বঙ্গভঙ্গ রদ থেকে মন্টফোর্ড প্রস্তাব রাজনীতির নৈরাজ্য
বঙ্গভঙ্গ তাে রদ হলাে কিন্তু এর উত্তেজক প্রভাব তৈরি করে রকমারি চরিত্রের রাজনৈতিক ঢেউ। একদিকে ওই আন্দোলনের প্রভাবে জাতীয়তাবাদী ধারার পাশাপাশি স্বাধীনতা আদায়ের দৃঢ় পণ নিয়ে দেখা দেয় বিপ্লবী গােষ্ঠী ও তাদের তৎপরতা। তাদের আদর্শে ধর্মীয় সংস্কৃতির লেবেল আঁটা। অন্যদিকে উচ্চবর্গীয় ও মধ্যসারির মুসলমান শিক্ষিতশ্রেণিতে আর্থ-রাজনৈতিক আত্মসচেতনতা এবং কিছুটা স্বতন্ত্র আইডেনটিটিরও উদ্ভাস। কিছুটা স্ববিরােধিতার প্রকাশ জাতীয়তাবাদী নামে পরিচিত মুসলমান রাজনীতিকদের মধ্যেও। অর্থাৎ রাজনৈতিক অসাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে ক্ষেত্রবিশেষে স্বাতন্ত্রবাদী চেতনারও প্রকাশ। এই প্রকাশ যেমন বাংলায় বঙ্গভঙ্গ রদের প্রতিক্রিয়ায় দেখা যায়, তেমনি দেখা যায় বৃহত্তর ভারতীয় প্রেক্ষাপটে ধর্মীয় চেতনার রাজনীতি ঘিরে এদিক থেকে হিন্দু র্যাডিক্যাল ও মুসলিম র্যাডিক্যাল মােটামুটি একই চরিত্রের, অবশ্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে। যেমন হাকিম আজমল খান ও হসরত মােহানীর মতাে দুই জাতীয়তাবাদী (কংগ্রেসী) তেমনি আলী ভ্রাতা নামে বহু পরিচিত রাজনীতিক মােহাম্মদ আলী, শওকত আলী। এদের সঙ্গে কিছুটা চারিত্র মিল রয়েছে বাংলার তৃণমূল প্রতিনিধি রাজনীতিক এ কে ফজলুল হকের। হকের রাজনীতিতে ধর্মীয় গোঁড়ামি কখনাে ছিল না। ছিল পিছিয়ে পড়া বঙ্গীয় মুসলমানের উন্নয়ন চেষ্টা এবং তা বাঙালিত্বসহ। বঙ্গভঙ্গ রদের প্রতিক্রিয়ার প্রভাবে মুসলিম লীগের প্রবীণ নেতৃত্ব ১৯১২ সাল নাগাদ পিছু হটে। অপেক্ষাকৃত নবীনদের বাদে যারা মুসলিম রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য মােহাম্মদ আলী, শওকত আলী, হসরত মােহানী প্রমুখ। এদের সঙ্গে বঙ্গের তরুণ নেতা ফজলুল হকের নামও লক্ষ্য করার মতাে। শেষােক্তজন সম্পর্কে সুমিত সরকারের মন্তব্য: ‘বাংলার ফজলুল হক এক উদীয়মান তরুণ আইনজীবী, ৫০ বছর ধরে যিনি পরিশীলিত রাজনৈতিক তৎপরতার সঙ্গে খাটি গ্রামীণ গণআবেদনকে মেলাবেন।… আর বয়স্কদের প্রসঙ্গে তার মতে এদের সামাজিক বিন্যাস ছিল র্যাডিক্যাল হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের মতাে। সর্বইসলামী (প্যানইসলামী) ও ব্রিটিশ-বিরােধী সুরের জন্য মােহাম্মদ আলীর কমরেড’ (কলকাতা), আবুল কালাম আজাদের ‘আল হিলাল’ (কলকাতা) বা জাফর আলী খানের ‘জমিনদার’ (লাহাের)-এর মতাে পত্রিকা পুলিশের নজরে এলাে।…
বলকান যুদ্ধে তুর্কিকে সাহায্য করার জন্য ১৯১২-১৩-য় এক চিকিৎসকদল নিয়ে গেলেন ডা. আনসারি ও জাফর আলী খান। ‘মুসলিম লীগের নতুন সচিব ওয়াজির হাসান মার্চ ১৯১৩-য় একটি প্রস্তাব পাস করান। তাতে বলা হয় লীগের লক্ষ্য হলাে সাংবিধানিক উপায়ে। ঔপনিবেশিক স্বশাসন। এভাবেই সেটি কংগ্রেসের সঙ্গে এক সূত্রে বাঁধা হলাে। খিলাফত আন্দোলন ও সাধারণ হিন্দু-মুসলমানের রাজনৈতিক সহযােগিতার প্রস্তুতি চলেছিল এভাবে’ (প্রাগুক্ত)। আমার মনে হয় এ পর্বে উভয় পক্ষে ধর্মীয় উপাদান প্রধান প্রেক্ষাপট হয়ে থাকার কারণে ঐক্য স্থায়ী হয়নি। ধর্মীয় চেতনা জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সহায়ক নয় । ধর্মকে আদর্শগত কেন্দ্রে রেখে বিদেশি শাসন-বিরােধী ঐক্যবদ্ধ লড়াই যত আন্তরিকই হােক শেষ লক্ষ্যে সর্বদা সুফল দেয় না। তার পয়লা নম্বর উদাহরণ কংগ্রেস-খিলাফত ঐক্যে ভাঙন। অথচ কী আবেগ ও আন্তরিকতা নিয়ে ব্রিটেন ও তুরস্কের বিবাদ উপলক্ষে গড়ে ওঠে হিন্দু জাতীয়তাবাদী ও সর্বইসলামবাদী জঙ্গী মুসলমানদের মধ্যে নিবিড় সহযােগিতা। দেখা দিলেন ‘গদর’-এর বরকাতুল্লা এবং দেওবন্দ মােল মাহমুদ হাসান ও ওবেইদুল্লা সিন্ধির মতাে গুরুত্বপূর্ণ মুসলমান বিপ্লবী নেতা” (সরকার)। ইতিমধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু। ভারত ভুখণ্ড থেকে ইংরেজ সৈন্যের একটা বড় অংশ সরাতে হয় ব্রিটিশরাজকে। এ সুযােগে ভারতে বিপ্লবী তৎপরতা বেড়ে যায়। বঙ্গীয় ও পাঞ্জাবি বিপ্লবীদের উত্তেজনা বাড়ে । বিদেশভূমিতেও দেখা দেয় ভারতীয় বিপ্লবীদের তৎপরতা। জার্মান বৈদেশিক দফতরের সহযােগিতায় ভর করে তৈরি হয় ১৯১৫ সালে ভারতীয় স্বাধীনতা সমিতি’। ডিসেম্বর ১৯১৫ কাবুলে স্বাধীন ভারতের অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেন মহেন্দ্রপ্রতাপ, বরকাতুল্লা ও ওবেইদুল্লা সিন্ধি। তারা সমর্থন পেয়েছিলেন আফগান বাদশাজাদা আমানুল্লাহর।’ এসব কর্মকাণ্ডের নায়ক বাংলা ও পাঞ্জাব ভুখণ্ড এখানে দেখা গেল সাম্প্রদায়িক ঐক্য।
এ পর্যন্ত হিন্দু-মুসলমান সহযােগিতা ভালােভাবে এগিয়ে চলেছে ১৯১৫ সালে ফজলুল হক বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সেক্রেটারি এবং লীগের উদারনৈতিক অংশের নেতা। এ সময় ফজলুল হক ও সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি যথাক্রমে লীগ ও কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে আলােচনা শুরু করেন যাতে উভয় সংগঠন মিলে যৌথ রাজনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে। এ বিষয়ে দুই সংগঠনই তৎপর হয়ে ওঠে (১৯১৫)। শেষ পর্যন্ত অনেক আলােচনার পর কংগ্রেস-লীগ যৌথভাবে একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে এবং তা ওই দুই দলেরই লক্ষ্ণৌ অধিবেশনে গৃহীত হয় (১৯১৬) যা লখনৌ চুক্তি নামে পরিচিত। মুসলিম লীগের ওই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন মােহাম্মদ আলী জিন্না। সেখানে বঙ্গীয় নেতা আবদুর রসুল ওই প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং তা সমর্থন করেন আরেক বঙ্গীয় তৃণমূল নেতা ফজলুল হক। উল্লেখযােগ্য যে যুদ্ধ চলাকালে সরকার চরম দমননীতি চালায়। এবং আলী ভ্রাতৃদ্বয়, মাওলানা আজাদ ও হসরত মােহানীকে অন্তরীণ করে রাখা হয় । তখন দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে উদারপন্থীদের প্রাধান্য। লক্ষৌ প্যাক্টের ভিত্তি রাজনৈতিক বিচারে নরমপন্থীদের ঐক্যবােধ। যুদ্ধে সরকারের প্রতি সহযােগিতা, বিনিময়ে যুদ্ধশেষে স্বরাজ। অন্যদিকে লীগ-কংগ্রেসের এই দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পূর্বশর্ত মুসলমান সংখ্যালঘু প্রদেশে (যেমন যুক্তপ্রদেশ) অধিক সংখ্যক মুসলমান) আসনের প্রতিনিধিত্ব- পরিবর্তে মুসলমানপ্রধান প্রদেশে হিন্দুদের অধিক আসন (যেমন বঙ্গে মুসলমানদের জন্য মাত্র ৪০ শতাংশ আসন বরাদ্দ আসলে এটা করা হয় যুক্তপ্রদেশের মুসলিম স্বার্থে । বলি দেয়া হয় বঙ্গে মুসলিম স্বার্থ এবং তা মুসলিম লীগ নেতাদের উদ্যোগে। এতে বঙ্গে বিশেষ করে পূর্ববঙ্গে মুসলমান নেতাদের একাংশে অসন্তোষ দেখা দেয় । ঢাকার নবাবের অনুসারী নেতৃবৃন্দ, ময়মনসিংহের জমিদার নওয়াব আলী চৌধুরী প্রমুখ লক্ষ্ণৌ প্যাক্টের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। অন্যদিকে ফজলুল প্রমুখ নেতা চুক্তির পক্ষে, মূলত ঐক্যমঞ্চ গঠনের স্বার্থে। এবং সে সূত্রে স্বশাসনের স্বার্থে। তবে লক্ষ্ণৌ চুক্তিরও নেতিবাচক দিক ছিল স্বতন্ত্র নির্বাচন। মেনে নেয়া। তারা তাৎক্ষণিক স্বার্থে স্বতন্ত্র নির্বাচনের সাম্প্রদায়িক দিকটা উপেক্ষা করেছেন যা আদৌ ঠিক ছিল না ।
একইভাবে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের স্বার্থে তারা খিলাফত আন্দোলনের নেতিবাচক তথা প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রও বিবেচনায় আনেননি। থলিফাতন্ত্র ও তুর্কি সুলতানাত উদ্ধার যে প্রগতিশীলতার ধারক-বাহক নয় এ সত্য মাওলানা আজাদ, ডা. আনসারি বা মােহাম্মদ আলীর মতাে সাম্রাজ্যবাদবিরােধী নেতাদের উপলব্ধিতে আসেনি। ইসলাম ও ধর্মীয় সংস্কৃতির বিষয়টিই তাদের চোখে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তেমনি বিষয়টি অন্য কংগ্রেস নেতারাও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করে দেখেননি। এটা এক ধরনের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা। প্রকৃতপক্ষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ভারতীয় রাজনীতিতে নানামাত্রিক উপাদান যােগ করে তাতে স্ববিরােধিতার চরিত্র আরােপ করেছিল। যেমনটা দেখা যাবে বেশি করেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবে। পূর্বোক্ত পর্বের বৈশিষ্ট্য হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতার চেষ্টায় বিপ্লবী তৎপরতা বৃদ্ধি, জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ধারায় নরমপন্থা ও চরমপন্থার সক্রিয় রূপ ও গান্ধি রাজনীতির সুচনা, অন্যদিকে শাসকরাজ-এর চরম দমননীতি। শেষােক্ত বিষয়ে উল্লেখযােগ্য ভারত রক্ষা আইনের (১৯১৫) নির্মম প্রয়ােগ যা আরাে পরে দেখা যাবে কুখ্যাত রাওলাট আইনে। তবে যুদ্ধের উপলক্ষে নিরাপত্তার যুক্তি দেখিয়ে যে ধরনের ব্যাপক নির্যাতন, নিপীড়ন ও শাস্তির ব্যবস্থা চলে তাতে দেখা যায় খুব অল্প সময়েই বাংলা ও পাঞ্জাবে বহু সংখ্যক রাজনৈতিক নেতা বা কর্মীর কঠিন সাজা হয় বিশেষ আদালতে । বিনাবিচারে আটকের সংখ্যা আগুনতি। শুধু গদর বিপ্লবীদের তালিকায় দেখা যায় ৪৬ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং ৬৪ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড’ (সরকার, প্রাগুক্ত)। বিস্তারিত ইতিহাস পর্যালােচনায় দেখা যাবে বিপুল সংখ্যকের শাস্তি- ফাসি, আন্দামান কারাদণ্ড, অন্তরীণ ইত্যাদি ঘটনা। তবে ওই যে বলা হয়েছে নরমপন্থা-চরমপন্থার কথা তাতে নরমপন্থী নেতাদের দেখা যায় রাজপক্ষের সমর্থনে যুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে, যুদ্ধের জন্য স্বেচ্ছাসেবক বা যােদ্ধা সংগ্রহ করতে । এদের শীর্ষস্থানীয়দের অন্যতম নেতা এম.কে, গান্ধি। এদের প্রত্যাশা ছিল এ জাতীয় সেবার বদলে যুদ্ধশেষে রাজনৈতিক ইনাম পাওয়ার- তা হােমরুল বা স্বরাজ বা অধিকতর শাসনক্ষমতার অংশীদারিত্ব—যা-ই হােক না কেন।
কিন্তু বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেড়েনি- সেসব পরের কথা। সম্ভবত সময় বিচার করেই পরিস্থিতি সুবিধাজনক ভেবে তিলক ও অ্যানি বেসান্তের হােমরুল আন্দোলনের সূচনা (১৯১৬)। বেসান্তের কর্মকাণ্ডের পেছনে ছিল তার ব্যক্তিগত ভাববাদী চিন্তাধারা ও উপরতলীয় আবেগ যা কিছু সময় পরেই মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার প্রস্তাবের টানে ভেসে যায়। রাজবিরােধী আন্দোলনের বিচিত্র ধারায় নানামাত্রিক নেতৃত্বের পারস্পরিক বিরােধিতায় এম.কে, গান্ধির ভারতীয় রাজনীতিতে আবির্ভাব (১৯১৫)। গান্ধি গােটা জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে ক্রমে একটি বিশেষ ধারায় (অহিংস প্রতিবাদে) সংহত করেন যা ভারতীয়, বঙ্গীয় রাজনীতির জন্য স্বাদেশিকতার বিচারে শুভ পরিণামদায়ক হয়নি। বিষয়টি বিস্তারিত আলােচনার। তবে এটুকু বলা দরকার যে চরকা থাদি সত্যাগ্রহ ও অহিংসানীতি সাম্রাজ্যবাদী শাসক শক্তিকে উৎখাতের পন্থা ছিল না। সেজন্য দরকার ছিল শক্তির প্রয়ােগে মুক্তি সংগ্রাম ও গণবিদ্রোহ। সমঝােতায় ক্ষমতাপ্রাপ্তি বা ক্ষমতা হস্তান্তরের নমুনা তাে রক্তরঞ্জিত সাতচল্লিশের আগস্ট। ১৯০৫-এর স্বদেশী আন্দোলন থেকে ১৯১৯-এর সংস্কারপূর্ব সময় পর্যন্ত ভারতীয় রাজনীতি বিচিত্র আন্দোলনে স্পন্দিত ভদ্রলােক শ্রেণির আন্দোলনের (জাতীয়তাবাদী ও বিপ্লবী) বাইরে কৃষক আন্দোলন, জাতপাতের আন্দোলন, উপরিস্তরে সম্প্রদায়গত ঐক্য, আবার কখনাে সাম্প্রদায়িক সংঘাত, ভূস্বামীবিরােধী আন্দোলন ইত্যাদি বিষয় নানা স্রোতের সৃষ্টি করেছে যা কখনাে পরস্পরবিরােধী । স্বভাবত সবকিছু মিলে শাসক-বিরােধী সংহত চরিত্রের আন্দোলন বা লড়াই গড়ে ওঠেনি। কিছু ঘটনা জনস্তরে সাম্প্রদায়িক সংঘাতেরও জন্ম দিয়েছে। তেমনি দেখা গেছে পূর্ববঙ্গে গরিব মুসলমান চাষীদের সঙ্গে নিমবর্গীয় হিন্দু) হিন্দু জমিদারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জমিদারবাড়ি আক্রমণ (মহাজনসহ) অন্যদিকে বিহারে হিন্দুজনতার মুসলমান নিবাস ধ্বংস করা, বিষয় অবশ্য গােরক্ষা (১৯১৭)। আবার ১৯১৮ সালে কলকাতায় মাড়ােয়ারি ব্যবসাপট্টিতে দরিদ্র মুসলমান জনতার আক্রমণ শ্রেণীগত হয়েও সম্প্রদায়বাদী। ক্ষেত্রবিশেষে এসবের জন্য কেউ কেউ হিন্দুপ্রধান কংগ্রেসের ভুলুভ্রান্তিকে দায়ী করেছেন (সরকার)। দায় মুসলিম রক্ষণশীল মােল্লা মৌলভী বা রাজনীতিকেরও ছিল।
যুদ্ধের ধাক্কা সামলাতে অর্থনৈতিক পীড়ন, শাসন-শােষণ, রাজনৈতিক নির্যাতন, অন্যদিকে শিল্পপতিদের সীমাহীন মুনাফাবাজির প্রতিক্রিয়ায় ভারতীয় সমাজের নিমস্তরে অসন্তোষ, ক্ষোভ, কোনাে কোনাে স্তরে প্রতিবাদ বা বিক্ষোভ এক ধরনের সামাজিক-রাজনৈতিক নৈরাজ্যের সৃষ্টি করেছিল। এর মধ্যে গােদের ওপর বিষফোড়ার মতাে দেখা দেয় বিপ্লবী তৎপরতা বন্ধ করতে কুখ্যাত রাওলাট কমিটির প্রতিবেদন এবং পরে যা আইন হিসেবে গৃহীত হয় (মার্চ, ১৯১৯)। এই বিচিত্র সময়পর্বে একাধিক ধর্মবিশ্বাসী এবং বহু ভাষা ও সংস্কৃতির ছােট ছােট ভূখণ্ড নানাভাবে তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটায়। তাতে ঐক্য বা সংহতির চেয়ে অনৈক্য বা বিচ্ছিন্ন বৈচিত্র্যের প্রকাশ ছিল অপেক্ষাকৃত বেশি। বঙ্গভঙ্গবিরােধী স্বদেশী আন্দোলন ছিল মূলত ভূখণ্ডভিত্তিক । জাতীয়তার চেতনা সেখানে অগ্রচারীর ভূমিকা পালন করলেও তা পুরােপুরি ধর্মনিপেক্ষ ও শ্রেণী-নিরপেক্ষ ছিল না। অবশ্য সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রভাব সেখানে ছিল, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ রচিত স্বদেশী গানের উদ্দীপনায় সর্বজনীন জাতীয়তার চরিত্র নিয়ে । বিপ্লববাদী আন্দোলনে যেমন অবাঞ্ছিত প্রভাব রেখেছিল হিন্দুত্বের ধর্মীয় সংস্কৃতি তেমনি তুরস্ককেন্দ্রিক খিলাফত আন্দোলনে ছিল সর্বইসলামিয়াতের (প্যান ইসলামিজম) ধর্মীয়-রাজনীতির প্রভাব। উভয়কেই রাজনৈতিক বিচারে প্রগতিবিরােধী ধারা হিসেবে গণ্য করতে হয়। এ দুটোই বঙ্গকেন্দ্রিক। কিন্তু এ পর্বের কৃষক আন্দোলনগুলাের বিস্তৃতি সর্বভারতীয়। বঙ্গ-বিহার হয়ে দক্ষিণ ভারতে নিমবর্গীয় বিদ্রোহ বা আন্দোলন বা উত্থান। এর প্রভাব নানাভাবে পড়েছে সমাজে। বঙ্গে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির অবহেলায় কৃষক বিক্ষোভ বা বিদ্রোহ সম্প্রদায়গত বিন্যাসের কারণে মুসলিম স্বাতন্ত্রবাদের ভিত তৈরি করে। দক্ষিণ ভারতে তা যেমন ছিল জাতপাতের তথা বর্ণবাদী তেমনি আবার মালাবারে সম্প্রদায়বাদী। তবে ভাষাগত স্বাতন্ত্রের কিছু দাবিও ওঠে দক্ষিণে- যতটা তামিল, তারচেয়ে বেশি তেলেগু ও মালায়লম ভাষা কেন্দ্র করে। যেমন সমাজসংস্কার ও দেশপ্রেমের শক্তিশালী বাহন হয়ে উঠেছিল মালায়লম ।… ভাষাভিত্তিক রাজ্যের সুস্পষ্ট দাবি তখনাে পর্যন্ত উঠেছিল একমাত্র অস্ত্রেই’ (সরকার, প্রাগুক্ত)।
বিভাগােত্তর পূর্ববঙ্গে বাংলাভাষার দাবি নিয়ে যে প্রতিবাদী ঝড় ওঠে ১৯৪৮ থেকে এর অসম্প্রদায়বাদী জাতীয় চেতনার পূর্বসূত্র দেখা যায় কখনাে চিত্তরঞ্জন দাসের বা সুভাষ পরিবারের রাজনীতিতে, কখনাে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক বক্তব্যে উল্লেখিত সমম্বিত রাজনীতি ও সাহিত্য সাধনার আহ্বানে। কিন্তু লীগকংগ্রেস দুই পক্ষ থেকেই সম্প্রদায়বাদী রাজনীতি বঙ্গে ভাষাভিত্তিক রাজনীতির ভাবনা অর্থাৎ ভাষিক জাতিসত্তার রাষ্ট্রভাবনাকে চাপা দিয়েছিল। তবু বিরল সংখ্যক ভাষিক জাতিসত্তাভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিবিদের চিন্তায় বাংলাভাষা ও সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালিত্বের চেতনা প্রকাশ পেয়েছিল, সূচনা অবশ্য স্বদেশী আন্দোলন-সংগীতে, রাজপথের প্রতিবাদে । প্রসঙ্গত এস, ওয়াজেদ আলীর ‘ভবিষ্যতের বাঙ্গালী স্মর্তব্য। সেই ধারায় ঐক্য ও বিচ্ছিন্নতাবাদের পরস্পরবিরােধিতার মধ্যেই ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে এক বক্তৃতায় বাঙালিত্বের ওপর জোর দিতে গিয়ে চিত্তরঞ্জন দাস বলেন, বাঙালি হিন্দু বা মুসলমান বা খ্রিস্টান হতে পারেন, কিন্তু বরাবর বাঙালিই থেকে যান’ (সরকার)। বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানকে এক কাতারে দাঁড় করানাের চেষ্টা রবীন্দ্রনাথও করেন তার লেখা বা বক্তৃতার মাধ্যমে। তবে ১৯১৫ সালে ‘সবুজপত্র’ সাহিত্যগােষ্ঠীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে চলিত ভাষায় সহজ করে বলার যে ভাবনা তিনি প্রকাশ করেন তার মৃত্তিকাঘনিষ্ঠ তাৎপর্য উপেক্ষা করার মতাে নয়। আর চিত্তরঞ্জন ঐক্যের চেষ্টা চালান বিশেষভাবে রাজনীতিতে, ফজলুল হকও ওই পথে চলেন ভিন্নভাবে।
এটা বহুকথিত সূত্র যে সম্প্রদায়বাদী চেতনার প্রভাব ভারত ও বঙ্গের রাজনীতিতে একটি অবাঞ্ছিত বাস্তবতা। ভারতবর্ষ যেহেতু একটি বহুভাষী, বহু জাতি-ভূখণ্ডভিত্তিক একাধিক ধর্মবিশ্বাসী মানুষের বাসস্থান তাই এর সমাজ বিন্যাস ছিল খণ্ডিত, অর্থনীতি-রাজনীতিও ভিন্নচরিত্রের, তাই প্রতিক্রিয়াও ছিল নানাধর্মী । যেমন কৃষকপ্রধান বাঙালি মুসলমানের আর্থসামাজিক অবস্থান উত্তর ভারতীয় মুসলমানদের থেকে ভিন্ন। তাই তাদের আর্থসামাজিক আকাক্ষার চরিত্রও অনেকাংশে ভিন্ন ছিল। কিন্তু ধর্মীয় পরিচিতি এক ছিল বলে ধর্মীয় রক্ষণশীলদের প্রচার ও রাজনীতিকদের প্রচার সম্প্রদায়বাদিতার একবিন্দুতে মিলে । তাই রাজনীতি ক্ষেত্রে স্বাদেশিকতার তুলনায় সাম্প্রদায়িকতা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিমান উপাদান হয়ে দাঁড়ায়। ওই পথেই আর্থ-সামাজিক আকাঙ্ক্ষা পূরণ সহজ মনে হওয়ায় স্বাদেশিকতার বিষয়টি আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক স্বার্থের তুলনায় গৌণ বিবেচিত হয়। স্বদেশ চেতনায় হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী ধর্মীয় সংস্কৃতির লেবেলযুক্ত হওয়াও এর আরেকটি কারণ। তবে মালাবারের মুসলমান মােপলা কৃষক এবং বঙ্গের মুসলমান কৃষকের শ্রেণীগত স্বার্থ ও বিদ্রোহের বা বিক্ষোভের কারণ ভিন্ন ছিল না । কিন্তু পক্ষপ্রতিপক্ষ ভিন্নধর্মাবলম্বী হওয়া এবং অর্থনৈতিক পীড়নের অন্তত কিছু কারণ ধর্মীয় অনুষঙ্গের হওয়ায় শ্রেণীসংঘাত সাম্প্রদায়িক সংঘাতের আপাত-রূপ নেয় যদিও সংঘাতের মূল কারণ শ্রেণীস্বার্থনির্ভর। রাজনীতির চরিত্র এভাবে জটিল ও মিশ্র ধরনের হয়ে দাঁড়ায়। যে কারণে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সর্বজনীন হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে পদে পদে বাধাগ্ৰওঁ হয়েছে। স্বাধীনতার চেয়ে কখনাে সম্প্রদায়গত উন্নয়ন ভাবনা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এই সময়পর্বে বিশ্বযুদ্ধ, ভারতের রাজনৈতিক অসন্তোষ ইত্যাদি বিবেচনা করেই উপশমক ব্যবস্থা হিসেবে ভারতের জন্য কিছু রাজনৈতিক সুযােগ-সুবিধাভিত্তিক সাংবিধানিক সংস্কারের প্রস্তাব আনা হয় ব্রিটিশরাজের পক্ষ থেকে। এ প্রস্তাব ‘মন্টেগু-চেমসফোর্ড’ সংক্ষেপে ‘মন্টফোর্ড’ সংস্কার হিসেবে পরিচিত যা এ সময়কার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ।
কারণ এতে বলা হয় যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ভারতে একটি দায়িত্বশীল সরকার গঠনের লক্ষ্যে স্বয়ংশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলাের ক্রমবিকাশ ঘটানাের চেষ্টা চলবে। এক্ষেত্রে ‘সাম্রাজ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ” কথাটা মনে রাখা দরকার। কমন্সসভায় ১৯১৭ সালে ভারতসচিব মন্টেগুর ঘােষণার পর ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ভারতে এ প্রস্তাব আইন হিসেবে গৃহীত হয়। দেশীয়দের জন্য কিছু শাসনতান্ত্রিক সুযােগ-সুবিধার প্রসার, ভারতীয় সুতিবস্ত্রের ওপর উৎপাদন শুল্ক ছাড়, কুলি রফতানি ব্যাপারে নমনীয়তা ইত্যাদি নানাদিক থেকে এ আইন নরমপন্থী রাজনীতিকদের জন্য আকর্ষণীয় মনে হয়। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল পৃথক নির্বাচন, সম্প্রদায়ভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব ও সংরক্ষণ ব্যবস্থার প্রসার ঘটানাে নিয়ে। কিন্তু এদিকে রাজনীতিকদের নজর ছিলনা। এ নমনীয়তার মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতে ব্রিটিশ শাসন মজবুত করা। তারচেয়ে বড় একটি কারণ কারাে কারাে হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। আর তা হলাে বলশেভিক বিপ্লবের উত্তাপ থেকে ভারতীয় রাজনীতিকে দূরে রাখার চেষ্টা। তাছাড়া ভারতীয় রাজনীতি যেন তাদের ছককাটা বৃত্তের বাইরে যেতে না পারে। তা সত্ত্বেও সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, এম. কে. গান্ধি, মদনমােহন মালব্য প্রমুখ নেতা ‘সুযােগ-সুবিধার যতটা সদ্ব্যবহার করা যায় তাই ভালাে’ এই চিন্তা থেকে। মন্টফোর্ড ঘােষণা ও প্রণীত আইনের প্রতি সমর্থন জানান। চরমপন্থী কংগ্রেসীরা এটা বর্জন করেন। ঠিক একই সময়ে বিপরীতধর্মী দুটো ঘটনায় শাসকশ্রেণীর সদিচ্ছার অভাব। স্পষ্টই প্রকাশ পায়। যেমন সব রাজনৈতিক প্রতিবাদ ও আপত্তি উপেক্ষা করে বিপ্লবী তৎপরতা ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করতে রাওলাট আইন পাস করে ভারত সরকার। ফলে দেশব্যাপী প্রবল উত্তেজনা দেখা দেয়। সে উত্তেজনার প্রকাশ স্তব্ধ করতে অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগে জেনারেল ডায়ারের নেতৃত্বে ঘটানাে হয় বর্বর হত্যাকাণ্ড। সেখানে কয়েকশ নিরস্ত্র মানুষের মৃত্যু, হাজারেরও বেশি আহত । এ সংখ্যা থেকে অনুমান করা যায় উপস্থিত মানুষের সংখ্যা। ভারতে ইংরেজ শাসনের ইতিহাসে এটাই ছিল বােধহয় সবচেয়ে বড় ধরনের কলঙ্ক যা ভারতবাসীর জন্য সর্বাধিক মর্মবেদনার। অথচ ব্রিটিশ মন্ত্রীসভা অন্যায় ভাবে ডায়ারকে সমর্থন করে গেছে। কমন্সসভায় সে দৃশ্য দেশে অ্যান্ড্রুজকে। লেখা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথের তীব্র ক্ষোভ স্মরণযােগ্য। স্মরণযােগ্য ওই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথের স্যার’ উপাধি ত্যাগ। সম্প্রতি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরুন ভারত সফরে এসে এ বিষয়টি উল্লেখ করলেও ডায়ারি বর্বরতার জন্যে ক্ষমা চাওয়ার রাজনৈতিক ঔদার্য দেখাননি।
সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক