে ছিলেন দুই দশক পর তাদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করে দিয়ে’ (দ্য গ্রেট ডিভাইড, ১৯৬৯)।

ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন জিন্নার ‘অতি আত্মম্মন্যতা’ (মেগালােম্যানিয়া) প্রসঙ্গে তাকে সাইকোপ্যাথিক কেস’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। এবং অ্যাটুলিসহ একাধিক ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ জিন্না স্বভাবের ‘গর্ব ও অহমিকা’ ভারতবিভাগ ও পাকিস্তান সৃষ্টির পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেছেন (আর. জে. মুর-ইন্ডিয়াস পাটিশন গ্রন্থের প্রবন্ধ)। তবে জিন্নার ব্যক্তিত্ব, দৃঢ়তা ও কৌশল-দক্ষতা যে পাকিস্তান অর্জনে প্রধান সহায়ক কারণ তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। প্রসঙ্গত চার্চিলের জিন্নাপ্রীতি এবং জিন্না-চার্চিলের সুসম্পর্ক স্মরণযােগ্য। | জিন্না-রাজনীতির অনুসারি এ বি, হাবিবুল্লাহ’র মতেও জিন্না ছিলেন প্রচণ্ড অহমবােধ সম্পন্ন তােষামােদ প্রিয় মানুষ। এবং এতটা অসহিষ্ণু যে ১৯৪৩ সনের পর থেকে তিনি সমালােচনা সহ্য করতে পারতেন না।‘জো হুজুরদেরই তিনি পছন্দ করতেন’ (হেক্টর বলিথাের ‘ইন কোয়েস্ট অব জিন্না’-যশবন্ত সিংয়ের ‘জিন্না’ বইতে উদ্ধৃতি, পৃ. ২০৮)। অন্যদিকে পাকিস্তান আন্দোলনের বাঙালি নেতা কামরুদ্দীন আহমদ কাছ থেকে দেখা জিন্নাকে শনাক্ত করেছেন। ‘মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত’ হিসাবে (বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৯৩, ১৩৮২ বঙ্গাব্দ)। তার বিশ্বাস পাকিস্তানের চেয়েও ‘রাজকাটের দেওয়ানের পুত্র গান্ধিজি ও বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত নেহেরুর উপর প্রতিশােধ নেওয়া জিন্নার কাছে বড় হয়ে উঠেছিল (প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৪)। এ ধরনের মতামত প্রকাশ কমবেশি আরাে দু-এক জন করেছেন। জিন্নার রাজনৈতিক জীবন-ইতিহাস পাঠে, ঘটনাবলীর দায়ে তেমন মনে হতেই পারে। অগাধ বিশ্বস্ততার জন্য জিন্না নাজিমুদ্দীনকে খুব পছন্দ করতেন। অথচ যুক্তপ্রদেশের মুসলিম লীগ সভাপতি ইসমাইল খানকে দূরে সরিয়ে রাখেন তার ভুলগুলাে ধরিয়ে দেবার কারণে (সিং, প্রাগুক্ত)। | জিন্নার ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে হেক্টর বলিথাে আরাে লিখেছেন : ‘জিন্না ছিলেন প্রাণশক্তির আধার যদিও রাজনীতিক্ষেত্রে ঠাণ্ডামাথার বাস্তববাদী। তার একমুখীমনের পেছনে ঐ শক্তি কাজ করেছে’ (ইন কোয়েষ্ট অব জিন্না’)।

বলতে হয়, অনেকটা লক্ষ্যভেদী অর্জুনের মতাে মানসবৈশিষ্ট্য। সম্পূর্ণ বিলেতি কেতায় ও মানসিকতায় অভ্যস্ত জিন্না দেহাতি মানুষের সান্নিধ্য পছন্দ করতেন না। শুরুতে তার রাজনীতি ছিল একদিকে নিয়মতান্ত্রিক অন্যদিকে শিক্ষিত ও এলিট শ্রেণীর সমধর্মী । তার অহমবােধ কখনাে কখনাে সৌজন্য অতিক্রম করেছে যখন তিনি কংগ্রেস সভাপতি মাওলানা আজাদের সঙ্গে করমর্দনে (হ্যান্ডশেক) বিরত হন কিংবা আরেক কংগ্রেস সভাপতি সুভাষের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিষয়ক আলােচনায় রূঢ় প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন। | জাতীয়তাবাদী মুসলমান রাজনীতিকদের প্রতি তার বিরূপতার কারণ একটিই। রাজনীতিতে তিনি হতে চেয়েছেন ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র মুখপাত্র’ (আয়েশা জালাল ও আরাে দু একজনের ভাষ্যে ‘সােল স্পােম্যান’)। কিন্তু ১৯৩৫ সনের ‘রাজ কর্তৃক জারিকৃত কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড’ সত্ত্বেও ১৯৩৭ সনের প্রাদেশিক নির্বাচনের ফলাফল বিচারে দেখা যায় জিন্না এবং তার মুসলিম লীগ তখনাে ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র মুখপাত্র নয়। এমন কি গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম-প্রধান প্রদেশ বাংলা ও পাঞ্জাবেও নয়, সীমান্ত প্রদেশে তাে নয়ই। 

তা সত্ত্বেও ঐ সময়ে জিন্না ঐ দাবির পক্ষে এমন বক্তব্য রাখেন যে তিনিই ভারতীয় মুসলমানদের পক্ষে কথা বলার একমাত্র প্রতিনিধি । তার ভাষায় ‘৯৯ শতাংশ মুসলমান তার সঙ্গে। এর বাইরে রয়েছে কিছু সংখ্যক বিশ্বাসঘাতক, বাতিকগ্রস্ত, অতিমানব বা পাগল’। ১৯৪৮-এ তার ঢাকা বক্তৃতায় অনুরূপ শব্দাবলী স্মর্তব্য যদিও ভিন্ন প্রসঙ্গে। এ পর্যায়ে তার প্রতিটি বক্তৃতায় ‘হিন্দুকংগ্রেস’ ‘হিন্দুভারত’, ‘হিন্দুরাজ’ ইত্যাদি শব্দ ঘুরে ফিরে এসেছে। এক সময় ভাইসরয় লিনলিথগাে সাম্প্রদায়িক খেলাটা ভালােই খেলেছেন একাধিকবার জিন্নার সঙ্গে দেখা করে তাকে হাতের মুঠোয় এনে। যেমন খেলেছেন শেষ ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন। প্রসঙ্গত আয়েশা জালালের জিন্না বিষয়ক আরাে কিছু বক্তব্য সঠিক মনে হয় । তার বিচারে জিন্নার রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক বিষয়টি নিছক রাজনৈতিক কৌশল, কোনাে প্রকার আদর্শিক অঙ্গীকার (কমিটমেন্ট) নয়’ (দ্য সােল স্পেক্সম্যান’, ১৯৮৫, পৃ. ৫)। অথচ ধর্মকে টেনে সামপ্রদায়িক রাজনীতির শ্লোগানে মুসলমান জনমতের সমর্থন আদায়ের বাইরে অন্য কোনাে আদর্শই জিন্নার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে (১৯৩৭-পরবর্তী লক্ষ্য করা যায় না । হডসনের মতেও জিন্নার এ ভিন্ন যাত্রার কারণ ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক বিশ্বাসজাত। তার মুসলিম জাতীয়তাবাদী চেতনা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অনেক উর্ধ্বে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে’ (পৃ. ৪২)। হডসন বা অনুরূপ বিদেশী লেখকের বক্তব্য বলে নয়, এ সময় থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত জিন্নার রাজনৈতিক বক্তৃতায় শুধু সাম্প্রদায়িক বিভেদের সুর নানামাত্রায় তিক্ত রূপ পরিগ্রহ করেছে- কখনাে বিশেষভাবে গান্ধি। বা নেহরুর বক্তব্য উপলক্ষে কিংবা তাদের সমালােচনায় । আয়েশা জালাল এবং পাকিস্তানবাদী লেখকদের এমন বক্তব্য যুক্তিনিষ্ঠ নয় যে জিন্নার পাকিস্তান প্রস্তাব বা দ্বিজাতিতত্ত্ব কংগ্রেস ও ‘রাজ’-এর সঙ্গে রাজনৈতিক চাপ ও দেনদরবারের হাতিয়ার। ১৯৩৫-এর, বিশেষ করে নির্বাচনের (১৯৩৭) পর থেকে জিন্নার বক্তব্য বরং বিপরীত সত্যই তুলে ধরে। এমন কি শীর্ষস্থানীয় বিশেষত উত্তর ভারতীয় মুসলিম নেতাদের বক্তব্যেও।

মিয়া বশির আহমদ ও আলীগড় গ্রুপের দ্বিজাতিতত্ত্ব ও স্বতন্ত্রভুবন বিষয়ক বক্তব্যের সঙ্গে জিন্নার ধর্মীয় স্বাতন্ত্রবাদী বক্তব্যের মিল খুবই স্পষ্ট। এর মূলকথা : ‘গত বারােশত বৎসর যাবত ভারতবর্ষ হিন্দুভারত ও মুসলমান ভারতে বিভক্ত। বর্তমান ঐক্য একেবারে কৃত্রিম …হিন্দুমুসলমান সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতি বিচারে দুই স্বতন্ত্র   জাতি। কাজেই ভারতবর্ষকে ভাগ করে এ দুই জাতির জন্য আলাদা বাসভূমি তথা জাতিরাষ্ট্র গঠন করতে হবে’। | যে জিন্নার জন্ম খােজা সিন্ধি পরিবারে (১৮৭৬), গোঁড়া সুন্নি পরিবারে নয়, যার শিক্ষা, বেড়েওঠা আধুনিক পাশ্চাত্য ধারায়, যিনি লন্ডন পরিবেশ থেকে বােম্বের স্বনামখ্যাত আইনজীবী এবং উদারনৈতিক, রাজনীতিক নওরােজি ও গােখলের ভাবশিষ্য, সরােজিনী নাইডুর ভাষায় হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির দূত’তিনি কেন তিরিশের দশকের শেষপর্ব পেরিয়ে অসম্প্রীতির তীব্র প্রবক্তা? এ প্রশ্ন বহু-আলােচিত তার প্রকৃতি বৈশিষ্ট্য ও কংগ্রেসের সঙ্গে মুসলিম দাবি বিষয়ক লেনদেনে ব্যর্থতার প্রসঙ্গ টেনে। তাছাড়া ব্যক্তিগত অবস্থানের প্রশ্ন তাে আছেই। সঙ্গত কারণে এমন প্রশ্ন উঠে আসে যে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি যদি তার আদর্শই হতাে তাহলে কংগ্রেস-বিরােধী হয়েও সেকুলার মুসলিম রাজনীতি তার দাবি আদায়ের হাতিয়ার হতে পারতাে। জাতীয়তাবাদী মুসলমান রাজনীতিকের সংখ্যা বিশ থেকে তিরিশের দশকে নেহাৎ কম ছিল না। হয়তাে সমস্যা ছিল নেতৃত্ব নিয়ে, ছিল আদর্শগত সমমানসিকতা নিয়ে। তবু সম্প্রদায়বাদী রাজনীতির পথই বেছে নেন জিন্না। এর বড় কারণ প্রতিশােধস্পৃহা, ক্ষুব্ধমনের পরিতৃপ্তি অর্জন। এবং একক রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী তথা একনায়ক হওয়া। তাছাড়া প্রকৃতিগত আরো একটি প্রবণতা বিচার্য । তার বড় হয়ে ওঠার পরিবেশে তার মানসিকতায় সাম্রাজ্যবাদ-বিরােধিতা বা নিখাদ সেকুলার জাতীয়তাবাদী আদর্শের কোনাে প্রভাব ছিল না। তাই শাসক সমর্থক উদার রাজনীতির উত্তর প্রভাব বহন করে বিলাতফেরত ব্যারিস্টার জিন্না ভারতে এসে ১৮৯৭ সালে ‘আঞ্জুমানে ইসলাম’-এ যােগ দেন যা তার বহিরঙ্গ-বৈশিষ্ট্যের বিপরীত । এমন ভাবনা কি অসঙ্গত যে তার মনােগহনে রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও ধর্মীয় চেতনার স্ববিরােধী প্রভাব যথেষ্টই ছিল, শুধু অনুকূল পরিবেশের জন্য অপেক্ষা। এ সময় তাে কংগ্রেসের সঙ্গে কোনাে সাংঘর্ষিক কিছু ঘটেনি। এরপর ১৯১৩ সনে মুসলিম লীগে যােগদান। তখনাে কংগ্রেসে গান্ধির আবির্ভাব ঘটেনি।

অনায়াসে গান্ধিবিহীন কংগ্রেসে যােগ দিয়ে তার সেকুলার অংশকে সংগঠিত ও সংহত করতে পারতেন এই প্রতিভাবান আইনজীবী-রাজনীতিক। সেক্ষেত্রে তার রাজনৈতিক চিন্তা ও উচ্চাশা পূরণে কংগ্রেস হয়তােবা নেতিবাদী নিয়তি  (নেমেসিস) হয়ে উঠতােনা । তখন সাহেবি পােষাকের জিন্নাকে শেরওয়ানি টুপি পরিহিত কায়েদে আজম’ হয়ে ওঠার প্রয়ােজন পড়তাে না। এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় মনে রাখা দরকার যে জিন্না প্রকৃতিগত ভাবেই জনরাজনীতির প্রতি অনুরক্ত ছিলেন না (যেমন ছিলেন গান্ধি ফজলুল হক)। বরং জনসাধারণ সম্পর্কে ছিল এক ধরনের উন্নাসিক অবজ্ঞা । ঘটনা এবং তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাকে বাধ্য করে ছিল জননেতার মুখােশ পরতে এবং তা জনবিমুখ মানসিকতা নিয়ে । কামরুদ্দীন আহমদ প্রমুখের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা তাই বলে। এদিক থেকে। শীর্ষ কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে তার বেশ অমিল । অমিল বঙ্গীয় মুসলিম লীগ নেতা আবুল হাশিম বা সােহরাওয়ার্দির সঙ্গে যদিও এরা দুজনই উচ্চশিক্ষিত শ্রেণীর মানসিকতা সম্পন্ন । লাহাের প্রস্তাবকে (১৯৪০) দেশবিভাগের ইতিহাসে প্রথম মাইলফলক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। আসলে ওই মাইলফলক হচ্ছে ১৯৩৫ সনের কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড (সাম্প্রদায়িক রােয়েদাদ) যার,সূচনা ১৯০৯-এর মর্লি-মিন্টো, ১৯১৯-এর মন্টেগু-চেমসফোর্ড এবং পরবর্তী সংস্কার প্রস্তাবগুলাে যেখানে পৃথক নির্বাচনের ভেদনীতিকে আইনি বাস্তবতায় প্রতিষ্ঠিত করা হয় । লখনৌ চুক্তির পর বেঙ্গল প্যাক্ট বাতিল ও ধারাবাহিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বিপর্যন্ত বিশের দশকের ঘটনাবলীও দেশবিভাগের পথ তৈরিতে কম গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক নয়। এসবের ধারাবাহিকতায় ১৯৪০-এর বিভাজনধর্মী লাহাের প্রস্তাব যা একান্তভাবেই জিন্নার পরিকল্পনা প্রসূত। ট্রান্সফার অব পাওয়ার’-এর বিপুল তথ্যাবলী এবং অন্যান্য সূত্র একথাও বলে যে লাহাের প্রস্তাব প্রণয়নে ব্রিটিশ রাজের যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। এ প্রসঙ্গে আরাে দ্রষ্টব্য ওয়ালি খানের ‘ফ্যাক্টস আর ফ্যাক্টস’ গ্রন্থটি। প্রধানমন্ত্রী চার্চিল থেকে ভারতসচিব আমেরি, কিংবা ভাইসরয় লিনলিথগাে থেকে শেষ ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন তক এবিষয়ে কেউ ধােয়া তুলসিপাতা নন। আর লাহাের অধিবেশনে জিন্নার দীর্ঘভাষণের প্রতিটি বাক্য যেন সাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীক।

দেশবিভাগের সত্যকার মাইলফলক যদি খুঁজতেই হয় তবে তা একদাসম্প্রীতির দূত জিন্না’র জিহাদি ডাক- প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস (ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে) ঘােষণা এবং তার শিষ্য সােহরাওয়ার্দির বিভ্রান্তিকর ভূমিকার পরিণামে সংঘটিত কলকাতা মহাহত্যাকাণ্ডে (দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’) যার ফলে  রক্তস্রোতের টানে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘৃণা বিদ্বেষ উপচে পড়ে। প্রতিক্রিয়ায় নােয়াখালি, বিহার ইত্যাদি ঘটনা। সম্প্রীতির কফিনে আসল পেরেকটি পোতা হল। এর পর তাে একের পর এক ঘটনা দেশবিভাগ নিশ্চিত করে। তাতে লীগ-কংগ্রেস উভয়পক্ষেরই অবদান রয়েছে। ঐ নিশ্চিতিতে জিন্নার অহমবােধ ও প্রতিহিংসাম্পৃহা পরিতৃপ্ত হয়। কিন্তু প্রশ্ন থাকে জিন্না কি উপলব্ধি করেছিলেন তার সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পরিণাম? দেখতে পেয়েছিলেন উপমহাদেশের নিরীহ সাধারণ মানুষের ভবিষ্যত? তার মতাে প্রতিভাবান রাজনীতিকের বুঝতে না পারার কথা নয় যে ভারতীয় মুসলমান সবার স্বপ্নের ভুবন পাকিস্তানে ঠাই হবে না। কয়েক কোটি ভারতীয় মুসলমান জনতা যারা বিচ্ছিন্নভাবে হিন্দুপ্রধান বিভিন্ন প্রদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন তাদের আবাসস্থল সঙ্গতকারণে পাকিস্তানভুক্ত হবে না সেকথা তিনি জানতেন। তাহলে কেন তাদের স্বপ্ন দেখানাে, জেনে শুনে তাদের অসম্ভবের বিষপান করানাে। এ অনৈতিক কাজটাই জিন্না করেছেন তার অহমবােধের তাড়নায় । কয়েক কোটি মুসলমানকে তার কথিত ‘হিন্দুরতে রেখে গেলেন গভীর অনিরাপত্তায় । অবশ্য রাজনীতিতে প্রতারণু বোধহয় অনৈতিক নয়। তবে এ কালাে সম্ভাবনার কথা মাওলানা আজাদ বিভাগ-পূর্বসময়ে মুসলমান জনতার উদ্দেশ্যে একাধিক বার বলেছেন (রামগড় কংগ্রেস, ১৯৪০), বলেছেন দেশভাগের অব্যবহিত পরে দিল্লির জামে মসজিদে উপস্থিত মুসল্লিদের উদ্দেশে। আর এ জতুগৃহদাহে জ্বালানি কম যােগ করেন নি নেহরু, প্যাটেল, প্রসাদসহ কংগ্রেসী নেতৃবৃন্দ। গান্ধির কাছে সম্প্রীতির গুরুত্ব সবার উর্ধ্বেএমন ভাবনা সত্ত্বেও তিনি রাজনৈতিক স্বার্থবাদী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সফল প্রতিবাদে দাঁড়াতে পারেন নি।

আসলে গান্ধি ও জিন্না দুজনেই অর্ধসত্য পুঁজি নিয়ে রাজনীতিতে তৎপর হয়েছিলেন। একজন অখণ্ড ভারতের নামে, অন্যজন বিভক্ত ভারতের পাকিস্তানের টানে। এর পরিণাম বিশেষ শ্রেণী বাদে সাধারণ মানুষের জন্য ভালাে হয় নি । গান্ধি ভারতভাগের দায়ে ও সম্প্রীতি প্রচারের কারণে রক্ষণশীল স্বধর্মীর হাতে প্রাণ দিলেন। অথচ তার রাজনীতির অর্ধেক ছিল সনাতনধর্ম রক্ষার জন্য । যে সতীর্থদের রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষায় মহীরুহের ছায়া বিস্তার করেছিলেন। তাদের অবহেলায় তার প্রাণ গেল । আর জিন্না। যে ভূস্বামী-মুৎসুদ্দি ও এলিটদের নিয়ে তার স্বতন্ত্রভুবন প্রতিষ্ঠা- গান্ধির বিপরীত পন্থায় ক্ষমতার  শীর্ষস্থান দখলে রেখেও অবজ্ঞা-অবহেলায়, অর্ধচিকিৎসায় তার মৃত্যু। তার প্রধান সহকারী লিয়াকতের প্রাণ গেছে ‘অস্বাভাবিক রাষ্ট্র’ পাকিস্তানের অস্বাভাবিক ষড়যন্ত্রে । পাকিস্তানের রাজনীতি পূর্বাপর হত্যা, সামারিক শাসন ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পােষ্য হিসাবে বর্তমান বিপর্যয়ে ভাসমান। গণতন্ত্র শব্দটি সেখান থেকে নির্বাসিত। মরুভূমির তীব্রদাহের অবার প্রান্তরে ক্ষণিক মরুদ্যানের ছায়া হয়ে মাঝে মধ্যে আসে যায় কথিত গণতন্ত্রী নির্বাচিত সরকার। আর সে অপরাধে কখনাে প্রধান ব্যক্তিটিকে প্রাণ দিতে হয়, যেমন বেনজির ভুট্টো! কিন্তু পাকিস্তানে এজাতীয় হত্যাকাণ্ডের বিচার দূরে থাক, সুষ্ঠু তদন্তই হয় । লিয়াকত থেকে বেনজির এর উদাহরণ। এমন চরিত্র নিয়ে এগিয়ে চলেছে। পাক রাজনীতি, হয়তাে বা দেশভাগের মাশুল দিচ্ছে।

দেশবিভাগের মাধ্যমে ক্ষমতার হস্তান্তর এবং তাৎক্ষণিকভাবে কমনওয়েলথের গােয়ালে অবস্থান নিশ্চিত করে ব্রিটিশ রাজশক্তির স্বদেশে প্রত্যাবর্তন ভারত পাকিস্তানের জন্য স্বাধীনতার যথার্থ সুফল কটা নিশ্চিত করতে পেরেছে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে গেছে। স্বাধীনতার স্বাদ কর্তটা মিঠে কতটা তেতাে তা নিয়ে বিচার বিবেচনার অবকাশও রয়েছে বিদেশী শাসন থেকে মুক্তি সর্বসাধারণ বিশেষ করে তৃণমূলস্তুরের মানুষের আর্থ-সামাজিক বৈষম্য থেকে কতটা মুক্তি বয়ে এনেছে সেসব নিয়ে প্রশ্ন অনেক । পড়তে পারেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘স্বাধীনতার স্বাদ’ উপন্যাস। এছাড়াও রয়েছে সমালােচনার আরাে কিছু দিক। দেশবিভাগের রাজনৈতিক আদর্শ বিচারের পরিপ্রেক্ষিতে গণতান্ত্রিক মূল্যবােধ, মানবিক চেতনা ইত্যাদি বিষয় আমলে নিতে চাইলে দেশবিভাগজনিত অবাঞ্ছিত উপসর্গগুলাে মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ধর্মীয় চেতনাযুক্ত যে সম্প্রদায়বাদী রাজনীতি লীগ কংগ্রেস উভয় পক্ষ কম বেশী ধারণ করেছে ও পরিণামে দেশবিভাগ নিশ্চিত করেছে সেই অবাঞ্ছিত উত্তরাধিকার থেকে বিভক্ত ভূখণ্ড, এমন কি ত্রিধাবিভক্ত রাষ্ট্রও পুরােপুরি মুক্তি পায়নি। কম আর বেশি সে ঐতিহ্য বহন করে চলছে তারা। সংবিধান যেমনই হােক শাসনযন্ত্র, এমন কি অংশত জনমানস থেকেও সাম্প্রদায়িক চেতনা দূর হয়নি। থেকে থেকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা তার প্রমাণ। বাংলাদেশে এ সহিংসতা অপেক্ষাকৃত কম হলেও ধর্মীয় রাজনীতির মানসিকতা থেকে সে মুক্ত নয় । সমাজ এদিক থেকে শুদ্ধ নয়। সাম্প্রতিক কিছু  ঘটনা নতুন করে উদাহরণ তৈরি করেছে। মনে হচ্ছে চল্লিশের দশকের। রাজনীতির ভূত এখনাে পুরােপুরি আমাদের ছেড়ে যায় নি। সম্প্রদায়বাদী সামরিক শাসন, বেসামরিক স্বৈরশাসন, রাজনৈতিকসামাজিক নৈরাজ্য ইত্যাদি বিচারে পাকিস্তান সবার সেরা। জন্মলগ্ন থেকে মার্কিনি পরাশক্তির তাবেদার হয়ে এক পর্যায়ে মাদ্রাসা-ভিত্তিক তালেবান যােদ্ধা। তৈরি করে গােটা দেশে গুম, খুন, রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার অভয়াশ্রম তৈরি করেছে পাকিস্তানি শাসকশ্রেণী। গণতন্ত্রী-স্বৈরতন্ত্রী সবাই এ বিষয়ে এক কাতারে। দেখা দিয়েছে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের প্রাধান্য। সেনাবাহিনী তা দমন করতে অপারগ বা অনিচ্ছুক । জঙ্গিবাদের সঙ্গে সেনাদফতরের আঁতাত নিয়ে অভিযােগও কম নয়। প্রশ্ন উঠতে পারে, জিন্না কি এই পাকিস্তান। চেয়েছিলেন? অবশ্যই চাওয়ার কথা নয়।

কিন্তু যে বিপজ্জনক মতাদর্শ ও স্লোগানের সাহায্যে পাকিস্তান অর্জন তার ধারাবাহিকতা থেকে তিনি বা তার উত্তরসূরি কোনাে শাসক সরে আসেন নি বা আসতে পারেন নি। পরিণাম যথারীতি । এর প্রভাব পড়েছে সমাজে। | ভারতও এ সম্প্রদায়বাদী ধারা থেকে পুরোপুরি মুক্ত নয়। ক্ষমতার লােভ ও দুর্নীতি এই দুইয়ে মিলে সব নষ্ট করেছে। সেই সঙ্গে পূর্বোক্ত ধর্মীয় । সম্প্রদায়বাদী চেতনার প্রভাব, যে প্রভাব আধুনিক সমাজেও সঞ্চারিত । অযােধ্যাকাণ্ড, গুজরাতকাণ্ডের মতো ভয়াবহ ঘটনাবলী তার প্রমাণ। আর । অর্থনৈতিক উন্নতি ‘ভার্টিকাল’হওয়ার কারণে তা সর্বজনীন নয়, এবং প্রদীপের নিচে অন্ধকার। রাজনীতি-সমাজ কোনােটাই দূষণমুক্ত নয়। সম্প্রতি রাজধানী দিল্লিতে সংঘটিত প্রকাশ্য গণধর্ষণ এবং বিভিন্ন শহরে তার পরম্পরা সমাজের কোন্ পরিচয় প্রকাশ করে? অন্যদিকে অনাহারে মৃত্যু বা কৃষকের আত্মহত্যা? আর সর্ববিস্তারি দুর্নীতি? | এসব ছাড়িয়ে দেশবিভাগ সূত্রে পাক-ভারত বৈরিতা, আঞ্চলিক যুদ্ধ, জনমানসে পারস্পরিক বিরূপতা বিভাগপূর্ণ কালের সমাজ, সমপ্রদায় ও রাজনীতির দ্বন্দ্ব ও বিরূপতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় । জন্মলগ্ন থেকেই চিরশত্রু। দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তান, মধ্যিখানে কাঁটা কাশ্মীর। জুলফিকার আলী ভুট্টোর যে-উপলক্ষে হাজার বছর ধরে লড়াইয়ের বাসনা। দেশবিভাগের এজাতীয় পরিণাম ও উপসর্গের দিকে চোখ বন্ধ করে থাকা যায় না। তাই প্রশ্ন জাগে : সাতচল্লিশের ভারতবিভাগ কি সঠিক ছিল? জবাব দেবার দায় যাদের তারা সবাই প্রয়াত, এখন দায় রাজনীতিমনস্ক লেখক ও ইতিহাসবিদদের । যারা বিচার-ব্যাখ্যায় যে-যার মতাে সিদ্ধান্ত টানেন।  প্রশ্ন উঠতে পারে দেশবিভাগ আলােচনায় গান্ধি-জিন্না সমাচার কি প্রাসঙ্গিক? অবশ্যই । এ দুই ব্যক্তিত্ব-বিশ্লেষণ ও তাদের তৎপরতার প্রেক্ষাপট বিচার ছাড়া দেশভাগ আলােচনা সম্পূর্ণ হতে পারে না। এদের সঙ্গে যুক্ত হওয়া উচিত নেহরু, প্যাটেল ও মওলানা আজাদ। দেশভাগের কারিগরদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এই পঞ্চরাজনীতিক। এবং ওয়াভেল ও মাউন্টব্যাটেন। সেই সঙ্গে শ্বেতাঙ্গকৃষ্ণাঙ্গ ও বাদামি আমলাতন্ত্র। উত্তরপত্র হিসাবে ত্রিধাবিভক্ত উপমহাদেশের পরিস্থিতি বিচারে ক্যাস্ত্রো ও চে-গুয়েভারার রাজনৈতিক চিন্তা স্মরণে আনতে হয়। মুক্ত স্বদেশেও ঔপনিবেশিক কাঠামাে ও আমলাতন্ত্র বজায় রেখে জনকল্যাণ শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা যায় না। দরকার আদর্শবাদী দেশপ্রেমী শাসনযন্ত্র, আর সর্বজনের শিক্ষা, যে শিক্ষা সেকুলার চেতনা নিশ্চিত করতে পারে ।

সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক