১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ আজকের এদিনে
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী
বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সরকারের ভ্রাম্যমাণ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনে বলেছেন, বাংলাদেশে বেসামরিক প্রশাসন চালানোর জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক জন বেসামরিক ব্যক্তিকে গভর্নর নিযুক্ত করায় বাংলাদেশের জনগনের মনে কোন উত্তেজনা বা উৎসাহ সৃষ্টি হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানের নতুন বেসামরিক গভর্নর হিসেবে ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিককে নিয়োগের ঘোষণার পর তিনি এই মন্তব্য করেন। তিনি বলেন মালিক হল ইয়াহিয়া খানের কুইস্লিং। তার সাথে বাঙ্গালীদের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন ইয়াহিয়ার সৈন্য বাহিনীকে বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ না করা পর্যন্ত বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ ক্ষান্ত হবেনা। তিনি বলেন বাঙ্গালীদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশে এখন দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেছেন। [যুগান্তর ২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
‘লা ফিগারো পত্রিকায় ইয়াহিয়ার সাক্ষাৎকার
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া প্যারিস থেকে প্রকাশিত ‘লা ফিগারো’ পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে বলেন, ‘ভারত যদি এতে বাড়াবাড়ি করে তবে সর্বাত্মক যুদ্ধ করতে হবে। ’তিনি বলেন, ‘কিছু কিছু সীমান্ত ছাড়া সব জায়গাই এখন সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে’। এক প্রশ্নের জবারে তিনি জানান, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করে দেশদ্রোহীদের বিতাড়িত করেছি।’ তিনি বলেন আমি বিশ্বকে হুশিয়ার করে দিতে চাই ভারত যদি মনে করে থাকে যে তারা বিনা উস্কানিতে আমাদের ভূখণ্ডের কিছু দখল করতে পারবে তা হলে তারা মারাত্মক ভুল করবে। দেশের সঙ্কটকালে এটা ফাঁস হয়ে গেছে যে বিদ্রোহীদের পিছনে পুরোভাগে রয়েছে ব্রিটেন। পূর্ব পাকিস্তান সঙ্কটে তিনি চীন ও ফ্রান্সের ভুমিকার প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেওন তিনি জনগনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তিনি বলেন আমি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করেছি কিন্তু তাদের সকল পরিষদ সদস্যদের আসন বাতিল করিনি। তিনি বলেন ভারত শরণার্থীদের পুজি হিসেবে ব্যাবহার করছে। [ইত্তেফাক/পাকিস্তান ২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
৪৮ জন এমপিএকে সামরিক আদালতে সমন
রাজশাহী অঞ্চলের নির্বাচিত ৪৮ জন এমপিএ’কে ৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ২ নম্বর সেক্টরের (নাটোর) উপ-সামরিক আইন প্রশাসকের কাছে বিচারের জন্যে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। এরা হলেন রংপুরের আবিদুল ইসলাম, আজহারুল ইসলাম, করিম উদ্দিন, এলাহি বক্স, সিদ্দিক হোসেন, গাজী রহমান, শামসুল হক চৌধুরী, আব্দুল হাকিম, আবুল হোসেন, আব্দুল্লাহ সোহরাওয়ারদি, নুরুল ইসলাম, এমএ তালেব মিয়া, ওয়ালিউর রহমান, আজিজুর রহমান, দিনাজপুরের কমর উদ্দিন আহমেদ, সেরাজুল ইসলাম, ফজলুল করিম, গোলাম রহমান, এসএম ইউসুফ, আবিদুর রহমান, খতিবুর রহমান, সরদার মশাররফ হোসেন, বগুড়ার সাইদুর রহমান, কসিম উদ্দিন, রাজশাহীর ডাঃ মইন উদ্দিন আহমেদ, ডাঃ মেসবাহুল হক সাচ্চু। (আংশিক) [ইত্তেফাক/ পূর্বদেশ /অবজারভার/ আজাদ/ মর্নিং নিউজ/ সংগ্রাম ২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
সামরিক আদালতে ১৩ জন সি.এস.পি অফিসারকে তলব
১৩ জন সি.এস.পি অফিসারকে ৬ নং উপ সামরিক আইন প্রশাসকের সামরিক আদালতে ৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যে হাজির হবার নির্দেশ দেয়। ১৩ জন হলেন ১) খন্দকার আসাদুজ্জামান ২) হাসান তৌফিক ইমাম ৩) আব্দুস সামাদ ৪) নুরুল কাদের খান ডিসি পাবনা ৫) সৈয়দ আব্দুস সামাদ উপসচিব ৬) কুদ্রতে এলাহি চৌধুরী এডিসি রাজশাহী ৭) খস্রুজ্জামান এসডিও কিশোরগঞ্জ ৮) কাজী রকিবুদ্দিন এসডিও ব্রাহ্মনবারিয়া ৯) অলিউল ইসলাম এসডিও মাগুরা ১০) আকবর আলি খান এসডিও হবিগঞ্জ ১১) কামাল সিদ্দিকি এসডিও নড়াইল ১২) তৌফিক এলাহি চৌধুরী এসডিও ঝিনাইদহ ১৩) সাদত হসাইন সহকারী কমিশনার (আংশিক)। [ইত্তেফাক/ পূর্বদেশ /অবজারভার/ আজাদ/ মর্নিং নিউজ/ সংগ্রাম ২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
কয়েকজন অধ্যাপককে সামরিক আদালতে তলব
এদিন সামরিক কর্তৃপক্ষ (খ) কয়েকজন অধ্যাপককে ৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। এরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মোজাফফর আহমদ, আবদুর রাজ্জাক, ইংরেজি বিভাগের সারওয়ার মুর্শেদ বাংলা একাডেমীর আবু জাফর শামসুদ্দীন বাংলা বিভাগের মাজহারুল ইসলাম প্রমুখ। (আংশিক) [ইত্তেফাক/ পূর্বদেশ /অবজারভার/ আজাদ/ মর্নিং নিউজ/ সংগ্রাম ২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
নাসিরাবাদ থেকে অস্র উদ্ধার।
এপকাফ এর একটি টহল দল দেশপ্রেমিক জনগনের সহযোগিতায় নাসিরাবাদ বস্তিতে এক আক্রমনে ৯জন ভারতীয় দুষ্কৃতিকারী হত্যা করেছে। বাকিরা পালিয়ে যায়। পরে এপকাফ বস্তিতে ঢুঁকে বিপুল অস্র উদ্ধার করে। বস্তির অধিবাসীরা দুষ্কৃতিকারীদের সহযোগিতা করার কথা স্বীকার করে। এখান থেকে ৯টি রাইফেল ৩টি স্টেনগান, ৫টি শট গান, ৩৯টি গ্রেনেড, ৪৩টি মাইন কয়েকশত কাট্রিজ উদ্ধার করে। (আংশিক) [ইত্তেফাক/ পূর্বদেশ /অবজারভার/ আজাদ/ মর্নিং নিউজ/ সংগ্রাম ২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
গভর্নর টিক্কা খানের কুষ্টিয়া এলাকা সফর
গভর্নর টিক্কা খান এ সময় কুষ্টিয়া এলাকা সফরে গেলে কাইয়ুম মুসলিম লীগের (sobur khan)জয়েন্ট সেক্রেটারি ও আইউব আমলের জাতীয় পরিষদের সাবেক সদস্য মনসুর আলী তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানান। তিনি (মনসুর আলী) বলেন ‘দেশের জন্যে কাজ করতে গিয়ে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কুষ্টিয়া এলাকার পুনর্গঠনে কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকার সাহায্য প্রয়োজন।’ (আংশিক) [ইত্তেফাক/ পূর্বদেশ /অবজারভার/ আজাদ/ মর্নিং নিউজ/সংগ্রাম ২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
নতুন গভর্নর এর প্রতি অভিনন্দন
ডা. মালিক নতুন গভর্নর নিযুক্ত হওয়ায় পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির সহ সভাপতি সৈয়দ আজিজুল হক নান্না মিয়া (শেরে বাংলার ভাগ্নে), পাকিস্তান দরদী সঙ্ঘের সভাপতি মওলানা এ.টি. সাদী, ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগের সাধারন সম্পাদক ও শান্তি ও কল্যাণ সমিতি সাধারন সম্পাদক মৌলানা নূরুজ্জামান, কৃষক শ্রমিক পার্টির সহ-সভাপতি জয়নাল আবন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও গভর্নর মালিকের প্রতি অভিনন্দন জানিয়েছেন।
নতুন গভর্নর এ এম মালিক বলেছেন তিনি জাতির উদ্দেশে আগামী শুক্রবার ভাষণ দিবেন। (আংশিক) [ইত্তেফাক/ পূর্বদেশ /অবজারভার/ আজাদ/ মর্নিং নিউজ/ সংগ্রাম ২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
শরণার্থী
প্রাদেশিক সরকার ভারতে শরণার্থী যাওয়াদের জেলাওয়ারী একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায় ভারতে যাওয়া শরণার্থীর সংখ্যা ২০ লাখের সামান্য বেশী। এ হিসেবে ভারতে যাওয়া শরণার্থীর সংখ্যা সবচে বেশী দিনাজপুর জেলায় ২ লাখ ৬০ হাজার। সবচে কম টাঙ্গাইলে এ জেলার একজনও শরণার্থী হিসেবে ভারতে যায়নি। তারপর হল পটুয়াখালী সংখ্যা মাত্র দুই। [যুগান্তর ২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
বিবিসির টেলিভিশন সংবাদ বুলেটিন
আজ বিবিসির টেলিভিশন সংবাদ বুলেটিনে বাংলাদেশের উপর দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রচারিত হয়। বিবিসির সাংবাদিক মারটিন বেল ভারত ঘুরে গিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করেন। তিনি মুক্তিবাহিনী এবং শরণার্থীদের উপর কিছু চিত্রধারন করে নিয়েছিলেন। তা সেই প্রতিবেদনে দেখানো হয়। তিনি বলেছেন মুক্তিবাহিনী পাকিস্তান বাহিনী থেকে দখল করা বিপুল চীনা অস্র তাদের বিরুদ্ধে ব্যাবহার করছে। তিনি মত প্রকাশ করেন বাংলাদেশের বাস্তবতা খুব কাছেই।
দালাল তৎপরতা
লাহোরে মাহমুদ আলী
পিডিপি ভাইস প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আলী লাহোরে আইনজীবীদের উদ্দেশে বলেন পাকিস্তানের অখণ্ডতা এবং আদর্শিক সংহতি অক্ষুন্ন রাখার উদ্দেশে পাকিস্তানের আদর্শ পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন অত্যন্ত প্রয়োজন। তিনি বলেন পাকিস্তান শুধু ইসলামের জন্য ই প্রতিষ্ঠা হয়নি পাকিস্তান হয়েছে হিন্দুদের কাছ থেকে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানোর জন্য। এ ছাড়াও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় জনগনের সংকল্পও কাজ করেছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য কায়েদে আজমকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যই এত দূরত্ব সত্ত্বেও পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিয়াছিল। তিনি আর বলেন বিচ্ছিন্নতাবাদ দমনের জন্য সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ যাহা করেছে তাহা যুক্তিযুক্ত ছিল। এ কাজের জন্য তিনি আবারও সেনাবাহিনীর প্রতি অভিনন্দন জানান। তিনি আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবুর রহমানকে ভারতের যোগসাজশে পাকিস্তান ভাঙ্গার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার জন্য অভিযুক্ত করেন। তিনি বলেন বহি বিশ্ব এ পাকিস্তানের বন্ধু কমানোর জন্য ভারত চেষ্টা করে যাচ্ছে। তিনি বলেন কতিপয় সাম্রাজ্য বাদী শক্তি শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের সাথে একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য পাকিস্তানকে চাপ দিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন আওয়ামী লীগ স্বায়ত্তশাসন চায়না কিন্তু সরকার ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব মোতাবেক পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে চায়। (আংশিক) [ইত্তেফাক/ পূর্বদেশ /অবজারভার/ আজাদ/ মর্নিং নিউজ/সংগ্রাম ২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
ভারতের তৎপরতা
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে বাংলাদেশ ও ভারতের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য কলকাতা এসেছেন। এসময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন তিনি কখনও বলেননি শরণার্থীরা ৬ মাসের মধ্যে দেশে ফিরে যেতে পারবে তিনি বলেন তিনি বলেছিলেন শরণার্থীদের পিছনে সরকারের ৬ মাসের খরচ কত হবে। তিনি বলেন জাতিসংঘ তার বক্তব্য এর সেই অর্থ করেছে। তিনি বলেন তিনি এ কথাও বলেননি যে কলকাতায় বাংলাদেশের মিশন স্থাপন হয়েছে যার অর্থ দাড়ায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। তিনি স্বীকার করেন তিনি বলেছিলেন বাংলাদেশ সরকারের কলকাতার মিশন প্রধান বাংলাদেশ সরকারের মুখপাত্র। তিনি বলেন তিনি শরণার্থীদের স্থানান্তর করার জন্য প্রচেষ্টা নিয়েছেন। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন পাকিস্তান কখন ভারত আক্রমন করতে পারে তা তিনি জানেন না। তিনি বলেন আসামে শরণার্থীদের সাথে কিছু পাকিস্তানী গুপ্তচর মিশে আছে। প্রধানমন্ত্রীর সফর সঙ্গী ছিলেন পদ্মজা নাইডু, ডি পি ধর এবং ভবানী মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন শেখ মুজিবের বিচারে কি হয় তা দেখা যাক। সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলাদেশ/পশ্চিমবঙ্গ বিষয়ক কেন্দ্রীয় দফতর বিহীন মন্ত্রী সিদ্ধার্থ সঙ্কর এয়ায় উপস্থিত ছিলেন। সন্ধ্যায় তিনি দিল্লী ফিরে যান। [যুগান্তর ২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
Prepared by Salah Uddin