1971.09.11 | ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ | আজকের এদিনে (with references)
জাতীয় পরিষদ সদস্য এনায়েত হোসেন এর সভাপতিত্তে খন্দকার মোস্তাক, আব্দুর রব সেরনিয়াবত, যুব নেতা শেখ মনি, শেখ আব্দুল আজিজ সহ কতক পরিষদ সদস্য ও রাজনৈতিক নেতা অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করে প্রবাসী সরকার প্রধান এবং আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে তাজউদ্দীনকে অপসারণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। [মিজান চৌধুরী রাজনীতির তিন কাল পৃষ্ঠা ১২৮]
ভাসানী ন্যাপ এক গোপন স্থানে বৈঠক করে দলের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমানকে রাষ্ট্র বিরোধী তৎপরতার অভিযোগে দল থেকে বহিস্কার করেছে। তিনি বর্তমানে পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন। [কালান্তর ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
যুগান্তর পত্রিকা বলেছে পাক সরকার বেগম মুজিবকে ৩২ নং বাড়ীতে অবস্থান করার অনুমতি দিয়েছিল কিন্তু বেগম মুজিব তাতে সম্মতি দেননি। পত্রিকাটি বলেছে মুজিবের দুই পুত্র শেখ কামাল এবং শেখ জামাল পালিয়ে গিয়েছে। বেগম শেখ এখন ১ কিমি দূরে ২৬ সেনা পাহারার আরেক বাড়ীতে আছেন। বাড়ীর রাস্তা সংলগ্ন দু গেট সারাদিন বন্ধ থাকে। রাতেও গেট তালাবদ্ধ থাকে। বেগম শেখ এর সাথে বা শেখ মুজিবের বা তার কৌঁসুলি ব্রোহীর সাথে তার যোগাযোগ নেই। বেগম শেখের সাথে আছেন তার দুই কন্যা এবং এক শিশুপুত্র। তার এক মাত্র জামাতাও তাদের সাথে থাকেন। [এপি ১০ সেপ্টেম্বর/যুগান্তর/কালান্তর ১২ সেপ্তেম্বর ১৯৭১]
ঝাকঝমক ভাবে কায়েদে আজমের জন্ম বার্ষিকী পালন
পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাসে পূর্ব পাকিস্তানে এবারই প্রথম ঝাক ঝমক ভাবে কায়েদে আজমের জন্ম বার্ষিকী উদযাপন করা হয়। এবারের অনুষ্ঠান মালা গুলোতে প্রতিষ্ঠান সমুহ এবং পাকিস্তানপন্থী বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবীদের ব্যাপক অংশ গ্রহন ছিল।
নজরুল একাডেমীর অনুষ্ঠানে সভাপতি হিসেবে ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি মকসুমুল হাকিম তার আলোচনায় এ কায়েদে আজমের ন্যায় নিষ্ঠার আদর্শ অনুসরণ ও তা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। আলোচনায় আরও অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের রিডার মোহর আলী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রোকেয়া হলের প্রভোস্ট মিসেস আখতার ইমাম, অধ্যাপক সাহেদ আলী এবং মওলানা আমিনুল ইসলাম। আলোচনা শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কবিতা আবৃত্তি করেন একাডেমীর সভাপতি কবি তালিম হোসেন, জাহানারা আরজু, সৈয়দ শামসুল হুদা, ইকবাল হোসেন। সঙ্গীত পরিবেশন করেন শেখ লুতফর রহমান, আব্দুল লতিফ, নুরুল ইসলাম টুলু ও কবি তালিম হোসেনের তিন কন্যা ইয়াসমিন মুস্তারী, পারভিন মুস্তারী, শবনম মুস্তারী। নজরুল একাডেমীর শিশু বিদ্যালয়ের শিশুরা।
কার্জন হলে পাকিস্তান একাডেমী, বাংলা একাডেমী, কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামিক একাডেমী, পাবলিক লাইব্রেরী, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা বিভাগ, রেডিও ও টেলিভিশন ইসলামী ছাত্র সংঘের সাথে যৌথ ভাবে কার্জন হলে এক বিশাল প্রদর্শনীর আয়োজন করে। প্রত্যেক সংস্থা তাদের নিজস্ব স্টল আকারে তাদের প্রদর্শনী উপস্থাপন করে। এখানে সারাদিন কায়েদে আজমের ভাষণ শুনানো হয় এবং কায়েদের জীবন ভিত্তিক ভিডিও দেখানো হয়। বাংলা একাডেমী তাদের বিভিন্ন প্রকাশনা প্রদর্শনীতে উপস্থাপন করে।
ঢাকা শহর শান্তি কমিটি আহসান উল্লাহ রোডে এক আলোচনা সভা, মিলাদ ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করে এতে আলোচনায় অংশ নেন শহর শান্তি কমিটি সাধারন সম্পাদক মনসুর আলী, যুগ্ন সম্পাদক রইস উদ্দিন, প্রচার সম্পাদক মোবারক হোসেন, ওয়াহিদুল্লাহ ও হাবিবুল হক। অনুষ্ঠানে মুন্নি আস্মি রুব্বার গাওয়া জাতীয় সঙ্গীত দর্শকদের আলোড়ন সৃষ্টি করে।
কায়েদে আজমের জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বানী দিয়েছেন।
ইরান সফরে যাওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান করাচী এদে পৌঁছেছেন।
পাকিস্তান সরকার ব্রিটেনে বাঙ্গালী ছাত্রদের বৃত্তি বাতিল করছে।
[ইত্তেফাক, পাকিস্তান, সংগ্রাম ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
নুরুল আমীন
কায়েদে আজমের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে মইনুদ্দিন মেমোরিয়াল হলে ঢাকা শহর পিডিপির এক আলোচনা সভায় পিডিপি প্রাদেশিক প্রধান নুরুল আমীন কায়েদে আজমের কর্মময় জীবনের উপর আলোচনা করেন। তিনি বলেন ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রে পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য অধিকার ও আইন সঙ্গত দাবী গুলো পূরণ করতে হবে। তিনি বলেন একটি শাসনতন্ত্র নাকি প্রস্তুত করা হয়েছে তা তিনি দেখেননি। সভায় মাহমুদ আলী, এডভোকেট জুলমত আলী, রফিকুল হোসেন বক্তব্য রাখেন। [ইত্তেফাক, পাকিস্তান, সংগ্রাম ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
কায়েদে আজমের মৃত্যু বার্ষিকীতে গোলাম আজম
কায়েদে আজমের মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকায় ইসলামী ছাত্র সংঘ আয়োজিত চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন প্রাদেশিক জামাত সভাপতি গোলাম আজম। তিনি সেখানে বলেন ইসলামী আদর্শে যারা বিশ্বাসী এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদে যারা আস্থাশীল তাদেরই কায়েদে আজমের প্রতি শ্রদ্ধা বোধ রয়েছে শুধু তারাই কায়েদে আজমের আমানত পাকিস্তান রক্ষা করতে পারবে। তিনি দুঃখ করে বলেন প্রদর্শনীটা সরকারী ভাবে আরও বড় পরিসরে করা যেত। আগে কায়েদে আজমের মৃত্যুবার্ষিকী দায়সারা ভাবে পালন করা হইত। যখন মানুষ মহান নেতাকে ভুলে যেতে বসেছে তখনই ছাত্র সংঘের এই আয়োজন অত্যন্ত আশাব্যাঞ্জক। তিনি বলেন পাকিস্তান আন্দোলনের সময়ের মত পাকিস্তান রক্ষার জন্য এখন নতুন করে বিশাল কর্মী বাহিনী গঠন খুব প্রয়োজন। তিনি ইসলামী ছাত্র সংঘকে ইঙ্গিত করে আশা প্রকাশ করে বলেন এ কর্মী বাহিনীই কায়েদে আজমের পাকিস্তানকে রক্ষা করতে পারবে।
প্রদর্শনীতে কায়েদে আজমের ভাষণ বাজানো হয়। [ইত্তেফাক, পাকিস্তান, সংগ্রাম ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
গভর্নর সকাশে কনভেনশন মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ
গভর্নর এ এম আব্দুল মালিক কনভেনশন মুসলিম লীগের প্রাদেশিক সভাপতি শামসুল হুদা চৌধুরী ও তার দলের একটি প্রতিনিধিদলের সাথে মতবিনিময়ের সময় বলেন যে কোন ভাবেই হোক প্রতি পাকিস্তানির জানমাল রক্ষা এবং জনগনের মনে আস্থার ভাব পুনঃ প্রতিষ্ঠা করা হবে। পরে শামশুল হুদা সাংবাদিকদের বলেন প্রদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা বিশেষ করে বন্যা দুর্গতদের ত্রান ও পুনর্বাসন নিয়ে তারা গভর্নরের সহিত আলোচনা করেছেন। গভর্নরকে তারা তার মন্ত্রীসভায় সম্ভাব্য সদস্যদের তালিকা ও সম্ভাব্য দপ্তর নিয়েও আলোচনা করেন। [ইত্তেফাক, পাকিস্তান, সংগ্রাম ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
মাহমুদ আলী
পিডিপিঁ ভাইস প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আলী দীর্ঘদিন বিদেশ সফর শেষে ঢাকা ফিরে আসেন। আগামীকাল তার দলের আঞ্চলিক ইউনিট এর সংবর্ধনা সভায় তিনি তার সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করবেন। [ইত্তেফাক, পাকিস্তান, সংগ্রাম ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
মওলানা এ টি সাদীর ঢাকা ত্যাগ
পাকিস্তান শান্তি কমিটির কেন্দ্রীয় নেতা এবং পাকিস্তান দরদী সংঘের সভাপতি এ টি সাদী ও পাকিস্তান শান্তি কমিটির কেন্দ্রীয় নেতা ও পিডিপি নেতা এডভোকেট জুলমত আলী খান জাতিসংঘ সাধারন পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য নিউইয়র্কের উদ্দেশে দেশ ত্যাগ করেছেন। [ইত্তেফাক, পাকিস্তান, সংগ্রাম ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
মওলানা সিদ্দিক ও মওলানা নুরুজ্জামানের আবেদন।
নিখিল পাকিস্তান নেজামে ইসলাম দলের সাধারন সম্পাদক মওলানা সিদ্দিক আহমেদ পৃথক পৃথক ভাবে বিবৃতিতে বলেন জাতিসংঘে পাকিস্তানী প্রতিনিধিদলে গোলাম আজম প্রস্তাবিত আরও কয়েকজনকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ইয়াহিয়া খানের প্রতি অনুরোধ করেছেন। দলের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি সংক্রান্ত গোলাম আজমের যুক্তি গ্রহণযোগ্য। [ইত্তেফাক, পাকিস্তান, সংগ্রাম ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
পাকিস্তান শান্তি ও কল্যাণ সমিতির সাধারন সম্পাদক এবং ইসলামী গণতন্ত্রী দলের নেতা মওলানা নুরুজ্জামান অনুরূপ বক্তব্য প্রদান করেন। [ইত্তেফাক, পাকিস্তান, সংগ্রাম ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সরণ সিংহের শ্রীলঙ্কা সফর শেষে ভারত ও শ্রীলঙ্কা যৌথ ইস্তাহারে বলেছে ভারতে বাংলাদেশের শরণার্থীর সমস্যাকে একটি জরুরী সমস্যা মনে করে। এ সমস্যা ভারতকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটাপন্ন করেছে তা শ্রীলঙ্কা স্বীকার করে। বিবৃতিতে দু দেশ শরণার্থী প্রত্যাবর্তনে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সমাধান কাম্য করে। শ্রীলঙ্কা এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের নাম উহ্য রাখে। আজ সকালেও সরন সিং বন্দরনায়েকের সাথে বৈঠক করেছেন। আজই তিনি দেশে ফিরেছেন।
ভারত তার পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত সংলগ্ন রাজ্যগুলির শরণার্থী শিবির গুলো থেকে বিদেশী ডাক্তার নার্স স্বেচ্ছাসেবকদের প্রত্যাহার করে সেখানে দেশীয় লোকদের নিয়োগ দিচ্ছে। ভারতের ধারনা এদের মধ্যে কিছু গোয়েন্দা অনুপ্রবেশ ঘটেছে। লন্ডন টাইমস এর সাথে কথা বলার সময় ভারতের ত্রান মন্ত্রী খাদিলকার উক্ত তথ্য প্রকাশ করেন। রিপোর্টটি অবশ্য অনেক আগে ৩১ আগস্ট প্রকাশ হয়েছে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের উপর একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে। প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন কেন্দ্রীয় সম্প্রচার মন্ত্রী নন্দিনি সতপতি। প্রদর্শনীতে ৩০০ আলোকচিত্র রাখা হয়েছে। ছবি গুলির বেশীরভাগ নেয়া হয়েছে শেখ মুজিবের মার্চ মাসের সময়ের।
ব্রিটিশ রক্ষনশীল এমপি মিসেস জন হল সল্ট লেক ও ২৪ পরগনার আম বাগান শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে কলকাতায় রাজ্য মুখ্য সচিব এনসি সেনগুপ্তের সাথে বৈঠক করে শরণার্থী সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি পরে কেন্দ্রীয় ত্রান অতিরিক্ত সচিব কর্নেল লুথরার সাথেও বৈঠক করেছেন। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন এ সমস্যা খুব অল্প সময়ে সমাধান হবে না। তিনি এ বিশাল সমস্যা সাফল্য এর সহিত মোকাবেলা করার জন্য ভারত সরকারকে ধন্যবাদ জানান।
ভারতে ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত জ্যা ভা লাগারদ কলকাতায় রাজ্য মুখ্য সচিব এনসি সেনগুপ্তের সাথে দেখা করেছেন। তিনি আজ কয়েকটি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেছেন।
ভারতে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ গলব্রেথ কলকাতায় রাজ্য মুখ্য সচিব এনসি সেনগুপ্তের সাথে দেখা করে শরণার্থী সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন। পরে প্রেসক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলনে গলব্রেথ বলেন তিনি মনে করেন না যে বাংলাদেশ সমস্যা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। তিনি বলেন ৮৫ লাখ শরণার্থী যে পরিস্থিতিতে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে তাকে আর অভ্যন্তরীণ বিষয় বলা যায়না। তিনি বলেন পূর্ব পাকিস্তানীরা প্রদেশের নিয়ন্ত্রন না পাওয়া পর্যন্ত শরণার্থীরা দেশে ফিরে যেতে পারে না। এ নিয়ন্ত্রন স্বায়ত্তশাসন এর মাধ্যমেও হতে পারে স্বাধীনতার মাধ্যমেও হতে পারে। তিনি বলেন তিনি বাংলাদেশের একজন মন্ত্রী ও কয়েক নেতার সাথেও কথা বলেছেন। ভুটানের রাজা জিগ্মে দরজি ওয়াংচুক সল্ট লেক শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেছেন। [ কালান্তর/ যুগান্তর/আনন্দবাজার ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
Prepared by Salah Uddin