ব্রিটিশ সিংহের ভারতত্যাগের ঘােষণা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিস্তার
মি. জিন্নার অন্তর্বর্তী সরকারে যােগদান যে উদ্দেশ্যমূলক পরবর্তী ঘটনাবলিতে তার আভাস মেলে। গান্ধির আশঙ্কা হয়তাে ভুল ছিল না। স্বল্পমেয়াদি অন্তর্বর্তী সরকার প্রস্তাব গ্রহণ করে দীর্ঘমেয়াদি অর্থাৎ মূল মিশন প্রস্তাব বানচাল করা যে এই তীক্ষধী আইনজীবী রাজনীতিকের উদ্দেশ্য ছিল কংগ্রেস অর্থাৎ নেহরুপ্যাটেল তা বুঝতে পারেননি। অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান হতে পেরেই আবেগপ্রবণ নেহরু ধরে নিয়েছিলেন জয় তাদের হাতের মুঠোয়। বিষয়টা আসলে ছিল এর ঠিক বিপরীত। জিন্না যে মূল প্রস্তাব সফল করার পরিবর্তে তা ভাঙনের পথে ঠেলে দিতে অন্তর্বর্তী সরকারে যােগ দিয়েছিলেন এবং এরপর একের পর এক আইনি জেরায় আবহ সমস্যাজটিল ও সংশযুজারিত করে তুলেছিলেন ঘটনার দীর্ঘকাল পর হডসন তার বইতে সে বিষয়টা নিয়ে ভালাে রকম কাটাছেড়া করেছেন। তাতে বােঝা যায়, আইনি সওয়াল-জবাবে দক্ষ জিন্না তার সেই বুদ্ধিমত্তা রাজনীতিতে কাজে লাগিয়ে গান্ধি-নেহরুকে পরাজিত করেন তার লক্ষ্য পাকিস্তান হাসিল করে। তবে তা যে পুরাে পাকিস্তান হয়ে ওঠেনি সে কৃতিত্ব অনেকটা মাউন্টব্যাটেনের। এক্ষত্রে অবশ্য পরাজয় ভাইসরয় ওয়াভেলেরও । তিনি যে ভাবনা নিয়ে ও অখণ্ড ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা নিয়ে সুস্থ পরিবেশে তা সফল করতে গিয়ে জিন্না তথা মুসলিম লীগকে সুযােগ-সুবিধা দিয়েছিলেন সেগুলােই জিন্না যথাসম্ভব তার লক্ষ্য অর্জনে ব্যবহার করেছেন নানা তাত্ত্বিক ও আইনি প্রশ্নের জটিলতা সৃষ্টি করে। ভাইসরয় ওয়াভেলের অন্তত একটি সদিচ্ছা ছিল বিশেষ একটি দল নিয়ে অবস্থার টানে হলেও সরকার গঠন না করে নিরপেক্ষতা রক্ষা করা। জিন্না সে সুযােগ কাজে লাগিয়েছেন। ভাইসরয় নানাভাবে চেষ্টা করেছেন জিন্নাকে অন্তর্বর্তী সরকারে টেনে আনতে, যেমন চেষ্টা করেছেন কংগ্রেসকেও আনতে সেই সঙ্গে তার চেষ্টা। জিন্না-নেহরুর মধ্যে ব্যবধান ও দূরত্ব কমিয়ে আনা যা কখনই সম্ভব ছিল না।
এ না থাকার কারণ ইতহাসের অনেক পেছনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত সেক্ষেত্রে গান্ধির চেয়েও নেহরুর প্রতি জিন্নার বিরূপতা ছিল অনেক বেশি। প্রসঙ্গত হডসন জিন্না-উত্থাপিত ৯ দফার বিষয়টি নিয়েও আলােচনা করেছেন এবং জিন্নার মূল উদ্দেশ্য আকর্ষণীয় রূপকের ভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন। করেছেন বেশ কয়েক পাতার দীর্ঘ কথকতায় । অন্তর্বর্তী সরকারে লীগ সদস্যদের পাঠিয়ে সে সুযােগে প্রশ্নের পর প্রশ্নে মন্ত্রীমিশনের মূল পরিকল্পনা অনিশ্চিত করে তােলেন জিন্না। আর সে উপলক্ষে হডসন লেখেন : মি, জিন্নার বরাবর ব্যবহৃত কৌশলের ছিল দ্বিমুখী রূপ । দেনদরবারে বা সংলাপে সর্বদাই কোনাে প্রকার সমঝােতা বা অঙ্গীকারে অস্বীকৃতি জানানােই ছিল জিন্নার কৌশলগত দিক যাতে করে তর্ক-বিতর্কের দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় ত্যক্তবিরক্ত বা হতাশাগ্রস্ত প্রতিপক্ষ সচেতন বা অসচেতনভাবে কিছু সুবিধা বা ছাড় দিতে বাধ্য হয় বা ভুল পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ফলে পুরাে রুটির অংশবিশেষ নিয়ে তাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। অন্যদিকে প্রতিপক্ষের জন্য দীর্ঘস্থায়ী সুবিধার পথ তৈরি হয়। স্বভাবতই হডসনের মন্তব্য: মুসলিম লীগের অন্তর্বর্তী সরকারে যােগদান যে স্বস্তি ও আশার সঞ্চার করেছিল অচিরে মিথ্যা প্রতিপন্ন হয় । ভাইসরয়ের চেষ্টা সত্ত্বেও জিন্না তার মৌখিক আশ্বাসের চেয়ে এক পা এগােননি, লীগ। কাউন্সিলের অধিবেশন ডেকে ১৬ মের প্রস্তাব গ্রহণের কোনাে চেষ্টা নেননি। কংগেস নেতাদের আহ্বান স৪ে জিন্নার মন্তব্য : ‘সাংবিধানিক পরিষদের অধিবেশন ডাকা হলে তা বিপর্যয়ের সৃষ্টি করবে। এর তাৎপর্য অর্থাৎ জিন্নার উদ্দেশ্য অচলাবস্থা সৃষ্টি করে রাখা, কোনাে প্রকার সংবিধান প্রণীত হতে না দেয়া। সেক্ষেত্রে ভাইসরয় জোর করে কিছু চাপিয়ে দিলে অনর্থ সৃষ্টি হতে পারে, যেমন ব্যাপক সাম্প্রদায়িক সহিংসতা অর্থাৎ দেশ সামপ্রদায়িক গৃহযুদ্ধের মুখােমুখি হবে। এমন আশঙ্কাই ভাইসরয় জানান বিদেশসচিবকে। কিন্তু ব্রিটিশরাজ দীর্ঘ অনিশ্চয়তা নিয়ে ভারতে বসে থাকতে পারে না। তাদের ভালাে পরিস্থিতিতে পাততাড়ি গুটাতে হবে । ভাইসরয় তাই জিন্নাকে সাংবিধানিক ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানান যাতে লীগকংগ্রেস সমঝােতা ও মতৈক্যের ভিত্তিতে এগিয়ে আসে। এ প্রস্তাবে জিন্নার সংক্ষিপ্ত জবাব : দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে মতৈক্য অসম্ভব। ব্রিটিশ যদি ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যেতেই চায়, তাহলে তারা এক্ষুণি চলে যাক । যাওয়ার আগে তারা মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র ভূখণ্ড দিয়ে যাক সেখানে তারা দরকার হলে দিনে একবেলা খেয়েও নিজের মতাে করে বসবাস করতে পারবে’ (হডসন, পৃষ্ঠা ১৭৫)। এ জবাব শুনে। একদা সেনাপতি ওয়াভেল কী ভেবেছিলেন তা আমাদের জানা নেই।
আসলে জিন্নার আস্তিনে লক্ষ্য হিসেবে বরাবর পাকিস্তানই ছিল অন্য কিছু নয়, যে জন্য অবিভক্ত ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে কোনাে প্রকার প্রস্তাবই তার কাছে গ্রহণযােগ্য বিবেচিত হয়নি। ভারতবিভাগ তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল । যে জন্য পূর্বোক্ত বক্তব্যে তার কথা, যত ছােটই হােক একমাত্র পাকিস্তানই তাদের অন্বিষ্ট । অবশ্য শেষ মুহূর্তে আক্ষেপ করেছেন এই বলে যে, ‘পােকায় খাওয়া (মথ ইটন) পাকিস্তান নিয়ে তাকে সন্তুষ্ট থাকতে হলাে’। অবশ্য তাও গােটা দেশকে রক্তস্রোতে ভাসিয়ে। জিন্নার এই ভিন্ন চেহারা দেখে ক্ষুব্ধ ভাইসরয় ওয়াভেল ২৫ নভেম্বর (১৯৪৬) সব দলের উদ্দেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে এক বিবৃতিতে ৯ ডিসেম্বর সাংবিধানিক পরিষদের (কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির) সভা আহবান করেন। জিন্না এ পদক্ষেপকে মারাত্মক ভুল ও বিপজ্জনক’ আখ্যায়িত করে অভিযােগ তােলেন যে পরিস্থিতির বাস্তবতা বিচার না করে কংগ্রেসকে সন্তুষ্ট করার জন্য ভাইসরয় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি মুসলিম লীগ সদস্যদের ওই সভায় যােগ দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, মুসলিম লীগ কেবিনেট মিশন পরিকল্পনা বাতিল করে দিয়েছে (হডসন)। এবার থলে থেকে বিড়াল বেরিয়ে এলাে। জিন্নার উদ্দেশ্য এখন পরিষ্কার। পাকিস্তান ছাড়া অন্য কোনাে প্রস্তাব তার কাছে গ্রহণযােগ্য নয়, এর অর্থ ভারতবিভঞ্চ। কোনাে উপায় না দেখে ভাইসরয় বিদেশসচিবের শরণাপন্ন। পেথিক রেন্সের বক্তব্য : দুই প্রধান দলের মতৈক্য ছাড়া স্থায়ী সংবিধান প্রণয়ন সম্ভব নয়। কাজেই লীগ-কংগ্রেসকে ঐকমত্যে আনার চেষ্টা করা হােক। ডাকা হােক তাদের প্রতিনিধিদের লন্ডনে। কিন্তু মতৈক্য যে কখনই সম্ভব নয় এ সত্য ভাইসরয় ওয়াভেল ততদিনে বুঝে গেছেন। কী করা যাবে, কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। সেখানেও সমস্যা।
লন্ডন যেতে কেউ রাজি, কেউ গররাজি। ইতিমধ্যে লীগ, কংগ্রেস যে যার মতাে অবস্থান নিয়েছে । মতৈক্য দূরে থাক পরস্পরবিরােধিতা একমাত্র সত্য হয়ে দাড়িয়েছে এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলির আহ্বানও কাজে আসেনি। হডসনের মতে ব্রিটিশ সরকার ইতিমধ্যে লীগের প্রতি কিছুটা ঝুঁকে পড়েছে। হয়তাে সংখ্যালঘুর কথা বিবেচনা করে। শেষ পর্যন্ত প্রতিনিধি দল লন্ডনে গিয়েও (২ ডিসেম্বর, ১৯৪৬) সমঝােতায় পৌছতে পারেনি, যেমনটা ভাবা গিয়েছিল। বৃথা সময় নষ্ট । ডিসেম্বরে (৯ তারিখ নির্ধারিত সংবিধান সভায় কার্যকর কোনাে সিদ্ধান্ত নেয়া যায়নি লীগ ওই সভা বয়কট করার কারণে। সভায় শুধু নীতিগতভাবে ভারতের স্বাধীনতার ঘােষণা দেয়া হয়, এই যা আর অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করে দিয়ে লীগ-কংগ্রেসের দ্বন্দ্ব এ পর্যায়ে পৌছায় যে কংগ্রেস লীগ সদস্যদের পদত্যাগের দাবি জানায়। এমনকি প্যাটেলের প্রকাশ্য ঘােষণা যে লীগ সদস্যদের সরকারে রাখা হলে কংগ্রেস সদস্যরা পদত্যাগ করবেন। সমস্যা এতটাই জটিল হয়ে ওঠে যে তা একজন অরাজনৈতিক ভাইসরয়ের পক্ষে সামলানাে সম্ভব ছিল না। কাজেই ব্রিটিশ মন্ত্রিসভাকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, অর্থাৎ ভাইসরয় পরিবর্তন। ইতিমধ্যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলির ঐতিহাসিক ঘােষণা এবং তা রাজনৈতিক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ দিনটি ১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। সে ঘােষণা ব্রিটিশ সিংহের ভারতত্যাগ ও ভারতীয়দের হাতে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের, বলতে গেলে ভারত ছাড়’ আন্দোলনের প্রায় পাঁচ বছরের মধ্যেই। অবশ্য অ্যাটলির ঘােষণায় সুস্পষ্টভাবে বলা হয় যে, ক্ষমতা হস্তান্তর ১৯৪৮ সালের জুনের মধ্যেই সম্পন্ন করতে হবে। কিন্তু কাদের হাতে হস্তান্তর সে বিষয়ে অস্পষ্টতা অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। কারণ সর্বসম্মতিক্রমে সংবিধান রচনা ও দিকনির্দেশনা অসম্ভবই ছিল। তবে সে অসম্ভবকে তার মতাে করে, বলা যায় ব্রিটিশ শাসকদের মতাে করে সম্ভব করে তােলে মাউন্টব্যাটেনের চাতুর্য। সেখানে হাঁর দেশি রাজনীতিকদের। তাদের কারােরই চাওয়া শতভাগ পূরণ হয়নি। ওই ঘােষণায় আরাে বলা হয়, এ কাজ সম্পন্ন করতে লর্ড ওয়াভেলের স্থলে নতুন ভাইসরয় হবেন অ্যাডমিরাল ভাইকাউন্ট লর্ড মাউন্টব্যাটেন বেচারি লর্ড ওয়াভেল, দিল্লির গরমে মাথার ঘাম পায়ে ঝরিয়েও দুই মাথা একত্র করতে পারেননি।
কিন্তু স্বেচ্ছায় ব্রিটেনের ভারতীয় স্বার্থ পরিত্যাগ? বিষয়টা বহু আলােচিত। মােদ্দা কারণ ব্যাপক জনবিক্ষোভ, আন্দোলন, বিদ্রোহ এমনকি সেনাবাহিনীতে এর বিস্তার। সমুদ্রপার থেকে নতুন করে শ্বেতাঙ্গ সেনাসদস্য যােগ করার অর্থনৈতিক সামর্থ্য যুদ্ধাহত বৃদ্ধ ব্রিটিশ সিংহের ছিল না। তদুপরি বিষফোঁড়া সাম্প্রদায়িক সংঘাত, বামরাজনীতির শক্তিবৃদ্ধি, শ্রমিক-কৃষকের প্রতিবাদী আন্দোলন আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি সঙ্কটাপন্ন করে তুলেছিল। ব্রিটিশ শাসনের সাম্রাজ্যবাদী সুদিন তখন শেষ। নতুন রাজনৈতিক সূর্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দুর্বল, জীর্ণ ব্রিটেন অনেক ঋণে বাঁধা পড়ে আছে। কাজেই ভারত ছেড়ে এসে কমনওয়েলথের অধীনে তাদের সঙ্গে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সুসম্পর্ক গড়ে তােলা বরং লাভজনক। ভাঙনের মধ্যে যা কিছু প্রাপ্তি। এ সহজ সত্য বুঝতে চায়নি ব্রিটেনের অভিজাতকুল, তাদের উচ্চবর্গীয় রাজনৈতিক প্রতিনিধি লর্ড সভা । ডাইকাউন্ট টেম্পলউড লর্ড সভায় ক্ষমতা হস্তান্তরের শ্রমিক দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রস্তাব তােলেন। তার সমর্থনে কয়েকজন অভিজাত সদস্য এগিয়ে আসেন। তবে আরেক সদস্য লর্ড হ্যালিফ্যাক্স সরকারি সিদ্ধান্তের পক্ষে দাঁড়ান। সেই সঙ্গে ভারতসচিব লর্ড পেথিক লরেন্স, স্যার স্টাফোর্ড ক্রিপস প্রমুখের বাকচাতুর্যে শ্রমিক দলীয় সিদ্ধান্ত রক্ষা পায়। অবশ্য কমন্স সভায় রক্ষণশীল দলীয় সদস্য চার্চিল, বাটলার, জন। অ্যান্ডারসন প্রমুখ চরমপন্থীর বিরােধিতা খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর এ ঘােষণা বলা বাহুল্য ভারতসহ বিশ্বের অন্যত্র অভিনন্দিত হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট তাে সেই ১৯৪২ সাল থেকে চার্চিলের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন যাতে ভারতের স্বাধীনতার ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী চার্চিল নানা ছলাকলায় বিষয়টাকে যথাসম্ভব ধামাচাপা দিয়ে রাখেন। নেহরু ব্রিটিশরাজের এ সিদ্ধান্তের প্রতি অভিনন্দন জানান। একই প্রতিক্রিয়া ভারতের সব গণতন্ত্রী ও প্রগতিবাদী। মহলের। তবে জিন্না এ সম্বন্ধে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এবং তিনি জোর দিয়ে বলেন, মুসলিম লীগ তার পাকিস্তান দাবি থেকে এক ইঞ্চিও সরে আসবে ’ (ভিপি মেনন, পৃষ্ঠা ৩৪০)। পাকিস্তান সম্বন্ধে এতটাই অবসেশন’ জিন্নার । ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘােষণা যেন ভারতীয় রাজনীতির মৌচাকে ঢিল। সম্ভাব্য ফুলফোটা মধুর লােভে শুরু হয় নতুন করে তৎপরতা। যে যার মতাে করে তার তরবারিতে শান দিতে থাকে। প্রদেশগুলাে নতুন করে হিসাব কষতে থাকে, বিশেষ করে মুসলমানপ্রধান প্রদেশ বাংলা ও পাঞ্জাব। সেই সঙ্গে হিন্দুপ্রধান (যদিও সামান্য সংখ্যাগরিষ্ঠ) আসাম যে প্রদেশটিকে মন্ত্রীমিশন প্রস্তাবে বাংলার সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয় যুক্তিহীনভাবে। মন্ত্রীমিশনের এবিসি গ্রুপিংয়ের পর থেকেই শুরু হয় বাঙালি মুসলমানের আসামের দিকে অভিবাসন যাত্রা। উদ্দেশ্য মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন। এ ছাড়াও আসামের কোনাে কোনাে অঞ্চলে ছিল বাঙালি-প্রাধান্য। সম্ভবত এমনি একাধিক ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ছেচল্লিশ থেকেই খাস অসমিদের মনে বাঙালিবিরােধী প্রতিক্রিয়া শুরু হয় বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন ও সহিংসতা। বঙ্গে লীগ মন্ত্রিসভা বহাল থাকলেও সাম্প্রদায়িক অস্থিরতার অবসান ঘটেনি। কলকাতা দাঙ্গার ক্ষত তখনাে উভয় মহলে ঘৃণা, বিদ্বেষ, অবিশ্বাস, অনাস্থার প্রকাশ ঘটিয়ে চলেছে। হিন্দুমহাসভা সক্রিয় হয়ে ওঠে হিন্দুপ্রধান পশ্চিমবঙ্গকে হিন্দুবঙ্গ হিসেবে ঘােষণার সম্ভাব্যতা নিয়ে। অন্যদিকে মুসলিম লীগের চেষ্টা বঙ্গের অখণ্ডতা রক্ষার, যা জিন্না ঘােষিত দ্বিজাতিতত্ত্ব ও বিভাজন নীতির সঙ্গে একেবারে খাপ খায় না। কিন্তু জাতিসত্তার বিবেচনায় ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গবিরােধী আন্দোলনের ধারায় বঙ্গীয় কংগ্রেসের বাম-ঘরানা এবং বঙ্গীয় লীগের অনুরূপ পশ্চিমবঙ্গবাসী নেতাদের একাংশ বঙ্গের অখণ্ডতা রক্ষার চেষ্টা চালায়। এদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য আবুল হাশিম, শহীদ সােহরাওয়ার্দী, শরৎ বসু, কিরণশঙ্কার রায় প্রমুখ কিন্তু পাঞ্জাবের অবস্থা হয়ে ওঠে। বিস্ফোরণমুখী।
সিকান্দার হায়াত খানের মতাে অখণ্ড পাঞ্জাবপ্রেমী ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বের। অনুপস্থিতিতে মুসলিম লীগের জঙ্গি সাম্প্রদায়িক প্রচারের দাপটে সেকুলার রাজনীতিক খিজির হায়াত খানের পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। যদিও কংগ্রেস সমর্থনে তিনি তখন পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী। জিন্নার লক্ষ্য পাঞ্জাবে মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা গঠন বঙ্গের অনুকরণে। তাই শুরু হয় লীগ ক্যাডারদের পক্ষে ধ্বংসাত্মক ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সাম্প্রদায়িকতার তীব্র প্রকাশ। ঘটিয়ে। অবস্থা এমনি সঙ্কটাপন্ন হয়ে ওঠে যে মুখ্যমন্ত্রী খিজির হায়াত খানকে পদত্যাগ করতে হয়। এবার লীগের সামনে আপেল। কিন্তু হিন্দু ও শিখ সদস্যদের বিরােধিতায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি লীগ। পাঞ্জাবে গভর্নরের শাসন। (৯৩ ধারায়) জারি। এদিকে মুসলিম লীগ ছাড়বার পাত্র নয় শুরু হয়ে যায় জোরেশােরে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা । রাজপথে সহিংসতা, মৃত্যু, রক্ত, নারী নির্যাতনে প্রয়াত সিকান্দার হায়াতের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়ে ওঠে। মুসলিম লীগের এ চরিত্র নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন সিকান্দার । কথাটা স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন পেন্ডেরেল মুনকে। তবে গভর্নর স্যার জেনকিন্সের চেষ্টায় অবস্থা অনেকটা আয়ত্তে আসে। ব্যক্তিভেদে অনেক কিছু ঘটে বাঞ্ছিত-অবাঞ্ছিত, ভালাে-মন্দ। বঙ্গে ১৯৪৬ আগস্টে দরকার ছিল জেনকিন্সের মতাে গভর্নর। ভারতজুড়ে তখন সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস- ক্ষমতার প্রচণ্ড লােভ সর্বপ্রকার মানবিক বােধ কেড়ে নেয়। ভাইসরয় ওয়াভেলের ব্যক্তিগত সদিচ্ছা সেখানে। দাগ কাটে না। সম্প্রদায় চেতনা এমন অন্ধতার সৃষ্টি করে যে কোনাে সৎ পদক্ষেপকেও সঠিক মনে হয় না যদি তা ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থের সঙ্গে না। মেলে । ভাইসরয়ের পরামর্শ সেখানে থই পায় না ।
অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থবিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত লিয়াকত আলী খান যখন তার বাজেটে ব্যবসা-লভ্যাংশের ওপর ২৫ শতাংশ কর আরােপের প্রস্তাব করেন তখন বৃহৎ পুঁজি সমর্থিত কংগ্রেস এ পদক্ষেপকে আখ্যায়িত করে হিন্দু ব্যবসায়ীদের শাস্তিদানের চেষ্টা হিসেবে (মেনন)। অবশেষে প্রবল এক নৈরাজ্যিক পরিস্থিতিতে ব্যর্থতার বােঝা কাঁধে নিয়ে লর্ড ওয়াভেল যখন ভারত ছেড়ে যান তখন একরাশ হতাশা ও বিষন্নতা তার সঙ্গী। কিন্তু এর সব দায় তার ছিল না। এ সম্বন্ধে মাওলানা আজাদের মূল্যায়ন যথেষ্ট বাস্তবধর্মী। প্রসঙ্গত সেকুলার জাতীয়তাবাদী ও স্বদেশপ্রেমী মাওলানা আজাদ সম্পর্কে দুএক কথা বলতে হয় । কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট মাওলানা আজাদ বা রাজনৈতিক নেতা আজাদ কিংবা নিছক ব্যক্তি মাওলানা আজাদের মধ্যে ফারাক দেখা যায় । রাজনীতিবিদ হয়েও তার মধ্যে রাজনীতিতে প্রচলিত চতুরতা, বিশ্বাসের সঙ্গে প্রতারণা বা সুবিধাবাদ অনুপস্থিত। তাই প্রচলিত রাজনীতিতে তিনি ‘মিসফিট’। নিজ সম্প্রদায়ের ভালাে-মন্দ সম্বন্ধে সচেতন থেকেও অন্ধ যুক্তিহীন সমর্থনের পক্ষে হাল ধরেননি। চলেছেন নিজের বিচার, বুদ্ধি, যুক্তি ও বিবেকের নির্দেশমাফিক। তবে দলীয় রাজনীতি করেছেন বলে দলীয় নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলতে হয়েছে, সেখানকার ধরাবাঁধা নিয়মনীতির বাইরে যেতে পারেননি। এতে খানিকটা আপসবাদিতার প্রতিফলন ঘটেছে। হয়তাে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নিবেদিতপ্রাণ মানুষ বলেই কংগ্রেসে নিহিত স্ববিরােধিতা সত্ত্বেও সংগঠন ছেড়ে চলে যেতে পারেননি। সহ্য করতে হয়েছে নানা স্ববিরােধী আচরণ। তবে সত্য কথা বলার সৎসাহস তার ছিল। অপ্রিয় জেনেও তা বলেছেন। সহকর্মী নেহরুর রাজনৈতিক প্রকৃতি ও পদক্ষেপের ভুলভ্রান্তি ও সেসবের বিপদ সম্বন্ধে মাওলানা আজাদকেই বলতে শােনা গেছে। আবার কোনাে ইংরেজ প্রশাসকের সদগুণ কে সঠিক পদক্ষেপ নির্ভীক সততায় প্রকাশ করেছেন। যেমন ভাইসরয় ওয়াভেল সম্বন্ধে তার কিছু মন্তব্য, ভাইসরয় হিসেবে ওয়াভেলের কিছু প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কারণ ওয়াভেল ভারতের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সঠিকভাবে অনুধাবন করে লীগ-কংগ্রেসকে ওই সংঘাতের বৃত্ত থেকে সরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। ভারতবিভাগ এড়ানাে সম্পর্কে তিনি ওয়াভেলের নীতিকে সঠিক বলে মনে করতেন, অংশত মন্ত্ৰীমিশনের প্রস্তাবও। তার ভাষায় একদিন হয়তাে ইতিহাস এটা স্বীকার করে নেবে যে লর্ড ওয়াভেলের নীতিকে মেনে নিয়ে তার পরামর্শ মতাে চললেই ভালাে হতাে। তিনি যেভাবে পরিস্থিতি অনুধাবন করেছিলেন তা মমাটেই ভ্রান্ত ছিল না’ (ভারত স্বাধীন হলাে, পৃ. ২৫৬)। তাছাড়া তিনি ওয়াভেল পরিকল্পনাও ভারতের জন্য সঠিক বিবেচনা করেছিলেন। ওয়াভেল সম্বন্ধে আজাদ আরাে বলেছেন, তাকে আমি দেখতে পাই একজন বাস্তববাদী সৈনিক হিসেবে। রাজনীতিবিদদের মতাে তার মনে কোনাে ঘােরপ্যাচ ছিল না। আর সে কারণেই রাজনীতিকদের ঘােরপ্যাচের সঙ্গে ভাইসরয় ওয়াভেল পেরে ওঠেননি।
তাছাড়াও নীতিগত মতভেদ ছিল বিদেশ। সচিব পেথিক লরেন্স বা কখনাে স্টাফোর্ড ক্রিপসের সঙ্গে। স্বভাবতই এ মতভেদ প্রভাবিত করেছে ব্রিটিশ মন্ত্রিসভা, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলিকে। এটা ঠিক যে, তার উত্তরসূরির মতাে তিনি লীগ বা কংগ্রেসের ওপর জোর করে। বা কৌশলে কিছু চাপিয়ে দিতে চাননি। সেজন্যই সমস্যা সমাধানে তিনি ব্যর্থ। ভারতীয় রাজনীতিতে ‘মিসফিট’ । ওয়াভেল সম্বন্ধে এমনই বােধহয় ভাবতেন আজাদ কিন্তু তার উত্তরসূরি মাউন্টব্যাটেন প্রত্যক্ষ রাজনীতির মানুষ না হয়েও ছিলেন তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন ব্যক্তি। তাই রাজনীতিকদের ঘােরপ্যাচ তিনি সঠিকভাবে মােকাবেলা করতে পেরেছেন। এমনকি তার বুদ্ধি ও চাতুর্যের। কাছে ভারতীয় রাজনীতিকগণ হার মেনেছেন। দীর্ঘ সময়ের চেষ্টায় ভাইসরয় ওয়াভেল যা পারেননি অতি অল্প সময়ে ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন তা করতে পেরেছেন। ভাঙনের পথ ধরে তিনি ভারতীয় রাজনীতির সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান করেছেন। ভারত ভাগ করে চিরবৈরী দুই ডােমিনিয়ন-রাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে। গেছেন কৃতী ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন সুস্তির সুবাতাস বইয়ে দিয়েছেন। অ্যাটলি মন্ত্রিসভার জন্য। তা কিন্তু সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান কি করতে পেরেছেন মাউন্টব্যাটেন ভারত ভাগ করে? ব্রিটিশ শাসকদের ভারতত্যাগের ঘােষণা প্রচারিত হওয়ার পর। থেকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, মৃত্যু ও নিষ্ঠুরতা যেন ভারতীয় জীবনের ভবিতব্য হয়ে দাঁড়ায় এবং তা হিন্দু-মুসলমান-শিখ নির্বিশেষে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, হত্যা, ধ্বংসাত্মক ঘটনা, নারী নির্যাতন কোনােটাই আকাক্ষিত স্বাধীন ভুবন। পাওয়ার পরও কী ভারতে কী পাকিস্তানে বন্ধ হয়নি। সে ট্র্যাডিশন এখনাে চলছে। তাহলে বলতে হয় : ভারত বিভক্ত হয়েও সামপ্রদায়িক সমস্যার সমাধানে ব্যর্থ হয়েছে। স্বভাবতই প্রশ্ন : ভারতভাগ কি রাজনৈতিক-সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে সফল বা সার্থক? এ প্রশ্নের জবাব সবারই জানা। আর। সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে যে স্বাধীনতা এসেছে সেটাও তাে বিভক্ত স্বাধীনতা, শ্ৰেণীবিশেষের স্বাধীনতা।
সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক