You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.04.22 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | সমাজতন্ত্র জনকের জন্মদিনে- | জ্যৈষ্ঠের কাঁঠাল যেন হাত ধরে না পাকে | দায়িত্ব শুধু সরকারের নয়- সকলের | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২২ এপ্রিল রোববার, ৯ই বৈশাখ, ১৩৮০

সমাজতন্ত্র জনকের জন্মদিনে—

বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের জনক ভাদিমির ইলিট উলিয়ানভ লেনিনের আজ ১০৩ তম জন্মবার্ষিকী। ১৮৭০ সালের ২২শে এপ্রিল রাশিয়ার ভলগা নদীর তীরে অবস্থিত সিমবিরস্ক নামক স্থানে এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের লেনিনের জন্ম হয়েছিল। রাশিয়ায় তখন জার শাসকের অত্যাচার, নির্যাতন ও শোষণের অন্ধকার রাজত্ব প্রতিষ্ঠা ছিল। সেই অন্ধকারের যুগে লেনিন মুক্তির জয়গান এবং নানা প্রতিবন্ধকতার ভেতর দিয়ে তিনি নিজের শিক্ষা জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছিলেন। পারিবারিক পরিবেশে তিনি উন্নত চরিত্রের অধিকারী হওয়ার দীক্ষা নিয়েছিলেন। লেনিনের বড় ভাই ছিলেন একজন সন্ত্রাসবাদি বিপ্লবী। জার তৃতীয় আলেকজান্ডার কে হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে লেনিনের বড় ভাইকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হতে হয়েছিল। লেনিনের জীবনে তার বড় ভাইয়ের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের গভীর প্রভাব পড়েছিল। লেলিনের বড় ভাই জার-তন্ত্রের ধ্বংস চেয়েছিলেন। লেলিন বড় ভাইয়ের মৃত্যুতে দারুন মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনিও বড় ভাইয়ের মতোই দিন দিন বিপ্লববাদের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন এবং সক্রিয়ভাবে বিপ্লবের কাজে জড়িত হওয়ার জন্য তাকে জার সরকারের কোপানলে পতিত হতে হয়। বরণ করে নিতে হয় জেল ও জুলুম। লেলিনের বিপ্লবী নেতৃত্বে ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব অনুষ্ঠিত হয় এবং বিশ্বের বুকে জন্মলাভ করে প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের। সমগ্র বিশ্বে তিনি মুক্তির দূত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছেন। বিশ্বের বুকে লেনিনই সর্বপ্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করেন। বিশ্বের দেশে দেশে আজও সমাজতন্ত্রের সেই রক্তিম পতাকা উড্ডীন রয়েছে। যেখানে অত্যাচার, নির্যাতন ও শোষণ নেমে আসে, সেখানে লেলিনের আদর্শ উচ্চকিত হয়ে ওঠে। তাই বিশ্বের দিকে দিকে আজ লেলিনের বন্দনা সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অগ্রযাত্রা অব্যাহত।
লেনিনের ১০৩ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে শিল্পমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেছেন, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় সোভিয়েত ইউনিয়ন অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ ও শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থানের নীতির উপর বাংলাদেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন অটুট থাকবে। মন্ত্রী মহোদয় আরো বলেছেন, স্বাধীনতা সংগ্রাম কালে সোভিয়েত নেতাদের মাঝে সাহায্য-সহযোগিতার যে প্রতিফলন ঘটেছে, তা ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে এবং বাঙালি জাতি তার চিরদিন মনে রাখবে।
লেলিন প্রতিষ্ঠিত সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশ থেকে স্বৈরাচারী শাসক গোষ্ঠীর অত্যাচার ও নির্যাতনের অবসানের জন্য সর্বোত্তম সাহায্য দিয়েছে। বাংলাদেশ আজ সমাজতন্ত্রের উত্তরণের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় আমরা সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা লেলিনের জন্মবার্ষিকীতে নিশ্চয়ই নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারি না। সমাজতন্ত্রের প্রতি জানাই আমাদের অভিনন্দন। লেলিনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের প্রতি শ্রদ্ধায় হই অবনত। লেলিন যে সাধনা, অধ্যবসায় ও কর্মকুশলতার মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো বাস্তবায়ন সাধন করে গেছেন, সেই সমাজতান্ত্রিক আদর্শে তুলে ধরার আজ প্রকৃষ্ট সময়। মানবতা যেখানে লাঞ্চিত, অত্যাচার, নির্যাতন ও শোষণ যেখানে তীব্র, সেখানেই লেলিনের মর্মবাণী আমাদের উদ্দীপিত করে। কবি সুকান্তের ভাষায় তাই আমাদেরও বলতে ইচ্ছে করে, পৃথিবীর যেখানেই বিপ্লব স্পন্দিত হয়, এবং যেখানে মুক্তির সংগ্রাম সেখানেই মহান লেলিন।

জ্যৈষ্ঠের কাঁঠাল যেন হাত ধরে না পাকে

বাংলাদেশ খাদ্য ঘাটতি চলছে। সাধ্যনুযায়ী চেষ্টা সত্ত্বেও খাদ্য ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে বাৎসরিক ২৫ লক্ষ টন খাদ্য ঘাটতির মধ্যে আগামী জুন মাস নাগাদ ১৮৫০ লক্ষ টন খাদ্যশস্য বিদেশ থেকে সংগ্রহ করা সম্ভব হবে বলে খাদ্যমন্ত্রী শ্রী ফনী ভূষণ মজুমদার জাতীয় সংসদে জানিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন খাদ্য ঘাটতি পূরণের জন্যে সরকারের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হবে।
স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে বিদেশের দিকে চাতক পাখির মতো খাদ্য বৃষ্টির জন্য তাকিয়ে থাকলে চলবে না। নিজেদের পায়ে দাঁড়াবার মত পথ খুঁজে নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খাদ্য ঘাটতি পূরণের দিকে লক্ষ্য রেখেই আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবার জন্য দেশবাসীর প্রতি আবেদন জানিয়েছেন।
সরকার যাই বলুন না কেন সরকারি আমলারা কিন্তু তা বলছেন না। ফলে সামগ্রিক পরিকল্পনাই ভেস্তে যেতে বসেছে। ডিজেল সংকটে দরুন পাম্প বন্ধ। সেজন্যে সেচের পানির অভাব। নিয়মিত সার সরবরাহের ত্রুটি-বিচ্যুতি ইত্যাদি তো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। পত্রিকার পাতা খুললেই এ ধরনের অভাব-অভিযোগ চোখে পরে। এমনি অবস্থায় আবার গোঁদের উপর বিষফোড়ার মতো আরেক সমস্যা দেখা দিয়েছে দেশের উত্তরাঞ্চলে।
স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে যে, উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের অবহেলা এবং অহেতুক গড়িমসির ফলে উত্তরাঞ্চলে কৃষিঋণ গ্রহণকারী কৃষকগণ এক চরম দুরবস্থার সম্মুখীন। সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের অহেতুক অলসতার জন্য একজন কৃষক আবেদনপত্র জমা দেয়ার প্রায় চার পাঁচ মাস পরে বহু আর্থিক খেসারত দিয়ে ঋণের প্রথম কিস্তির টাকা পায়। এমন সময় টাকা তাদের হাতে পৌঁছে যখন চাষাবাদের মৌসুম শেষ হয়ে যায়।
অভিযোগ যদি সত্যি হয় তাহলে অবস্থা যে অত্যন্ত গুরুতর এ কথা আর বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। সরকার যেখানে খাদ্য ঘাটতি পূরণের উদ্দেশ্যে সবুজ বিপ্লবকে সার্থক করে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন সেখানে যদি কতিপয় আমলা আর কর্মচারীদের অবহেলা আর গাফিলতির ফলে তা ভেস্তে যায় তাহলে বুঝতে হবে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। বাংলাদেশ সরকারকে ভিক্ষার ঝুলি নিয়েই ফিরতে হবে বিদেশের দুয়ারে দুয়ারে।
‘সবুজ বিপ্লব’কে সাফল্যমন্ডিত করে তোলার অন্যতম শর্ত হলো চাষি ভাইদের দুয়ারে পর্যাপ্ত পরিমাণে বীজ, সার ও ঋণ পৌঁছে দেয়া। সেচের জন্য পাম্প বিতরণ এবং বন্যার পানি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা। অথচ সামান্য ঋণের জন্য যদি চাষি ভাইদের ঘুরে বেড়াতে হয় এবং তাও যদি ফসলের মৌসুম শেষ হয়ে যাবার পর পায় তাহলে আর যাইই হোক ‘সবুজ বিপ্লব’ দূরে থাক কোন বিপ্লবী হবে না। গ্রামবাংলায় একটা কথা চালু আছে বুদ্ধিমান বিচক্ষণ ব্যক্তিরা কোনদিনই জ্যৈষ্ঠের কাঁঠাল ভাদ্র মাসে পাকাতে চেষ্টা করে না। দুঃখের বিষয় উত্তরাঞ্চলের কৃষি ব্যাংকের হোমরা-চোমরা আমলা ও কর্মচারীরা কিন্তু তাই করছেন। অথচ এটা হওয়া উচিত নয়। অন্ততঃ বাস্তব ঘটনা বলি তাই বলে।

দায়িত্ব শুধু সরকারের নয়— সকলের

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিনা টিকিটে ভ্রমণ বন্ধ করতে রক্ষী বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন। এবং এ জন্য দেশের বিভিন্ন রেলস্টেশন ও স্টিমার ঘাটে রক্ষী বাহিনী নিয়োগ করা হবে বলে খবরে প্রকাশ।
বিনা টিকিটে ভ্রমণ করা যে কোন দেশের আইনে অপরাধ এবং নীতি বিগর্হিত কাজ। বাংলাদেশ রেলওয়ের আইনেও বিনা টিকিটে ভ্রমণ অপরাধ। অথচ সেই আইনের চোখে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে বিনা টিকিটে ভ্রমণের অভ্যাস ও প্রবণতা বেড়ে গিয়ে এমন সমস্যার সৃষ্টি করেছে যে, তা দমন করার জন্য শেষ পর্যন্ত সরকারকে রক্ষীবাহিনীকে নিয়োগ করতে হচ্ছে। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশবাসীর পক্ষে এটা খুব একটা গৌরবের কথা নয়।
বিধ্বস্ত বাংলাদেশের ভেঙে পড়া যোগাযোগ ব্যবস্থার স্বাভাবিকীকরণ যখন ত্বরান্বিত হওয়া প্রয়োজন সেই মুহূর্তে বিনা টিকিটে ভ্রমণের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থের অপচয় এর ফলে যোগাযোগের পূর্বাবস্থা ফিরিয়ে আনা ও উন্নয়নের জন্য কিছুতো করাই যাচ্ছে না। উপরন্ত সরকারকে এবং রেল কর্তৃপক্ষকে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে নানাভাবে। এই ক্ষতি মূলত শুধু সরকার বা রেল কর্তৃপক্ষের নয়-ক্ষতি সমগ্র দেশবাসীর। কেননা আর দু দশটা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের মত রেলওয়েও জাতীয় সম্পদ। সুতরাং এই জাতীয় সম্পদের ক্ষতির অর্থ সকল জনগণের লোকসান।
অতএব আমাদের স্বার্থে, জনগণের কল্যাণে বিনা টিকিটে ভ্রমণ বন্ধ করতে হবে। আর এই দায়িত্ত্ব শুধুমাত্র সরকার বা রক্ষীবাহিনীর উপর বর্তায় না। এ দায়িত্ব আপনার আমার সবার। আমরা সবাই যদি আত্মসচেতন হয়ে বিনা টিকিটে ভ্রমণ বন্ধ করি তাহলে এই নীতি বিগর্হিত কার্য কলাপের অবসান ঘটতে পারে। সুতরাং বিনা টিকিটে ভ্রমণ বন্ধ করার জন্য গৃহীত ব্যবস্থাসহ সরকারকে যেমন আরো স্থায়ী এবং কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে, তেমনি সে ব্যবস্থা বাস্তবায়িত করার জন্য সরকারের প্রতি জনগণকেও সক্রিয় সহযোগিতা প্রদান করতে হবে সমভাবে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন