বাংলার বাণী
ঢাকা: ২১ এপ্রিল শনিবার, ৮ই বৈশাখ, ১৩৮০
খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হবে
সম্প্রতি প্যারিস থেকে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। আগামী মৌসুমের ফসল যদি ভালো না হয় তাহলে বিশ্বের একটি বিরাট অংশ দুর্ভিক্ষের কবলে পতিত হবে। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার (ফাও) পরিচালক এডিক বোমি এবং ফ্রান্সের একটি সাধ্য দৈনিক লা বন্ডের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে একথা উল্লেখ করেছেন। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা পরিচালকের মতে ভারত সহ এশিয়ার কয়েকটি দেশ এবং আমেরিকার কয়েকটি দেশ বর্তমানে দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বারবার উপর্যপুরী ফসল উৎপাদন না হওয়ায় ও জোড়াতালি দেয়া অর্থনীতি কারণে পশ্চিম আমেরিকার দেশগুলোতে এবং ভারতের কয়েকটি দেশে দুর্ভিক্ষ মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিঃ এডিক বোমি আরো বলেছেন, দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা রয়েছে এমন সব দেশগুলিতে শিল্পায়নের পরিবর্তে কৃষির উপর তাদের শক্তি কেন্দ্রীভূত করা উচিত। মিঃ বোমি আগামী সাধারণ অধিবেশনে প্রত্যেকটি সদস্য দেশের প্রতি জরুরি অবস্থার জন্য কিছু খাদ্য মজুদ করার প্রস্তাব দেবেন বলে জানিয়েছেন। এর ফলে যেসব দেশে দুর্ভিক্ষ অবশ্যম্ভাবী হয়ে দেখা দেবে সে সকল দেশ থেকে খাদ্যশস্য নিতে পারবে বলে তিনি মনে করেন।
ফাও এর পরিচালকের এই গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যটি অত্যন্ত সময়োপযোগী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খাদ্য পরিস্থিতির জরিপ কাজ সম্পাদনা করার পর তিনি যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন তার পরিপ্রেক্ষিতেই এই অভিমত প্রকাশ করেছেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত ও বাংলাদেশের খাদ্য পরিস্থিতি যে আশঙ্কাজনক তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। বাংলাদেশের নব প্রতিষ্ঠার এই পর্বে সবচেয়ে বড় সমস্যা হল খাদ্য ঘাটতি। স্বাধীনতার পর থেকেই সরকার এই খাদ্য ঘাটতি পূরণের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
তাঁতহীন তাঁতীদের বিরুদ্ধে কঠোর হোন
সমবায় আন্দোলনেও অবশেষে ভূতের বাসা আবিষ্কৃত হয়েছে। সমবায় মন্ত্রী জনাব মতিউর রহমান সম্প্রতি এক সাংবাদিক সম্বেলনে তথ্য প্রকাশ করে বলেছেন যে, বর্তমানে বাংলাদেশের সমবায় সমিতির অন্তর্ভুক্ত তাঁতী সমবায় সমিতির মধ্যে অর্ধেকেরেও বেশি ভূয়া তাঁতী রয়েছে। এইসব ভূয়া তাঁতীদের কোন তাঁত নেই এবং এমনকি তাঁত সম্পর্কে এদের কোন রকম সাধারন জ্ঞানও নেই । তাঁতী সমবায় সমিতির সদস্য এই সব ভুয়া তাঁতীরা সমবায় ব্যবস্থার মাধ্যমে সুতো পাচ্ছে। সেই সূতো বাজারে চড়া দামে বিক্রি করে দিচ্ছে। ফলে, প্রকৃত তাঁতীরা চড়া দামে সুতো কিনে কাপড় তৈরী করছে। এ জন্যেই দশ টাকার কাপড়ের দাম ষাট টাকা হয়েছে।
সমবায় মন্ত্রী মহোদয় সাংবাদিকদের কাছে জানিয়েছেন, বর্তমানে বাংলাদেশে রেজিষ্ট্ৰাকৃত মোট তাঁতের সংখ্যা হচ্ছে সাত লক্ষ বাইশ হাজার। কিন্তু এর মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ ভাগেরও বেশী রয়েছে ভূয়া তাঁতীর সংখ্যা। দেশে প্রতি বছর প্রায় চার কোটি গজ কাপড় প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে চার লক্ষ তাঁতে মাত্র আঠারো থেকে কুড়ি কোটি গজ কাপড় তৈরী করা সম্ভব। স্বাধীনতা পূর্ব দেশে বিয়াল্লিশ কোটি গজ কাপড় তৈরী করা হতো বলে তিনি জানান।
সমবায় মন্ত্রীর তথ্যানুযায়ী দেখা যাচ্ছে যে, ভূয়া তাঁতীরাই বাংলাদেশের সমবায় আন্দোলনকে বানচাল করার জন্য ভূয়া তাঁতী সমবায় সমিতি গঠন করে অসাধু উপায়ে সুতোর দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। যারা প্রকৃত তাঁতী তারা সুতোর অভাবে কাজ করতে পারছি না এবং সুতো চড়া দামে কিনে কাপড় তৈরী করছে । এতে যে শুধু কাপড় তৈরীর হারই কমে গেছে তা নয়, এ ব্যবস্থার ফলে তাঁতীরা বাধ্য হয়েই কাপড়ের মূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। অর্থাৎ ভুয়া তাঁতীদের অসাধুপনার খেসারত মলতঃ দেশের সাধারণ মানুষকেই দিতে হচ্ছে কড়ায়-গণ্ডায় ।
সমবায় মন্ত্রী দেশের সমবায় আন্দোলনে প্রাণ সঞ্চার করতে উদ্যোগ নিয়েছেন এবং এজন্যে তিনি আগামী সাতই মের মধ্যে ভূয়া তাঁতী সমবায় সমিতির ভূয়া সদস্য ও কর্মকর্তাদের অবৈধ পারমিট বিভাগীয় কতৃপক্ষের কাছে জমা দেয়ার নিদেশ দিয়েছেন। এই নির্দেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী কাঠার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন।
এ প্রসঙ্গে আমরা বলতে চাই যে, পর্যবেক্ষণ করে যখন ধরা পড়েছে যে, দেশের মোট তাঁতের সংখ্যানুপাতে অর্ধেকেরও বেশী তাঁত ভুয়া এবং বানোয়াট, তখন এইসব ভয়া তাঁতীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কেন গ্রহণ করা হবে না? এই সব ভূয়া তাঁতীরা কি সমবায়ের মাধ্যমে সুতো পেয়ে তা কালোবাজারী করে নি? দেশে বর্তমানে যে কাপড় সংকট দেখা দিয়েছে ও অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে তার মূলে রয়েছে এইসব ভূয়া তাঁদের অসাধু-কৃর্তি । এর ফলে সমবায় আন্দোলনেরও যথেষ্ট ক্ষতি হচ্ছে। ফলে এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে শুধু এ কথা মুখে মুখে উচ্চারণ করলেই হবে না, ভুয়া তাঁতীরা যেন কোন ক্রমেই সমবায়ের মাধ্যমে আয় সুতো না পায় সে ব্যবস্থা চুড়া করতে হবে। এবং তাঁতী সমবায় সমিতি থেকে ভুয়া তাঁতীদের সম্পর্ণরূপে বর্জন করতে হবে। নইলে যাদের ঢাল-তলোয়ার কিসসু নেই, তারাই নিধিরাম সর্দার হয়ে বসবেন। কাজেই সরকারকে অবিলম্বে তাঁতহীন তাঁতীদের বিরুদ্ধে যথাযোগ্য আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতি মনোযোগী হতে অনুরোধ জানাই।
আর কতকাল ডুডু-তামাকু এক সাথে খাবেন?
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের উপসচিব মিঃ কেনেথ রাশ ও মিঃ জোসেফ সিসকো গত ১৮ই এপ্রিল মাত্র পাঁচ ঘণ্টার জন্য বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা সফরে এসেছিলেন। ঢাকায় তারা প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে ঘন্টাখানেক ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেনের সাথে ঘন্টাখানেক পারস্পারিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট উপমহাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি ও বিভিন্ন বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তারপর কাঠমুন্ডু চলে গেছেন।
কাঠমান্ডু যাওয়ার পথে ঢাকা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সাথে আলোচনাকালে এক প্রশ্নের জবাবে মিঃ কেনেথ রাশ বলেছেন, আমেরিকা যে আবার পাকিস্তানকে সমরাস্ত্র দিচ্ছে তাতে উপমহাদেশের শান্তির চেষ্টা বিঘ্নিত হবে না। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের এই চেষ্টার ওপর অস্ত্র সাহায্যের কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে না।
মিঃ রাশের এই উক্তিকে অনেকটা চোরকে চুরি করাতে বলা আর গৃহস্থকে সজাগ থাকতে বলার মত নয় কি? কেননা ভারতে বৃটিশ শাসনের পর থেকে এই উপমহাদেশে যতটা উত্তেজনা ও রণোন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছিল তার মূলে মার্কিন সরকারের সমরাস্ত্র নয় কি- রাশ সাহেবরা কি একথা অস্বীকার করতে পারেন? ১৯৪৯ সালে কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ কালে মার্কিন অস্ত্রই কি পাকিস্তানকে যুদ্ধে ঝুঁকি নিতে সাহায্য করেনি? ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে কি সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেনি? পরিশেষে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানিরা কি সেই একই মার্কিন অস্ত্র আর বুলেট দিয়ে তিরিশ লক্ষ নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করেনি? সেই কালে কি পাকিস্তানকে মার্কিন সমরাস্ত্র সরবরাহ প্রশ্নে ভারতসহ বিশ্ববাসী প্রতিবাদ জানালে রাশ-সিসকো সাহেবদের সহযোগী পেন্টাগনের নেতৃবৃন্দ কি একই কথা বলেনি?
আসলে বিশ্বের প্রধান ধণতান্ত্রিক দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি হলো অস্ত্র বিক্রয়ের রাজনীতি। সমরাস্ত্র সাহায্য আর তার সাথে সাথে কিছু অর্থ সাহায্যের নামে তারা চায় বিশ্বের বিশেষ করে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার অনুন্নত ও উন্নতিশীল দেশগুলোকে নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী গাঁটছাড়ায় আবদ্ধ করতে। অতীতের কোরিয়া, জাপান, তাইওয়ান, আজকের ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া কি তারই প্রমাণ নয়? এমতাবস্থায় পাকিস্তানকে অস্ত্র দিলে উপমহাদেশের শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে কোনো বিঘ্ন হবে না বলে রাশ সাহেব তথা মার্কিন বড়কর্তাদের সাফাই না গেয়ে উপায়ই বা কি? বিশেষ করে ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দীর মধ্যে বাংলাদেশে যখন মাত্র ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের ব্যবস্থা করে বাকিদের দিয়ে পাকিস্তানে আটক সকল বাঙালিকে উদ্ধারের প্রস্তাব করে সম্প্রতি যে বাংলাদেশ-ভারত যুক্তি বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে সে সময় এটা ছাড়া আর কি-ই বা তারা বলতে পারেন! তবে ডুডু আর তামাকু যে একসঙ্গে চলে না আজকের দিনের বাস্তব ঘটনাবলীই তার জ্বলন্ত স্বাক্ষর।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক