প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস কলকাতায় সাম্প্রদায়িক গণহত্যা
সাংবাদিক সম্মেলনে জওহরলাল নেহরুর বক্তব্য বাস্তবিকই এক অশনিসঙ্কেত হয়ে দাঁড়ায়। এ ঘটনা লীগমহলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয় । ক্রুদ্ধ জিন্নার বক্তব্য হয়ে ওঠে ধারালাে । তাতে যুদ্ধংদেহী মনােভাব স্পষ্ট। তার ভাষায় ‘এতদিন আমরা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ ধরে চলেছি, এখন হাতে পিস্তল তুলে নেয়া ও তা ব্যবহারের সময় এসে গেছে’ (ভিপি মেনন, এইচ ভি হডসন)। প্রশ্ন উঠতে পারে, নেহরুর একপেশে বক্তব্যের বিপরীতে জিন্নার। এতটা উত্তেজক মনােভাব কি সঠিক ছিল? মনে হয় এ বিষয়ে জিন্নার রাজনৈতিক অবস্থান গণতান্ত্রিক রীতিনীতির। পরিচায়ক ছিল না । একে তাে নেহরুর কথায় পিস্তলের কোনাে ইঙ্গিত ছিল না। অন্যদিকে সাবেক কংগ্রেস সভাপতি মাওলানা আজাদ ও কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি নেহরুর বক্তব্যের পরপরই তাদের পূর্ববর্তী অবস্থানের পক্ষে বিবৃতি প্রচার করে। কিন্তু জিন্না তাতে শান্ত হননি। তিনি ২৯ জুলাই মুসলিম লীগ। কাউন্সিল সভায় উত্তেজক সাম্প্রদায়িক বক্তৃতা শেষে নেহরুর বক্তব্যের এবং ভাইসরয়ের ভূমিকার প্রতিবাদে ১৬ আগস্ট ভারতের সর্বত্র প্রত্যক্ষ সংগ্রাম। দিবস’ পালনের ঘােষণা দেন, যা ওই সভায় সিদ্ধান্ত আকারে গৃহীত হয়। প্রকৃতপক্ষে তিনি এ সুযোেগ তার রাজনৈতিক লক্ষ্য পাকিস্তান অর্জনের জন্য জিহাদের ডাক দেন (ওয়াভেলের ডায়েরি)। প্রত্যক্ষ সংগ্রামের কর্মসূচিতে যদিও ছিল প্রতিবাদী সভা, সমাবেশ, মিছিল ইত্যাদির কথা, কিন্তু ইঙ্গিত ছিল সহিংসতার । প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসে ঠিক কী। করা হবে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে লীগ নেতাদের বক্তব্যে ছিল নৈরাজ্য সৃষ্টির স্পষ্ট আভাস। সে সময় ‘যুগান্তর পত্রিকায় গজনফর আলী খানের অনুরূপ। মন্তব্য পড়ে অবাক হয়েছিলাম। প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস উপলক্ষে মুসলিম লীগের প্রতিবাদী উত্তেজনা, সাম্প্রদায়িক প্রচার অন্যপক্ষে পাল্টা প্রচার ইত্যাদি কারণে শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
ভূগর্ভভুবনের দুবৃত্ত শক্তিও সক্রিয় হয়ে ওঠার প্রস্তুতি নেয়। এসব খবর সাধারণত চাপা থাকে না। নাগরিকদের মধ্যে টানটান উত্তেজনা। প্রস্তুতি চলে উভয়পক্ষে। বঙ্গীয় লীগের সেক্রেটারি আবুল হাশিমের মতে, “ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দালাল বাহিনী দ্বারা দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছিল। এটা তার নিজস্ব ভাবনা। কারণ অন্য লীগ নেতাদের মধ্যে ছিল জিহাদি মনােভাব। ঘটনা বলে, প্রাথমিক দায় তাদের, সেই সঙ্গে অন্যদের। আবুল হাশিম ছিলেন অনেকটাই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দৈত্যকুলে প্রহ্লাদের মতাে। ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে যাচ্ছে এমন গুজব বাতাসে ছিল। দূর শহরেও ছিল তেমন বার্তা। সেই উত্তেজক, উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে বঙ্গীয় মন্ত্রীমণ্ডলীর দায় ছিল প্রতিরােধের সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেয়া । এমনকি উভয় পক্ষের সংবাদপত্রগুলাের সঙ্গে সংলাপে বসা। বিষয়টা তারা প্রয়ােজনীয় গুরুত্বে নেননি। পরিবর্তে মুখ্যমন্ত্রী শহীদ সােহরাওয়ার্দীর বক্তব্যে ছিল উত্তেজনা। বিশেষ করে কলকাতা শহর মুসলিম লীগের পক্ষে দেখা গেছে উত্তেজক সাম্প্রদায়িক প্রচার । আর সেখানে ছিল অবাঙালি প্রাধান্য। অন্যদিকে হিন্দু মহাসভাও সাম্প্রদায়িক প্রচারে পিছিয়ে ছিল না। ফলে পরিবেশ উত্তপ্ত । শহরে বিদ্যমান সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর মারাত্মক ভুল ১৬ আগস্ট সরকারি ছুটির দিন ঘােষণা (আবুল হাশিম)। হডসন এ সিদ্ধান্ত ‘অতীব বিপজ্জনক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন (পৃষ্ঠা ১৬৬)। এ মন্তব্য ভুল ছিল না। কথাটা আরাে অনেকে বলেছেন। এমনও বলা হয়েছে যে, সশস্ত্র পুলিশ ও সেনাবাহিনী মােতায়েন করে সম্ভাব্য সহিংসতা রােধের ব্যবস্থা নেয়া মুখ্যমন্ত্রীর চিন্তায় ছিল না (সুমিত সরকার) এ বিষয়ে আবুল হাশিমের বক্তব্য অবশ্য ভিন্ন। কিন্তু ইতিহাসবিদ অনেকেই মুখ্যমন্ত্রীকে দায়ী করেছেন। তাদের মতে মুখ্যমন্ত্রী এমন বিবৃতিও দেন যে কংগ্রেসকে যদি ক্ষমতায় বসানাের (অন্তর্বর্তী সরকারে) চেষ্টা চলে সেক্ষেত্রে বাংলা স্বাধীনতা ঘােষণা করে সমান্তরাল স্বাধীন শাসনব্যবস্থা চালু করবে, কেন্দ্রীয় সরকারকে কর ও রাজস্ব প্রদান বন্ধ রাখবে ইত্যাদি (ভিপি মেনন, পৃষ্ঠা ১৯৪, যশবন্ত সিং)।
আর ময়দানে আয়ােজিত জনসভায় খাজা নাজিমুদ্দিনের মতাে নম্রভাষী লীগ। নেতাও কংগ্রেস ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক দিলেন (আবুল হাশিম)। সঙ্গে খাজা নুরুদ্দিন। এর আগে পাঞ্জাবের লীগ নেতা রাজা গজনফর আলীর বক্তৃতায় আহ্বান ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদ ও দিল্লির সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করার। অর্থাৎ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্ররােচনা শুরু। আবুল হাশিম অবশ্য বলেন, প্রত্যক্ষ সংগ্রাম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে (কামরুদ্দিন আহমদ, বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭২)। আবুল হাশিম তেমন কথাই লিখেছেন তার আত্মজীবনীমূলক বইতে। কিন্তু ময়দানি বক্তৃতার উত্তেজনায় সভা শেষ হওয়ার আগেই শুরু হয়ে যায় ভাঙচুর ও হত্যালীলা। দুই সপ্তাহের প্রচার, পাল্টা প্রচারের ফল। এ সম্বন্ধে হডসনের মন্তব্য হচ্ছে সােহরাওয়ার্দী সরকার দুষ্টবুদ্ধিপ্রণােদিত হয়ে মারাত্মক প্যান্ডােরার বাক্স খুলে দেয় এবং দানবদের তৎপরতা ঠেকাতে এবং ওই বাক্স বন্ধ করতে সরকার অনিশ্চয়তায় ভুগেছে । আর গভর্নর স্যার ফ্রেড্রিক বারােজ মন্ত্রীমণ্ডলীর সিদ্ধান্তের ঊর্বে গিয়ে সেনাবাহিনী তলব করতে উদ্যোগ নেননি। সে কাজটি তারা করেন ১৭ আগস্ট দুপুরে । তখনাে অলিতেগলিতে ফৌজ মােতায়েনের মতাে অবস্থা ছিল না। বরং সেনাবাহিনীকে রাস্তা থেকে লাশ সরানাের কাজেই অধিক ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। উনিশ তারিখ গণসহিংসতা বন্ধ হয়। ঘটনার দায়দায়িত্ব নির্ধারণের জন্য গঠিত তদন্ত কমিটির কাজ পরে বনধ করে দেয়া হয় (পৃ. ১৬৭)। | হডসনের হিসেবে তিন দিনের সহিংসতায় হতাহতের সংখ্যা বিশ হাজারের মতাে’ । ভাবা যায়, কী ভয়ঙ্কর খুনের নেশায় মেতে উঠেছিল কলকাতার দুই সম্প্রদায়, প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস উপলক্ষে । রাস্তায় শুধু লাশ- নারী-পুরুষ নিরীহ মানুষের। তবে হডসন এবং আরাে অনেকের মতে শুরুটা মুসলমান পক্ষে হলেও শিখ ও হিন্দুদের প্রতিক্রিয়ায় মুসলমান নিধন সংখ্যায় বেশি। মুখ্যমন্ত্রী হয়তাে ভেবে দেখেননি যে কলকাতা হিন্দুপ্রধান শহর, নানাদিক বিচারে রয়েছে ওদের প্রাধান্য। আবারাে বলি, হিসেবে ভুল ছিল তার। প্রত্যক্ষ সংগ্রামের নেশায় ভুল করেছিলেন তিনি। কলকাতার ‘আন্ডারওয়ার্ল্ডের’ নেতা হওয়ার কারণে এ ভুল।
কলকাতা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সম্বন্ধে সুমিত সরকার লিখেছেন ময়দানের জমায়েতের পরই ব্যাপক মুসলিম আক্রমণ শুরু হয়। সুহরাবর্দি তার কিছু সমর্থক পরিবেষ্টিত হয়ে দীর্ঘ সময় লালবাজার কন্ট্রোল রুমে কাটান আর নিজ সম্প্রদায়ের লােকদের দুর্দশার জন্য হতাশাজনক ব্যতিব্যস্ততা দেখান, (ওয়াভেলকে গভর্নর বারােজ-২২ আগস্ট, ম্যানসার, খণ্ড ৮, পৃষ্ঠা ২৯৭৩০০)। হিন্দু ও বিশেষত শিখ গুণ্ডারা জোরদার পাল্টা আক্রমণ চালায়’ । ফলে কলকাতার অন্ধকার মহলের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের মধ্যে তা এক গণহত্যালীলায় পরিণত হয়। পরিণামে ১৯ আগস্ট (নাগাদ) ৪ হাজার নিহত ও ১০ হাজার আহত হন। …হিন্দুর চেয়ে মুসলমানই এতে নিহত হয়েছিলেন বেশি, শুধু ওয়াভেল নয়, প্যাটেলও একই মত পােষণ করেছিলেন’ (প্রাগুক্ত)। এরপরও দাঙ্গা কলকাতায়, মার্চ-এপ্রিলে এবং মহাহত্যাকাণ্ড তথা কলকাতা গণহত্যা দেশবিভাগ নিশ্চিত করে, জিন্নার আশা পূর্ণ হয়। সরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার এবং আহত ১৫ হাজারেও বেশি (ভিপি মেনন) | অবিশ্বাস্য এক হত্যাকাণ্ড! কলকাতা হত্যাযজ্ঞের ছবিটা যশবন্ত সিংহের বইতে কিছুটা বিশদ । প্রত্যক্ষ সংগ্রাম উপলক্ষে ঘােষিত হরতালে ১৬ আগস্টে খােলা দোকানপাট ভাঙচুর ও লুটের মধ্যে দিয়ে বিশৃঙ্খলা শুরু । মুসলমান পরিচালিত সংবাদপত্রগুলাে কদিন আগেই প্রচার শুরু করে যে এই রমজান জিহাদের মাস। একটি প্রচারপত্রে লেখা হয় দশ কোটি ভারতীয় মুসলমান ভাগ্যদোষে হিন্দু ও ব্রিটিশের দাস। এ অবস্থা থেকে মুক্তি চাই।’ আরেকটি ইশতেহারে তরবারি হাতে জিন্না। তাতে বলা হয়েছে, ‘মুসলমান এক সময় ভারত শাসন করেছে। তৈরি হও, হাতে তরবারি নাও কাফেরদের দিন শেষ, হত্যার দিন সামনে’ (পৃ. ৩৮৭)। প্রশ্ন উঠতে পারে এসব ঘটনা আবুল হাশিম বা সােহরাওয়ার্দী সাহেবদের অজান্তে ঘটেছিল? তরবারি হাতে জিন্না! আসলে ময়দানের জনসভা থেকেই প্রত্যক্ষ সংগ্রামের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। রাস্তায় গাড়ি পােড়ে, ট্রাম পােড়ে, দোকানপাটে আগুন, পথচারী ছুরিকাহত- ছবিটা এ রকমই। কিম ক্রিশ্চেন্তীর যুদ্ধ অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে এ বিষয়ে স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় লেখেনঃ “এটা দাঙ্গা নয়, স্রেফ উন্মত্ততা। এবং এর পেছনে অবশ্যই রয়েছে কোনাে সংগঠনের পরিকল্পিত তৎপরতা (উদ্ধৃতি যশবন্ত সিং)। নিঃসন্দেহে সে সংগঠন মুসলিম লীগ এবং পরিকল্পনা লীগ-নেতাদের।
বিভিন্ন লেখায় একটি কথাই উঠে এসেছে যে কলকাতা হত্যাকাণ্ড ছিল ভারত-ইতিহাসের নিকৃষ্টতম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের জন্য এমন হত্যাযজ্ঞ ছিল সম্পূর্ণ অভাবিত এবং অনভিপ্রেত। দুর্ভাগ্যজনক যে, বিষয়টা পরিকল্পিত। আর পরিকল্পিত বলেই প্রতিহত করতে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব ছিল কিন্তু তা নেওয়া হয়নি। তবু বাস্তবে তা ঘটেছে। দাঙ্গার মূল লক্ষ্যই ছিল মানুষ হত্যা, দাঙ্গার অন্যান্য উপসর্গ বড় একটা এক্ষেত্রে দেখা যায়নি। অর্থাৎ পরিকল্পিত গণহত্যা । শুরু যাদের হাত দিয়েই হােক, পরে দুপক্ষই এক অবিশ্বাস্য উন্মত্ততায় হত্যালীলায় অংশ নিয়েছে। এটা বাংলায় সােহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার জন্য ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। আসলে লীগ-কংগ্রেস ক্ষমতার জন্য, তাদের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য এতটা উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল যে সাধারণ মানুষের ধনপ্রাণ তাদের কাছে তুচ্ছ বিবেচিত হয়েছে। কলকাতা হত্যাকাণ্ড হয়তাে তাদের কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত। হয়নি। কিছু ঘটনা তেমন ইঙ্গিতই দেয়। কলকাতা সহিংসতার পর অকুস্থল পরিদর্শন শেষে ভাইসরয় ওয়াভেল ২৭ আগস্ট গান্ধি ও নেহরুর সঙ্গে আলাপে ওই হত্যাকাণ্ডের বীভৎসতা বর্ণনা করে বলেন, রাজনীতির নামে যে বর্বরতার প্রকাশ ঘটেছে তা অবিশ্বাস্য’ (লেনার্ড মােসূলে, ‘দ্য লাস্ট ডেজ অব ব্রিটিশরাজ’)। মােসলির বিবরণ মতে, ভাইসরয়ের মূল বক্তব্য ছিল এই বর্বরতার পুনরাবৃত্তি বন্ধ করতে হবে, তা না হলে ভারতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। আমার দায়িত্ব এসব বন্ধ করা। বর্তমান অবস্থায় সেজন্য মুসলিম লীগকে কিছু সুযােগসুবিধা দিতে হবে । লীগ-কংগ্রেস উভয়কে নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা কংগ্রেসের উচিত কেবিনেট মিশন প্রস্তাব পুরােপুরি গ্রহণ করা। কিন্তু গান্ধি-নেহরু দুজনই কূট-আইনি যুক্তিতর্কের জেরে বিষয়টা এড়িয়ে যান। কারণ মিশন পরিকল্পনার গ্রুপিং তাদের পছন্দসই ছিল না।
অন্যদিকে ভাইসরয়ের এটাই বা কেমন যুক্তি যে বর্বরতা বন্ধ করার জন্য সংশ্লিষ্টকে সুযােগ সুবিধা দিতে হবে? ভাইসরয়ের ডায়েরিতে একটি প্রাসঙ্গিক তথ্য হচ্ছে আলােচনার শেষ কথায় দেখা যায় মুসলিম লীগের প্রতি নেহরুর প্রবল বিতৃষ্ণা । কিন্তু গান্ধির ঠাণ্ডা মেজাজের বক্তব্যও ভাইসরয়কে হতবাক করে। গান্ধি বলেন : ‘রক্তস্নানই যদি অনিবার্য হয়ে থাকে তাহলে অহিংসার মধ্যেও তা ঘটতে থাকবে। সব কিছু শুনে ভাইসরয় ওয়াভেলের গান্ধি সম্বন্ধে মন্তব্য : আমার বরাবরের ধারণাই ঠিক, গান্ধির সন্তসুলভ ভাবমূর্তি ও অহিংসানীতি ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হাতিয়ার বই কিছু নয়’ (ডায়েরি) । আমাদের বিশ্বাস একই সঙ্গে গান্ধি তার সস্ত ভাবমূর্তির সাহায্যে কংগ্রেসকে তার নেতৃত্বে একমাত্র সর্বভারতীয় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। অনেকটা জিন্নার মতাে। এরপর আগস্ট মাসের শেষ দিকে ভাইসরয় ওয়াভেলের যােগাযােগ শুরু নেতাদের সঙ্গে, মূলত গান্ধি নেহরু ও জিন্না। সেই সঙ্গে চিঠি চালাচালি । এ বিষয়ে গান্ধির চিঠিতে আশাপ্রদ কিছুই ছিল না। আর নেহরুর বক্তব্য নেতিবাচক এ সম্পর্কে পেন্ডেরেল মুনের মন্তব্য : নেহরু সুস্পষ্ট ভাষায় গ্রুপিং সম্বন্ধে পূর্বমতই প্রকাশ করেছেন, নতুন কিছু তাদের বলার নেই। আশাহত ভাইসরয় ওয়াভেল। কংগ্রেস ও লীগ তাদের নিজ নিজ অবস্থানে অনড় ।
এক কদম ডানে-বাঁয়ে সরতে নারাজ। কিন্তু ঘটনা কারাে জন্য অপেক্ষা করে না। সে তার নিজের মতাে করে চলতে থাকে। সে চলা ভারতের জন্য শুভসঙ্কেতের ছিল না। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল কোনাে কোনাে নেতার অদূরদর্শী পদক্ষেপ। অন্যদিকে ভাইসরয় ওয়াভেলের ডায়েরিতে সমাধানের লক্ষ্যে যে আন্তরিকতার ছবি ফুটে উঠেছে তা কতটা তথ্যনির্ভর ছিল কোনাে কোনাে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। কলকাতা দাঙ্গায় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তৎপরতার অভাব নিয়ে মাওলানা আজাদের অভিযোগ অন্য কারাে কারাে কণ্ঠেও ধ্বনিত হয়েছে। প্রসঙ্গত এ বিষয়ে লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডায়েরির মন্তব্য স্মরণ করার মতাে। সন্দেহ নেই কলকাতায় প্রত্যক্ষ-সংগ্রাম উপলক্ষে দাঙ্গা তথা নরহত্যার প্রাথমিক দায় সেখানকার উগ্রপন্থী মুসলিম লীগ নেতৃত্বের, ক্ষমতাসীন। মন্ত্রিসভার, কিন্তু এর পেছনে শাসক শ্রেণির কি কোনাে ভূমিকা ছিল না? | একটি তথ্য এ বিষয়ে সন্দেহ জাগায়। ম্যানসারের উল্লিখিত তথ্যে দেখা যায় ২৪ জানুয়ারি (১৯৪৭) ভারতে গােয়েন্দা বিভাগের প্রধান তার মন্তব্যে লিখছেন: “খেলা ভালােভাবে শেষ হয়েছে। ফলে কংগ্রেস ও লীগ উভয়েই কেন্দ্রীয় সরকারে যােগ দিতে বাধ্য হয়েছে, ভারতীয় সমস্যাকে সাম্প্রদায়িকতার ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, …মারাত্মক সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলা আমাদের কাজে বাধা সৃষ্টি করবে না যার ফলে ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলন তৈরি হতে পারে।’ অর্থাৎ সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলন দমন।
চমৎকার! শাসকশ্রেণির আন্তরিকতা সম্বন্ধে আরাে দুয়েকটি ঘটনা আমাদের একইভাবে সন্দিহান করে তােলে আমরা জানি কলকাতা হত্যাকাণ্ড ও তার নেপথ্যের রাজনৈতিক কারণের প্রতিক্রিয়ায় ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দেখা দেয়। তাৎক্ষণিকভাবে নােয়াখালী ও ত্রিপুরায় এবং এর প্রতিক্রিয়ায় বিহার, বােম্বাই প্রভৃতি প্রদেশে দাঙ্গার সূত্রপাত। আরাে পরে, বিশেষ করে ১৯৪৭-এর বিভাগপূর্ব মাসগুলাে বুঝি রক্ত নিয়ে খেলার তাণ্ডবে মেতে ছিল। জিঘাংসা ও হত্যা আর নারী নির্যাতনের বাইরে অন্য কিছু মানুষগুলাের মাথায় ছিল না। রাজনীতিকদের প্ররােচনায় মানুষ দানবে পরিণত হয়েছিল। ব্রিটিশ সিংহ তা হাসিমুখ নিয়ে দেখেছে। কুলদীপ নায়ারের ভাষায়, ‘দয়া বলে কোনাে শব্দ তখন কারাে অভিধানে ছিল না।’ (আত্মজীবনী)। কলকাতা দাঙ্গায় মুসলমান হত্যার বদলা নিতে নোয়াখালীতে দাঙ্গা শুরু এমন। একটি মতামত খুবই প্রচলিত। তবে এর অন্য একটি দিকও রয়েছে। কলকাতা দাঙ্গা উপলক্ষমাত্র। এখানে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য আসল কারণ। সুমিত সরকার লিখেছেন : ‘সেখানে কৃষকরা প্রধানত মুসলমান আর হিন্দুরা মূলত ভূস্বামী, ব্যবসায়ী ও অন্য পেশাদার গােষ্ঠী। গভর্নর বারোজের প্রতিবেদন অনুযায়ী দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার অস্থিরতা হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সাধারণ অভ্যুত্থান নয়, বরং এটি একদল গুপ্তার সংগঠিত কাজ। সাম্প্রদায়িক অনুভূতিকে তার কাজে লাগিয়েছে। নিহতের সংখ্যা কম, কিন্তু সম্পত্তি নাশের পরিমাণ প্রচুর (ম্যানসার, ৮ম খণ্ড)। আমরা জানি গােলাম সারােয়ার ধর্মের দোহাই তুলে দাঙ্গার সূচনা ঘটায় । হিন্দু সম্প্রদায়ের সমৃদ্ধি ঈর্ষার আগুন জ্বালায় । তাতে পােড়ে মানবিকবোধ। আর মান ও সম্পদ। ২৫ অক্টোবর ‘নােয়াখালী দিবস’ উদ্যাপনের পরপরই বিহারে দাঙ্গা শুরু। …নােয়াখালী দাঙ্গার চেয়ে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর এক হত্যাকাণ্ড, সেখানে নিহতের সংখ্যা অন্তত ৭ হাজার। জনগণকে গ্রাস করছে উন্মত্ততা।’ অর্থাৎ সংখ্যাবিচারে বিহার কলকাতাকে ছাড়িয়ে যায়। কলকাতার মতাে বিহারেও দেখা গেছে সরকারি নিষ্ক্রিয়তা, যেজন্য মৃতের সংখ্যা এত বেশি।
ঘটনার দায় বিহার প্রশাসনের গণ্ডি অতিক্রম করে দিল্লির ভাইসরয় অফিস পর্যন্ত পৌছায়, কিন্তু তারপরও তাৎক্ষণিক কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এটা কি ইচ্ছাকৃত? | দাঙ্গা থামাতে বিমান থেকে বােমা বর্ষণের জন্য বিহারি মুসলমানদের আবেদন প্রশাসনে সাড়া জাগায়নি বরং এ প্রসঙ্গে ওয়াভেলের মন্তব্য বিস্ময়কর : ‘বাধ্য না হলে কেউ আকাশ থেকে মেশিনগানের অর্তে অস্ত্র চালায় না, যদিও ১৯৪২-এ এর ব্যবহার করতে আমরা দ্বিধা করিনি’ (ভাইসরয়ের ডায়েরি)। এরপর কি বলা যাবে, ভারতে দাঙ্গা নামক গণহত্যায় শাসকদের কোনাে ভূমিকা ছিল না? কলকাতা দাঙ্গার ভয়াবহতা দেখে ওয়াভেলের বিমর্ষ প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে এ মন্তব্য কি মেলে? নাকি অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর সব দায় চাপাতে এ ধরনের নিষ্ক্রিয়তা। ১৯৪২ সালে ভারত ছাড় আন্দোলন দমন করতে তৎকালীন ভাইসরয় লিনলিথগাে ঠিকই বিমানবহর ব্যবহার করেন। আর সাম্প্রদায়িক হত্যার প্রতিরােধে একজন সেনাপতি-ভাইসরয়ের একই কাজে অনীহা বড় অদ্ভুত! প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের চরিত্র ছিল শয়তানের হাতে খােলা তরবারি তুলে দিয়ে খেলা শুরু করা। আর সে কাজ ভালােভাবেই শুরু করেন বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও কলকাতা মুসলিম লীগের অবাঙালি নেতৃত্ব। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় নরকের আগুন জ্বালে কংগ্রেস-হিন্দু মহাসভাকর্মীসহ হিন্দু-শিখ দুবৃত্ত দল। মুখ্যমন্ত্রী যখন নিজের ভুল বুঝতে পারেন তখন ঘটনা অনেক দূর। এগিয়ে গেছে। তবে এতে জিন্না ও লীগ নেতাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছিল । ভয়াবহ রক্তপাত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করে দেয়। এর দায় কি জিন্না এড়াতে পারেন?
সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক