ভারত ছাড় আন্দোলন
যেমনটা আগে বলা হয়েছে চল্লিশের দশকের প্রথমার্ধ পরবর্তী বছর দুয়েকের মতােই অভাবনীয় ঘটনায় তাড়িত। যেমন লাহাের প্রস্তাব’ (১৯৪০), বিশ্বযুদ্ধের তাপ, কমিউনিস্ট পার্টির ‘জনযুদ্ধ সিদ্ধান্ত তেমনি হক-সিকান্দারের বিচিত্র পদক্ষেপ ও ক্রিপস প্রস্তাব। ভারতীয় স্বশাসনের উদ্দেশ্যে রচিত ক্রিপস প্রস্তাব ভারতের রাজনৈতিক মহল কর্তৃক প্রত্যাখ্যান যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি করে তা পূরণ করতেই কি অহিংসাপী জননেতা গান্ধির ‘ভারত ছাড়’ (কুইট ইন্ডিয়া) প্রস্তাব? কারাে কারাে মতে শূন্যতা’ নয়, হতাশা অপসপন্থী দক্ষিণী কংগ্রেস নেতা রাজাগােপালাচারীর হতাশা বােধহয় সর্বাধিক। মনে হয় ওই হতাশার কারণে তার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল পাকিস্তান প্রস্তাব সমর্থন ও লীগ-কংগ্রেস ঐক্যের শ্লোগান তােলা। এতে মহাখুশি জিন্না ও তার অনুসারী শীর্ষস্থানীয় লীগ। নেতারা। অন্যদিকে কংগ্রেস, মহাবিরক্ত- একদিকে ‘ক্রিপস প্রস্তাব’ ভণ্ডুল হওয়ায়, অন্যদিকে রাজাজির আচরণে । তারা বিশেষভাবে বিরক্ত কারণ দেশবিভাগ মেনে নেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। ক্রিপস প্রস্তাব বাতিলের এটাও একটা কারণ যদিও ওই প্রস্তাবে সরাসরি দেশভাগের কথা ছিল না। আসলে লিনলিথগাে ওয়াভেলের বিরােধিতা ও ব্রিটিশ মন্ত্রীসভায় ক্রিপসের বিরুদ্ধে কানভারি করার ফলে ক্রিপসের ওপর চাপ সৃষ্টি, ফলে ক্রিপসের অবস্থান পরিবর্তন। বিশেষ করে প্রতিরক্ষা বিভাগে ভারতীয় অন্তর্ভুক্তি এদের ক্রোধের কারণ। তাছাড়া ওদের এমন ভাবনাও ছিল যে ক্রিপস কংগ্রেসকে বেশি সুবিধা দিয়েছেন। অগত্যা ক্রিপসের পিছুহটা এবং কংগ্রেসের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান। নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি ২৯ এপ্রিল (১৯৪২) তাদের এলাহাবাদ অধিবেশনে ভারত বিভাগবিরােধী রাজনৈতিক প্রস্তাব কঠোর দৃঢ়তার সঙ্গে গ্রহণ করে। সেইসঙ্গে ছিল যে কোনাে প্রকার আগ্রাসনের প্রতিরােধ বিষয়ক সিদ্ধান্ত এবং ব্রিটিশরাজকে শাসনদণ্ড পরিত্যাগ করার আহ্বান। শেষােক্ত সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হয় হরিজন’ পত্রিকায় গান্ধির ক্রমান্বয়ে প্রবন্ধ প্রকাশ, যার মূল কথা ব্রিটিশ শাসনের স্বেচ্ছা-অবসান যা ব্রিটেন সদিচ্ছা-প্রণােদিত হয়ে করতে পারে। কিন্তু বাধ্যতামূলক না হলে কোনাে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কখনাে তা করে না। বিশ্বযুদ্ধ, জাপানি আগ্রাসন ইত্যাদি ঘটনা বিশেষ করে ক্রিস দৌত্য ব্যর্থ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে হঠাৎ করে গান্ধিকে দেখা গেল আন্দোলনের মেজাজে । বলাবাহুল্য যথারীতি তার অহিংস আন্দোলন।
এর নান্দীমুখ হিসেবে ওয়ার্ধায় কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে (৬ জুলাই, ১৯৪২) বিশেষ প্রস্তাব- অবিলম্বে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান চাই। অন্যথায় কংগ্রেস গান্ধির নেতৃত্বে দেশব্যাপী অহিংস আন্দোলন শুরু করতে বাধ্য হবে। নয় (৯) দিনের তাৎপর্যপূর্ণ বৈঠকের মূল সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জিন্নার বিবৃতি ছিল তীব্র সাম্প্রদায়িক চেতনায় জারিত। তার কথা, এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ‘ভারতে হিন্দুরাজ প্রতিষ্ঠা করা’। দুর্বোধ্য কারণে হিন্দু মহাসভা ও সাভারকরের মতাে কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা কংগ্রেস সিদ্ধান্তের পক্ষে সমর্থন জানাননি। এমনকি তেজবাহাদুর সার মতাে মধ্যপন্থী নেতারা দেশের তৎকালীন পরিস্থিতিতে সম্ভাব্য আন্দোলনের সিদ্ধান্ত বাতিল করার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। আর ব্রিটিশরাজ বা তাদের প্রতিক্রিয়া ভারতসচিব আমেরি এবং স্টাফোর্ড ক্রিপূসের বিবৃতির মূল কথা হলাে বর্তমান যুদ্ধপরিস্থিতি বিচারে এ জাতীয় আন্দোলন ভারতীয় জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী । ব্রিটিশ সরকার এখনাে ক্রিস প্রস্তাব কার্যকর করার পক্ষে এ অবস্থায় ভারত সরকারের পক্ষে কংগ্রেসের চ্যালেঞ্জ মােকাবেলা করা ভিন্ন দ্বিতীয় কোনাে পথ নেই । শ্রমিকদলীয় মুখপত্র ‘ডেইলি হেরাল্ড’-এরও একই সুর (মেনন)। এর মধ্যে দুটো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা লক্ষ্য করার মতাে। প্রথমত বর্তমান যুদ্ধকে ‘জনযুদ্ধ ঘােষণার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং জেল থেকে কমিউনিস্ট নেতাদের মুক্তি প্রক্রিয়া শুরু। দ্বিতীয়ত ভাইসরয়ের নির্বাহী কাউন্সিলের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি এবং প্রতিরক্ষা বিভাগের বিভাজন। এতে ‘যুদ্ধ বিভাগ প্রধান সেনাপতির অধীনে এবং ‘ডিফেন্স’ তথা প্রতিরক্ষা বিভাগ একজন ভারতীয় সদস্যের অধীনে। যেমনটা সর্বশেষ পিস প্রস্তাবে বলা হয়েছিল। কিন্তু তখন ভাইসরয় সাহেব তাতে মত দেননি। নতুন সম্প্রসারিত কাউন্সিলের সদস্য সংখ্যা ১৪ এবং তাদের ১১ জনই হবেন ভারতীয়। সবকিছুই জিন্নার জন্য সুসংবাদ। কিন্তু ক্রিসের উপস্থিতিতে এ কাজগুলাে করা হয়নি। বুঝতে অসুবিধা নেই, কেন করা হয়নি। ভাইসরয় কংগ্রেসকে সুবিধা দিতে রাজি নন।
এরপর সেই ক্রান্তিক্ষণ, ৭ আগস্ট (১৯৪২)। নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি বােম্বাই অধিবেশনে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির গৃহীত সিদ্ধান্তের পক্ষে সমর্থন জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করে। গান্ধীর নেতৃত্বে অহিংস জনসংগ্রাম। অধিবেশনে কংগ্রেস সভাপতি মাওলানা আজাদের প্রস্তাব হলাে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট, মার্শাল চিয়াং কাইশেক ও ব্রিটেনে রুশ রাষ্ট্রদূতের কাছে এ বিষয়ে আহ্বান জানানাের জন্য। কিন্তু এর মধ্যেই আকস্মিক আঘাত। সরকার প্রস্তুত ছিল। আগস্টের ৯ তারিখ প্রত্যুষে গান্ধিসহ কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সব সদস্য গ্রেফতার। সরকার এতটাই প্রস্তুত যে, দেশব্যাপী কংগ্রেস নেতাদের ঝাঁকে ঝাকে তুলে এনে জেলে পােরা হলাে। কংগ্রেস কমিটি ও সমাবেশ অবৈধ ঘােষণা করা হয়। আন্দোলন পরিচালনার মতাে কংগ্রেস-নেতৃত্ব আর জেলের বাইরে থাকেনি। ব্রিটিশ শাসনতান্ত্রিক চাতুর্যের কাছে গান্ধি-কংগ্রেসের হার। বলতে হয় সাংগঠনিক দিক থেকে দূরদর্শিতার অভাব । এত বড় একটি আন্দোলন, বিশেষ করে যুদ্ধাবস্থায়, সরকার যথাশক্তিতে পাল্টা আঘাত করবে এটাই স্বাভাবিক। সে ক্ষেত্রে আন্দোলনের জন্য সাংগঠনিক প্রস্তুতি থাকবে না এটাইবা কেমন কথা। শীর্ষ নেতাদের দু-চারজন বাদে অন্যদের এবং শহুরে নেতাদের আত্মগােপনের প্রস্তুতি থাকা উচিত ছিল- তা না হলে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবেন কারা? নেতৃত্বহীন আন্দোলন দ্রুতই স্তব্ধ হয়ে যেতে বাধ্য। কিন্তু গান্ধির একক নেতৃত্বের আন্দোলন তার নিজস্ব হিসাব-নিকাশ অনুযায়ীই চলে। এক্ষেত্রে চলেনি। কারণ মানুষ আন্দোলন হাতে তুলে নিয়েছে, দমননীতির জবাবে সহিংস হয়েছে ।
কংগ্রেসী প্রতিপক্ষ কারাগারে। জিন্নার ওয়ার্কিং কমিটি ওই আন্দোলনের বিরুদ্ধে নিন্দা জ্ঞাপন করেই ক্ষান্ত থাকেনি, ভারতীয় মুসলমানদের এ আন্দোলন থেকে দূরে থাকার আহ্বানও জানানাে হয়। এ সুযােগে মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারস্বরূপ পাকিস্তান পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ভাইসরয়ের প্রতি আহ্বান জানায় ওয়ার্কিং কমিটি। জিন্না নিজেও এ ব্যাপারে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। ইতিহাস লেখক সবাই এ বিষয়ে একমত যে, কংগ্রেসের অনুপস্থিতিতে জিন্নার জন্য সুযোেগ এসে যায় গােটা মুসলমান সমাজকে কাছে টানার। বস্তুত ওই কবছরে মুসলিম লীগের ব্যাপক সাংগঠনিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটে । শুরুটা ১৯৪২ আগস্ট থেকে। এর মধ্যে আরেক অঘটন যা জিন্নার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার পক্ষে অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। ডিসেম্বরের শেষ দিকে সিকান্দার হায়াতের আকস্মিক অকালমৃত্যু জিন্নার আধিপত্য বিস্তারের পথ প্রশস্ত করে দেয়। অন্যদিকে ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়’ আন্দোলন ইতিহাসে একটি তাৎপর্যময় কালখণ্ড হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এ আন্দোলন ভারত শাসনের বয়ােবৃদ্ধ ব্রিটিশ সিংহ কঠোর থাবায় দমন করে । তবে আন্দোলন মূলত রাঢ়বঙ্গ, বিহার ও উত্তরপ্রদেশের অংশবিশেষকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হলেও আন্দোলনের প্রভাব গােটা ভারতজুড়ে অনুভূত হয়। এ আন্দোলন দমন করতে সেনাবাহিনী নামাতে হয়। অজ্ঞাত কারণে হডসন ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন সম্বন্ধে কয়েক লাইন লিখে যতি টেনেছেন এই বলে যে ‘প্রায় তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন দমন করা হয় এবং বিদ্রোহের ব্যর্থতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ ব্যর্থতা প্রমাণ করে ভারতে ইংরেজ সরকার এখনাে কতটা শক্তিমান।’ কিন্তু ঘটনা কি এমন কথা বলে? হডসন এ বিদ্রোহ চিহ্নিত করেছেন সামান্য ঝাট’ (লিটল ট্রাবল) বলে । ভি, পি মেননও আগস্ট আন্দোলনের উল্লেখে তেমন কালি খরচ করেননি। কিন্তু কী ঘটেছিল ভারত ছাড়’ আহ্বানের প্রতিক্রিয়ায়? মনে হয় মানুষ তৈরি হয়েই ছিল কিছু একটা ঘটানাের জন্য। গান্ধির ঘােষণা করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে’ গান্ধির জন্য নয় আন্দোলনের কুশীলবদের জন্য সত্য হয়ে উঠেছিল। গান্ধিসহ কংগ্রেসের শীর্ষনেতৃবৃন্দ যখন কারাগার নামক আগা খান প্রাসাদের মনােরম পরিবেশে বন্দি তখন মানুষ পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙতে যে যার মতাে কিছু করেছে ও মরেছে’ । এ ক্ষেত্রে ছাত্রদেরই যথারীতি অগ্রণী ভূমিকা । তারাই হরতাল ডেকে প্রথমে রাজপথে, পরে মাঠে-ময়দানে নামে।
তাদের পথ ধরে সাধারণ মানুষ, মূলত রাজনীতিমনস্ক মানুষ ঘরের বাইরে। সরকারবিরােধী তৎপরতায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে। গান্ধির অহিংস আন্দোলন সরকারি দমননীতির পাশাপাশি প্রথম থেকেই সহিংস রূপ নিতে শুরু করে। পুলিশের লাঠি-গুলি যখন আন্দোলন দমনে ব্যর্থ তখন রণাঙ্গনে নামানাে হয় সামরিক বাহিনী। তাদের তৎপরতায় রাজপথ এবং মাঠ-ময়দান রক্তলাল হতে থাকে। আর আন্দোলনরত বিদ্রোহীদের হাতে আক্রান্ত হতে থাকে থানা, পােস্টঅফিস, টেলিগ্রাফ অফিস, ইত্যাদি। সেই সঙ্গে চলে রেললাইন ও টেলিগ্রাফপােস্ট উপড়ে ফেলার ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ। থানা পুড়েছে, অফিস পুড়েছে, সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত রেলপথ । এসব ঘটনা যদি সামান্য ট্রাবল’ই হবে। তাহলে রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতাে ধীমান লিখতেন না- জনশক্তি পাটনায় সরকারের অস্তিত্ব শেষ করে দিয়েছে’ কিংবা নামাতে হতাে না সেনাবাহিনী। শুরুতে বিহারের রাজধানী পাটনা হয়ে ওঠে শহুরে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। ছাত্র মিছিলে পুলিশের গুলিতে কয়েকটি মৃত্যু আন্দোলনের ব্যাপক বিস্তার ঘটায় (১১ আগস্ট, ১৯৪২)। ক্ষুব্ধ জনতা রাস্তায় নামে। কয়েক দিনের জন্য পাটনা মুক্ত এলাকা। দ্রুত ছুটে আসে সেনাবাহিনী, দখল করে নেয় পাটনা। এভাবে প্রতিটি শহরে দখল ও পাল্টা দখলের ঘটনা ঘটতে থাকে। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আদিম অস্ত্র নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না আন্দোলনকারীদের। এ আন্দোলনের চরিত্র মনে করিয়ে দেয় ১৯৭১-এর প্রথমার্ধে সুশিক্ষিত পাক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালির প্রতিরােধ সংগ্রামের দিনগুলাে। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে ব্রিটিশ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে। বিহার, যুক্তপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, ওড়িষ্যা থেকে দক্ষিণ ভারতের কোনাে কোনাে শহরে। এ আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্য গ্রামাঞ্চলে এর বিস্তার। তবে বিহার ও রাঢ়বঙ্গ হয়ে ওঠে সহিংস আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল । বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিশীলতায় এ আন্দোলনের চরিত্র পরিচয় ধরা রয়েছে। বিশেষ করে পাঠক মনে করতে পারেন। সতীনাথ ভাদুড়ির ‘জাগরী’ কিংবা মনােজ বসুর সৈনিক’-এর মতাে রচনাদি ।
বামপন্থী লেখক-রাজনীতিক গোপাল হালদার এগুলােকে ‘বিয়াল্লিশি বিলাস বলে যতই ঠাট্টা করুন, জনযুদ্ধের চিন্তা মাথা থেকে দূর হওয়ার পর কমিউনিস্ট লেখকগণ উপলব্ধি করেছেন যে, আগস্ট আন্দোলনের মূল্যায়নে ও চরিত্র বিচারে তারা ভুল করেছিলেন। কারণ একটাই। সােভিয়েত ইউনিয়ন ও ‘জনযুদ্ধ’ । কিন্তু তাই বলে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদবিরােধী আন্দোলনের বাস্তবতা তাে অস্বীকার করা চলে না। কোনাে মতেই না । অস্বীকার করা চলে না কমিউনিস্ট পার্টির এ বিষয়ে অনুসৃত বিভ্রান্তিকর নীতির কথা । বিভ্রান্তিকর এ অর্থে যে এ আন্দোলন গান্ধির ডাকে শুরু হলেও গান্ধি এর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে ছিলেন না। আত্মগােপনে থাকা তাদের কিছুসংখ্যক মধ্যম সারির নেতৃত্ব উপস্থিত থাকলেও আন্দোলন মূলত পরিচালিত হয় স্থানীয় ছাত্র নেতৃত্ব, আরএসপিআই, সিএসপি, ফরােয়ার্ড ব্লক ও কিসান সভার নেতাদের দ্বারা। উল্লেখযােগ্য কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দু-একটি নাম যথা- জয়প্রকাশ নারায়ণ, রামমনােহর লােহিয়া, অচ্যুত পট্টবর্ধন, অরুণা আসফ আলী প্রমুখ। গান্ধি বরং ব্রিটিশ বিতাড়নের এ সহিংস আন্দোলনের প্রতি নিন্দা জানিয়ে ১৯৪৩ সালের শুরুতে বিবৃতি প্রচার করেন এবং আন্দোলনের দায়-দায়িত্ব অস্বীকার করেন। সুনীতিকুমার ঘােষ হয়তাে ঠিকই অনুমান করেছেন যে, আন্দোলন থেকেই উঠে এসেছিল নেতৃত্ব, পরিচিত কয়েকটি নামের বাইরে যাদের নাম আমাদের জানা নেই। কমিউনিস্ট নেতাদের বােঝা উচিত ছিল, এ আন্দোলনের সঙ্গে ফ্যাসিস্ট শক্তির দেশজয়ের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। এ আন্দোলন পুরােপুরি স্বাধীনতা সংগ্রাম, দেশ থেকে বিদেশি শক্তি ব্রিটিশরাজ তাড়ানাের লড়াই। আন্দোলন সহিংসতা নিয়ে যেভাবে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল তাতে সঠিক বিপ্লবী নেতৃত্বে ইতিবাচক ফল দেখা দিতে পারত। কংগ্রেস এর দায়। অস্বীকার না করে দিকনির্দেশনা দিলেও হয়তাে কিছুটা সুফল মিলত। মিলত শ্রমিকশ্রেণী এগিয়ে এলে । কিন্তু কংগ্রেস ও সিপিআই নিয়ন্ত্রিত শ্রমিক সংগঠন এ আন্দোলনে যােগ দেয়নি অর্থাৎ যােগ দিতে বাধা দেয়া হয়েছে ।
আশ্চর্য যে, কমিউনিস্ট পার্টি এ আন্দোলনের নিন্দায় কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, ব্যক্তি রাজাগােপালাচারী প্রমুখের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়ায়। স্বাধীনতা সংগ্রাম তাদের কাছে দাম পায়নি। ‘জাগরী’র প্রতিনায়ক কমিউনিস্ট নীলুর বক্তব্যই ছিল তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির বক্তব্য এবং ফাসির আসামি বড় ভাই বিলু সম্পর্কে তার প্রতিক্রিয়াসবকিছুই অবজেকটিভলি বিচার করে দেখতে হবে।’ অর্থাৎ এ আন্দোলন। চরিত্র-বিচারে প্রতিক্রিয়াশীল। তাই সমর্থনযােগ্য নয়। কিন্তু ওই মূল্যায়ন সঠিক ছিল না। এ আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল গ্রামাঞ্চলে এর জনসংশ্লিষ্টতাবিহার, ওড়িষ্যা ও পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে । যেমন ওড়িষ্যার বিখ্যাত বালাসাের অঞ্চল কিংবা পশ্চিমবঙ্গের তমলুক, কাঁথি প্রভৃতি মহকুমা অঞ্চল এবং মহারাষ্ট্রের সাতারা, পুনে, সুরাট ইত্যাদি স্থানে। আন্দোলন এতই জোরাল হয়ে ওঠে যে প্রতিটি ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনী, কোননা কোনাে ক্ষেত্রে বিমানবাহিনীকে তলব করতে হয় । এ লড়াইকেই তাে বরং অঞ্চল বিশেষে জনযুদ্ধ বলে আখ্যা দিতে হয় বা বলা যায় কৃষক-জনতার অভুত্থান।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় মেদিনীপুরের তমলুক ও কাঁথি মহকুমায়। গণঅভুত্থানের কথা। সেখানে আন্দোলনের সূত্রে গড়ে ওঠে মুক্তিবাহিনী’ বেশ কয়েক হাজার গ্রামবাসীর সমম্বয়ে। এরা আক্রমণ চালায় থানা ও সরকারি দপ্তরে। দখল করে নেয় কয়েকটি থানা। সরকারি বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। বর্ষীয়সী জননেত্রী মাতঙ্গিনী হাজরসহ বেশ কিছুসংখ্যক সংগ্রামী নারী। তমলুক-কাঁথির স্বাধীনতা সংগ্রাম বাস্তবিকই ছিল নিমবর্গীয়দের সমন্বয়ে সংগঠিত ও জনযুদ্ধের চরিত্রসম্পন্ন । মুসলমান সম্প্রদায় ও কমিউনিস্ট সদস্যরা বাদে স্থানীয় অধিবাসী সবাই শাসকবিরােধী এ লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলেন। কৃষক সমিতিও হয়ে ওঠে লড়াইয়ের সমর্থক। গড়ে ওঠে নিজস্ব শাসনে মুক্তাঞ্চল। কিন্তু দেশের ছােট একটি অংশে মুক্তি ধরে রাখা যায়নি । যায়নি সরকারের বিশাল ও আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত সামরিক বাহিনীর তৎপরতায়। স্বভাবতই চলে সামরিক বাহিনীর অনাচার- বর্বরতা যার নাম গণগ্রেফতার, গণধর্ষণ । সবকিছুই বিদ্রোহ দমনের নামে জায়েজ বিবেচিত হয়। | চট্টগ্রামের মতাে মেদিনীপুরও সংগ্রামী ঐতিহ্যে ইতিহাস রচনা করেছে বিভিন্ন সময়ে। তিরিশের দশকের মতাে ১৯৪২ সালের শেষপর্ব তেমনই একটি কালখণ্ড, যা সংগ্রামী চরিত্রে উজ্জ্বল। স্বল্প সময়ের জন্য হলেও ওই সংগ্রাম “তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার গঠনের কৃতিত্ব নিয়ে ইতিহাসে বেঁচে রয়েছে । আশ্চর্য যে, ওই স্বাধীন সরকার ১৯৪৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত টিকেছিল। শেষ পর্যন্ত গান্ধির ব্যক্তিগত প্রচারে ও নির্দেশে সংগ্রামীদের পিছু হটতে হয় । ভেঙে দেয়া। হয় জাতীয় সরকার। আমরা অবাক হই হডসনের বক্তব্যে, তিন সপ্তাহে শাসক-সরকার নাকি গুড়িয়ে দেয় আগস্ট আন্দোলন, যেখানে কীখি-তমলুকের জাতীয় সরকার স্বেচ্ছায় ভেঙে দেয়া হয় ১৯৪৪ সালের আগস্টের পর। অর্থাৎ ছােট ছােট পকেটে হলেও এ আন্দোলন চলেছে অন্তত দুবছর সময় ধরে। সন্দেহ নেই। আগস্ট আন্দোলন কাপিয়ে দিযূেছিল ইংরেজ শাসনের ভিত । হয়তাে তাই এর রাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে সমকালে, এমনকি বছর কয় পরেও বিচার-ব্যাখ্যা চলেছে । চলেছে বিতর্ক এ আন্দোলন নিয়ে বাংলায় রচিত হয়েছে সাহিত্য। কিন্তু আন্দোলনের রাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অপেক্ষাকৃত কম হয়েছে। তেমনি কম সঠিক ইতিহাস রচনা। অথচ ওই ক্রান্তিকালে কী তাৎপর্যপূর্ণ ছিল ওই আন্দোলন। ভাইসরয় লিনলিথগাে তা বুঝলেও বুঝতে পারেনি কংগ্রেস, লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টি- ভারতের তিন প্রধান দল।
সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক