সিমলা বৈঠকের ব্যর্থতার দায় কার
সিমলা কনফারেন্সের (জুন, ১৯৪৫) ব্যর্থতা ছিল অখণ্ড ভারতের কফিনে বড়সড় একটি পেরেক পুঁতে দেয়ার মতাে ঘটনা। বিষয়টা নিয়ে ইতিপূর্বে আলােচনা হয়েছে। তবু এর ব্যর্থতার দায়দায়িত্ব নিয়ে কিছু আলােচনা দরকার। অতিসংক্ষিপ্ত পর্যালােচনায় দেখা যায়, অচলাবস্থার জন্য এবার দায়ী জিন্নার অনড় দাবি যে, নির্বাহী কাউন্সিলের মােট পাঁচটি মুসলিম আসনের সব কটিই মুসলিম লীগ দল থেকে নিতে হবে। সেই সঙ্গে ভেটো দেয়ার অধিকার। ভাইসরয় ওয়াভেল এই অযৌক্তিক দাবি মেনে নিতে পারেননি। এছাড়াও জিন্না পাঞ্জাব ইউনিয়নিস্ট পার্টি থেকে কাউন্সিলে মুসলিম সদস্য গ্রহণের ঘােরবিরােধী। ফজলি হােসেন, সিকান্দার হায়াত খান থেকে খিজির হায়াত থান পর্যন্ত সেকুলার চরিত্রের ইউনিয়নিস্ট নেতা শাসিত পাঞ্জাবে তখনাে তাদের যথেষ্ট প্রভাব- সে হিসের্বে ভাইসরয়ের সিদ্ধান্ত যুক্তিহীন ছিল না (হডসন)। কংগ্রেস এক্ষেত্রে ইউনিয়নিস্ট পার্টিকে ছাড় দিতে রাজি ছিল তাদের দল থেকে কোনাে মুসলমান নেতা মনােনীত না করে। কিন্তু মুসলিম সদস্য মনােনয়নের ক্ষেত্রে ছাড় দিতে রাজি হননি জিন্না যে জন্য এবং এমনি একাধিক কারণে ওয়াভেল পরিকল্পনার মৃত্যু। যারা বলে থাকেন এবং এ বিষয়ে অভিসন্দর্ভ রচনা করে থাকেন এই বলে যে, ভারতবিভাগ ও পাকিস্তান জিন্নার মূল লক্ষ্য ছিল না, দরকষাকষির অস্ত্র ছিল মাত্র, তাদের এমন দাবি পূর্বোক্ত একাধিক কারণে ধােপে টেকে না। টেকে না। যখন জিন্না মাওলানা আজাদের বক্তব্যের জবাবে বলেন, লীগ ও কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই ভিন্ন এবং পাকিস্তান আইডিয়া ও অখণ্ড ভারতের আইডিয়া পরস্পরবিরােধী। স্বভাবতই লীগ-কংগ্রেসের মধ্যে মতের মিল, মনের মিল এক অসম্ভব বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এ অবস্থায় পাকিস্তানের কোনাে বিকল্পই জিন্নার কাছে গ্রহণযােগ্য হতে পারে না এবং তা হয়নি। এভাবে প্রতিটি ইস্যুতে জিন্নার অনড় সাম্প্রদায়িক অবস্থানের কারণে সিমলার ঠাণ্ডা আবহাওয়া উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সিন্ধান্ত গ্রহণে ঐকমত্য সম্ভব হয় কংগ্রেস অন্য বিষয়ে যা-ই করুক হিন্দু-মুসলমান সংখ্যাসাম্য মেনে নিয়ে জিন্নাকে অনেকটা ছাড় দিয়েছিল সিমলা সম্মেলন সফল করে তুলতে ভারতের মুসলমান সংখ্যা মােট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশেরও কম। সে বিচারে ‘প্যারিটি’ বা সংখ্যাসাম্য যুক্তিসঙ্গত ছিল না। তা ছাড়া ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র মুখপাত্র (সােল স্পােকসম্যান) হওয়ার দাবি থেকে কিছুতেই সরে আসেননি জিন্না- যদিও এ দাবি তখনাে পুরােপুরি সঠিক ছিল না। জিন্নার অযৌক্তিক, অনমনীয় মনােভাব ও আচরণে বিরক্ত ওয়াভেল তার পরিকল্পনা নিয়ে আর এগিয়ে যাননি। হয়তাে রাজনীতিক না হয়ে সেনানী হওয়ার কারণে এমন সিদ্ধান্ত ।
কেন জানি না, সংবিধান প্রণয়ন ও ভারতের ভবিষ্যৎ স্বাধীনতা বিষয়ে ওয়াভেলের ভূমিকা নিয়ে মাওলানা আজাদ ইতিবাচক মনােভাব পােষণ ও প্রকাশ করেছেন। হয়তােবা সংলাপে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা ও নিকট থেকে তাকে দেখা ও তার মতামত জানার কারণে। তবু হঠাৎ আলােচনা বন্ধ করা ওয়াভেলের জন্য। রাজনীতিকসুলভ আচরণ ছিল না বলে হডসনও মনে করেন। কেননা রাজনৈতিক সংলাপে বিশেষ করে সমঝােতামূলক আলােচনায় ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা খুব জরুরি। সেনাপতি ওয়াভেল সহিষ্ণুতার তেমন পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। হয়তাে তাই রাজনীতিবিদ, বিশেষক, এমনকি ভাইসরয়ের কিছুসংখ্যক পরামর্শকেরও অভিমত যে জিন্নার ভেটো দেয়ার ক্ষমতা মেনে নেয়া ভাইসরয়ের পক্ষে যুক্তিসঙ্গত হয়নি। ঠিক হয়নি জিন্নার ওপর ন্যায্য চাপ দিয়ে তাকে সমঝােতায় আনার শেষ চেষ্টা না করে ময়দান ছেড়ে দেয়া, অভিভাবকের দায়িত্ব পুরােপুরি পালন না করা। যে জন্য ভারতবিভাগ অনিবার্য হয়ে ওঠে। ওঠে এ কারণে যে, হটকারী আচরণ সত্ত্বেও লীগ-কংগ্রেস দ্বন্দ্বে জিন্নার অযৌক্তিকঅনমনীয়তা তার পক্ষে ইতিবাচক ফল বয়ে আনে, মুসলমান সমাজে এমন ধারণা ক্রমবর্ধমান হয়ে ওঠে যে, তিনি মুসলমান স্বার্থের জন্য লড়ে যাচ্ছেন। আর শাসকও তাকে অযৌক্তিক ছাড় দিয়ে চলেছেন। ফলে মুসলমান সমাজে জিন্না ও মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। তা ছাড়া ভাইসরয়ের ব্যক্তিগত সদিচ্ছা সত্ত্বেও তাদের বিভাজন-নীতি তখনাে চলমান যা জিন্না ও তার মুসলিম লীগকে সাহায্য করেছে। যেমন ভারতের দুটো গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশের একটি বঙ্গদেশের গভর্নরদের বরাবর দেখা গেছে মুসলিম লীগের প্রতি সমর্থন জুগিয়ে যেতে। সমঝােতার চেষ্টা সত্ত্বেও ব্যর্থতার বােঝা মুসলিম লীগের জন্য ইতিবাচক হয়ে ওঠে। তাই অখণ্ড ভারত নিয়ে সমঝােতার চেষ্টায় ওয়াভেলের ব্যক্তিগত সদিচ্ছা সত্ত্বেও ঘটনার অনিবার্য পরিণতি বেগবান হয়ে ওঠে ভারতবিভাগ ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দিকে। এ বিষয়ে জিন্না ছিলেন অনমনীয় তা ছাড়া এ বিষয়ে আরাে একটি কারণ বিবেচ্য।
আর তাহলাে ভারতীয় রাজনীতির দ্বন্দ্ব ও ভারতের ভবিষ্যৎ স্বাধীনতা সম্বন্ধে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের আপসহীন মনোেভাব, ভাইসরয়কে তার ইচ্ছামতাে খােলা হাতে কাজ করতে না দেয়া। চার্চিলসহ একাধিক রক্ষণশীল দলীয় মন্ত্রীর ধারণা, ভারতীয় রাজনীতিকদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়া পাগলামি বই কিছু নয় (হডসন)। তাই এক্ষেত্রে সদিচ্ছার অভাব কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল না। তবু ঘটনা-বিশ্লেষকগণ হঠাৎ সংলাপ বন্ধ করা এবং তার ফলে সমাধান। খুঁজে পেতে ব্যর্থতার জন্য ভাইসরয়কে দায়ী করেছেন এই বলে যে, তার উচিত ছিল বিকল্প পরিকল্পনার জন্য চেষ্টা চালানাে। হডসনের ধারণা, এতে জিন্নাও বিস্মিত হন, তারও ইচ্ছা ছিল আলােচনা অব্যাহত থাকুক। তবে সবকিছু বিচারে এবং পরবর্তী ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয় জিন্না খুশিও হয়েছিলেন হয়তাে এই ভেবে যে, তার অন্বিষ্ট পাকিস্তান অর্জনের পথে আরাে এক পা এগিয়ে যাওয়া গেল। সিমলা সম্মেলনটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়েছিল সবার পক্ষ থেকেই। এবং এখনাে ভারতবিভাগ বিচারে তা মনে করা হয়ে থাকে। সেটা হঠাৎ করে সাতড়াতাড়ি শেষ করে দেয়া রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচায়ক ছিল না অনেকের মতে, এ পদক্ষেপ ভারতবিভাগের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে। আশ্চর্য যে, তা সত্ত্বেও সিমলা বৈঠক ভেঙে যাওয়ার পর দুই পরস্পরবিরােধী শক্তি লীগ-কংগ্রেস উভয়ের পক্ষ থেকে ভাইসরয় ওয়াভেলের উদ্দেশে প্রশংসাবাণী উচ্চারিত হয়েছে এই বলে যে তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। কথাগুলাে বলেছেন তকালীন কংগ্রেস সভাপতি মাওলানা আজাদ এবং মুসলিম লীগ সভাপতি মােহাম্মদ আলী জিন্না। এ প্রশংসা মূলত ভাইসরয়ের সদিচ্ছার কারণে এবং ভাইসরয়ের পক্ষ থেকে ব্যর্থতার দায়ভার গ্রহণের কারণে। শেষােক্ত বিষয়টাই হয়তাে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তার সদিচ্ছার দাম রাজনীতিকরা দেননি, এক্ষেত্রে বিশেষ করে জিন্না । তার জেদ, তার অনমনীয় মনােভাব সমঝােতার অনুকূল ছিল না। আগেও বলেছি, একাধিক ঘটনা প্রমাণ করে যে সমঝােতা-সংলাপ ভেঙে এগিয়ে যাওয়া হয়ে উঠেছিল জিন্নার নীতি। সা, দেশাই-লিয়াকত ইত্যাদি প্রস্তাব একের পর এক নাকচ করে দেয়ার দায় তাে পুরােপুরি মি. জিন্নারই সে কথা তিনি অস্বীকার করতে পারেন না।
সিমলা বৈঠকের ব্যর্থতার মূল গায়েন জিন্না হলেও একে বিকল্প পরিকল্পনায় টেনে না নেয়ার কারণ আসলে ওয়াভেল নন, কারণ ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত যা পরবর্তী সময়ের তথ্যাদি থেকে জানা যায়। ব্রিটেনে আসন্ন সাধারণ নির্বচনের ফল ও ক্ষমতাসীন সরকারের নীতি সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়ার জন্যই এই সময়ক্ষেপণ। সমঝােতা যখন হচ্ছেই না, তখন কী দরকার তা টেনে নিয়ে অযথা শ্রম ও সময় ব্যয় করা? বরং ওটাকে সময়ের হাতে তুলে দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলা ভালাে। পরবর্তী সরকার এসে যা ভালাে বুঝবে করবে। সেই বিশুদ্ধ বেনিয়াবুদ্ধি, চতুর ব্রিটিশ রাজনীতি। তাই সিমলা ব্যর্থতার দায় ওয়াভেলের নয়। সংলাপ টেনে নিলেও সুফল মিলতাে না। প্রসঙ্গত ভারতের স্বরাজ ও স্বাধীনতা সম্পর্কে চার্চিলের বিরূপ মনােভাবের গুরুত্ব মনে রাখা উচিত। বিষয়টি নানা ঘটনা উপলক্ষে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের হস্তক্ষেপের কারণে বিষয়টা নিষ্পত্তির দিকে যেতে পারেনি। শুধু ১৯৪২ বা ১৯৪৪-এই নয়, বরাবরই ভারত সম্পর্কে চার্চিলের মনােভাব ছিল নেতিবাচক এবং ভারতসচিব আমেরির বিচারে তা “হিটলারসুলভ’ একনায়কের। মার্চ ১৯৪৫-এ চার্চিল ওয়াভেলকে বলেন, ভারতের সমস্যা যতদিন সম্ভব বরফচাপা দিয়ে রাখা উচিত। ভাইসরয়ের মনে হয়েছে চার্চিল ভারতকে পাকিস্তান, হিন্দুস্তান, প্রিন্সস্তান ইত্যাদি নানাভাগে ভাগ করে দেয়ার পক্ষপাতী’ (বড়লাটের রােজনামচা’, উদ্ধৃতি সুমিত সরকার)। ভারতের জন্য এটা ভালো কী মন্দ তা নিয়ে নানাজনে নানাভাবে বিচার করতে পারেন, তবে এটা ঠিক যে, মন্দের ভালাে হিসেবে জুলাই নির্বাচনে (১৯৪৫) ব্রিটেনে শ্রমিক দল (লেবার পার্টি) বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী এবং ক্লিমেন্ট অ্যাটলি প্রধানমন্ত্রী, ক্রিপস সাহেবও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী। তাদের ইচ্ছা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভারতীয় রাজনীতিকদের সঙ্গে সমঝােতায় পৌছাতে পারা। তবে কিছুসংখ্যক শ্রমিক দলীয় নেতাও এমন চিন্তা সুনজরে দেখেননি, যেমন পররাষ্ট্রসচিব বেভিন। কাজেই ভারতের স্বরাজ বা স্বাধীনতা নিয়ে টানাপড়েন একটা স্থায়ী বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। একটি বিষয় এ পর্যায়ে স্পষ্ট করা দরকার যে, সিমলা বৈঠকে এবং এর আগেও সরকারপক্ষ থেকে জিন্নার সঙ্গতঅসঙ্গত দাবির প্রতি অস্বাভাবিক নমনীয়তা দেখানাে হচ্ছিল এবং তা ছিল ব্রিটিশনীতির অংশবিশেষ। তখনাে জিন্না ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র মুখপাত্র’ হওয়ার বাস্তব যােগ্যতা অর্জন তথা জনসমর্থন লাভ করেননি। এবং তা সরকারি মদত, প্রাদেশিক গভর্নরদের অযৌক্তিক সহযােগিতা সত্ত্বেও।
এ অবস্থার প্রতিফলন দেখা গেছে প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা ভাঙা-গড়ার মধ্যেও যদিও শাসকশ্রেণির চেষ্টা চলেছে মুসলিম লীগকে ক্ষমতার আসনে বসিয়ে রাখার জন্য। গুরুত্বপূর্ণ পাঞ্জাব প্রদেশে ইউনিয়নিস্ট পার্টির প্রধান খিজির হায়াত খানের নেতৃত্বে জিন্নার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে গঠিত (১৯৪৪) মন্ত্রিসভা, কংগ্রেস নেতারা কারামুক্ত হওয়ার পর সীমান্ত প্রদেশে আবার ডা. খান সাহেবের নেতৃত্বে লালকুর্তা-কংগ্রেস যুক্তমন্ত্রিসভা গঠিত হয়। মার্চ ১৯৪৫-এ বঙ্গে নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভার পতন, কিন্তু গভর্নর বিকল্প মন্ত্রিসভা গঠন করতে না দিয়ে নিজের হাতে ক্ষমতা ধরে রাখেন। আসাম ও সিন্ধুতে নড়বড়ে লীগ মন্ত্রিসভা যে কোনাে সময় পতনের অপেক্ষায়। ঘটনাগুলাে জিন্নার একমাত্র মুখপাত্র হওয়ার দাবির পক্ষে যায় না। এ সময়টাতে জিন্না খােশ মেজাজে ছিলেন না। তাই কোনাে প্রকার সমঝােতার নীতির প্রতি তিনি সহযােগিতার হাত বাড়াতে রাজি হননি। তার এ নীতি ১৯৩৭-৩৮ পরবর্তী সময় থেকেই, যে জন্য ১৯৪৪-এর সেপ্টেম্বরে গান্ধি-জিন্না আলােচনাও কোনাে সুফল তৈরি করতে পারেনি। এমনকি ১৯৪৫-এ জাপানের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার (১৫ আগস্ট, ১৯৪৫) পর জিন্নার চিরাচরিত দাবি- এবার পাকিস্তান চাই’ । তার বক্তব্য : যুদ্ধের কারণে মুসলিম লীগ এতদিন ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে সহযােগিতা করে এসেছে। আর অপেক্ষা নয় ।এখন পাকিস্তান নিয়ে আলােচনায় বসতে হবে। এরপরও কী বলা যায়, জিন্না পাকিস্তান চাননি? জিন্নার কথার জবাবে স্যার ক্রিপস বলেন : তথাস্তু । আলােচনায় পাকিস্তান দাবি অবশ্যই প্রাধান্য পাবে। তার আগে সাধারণ নির্বাচন হয়ে যাক যা যুদ্ধের কারণে স্থগিত ছিল। ভাইসরয় এ প্রস্তাবে সম্মতিসূচক মাথা নাড়েন। লীগপ্রধান জিন্না আবারাে জানিয়ে দেন যে, পাকিস্তানভিত্তিক আলােচনা ছাড়া কোনাে সমাধানই মুসলিম লীগের কাছে গ্রহণযােগ্য বিবেচিত হবে না। অন্যদিকে কংগ্রেস অসন্তুষ্ট ভাইসরয় ওয়াভেলের ঘােষণায় ভারতের স্বাধীনতা প্রসঙ্গ না থাকায় ।
এবার নয়া ভারতসচিব লর্ড পেথিক লরেন্স। ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে যুদ্ধংদেহী উত্তাপ লক্ষ করে নয়া ভারতসচিব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত । তদুপরি গােদের ওপর বিষফোঁড়া আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার নিয়ে ভারতীয় প্রতিক্রিয়া যা সহিংসতার জন্ম দিতে পারে। তাই তার ঘােষণা : ভারতকে কমনওয়েলথে স্বাধীন সহযােগী হিসেবে পাওয়ার প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করা হবে। এ উদ্দেশ্যে শিগগিরই ভারতে সর্বদলীয় সংসদীয় প্রতিনিধি দল পাঠানাে হবে, যাতে ভারতীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে দ্রুত আলােচনা শুরু করা যায় (হডসন)। সব কিছুর হিসাবে বলা যায় রাজ-কংগ্রেস-লীগ এই ত্রিশক্তিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে নৈরাজ্যিক পরিস্থিতির প্রকাশ তা মধ্য-পঁয়তাল্লিশে এসেও শেষ হয়নি। বরং তা ক্রমশ ঘনীভূত ও জটিলতর রূপ নিতে শুরু করে। ব্রিটেনের নয়া মন্ত্রিসভা তাতে কোনাে প্রভাব ফেলতে পারেনি। এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিচার-বিবেচনার যােগ্য যা মানসার-এর বিশাল ট্রান্সফার অব। পাওয়ার’ গ্রন্থমালায় উদ্ভূত। লীগ-কংগ্রেস দ্বন্দ্ব ও হিন্দু-মুসলিম বিভেদ ভারতীয় রাজনীতিতে কতটা প্রভাব তৈরি করেছিল তার আভাস মিলবে সঙ্কট থেকে মুক্তির লক্ষ্যে মাওলানা আজাদের ভাবনা ও পরিকল্পনায় । লীগ-কংগ্রেস রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব কেউ কেউ দেখতে চেয়েছেন সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের পরিবর্তে সংখ্যাগুরু বনাম সংখ্যালঘু স্বার্থের দ্বন্দ্ব হিসেবে। বিষয়টা যেভাবেই দেখা যাক না কেন শেষ পর্যন্ত সেটা সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বে দাঁড়িয়ে যায় । অন্তত এটুকু মানতে হয় যে, সংখ্যাগুরু বনাম সংখ্যালঘু স্বার্থের বিষয়টাকেই জিন্না দ্বিজাতিতত্ত্বের মাধ্যমে ধর্মীয় তথা সাম্প্রদায়িক রূপে উপস্থাপন করেন, যা শেষ পর্যন্ত ছিল ধর্মীয় সহিংসতার অশুভ বার্তাবাহক। সে অশুভ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার পক্ষে তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি মাওলানা আজাদ গান্ধিকে তার নিজস্ব চিন্তা ও পরিকল্পনার কথা লেখেন (২ আগস্ট, ১৯৪৫)। মাওলানা আজাদের প্রর্থম চিন্তা মুসলিম লীগের বাইরে মুসলমান সংগঠনগুলােকে ঐক্যবদ্ধ করা যাতে তারা ভারতীয় মুসলমানের স্বার্থরক্ষার মধ্য দিয়ে ভবিষ্যৎ সংবিধান তৈরির পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ করতে পারে এবং তা এমন সংবিধান যা তাদের স্বার্থহানির ভয় দূর করতে পারে।
একমুখী সরকার যেমন ব্যর্থ হতে বাধ্য, তেমনি ভারতবিভাগও, যা তার মতে মুসলমান স্বার্থের পরিপন্থী। আজাদের মতে বিভাজন পরাজিতের মনােবৃত্তি যা কিছুতেই গ্রহণযােগ্য হতে পারে না। তাই সঠিক ভবিষ্যৎ সংবিধানে ভারত হবে একটি ফেভারেল কাঠামাের রাষ্ট্র যেখানে ইউনিটগুলাে (প্রদেশ) সম্পূর্ণ স্বশাসনের অধিকারী হবে এবং তাদের মতামতভিত্তিতে কেন্দ্রের অধীনস্থ বিষয়গুলাের নির্ধারিত হবে। ইউনিটগুলাের বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার থাকবে। কেন্দ্রে ও প্রদেশে যুক্তনির্বাচন ব্যবস্থা চালু থাকবে। কেন্দ্রে আসন হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সমসংখ্যার ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে। কেন্দ্রীয়প্রধান পর্যায়ক্রমে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায় থেকে মনােনীত বা নির্বাচিত হবেন। আশ্চর্য, প্রায় চার দশক আগে রাজনীতিক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নিরসনের চেষ্টায় রবীন্দ্রনাথ নীতিগতভাবে প্রায় একই রকম প্রস্তাব রাখেন প্রাদেশিক কংগ্রেসের পাবনা সম্মেলনে সভাপতির দীর্ঘ ভাষণে । কংগ্রেস নেতৃত্ব তাতে কান দেয়নি। এ প্রস্তাবে গান্ধি আজাদকে থামিয়ে দেন এই বলে যে, কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে তার এ মতামত এই মুহূর্তে প্রকাশিত হওয়া উচিত নয়। এতে অন্যদের চিন্তার প্রতিফলন নেই। তাছাড়া কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে আলােচনা না করে কোনাে রকম প্রস্তাব প্রকাশ্যে আনা ঠিক হবে না। তার অর্থাৎ গান্ধিরও এ বিষয়ে ভিন্নমতের অবকাশ রয়েছে। গােটা বিষয়টা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার অবকাশ রয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। তখনকার লীগ-কংগ্রেস দ্বন্দ্বে এবং বিরাজমান পরিস্থিতি বিবেচনায় মাওলানা আজাদের প্রস্তাব অনেকটাই বাস্তবধর্মী ছিল যা হয়তােবা সবার কাছে গ্রহণযােগ্য মনে হতে পারত। কিন্তু গান্ধি সে সম্ভাবনা নষ্ট করে দেন। এবার দায় জিন্নার নয়, গান্ধির । এ প্রস্তাব ব্রিটিশ সরকারের সমর্থন পেতে পারত, অন্তত কেবিনেট মিশন প্রস্তাবের আলােকে এমন ধারণা অবাস্তব নয়। ভারতবিভাগ রােধের একটি সম্ভাবনার এভাবে মৃত্যু ঘটে হয়তাে কংগ্রেসের পক্ষে অতিপ্রাপ্তির লােভে। এবং রাজনৈতিক রথের যাত্রা নিশ্চিত হতে থাকে ভারতবিভাগের দিকে।
সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক