You dont have javascript enabled! Please enable it! বিয়াল্লিশের ক্রান্তিকালে জাতীয়তাবাদী মুসলমান নেতৃত্ব - সংগ্রামের নোটবুক

বিয়াল্লিশের ক্রান্তিকালে জাতীয়তাবাদী মুসলমান নেতৃত্ব

চল্লিশের দশকের প্রথম ৭ বছরের প্রতিটি বছরই ভারতীয় রাজনীতির অঙ্গনে ক্রান্তিকাল হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যােগ্য- এরপরও কি দুর্যোগের পুরােপুরি অবসান ঘটেছিল পাকিস্তানি পূর্ববঙ্গে? পূর্বোক্ত সাত বছর তাে যুক্তবঙ্গের রাজনীতির জন্য আশা-নিরাশার টানটান উত্তেজনার কাল। সেই রাজনৈতিক সংঘাত, সাম্প্রদায়িক সংঘাত- দড়ি টানাটানির খেলা, শ্বেতাঙ্গ রেফারির মর্জিমাফিক বাঁশি বাজিয়ে তাতে ইতি টানা । কিন্তু বিয়াল্লিশে ক্রিপস সাহেবের আসা-যাওয়া, কংগ্রেসের নতুন করে সরকার-বিরােধী অহিংস আন্দোলনের ডাক জিন্নার দ্বিজাতিতত্ত্বভিত্তিক সাম্প্রদায়িক শ্লোগান নিয়ে এগিয়ে চলা এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কী করছিলেন তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক? তিনি তাে তখন অসাম্প্রদায়িক প্রগ্রেসিভ কোয়ালিশন ফ্রন্টের অন্যতম প্রধান নেতা। সিরাজউদ্দৌলা নাটকের অনুকরণ করে বলতে হয়, শুধু বাংলার নয়, ভারতের রাজনৈতিক আকাশে তখন দুর্যোগের ঘনঘটা, নাকি তেমন আশঙ্কা। ‘ঘনঘটা তখনাে শুরু হয়নি। সম্ভাব্য দুর্যোগের মােকাবেলা করতে চেয়েছিলেন ফজলুল হক। তখন বাংলা পাঞ্জাব এই দুই মুসলমানপ্রধান প্রদেশের ওপর জিন্নার ছিল ভরসা। বিশেষ করে তার চেষ্টা বাংলাকে বাগে আনা। ফজলুল হক সে ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। জিন্না তাকে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কার করেছেন। কিন্তু ভাঙতে পারেননি হককে। ফরােয়ার্ড ব্লক, হিন্দু মহাসভার সাহায্যে মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন ফজলুল হক । হিন্দুদের সঙ্গে মিলে মন্ত্রিসভা? এ সুযােগ কাজে লাগাতে চেষ্টা করেন জিন্না সাম্প্রদায়িক প্রচারের কৌশলে।  রাজধানী কলকাতায় শুরু হয় লীগের পক্ষ থেকে ব্যাপক কুৎসা ও অপপ্রচার । মূল বক্তব্য ফজলুল হক হিন্দুদের সঙ্গে মিলে মুসলমান স্বার্থ নষ্ট করে চলেছেন। এ ক্ষেত্রে শহরে ছাত্রযুবা এবং গ্রামাঞ্চলে মােল্লা-মৌলবিরা মুসলিম লীগের পক্ষে প্রচারে নেমে গেলেন। এতে বেশ কাজও হলাে।

তরুণ সমাজকে বিভ্রান্ত করার সুযােগ পাওয়া গেল। সত্যি বলতে কি সাম্প্রদায়িক  রাজনৈতিক দল হিন্দুমহসভার সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়াটা কৌশলগত দিক থেকে ভুল ছিল। এ উপলক্ষে মুসলমানদের ধর্মীয় আবেগ ব্যবহার করা লীগের পক্ষে খুব সহজ হয়ে ওঠে। এ সময় ছােট একটা মহকুমা শহরে দেখা গেল কলেজের কিছুসংখ্যক মুসলমান ছাত্র জোট বেঁধে চিৎকার করছে ‘শ্যামাহক মন্ত্রিসভা ধ্বংস হােক, ধ্বংস হােক’। সেই সঙ্গে কিছু অশালীন বাক্যবন্ধ । সেখানে এমন কয়েকজন ছাত্র যুবা উপস্থিত যাদের সবাই সদাচারী বলে জানে। এরা মাত্র কয়েকজন। তবু মানুষ কৌতূহলী? কী করেছেন হক সাহেব- শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হক? এমনকি হক-বিরােধী প্রচারে আদালত প্রাঙ্গণে দু-তিনজন নিম্নশ্রেণীর কর্মচারীকেও উত্তেজিত অবস্থায় দেখা গেল- লীগের কট্টর সমর্থক তারা । ফজলুল হক এসব অভিযােগের বিরুদ্ধে যা যা বলেছেন বক্তৃতায় ও বিবৃতিতে তা রক্ষণশীল মুসলমান সমাজ শুনতে খুব একটা প্রস্তুত ছিল না । কারণ ইতিমধ্যে মুসলিম লীগের প্রচারে সাম্প্রদায়িকতার বিষপ্রভাব দেখা দিতে শুরু করেছে। তবু ফজলুল হক বাংলার পাশাপাশি সর্বভারতীয় ভিত্তিতে অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রমুখী রাজনৈতিক প্রচার শুরু করেন। সেই সঙ্গে সেকুলার মুসলিম রাজনীতি সংগঠিত করার চেষ্টা। মুসলিম লীগ পর্বে যা বলেছেন, তার বিপরীত ধারায় প্রচার । কিন্তু লীগপন্থীরা তার পূর্ব বক্তৃতার সুযোগ নিয়েছে ভালােভাবেই।

6) বঙ্গদেশে মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রভাব হ্রাস করার উদ্দেশ্যে ফজলুল হক নতুন করে সেকুলার ধারার মুসলিম রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা শুরু করেন। কিন্তু ইতিমধ্যে মুসলিম লীগের প্রভাব বাংলায় অনেকটা বেড়েছে। ঢাকার নবাব হাবিবুল্লাহ ও সৈয়দ বদরুদ্দোজাকে যথাক্রমে সভাপতি ও সেক্রেটারি মনােনীত করে যে সাংগঠনিক কমিটি গঠন করেন ফজলুল হক তা বিশেষ ফলপ্রসূ হয়নি। এবার ১৯৪২ সালের ২০ জুন হিন্দু-মুসলমান ঐক্য সম্মেলনের আয়ােজন করেন কলকাতা টাউন হলে। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন মুর্শিদাবাদের নবাব। কংগ্রেস, কৃষক প্রজাপার্টি, প্রগ্রেসিভ মুসলিম লীগ শীর্ষক রাজনৈতিক সংগঠন সম্মেলনে যােগ দেয়। সম্মেলন উদ্বোধন করেন হক সাহেব । তার ভাষণে তিনি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করার জন্য সম্প্রদায়-নির্বিশেষে সবার প্রতি আহ্বান জানান। ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের মূল শর্ত যে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য, সম্মেলনে মূল বক্তাদের ভাষণে সে কথাই ফুটে ওঠে। সভাপতিও একই সুরে কথা বলেন। বলেন মন্ত্রী শামসুদ্দীন আহমদ, মন্ত্রী হাশেম আলী খান, মেয়র হেমচন্দ্র নস্কর, হুমায়ুন কবির, সৈয়দ বদরুদ্দোজা, ড. নলিনাক্ষ সান্ন্যাল, একে এম  জাকারিয়া, মৌলানা আহমদ আলী, ডা. বিধানচন্দ্র রায়, কিরণশঙ্কর রায়, আবদুল হালিম গজনভি, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, সৈয়দ নওশের আলী প্রমুখ। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নেতা। হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ও সংহতি নিশ্চিত করতে সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করারও প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় এই সম্মেলনে (অধ্যাপক অমলেন্দু দে)। কিন্তু ফজলুল হকের এ প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে জিন্না বঙ্গীয় মুসলিম লীগকে তৎপর করে তােলেন। বাংলার গভর্নর, এমনকি গভর্নর জেনারেল লর্ড লিনলিথগাে পর্যন্ত ফজলুল হকের এ রাজনৈতিক তৎপরতা সুনজরে দেখেননি।

কারণ এ রাজনীতি তাে তাদের চিরাচরিত ভাগ কর, শাসন কর’ নীতির ঠিক বিপরীত। সেই সঙ্গে তাদের স্বার্থবিরােধীও বটে। শুধু বঙ্গদেশেই নয়, ফজলুল হকের লক্ষ্য ছিল নতুন করে সর্বভারতীয় ভিত্তিতে একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল গঠন করা । কিন্তু লীগ-কংগ্রেসের মতাে দু-দুটো বড় দলের উপস্থিতিতে এ কাজ মােটেই সহজ ছিল না। তা সত্ত্বেও হক সাহেব সংগঠন না হলেও সর্বভারতীয় ভিত্তিতে একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক মঞ্চ গঠনের কথা চিন্তা করেন। এ জাতীয় মঞ্চের রাজনৈতিক দাবিও হবে অসাম্প্রদায়িক ও দেহিতনির্ভর। ইতঃপূর্বে বলা হয়েছে সারি স্টাফোর্ড ক্রিস তার প্রস্তাব নিয়ে দিল্লিতে আসেন ২৩ মার্চ (১৯৪২)। পরিস্থিতি বিবেচনায় তার আসার আগেই তিন মুসলমান নেতা বাংলার ফজলুল হক, সিন্ধুর আল্লাবকশ ও সীমান্ত প্রদেশের ডা, খান সাহেব ১০ মার্চ (১৯৪২) ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে তারবার্তা পাঠান ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানিয়ে। এ তিন মুখ্যমন্ত্রীই ছিলেন রাজনৈতিক বিচারে জাতীয়তাবাদী এবং বলাবাহুল্য অসাম্প্রদায়িক । মজার বিষয় হল ওই ১০ই মার্চ চার্চিল আসন্ন ক্রিপস মিশন সম্বন্ধে ভাইসরয়কে জানান যে যুদ্ধ নিয়ে গুজব, প্রচার এবং মার্কিনি চাপের কারণে এই মিশন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। ভারতীয় রাজনীতিকরা যদি এটা প্রত্যাখ্যান করে তাহলে দুনিয়ার কাছে ব্রিটেনের ভারত বিষয়ক উদ্দেশ্যের আন্তরিকতা প্রমাণ হবে। অর্থাৎ চার্চিল জানতেন ক্রিপস ব্যর্থ হবেন। লিনলিথগাের পদত্যাগের হুমকিতে তাকে আশ্বস্ত করেন তিনি। পরে ক্রিসের সঙ্গে ফজলুল হক দেখা করে জাতীয় ঐক্য সম্বন্ধে তাকে  আশ্বাস দেন। যে কারণেই হােক ক্রিপস এ বৈঠকের প্রতি গুরুত্ব আরােপ করেননি। যেমন করেননি সিন্ধুর মুখ্যমন্ত্রী আল্লাবকশের সঙ্গে বৈঠকের। এ সম্পর্কে মাওলানা আজাদ তার আত্মজীবনীতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং তার ক্ষুব্ধ বক্তব্যে ব্রিটিশ-রাজনৈতিক চাতুরীর বেশ কিছু ইশারা-ইঙ্গিতের হদিস মেলে। হতে পারে এরা আঞ্চলিক নেতা হওয়ার দরুন ততটা গুরুত্ব পাননি। সম্ভবত ভাইসরয় লিনলিথগাের প্রভাবে স্যার ক্রিপস মুসলিম জাতীয়তাবাদী নেতাদের সঙ্গে আলােচনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন এবং আল্লাবকশ বিষয়ক ঘটনা অসৌজন্যমূলক পর্যায়ে এসে দাঁড়ায়।

আজাদের ভাষায়, ‘স্যার স্টাফোর্ড ভারতে আসার সময় কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক নেতাকে আমন্ত্রণ জানানাের জন্য। ভাইসরয়কে বলেছিলেন। এই নেতাদের মধ্যে মি. আল্লাবকশও ছিলেন।  ‘আল্লাবকশ ভাইসরয়ের নিমন্ত্রণপত্র পেয়ে দিল্লিতে এসে স্যার স্টাফোর্ডের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু সাক্ষাতের দিনক্ষণ স্থির হলাে  ব্যাপারটা বিশ্রী অবস্থায় দাঁড়াচ্ছে দেখে আমি স্যার স্টাফোর্ডের কাছে। বিষয়টি উল্লেখ করি। তিনি তখন বলেন, শিগগিরই তিনি আল্লাবকশের সঙ্গে দেখা করবেন। কিন্তু সাক্ষাতের কোনাে ব্যবস্থাই হলাে না। ফলে আল্লাবকশ রীতিমতাে বিরক্ত হয়ে দিলি পরিত্যাগ করবেন বলে স্থির করেন।’ এরপর মাওলানা আজাদের হস্তক্ষেপে ক্রিস-আল্লাবকশের সাক্ষাৎকার ছিল নিতান্তই মামুলি আলােচনা দায়সারা আলােচনা। এ বিষয়ে ক্ষুব্ধ মাওলানা আজাদের মন্তব্য : জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের সঙ্গে দেখা করার অনিচ্ছা থাকলে সেটা আগেই স্থির করা উচিত ছিল। আমার মতে, ক্রিস এ ব্যাপারে রাজনীতিকদের মতাে ব্যবহার করেননি। আমাদের ধারণা এ ব্যাপারে জিন্নার মতামতও হয়তােবা ক্রিপসকে প্রভাবিত করে থাকতে পারে। কারণ মুসিলম লীগের বাইরে কোনাে মুসলমান নেতার সঙ্গে শাসক-প্রতিনিধিদের সাক্ষাতের বিষয়ে জিন্নার বরাবরই প্রবল আপত্তি দেখা গেছে। এমনকি দেখা গেছে, মাওলানা আজাদের ব্যাপারেও। কারণ। জিন্নার মতে তিনিই মুসলমানদের একমাত্র মুখপাত্র। কিন্তু আজাদ তখন কংগ্রেস সভাপতি । তার সঙ্গে দেখা না করে কি পারা যায়? জিন্নার এ ধরনের অযৌক্তিক একগুঁয়েমিকে প্রশ্রয় দিয়েছেন ইংরেজ শাসকরা। বিষয়টি নিয়ে ইতিপূর্বে আলােচনা করা হয়েছে। চল্লিশের দশকের শুরুতে জিন্না যখন মুসলিম লীগের মাধ্যমে সমগ্র ভারতীয় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব দাবি করতে থাকেন এবং তা বেশ জোরেশােরে, তখন  লীগবৃত্তের বাইরে বেশ কিছুসংখ্যক মুসলমান নেতা ও সংগঠনের সক্রিয় উপস্থিতি ছিল রাজনৈতিক অঙ্গনে। কিন্তু তারা লীগের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তুলতে পারেননি। এমন কি চেষ্টাও করেন নি। সেটা যেমন দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের জন্য তেমনি সর্বভারতীয় রাজনীতির জন্যও। কংগ্রেস তাদের দলের মুসলমান রাজনৈতিক নেতাদের নিয়েই খুশি ছিল।

চেষ্টা করেনি ঐক্যবদ্ধ মুসলিম রাজনৈতিক মঞ্চ গঠনের, যে চেষ্টা অনেক পরে, বলা চলে দেরিতে শুরু করেন ফজলুল হক। এতে কংগ্রেসের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা প্রকাশ পেয়েছে। কংগ্রেসের রক্ষণশীল হিন্দু রাজনীতির প্রভাবও সম্ভবত নতুন রাজনৈতিক মঞ্চ গঠনের বিপক্ষে কাজ করে থাকবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও কথাটা সত্য যে, কংগ্রেস মুসলিম লীগ রাজনীতির শক্তি ও ব্যাপকতার সম্ভাবনা সম্বন্ধে বরাবর ভুল ধারণা পােষণ ও অপরিণামদর্শী হিসাবনিকাশ করে এসেছে। এমনকি জিন্নার কূটকৌশলী নেতৃত্বকে গুরুত্ব দিতে চায়নি। এ ব্যাপারে তারা বরাবর এক ধরনের আত্মতুষ্টিতে ভুগেছে। এর ফল যে ভারতীয় রাজনীতিতে কতটা সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে সে সম্বন্ধে তাদের কোনাে ধারণা ছিল না। এর মাসুল তারা দেয়নি, দিয়েছে সেকুলার ভারত ও সেকুলার বঙ্গের সমর্থক ও অনুরূপ বিশ্বাসের রাজনীতিকরা। সর্বোপরি সাধারণ মানুষ। | কারা ছিলেন জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মুসলমান নেতা এবং কী পরিচয় ছিল তাদের সংগঠনের? দেশি-বিদেশি ইতিহাসবিদদের লেখায় তারা প্রায় অনালােচিত থেকে গেছেন। তাদের মধ্যে দু-চারজন নেতা যেমন ফজলুল হক, সিকান্দার হায়াত খান, আল্লাবকশ প্রমুখ সম্পর্কে কিছু কথা লেখা হয়েছে এই যা। এদের বাইরে অধিকাংশই অনুল্লিখিত। অবশ্য তার কারণও আছে। ভারতীয় রাজনীতির বিশেষ কালক্ষণে সম্ভাবনা সত্ত্বেও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার অভাবে তারা সেই রাজনৈতিক ইতিহাসে বিশেষ কোনাে ভূমিকা বা প্রভাব রাখতে পারেননি। পারেননি সর্বভারতীয় ভিত্তিতে। তাছাড়া অভাব ছিল জিন্নার মতাে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতার। | অথচ চল্লিশের ওই কালক্ষণে কিছুসংখ্যক বঙ্গীয় দৈনিকে এদের সম্বন্ধে খবর প্রকাশিত হতে দেখেছি। স্বল্পসংখ্যক অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির সমর্থক মুসলমান ছাত্র-যুবার তাদের সম্বন্ধে, ওই সেকুলার মুসলিম রাজনীতি সম্বন্ধে আগ্রহ দেখা গেছে, কিন্তু তারা সংখ্যায় অল্প। জিন্না-লীগের দ্রুত বাংলা দখলের সঙ্গে প্রতিযােগিতায় তারা এঁটে উঠতে পারেননি। পারেননি তাদের অগ্রজ রাজনীতিকরা, ব্যক্তিগত মতভেদ ও বিভেদ ভুলে একাট্টা হতে না পারার কারণে। 

তবে ফজলুল হক কিছুটা হলেও চেষ্টা করেছিলেন বাংলার বাইরে জাতীয়তাবাদী মুসলমান নামে পরিচিত সেকুলার রাজনৈতিক খণ্ডগুলােকে ঐক্যবদ্ধ করতে। যেমন বিহারের মােমিন ও পাঞ্জাবের আহরার সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক সংগঠন, পাঞ্জাবের খাকসার নামক জঙ্গি সংগঠন (নেতা আল্লামা মাশরেকি, যিনি ছিলেন প্রচণ্ড রকম জিন্নাবিরােধী), আধারাজনৈতিক সংগঠন ‘জামিয়াত-উলেমাই হিন্দ’, সীমান্তের খুদাই খিদমতগার’ (যারা আবার লালকুর্তা নামে পরিচিত)- এদের সুপরিচিত নেতা আবদুল গাফফার খান, ডা. খান সাহেব, সিন্ধুর আল্লা বকশ ও জিএম সৈয়দের মতাে জাতীয়তাবাদী নেতাদের নিয়ে ঐক্য। শেষােক্তের শ্লোগান ছিল ‘জিয়ে সিন্দ’। আর সীমান্তের লালকুর্তা নেতারা তাে কংগ্রেসের নেতৃস্থানীয় সদস্য ছিলেন। আগেই বলেছি দলীয় মতাদর্শ বা অন্য যে কোনাে কারণে হােক এরা একমঞ্চে ঐক্যবদ্ধ হতে পারেননি। হতে পারলে ভারতীয় রাজনীতিতে একটি ভিন্ন ধারার অধ্যায় সংযােজিত হতে এবং ফজলুল হকের বঙ্গদেশও ভিন্ন বাংলার পথ খুঁজে পেত বলে আমার বিশ্বাস তবে এ বিষয়ে কিছু চেষ্টা নেয়া হয় ১৯৪২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ক্রিপ সাহেবের দিল্লি আসার প্রাক্কালে। জাতীয়তাবাদী, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির মুসলিম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। দিল্লিতে ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে। সিন্ধুর মুখ্যমন্ত্রী আল্লাবকশের সভাপতিত্বে এ মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে কংগ্রেসী ও অকংগ্রেসী মুসলিম লীগবিরােধী মুসলমান নেতারা অংশ নেন। এদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য কংগ্রেসের আসফ আলী, পাঞ্জাবের অসাম্প্রদায়িক নেতা মিয়া ইফতেখারউদ্দিন, বাংলার ফজলুল হক, বােম্বাই ও যুক্তপ্রদেশের দুই প্রাক্তন মন্ত্রী এবং পূর্বোক্ত জাতীয়তাবাদী চেতনার ৯টি সংগঠনের নেতাকর্মী। ছিলেন সীমান্তের ডা. খান সাহেবও। সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবের গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য ছিল সম্প্রদায়-নির্বিশেষে ভারতীয়দের ঐক্য যাতে ভারতের স্বাধীনতা দিতে ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয়। প্রস্তাবে আরাে বলা হয়, মুসলিম লীগ ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র রাজনৈতিক প্রতিনিধি (আয়েশা জালালের ভাষায় একমাত্র মুখপাত্র’- ‘সােল। সিেক্সম্যান) এই দাবি তুলে ও শাসকদের সঙ্গে সহযােগিতার মাধ্যমে মি. জিন্না ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের পথে বাধা সৃষ্টি করছেন।

বিশ্বযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে অবিলম্বে ভারতীয় জনপ্রতিনিধিদের হাতে ব্রিটিশ সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তর করা উচিত।’ ভাইসরয় লিনলিথগাে ও ভারতসচিব অ্যামেরির   কাছে এসব প্রস্তাবের টেলিবার্তা পাঠানাে হয়। পরে তিন ভারতীয় মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষ থেকে একই দাবি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের কাছে পাঠানাে হয়, যে কথা ইতিপূর্বে বলা হয়েছে । বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এ সম্মেলনকে ইংরেজ সরকার সুনজরে দেখেনি এবং তাদের গােপন প্রতিবেদনে তেমন প্রমাণ রয়েছে। সেসব তথ্য মেলে ‘ক্ষমতা হস্তান্তর’ ট্রান্সফার অব পাওয়ার বিষয়ক রচনাবলীতে। সম্ভবত এ কারণেই ক্রিপস জাতীয়তাবাদী মুসলমান নেতাদের সঙ্গে গুরুত্বের সঙ্গে আলােচনায় বসেননি এবং ভাইসরয় থেকে বাংলা ও সিন্ধুর গভর্নরদের ছিল ওইসব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীদের প্রতি বিরূপ মনােভাব। আল্লাব হত্যাকাণ্ড কি এ জাতীয় একাধিক কারণের পরিণাম?  তাই আমরা দেখি যুদ্ধাবস্থায় শাসকস্বার্থ সঠিকভাবে পালিত না হওয়ার অজুহাতে এ দুই প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শাসককুলের বিরাগভাজন হন। শাসকগােষ্ঠী তাদের কংগ্রেসী কাতারের অন্তর্ভুক্ত করে তাদের মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়ার চক্রান্তে লিপ্ত হয়। এদিকে যুদ্ধের কারণে বাংলায় জাপানি আক্রমণের ভয়ে যে অবস্থার সৃষ্টি হয় তাতে শীর্ষ শাসকদের গৃহীত সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ জনস্বার্থবিরােধী হয়ে ওঠে। আর এ দাহন করতে হয় ফজলুল হক মন্ত্রিসভাকে। পরবর্তী পর্যায়ে দেখা যাবে জোর করে হক মন্ত্রিসভার পতন ঘটানাের পর নাজিম মন্ত্রিসভা ও খাদ্যমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর শাসনামলে বাংলার বুকে দুর্নীতি, কালােবাজারি, মজুতদারি এবং মন্বন্তর ও মৃত্যুর কী ব্যাপক কালােছায়া নেমে আসে। কিন্তু তাতে মন্ত্রিসভার পতন ঘটেনি। মৃত্যুর বিশাল কাফেলা তাদের জন্য অভিশাপ হয়ে ওঠেনি। 

এ আলােচনার মূল কথা ভারত ও বাংলার রাজনীতিতে ১৯৪২ সালে ও পরবর্তী কিছু সময়ে সুস্থ রাজনীতির যে সম্ভাবনা তৈরি হয় সঠিক ঐক্য ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের অভাবে, সর্বোপরি কংগ্রেসের সহযােগিতার অভাবে তা ফলপ্রসূ হতে পারেনি। কথাটা অধ্যাপক অমলেন্দু দে তার হক বিষয়ক বইতে লিখেছেন এভাবে : যদি বাংলাদেশে কংগ্রেস ফজলুল হকের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ-বিরােধী জাতীয় মাের্চা গঠন করত এবং শাসনতন্ত্রের সীমিত ক্ষমতার মধ্যে জনসাধারণের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নয়নের জন্য বাস্তবমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করত, তাহলে হয়তাে বাংলাদেশের ইতিহাস অন্য ধরনের হতাে। আর ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মতাে গােটা ভারতের সাম্প্রদায়িক ঘূর্ণিঝড়কে পূর্বাঞ্চলে ঠেকাতে পারত। কথাগুলাে বহু ধীমানের লেখনী থেকে উৎসারিত । যেমন নীতিশ সেনগুপ্তের বিশাল গ্রন্থ ‘দ্য ল্যান্ড অব টু রিভারস’। সেই সঙ্গে আরাে একটি বিষয়  সংযােজনের মতাে যে, পূর্বোক্ত জাতীয়তাবাদী মুসলমান সম্মেলনের পথ ধরে রাজনৈতিক সংগঠন বা মাের্চা গঠিত হলে তা আরাে ভালােভাবে ওই ঘূর্ণিঝড় প্রতিহত করাই নয়, বরং অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির নয়া ধারা তৈরিতে সহায়ক হতাে। সম্ভবত নিজস্ব দলীয় স্বার্থের কারণেই কংগ্রেস ওই পথে পা বাড়ায়নি। ফলে ভারতীয় রাজনীতির অঙ্গনে যা কিছু অবাঞ্ছিত তার সবকিছুই ঘটেছে। জয় হয়েছে মানবিক মূল্যবােধহীন রাজনীতির, এমনকি দ্বিভাজিত ভূখণ্ডের সীমান্তরেখার এপারে-ওপারে।

সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক