You dont have javascript enabled! Please enable it! সিকান্দার হায়াতের পাকিস্তান বনাম পাঞ্জাব-ভাবনা - সংগ্রামের নোটবুক

সিকান্দার হায়াতের পাকিস্তান বনাম পাঞ্জাব-ভাবনা

ব্রিটিশ-ভারতে বাংলা ও পাঞ্জাব এ দুই প্রদেশ রাজনীতির বিচিত্র তৎপরতায় বরাবরই তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাতে স্ববিরােধিতাও কম ছিল না। ব্রিটিশরাজের ক্ষমতা হস্তান্তর পর্বের এক দশক আগেকার অর্থাৎ ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭- এই সময়-পরিসরে বাংলা-পাঞ্জাব যেন অদ্ভুত এক স্ববিরােধিতা নিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশ নামক বিশাল ভূ-খণ্ডটিকে নিয়তি-নির্ধারিত বিভাজনের দিকে টেনে নিয়ে যায় এবং একই সঙ্গে এর বিপরীত ইতিবাচক সম্ভাবনাও ধারণ করে। নিজ নিজ জাতিগত বৈশিষ্ট্যের আবেগ ধারণ করে উল্লিখিত সময়কার দুই রাজনীতিবিদ মুখ্যমন্ত্রী আশ্চর্য এক সাদৃশ্যের পথ ধরে চলেছেন। তাদের চারিত্র্য বৈশিষ্ট্যে ও কর্মতৎপরতায়ও অবিশ্বাস্য মিল। তকালীন রাজনীতির অঙ্গনে প্রাদেশিক নেতা হয়েও দেশের রাজনৈতিক তাৎপর্য বিচারে এরা জাতীয় রাজনীতিতে নায়কের ভূমিকা পালন করেছেন এবং তা উপমহাদেশের অবশেষ পরিণতির ক্ষেত্রেও।   এদের প্রথমজন বাঙালি রাজনীতিবিদ একে ফজলুল হক। প্রথম জীবনে সম্প্রদায়-স্বাতন্ত্রবাদী রাজনীতিতে হাতেখড়ি সত্ত্বেও এক সময় কৃষকজনশ্রেণীর প্রতিনিধি হিসেবে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বাংলার রাজনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। সঠিক-বেঠিক পথে সৃষ্টি করেছেন ইতিহাস, যা কিছুটা হলেও ইতিমধ্যে আমাদের লেখায় উঠে এসেছে। এদিক থেকে তার রাজনৈতিক সমগােত্রীয় নায়ক পাঞ্জাবের সিকান্দার হায়াত খান । দুজনই জাতীয়তাবাদী চেতনার মানুষ ও মনে-প্রাণে সেকুলার। রাজনীতিবিদ। জাতিসত্তা ও ভূখণ্ড নিয়ে তাদের গর্ব ও আবেগ মনে হয় সমপরিমাণ। একজন খাটি বাঙালি, অন্যজন খাটি পাঞ্জাবি। আবার রাজনৈতিক ভুল-ভ্রান্তিতে দুজনের মধ্যেই বিস্ময়কর মিল। মিল জিন্নার কাছে নিজেদের রাজনৈতিক জীবন, স্বল্প সময়ের জন্য হলেও বিকিয়ে দেওয়ায়। সে ভুলের। মাশুল তারা দুজনেই দিয়েছেন এবং সে মাশুল আদায় করেছেন চতুর বােম্বাইগুজরাটি রাজনীতিবিদ মােহাম্মদ আলী জিন্না। অকালমৃত্যু না হলে সিকান্দার হায়াতের পরিণতিও আমার মনে হয় ফজলুল হকের মতােই হতাে- হতেন। হকের মতােই স্বখাত সলিলে নিমজ্জিত রাজনৈতিক ট্র্যাজেডির নায়ক।  

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (সূচনা সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯) পরিপ্রেক্ষিতে দুজনের পদক্ষেপে আশ্চর্য মিল- ভাইসরয়ের ‘ডিফেন্স কাউন্সিলে’ যােগদান ও জিন্নার চাপে পদত্যাগ এবং নিজস্ব সেকুলার দলটিকে সম্প্রদায়বাদী মুসলিম লীগের সঙ্গে এক করে দেয়া। তাদের বড় ভুল ছিল মুসলিম লীগে যােগদান। মুসলিম লীগ রাজনীতি তাদের জন্য সঠিক ছিল না, তাদের রাজনৈতিক মেজাজের সমান্তরাল ছিল না। কারণ এরা দুজনই নিজ নিজ প্রদেশে মুসলিম লীগের উপস্থিতি সত্ত্বেও সেকুলার রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলেছেন। বঙ্গে ফজলুল হকের হাতে কৃষক প্রজাপার্টি এবং পাঞ্জাবে সিকান্দার হায়াতের ইউনিয়নিস্ট পার্টি। শেষােক্ত পার্টিতে ছিল মুসলমান, হিন্দু ও শিখ প্রতিনিধিত্ব। অথচ পাঞ্জাব বিপুল সংখ্যায় মুসলমান-প্রধান প্রদেশ। তা সত্ত্বেও সিকান্দার হায়াত খান ও তার ইউনিয়নিস্ট পার্টির লক্ষ ছিল সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্য বজায় রাখা, যাতে তার সাধের পাঞ্জাব ধর্মীয়-সম্প্রদায়গত অজুহাতে বিভক্ত না হয়। কিন্তু ভারতীয় রাজনৈতিক নিয়তির কী পরিহাস যে, ভারত বিভাগের টানাপড়েনে শুধু বাংলা-পাঞ্জাবই বিভক্ত হলাে, তাও ভ্রাতৃঘাতী রক্তস্রোতে। অথচ ওই বিভাগ কাম্য ছিল না বঙ্গ ও পাঞ্জাবের দুই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা ও মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক ও সিকান্দার হায়াত খানের। আমার মনে হয় এ দুই নেতাই বুঝতে পেরেছিলেন কি ভুল তারা করেছেন জিন্নার ডাকে মুসলিম লীগে যােগ দিয়ে । কিন্তু ততদিনে পাশার দান পড়ে গেছে, সংশােধনের সুযােগ। অনেক দূরে সরে গেছে। সে তবু ফজলুল হক তার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। আর সিকান্দার হায়াত সে চেষ্টা কিছুটা করেছেন নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। কাজে লাগাতে চেয়েছেন তার ব্যক্তিগত ভাবমূর্তির প্রভাব। কারণ সাম্প্রদায়িক সংঘাত, কংগ্রেসের ভুলভ্রান্তি ইত্যাদি মিলে মুসলমান জনগােষ্ঠীতে বিচ্ছিন্নতার ঝোক ও পাকিস্তান ঘিরে যে। স্বপ্ন তৈরি হতে শুরু করে তাতে শঙ্কিত হয়ে ওঠেন স্যার সিকান্দার।  ভিপি মেনন তার ট্রান্সফার অব পাওয়ার ইন ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে লিখেছেন, অবস্থা। বিচারে সিকান্দার হায়াত সদলবলে মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাকে মুসলিম লীগে ধরে রাখা হয়। বলতে গেলে তিনি তখন অবস্থার শিকার। মুসলিম লীগে থেকে গিয়ে। সাম্প্রদায়িকতা ও দেশবিভাগের বিরুদ্ধে তাত্ত্বিক লড়াই ছিল অর্থহীন, এক অর্থে আত্মহনন। তবু রাজনৈতিক চিন্তায় তার অবস্থান স্পষ্ট করার উদ্দেশ্য নিয়ে সিকান্দার হায়াত খান, বিশেষ করে পাকিস্তান ও সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে পাঞ্জাব বিধানসভায় যে দীর্ঘ ভাষণ দেন (১১ মার্চ, ১৯৪১) মেননের মতে তা ‘ঐতিহাসিক তাৎপর্য বহন করে। 

তার পাকিস্তান-ভাবনার মর্মবস্তু হলাে প্রদেশগুলাের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও সীমিত শক্তির কেন্দ্র। সেখানে দেশবিভাগ নেই, প্রদেশ বিভাগ নেই, পাঞ্জাব বিভাগ তাে দূরের কথা। তার বিবেচনায় ভারতীয় মুসলমান শক্তিশালী কেন্দ্রের বিরােধী। কারণ শক্তিশালী কেন্দ্রের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন সম্প্রদায়বাদী শাসনে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মুসলমান সেটা চায় না সমগ্র ভারতে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে। শাসিত হওয়ার ভয় রয়েছে তার মনে। সে ভয় অমূলক হতে পারে। কিন্তু এর গুরুত্ব উড়িয়ে দেয়া যায় না । তাই তার পরিকল্পনামাফিক ইউনিটগুলােকে (হতে পারে তা প্রদেশ, একটি বা দুটি) পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে যেগুলাে মিলে অঞ্চল বা জোন গঠন করবে। ইউনিটের প্রতিনিধি অঞ্চলে এবং কেন্দ্রে তাদের ভূমিকা পালন করবে। ফলে কেন্দ্র ইউনিট বা প্রদেশের ওপর জবরদস্তিমূলক প্রভাব খাটাতে পারবে  কেন্দ্র হবে নমনীয় । তার হাতে থাকবে প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক, মুদ্রা, রাজস্ব ইত্যাদি, ইত্যাদি। | পাঠকের হয়তাে ভাবতে অবাক লাগবে রাজনৈতিক ইতিহাসের বিস্ময়কর পুনরাবৃত্তি লক্ষ করে। সিকান্দার হায়াতের পূর্ণাঙ্গ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের চিন্তা উচ্চারিত হয় আড়াই দশক পর আরেক জাতীয়তাবাদী বাঙালির কণ্ঠে। নাম শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু পাঞ্জাব তখন তার বিরােধিতায়। কারণ সে পাঞ্জাব তাে সিকান্দার হায়াত বা খিজির হায়াত খানের অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রী জাতীয়তাবাদের পাঞ্জাব নয়। পাঞ্জাব তখন আধিপত্যবাদী ধর্মীয় চেতনার ভিন্ন এক পাঞ্জাব। সে পাঞ্জাব ফজলুল হুঁকের বাংলা, শেখ মুজিবরের বাংলাকে তার ন্যায্য অধিকার দিতে অনিচ্ছুক এমন একটি গণতান্ত্রিক শাসন পরিকল্পনা তুলে ধরে সিকান্দার হায়াত খান বলেন, “আমরা এমন স্বাধীনতা চাই না যেখানে একদিকে মুসলমানরাজ, অন্যদিকে হিন্দুরাজ। এই যদি পাকিস্তান হয়ে থাকে তাহলে এর সঙ্গে আমার কোনাে সম্পর্ক নেই। এ কথা আমি আগেও বলেছি, এখনাে বলছি। বলছি বিধানসভায় দাঁড়িয়ে।’ ইতিপূর্বে তার বক্তব্যে পাকিস্তানের বিকল্প প্রস্তাব এসেছে। যেখানে ভারত বিভাগের পরিকল্পনা নেই। নেই সাম্প্রদায়িকতার স্লোগানদ্বিজাতিতত্ত্বের নামে যে শ্লোগান দিয়েছিলেন মােহাম্মদ আলী জিন্না ।

আবেগজড়িত কণ্ঠে সেদিন সিকান্দার হায়াত বলেছিলেন, ‘আপনারা যদি পাঞ্জাবের সত্যিকার স্বাধীনতা চান অর্থাৎ এমন পাঞ্জাব চান যেখানে অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সব সমপ্রদায়ের যুক্তিসঙ্গত অংশীদারিত্ব থাকবে তাহলে সে পাঞ্জাবি পাকিস্তান নয়, সে পাঞ্জাব একান্তভাবেই পাঞ্জাব, পঞ্চনদ বিধৌত ভূখণ্ডের পাঞ্জাব। নয়া সংবিধানমাফিক আমার প্রদেশের জন্য, আমার দেশের জন্য এমন রাজনৈতিক ভবিষ্যতই আমি দেখতে চাই । চাই মুসলমান, হিন্দু, শিখ, খ্রিস্টান সবার জন্য (ভিপি মেনন)। আমরা আগেই বলেছি তার চোখে পাকিস্তান মানে ‘ম্যাসাকার’ । এ বক্তব্যের (১৯৩৮) সূত্রে হডসনের মন্তব্য : নয় বছর পর পাকিস্তানের অর্থ ‘ম্যাসাকার’ই হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু তা দেখার জন্য স্যার সিকান্দার বেঁচে ছিলেন না। হডসনের। মতে, কৌশলগত কারণের চাপে সিকান্দার হায়াত খানকে লাহাের প্রস্তাব সমর্থন করতে হয়েছিল। সে প্রস্তাব মুসলিম লীগের লাহাের অধিবেশনে (১৯৪০) উপস্থাপন করেন ফজলুল হক। পূর্বোক্ত বক্তৃতায় সিকন্দার হায়াত খান হিন্দু-মুসলমান-শিখসহ সব ভারতবাসীর সহাবস্থানের ওপর গুরুত্ব আরােপ করে বলেন, যে সাতটি প্রদেশে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানকার মুসলমানদের উচিত তাদের প্রতি সহযােগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া। চারটি প্রদেশে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ । সেসব প্রদেশে হিন্দু ও শিখদের পক্ষে উচিত হবে অপর পক্ষের সঙ্গে সহযােগিতা করা। আমাদের একসঙ্গে থাকতে হবে। বাস্তবতা মেনে চলতে হবে। তিনি ‘ খাসারাজ, হিন্দুরাজ ও মুসলমানরাজ শ্লোগান তুলে জনগণের মন বিষাক্ত না করার আহ্বান জানান। একই সঙ্গে তিনি বলেন, আসুন প্রদেশে শান্তি-সংহতি রক্ষা করে ভারতের বাকি অংশের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সাহসের সঙ্গে বাইরের বিপদের মােকাবেলা করি। স্যার সিকান্দারের এই সেকুলার। আহ্বান হালে পানি পায়নি মূলত জিন্নার ভিন্নমতের কারণে।

বিশেষ করে স্যার সিকান্দারের অকালমৃত্যুর কারণে আবহাওয়ার বদল ঘটে। যেমন ঘটেছিল বাংলায় চিত্তরঞ্জনের অকালমৃত্যুতে বাতিল হয়ে যায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যকার সম্প্রীতির সেতু ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’।  সিকান্দার হায়াতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আহ্বান এবং বিধানসভায় তার দীর্ঘ রাজনৈতিক বক্তব্য মনে হয় পরিকল্পিতভাবে জিন্নার সঙ্গে মতবিরােধের কারণে প্রকাশ পেয়েছিল । কিছু নেপথ্য ঘটনায় তেমন আভাস মেলে । জিন্না এ সময়ে পাকিস্তান’ ইস্যুটিকে যেভাবে সাম্প্রদায়িক ইস্যু হিসেবে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন তা লীগেরও দুচারজন উদার। রাজনীতিকের পছন্দসই ছিল না। হয়তাে এ কারণেই ভারতে ভিন্নমতের। মুসলিম রাজনীতির প্রকাশ দেখা দিতে শুরু করে। কিন্তু তারা ঠেকাতে পারেননি। মুসলিম লীগের সম্প্রসারণ।  মুসলিম লীগের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার কারণ ছিল একাধিক। যতটা ইতিবাচক পথে তার চেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাবে। এর মধ্যে কংগ্রেসের বিভ্রান্তিকর বিরূপ প্রচার শিক্ষিত মুসলমান সমাজে মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা বাড়াতে সাহায্য করে । লাহাের প্রস্তাবকে ‘অর্থহীন’ বলে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টায় শুধু নেহরু একাই তৎপর ছিলেন না, ছিলেন শীর্ষ নেতাদের অনেকে। এর প্রতিক্রিয়া লীগের পক্ষে গেছে, কংগ্রেসের পক্ষে নয়। তাছাড়া মুসলিম মানসে লীগের প্রভাব অস্বীকার করা কংগ্রেসের পক্ষে বাস্তব চিন্তার পরিচায়ক ছিল না। অখণ্ড ভারতের স্বার্থে তাদের উচিত ছিল লীগের সঙ্গে যতটা সম্ভব সমঝােতার পথ ধরে এগােনাে। কুশলী রাজনীতির কৌশলগত প্রকাশ ঘটানাে। কিন্তু তাতে ব্যর্থ হন অহমিকার কারণে। বড় অদ্ভুত যে লাহাের প্রস্তাবকে পাকিস্তান প্রস্তাব’ নামে পরিচিত করে তােলার পুরাে দায় যে হিন্দু প্রেস তথা প্রচার মাধ্যমের’, তির্যক হাসিতে সেকথা শুধু জিন্না-ই বলেননি, পূর্বোক্ত বক্তৃতায় কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গে কথাটা বলেছেন পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী সিকান্দার হায়াত খানও। তাদের ভাষায় পাকিস্তান’ শব্দটির সঙ্গে মুসলমানদের আত্মিক সম্পর্ক তৈরি করেছে কংগ্রেস ও হিন্দু প্রেসের প্রচার’। তবে বিশেষভাবে হিন্দু মহাসভার বিরােধিতা মুসলিম লীগের প্রতি শিক্ষিত মুসলমানশ্রেণীর সমর্থন জোরদার করেছে। জিন্না ঠিকই বলেছেন, তিনি পাকিস্তান প্রস্তাব পেয়েছেন হিন্দুদের কাছ থেকে। অদূরদর্শিতা আর কাকে বলে! অবশ্য লীগের প্রাপ্তি সবই নেতিবাচক পথে নয়। জিন্নার দ্বিজাতিতত্ত্ব, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার প্রচার মুসলিম লীগের শক্তি সংহত হতে সাহায্য করে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অবদান রাখে বাংলা, পাঞ্জাব ও যুক্তপ্রদেশ।

বিশেষভাবে বাংলা ও পাঞ্জাবের দুই মুখ্যমন্ত্রী যথাক্রমে আবুল কাশেম ফজলুল হক ও স্যার সিকান্দার হায়াত খানের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিও তৎপরতা। এ কাজ জিন্না ও তার মুসলিম লীগের শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে যে কথা আগে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে নেপথ্য শক্তি ছিল মােহাম্মদ আলী জিন্নার রাজনৈতিক চাতুর্য ও ক্রমশ গড়ে ওঠা ব্যক্তিত্বের প্রভাব  তবে চল্লিশের দশকের প্রায় মধ্যপর্যায় থেকে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সম্পাদক আবুল হাশিম ও তার সহকর্মীদের সাংগঠনিক শক্তি বঙ্গদেশে মুসলিম লীগকে একটি রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হতে সাহায্য করে তাদের শ্রমে ও বিচক্ষণতায়। আমরা জানি সমাজে ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক শক্তির প্রবল প্রভাবের কথা। আর এ দুই শক্তি ঐক্যবদ্ধ হলে তার সঙ্গে পেরে ওঠা কঠিন। সংখ্যালঘু জনগােষ্ঠীর জন্য তা হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। প্রথম উপকরণটি যদি সর্বভারতীয় মুসলমান সমাজকে আত্মপরিচয়ে ও আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ করে থাকে তাহলে বলতে হয় দ্বিতীয় কারণটি লড়াইয়ের বাস্তব ভিত তৈরি করেছিল। প্রথম কারণটি সমগ্র ভারতের মুসলমান সমাজকে বিভ্রান্ত করতে সাহায্য করে। কিন্তু বঙ্গদেশে? বাংলার পশ্চাদপদ মুসলমান সমাজে দুটো উপকরণই যুক্ত হয়ে স্বতন্ত্র ভুবন পাকিস্তানের পক্ষে জোয়ার সৃষ্টি করে। একা ফজলুল হক বা তার প্রজাপার্টির গণতন্ত্রী বা বামপন্থী নেতাদের সাধ্য কি সে জোয়ার ঠেকায়?  তারা পারেননি। পারেননি জোয়ার-পূর্ববর্তী ভিন্ন ঢেউ ওঠা লগ্নেও। পারেননি পাঞ্জাবি সেকুলার নেতা সিকান্দার হায়াত খান। পারেননি সিন্ধুর   আল্লাবকশ। তবে দেরিতে হলেও তাদের চেষ্টার অভাব ছিল না। ১৯৪১ সালের মার্চে পাঞ্জাবের বিধানসভায় পূর্বোক্ত ঐতিহাসিক বক্তৃতা ও পরিকল্পনা উপস্থাপনের পরও থেমে ছিলেন না সিকান্দার হায়াত খান। এ বিষয়ে ইতিহাসবিদ অমলেন্দু দে লিখেছেন : ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের মে মাসেই জিন্নার সঙ্গে বাংলা ও পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক ও স্যার সিকান্দার হায়াত খানের মতান্তর প্রকাশিত হয়। তারা জিন্নাকে যেভাবে চ্যালেঞ্জ করেন তাতে অনেকেই বিস্মিত হন। এ বিষয়ে স্যার তেজবাহাদুর সাঞ্জু ও শিব রাওএর মধ্যে পত্রালাপ হয়। বাংলা ও পাঞ্জাবের রাজনীতিতে এর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে তাই ছিল আলােচ্য বিষয়।’

বাস্তবিকই ওই ঘটনা বাংলা ও পাঞ্জাবের রাজনীতিতে ঢেউ তুলেছিল।  ‘স্যার সিকানদার শিব রাওকে বলেন, কংগ্রেস ও জিন্না-বিরােধী মুসলিম নেতৃবৃন্দের সামনে এক সুবর্ণ সুযোেগ উপস্থিত । এই দুই অংশ এখন সহজেই। মিলিত হতে পারে, এমনকি ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গেও মীমাংসায় পৌছতে পারে। না, ওই দুই অংশ মিলতে পারেনি। পারেনি গান্ধি প্রমুখের প্রভাবে অনুসৃত কংগ্রেসের অদূরদর্শী নীতির কারণে। আর ব্রিটিশ সরকার যে এদের পক্ষে নয়, বরং জিন্নাকে যে তারা শিখণ্ডি দাঁড় করিয়ে কংগ্রেস ও জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে এ সত্যটা স্যার সিকান্দার কেন বুঝতে পারেননি সেটাই বিস্ময়কর। ৩ | তবে এটাও ঠিক যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাদের পক্ষে ছিল না। কংগ্রেস উল্টোপথে হেঁটেছে আর ঘটনাও তাদের পক্ষে দাঁড়ায়নি। প্রমাণ আল্লাবকশ হত্যাকাণ্ড, সিকান্দার হায়াতের অকালমৃত্যু, বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব, সুভাষচন্দ্রের ফ্যাসিস্ট শক্তির সঙ্গে যুক্ত হয়ে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের চেষ্টার মতাে ঘটনাবলী । জিন্না ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন যে যুদ্ধ মানুষের জন্য অভিশাপ হলেও তার রাজনীতির জন্য আশীর্বাদ বয়ে এনেছে।’ কংগ্রেসকে সামাল দিতে ভাইসরয় লিনলিথগােকে জিন্নার দিকে প্রসন্নমুখ ফেরাতে হয়েছে। জিন্না সে সুযােগ ভালােভাবেই কাজে লাগিয়েছিলেন।  এ জন্যই আমাদের মন্তব্য: ঘরে-বাইরে পরিস্থিতি সেকুলার জাতীয়তাবাদীদের পক্ষে ছিল না। হক-সিকান্দার তাই জিন্নার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারেননি। সিকান্দার যত পরিকল্পনাই করুন ঘটনা ধীরে-সুস্থে হলেও দেশবিভাগের দিকে এগিয়ে গেছে। সে বিভাজন স্পর্শ করেছে বাংলা ও পাঞ্জাবকে। 

 

সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক