1971.09.13 | ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ | আজকের এদিনে (with references)
প্রবাসী সরকার তৎপরতা
বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন উপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু যে পথ নির্দেশিত করে গেছেন উহা আমরা যে কোন মূল্য এ বাস্তবায়ন করবো। তিনি বলেন বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথই আমাদের মুক্তির পথ। আমাদের মহান নেতার বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া খানের অশালীন মন্তব্য এর জবাব দিবে বাংলার জনগন অস্রের ভাষায়। তিনি বলেন বাঙ্গালীদের মধ্যে ঐক্য যত জোরদার হবে হানাদারদের বিরুদ্ধে আক্রমন তত জোরালো হবে। ততই দ্রুত হবে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তিনি বলেন বাঙ্গালী জাতির এই যুদ্ধ রাজনৈতিক জনযুদ্ধ জনগনের আস্থাভাজন আওয়ামী লীগের প্রধানের বিঘোষিত গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের জন্য এ যুদ্ধ চলমান। তিনি আবারও তার চার দফা উল্লেখ করে বলেন এ চার দফা মানা না হলে কোন রাজনৈতিক সমাধানের প্রশ্ন উঠে না। চার দফা হল শেখ মুজিবের মুক্তি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নেয়া, পাকিস্তানের সৈন্য প্রত্যাহার ও ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদান। [জন্মভুমি ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের দূত মঈদুল হাসান দিল্লিতে গোয়েন্দা সংস্থা (‘র’) প্রধান রামনাথ কাওয়ের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি আলাদা একটি বাহিনী হিসেবে মুজিব বাহিনী গঠনের ফলে উদ্ভূত সমস্যা নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেন। [ যুগান্তর ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
পাকিস্তানী সৈন্য ও রসদবাহী ট্রেন ধ্বংস
মুক্তিবাহিনী লেঃ মোরশেদের নেতৃত্বে আখাউড়া-হরশপুর রেলওয়ে লাইনে মুকুন্দপুরের কাছে ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন পুঁতে তার সাথে বৈদ্যুতিক তার যোগ করে ৩০০ গজ দূরে রিমোট কন্ট্রোল স্থাপন করে অবস্থান নেয়। পাকবাহিনীর এক কোম্পানী সৈন্য বোঝাই একটি ট্রেন এ্যামবুশ অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়ে মাইনের উপরে এলে মুক্তিযোদ্ধারা সুইচ টিপে মাইন বিস্ফোরণ করে। এতে ইঞ্জিনসহ ট্রেনটি বিধ্বস্ত হয় এবং দুইজন অফিসারসহ ২৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। [মেজর নাসির, যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা]
প্রাদেশিক স্বরাষ্ট্র দপ্তরের পাক্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে প্রকাশিত আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি
১) মুক্তিবাহিনী সিরাজগঞ্জের কাজীপুর থানা আক্রমন করে। পুলিশ ও রাজাকারের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আক্রমন প্রতিহিত। হতাহত নাই।
২)মাদারীপুরের ঘাঁটমাঝি এলাকায় মাদারীপুর মোস্তফাপুর সড়কে মুক্তিবাহিনীর পুতে রাখা মাইনে কয়েক পুলিশ সদস্য ও রাজাকার নিহত। মহকুমা পুলিশ অফিসার এবং ওসি সামান্য আহত হয়েছে। [শামশুল আরেফিন, বাংলাদেশ কোড]
বড়লেখায় পাকসেনাদের অবস্থানের ওপর মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ
মৌলভীবাজারের বড়লেখার শাহবাজপুরে মুক্তিবাহিনীর ৪ নং সেক্টরের বড় পুঞ্জি সাব সেক্টরের ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল (কমান্ডার ক্যাপ্টেন রব) পাকসেনাদের শাহবাজপুর অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। ১০ মিনিট পর পাকসেনারা পাল্টা আক্রমণ চালালে উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে ১৫ জন পাকসৈন্য ও রাজাকার নিহত হয়। মুক্তিবাহিনী অক্ষত অবস্থায় নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসে।
[মেজর রফিক, সেক্টর ভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস]
২ এমপিএ কে মামলা থেকে অব্যাহতি
যে সকল প্রাদেশিক এমপিএ এর বিরুদ্ধে সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার জন্য সমন জারী হইয়াছিল তাদের মধ্যে কেউ কেউ আদালতে হাজিরা দিয়াছিলেন। এদের মধ্যে টাঙ্গাইলের বাসাইল (আসন নং ১৩৮) থেকে নির্বাচিত জনাব শামসুদ্দিন আহম্মদ এবং হবিগঞ্জ সদরের আবুল হাসেম ( আসন নং ২০৮) মামলা থেকে অব্যাহতি লাভ করিয়াছেন। [ইত্তেফাক ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
নোট ঃ ডাঃ আবুল হাসেম সপ্তাহ খানেক পর পিঁডিপিতে যোগদান করেন।
সাভারে রাজাকার প্রশিক্ষন সমাপ্ত
সাভারে রাজাকারদের প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষন সমাপ্ত হয়। এদের অচিরেই ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় মোতায়েন করা হবে।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচীতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠক করেন। কূটনৈতিক মহল জানায়, বৈঠকে ভুট্টো ইয়াহিয়ার কাছে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দেওয়ার দাবী জানান, কিন্তু ইয়াহিয়া ভুট্টোর প্রস্তাবে সম্মতি দেননি। [ইত্তেফাক ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
ফিলিপাইনে পাকিস্তানের বাঙালি রাষ্ট্রদূত খুররম খান পন্নী পদত্যাগ করে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেন। পদত্যাগের পর খুররম খান পন্নী ম্যানিলায় অবস্থান করছেন। নাইজেরিয়ার রাজধানী লাগোসে পাকিস্তান হাইকমিশনের বাঙালি চ্যান্সারি কর্মকর্তা মহিউদ্দিন আহমদ জায়গীরদারও পদত্যাগ করে এই দিন সপরিবার লন্ডন পৌঁছে বাংলাদেশ মিশনে যোগ দিয়েছেন। [ইত্তেফাক, যুগান্তর ১৪/১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের সম্মেলনে নিউজিল্যান্ডের প্রতিনিধি এইচ.সি. টেম্পেল্টন পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য কমনওয়েলথ এবং ব্রিটেনের প্রতি আবেদন জানান। সাবেক কমনওয়েলথ বিষয়ক ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বটমলি শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে সব সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি শেখ মুজিবকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জন্য কথা বলার একমাত্র ব্যক্তি বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যেন পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেন। [যুগান্তর ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
দালাল তৎপরতা
এক বিবৃতিতে ইত্তেহাদুল ওলামা প্রধান মওলানা মিয়া মফিজুল হক বলেছেন পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতির অবসান ঘটানোর জন্য গভর্নর যে মন্ত্রী পরিষদ গঠন করতে যাচ্ছেন তাতে দ্রুত শান্তি শৃঙ্খলা ফিরে আসবে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন ২৪ বছর যাবত যাদের গোপন হাতের উত্থান পতনের ফলে দেশের মানুশের উপর নানা প্রকার দুর্ভোগ নেমে এসেছে। মন্ত্রী পরিষদ গঠনের আগে সে বিষয় খেয়াল রাখার জন্য তিনি গভর্নরের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। তিনি বলেন এ ধরনের লোকদের মন্ত্রী পরিষদে নেয়া হলে সমস্যার সমাধান তো হবেই না বরং ভুলের পুনরাবৃত্তিই ঘটবে। তিনি বলেন সমাজের যে শ্রেণীটিকে অর্থনৈতিক সামাজিক শিক্ষা ক্ষেত্রে এমনকি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অবহেলা করা হয়েছে তারাই আজ জাতীয় দুর্যোগে এগিয়ে এসেছেন। সেই হিসেবে তিনি সর্বজন স্বীকৃত কয়েকজন নিঃস্বার্থ যোদ্ধা আলেমকে মন্ত্রী পরিষদে নেয়ার জন্য সুপারিশ করেছেন। তিনি বগুড়া মাদ্রাসার মওলানা নজিবুল্লাহ, মওলানা আব্দুল আলী ফরিদপুরি,নেজাম সভাপতি মওলানা সিদ্দিক আহমেদ, জমিয়তের মওলানা মুসলেহ উদ্দিনের নাম প্রস্তাব করেছেন। [সংগ্রাম ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
ভারতের তৎপরতা
দিল্লির কূটনৈতিক মহল এবং পাকিস্তানের মিডিয়া গুলো জানিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংয়ের শ্রীলঙ্কা সফর ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধান , বাংলাদেশে সেনা ও রসদ পাঠানোর কাজে নিয়োজিত পাকিস্তানি বিমান ও জাহাজকে নামার ও জ্বালানী নেয়ার যে সুযোগ শ্রীলঙ্কা দিয়ে আসছিল তা সরণ সিং এর এ সফরএ বন্ধ করা বা ইস্তেহারে আনা সম্ভব হয়নি। [যুগান্তর/সংগ্রাম ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত জন কেনেথ গলব্রেথ শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে এসে কলকাতায় এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন, পূর্ব বাংলার জনগণকে অনভিপ্রেত কোনো সরকারের অধীনে রাখলে তা পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের জন্য বিপর্যয়কর হবে। বাংলাদেশ সমস্যার একমাত্র সমাধান সেখানকার জনসাধারণকে তাদের ইচ্ছানুযায়ী সরকার গঠন করতে দেওয়া। বাংলাদেশে এরকম পরিবেশ সৃষ্টি হয় যাতে শরণার্থীরা সেখানে ফিরে যেতে পারেন। তিনি বলেন এরুপ অবস্থা সৃষ্টি করলে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি না দিলেও তিনি সে সমাধাঙ্কে স্বাগত জানাবেন। তিনি বলেন শেখ মুজিবুর রহ্মানের একমাত্র দোষ তিনি নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছিলেন।তিনি বাংলাদেশের জনগনের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার চেয়েছিলেন। পরে তিনি দিল্লীতে ফিরে ভারতের পরিকল্পনা কমিশনে গমন করেন এবং কর্মকর্তাদের সাথে মতবিনিময় করেন। [যুগান্তর ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী জি এম সাদিক বলেছেন আমাদের সময়ের সবচে দুঃখজনক ঘটনা বাংলাদেশের গণহত্যা পৃথিবীতে সহানুভুতি আদায়ে সক্ষম হয়নি। তিনি বলেন ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে দিল্লিতে শুরু হতে যাওয়া বাংলাদেশ বিষয়ক আন্তজার্তিক সম্মেলনের প্রস্তুতি কমিটির কাছে লেখা এক বার্তায় তিনি এ কথা বলেন।[যুগান্তর ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধিদলের নেতা এবং লোকসভার স্পিকার জি এস ধীলন কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোকে বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, পূর্ববঙ্গ সমস্যা ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে নয়, বরং পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যকার যুদ্ধের সমস্যা। তিনি বলেন বাংলাদেশের বিষয়টি সম্মেলনে পৃথক বিষয়ে আলোচনা না হওয়ায় তিনি হতাশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন পাকিস্তানে পার্লামেন্ট না থাকায় তারা ২৯ জাতির এ সম্মেলনে অংশ নেয়নি। তিনি বলেন পাকিস্তানের উচিত পূর্ব বঙ্গে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা এবং সেখান কার জনগনের ইচ্ছা মেনে নেয়া। [যুগান্তর ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
বাংলাদেশ সহায়ক শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী সমিতির উদ্যোগে কলকাতার বিড়লা একাডেমী এন্ড রিসার্চ এ বাংলাদেশ ও ভারতের ১৭ জন শিল্পীর ৬৬টি চিত্রকর্মের প্রদর্শনী সমাপ্ত হয়েছে। ১ সেপ্টেম্বর থেকে প্রদর্শনী শুরু হয়েছিল। যে সকল শিল্পীর চিত্র প্রদর্শনীতে ছিল তারা হলেন কামরুল হাসান, প্রানেশ মণ্ডল, পূর্ণ চন্দ্র, নাসির বিশ্বাস, চন্দ্র শেখর, অঞ্জন ভৌমিক, বরুন মজুমদার, মুস্তাফা মনোয়ার, রঞ্জিত নিয়োগী, কাজি জিয়ামুদ্দিন ?, নিতুন কুণ্ডু, স্বপন চৌধুরী বিরেন সোম এবং আরেকজন। [যুগান্তর ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
Prepared by Salah Uddin