পাকিস্তান আন্দোলন সাহিত্যচর্চায় প্রভাব
লাহাের প্রস্তাব, ইতিহাস পাঠকমাত্রেই জানেন সমকালীন পত্র-পত্রিকার কল্যাণে অদ্রুিত পাকিস্তান প্রস্তাব নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। এ পরিচিতির দায় জিন্না বা মুসলিম লীগের যতটা তারচেয়ে অনেক বেশি কংগ্রেস ও তাদের সমর্থক পত্রিকাগুলাের প্রচারের। যাকে বলে নিজের পায়ে কুড়ােল মারা । স্বতন্ত্র ভুবন হিসেবে পাকিস্তান’ শব্দটি ক্রমে বাঙালি মুসলমান শিক্ষিত শ্রেণীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের রাজনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে জড়িয়ে যেতে থাকে। পাকিস্তান হয়ে ওঠে তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব, অথবা বলা যায় তাদের জন্য ‘জাদু-ই-চেরাগ’। এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে যা পরবর্তী সময়ে শিক্ষিত শ্রেণিতে পাকিস্তানি চেতনা প্রসারিত করতে সাহায্য করে। বাঙালি সমাজের সম্ভবত একটি তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য রাজনীতির তুলনায় আদর্শগত দিকে সাহিত্য-সংস্কৃতির এগিয়ে থাকা, অন্য কথায় রাজনীতির ওপর সংস্কৃতির অধিকতর চালিকাশক্তির প্রভাব। উনিশ শতকের কথিত রেনেসাস এবং হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক প্রভাব থেকে একাধিক কালপর্বে এমনটাই দেখা গেছে। যেমন দেখা গেছে ১৯৫২ সালের পূর্ববঙ্গীয় ভাষা-আন্দোলনে। পাকিস্তানবাদী চেতনার প্রসার ঘটাতে ১৯৪২ সালে কলকাতায় গঠিত হয়। ‘পূর্বপাকিস্তান রেনেসাঁ সােসাইটি’। পাকিস্তান রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তখনাে একটি অনিশ্চিত প্রকল্প। তা সত্ত্বেও রাজধানী কলকাতাকেন্দ্রিক বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-সংস্কৃতির ভুবনে পাকিস্তান ঘিরে তৈরি হয় যথেষ্ট আবেগ। ধর্মীয় সংস্কৃতির চেতনায় উদ্বুদ্ধ কিছু সংখ্যক সাহিত্যিক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীর চেষ্টায় গঠিত হয় এই সােসাইটি। এর মতাদর্শগত উদ্দেশ্য উদ্যোক্তাদের ভাষায়, ‘পাকিস্তানবাদের সাহিত্যিক রূপায়ন এবং সাহিত্য সংস্কৃতিচর্চায় ইসলামী তাহজিব, তমদ্দনের’ প্রকাশ ঘটানাে। তাদের মতে প্রচলিত বাংলা সাহিত্য হিন্দু সাহিত্য’। তাই মুসলমানদের জন্য সৃষ্টি করতে হবে ভিন্ন চরিত্রের সাহিত্য যা তার ধর্মীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সমান্তরাল। এবং সে হিসেবে পাকিস্তানি আদর্শের সমান্তরাল । কারণ সাহিত্যের পাশাপাশি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্রবাদী পাকিস্তানি ভাবধারার প্রচারও ছিল উদ্যোক্তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। উদ্যোক্তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ব্যক্তি আবুল কালাম শামসুদ্দিন, মুজিবর রহমান খাঁ, মােহাম্মদ খায়রুল আনাম খাঁ (মাওলানা আকরাম খাঁর পুত্র), মােহাম্মদ মােদাব্বের, আবদুল হাই প্রমুখ বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতে পরিচিত-অপরিচিত মানুষ।
তবে অবাক লাগে এদের সঙ্গে সাহিত্যিকরাজনীতিক হবীবুল্লাহ বাহার কী ভেবে যুক্ত হয়েছিলেন। আর সাংবাদিক জহুর হােসেন চৌধুরী কি পথ ভুলে, দিকভ্রষ্ট হয়ে এই ধর্মীয় চেতনাপুষ্ট সাহিত্যসংস্কৃতির সংগঠনে? ১৯৪২ সাল নাগাদই কি বাঙালি মুসলমান শিক্ষিত শ্রেণিতে পাকিস্তানি স্বাতন্ত্রবাদী চেতনা এতটা প্রবল হয়ে ওঠে যে, তাদের মননশীলতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ঘাটতি পড়েছিল এবং বাঙালিত্ববােধ অনেক অনেক পিছিয়ে পড়ে। মনে হয় এটাই ছিল বাস্তবতা ।অই কিছুদিন পর আবুল মনসুর আহমদ এই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে রেনেসাঁ সােসাইটির অন্যতম প্রধান কর্মকর্তা রূপে পরিগণিত হন। অন্যদিকে ঢাকায় ইসলামী চেতনার দুই অধ্যাপক সৈয়দ সাজ্জাদ হােসায়েন ও সৈয়দ আলী আহসান এদের ভাবধারার গভীর সমর্থকই হয়ে ওঠেননি, এক বছর পর ঢাকায় গঠন করেন অনুরূপ আদর্শে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ (১৯৪৩)। এই দুই সংগঠনের মধ্যে তত্ত্বগত কোনাে প্রভেদ ছিল না । উভয়ের লক্ষ্য ধর্মীয় সংস্কৃতিভিত্তিক সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে শিক্ষিত শ্রেণিতে পাকিস্তানি চেতনার প্রসার ঘটানাে । সাহিত্যক্ষেত্রে তাদের উদ্দেশ্য খুব স্পষ্ট। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের খােলনলচে বদলে বাংলা ভাষায় এস্তার আরবি-ফারসি শব্দ যােগ করে পাকিস্তানি বাংলা নামে এক ধরনের মিশ্রভাষা তৈরি করা । বিষয়ে শৈলীতে ইসলামি বাংলার পত্তন ঘটানাে। আর এক্ষেত্রে সাহিত্য সৃষ্টির মূল আদর্শ। পুঁথিসাহিত্য।
এ বিষয়ে আধুনিক-অনাধুনিক সবাই একমত। ঢাকার তুলনায় কলকাতার সংগঠনটি অর্থাৎ রেনেসাঁ সােসাইটি ছিল অধিকতর শক্তিমান এবং তা সম্ভবত রাজধানী কলকাতায় অবস্থিত বলে। স্পষ্ট করে বলতে গেলে দুটো সংগঠনই সম্প্রদায়বাদী (কারাে ভাষায় স্বাতন্ত্র্যবাদী) এবং প্রগতিবিরােধী । পরবর্তী সময়ে এদের সাহিত্যচর্চায় ও প্রবন্ধাদিতে পরিস্ফুট বক্তব্যে সমাজবাদ-বিরােধিতা স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে । যেমন কবি গােলাম মােস্তফার লেখায় ও নিরন্তর প্রচারে। সংগঠিত হওয়ার পর অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনে এরা পাকিস্তানবাদী সাহিত্যের তত্ত্ব হাজির করে ব্যাপকভাবে সে বিষয়ে প্রচার চালান। এর সর্বাধিক প্রকাশ ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে (১-২ জুলাই) অনুষ্ঠিত রেনেসাঁ সােসাইটির মহাসমারােহে অনুষ্ঠিত সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্মেলনে। সম্মেলন উদ্বোধনে ইসলামি পতাকা ও পাকিস্তানের মানচিত্র সামনে রাখা হয়। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে সংগঠনের আদর্শিক প্রেরণা ইসলাম ও পাকিস্তান। বাংলা সাহিত্যকে এরা কোথায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন? তার প্রমাণ মেলে সম্মেলনের সভাপতি মহােদয়গণের বক্তব্যে ও কিছু শব্দ ব্যবহারে। ‘হাজেরান বন্ধুগণ’ সম্বােধনে অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি আবুল কালাম শামসুদ্দিন বলেন, পূর্বপাকিস্তানি সাহিত্যের তমদুনি বিশিষ্টতা খুঁজতে হবে পুঁথিসাহিত্যে এবং ধর্মীয় সংস্কৃতি হবে সাহিত্য সৃষ্টির প্রেরণা। একই কথা বলেন আরাে বিস্তারিতভাবে সম্মেলনের মূল সভাপতি আবুল মনসুর আহমদ তার দীর্ঘ বক্তৃতায় । তিনি বক্তৃতা শুরু করেন সমাগত সুধীদের ‘হাজেরানে মজলিস’ সম্বােধনে স্বাগত জানিয়ে। সােজাসাপটা পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যা দিয়ে আবুল মনসুর আহমদ বলেন, রাজনৈতিক বিচারে পাকিস্তানের অর্থ যাই হােক না কেন সাহিত্যিকের কাছে তার (অর্থাৎ পাকিস্তানের) অর্থ তমদুনী আজাদী, সাংস্কৃতিক স্বরাজ, কালচারেল অটনমি ।…তমনী আজাদী ছাড়া কোনাে সাহিত্য বাঁচা তাে পরের কথা- জন্মাতেই পারে না’ (মাসিক মােহাম্মদী, শ্রাবণ-ভাদ্র, ১৩৫১)। তিনি বলেন, পাকিস্তান একটি বিপ্লব। এ বিপ্লব আসবে সাহিত্যের মধ্য দিয়ে।
তার মতে বাংলাসাহিত্য মুসলমানের সাহিত্য নয়। রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে তিনি স্পষ্ট ভাষায়ই বলেন, রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্যের দরবারে স্থান দিয়ে গিয়েছেন। তবু এ সাহিত্য পূর্বপাকিস্তানের সাহিত্য নয়।’ রাজনীতি প্রসঙ্গে তিনি মােহাম্মদ আলী জিন্নার সুরে সুর মিলিয়ে বলেন : ‘ভারতের হিন্দু মুসলমান এক জাতি নয়।…ইসলাম আমাদের ধর্ম। ধর্ম আমাদের দীনে মােকাম্মেল। কোনাে সংস্কারের এতে গুঞ্জায়েশ নেই। …ধর্ম থেকে সংস্কৃতির জন্ম ।..সংস্কৃতির ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান যে আলাদা জাত এতে কোনাে তর্কের অবকাশ নেই। কিন্তু যুক্তিতর্কের অবকাশ ওই বক্তব্যের একাধিক বিষয়ে ছিল এবং আছে। জানি না, মহাসম্মেলনের মূল সভাপতির এ জাতীয় বিতর্কিত বক্তব্যের বিপরীতে শুদ্ধ বাঙালি সাহিত্যবাদীদের কেউ কোনাে বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলেন কি না। যেমন হুমায়ুন কবির বা এস ওয়াজেদ আলী কিংবা কাজী আবদুল ওদুদ। এরা ওই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন কি না তাও আমাদের জানা নেই। মনে হয় তারা। উপস্থিত ছিলেন না। তবে যে কোনাে যুক্তিবাদীই বলতে পারেন- হ্যা পাকিস্তান তাে বিপ্লবইতবে তা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক চেতনার এবং একই সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াশীলতার। অর্থাৎ প্রতিবিপ্লব। আর এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা চলে যে ধর্ম থেকে সার্বিক সংস্কৃতির জন্ম নয়, বরং সংস্কৃতি একটি ভাষিক জাতির জীবনযাত্রার বহুবর্ণিল রূপ। ধর্ম সে সংস্কৃতির অংশ বা অন্যতম উপকরণ। সংস্কৃতির রয়েছে আরাে নানা দিক, নানা মাত্রা। আর এ তর্ক তাে বহুদিন আগেই নিষ্পন্ন যে জাতি এবং ধর্ম এক জিনিস নয়। জাতিসত্তার অনেক ব্যাপক রূপ, তার ভিত্তি এবং বিস্তৃতি ও গভীরতা অনেক বেশি। তাই জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বিষয়ক মার্কসীয় তত্ত্ব জাতির ক্ষেত্রে প্রযােজ্য, ধর্মের বিষয়ে নয়। আসলে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিভ্রান্তিকর টানে ধর্মকে জাতির অবস্থানে এনে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভ্রান্ত রাজনীতির সাহায্যে বাঙালির সাহিত্য-সংস্কৃতিকেও বিভাজিত করা হয়। মূলত অর্থনৈতিক বৈষম্যের সমাধান করতে স্বাতন্ত্রবাদী রাজনীতির আবির্ভাব।
সেখানে সাধারণ মিলনক্ষেত্র সাহিত্যকে রাজনীতির তরবারির আঘাতে বিভক্ত করার প্রয়ােজন ছিল না। কিন্তু করেছিলেন কিছু সংখ্যক ধর্মীয় চেতনার মানুষ- লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী মূলত তাদের রক্ষণশীল চিন্তার প্রভাবে। | সত্যি বলতে কি পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর স্বতন্ত্রভাবে উন্নয়নের চিন্তাই নয়, বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনৈতিক চিন্তা শিক্ষিত মুসলমান-মনে চেপে বসেছিল । এর প্রভাব দেখা গেছে সাহিত্য-সংস্কৃতির বড়সড় অংশে। রাজনীতির টানে মধ্যপন্থীরাও সাহিত্য অঙ্গনে বিভাজিত চেতনার অংশীদার। তাই দেখা যায় উল্লিখিত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার প্রভাব। সে প্রভাবের চাপে তারা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে মিলের চেয়ে ভেদটাই খুঁজে ফিরেছেন। যেমন পূর্বোক্ত বক্তৃতায় আবুল মনসুর আহমদ বলেছেন, ‘এ কথা মানি যে। হিন্দুর সংস্কৃতি ও মুসলমানের তমদুনে একশ একটা মিল রয়েছে। কিন্তু এটাও মানতে হবে যে তাদের মধ্যে গরমিলও রয়েছে প্রচুর। মিলটাই সত্য নয়, গরমিলটাই সত্য।’ কী উদ্ভট কথা। মানুষের মধ্যে মিলের চেয়ে গরমিলটাকে যে বা যারা বড় করে তুলতে বা দেখতে চান তার বা তাদের চেতনায় সঙ্কীর্ণতা ও সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব বড় হয়ে ওঠার কথা। সে প্রভাব সাহিত্যে পড়তে। বাধ্য। বাস্তবে তা পড়েছেও। কিন্তু এ প্রভাব সম্প্রদায়বাদী, পাকিস্তানবাদীরা। ধরে রাখতে পারেননি এই যা। চুয়াল্লিশ থেকে বায়ান্ন- আট বছরের মধ্যেই রক্ষণশীলতার অচলায়তনে ভাঙন শুরু। বায়ান্নে-চুয়ান্নে পাকিস্তানি চেতনার সেখানে হার। রাজনৈতিক মিল-গরমিলের প্রশ্নে উদ্বিগ্ন রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন যে, বাংলাদেশে সৌভাগ্যক্রমে আমাদের একটা মিলনের ক্ষেত্র আছে…সে আমাদের ভাষা ও সাহিত্য। এখানে আমাদের জাতিভেদের কোনাে ভাবনা নেই’ (রচনাবলী ২৩)। কিন্তু চল্লিশের দশকে বিভাজন ভাবনা তৈরি করা হয় রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে। বিভেদের বীজ এমন গভীরভাবে মাথায় গেঁথে গিয়েছিল যে আবুল মনসুর আহমদের মতাে বাংলা ভাষার সাহিত্যিক বিভ্রান্তির অচলায়তনে বন্দি হয়ে পড়েন। আবুল কালাম শামসুদ্দিনের পথ অনুসরণ করে আবুল মনসুর আহমদও সাহিত্য সৃষ্টির প্রেরণা খুঁজেছেন পুঁথিসাহিতে। আধুনিকতাকে বিসর্জন দিয়ে অনাধুনিক পথটাকেই আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলেন তারা।
তাই বলতে দ্বিধা হয়নি : ‘মাদ্রাসা মক্তবে শিক্ষিত লাখ লাখ মুসলমান পাঠক পুঁথিসাহিত্য থেকেই জীবনের প্রেরণা পাচ্ছে। কাজেই পুঁথিসাহিত্য থেকেই বাঙালি মুসলমানকে সাহিত্যের পাঠ নিতে হবে। এমন উদ্ভট কথাও আমাদের অগ্রজ কারাে কারাে কাছ থেকে শুনতে হয়েছে। আর ভাষা? সে সম্পর্কে তাদের বক্তব্য আরাে নির্মম, আরাে যুক্তিহীন। আসলে পাকিস্তান নামক স্বপ্ন আমাদের শিক্ষিত শ্রেণির একাংশের চিন্তাভাবনা সবকিছু এলােমেলাে করে দিয়েছিল। তাই ভাষা সম্পর্কে এমন উদ্ভট কথা আবুল মনসুর আহমদের পক্ষে বলা সম্ভব হয় : বাঙলা বর্তমান বর্ণমালার আবর্জনা আমরা রাখব না ।…মাত্র কুড়িটি হরফ ও চারটি হরকত বা কার থাকবে। ফলা বা যুক্তাক্ষর কিছুই থাকবে না।’ আরবি-ফারসি শব্দের মিশ্র বাঙলার পক্ষে পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি তুলে আবুল মনসুর আহমদ তার দীর্ঘ বক্তৃতা শেষ করেন। এভাবে ১৯৪৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে সম্প্রদায়বাদী পাকিস্তান। রাজনীতির ধারায় প্রচলিত বাংলা ভাষার ইসলামী সংস্কার ও ধর্মীয় সংস্কৃতিবাদী সাহিত্য সৃষ্টির প্রস্তাব নিয়ে রেনেসাঁ সােসাইটির দুদিনব্যাপী সাহিত্য সম্মেলন শেষ হয়। সভাপতির ভাষণে ছিল সাহিত্য-সংস্কৃতি বদলের রূপরেখা যাতে আধুনিকতা বা প্রগতির নামগন্ধ ছিল না। ছিল ওই দুই দিকেই বিরােধিতা । এবং তা এমন দু-একজনের হাত ধরে যারা এক সময়ে সাহিত্যসৃষ্টির ক্ষেত্রে উদার আধুনিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। যেমন হবীবুল্লাহ বাহার বা আবুল মনসুর আহমদ। এবং তারা প্রচলিত বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা করে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তাই তাদের এ অভিযােগ খাটে না যে বাংলা সাহিত্য তাদের নয় এবং বাংলাভাষা বাঙালি মুসলমানের সাহিত্য সৃষ্টির অনুকূল নয়। তা সত্ত্বেও তারা বিশেষ করে পূর্বোক্ত দুজন বাদেও অধ্যাপক সৈয়দ সাজ্জাদ হােসায়েন (সাহিত্য শাখার সভাপতি), মুজিবর রহমান খাঁ (তাহজিব তমদ্দন শাখার সভাপতি) অধিকতর উগ্র ভাষায় সাম্প্রদায়িকতাবাদী সাহিত্যের পক্ষে তাদের মতামত ব্যক্ত করেন। অথচ তাদের দাবি তারা মুসলিম বাঙলার ইন্টলেকচুয়াল মুভমেন্টের প্রতীক’।
ইন্টলেক্ট-চর্চা তথা বুদ্ধি ও মননের চর্চা যে ধর্মীয় রক্ষণশীলতায় ভর করে একসঙ্গে চলে না, যুক্তি ও মানবিক চেতনাকে সঙ্গে নিয়ে চলে পাকিস্তানবাদী রাজনীতির বিভ্রান্তির টানে তারা এ সত্যুভুলে গিয়েছিলেন, তাই অধ্যাপক সাজ্জাদ হােসায়েন রবীন্দ্রনাথ তাে বটেই সেকুলার নজরুলকেও বাতিল করে হালি ও ইকবালের উত্তরসূরি হিসেকে পুঁথিসাহিত্যনির্ভর সাহিত্য সৃষ্টির আহ্বান জানান। আর তওহিদপন্থী মুসলমানের সঙ্গে বাংলাসাহিত্যের সংঘর্ষ অনিবার্য, এমন মন্তব্য করেন মুজিবর রহমান খাঁ। তুলনায় শিক্ষা শাখার সভাপতি হবীবুল্লাহ বাহার সােভিয়েত শিক্ষা ব্যবস্থার প্রশংসা করে কিছুটা নমনীয় ভাষায় ‘গণতান্ত্রিক ইসলামী সভ্যতা ও বিপ্লবী ইসলামী সংস্কৃতি’ অনুসরণের কথা বলেন। কিন্তু এ বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা না দিয়ে অনুকূল স্রোতেরই অনুগামী হন। তারা সাহিত্য-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে পাকিস্তানবাদী এক সঙ্কীর্ণ ও রক্ষণশীল চিন্তা দ্বারা তাড়িত হয়ে পরবর্তী সাতআট বছর ওই ধারার প্রচারেই ব্যস্ত থাকেন। বিশেষ উগ্রতা নিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর। তাই ডা, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ পাকিস্তানি পূর্ববঙ্গে অনুষ্ঠিত প্রথম সাহিত্য সম্মেলনে মূল সভাপতির ভাষণ দিতে গিয়ে এদের ‘মতিচ্ছন্ন হওয়ার কথা বলে ভুল কিছু বলেননি। | চল্লিশের দশকের প্রথমার্ধেই পাকিস্তানবাদী সাহিত্য রচনা নিয়ে রেনেসাঁ সােসাইটি বা সাহিত্য সংসদের ধারক-বাহকদের উন্মাদনা সাহিত্যের সঙ্কীর্ণ গলিপথ ধরে পাকিস্তানের পক্ষে দামামা বাজিয়ে প্রচারে নামে। সে প্রচারের উন্মাদনায় মধ্যপন্থী বা প্রচলিত সাহিত্যপন্থী কোনাে কোনাে কবি, লেখকও ভেসে যান। যেমন কবি শাহাদাত হােসেন বা সৈয়দ এমদাদ আলী, লেখকসাংবাদিক কাজী মােহাম্মদ ইদরিস। শুরু হয় পাকিস্তান সংগীত’ বা ‘পুণ্য পাকিস্তান’ বন্দনায় কবিতা লেখা। তাই সৈয়দ আলী আহসান লিখতে পারেন মিশ্র ভাষায়- ‘কোরবানি’ শীর্ষক নাটক (খােদার লা’নতে মৃত্যু হরিল কাফেরের প্রাণ কণা’) ও মিশ্র ভাষায় কবিতা (পদ্য বলাই সঙ্গত)। একই বছরে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে মূল সভাপতি সৈয়দ এমদাদ আলী তার ভাষণে বলেছেন, ‘মনের দিক দিয়া আমাদের খাঁটি মুসলমান হইতে না পারিলে আমাদের প্রকৃত নবজীবন লাভ সম্ভব হইবে না’ (মােহাম্মদী, বৈশাখ, ১৩৫১)।
তিনিও যথারীতি রেনেসাঁস অর্থাৎ নবজাগরণের সম্ভাবনাকে ধর্মীয় জাগরণের পথে চালিয়ে দেন অনেকটা উনিশ শতকী রেনেসাঁসের সাহিত্যধারার মতাে করে। বিশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে এমন পথধরা কিছুটা অভাবিতই ছিল। কিন্তু পাকিস্তানি রাজনীতি এ ক্ষেত্রে উদ্দীপনা সঞ্চার করে থাকবে। তাই এ সম্মেলনেও বলা হয় জাগরণকে স্থায়ী করিবার জন্য আমাদের ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি এবং জাতীয় ভাব ও আদর্শের পরিপুরক সাহিত্যই সৃষ্টি করিতে হইবে। মুসলিম হিসাবে বাঁচিয়া থাকার ইহাই একমাত্র পথ ও প্রকৃষ্ট পথ’ (প্রাগুক্ত)। এ বক্তব্যে উগ্রতা না থাকলেও ঈহিত্য সৃষ্টির জন্য ধর্মবাদী পথের ঠিকানাই নির্দেশ করা হয়। সময়ের আহ্বান থাকলেও তা পূর্বোক্ত সম্প্রদায়বাদী উগ্রতায় ভেসে যায়। আসলে বাঙালি মুসলমানের সাহিত্য সাধনা এ সময়পর্বে মুসলিম লীগের সম্প্রদায়বাদী রাজনীতি ও দ্বিজাতিতত্ত্বের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কারণে তাদের পথচলায় ধর্মীয় রক্ষণশীলতার প্রভাব বড় হয়ে ওঠে, যা ছিল পাকিস্তানি রাজনীতির সমান্তরাল। তাই হিন্দু মুসলমান দুই ভিন্ন জাতি- এই রাজনৈতিক তত্ত্বের পথ ধরে ধর্মীয় ভেদরেখায় বাংলা সাহিত্যকে হিন্দু সাহিত্য ও মুসলমান সাহিত্য এই দুই ধারায় দ্বিখণ্ডিত করার তামদুনিক আদর্শ নিয়ে প্রচারে নামে রেনেসাঁ সােসাইটি। এই সঙ্কীর্ণ ধর্মীয় পথ অনুসরণের আশঙ্কা করে সম্মেলনে উপস্থিত বঙ্কিম মুখার্জি ভিন্ন ধারায় সঠিক বক্তব্য রেখেছিলেন। তিনি বলেন, “উনিশ শতকের হিন্দু রেনেসাঁসের মতাে এই রেনেসাঁ আন্দোলনও যেন বিপথে না যায়। তার আশঙ্কা ভুল ছিল না। পাকিস্তানবাদী সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী সাহিত্যচর্চায় নিরন্তর পাকিস্তান বন্দনায় ব্যস্ত থেকে বিপথকেই তাদের পথ হিসেবে বাছাই করে নেন। তারা বাংলা সাহিত্যকে বিভাজিত করার চেষ্টার মধ্য দিয়েই রাজনৈতিক প্রচারে ভারত বিভাগ নিশ্চিত করার পথ ধরে এগিয়ে যেতে থাকেন। প্রতিপক্ষের ভুল-ক্রটি তাদেরও ভুল পথে যাত্রায় উৎসাহিত করে। শেষ পর্যন্ত দেশবিভাগ অর্থাৎ ভারত বিভাগ ও বঙ্গবিভাগ অনিবার্য পরিণতি হয়ে দাঁড়ায়। তবে মনে রাখতে হবে মুসলিম বাংলায় আধুনিক ও প্রগতিশীল ধারার সাহিত্যিক একই সময়ে সৃষ্টিশীল ছিলেন। তারা ছিলেন সংখ্যায় কম কিন্তু সৃষ্টিগুণে অধিকতর মান সম্পন্ন। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য কাজী আবদুল ওদুদ, হুমায়ুন কবির, এস, ওয়াজেদ আলী, কাজী মােতাহার হােসেন প্রমুখ।
সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক