You dont have javascript enabled! Please enable it! স্বশাসন প্রস্তাবের চোরাবালিতে স্থানীয় রাজনীতি - সংগ্রামের নোটবুক

স্বশাসন প্রস্তাবের চোরাবালিতে স্থানীয় রাজনীতি

যুদ্ধে যখন ব্রিটেন কোণঠাসা তখন ব্রিটেনের তরফ থেকে ভারতের জন্য ঘােষিত সহযােগিতা-ভিত্তিক স্বশাসনের প্রস্তাবে কতটা আন্তরিকতা ছিল মূল প্রস্তাবকের তা বিবেচ্য বিষয়। সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলী তলিয়ে দেখতে চাইলে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা চিত্র বেরিয়ে আসে, যে কথা এ পর্যন্ত আলােচনায় আভাস-ইঙ্গিতে উঠে এসেছে। এবার এ সম্পর্কে কিছু স্পষ্ট কথা বলা দরকার। তবে প্রসঙ্গত একটা মােটা দাগের কথা হলাে এ প্রস্তাব নানা দিক বিবেচনায় যেমন ভারতীয় রাজনৈতিক দল এবং বিশিষ্টজনের (যেমন সাঞ, আম্বেদকর প্রমুখ) কাছে। গ্রহণযােগ্য বিবেচিত হয়নি যার যার বিবেচনায় তেমনি হয়নি ভারতে ব্রিটিশ শাসন-প্রতিনিধি ভাইসরয় লিনলিথগাে ওর আমলাতন্ত্রের কাছে। এ বিষয়টি নিয়েই আলােচনা করা যাক। এ সম্বন্ধে ‘ট্রান্সফার অব পাওয়ার ইন ইন্ডিয়া’ গ্রন্থের লেখক ভি. পি মেনন মনে করেন, এক্ষেত্রে স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস ও ভাইসরয়ের মধ্যে বোঝাবুঝির অভাব ছিল। যেমন ছিল ক্রিপস ও ব্রিটিশ কেবিনেটের মধ্যে। আমাদের মতে এ বক্তব্যের অন্যদিকও রয়েছে। যেমন, একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রস্তাব যার মূল কথা ভারতের জন্য ভবিষ্যৎ স্বশাসন সেটি ভালােভাবে না বুঝে নিয়ে ক্রিপসের মতাে একজন সফল। রাজনীতিক-কূটনীতিক ভারতে চলে এলেন কেন? মেনন মনে করেন ক্রিপসের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস এর কারণ। ভারতীয় রাজনীতিবিদ, বিশেষ করে কংগ্রেসের সঙ্গে তার পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে সম্ভবত ক্রিপস ভেবে থাকতে পারেন যে প্রস্তাব গ্রহণ করানাের ক্ষেত্রে তিনি সফল হবেন। কিন্তু হননি। আবার ঘটনাক্রমে দেখা যায়, ভাইসরয় পূর্বাপর এ ধরনের প্রস্তাবের পক্ষে ছিলেন না। এমন কি প্রস্তাবের সাফল্য চাননি খােদ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল। প্রমাণ চার্চিলের তৎকালীন তৎপরতা এবং চার বছর পর (১৯৪৬) কমন্স। সভায় তার বক্তৃতা। ওই বক্তৃতায় তিনি স্পষ্টই বলেন যে ক্রিপস যতদূর এগিয়ে সমঝােতা সফল করে তুলতে চেয়েছিলেন তাতে তাদের সরকারের সম্মতি ছিল (মেনন)। তাহলে বলতে হয় অতি-উৎসাহী ক্রিপসকে গাড়ায় ফেলে দেয়াই  ছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের উদ্দেশ্য। সে জন্যই তাকে একটি অকেজো বা অগ্রহণযােগ্য প্রস্তাব সহকারে ভারতে পাঠানাে হয়। এ বিষয়ে ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগাে একই মঞ্চে দাঁড়ানাে। বরং তার বিরােধিতা ছিল সবার চেয়ে বেশি। ক্রিপস প্রধানমন্ত্রীর চাল ধরতে পারেননি কেন? ভারতে সাফল্য লাভের উচ্চকাক্ষার টানে? হয়তাে তাই, তবে তার চেষ্টায় ঘাটতি ছিল না।

স্বভাবতই ব্যর্থতার দায় ঘটনা বিচারে পুরােপুরি ক্রিপসের নয়। দায় চার্চিল, ভাইসরয়সহ আরাে অনেকের। আর সেই ‘অনেকের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য গান্ধি ও গান্ধি-কংগ্রেস এবং অন্যান্য দল । বাদ যান না জিন্নাও। তবে গান্ধির দায় স্থানীয় বিচারে সর্বাধিক। দৌত্যে ব্যর্থ ক্রিপস ১২ এপ্রিল (১৯৪২) লন্ডনের পথে রওনা হয়ে যাওয়ার ঠিক পরদিনই গান্ধির মন্তব্য: ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ প্রস্তাবে ব্যর্থতার কারণ ব্রিটিশ সরকার। তিনি আরাে বলেন, দুর্ভাগ্য যে প্রগতিবাদীদের মধ্যেও প্রগতিবাদী এবং ভারতের বন্ধু হিসেবে পরিচিত ক্রিপসকে কি না এমন একটি প্রস্তাব দিয়ে ভারতে পাঠানাে হয়েছিল।’ অর্থাৎ প্রস্তাব গ্রহণযােগ্য নয়। তার মতে “ক্রিপসের দিক থেকে সদিচ্ছার অভাব ছিল না। তাই যদি হবে তাহলে প্রস্তাবের আগাপাছতলা না দেখে প্রথমেই কেন তিনি এ সম্বন্ধে নেতিবাচক মন্তব্য করেছিলেন? | কেন অগ্রিম প্রত্যাখ্যান? অথচ নেহরু শুরুতে প্রস্তাবের পক্ষে, মাওলানা আজাদ অংশত । ক্রিপস প্রস্তাব ঘিরে একটি সঙ্কট তৈরির পেছনে ছিলেন অনেক কুশীলব । চার্চিলের বক্তৃতাই শুধু নয়, ভারত সচিব আমেরিও কমন্স সভায় (২৮ এপ্রিল, ১৯৪২) এমন কথা বলেন যে কংগ্রেসের জাতীয় সরকার গঠনের দাবি। এখানকার পার্লামেন্টের পক্ষে গ্রহণযােগ্য নয়। তেজবাহাদুর সাঞ্জু ও তার সহকর্মী বা কংগ্রেসের দাবি হিন্দুরাজ গঠনের দিকে যাবে যা মুসলিম বা অন্য সংখ্যালঘুরা মেনে নেবেন না।’ সেই পুরাতন ‘ভাগ কর, শাসন কর’ নীতি!  আর ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগাে- কী তার ভাবনা? তার মতে ‘এ প্রস্তাব কংগ্রেসই মানবে না।

আর এতে করে মুসলমান, ইউরােপীয় ব্লক ও আমলাতন্ত্রে বিরূপতা দেখা দেবে। কাজেই যুদ্ধপরিস্থিতি স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত কোনাে ঘঘাষণা না দেয়াই উচিত। মুসলমান, দেশীয় রাজ্য ও অন্য সংখ্যালঘুদের দেয়া। আমাদের পূর্ব প্রতিশ্রুতি যেন নষ্ট না হয়। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল। ‘ডিফেন্স’ তথা প্রতিরক্ষা নিয়ে । ভাইসরয় চাননি ওখানে ভাগাভাগি হােক। সব মিলিয়ে ক্রিপস ও ভাইসরয়ের অবস্থান দুই বিপরীত মেরুতে। তৃতীয়। মেরু থাকলে বলা যেত সেখানে গান্ধি-কংগ্রেসের অবস্থান। অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে   ভিন্ন মনােভাব নিয়ে ক্রিপস ও ভাইসরয় ভিন্ন বক্তব্য দিয়ে তারবার্তা পাঠান ব্রিটিশ সরকারকে। সরকার মেনে নেয় ভাইসরয়কে। ব্যস, সব খতম । উল্লিখিত ব্যর্থতার দায় ক্ষুব্ধ প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ব্রিটিশ মন্ত্রিসভা বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের ওপর চাপালেও হডসন মনে করেন মার্কিন দূত জনসনের আলােচনায় অনুপ্ৰেবশ, ক্রিপসের কৌশলগত দুর্বলতা (ভাইসরয়ের সঙ্গে যথােচিত মিথস্ক্রিয়ার অভাব), সর্বোপরি কংগ্রেস অর্থাৎ গান্ধির ভূমিকা আলােচনা ভেঙে যাওয়ার জন্য দায়ী । অবশ্য এতে জিন্নার কিছুটা হলেও ভূমিকা রয়েছে । ইতিহাস লেখক হয়েও হডসন যুক্তিহীনভাবে ভাইসরয়ের পক্ষে বেশ সাফাই গেয়েছেন। ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা এর কারণ হতে পারে। তার মতে এ বিষয়ে কংগ্রেস নেতৃত্ব ছিল ত্রিধাবিভক্ত। একদিকে মি, গান্ধি ও তার ঘনিষ্ঠ শিষ্যগণ যাদের লক্ষ্য ক্ষমতা, তাও আবার যুদ্ধ না করে তাদের বহু অনুসৃত অহিংস পদ্ধতিতে। দ্বিতীয় গ্রুপে মধ্যপন্থী মাওলানা আজাদ, রাজাগােপালাচারি প্রমুখ উদারনীতিকগণ যারা যুদ্ধে মিত্রশক্তিকে সহযােগিতায় ইচ্ছুক তবে তাদের ক্ষমতা ও দায়িত্ব প্রদানের শর্তে। তৃতীয় গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত সরদার প্যাটেলের মতাে সংক্ষিপ্ত কঠিনপস্থার অনুসারী নেতৃবৃন্দ যারা যুদ্ধে সহায়তার বিরােধী না হলেও তাৎক্ষণিক স্বল্পকালীন বৃহৎ ত্যাগের বিনিময়ে স্বশাসন অর্জনের পক্ষপাতী ।

আর এদের মধ্যে দোদুল্যমান পণ্ডিত নেহরু এক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে’ (হডসন, পৃ. ১০৪-১০৫)। আমার বিশ্বাস রাজাজি ও মাওলানা আজাদকে পুরােপুরি এক কাতারে ফেলা যায় না- উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গিতে যথেষ্ট অমিল রয়েছে। আর হার্ডনাট’ প্যাটেল মুখে যাই বলুন, ঘুরেফিরে ওয়ার্ধায় গান্ধি ক্যাম্পেই তার শেষগতি। একই কথা খাটে জওহরলাল নেহরু সম্পর্কেও বিচিত্র ভুবনে বিচরণ শেষে তারও শেষগতি গান্ধি-আশ্রমে। এর অর্থ, কংগ্রেসে ঘুরে ফিরে গান্ধিবাদেরই রাজত্বমতাদর্শ বিচারে সেখানে মূল কথা অহিংসপন্থায় সংগ্রাম । মাওলানা আজাদ অবশ্য আলােচনা ভেঙে যাওয়ার দায় মূলত ব্রিটিশ মন্ত্রিসভা, চার্চিল এবং অংশত ক্রিপসের ওপর চাপিয়েছেন। যদিও স্বীকার করেছেন যে সেক্ষেত্রে ক্রিপসের জন্য অন্য পথ খােলা ছিল না। কারণ প্রধানমন্ত্রীর অনুমােদনের বাইরে এক-পা বাড়ানাের ক্ষমতা তাকে দেওয়া হয়নি। তবে একথাও ঠিক যে আজাদ এ বিষয়ে গান্ধি দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে তার ভিন্নমত পােষণ করেও গান্ধিকে দৌত্যে-ব্যর্থতার জন্য সরাসরি প্রকাশ্যে দায়ী  করেননি। নিজ দল বলে কথা। তাছাড়া দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামত মেনে নেয়া গণতন্ত্রের রীতিনীতিসম্মত। তবে নেহরুর প্রতি ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা রেখেও তার। দোদুল্যমানতার সমালােচনা করেছেন আজাদ। কিন্তু গান্ধি সম্পর্কে করেননি।  ‘ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য রাজ’ গ্রন্থের লেখক, যিনি মার্কসবাদী দৃষ্টিতে ভারতীয় সংগ্রামের ইতিহাস পর্যালােচনা করেছেন তিনি প্রধানত চার্চিলের সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতাকেই ক্রিপস প্রস্তাবের বিফলতার জন্য দায়ী করেছেন। সেই সঙ্গে দায়ী করেছেন ভারতসচিব অ্যামেরি, ভাইসরয় লিনলিথগাে ও তাদের সহকর্মীদের এবং ভারতীয় পক্ষে গান্ধিকে। তার মতে, ক্রিপস দৌত্যের ব্যর্থতায় উল্লিখিত সব কজনই খুশি হয়েছিলেন। সাম্রাজ্য রক্ষা পাওয়ায় পূর্বোক্তদের খুশি হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু গান্ধির খুশি হওয়ার কারণ দুর্বোধ্য হলেও এর কিছুটা আভাস মেলে তার পরবর্তী তৎপরতায় (ভারত ছাড় আন্দোলনে)। তিনি কি ভেবেছিলেন তার আন্দোলনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জাপান ভারত আক্রমণ করবে? তারপর দুয়ে দুয়ে চার । কিন্তু দুর্বোধ্য জাপানের আচরণ আসাম প্রান্তে এসে কালক্ষেপণ । ক্রিপস প্রস্তাব সম্বন্ধে গান্ধির বিরূপতা যেমনই হােক না কেন নেহরুর ব্যক্তিগত অভিমত ছিল কিছু অদলবদলের মাধ্যমে তা গ্রহণের পক্ষে। কিন্তু দলগত অভিমত, বিশেষত গান্ধির দৃঃ অভিমতের বিরুদ্ধে নিজস্ব অভিমত প্রকাশ করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি।নানা সূত্রে তার বক্তব্যে যেমন জনসনের সঙ্গে ও ক্রিপসের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় তা বােঝা যায়। এমন কি তা আরাে স্পষ্ট হয়ে ওঠে রুজভেল্টের কাছে লেখা চিঠিতে ক্রিপস-দৌত্যের ব্যর্থতায় দুঃখ প্রকাশে । এজন্য তিনি ক্রিপসকে নয়, ব্রিটিশ সরকারকে পরােক্ষে দায়ী করেছেন। এমনকি ভারতে জাপানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুজভেল্টকে সর্বাত্মক সহযােগিতার আশ্বাসও ব্যক্ত করেন। এ ধরনের দুর্বলতা ও স্ববিরােধিতা নেহরুর রাজনৈতিক আচরণে একাধিক বার দেখা গেছে।

সবকিছু মিলিয়ে দেখলে মনে হয় ক্রিপস প্রস্তাবের মধ্যেই এর ব্যর্থতা নিহিত ছিল। কারণ প্রস্তাবটি ছিল দৃঢ়সংবদ্ধ কাঠামাের যেখানে বড়সড় অদলবদল সম্ভব নয়। অথচ যে কোনাে সমঝােতা চুক্তির সাফল্য নির্ভর করে। এর নমনীয়তা ও শর্ত অদলবদলের সুযােগের ওপর, যা এক্ষেত্রে ছিল না বা থাকলেও তা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর অনুমােদনের ওপর নির্ভরশীল ছিল। তাছাড়া সাফল্যের বড় চাবিকাঠি তাে প্রকৃতপক্ষে উভয়পক্ষের সদিচ্ছা । সে সদিচ্ছার অভাব যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ছিল তা কম বেশি অধিকাংশের মন্তব্যে প্রকাশ পেয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা প্রস্তাবটি ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার, ক্রিপসের একার নয়।   আর কংগ্রেস অর্থাৎ গান্ধি এ প্রস্তাব গ্রহণের জন্য গােড়া থেকেই প্রস্তুত ছিলেন না । কংগ্রেসের মধ্যে ভিন্নমত থাকলেও এ অপ্রিয় সত্য সবারই জানা। ছিল যে জাতীয় কংগ্রেসের শীর্ষপদে অধিষ্ঠিত না থাকলেও গান্ধির ইচ্ছাই শেষ কথা হিসেবে বরাবর কংগ্রেস সংগঠনে বিবেচিত হয়ে এসেছে। | এ বিষয়ে এমন চুটকি বঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও প্রচলিত ছিল যে অভাবিত কোনাে রাজনৈতিক সঙ্কটের মুখে গান্ধি সে দায় বহন না করে বলতে অভ্যস্ত ছিলেন যে তিনি কংগ্রেসের চারি আনার সদস্যও নন’ । কিন্তু ওই চারি আনার বাইরের মানুষটির মতামত অগ্রাহ্য করার সাহস বা ক্ষমতা কোনাে কংগ্রেস নেতার ছিল না।

যাদের ছিল তাদের ক্ষেত্রে নীরবতাই ছিল আশীর্বাদস্বরূপ- যেমন হসরত মােহানী বা মাওলানা আজাদ । আর বিদ্রোহী হওয়ার পরিণতি দল থেকে বহিষ্কার, যেমন সুভাষচন্দ্র। চিত্তরঞ্জনকেও ভিন্ন মতের জন্য মূল কংগ্রেসের নীতির বাইরে ‘স্বরাজ্য দল গঠন করতে হয় আর সুভাষ বসুকে ফরােয়ার্ড ব্লক’। তাই বলতে হয়, ভারতীয় রাজনীতি তথা কংগ্রেস রাজনীতিতে মােহনদাস করমচাঁদ গান্ধি তার বিশাল ব্যক্তিত্বসত্ত্বেও কিন্তু বিতর্কের ঊর্বে নন। ভারতীয় রাজনীতির ব্রিটিশ-বিরােধী জাতীয় সংগ্রামে গান্ধি নেতৃত্বের সফলতা-ব্যর্থতা দুইই প্রশ্নবিদ্ধ। যেমন মতাদর্শের ক্ষেত্রে তেমনি কর্মের বাস্তবতায়। ক্রিপস প্রস্তাব সম্বন্ধে গান্ধি একাধিক আচরণের পেছনে যে কয়েকটি কারণ গুরুত্বপূর্ণ তার মধ্যে রয়েছে বিশ্বযুদ্ধের গতি প্রকৃতি দেখে গান্ধির মনে এমন নিশ্চিত বিশ্বাস জন্মে যে এ যুদ্ধে ইংরেজের পরাজয় অনিবার্য, যে কথা এর আগে বলা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ভারতীয় জনতার (প্রধানত হিন্দু সম্প্রদায়ের) চরম ইংরেজ-বিরােধী মনােভাব। এমন কি তারা ইউরােপে জার্মানির ও এশিয়ায় জাপানের বিজয়ী অগ্রযাত্রায় উল্লসিত । এর কারণ ফ্যাসিস্ট সমরশক্তির বর্বরতা সম্বন্ধে সঠিক ধারণা থাকার মতাে রাজনৈতিক সচেতনতা তাদের ছিল না।  ছিল না বঙ্গের শিক্ষিত শ্রেণীর বড়সড় অংশের মধ্যেও। এমনকি ছিল না জাতীয়তাবাদী ধারার লেখক-শিল্পী-সাংবাদিকদের মধ্যে। তাই বিখ্যাত ‘ফসিল’ গল্পের লেখক, প্রগতিবাদী নামে পরিচিত কথাসাহিত্যিক সুবােধ ঘােষ লিখতে পারেন কংগ্রেসী জাতীয়তাবাদের নামে প্রতিক্রিয়াশীল উপন্যাস ‘তিলাঞ্জলি’ যা শুধু ভাষার গুণেই সাহিত্য পদবাচ্য। চরম কমিউনিস্ট বিদ্বেষে আক্রান্ত এ উপন্যাসে রয়েছে জাপানি আক্রমণের প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন। বিশেষ করে যখন গণনাট্য সংঘ ও ফ্যাসিস্টবিরােধী শিল্পী সংঘের প্রতি বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে লেখকের কলমে উর্মিলা কাঞ্জিলালের গীতনৃত্যের পরিবেশনে উচ্চারিত হয়  ‘অশথ কেটে বসত করি। জাপানি কেটে আলতা পরির মতাে পর্ভূক্তি। কী চমৎকার শৈল্পিক রসিকতা! এ ধরনের রচনা কংগ্রেস সাহিত্য সংঘের দীক্ষিত সাহিত্যিক-সাংবাদিকের কলমেও প্রকাশ পেতে দেখা গেছে। যেমন বনফুল (বলাইচাদ মুখােপাধ্যায়)।

শুধু লেখালেখিতে নয়, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেও বলা যায়, দেশের রাজনীতিমনস্ক মানুষের ইচ্ছা- ইংরেজ হারুক। যুদ্ধের শুরুতে ইউরােপে হিটলারি জয়ে তাদের আনন্দ-উল্লাস, ১৯৪২ সালে পৌছে সে আনন্দ জাপানি আগ্রাসন ঘিরে। যেন জাপান এসে ভারতকে স্বাধীনতা উপহার দেবে। সুনীতিকুমার ঘােষ একটি বাক্যে পরিস্থিতির মূল্যায়ন করেছেন এই বলে যে “জনসাধারণের মধ্যে ব্রিটিশ-বিরােধী ঘৃণা তীব্র হয়ে উঠেছিল।’ এপ্রিলের গােড়ার দিকে (১৯৪২) এশিয়া অঞ্চলের অবস্থা আরাে খারাপ। হয়ে ওঠে। কলম্বাে ও বিশাখাপত্তমে জাপানি বােমাবর্ষণ তার প্রমাণ । কলকাতায় জাপানি বােমার ভয়ে কী নাটকই না ঘটে গেল । জাপানি বােমা নিয়ে কত না ছড়া শােনা গেছে যেমন- ‘সা রে গা মা পা ধা নি বােম্ ফেলেছে জাপানি/ বােমের মধ্যে কেউটে সাপ/ ব্রিটিশ বলে বাপরে বাপ’ । মনে হয় দক্ষ হাতে লেখা। এ জাতীয় অনেক ছড়ায় যুদ্ধ সম্বন্ধে বাঙালির উদ্ভট চেতনার প্রকাশ যা রাজনৈতিক সচেতনতার পরিচায়ক নয়। তখন ব্রিটিশরাজ ভারতরক্ষা নিয়ে আতঙ্কিত। তারা তৈরি ছিল পােড়ামাটি নীতি অনুসরণ করে আসাম-বঙ্গকে জাপানের মুখে ফেলে দিয়ে বিহারে এসে প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে ভােলার জন্য। ভারতে ব্রিটিশরাজের এমন বিপর্যস্ত অবস্থা সত্ত্বেও জাপান কেন ভারতের পূর্বদ্বারে পৌছে বসে ছিল ভবিষ্যতে পরাজয়ের গ্লানি মাথায় তুলে নিতে সেটা সত্যই বিচার্য। জাপান কেন ভারত আক্রমণ করছে না’ এমন কথা তখন অনেকের মুখে শােনা গেছে। একাত্তরের (১৯৭১) স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যেমন বহুকণ্ঠে বলতে শােনা গেছে- ভারত পাকিস্তানিদের আক্রমণ করে আমাদের মুক্ত করছে না কেন? অন্যের শক্তিতে মুক্তি কি জনস্তরে আমাদের আরাধ্য বরাবরই, আত্মশক্তিতে বিশ্বাস না রেখে?  খ্যাতনামা মার্কসবাদী ইতিহাসবিদ দামােদর কোসাম্বিও বিস্ময়ের সঙ্গে মন্তব্য করেছেন যে জাপানিদের তাৎক্ষণিক সজোর আঘাতে তথাকথিত গােটা প্রতিরােধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়তাে’। অর্থাৎ ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তখন এতটাই দুর্বল ছিল। তবু দুর্বোধ্য কারণে জাপানিরা সময়মতাে আঘাতের কাজটি করেনি। করলে হয়তােবা দখল করে নিতে পারত ভারতের পূর্বাঞ্চল অনেকটা মালয়, সিঙ্গাপুর ও বর্মার মতন। আমাদের জন্য পরিণাম যেমনই হােক।  আর এদিকে বিভ্রান্তিকর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গান্ধি-কংগ্রেস অপেক্ষা করেছে জাপানি আক্রমণের জন্য। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর দুর্বলতা ইতিমধ্যে প্রকট হয়ে উঠেছে। তাই দেখে খুশি কংগ্রেসের রক্ষণশীল অংশ । এডগার সাে’র বক্তব্য থেকে জানা যায় ভারতীয় বড়বড় শিল্পপতির অনেকে জাপানকে অভ্যর্থনা জানাতে তৈরি ছিলেন। জাপানি ফ্যাসিবাদ সম্বন্ধে কী ভুল ধারণা। এসব কারণেই ভারতীয় কমিউনিস্টদের জনযুদ্ধ’ শ্লোগান হালে পানি পায়নি। জনসমর্থন মেলেনি বামপন্থীদের।

সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক