কেবিনেট মিশন সমঝােতার নয়া প্রচেষ্টা
আজাদ হিন্দ ফৌজের সদস্যদের বিচার নিয়ে দেশজুড়ে তুমুল বিক্ষোভ, সারা ভারতে শ্রমিক ধর্মঘট, বিশেষ করে নৌসেনাদের বিদ্রোহ ব্রিটিশ শাসকদের বুঝিয়ে দেয় যে, তাদের রাজত্ব শেষ তাই সুসম্পর্ক রেখে বিদায় নেয়া ব্রিটিশ শাসকদের কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয়। কমনওয়েলথের গােয়ালে বেঁধে রেখে যতটা স্বার্থ আদায় করতে পারা যায় তা-ই ভালাে- এমনই ছিল ব্রিটিশনীতি। কিন্তু বড় সমস্যা হয়ে দাড়ায় সম্প্রদায়গত বিভেদ, লীগ-কংগ্রেস দ্বন্দ্ব। আরাে স্পষ্ট করে বলতে হয় গান্ধি-জিন্না দ্বন্দ্ব। আরাে ছােট বৃত্তে নেহরু-জিন্না দ্বন্দ্ব। এ দুই ভিন্ন মেরুকে নিরক্ষরেখায় টেনে আনা অসম্ভবই ছিল। তাই ব্যর্থ হয়েছে ক্রিপস মিশন, ব্যর্থ ওয়াভেল পরিকল্পনা কংগ্রেস পক্ষে অখণ্ড ভারত এবং মুসলিম লীগ পক্ষে খণ্ডিত ভারতে পাকিস্তান দাবি সমঝােতার বিরুদ্ধে পাথুরে। দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়। জনমত বিচার করে দেখার প্রয়ােজনবােধ করেন না কেউ। অবশ্য এ কথাও ঠিক যে, প্রচারের মহিমায় জনতার বড়সড় অংশই তখন বিভ্রান্ত। কাজেই গণভোেট ওই উন্মাদনার মুখে অর্থহীন হয়ে দাঁড়াত। জনমতের রথের রশি তখন দুদলীয় নেতৃত্বের হাতে। তবে ১৯৪৫ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারি সময়পর্বে গৃহীত গণভােট হয়তাে ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে সহাবস্থানের পক্ষে দাঁড়াতে পারত। কিন্তু তেমন সুযােগ ছিল না। তবে এ কথা ঠিক যে ভারত তখনাে অগ্নিগর্ভ। আর সেটা ব্রিটিশ তাে বটেই ভারত সফরে আসা ইউরােপীয় কোনাে কোনাে সাংসদেরও মন্তব্য (ঘােষ, প্রাগুপ্ত)। তাই ভারতে বিরাজমান বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতির কথা চিন্তা করেই বােধহয় বিলেতে শ্রমিকদলীয় মন্ত্রিসভা ১৯ ফেব্রুয়ারি (১৯৪৬) ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলােচনার জন্য তিন সদস্যের একটি দল সেখানে পাঠানাের সিদ্ধান্ত নেয়- যা রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘কেবিনেট মিশন (মন্ত্রী মিশন) নামে পরিচিত। দলনেতা ভারতসচিব লর্ড পেথিক লরেন্স, অন্য দুজন স্যার স্টাফোর্ড ক্রিপস ও এভি আলেকজান্ডার । এরা রাজধানী দিল্লিতে আসেন ২৪ মার্চ (১৯৪৬) এবং প্রথমে ভাইসরয় ওয়াভেলের সঙ্গে আলােচনায় বসেন পরিস্থিতির খুঁটিনাটি জেনে নিতে। শুরুতে ব্রিটিশ তরফে নিরপেক্ষ মনােভাবের প্রকাশ ঘটেছে যখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি ১৫ মার্চ কমন্সসভায় এক বক্তৃতায় ভারতকে যত দ্রুত সম্ভব স্বাধীনতা দেয়ার অঙ্গীকার করেন। নীতি হিসেবে তিনি ঘােষণা করেন এই বলে যে, সংখ্যালঘুর অধিকার সম্বন্ধে আমরা সচেতন এবং ভয়ভীতি থেকে মুক্ত পরিবেশে বেঁচে থাকার অধিকার তাদের রয়েছে।
অন্যদিকে সংখ্যাগুরুর অগ্রগতিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি বা ‘ভেটো দেয়াও আমরা মেনে নিতে পারি না (হডসন)। কিন্তু সঙ্গত যুক্তির পথ ধরে হাঁটতে ভারতীয় রাজনীতিকদের বড় একটা আগ্রহ ছিল না। সেখানেই যত সমস্যা, প্রত্যেকে নিজ নিজ পাতে ঝােল টেনে নিতে উদগ্রীব। দিল্লিতে পৌছে কেবিনেট মিশনের প্রথম কাজই ছিল ভাইসরয় ওয়াভেলের সঙ্গে শলা-পরামর্শ শেষ করে ভারতের বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলােচনা শুরু করা এবং ভারতের ভবিষ্যৎ স্বাধীনতা সম্বন্ধে তাদের মতামত জানা। বিশেষ করে অখণ্ড ভারত ও পাকিস্তান বিষয়ক কংগ্রেস ও লীগের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের বিষয়টি বুঝে নেয়া। কারণ অবিভক্ত ভারতের পক্ষে জাতীয়তাবাদী মুসলমান ও শিখসহ আরাে কেউ কেউ তখন দাবি তুলেছিলেন। কেবিনেট মিশনের সঙ্গে প্রাথমিক বৈঠকে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ তাদের পূর্বঘােষিত নীতিরই প্রকাশ ঘটায়। যেমন কংগ্রেস-সভাপতি মাওলানা আবুল কালাম আজাদের মূল কথা (৩ এপ্রিল, ১৯৪৬), ভারতের স্বাধীনতা প্রসঙ্গটি মাথায় রেখে সেই ভিত্তিতে গঠিত গণপরিষদ ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধান রচনা করবে। মধ্যবর্তী সময়ে কার্য পরিচালনা করবে অন্তর্বর্তী সরকার, তারা গণপরিষদ গঠনের দায়িত্বও পালন করবে। সংবিধান ফেডারেল কাঠামাের হবে। কেন্দ্রের হাতে থাকবে শুধু প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যােগাযােগ বিষয়ক দায়িত্ব। বাকি ক্ষমতা স্বায়ত্তশাসিত (অটোনােমাস) প্রদেশগুলাের ওপর বর্তাবে। সংবিধান রচনার পর কোনাে প্রদেশ ইচ্ছা করলে ওই সাংবিধানিক আওতার বাইরে থাকতে পারবে। কিন্তু কংগ্রেস কোনােক্রমেই ভারতবিভাগ মেনে নেবে না। মুসলিম লীগ-কথিত পাকিস্তান দাবি তাদের কাছে গ্রহণযােগ্য নয়। আর সাংবিধানিক প্রস্তাব এমন হওয়া দরকার যাতে দেশীয় রাজ্যগুলাে তাতে আকর্ষিত হয়। প্রসঙ্গত গান্ধির মতামত জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে যেন আলােচনা সম্পন্ন হয়। তবে তিনি পাকিস্তান প্রস্তাব সঠিক বলে মনে করেন ।
এ বিষয়ে রাজাগােপালাচারি ফর্মুলা (সিআর ফর্মুলা) আলােচনার পক্ষে সহায়ক হতে পারে। আর দ্বিজাতিতত্ত্ব তার মতে একটি বিপজ্জনক বিষয়। তিনি এর বাস্তবতা স্বীকার করেন না এবং দুই গণপরিষদও সঠিক বলে মেনে নিতে পারেন না। তবে তার মতে, প্রথম সরকার গঠন করতে জিন্নাকেই ডাকা উচিত। তিনি গররাজি হলে কংগ্রেস সে দায়িত্ব পালন করবে (ভিপি মেনন)। এরপর ৪ এপ্রিল মুসলিম লীগ সভাপতি জিন্নার সঙ্গে আলােচনা শুরু। জিন্না তার বহুকথিত যুক্তিগুলাে তুলে ধরেন এই বলে যে, ভারতের অখণ্ডতা রূপকথার বেশি কিছু নয়। ভারত কখনাে এক রাজ্য ছিল না। ব্রিটিশ শাসনে ভূখণ্ড ঐক্য সম্ভব হয়েছে। তাছাড়া হিন্দু ও মুসলমান নানাদিক বিচারে দুই জাতি, তাদের পক্ষে ভারতে সহাবস্থান সম্ভব নয়। তাই তাদের জন্য দরকার ভারত ভাগ করে একটি স্বাধীন, স্বতন্ত্র মুসলমান রাষ্ট্র পাকিস্তান। ইতিহাসের দোহাই দিয়ে জিন্না এসব অনৈতিহাসিক কথা বলেন। তার মতে ভারত ইউরােপ নয়, আয়ারল্যান্ডও নয় । হিন্দু ও মুসলমানের মানসিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি, ধর্মীয় বিশ্বাস, আচার-আচরণ, সংস্কৃতি সবকিছুই পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। শিখদের পক্ষে মাস্টার তারা সিং বলেন, তিনি অখণ্ড ভারতের পক্ষে। সব সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি নিয়ে কোয়ালিশন সরকার গঠন করা উচিত । কিন্তু হিন্দুমুসলমান অনৈক্যের কারণে যদি ভারত বিভক্ত হয় তাহলে শিখরা আলাদা স্বাধীন শিখরাষ্ট্র চাইবে, অবশ্য হিন্দুস্তান বাপ্রাকিস্তানের সঙ্গে ইচ্ছামাফিক যুক্ত হওয়ার অধিকারসহ । জ্ঞানী কর্তার সূি ও হরনাম সিং উভয়ই ভারত বিভাগের বিরুদ্ধে মতপ্রকাশ করেন। তাদের কথা বিভক্ত ভারতে স্বাধীন শিখরাষ্ট্র চাই । আর ড. আম্বেদকরের দাবি সংবিধানে তফসিলি হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য মানবিক অধিকার ও সুযােগ-সুবিধা থাকতে হবে। মধ্যপন্থী বা উদারপন্থী নেতা স্যার তেজবাহাদুর সাপ্রু ভারত বিভাগের বিরােধিতা করে বলেন, অবিলম্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা এবং মুসলমানদের জন্য যথেষ্ট ক্ষমতার ব্যবস্থা সংবিধানে রাখা দরকার। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলােকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। তিনি মুসলিম লীগকে পাশ না কাটাতে কেবিনেট মিশনকে পরামর্শ দেন। তবে তিনি জানান যে, তিনি শক্তিশালী কেন্দ্রের পক্ষে। আবার কেন্দ্রে বর্ণহিন্দু ও মুসলমানদের আসন সমতার পক্ষেও কথা বলেন। তার প্রস্তাবই হডসনের কাছে সবচেয়ে গঠনমূলক বলে মনে হয়েছে।
এভাবে কেবিনেট মিশন ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা মুনির নানামত সংগ্রহ করে (দেখে-শুনে বােধহয় অবাকই হয়ে থাকবেন তারা) তাদের নিজস্ব প্রস্তাব প্রকাশ করেন। তাতে ছিল অবিলম্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন (যা তাৎক্ষণিক প্রস্তাব হিসেবে বিবেচিত) এবং অখণ্ড ভারতে গ্রুপিং ব্যবস্থার মাধ্যমে সমস্যার স্থায়ী সমাধান, যে ব্যবস্থা তাদের মতে আধা পাকিস্তান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এতে থাকবে দুর্বল কেন্দ্র এবং কেন্দ্রের হাতে যথারীতি থাকবে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যােগাযােগ। ত্রিস্তরীয় এ ব্যবস্থায় ব্রিটিশ ভারতের প্রদেশগুলাে এবিসি এই তিন গ্রুপে (অঞ্চলে) বিভক্ত হবে এবং তা হিন্দু-মুসলমান ধর্মীয় সংখ্যাগুরুত্ব বিচারে। গ্রুপ ‘এ’তে থাকবে বােম্বাই, মাদ্রাজ, যুক্তপ্রদেশ (ইউপি), মধ্যপ্রদেশ, বিহার ও ওড়িষ্যা। গ্রুপ ‘বি’তে থাকবে পাঞ্জাব, সিন্ধু, সীমান্তপ্রদেশ ও বালুচিস্তান । আর গ্রুপ ‘সি’তে বঙ্গদেশ ও আসাম। গ্রুপগুলাে তাদের সংবিধান তৈরি করবে । এরপর দেশি রাজ্যের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মিলে কেন্দ্রীয় সংবিধান রচনা করবে, যাতে সবার মৌলিক অধিকার, সংখ্যালঘু অধিকার রক্ষা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকবে। আর কেন্দ্রীয় গণপরিষদের সিদ্ধান্ত দুই-তৃতীয়াংশ ভােটে গৃহীত হবে। এ প্রস্তাবের নেপথ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও উপস্থিত ছিল। ব্রিটিশ-ভারত বিভক্ত হবে কি না এ বিষয়ে এক মাসের মধ্যে মীমাংসায় পৌছতে হবে। অন্যথায় মুসলমানপ্রধান প্রদেশগুলাে ৭৫ শতাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ গণভােটে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। এ পর্যন্ত বিষয়টি জিন্নার পক্ষে কিন্তু (ওই ‘কিন্তু’তেই যত গণ্ডগােল) ওইসব প্রদেশের অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা অনুরূপ ভােটে বিচ্ছিন্ন হয়ে সন্নিহিত মূল ভারত ভূখণ্ডের সঙ্গে যােগ দিতে পারবে (হডসন)। একেই বলে ইংরেজের বেনিয়া বুদ্ধি (দুষ্টবুদ্ধি)। একহাতে দেবে অন্য হাতে নেবে। মিশন অবশ্য স্পষ্টই বলে দিয়েছিল যে, জিন্না প্রস্তাবিত পাকিস্তান সম্ভব নয়, কারণ সেখানে বিরাটসংখ্যক অমুসলমান অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে, যা দ্বিজাতিতত্ত্বের নীতিবিরােধী । উদাহরণ বঙ্গ ও আসাম।
কিন্তু জিন্না এ বিষয়ে আগের মতােই অনড় । তার পাথুরে দৃঢ়তা এবারাে ভাঙতে পারেননি স্টাফোর্ড ক্রিপস। অন্যদিকে এ প্রস্তাব জওহরলাল নেহরুও বাতিল করে দেন। যুক্তিবাদী মানুষ প্রশ্ন তুলতে পারেন, কী খেলায় রত ছিলেন ভারতভূমির এই ত্রিপক্ষ, বিশেষত স্বদেশ নিয়ে লীগ-কংগ্রেস? কিছুতেই তারা কোনাে বিষয়েই ঐকমত্যে পৌছতে পারেননি, নিজ নিজ জেদ ও অহমবােধের কারণে। পৃথক আলােচনায় তাে নয়ই, এমনকি ৫ মে সূচিত সিমলা বৈঠকেও দ্বন্দ্ব (এটি দ্বিতীয় সিমলা বৈঠক)। এ বিষয়ে ভিপি মেননের মন্তব্য: দুদিনের দীর্ঘ আলােচনার পরও দেখা গেল দুপক্ষের মতভেদ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে । দূরত্ব কমার কোনাে লক্ষণ নেই। বরং হঠাৎ করে অঘটন ঘটাল কংগ্রেস। পূর্ব অবস্থান থেকে সরে এসে তারা জানায় যে, আসনসংখ্যার সাম্য অর্থাৎ প্যারিটি গণতান্ত্রিক বিচারে যুক্তিসম্মত নয়, তাই গ্রহণযােগ্য হতে পারে না। আমাদের বিশ্বাস কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির চাপে কংগ্রেস সভাপতি মাওলানা আজাদকে তার নিজস্ব চিন্তার বিরুদ্ধে উল্লিখিত মতপ্রকাশ করে চিঠি লিখতে হয়। সে বছরটায় দিল্লিতে অস্বাভাবিক গরম। তাতেই কি রাজনৈতিক নেতাদের মস্তিষ্ককোষে উত্তাপ-উত্তেজনা? পেথিক লরেন্স তাে একদিন প্রচণ্ড গরমে অচেতন হয়ে পড়েন (হডসন)। এত টানাটানি সহ্য করা বােধহয় বয়স্ক মানুষটির পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই টানাপড়েনে অগতির গতি হিসেবে বিবেচিত গান্ধির সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতেও অচলাবস্থা নিরসনের কোনাে লক্ষণ দেখা যায়নি। ইতিমধ্যে কেবিনেট মিশন সদস্যদের মধ্যেও লীগ-কংগ্রেস নিয়ে মতভেদ বা বিভাজন দেখা যায়। ক্রিপসের কংগ্রেস ঘেঁষা মনােভাব পছন্দসই ছিল না মিশনের তৃতীয় সদস্য আলেকজান্ডার সাহেবের এবং ভাইসরয় ওয়াভেলেরও। এক্ষেত্রে দলপতি পেথিক লরেন্স মধ্যবর্তী অবস্থানে। ভারতীয় রাজনীতিকরা যে কী পদার্থ তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলেন ইংরেজ আলােচকরা। অন্যদিকে স্থানীয় নেতারাও বুঝতে পারছিলেন তাদের প্রতিপক্ষকে । অর্থাৎ স্বাধীনতার পরিপ্রেক্ষিতে পরস্পরকে চেনা।
কেবিনেট মিশন প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক মহলে এত পানি গােলা করা হয়েছে যে, এর বিশদ বিবরণ দেয়ার কোনাে প্রয়ােজন নেই। এটুকু বলাই যথেষ্ট যে, এই ক’মাসে অনেক হ্যা’, ‘না, অনেক গােপনবার্তা আদান-প্রদান চলেছে। যেমন ব্রিটিশ পক্ষে নিজেদের মধ্যে তেমনি তাদের পক্ষ থেকে লীগ-কংগ্রেসের সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত একদিকে আলাের রেখা—৬ জুন মুসলিম লীগ কেবিনেট মিশন প্রস্তাব গ্রহণ করে কিন্তু সেই সঙ্গে বলে রাখে যে, সার্বভৌম পাকিস্তান এখনাে তাদের অপরিবর্তনীয় লক্ষ্য। এরপরও কী বলা চলে যে, জিন্না পাকিস্তান চাননি, ওটা দরকষাকষির হাতিয়ার? অর্ধেক হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন মিশন সদস্যরা । দুদিন পরই জিন্না ভাইসরয়কে এক প্রকার হুমকি দিয়েই বলেন যে, অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্য সংখ্যা যেভাবে নির্ধারিত হওয়ার কথা তিনি অর্থাৎ ভাইসরয় যা বলেছেন (কংগ্রেস ৫, লীগ ৫, একজন করে শিখ ও খ্রিস্টান) তার কোনাে ব্যত্যয় যেন না হয়। হলে তারা। প্রস্তাব গ্রহণের সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেবেন। জিন্নার রাজনৈতিক কলাকৌশল বরাবর এমনই দেখা গেছে । ভাইসরয় জিন্নাকে সাফ জানিয়ে দেন যে, তেমন কোনাে প্রতিশ্রুতি তিনি জিন্নাকে দেননি। ইতিমধ্যে এ বিষয়ে কংগ্রেসের বিপরীত প্রস্তাব, তারা ভারতের জনসংখ্যা বিচারে প্যারিটি মানতে নারাজ। অগত্যা দুপক্ষকে সামাল দিতে ভাইসরয় ওয়াভেলের নয়া প্রস্তাব কংগ্রেস : লীগ : সংখ্যালঘুর জন্য ৬:৫:২ হিসেবে আসন সংখ্যা নির্ধারিত হবে। পরে কংগ্রেস ও শিখদের আপত্তির মুখে সংখ্যানুপাত ৬:৫:৩-এ গিয়ে দাঁড়ায়। মিশন এবার পাল্টা হুমকি দিয়ে বলে, এ প্রস্তাব কেউ মেনে না নিলে ভাইসরয় নিজ উদ্যোগে পছন্দমতাে সদস্য নিয়েই অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করবে। ফলে তিক্ততা আরাে বাড়ে। সমস্যা শুধু প্যারিটি নিয়েই ছিল না, ছিল মূলত কংগ্রেস পক্ষে মুসলমান সদস্য গ্রহণে জিন্নার প্রবল আপত্তিতে। কারণ তার মতে তিনি ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র মুখপাত্র।
কিন্তু তার এ দাবি যে যুক্তিসঙ্গত ছিল না সে সম্বন্ধে ইতিপূর্বে আলােচনা করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত অনেক পানি ঘােলা হওয়ার পর ২৫ জুন মাওলানা আজাদ কেবিনেট মিশনের ১৬ মের প্রস্তাব গ্রহণের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়ে বলেন যে, কিছু কিছু বিষয়ে তাদেরও ভিন্নমত রয়েছে। কংগ্রেসের জন্য ব্যাপারটা ছিল প্যাচে পড়ে জবরদস্তির চেঁকি গেলা। | একটি বিষয় এখানে স্পষ্ট করে না বললেই নয়। দেশে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি বিচার করে মাওলানা আজাদ নিশ্চিত হন যে, দেশের স্বার্থে লীগকে কিছু ছাড় দিতে হলেও কংগ্রেসের উচিত মিশন-প্রস্তাব গ্রহণ করে তারপর যতটা সম্ভব দাবি আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। দলীয় নিয়মনীতি রক্ষা করে আজাদ যতটা সম্ভব স্বচ্ছতার সঙ্গে সমঝোতার পথ ধরে এগােতে চেয়েছেন। যে জন্য লীগ-কংগ্রেসের পক্ষ থেকে কেবিনেট মিশন প্রস্তাব গ্রহণকে তিনি গৌরবময় ঘটনা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তখনাে তিনি জানতেন না যে, ওই আনন্দের। দিন’ অচিরেই কালাে অন্ধকারে ঢাকা পড়বে। কারণ সব ভালাে যার শেষ ভালাে। শেষ ভালাে ভারতের জন্য অনর্জিতই থেকে গেছে। আজাদের সততা, স্পষ্টবাদিতা, আন্তরিকতা রাজনৈতিক অঙ্গনে অন্যদের মধ্যে সচরাচর আচরিত গুণাবলী নয় বলেই বােধহয় একাধিক রাজপুরুষের মতাে হডসনও তার প্রশংসা করে লিখেছেন যে, মাওলানা আজাদ পূর্বাপর স্বচ্ছ, আন্তরিকতা ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন একজন মানুষ, যার মধ্যে দুর্বুব্ধি, সন্দেহপরায়ণতা দেখা যায়নি। অনিচ্ছার সমঝােতায় এগুলাে এক সময় কুৎসিত রূপ নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়ায় (পৃ. ১৫৯)। কংগ্রেসের সমস্যা ছিল তার রথী-মহারথী নেতাদের নানা মত, গান্ধির নিজস্ব পথ ধরে চলা ইত্যাদি। তাই কংগ্রেস সভাপতি হয়েও আজাদের পক্ষে কঠিন ছিল ওয়ার্কিং কমিটিকে সব সময় স্বমতে নিয়ে আসা। তবু কেবিনেট মিশনের মূল প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে পাস করাতে পেরেছিলেন মাওলানা আজাদ(আত্মজীবনী, ভারত স্বাধীন হলাে)।
কিন্তু তা সত্ত্বেও শেষ রক্ষা হয়নি। প্রস্তাব গ্রহণ সত্ত্বেও ‘শেষ ভালাে’ আর হয়ে ওঠেনি। মাওলানা আজাদ এ জন্য দায়ী করেছেন মুসলিম লীগকে। আসলে জিন্নার অনমনীয় জেদই তিনি দ্বিতীয় সিমলা সম্মেলন ব্যর্থ হওয়ার কারণ বলে মনে করেন। তার ভাষায় ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে সিমলা বৈঠক একটি যুগান্তকারী ঘটনা… বৈঠক ফলপ্রসূ না হওয়ার কারণ মুসলিম লীগের উগ্র সাম্প্রদায়িক মনােভাবসঞ্জাত অসহযােগিতা’ (আত্মজীবনী)। যেমন জিন্না দাবি তােলেন, কংগ্রেস শুধু হিন্দু সদস্যদের মনােনীত করবে এবং মুসলমান সদস্যদের করবে মুসলিম লীগ’ । বাস্তবিক জিন্নার এ দাবির পেছনে যুক্তি ছিল না । কংগ্রেস বলে কথা নয়, যে কোনাে দলেরই যে কোনাে সদস্যকে মনােনীত করার অধিকার রয়েছে, তা সে সদস্য যে ধর্মবিশ্বাসীই হােন না কেন। এটা তাে গণতন্ত্রের সাধারণ নিয়মে পড়ে। কিন্তু জিন্না তা মানেননি। জিন্নার ওই অযৌক্তিক দাবির জবাবে আজাদ সঙ্গত যুক্তিতেই বলেন যে, কংগ্রেস কাদের মনােনয়ন দেবে না-দেবে সে সম্বন্ধে কথা বলার অধিকার জিন্না বা মুসলিম লীগের নেই । কংগ্রেস যদি মুসলমান, শিখ, পারসি বা খ্রিস্টান সদস্য মনােনীত করে সেক্ষেত্রে তাে হিন্দু সদস্যের সংখ্যা কমে যাবে। আজাদ এ বিষয়ে ওয়াভেলের মতামত জানতে চাইলে তিনি লীগের দাবি বাস্তবানুগ বলে মনে করেননি। কিন্তু তিনি এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না দিয়ে বিষয়টি কংগ্রেস ও লীগের মধ্যে আলােচিত হওয়া উচিত বলে দায়িত্ব এড়িয়ে যান। অর্থাৎ জিন্নার অযৌক্তিক দাবির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে চাননি ভাইসরয়। জিন্নার অনড় বিরােধিতার মুখে সিমলা বৈঠক ভেঙে গেছে এমন অভিযােগ এনে মাওলানা আজাদ সাংবাদিক সম্মেলনে বিশেষভাবে মুসলিম লীগ যে ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধি (আয়েশা জালালের ভাষায় ‘সােল স্পােকসম্যান’) নয় সে বিষয়ে দাবি করেন যে, সীমান্তপ্রদেশে রয়েছে কংগ্রেসী মন্ত্রিসভা, সিন্ধু প্রদেশে গােলাম হােসেনকে কংগ্রেসের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে, আসামেও একই অবস্থা। (পাঞ্জাবে ইউনিয়নিস্ট কোয়ালিশন তখন ক্ষমতায়)।
অতএব মুসলিম লীগই যে ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধিস্থানীয় প্রতিষ্ঠান এ দাবি ধােপে টেকে না। ভারতীয় মুসলমানদের একটি বিরাট অংশ তখনাে মুসলিম লীগের আওতার বাইরে (আজাদ, আত্মজীবনী)। কিন্তু কেবিনেট মিশন প্রস্তাব গ্রহণ করানাের ঘটনা কংগ্রেস সভাপতি মাওলানা আজাদের কাছে যত স্বস্তিদায়ক হােক না কেন অঘটন নামক নিয়তিকে ঠেকাবে কে? এর মধ্যে কংগ্রেসের নতুন সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু। প্রস্তাব মাওলানা আজাদের। কিন্তু নেহরুর কিছু রাজনৈতিক ভুলভ্রান্তি ও অদূরদর্শী বক্তব্য (হডসন) গােটা রাজনৈতিক চিত্রপট এমনভাবে পাল্টে দেয়। যে, দেশ সাম্প্রদায়িক সংঘাতের দিকে দ্রুত এগিয়ে যায়, রক্তস্নান ও দেশবিভাগ অনিবার্য হয়ে ওঠে, যা একদিন আগেও কেউ ভাবেননি। অবস্থাদৃষ্টে ক্ষুব্ধ আজাদ যা ভেবেছিলেন তারই প্রকাশ ঘটে পরে লেখা তার আত্মজীবনীতে। আরাে একবার কংগ্রেস সভাপতি হওয়ার আহ্বান সত্ত্বেও নেহরুকে সভাপতি করার জন্য মাওলানা আজাদের প্রস্তাব সম্পর্কে তিনি নিজেই। লিখেছেন : “আমি যা সবচেয়ে ভালাে ও সঙ্গত মনে করেছিলাম সেভাবেই কাজ করেছিলাম। কিন্তু পরবর্তী ঘটনাবলী দেখে আমার মনে হয়েছে আমি হয়তাে ভুল করেছিলাম। এবং যারা আমাকে সভাপতি হিসেবে আরাে কিছুকাল থাকার কথা বলেছিলেন তারাই হয়তাে সঠিক ছিলেন’ (ভারত স্বাধীন হলাে)। শুধু ওয়ার্কিং কমিটিতে নয়, কেবিনেট মিশন প্রস্তাব ৬ জুলাই নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির বােম্বাই অধিবেশনে যথারীতি অনুমােদিত হয়।
আর সেই প্রস্তাব নিয়ে এক ঐতিহাসিক ভুলের সূচনা ঘটান সদ্য নির্বাচিত কংগ্রেস সভাপতি পণ্ডিত নেহরু। বােম্বাইয়ে ১০ জুলাই সাংবাদিক সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে নেহরু বলেন : কংগ্রেস গণপরিষদে অংশগ্রহণ করবে স্বাধীনভাবে, কোনাে রকম বাধ্যবাধকতা নিয়ে নয় আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কংগ্রেস উক্ত পরিষদে যােগ দেবে এটাই শুধু স্বীকার করেছে। সুতরাং প্রয়ােজনবােধে কেবিনেট মিশন পরিকল্পনার হেরফের করার স্বাধীনতা তার রয়েছে।’ ব্যস, মৌচাকে ঢিল। নেহরুর মতাে একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিকের এ ধরনের দায়িত্বহীন বক্তব্য যেমন অভাবিত তেমনি এর কার্যকারণ নিয়ে সমকালে এবং পরেও অনেক। বিচার-ব্যাখ্যা চলেছে । মাওলানা আজাদ তার নমনীয় ভাষায় বিবৃতিটিকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। হডসন বুঝতে চেয়েছেন এটা কি ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদের মধ্যে সূক্ষ সমঝােতা, নাকি রাজনৈতিক বিচারের স্কুল বিভ্রান্তি। যশবন্ত সিং এ সম্বন্ধে বিশদ আলােচনা করেছেন। বলেছেন, তার বক্তব্য যে মিশন প্রস্তাবের সমাধি রচনা করেছে সে ভুলটা নেহরু বুঝতে পারেননি। পারেননি যে এতে সমঝােতার সব সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে গেছে, বিশেষ করে যখন তেমন সম্ভাবনার দরজা খুলতে শুরু করেছিল। সরদার প্যাটেলের মতে নেহরুর মন্তব্য তার ‘অপরিণত আবেগের ফল’। আর জিন্নার মতে তা হলাে শিশুসুলভ বিবৃতি । মাত্র একটি বিবৃতি, একটি সাংবাদিক সম্মেলন যে একটি দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দিতে পারে, যে গতিপথ অশুভ ঘটনাবলীর, নেহরুর ১০ জুলাইয়ের বক্তব্য তার একটি প্রকৃষ্ট। উদাহরণ । এই বক্তব্যের কারণে শুধু যে কেবিনেট মিশন প্রস্তাব শেষ হয়ে গেল।
তাই নয়, কংগ্রেস-লীগ বিরােধিতায় সন্দেহ, অবিশ্বাস ও বিরূপতা তুঙ্গে ওঠে। রাজনৈতিক আস্থার কোনাে জায়গাই আর অবশিষ্ট থাকে না। এতে করেই নেহরুকে কংগ্রেস সভাপতি পদে প্রস্তাব করার জন্য মাওলানা আজাদের আত্মধিক্কারের কারণ বােঝা যায়। নেহরুর ‘স্বাধিকার প্রমত্ত’ বক্তব্য নিয়ে যে আলােড়ন সৃষ্টি হয় তা প্রতিটি প্রদেশের রাজনৈতিক নেতাদের কম বেশি স্পর্শ করে, বিশেষ করে যারা কেবিনেট মিশন প্রস্তাব নিয়ে আশাবাদী ছিলেন। এমনকি যেসব মুসলমান অখণ্ড ভারতে পাকিস্তানের বিকল্প নিয়ে খুশি থাকতে চেয়েছিলেন সেসব রাজনীতিকও কংগ্রেসের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন। অবশ্য এ ঘটনার পর কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি থেকে তাদের পূর্ব অবস্থান স্পষ্ট করা হলেও সদ্য নির্বাচিত কংগ্রেস সভাপতির বক্তব্যই সবার কাছে প্রাধান্য পেয়ে যায়। কেন হঠাৎ করে এমন নেতিবাচক মন্তব্য কংগ্রেস সভাপতির কণ্ঠে, তাও আবার দলের শীর্ষনেতা, এমনকি গান্ধির সঙ্গে আলাপ না করে এবং ওয়ার্কিং কমিটির অনুমােদন না নিয়ে। এর কারণ সত্যিই বােঝা মুশকিল। তবে আমার বিশ্বাস এটা নিছকই নেহরুর তাৎক্ষণিক চিন্তার ফসল। এবং এর পেছনে সম্ভবত রয়েছে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস্ এবং কংগ্রেসের প্রতি কেবিনেট মিশনের কিছুটা নমনীয় আচরণ । তাই স্বাগ-পাছ না ভেবে হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটানাে, যা ছিল জওহরলালের বরাবর স্বভাববৈশিষ্ট্য। যে জন্য প্রায়ই গান্ধিকে দেখা গেছে। নেহরুর আবেগপ্রবণ বক্তব্যের রাশ টেনে ধরতে। স্বভাবতই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ভাবতে পারেন নেহরুর বদলে সরদার প্যাটেল কংগ্রেস সভাপতি হলে কি এ ধরনের অঘটন এড়ানাে যেত? অর্থাৎ ইতিহাসের যাত্রা ভিন্নপথ ধরত? বলা কঠিন। কারণ প্যাটেল কংগ্রেসের রক্ষণশীল ঘরানার নেতা, তবে ধীরস্থির কঠিন মেজাজের। আবেগের টানে হঠাৎ কিছু বলা তার স্বভাববৈশিষ্ট্য নয়। তার খুবই ইচ্ছা ছিল এ পর্বে কংগ্রেস সভাপতি পদটিতে আসীন হওয়া। কারণ ইতিপূর্বে জওহরলাল নেহরু কংগ্রেস। সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু নেহরুর আন্তর্জাতিক পরিচিতির কারণেই বােধহয় তাকে সভাপতি পদের প্রতিযােগিতায় যােগ্যতর মনে করা হয়েছিল। তাছাড়া ব্রিটিশ রাজনৈতিক মহলে তার গ্রহণযােগ্যতা ছিল। অনেক বেশি যদিও মাঝে-মধ্যে সমাজতন্ত্রের পক্ষে কথা বলতেন তিনি। বিষয়টি নিয়ে এত কথা বলার কারণ এ ঘটনার ঐতিহাসিক তাৎপর্য। তৎকালীন ভারতবর্ষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নিয়েছিল। এ ঘটনার পরম্পরায়
ও পরিণামে যা কিছু ঘটে তাই-ই ভারতবিভাগের পথ নিশ্চিত করে দেয় এবং অখণ্ড ভারত ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মৃত্যুঘণ্টা বাজায়। এমনিতেই কংগ্রেস মন্ত্রীমিশন পরিকল্পনা গ্রহণ করেও কিছু কিছু বিষয় নিয়ে বিরােধী অবস্থান নিয়েছিল। এর মধ্যে নেহরু-কথিত স্বাধীন আচরণের বজ্রপাত সব সম্ভাবনার মূলে আঘাত করে। রাজনৈতিক অঙ্গনে দেখা দেয় আলােড়ন, যার ঢেউ বিলেতের কমন্সসভা পর্যন্ত পৌঁছে। সেখানে ১৮ জুলাই এক বিতর্কে ভারত সচিব পেথিক লরেন্স বলেন, ১৬ মের বক্তব্য গ্রহণ করার পর কোনাে দলই গণপরিষদ বিষয়ক শর্তাবলীর বাইরে যেতে পারে না। আর স্টাফোর্ড ক্রিপস প্রদেশগুলাের সংশ্লিষ্ট নিয়মকানুনের ব্যাখ্যা স্পষ্ট করে দেন। কিন্তু এসব বিচার-ব্যাখ্যায় কান না দিয়ে জিন্না চরমপন্থাই বেছে নেন। তিনি ২৭ জুলাই বােম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে তিক্ত ভাষায় কংগ্রেসের সমালােচনার পর কেবিনেট মিশন প্রস্তাব থেকে সরে দাঁড়ানাের ঘােষণা দেন। সেই সঙ্গে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তার জিহাদ ঘােষণা। এর ভয়াবহত ও তাৎপর্য কংগ্রেস বা ব্রিটিশরাজ বুঝতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না। জিন্না লীগ ওয়ার্কিং কমিটিকে নির্দেশ দেন প্রত্যক্ষ সংগ্রামের (ডাইরেক্ট অ্যাকশন) পরিকল্পনা ও রূপরেখা প্রণয়নের জন্য। তার ক্ষোভ ছিল ভারতীয় ইংরেজ শাসকদের ওপরও কংগ্রেসের অনুপস্থিতিতে মুসলিম লীগকে সরকার গঠনের জন্য আহ্বান না জানানাে এবং এ বিষয়ে তার অনুরােধ না রাখার কারণে। লীগ সদস্যদের উদ্দেশে তিনি নির্দেশ রাখেন সরকারের প্রদত্ত সব খেতাব বর্জনের জন্য। হডসন ঠিকই লিখেছেন, এটা ছিল কেবিনেট মিশন প্রস্তাবের ওপর মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা’ । শুধু কেবিনেট মিশন নয়, প্রত্যক্ষ সংগ্রামের অর্থ ছিল অমুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা এবং রাজনৈতিক-সামাজিক অঙ্গন সহিংসতার রক্তে ভাসিয়ে দেয়া। জিন্নার মতাে বুদ্ধিমান রাজনীতিকের না জানার কথা নয় এ ধরনের জিহাদ ঘােষণার ফল কী হতে পারে। তিনি জানতেন এবং জেনেশুনেই তার ক্রোধ মিটাতে নিরপরাধ মানুষের রক্ত নিয়ে খেলায় মেতে ওঠেন রক্তের বিনিময়ে জিঘাংসার তরবারিতে দেশবিভাগ ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে। নেহরু কি জানতেন তার এক অদূরদর্শী বক্তব্যের পরিণাম কী ভয়াবহ হতে পারে?
সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক